সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ)
নবী মুহাম্মদ (সা) এর সিরাতের পয়গাম সম্পর্কে কিছু বলতে এই প্রবন্ধ। এ সম্পর্কে যুক্তির কষ্টিপাথরে কথা বলতে গেলে প্রথমেই প্রশ্ন জাগে যে, একজন মাত্র নবীর সিরাতের পয়গাম কেন ? অন্য কারো পয়গাম কেন নয়? নবীগণের মধ্যে শুধুমাত্র সাইয়েদুনা মুহাম্মদ (সা) এর সিরাতের ওপর প্রথমেই আলোচনা করা এ জন্য প্রয়োজন যে, আমরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে, প্রাচীন ও আধুনিক যুগের কোনো পথপ্রদর্শকের জীবন চরিত নয়, বরঞ্চ শুধুমাত্র একজন নবীর জীবন চরিতই আমরা হেদায়াত বা পথের সন্ধান পেতে পারি। অন্য কোনো নবী অথবা ধর্মীয় নেতার জীবনে নয়, বরঞ্চ নবী মুহাম্মদ (সা) এর জীবন চরিতেই আমরা সে সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ হেদায়াত লাভ করতে পারি, যার প্রকৃতপক্ষে আমরা মুখাপেক্ষী।
আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হেদায়াতের প্রয়োজন
এ সত্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আল্লাহ তাআলাই জ্ঞানের একমাত্র উৎস। তিনিই এ বিশ্বপ্রকৃতি ও মানুষ পয়দা করেছেন। বিশ্বপ্রকৃতির নিগূঢ় তত্ত্ব এবং স্বয়ং মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি ও তার তত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞান তিনি ছাড়া আর কার থাকতে পারে ? স্রষ্টাই তো তাঁর সৃষ্টিকে জানতে পারেন, সৃষ্টি ততোটুকুই জানতে পারে যতোটুকু তার স্রষ্টা তাকে জানাবেন। সৃষ্টির নিজস্ব কোনো মাধ্যম নেই, যার দ্বারা সে প্রকৃত তত্ত্ব জানতে পারে।
এ ব্যাপারে দু’টি বিষয়ে পার্থক্য ভালোভাবে উপলব্ধি করা উচিত যাতে করে আলোচনায় কোনো বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে না পারে। একটি হচ্ছে, এমন কিছু তথ্য যা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আপনারা লাভ করতে পারেন এবং তার থেকে চিন্তা-গবেষণা, যুক্তি ও পরীক্ষা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কার করতে পারেন। এসব ব্যাপারে ঊর্ধ্বজগৎ থেকে কোনো জ্ঞান লাভের প্রয়োজন করে না। এ আপনাদের নিজস্ব অনুসন্ধান, চিন্তা-গবেষণা, পরীক্ষা পর্যবেক্ষণ ও আবিষ্কারের কাজ, এ দায়িত্ব আপনাদের। আপনারা আপনাদের চারপাশে যা কিছু পান তা অনুসন্ধান করে বের করুন। তাদের মধ্যে ক্রিয়াশীল শক্তিগুলো সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করুন। তাদের মধ্যে যে প্রাকৃতিক বিধিবিধান কার্যকর রয়েছে তা উপলব্ধি করুন। তারপর উন্নতির পথে অগ্রসর হোন। কিন্তু এ ব্যাপারে আপনাদের স্রষ্টা আপনাদেরকে একাকী ছেড়ে দেননি। তিনি ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে অননুভূত উপায়ে পর্যায়ক্রমে তাঁর সৃষ্ট জগতের সাথে আপনাদের পরিচয় করাতে থাকেন। নতুন নতুন তথ্যের দ্বার উন্মুক্ত করতে থাকেন। মাঝে মাঝে ইলহামের পদ্ধতিতে কোনো কোনো মানুষকে এমন ইঙ্গিত দান করতে থাকেন যে, সে নতুন কিছু আবিষ্কার করতে অথবা নতুন কোনো নীতি-পদ্ধতি জানতে পারে। তথাপি এসব কিছু মানুষের জ্ঞানেরই আওতাভুক্ত, যার জন্য কোনো নবী অথবা কোনো আসমানি কেতাবের প্রয়োজন হয় না। এ ব্যাপারে বাঞ্ছিত তথ্য লাভ করার উপায়-উপাদানও মানুষকে দেয়া হয়েছে।
