বিদায় হজের ভাষণ

শুক্রবার, ৯ জিলহজ, ১০ হিজরি সনে আরাফার দিন দুপুরের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লক্ষাধিক সাহাবির সমাবেশে হজের সময় এই বিখ্যাত ভাষণ দেন।
হাম্দ ও সানার পর স্বীয় ভাষণে এরশাদ করেন : আল্লাহ্ ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই। তার সমকক্ষ কেউ নেই।
আল্লাহ্ তার ওয়াদা পূর্ণ করেছেন। তিনি তার বান্দাকে সাহায্য করেছেন। আর তিনি একাই বাতিল শক্তিগুলো পরাভূত করেছেন।
হে আল্লাহ্র বান্দারা! আমি তোমাদের আল্লাহ্র ‘এবাদত ও তার বন্দেগির ওসিয়ত করছি এবং এর নির্দেশ দিচ্ছি।
হে লোক সকল! তোমরা আমার কথা শোন। এরপর এ স্থানে তোমাদের সাথে আর একত্র হতে পারব কি না জানি না।
হে লোক সকল! আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ করেছেন, হে মানব জাতি! তোমাদেরকে আমি একজন পুরুষ ও একজন নারী থেকে পয়দা করেছি এবং তোমাদেরকে সমাজ ও গোত্র ভাগ করে দিয়েছি যেন তোমরা পরস্পরের পরিচয় জানতে পারো।

তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহ্র দরবারে অধিকতর সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী, যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া অবলম্বন করে, সব বিষয়ে আল্লাহ্র কথা অধিক খেয়াল রাখে। ইসলামে জাতি, শ্রেণীভেদ ও বর্ণবৈষম্য নেই। আরবের ওপর কোনো আজমের, আজমের ওপর কোনো আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তেমনি সাদার ওপর কালোর বা কালোর ওপর সাদার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। মার্যাদার ভিত্তি হলো কেবল তাকওয়া।
আল্লাহর ঘরের হিফাজত, সংরক্ষণ ও হাজিদের পানি পান করানোর ব্যবস্থা আগের মতো এখনো বহাল থাকবে।
হে কুরাইশ সম্প্রদায়ের লোকগণ! তোমরা দুনিয়ার বোঝা নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে যেন আল্লাহ্র সামনে হাজির না হও। আমি আল্লাহ্র বিরুদ্ধে তোমাদের কোনোই উপকার করতে পারব না।
শুনে রাখো, সব জাহেলি বিষয় ও প্রথা আজ আমার পায়ের নিচে। জাহেলি যুগের রক্তের দাবিও রহিত করা হলো। সর্বপ্রথম আমি আমার কবিলার রক্তের দাবি অর্থাৎ রবি’আ ইবনুল হারিসের পুত্রের রক্তের দাবি রহিত ঘোষণা করছি। বনু সাদ গোত্রে থাকাকালে হুজাইলিরা তাকে হত্যা করেছিল।
জাহেলি যুগের সুদও রহিত করা হলো। সর্বপ্রথম আমি আমার কবিলার সুদের দাবি অর্থাৎ চাচা আব্বাসের সুদ মাফ করে দিলাম। সুতরাং সব সুদই আজ রহিত করা হলো।
হে লোকসকল! তোমাদের রক্ত, তোমাদের ‘ইজ্জত, তোমাদের সম্পদ পরস্পরের জন্য চিরস্থায়ীভাবে হারাম করা হলো, যেমন আজকের এই দিন, আজকের এই মাস, তোমাদের এই শহর সবার জন্য হারাম (পবিত্র ও নিরাপদ)।
তোমরা শিগগিরই আল্লাহ্র দরবারে হাজির হবে। তিনি তোমাদের সবাইকেই তোমাদের ‘আমল’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।
শুনে রাখো, অপরাধীর দায়িত্ব কেবল তার ঘাড়েই বর্তায়। পিতা তার পুত্রের জন্য আর পুত্র তার পিতার অপরাধের জন্য দায়ী নয়।
হে লোক সকল! নারীদের সম্পর্কে আমি তোমাদের সতর্ক করে দিচ্ছি। এদের প্রতি নির্মম ব্যবহার করার সময় আল্লাহ্র দণ্ড সম্পর্কে নির্ভয় হয়ো না। নিশ্চয়ই তাদের তোমরা আল্লাহ্র জামিনে গ্রহণ করেছ এবং তাঁরই বাক্যের মাধ্যমে তাদের সাথে তোমাদের দাম্পত্য সম্পর্ক হয়েছে। জেনে রাখো, তাদের ওপর যেমন তোমাদের অধিকার রয়েছে, তেমনি তোমাদের ওপর তাদেরও অধিকার রয়েছে। সুতরাং তাদের কল্যাণ সাধনের বিষয়ে তোমরা আমার নসিহত গ্রহণ করো।