দ্বিতীয় প্রকারের বস্তু এমন, যা আমাদের ইন্দ্রয়ানুভূতির ঊর্ধ্বে। তা আমাদের একেবারে নাগালের বাইরে। তা আমরা না পরিমাপ করতে পারি, আর না আমাদের নিজস্ব জ্ঞানের মাধ্যমে তা আমরা জানতে পারি। দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক সে সম্পর্কে কোনো অভিমত পেশ করলে তা নিছক আন্দাজ-অনুমানের ভিত্তিতে করে থাকেন। তাকে ‘জ্ঞান’ বলা যেতে পারে না। এ হচ্ছে তাদের চূড়ান্ত তথ্য, যে ব্যাপারে বিতর্কমূলক মতবাদকে স্বয়ং তাঁরাও সীমারেখা নিশ্চিত বলে ঘোষণা করতে পারেন না যাঁরা সে মতবাদ পেশ করেছেন। যদি তাঁদের জ্ঞানের সীমারেখা জানা থাকে তাহলে না, তাঁরা স্বয়ং তার উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেন আর না অন্য কাউকে বিশ্বাস করার আহ্বান জানাতে পারেন।
নবীগণের আনুগত্যের প্রয়োজন
এখন উপরে বর্ণিত দ্বিতীয় বিষয়ে কোনো জ্ঞান লাভ হলে, তা একমাত্র আল্লাহ তাআলার নির্দেশেই হতে পারে। কারণ সকল তত্ত্ব ও তথ্য তাঁর জানা আছে। আল্লাহ তাআলা মানুষকে যে বস্তুর মাধ্যমে এ জ্ঞানদান করেন তা হচ্ছে অহি যা শুধুমাত্র নবীগণের ওপর নাজিল হয়। আল্লাহ তাআলা আজ পর্যন্ত এ কাজ কখনো করেননি যে, একটি কিতাব মুদ্রিত করে প্রত্যেক মানুষের হাতে দিয়েছেন এবং তাদেরকে এ কথা বলে দিয়েছেন, ‘তোমার এবং বিশ্বপ্রকৃতির নিগূঢ় তত্ত্ব কি তা এ কিতাবখানা পড়ে জেনে নাও।’
বরঞ্চ এ তত্ত্ব অনুযায়ী দুনিয়ায় তোমার কর্মপদ্ধতি কি হওয়া উচিত তা-ও জেনে নাও এবং এ জ্ঞান মানুষ পর্যন্ত পৌঁছবার জন্য তিনি সর্বদা নবীগণকেই মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন যাতে করে তাঁরা এ জ্ঞান শিক্ষা দিয়েই ক্ষান্ত হন না বরঞ্চ তাদেরকে তা বুঝিয়ে দেবেন, সে অনুযায়ী নিজে কাজ করে দেখাবেন, তার বিরুদ্ধবাদীদেরকে সৎপথে আনার চেষ্টা করবেন এবং এ জ্ঞান যারা গ্রহণ করবে তাদেরকে এমন একটা সমাজের আকারে সুসংবদ্ধ করবেন যাদের জীবনের প্রতিটি স্তরে সে জ্ঞানেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটবে।
এ সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় এ কথা সুস্পষ্ট হয় যে, পথনির্দেশনার জন্যে আমরা শুধুমাত্র একজন নবীর সিরাতেরই মুখাপেক্ষী। কোনো অনবী যদি নবীর অনুসারী না হয়, তাহলে যতো বড়ো মহাপণ্ডিত ও জ্ঞানী-গুণী হোক না কেন, সে আমাদের পথপ্রদর্শক হতে পারে না। কারণ তাঁর কাছে সত্যজ্ঞান নেই এবং যে সত্যজ্ঞানের অধিকারী নয়। সে আমাদেরকে কোনা সত্য এবং সঠিক জীবনব্যবস্থা দিতে পারে না।
মুহাম্মদ (সা) ছাড়া অন্যান্য নবীগণের পক্ষ থেকে হেদায়াত না পাওয়ার কারণ
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, যাঁদেরকে আমরা নবী বলে জানি এবং যেসব ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে ধারণা করা যেতে পারে যে, তাঁরা সম্ভবত নবী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে শুধুমাত্র নবী মুহাম্মদ (সা) এর সিরাত থেকে আমরা কেন পয়গাম লাভের চেষ্টা করি? এ কি কোনো গোঁড়ামির কারণে, না এর কোনো যুক্তসঙ্গত কারণ আছে ?
আমি বলতে চাই যে, এর অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত কারণ রয়েছে। যেসব নবী উল্লেখ কুরআনে আছে, তাঁদেরকে যদিও আমরা নিশ্চিতরূপে নবী বলে জানি এবং মানি, কিন্তু তাদের মধ্যে কারো শিক্ষা ও জীবনচরিত কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে আমাদের কাছে পৌঁছেনি, যাতে করে তাঁর অনুসরণ আমরা করতে পারি। হযরত নূহ (আ), হযরত ইবরাহিম (আ), হযরত ইসহাক (আ), হযরত ইউসুফ (আ), হযরত মূসা (আ) এবং হযরত ঈসা (আ) নিঃসন্দেহে নবী ছিলেন। তাঁদের সকলের ওপর আমরা ঈমান রাখি। কিন্তু তাঁদের ওপর নাজিল হওয়া কোনো কিতাব সংরক্ষিত আকারে আজ বিদ্যমান নেই যে, তার থেকে আমরা হেদায়াত গ্রহণ করতে পারি। তাঁদের মধ্যে কারো জীবনচরিত এমন সংরক্ষিত ও নির্ভরযোগ্য উপায়ে আমাদের কাছে পৌঁছেনি যে, আমরা আমাদের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনের বিভিন্ন স্তরে তাঁদেরকে আমাদের পথপ্রদর্শক হিসেবে গ্রহণ করব। এসব নবীগণের শিক্ষা ও জীবনচরিত সম্পর্কে কেউ কিছু লিখতে চাইলে কয়েক পৃষ্ঠার অধিক লিখতে পারবে না এবং তা-ও কুরআনের সাহায্যে। কারণ কুরআন ছাড়া তাঁদের সম্পর্কে আর কোনো প্রামাণ্য উপকরণ বা মালমসলা বিদ্যমান নেই।
ইহুদি দ্বীনের গ্রন্থাবলি ও নবীগণের অবস্থা
হযরত মূসা (আ) এবং তাঁর পর আগমনকারী নবীগণ ও তাঁদের শিক্ষা-দীক্ষা সম্পর্কে এ কথা বলা হয়ে থাকে যে, সেসব বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে আছে। কিন্তু ইতিহাসের দিক দিয়ে বাইবেলের পর্যালোচনা করে দেখুন। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বায়তুল মাকদিসের ধ্বংসের সময় তা বিনষ্ট হয়ে যায়। সেই সাথে অন্য নবীগণের সহিফাগুলোও বিনষ্ট হয়ে যায়, যাঁরা সে যুগের পূর্বে অতীত হয়েছেন খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে যখন ইসরাইলিগণ বেবিলনে বন্দিদশা থেকে মুক্তি লাভ করে তখন হযরত উযায়ের (আ) অন্যান্য বুজর্গানের সাহায্যে হযরত মূসা (আ) এর সিরাত এবং বনি ইসরাইলের ইতিহাস সঙ্কলন করেন। তার মধ্যেই ওসব আয়াত সুযোগ মতো সন্নিবেশিত করেন, সেসব তাঁর ও তাঁর সাহায্যকারীগণের হস্তগত হয়েছিল। তারপর খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত বিভিন্ন লোক (জানি না তারা কে) ঐসব নবীগণের সহিফা সঙ্কলন করেন, যাঁরা তাদের কয়েক শতাব্দী আগে অতীত হয়ে গেছেন। জানি না কোন সূত্রে তারা এসব করেছে। যেমন ধরুন, হযরত