তোমরা তোমাদের অধীনস্থদের সম্পর্কে সতর্ক হও। নিজেরা যা খাবে, তাদেরও তা খাওয়াবে, নিজেরা যা পরবে, তাদেরও তা পরাবে।
হে লোক সকল! শুনে রাখো, মুসলিমরা পরস্পর ভাই। সাবধান! আমার পরে তোমরা একজন আরেকজনকে হত্যা করার মতো কুফরি কাজে লিপ্ত হয়ো না।
হে লোকসকল! আল্লাহ্ প্রত্যেককেই তার যথাযথ অধিকার দিয়েছেন। সুতরাং উত্তরাধিকারীর জন্য কোনোরূপ ওসিয়ত কার্যকর হবে না।
সন্তান হলো বিবাহিত দম্পতির। ব্যভিচারীর সন্তানের অধিকার নেই। আর সবার হিসাব-নিকাশ আল্লাহ্র ওপরই ন্যস্ত।
যে ব্যক্তি নিজের পিতার স্থলে অপরকে পিতা বলে পরিচয় দেয়, নিজের মওলা বা অভিভাবককে ছেড়ে দিয়ে অন্য কাউকে মওলা বা অভিভাবক বলে পরিচয় দেয়, তার ওপর আল্লাহ্র লানত।
ঋণ অবশ্যই ফেরত দিতে হবে। প্রত্যেক আমানত তার হকদারের কাছে অবশ্যই আদায় করে দিতে হবে।
কারো সম্পত্তি সে যদি স্বেচ্ছায় না দেয়, তবে তা অপর কারো জন্য হালাল নয়। সুতরাং তোমরা একজন অপরজনের ওপর জুলুম করবে না। এমনিভাবে কোনো স্ত্রীর জন্য তার স্বামীর সম্পত্তির কোনো কিছু তার সম্মতি ব্যতিরেকে কাউকে দেয়া হালাল নয়।
যদি কোনো নাক-কান কাটা হাবশি দাসকেও তোমাদের আমির বানিয়ে দেয়া হয় তবে সে যত দিন আল্লাহ্র কিতাব অনুসারে তোমাদেরকে পরিচালিত করবে, তত দিন অবশ্যই তার কথা মানবে, তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করবে।
শোন, তোমরা তোমাদের প্রভুর ‘এবাদত করবে। পাঁচ ওয়াক্ত সালাত যথারীতি আদয় করবে, রমজানের রোজা পালন করবে, স্বেচ্ছায় ও খুশি মনে তোমাদের সম্পদের জাকাত দেবে, তোমাদের রবের ঘর বায়তুল্লাহ্র হজ করবে আর আমিরের ইতায়াত করবে; তা হলে তোমরা জান্নাতে দাখিল হতে পারবে।
হে লোকসকল! আমার পর আর কোনো নবী নেই, আর তোমাদের পর আর কোনো উম্মতও নেই।
আমি তোমাদের কাছে দুটো জিনিস রেখে যাচ্ছি। যত দিন তোমরা এ দুটোকে আঁকড়ে থাকবে, তত দিন তোমরা গোমরাহ্ হবে না। সে দুটো হলো আল্লাহ্র কিতাব আর রাসূলের সুন্নাত।
তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি থেকে বিরত থাকবে। কেননা তোমাদের পূর্ববর্তীরা দীনের ব্যাপারে এই বাড়াবাড়ির দরুন ধ্বংস হয়েছে।
এই ভূমিতে আবার শয়তানের পূজা হবেÑ এ বিষয়ে শয়তান নিরাশ হয়ে গেছে। কিন্তু ুদ্র ুদ্র বিষয়ে তোমরা তার অনুসরণে লিপ্ত হয়ে পড়বে। এতে সে সন্তুষ্ট হবে। সুতরাং তোমাদের দীনের বিষয়ে তোমরা শয়তান থেকে সাবধান থেকো।
শোনো, তোমরা যারা উপস্থিত আছ, যারা উপস্থিত নেই তাদের কাছে এই পয়গাম পৌঁছে দিয়ো। অনেক সময় দেখা যায়, যার কাছে পৌঁছানো হয় সে পৌঁছানেওয়ালার তুলনায় অধিক সংরক্ষণকারী হয়।
তোমাদেরকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। তখন তোমরা কী বলবে?
সমবেত সবাই সমস্বরে উত্তর দিলেন : আমরা সাক্ষ্য দেবো, আপনি নিশ্চয় আপনার ওপর অর্পিত আমানত আদায় করেছেন, রিসালতের দায়িত্ব যথাযথ আনজাম দিয়েছেন এবং সবাইকে নসিহত করেছেন।
[রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আকাশের দিকে পবিত্র শাহাদত অঙ্গুলি তুলে আবার নিচে মানুষের দিকে নামালেন।]
হে আল্লাহ্! তুমি সাক্ষী থাকো। হে আল্লাহ্! তুমি সাক্ষী থাকো।