ঈসা (আ) এর তিন শ’ বছর আগে হযরত ইউনুস (আ) এর নামে কোনো এক ব্যক্তি একখানা বই লিখে বাইবেলের মধ্যে সন্নিবেশিত করে দেয়। অথচ তিনি খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে নবী ছিলেন। যবুর (চংধষসং) হযরত দাউদ (আ) এর ইন্তেকালের পাঁচ শ’ বছর পরে লেখা হয় এবং তার মধ্যে হযরত দাউদ (আ) ছাড়াও এক শ’ অন্যান্য কবিদের কবিতা সন্নিবেশিত করা হয়। জানি না কোন সূত্রে যবুর প্রণয়নকারীগণের কাছে এসব তথ্য পৌঁছে। হযরত সুলায়মান (আ) মৃত্যুবরণ করেন হযরত ঈসা (আ) এর ৯৩৩ বছর আগে এবং হযরত সুলায়মান (আ) এর প্রবাদগুলো লিখিত হয় হযরত ঈসা (আ) এর দু শ’ পঞ্চাশ বছর আগে। তার মধ্যে অন্যান্য বহু জ্ঞানী ব্যক্তির কথাও সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
মোট কথা বাইবেলের কোনো পুস্তকের সনদই ঐসব নবী পর্যন্ত পৌঁছে না যাদের প্রতি তা আরোপ করা হয়। উপরন্তু ইবরানি ভাষায় লিখিত বাইবেল এসব গ্রন্থ সত্তর খ্রিস্টাব্দে বায়তুল মাকদিস দ্বিতীয় বার ধ্বংস হবার সময় বিনষ্ট হয়ে যায়। ও সবের শুধু গ্রিক ভাষায় অনুবাদ অবশিষ্ট ছিল। এ অনুবাদ করা হয়েছিল ২৫৮ খ্রিস্টপূর্ব থেকে প্রথম শতাব্দী খ্রিস্টপূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে। ইহুদি পণ্ডিতগণ খ্রিস্টাব্দ দ্বিতীয় শতাব্দীতে ইবরানি বাইবেলে সব পাণ্ডুলিপি থেকে প্রণয়ন করে, যা অবশিষ্ট রয়ে গিয়েছিল। তার প্রাচীনতম যে বইখানি পাওয়া যায় তা ৯১৬ খ্রিস্টাব্দে লেখা। এ ছাড়া অন্য কোনো ইবরানি বাইবেল বিদ্যমান নেই। লুত সাগরের (উবধফ ঝবধ) সন্নিকটে ‘গারে কামরানে’ যে ইবরানি তাফসির (ঝপৎড়ষষং) পাওয়া যায় তা-ও বড়োজোর খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় ও প্রথম শতাব্দীর লেখা। তার মধ্যে বাইবেলের শুধু কিছু বিক্ষিপ্ত অংশই পাওয়া যায়। বাইবেলের প্রথম পাঁচ পুস্তকের যে সমষ্টি সামেরীয়দের (ঝধসধৎরঃধহং) নিকটে প্রচলিত তার প্রাচীনতম পুস্তক খ্রিস্টীয় একাদশ শতাব্দীর লেখা। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে যে গ্রিক অনুবাদ করা হয় তাতে অসংখ্য ভুলত্রুটি ছিল। তার থেকে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করা হয় খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীতে। হযরত মূসা (আ) এবং তাঁর পরবর্তী নবীগণের অবস্থা ও শিক্ষা সম্পর্কে এসব উপাদান ও মালমসলা কিসের মানদণ্ডে প্রামাণ্য (অঁঃযবহঃরপ) বলা যেতে পারে?
তা ছাড়া ইহুদিদের মধ্যে লোক পরম্পরা কিছু মৌলিক বর্ণনা পাওয়া যায় যাকে মৌখিক আইন (ঙৎধষ ষধ)ি বলা হয়। তের-চৌদ্দ শ’ বছর পর্যন্ত এসব অলিখিত ছিল। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষে এবং তৃতীয় শতাব্দীর প্রারম্ভে রিব্বি ইয়াহুদা বিন শামউন তা মিশনা নামে লিখিত রূপ দান করে। ফিলিস্তিনের ইহুদি পণ্ডিতগণ হালাকা নামে এবং বেবিলনের পল্গিতগণ হাগগাদা নামে তার ভাষ্য লেখেন খ্রিস্টীয় তৃতীয় এবং পঞ্চম শতাব্দীতে। এ তিনটি গ্রন্থের সমষ্টিকে বলা হয় তালমুদ। এ সবের কোনো বর্ণনারই কোনো সনদ নেই যাতে করে বুঝতে পারা যাবে যে, এসব কোন কোন লোকের দ্বারা কোন কোন লোকের কাছে বর্ণিত হয়েছে।
হযরত ঈসা (আ) এর খ্রিস্টধর্মের গ্রন্থাবলির অবস্থা
হযরত ঈসা (আ) এর সিরাত ও শিক্ষার অবস্থা কিছুটা এ ধরনেরই। আল্লাহর পক্ষ থেকে যে মূল ইঞ্জিল অহির মাধ্যমে নাজিল হয়েছিল, তা হযরত ঈসা (আ) লোকদেরকে মৌখিক শুনিয়ে দিতেন। তাঁর শিষ্যগণও সেসব অন্যদের কাছে মুখে মুখে এমনভাবে পৌঁছিয়ে দিতেন যে, নবীর অবস্থা এবং ইঞ্জিলের আয়াতগুলো একত্রে মিশ্রিত হয়ে যেতো। সে সবের কোনো কিছুই হযরত ঈসা (আ) এর জীবদ্দশায় অথবা তাঁর পরে লিখিত হয়নি। লেখার কাজ ঐ খ্রিস্টানগণ করেন যাদের ভাষা ছিল গ্রিক। অথচ হযরত ঈসা (আ) এর ভাষা ছিল সুরিয়ানি (ঝুৎরধপ) অথবা আরামি (অৎধসধরপ)। তাঁর শিষ্যগণও এ ভাষা বলতেন। গ্রিক ভাষাভাষী অনেক গ্রন্থকার এ বর্ণনাগুলো আরামি ভাষায় শুনেন এবং তা গ্রিক ভাষায় লেখেন। এসব গ্রন্থাকারের লিখিত কোনো গ্রন্থই ৭০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে লিখিত হয়নি। তাঁদের কেউই কোনো ঘটনা অথবা হযরত ঈসা (আ)-এর কোনো বাণীর সনদ বর্ণনা করেননি যার থেকে জানা যেতে পারে যে, তাঁর কোন কথাগুলো কার নিকট থেকে শুনেছেন। তারপর তাঁদের লিখিত গ্রন্থগুলোও সংরক্ষিত নেই। বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টের হাজার হাজার গ্রিক ভাষার বই একত্র করা হয়, কিন্তু তার কোনো একটিও খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর পূর্বেকার নয়। বরঞ্চ অধিকাংশ খ্রিস্টীয় একাদশ থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর। মিসরে পাপিরাসের উপরে লিখিত কিছু বিক্ষিপ্ত অংশ পাওয়া গেছে। তার মধ্যেও কোনোটাই তৃতীয় শতাব্দীর পূর্বেকার নয়। গ্রিক থেকে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ কে কখন এবং কোথায় করেন, সে সম্পর্কে কিছু জানতে পারা যায় না। চতুর্থ শতাব্দীতে পোপের নির্দেশে এসে পুনঃপরীক্ষা করে দেখা হয়। অতঃপর ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে ওসব পরিত্যাগ করে গ্রিক ভাষা থেকে ল্যাটিন ভাষায় এক নতুন অনুবাদ করা হয়। গ্রিক থেকে সুরিয়ানি ভাষায় চারটি ইঞ্জিলের অনুবাদ সম্ভবত ২০০ খ্রিস্টাব্দে করা হয়। কিন্তু তারও যে প্রাচীনতম গ্রন্থ বর্তমানে পাওয়া যায় তা চতুর্থ শতাব্দীর লেখা। পঞ্চম শতাব্দীর কলমে লেখা যে বইটি পাওয়া গেছে তা যথেষ্ট ভিন্ন ধরনের। সুরিয়ানি থেকে আরবি ভাষায় যে অনুবাদ করা হয়েছে তার মধ্যেও কোনোটি অষ্টম শতাব্দীর পূর্বেকার নয়। মজার ব্যাপার এই যে, প্রায় সত্তরটি ইঞ্জিলগ্রন্থ লেখা হয় কিন্তু তার মধ্যে মাত্র চারটি খ্রিস্টধর্মীয় নেতাগণ অনুমোদন করেছেন এবং অবশিষ্টগুলোকে নাকচ করে দিয়েছেন। জানি না অনুমোদন বা কেন করা হলো এবং নাকচই বা কেন করা হলো। এ ধরনের উপকরণ ও মালমসলার ভিত্তিতে লিখিত হযরত ঈসা (আ) এর সিরাত এবং তার শিক্ষা-দীক্ষা কোনো পর্যায়ে কি প্রামাণ্য বলে স্বীকার করা যেতে পারে?
যরদশতের সিরাত ও শিক্ষার অবস্থা
অন্যান্য ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের অবস্থাও অন্য ধরনের নয়। যেমন ধরুন যরদশত (তড়ৎড়ধংঃবৎ), যাঁর সঠিক জন্মকাল এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। বড়োজোর এ কথা বলা যেতে পারে যে, আলেকজান্ডারের ইরান বিজয়ের আড়াই শ’ বছর পূর্বে তিনি বিদ্যমান ছিলেন, অর্থাৎ হযরত মসীহ (আ) এর সাড়ে পাঁচ শ’ বছর পূর্বে। তাঁর গ্রন্থ আবেন্তা মূল ভাষায় এখন বিদ্যমান নেই এবং সে ভাষাও এখন মৃত যে ভাষায় তা লিখিত ছিল অথবা মৌখিক বর্ণনা করা হয়েছিল। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে তার কিছু অংশের অনুবাদ ব্যাখ্যাসহ ৯ খ-ে করা হয়েছিল। কিন্তু তার মধ্যে প্রথম দুই খ- বিনষ্ট হয়ে যায় এবং এখন তার যে প্রাচীনতম খণ্ডটি পাওয়া যায় তা ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের লেখা। এ হচ্ছে যরদশতের উপস্থাপিত গ্রন্থের অবস্থা। এখন রইলো তার নিজস্ব জীবনচরিতের ব্যাপার। তো এ সম্পর্কে আমাদের এর বেশি কিছু জানা নেই যে, তিনি চল্লিশ বছর বয়সে তাবলিগ শুরু করেন। দু’বছর পর বাদশাহ গুশতাস্প্্ তাঁর আনুগত্য গ্রহণ করেন এবং তাঁর ধর্ম সরকারি ধর্মে পরিণত হয়। সাতাত্তর বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর যতই সময় অতিবাহিত হতে থাকে ততই তাঁর সম্পর্কে নানান ধরনের আজগুবি গল্পকাহিনী রচিত হতে থাকে। তার কোনোটিকেই কোনো ঐতিহাসিক মর্যাদা দেয়া যায় না।
বৌদ্ধ ধর্মের অবস্থা
দুনিয়ার প্রখ্যাত ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের মধ্যে বুদ্ধ একজন। যরদশতের ন্যায় তাঁর সম্পর্কে এ অনুমান করা যায় যে, সম্ভবত তিনিও নবী ছিলেন। কিন্তু তিনি মোটেই কোনো কিতাব পেশ করেননি। তার অনুসারীগণও এমন কোনো দাবি করেননি যে, তিনি কোনো কিতাব এনেছেন। তাঁর মৃত্যুর এক শ’ বছর পর তাঁর কথা ও অবস্থা একত্র করার কাজ শুরু করা হয়। এ কাজ কয়েক শতাব্দী ধরে চলতে থাকে। কিন্তু এ ধরনের যত গ্রন্থকেই বৌদ্ধ ধর্মের মূল গ্রন্থ মনে করা হয় তার কোনোটির মধ্যে কোনো সনদ সন্নিবেশিত করা হয়নি, যার দ্বারা এ কথা জানা যেতে পারে যে, বুদ্ধের অবস্থা, বাণী ও শিক্ষা যাঁরা সঙ্কলন করেছেন কোন সূত্রে এসব তাঁদের নিকটে পৌঁছে।
শুধুমাত্র নবী মুহাম্মদ (সা) এর সিরাত ও শিক্ষাই সংরক্ষিত আছে
এর থেকে জানা গেল যে, যদি আমরা অন্যান্য নবী ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দের শরণাপন্ন হই তাহলে তাঁদের সম্পর্কে এমন কোনো প্রামাণ্য মাধ্যম পাওয়া যায় না যার দ্বারা আমরা তাঁদের শিক্ষা ও জীবনচরিত থেকে নিশ্চিন্ত ও দৃঢ়প্রত্যয়ের সাথে কোনো পথনির্দেশনা পেতে পারি। অতঃপর আমাদের জন্য এ ছাড়া আর অন্য কোনো পথ থাকে না যে, আমরা এমন এক নবীর শরণাপন্ন হবো যিনি নির্ভরযোগ্য ও সকল প্রকার বিকৃতি ও মিশ্রণের ঊর্ধ্বে এক গ্রন্থ আমাদের জন্য রেখে গেছেন এবং যাঁর বিস্তারিত অবস্থা, বাণী ও শিক্ষা-দীক্ষা নির্ভরযোগ্য সূত্রে আমাদের নিকটে পৌঁছেছে যার থেকে আমরা পথনির্দেশনা পেতে পারি। এমন ব্যক্তিত্ব সমগ্র দুনিয়ার ইতিহাসে একমাত্র নবী মুহাম্মদ (সা) এর পবিত্র সত্তা।
রাসূলের সিরাত ও সুন্নাতের পরিপূর্ণ নির্ভরশীলতা
তাঁর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, তিনি সকল আম্বিয়া ও ধর্মীয় গুরুদের মধ্যে এ ব্যাপারে একক। সে বৈশিষ্ট্য এই যে, তাঁর প্রতি প্রদত্ত কিতাবের ন্যায় তাঁর সিরাতও সংরক্ষিত আছে যার থেকে আমরা জীবনের প্রতি বিভাগে পথনির্দেশনা পেতে পারি। শৈশব থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যত লোক তাঁকে দেখছে, তাঁর জীবনের অবস্থা ও ক্রিয়াকলাপ দেখেছে, তাঁর বাণী শুনেছে, তাঁর ভাষণ শুনেছে, তাঁকে কোনো আদেশ করতে অথবা কোনো কিছু বিষয়ে নিষেধ করতে শুনেছে, তাদের মধ্যে বিরাট সংখ্যক লোক সবকিছু হৃদয়ে গেঁথে রেখেছে এবং পরবর্তী বংশধরদের কাছে তা পৌঁছিয়ে দিয়েছে। কিছু বিশেষজ্ঞদের মতে এমন লোকের সংখ্যা এক লক্ষ যাঁরা চোখে দেখা এবং কানে শুনা ঘটনাগুলোর বিবরণ পরবর্তী বংশধর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন। নবী (সা) কতিপয় হুকুম-আহকাম লিখিয়ে নিয়ে কিছু লোককে দিয়েছেন বা তাদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন, যা পরবর্তী যুগের লোকেরা পেয়েছে। সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে অন্তত ছয়জন ব্যক্তি এমন ছিলেন, যাঁরা হাদীস লিপিবদ্ধ করে নবী (সা) কে শুনিয়ে দিয়েছিলেন যাতে করে তার মধ্যে কানো ভুল থাকতে না পারে। এসব লিখিত তথ্যাবলি পরবর্তী কালের লোকেরা লাভ করেছে এবং নবী করীম (সা) এর ইন্তেকালের পর অন্তত পঞ্চাশ জন সাহাবী নবীর অবস্থা ও কার্যকলাপ এবং তাঁর কথা লিখিত আকারে একত্র করেন এবং এসব জ্ঞানভাণ্ডার তাঁদেরও হস্তগত হয় যাঁরা হাদীস সঞ্চয়ন ও সঙ্কলনের কাজ করেন। তারপর যেসব সাহাবী সিরাত সম্পর্কিত তথ্যাবলি মৌখিক বর্ণনা করেন তাদের সংখ্যা, যেমন আমি একটু আগে বলেছি, এক লক্ষ পর্যন্ত পৌঁছে। আর এটা কোনো আশ্চর্যজনক ব্যাপারও নয়। কারণ নবী (সা) যে বিদায় হজ সমাধা করেন তাতে এক লক্ষ চল্লিশ হাজার লোক উপস্থিত ছিলেন। এত বিরাট সংখ্যক লোক তাঁকে হজ করতে দেখেছেন, তাঁর নিকট থেকে হজের নিয়ম-পদ্ধতি শিক্ষা করেছেন এবং এ হজের সময় যে ভাষণ তিনি দিয়েছিলেন তা তাঁরা শুনেছেন। কী করে সম্ভব এত লোক যখন এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে নবী সাথে হজে শরিক হওয়ার পর নিজেদের অঞ্চলে প্রত্যাবর্তন করেন, তখন সেখানে তাঁদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং প্রতিবেশীগণ তাঁদের নিকট থেকে এ হজ ভ্রমণের বিবরণ জিজ্ঞেস করেননি এবং হজের নিয়ম-পদ্ধতি জেনে নেননি? এর থেকে অনুমান করুন যে, নবী (সা) এর মতো মহান ব্যক্তিত্ব দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার পর লোক কত আগ্রহের সাথে তাঁর অবস্থা ও কাজ কর্ম, তাঁর কথা, নির্দেশ ও হেদায়াত সম্পর্কে ঐসব লোকের নিকট থেকে জানতে চাইবে যাঁরা তাকে দেখেছেন এবং তাঁর নির্দেশনাবলি শুনেছেন।
সাহাবায়ে কিরাম (রা) থেকে যেসব বর্ণনা পরবর্তী বংশধরদের কাছে পৌঁছেছে, সে সম্পর্কে প্রথম থেকেই এ পন্থা অবলম্বন করা হয় যে, যে ব্যক্তি নবী (সা) এর প্রতি আরোপ করে কোনো কথা বলতেন তাঁকে এ কথা বলতে হতো যে, তিনি সে কথা কার কাছে শুনেছেন এবং তাঁর আগে ধারাবাহিকতার সাথে সে কার কাছ থেকে সে কথা শুনেছেন। এভাবে নবী (সা) পর্যন্ত বর্ণনা পরম্পরায় গোটা সংযোজন (খরহশ) লক্ষ্য করা হতো, যাতে করে এ নিশ্চয়তা লাভ করা যেতো যে, কথাটি সঠিকভাবে নবী (সা) থেকে বর্ণিত হয়েছে। যদি বর্ণনার সকল সংযোজক পাওয়া না যেতো, তাহলে তার সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি হতো। আবার বর্ণনা পরম্পরা নবী (সা) পর্যন্ত পৌঁছেছে, কিন্তু মাঝখানের কোনো রাবি (বর্ণনাকারী) অনাস্থাভাজন হয়েছে, তাহলে এ ধরনের বর্ণনা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এখন একটু চিন্তা করে দেখলে আপনি অনুভব করবেন যে, দুনিয়ার কোনো মানুষের জীবনবৃত্তান্ত এভাবে সঙ্কলিত হয়নি। এ বৈশিষ্ট্য শুধুমাত্র নবী মুহাম্মদ (সা) এর যে, তাঁর সম্পর্কে কোনো কথা বিনা সনদে মেনে নেয়া হয়নি। আর সনদে শুধু এতটুকুই দেখা হয়নি যে, একটি হাদীসের বর্ণনা পরম্পরা নবী পর্যন্ত পৌঁছেছে কিনা, বরঞ্চ এটাও দেখা হয়েছে যে, এ সম্পর্কিত সকল রাবি (বর্ণনাকারী) নির্ভরযোগ্য কিনা। উদ্দেশ্যে রাবিগণের জীবনবৃত্তান্তও পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে যাচাই করা হয়েছে এবং এ বিষয়ের ওপর বিস্তারিত গ্রন্থ প্রণয়ন করা হয়েছে। তার থেকে জানা যায় যে, কে নির্ভরযোগ্য ছিল এবং কে ছিল না। কার চরিত্র ও ভূমিকা কী রকম ছিল। কার স্মরণশক্তি প্রখর ছিল এবং কার ছিল না। কে ঐ ব্যক্তির সাথে দেখা করে যার থেকে বর্ণনা নকল করা হয়েছে এবং কে তার সাথে সাক্ষাৎ না করেই তাঁর নামে রেওয়ায়াত লিপিবদ্ধ করেছে। এভাবে এত ব্যাপক আকারে রাবিদের সম্পর্ক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে যে, আজও আমরা এক একটি হাদীস যাচাই করতে পারি যে, তা নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণনা করা হয়েছে, না অনির্ভরযোগ্য সূত্রে। মানব ইতিহাসে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি এমন পাওয়া যেতে পারে কি যাঁর জীবনবৃত্তান্ত এমন নির্ভরযোগ্য সূত্রে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে ? এমন কোনো দৃষ্টান্ত কি আছে যে, এক ব্যক্তির জীবনচরিতের সত্যতা নির্ণয়ের জন্য হাজার হাজার লোকের জীবনের ওপর গ্রন্থাদি প্রণীত হয়েছে যাঁরা ঐ এক ব্যক্তি সম্পর্কে কিছু বর্ণনা করেছেন ? বর্তমান যুগে খ্রিস্টান ও ইহুদি পণ্ডিতগণ হাদীসের সত্যতা সন্ধিগ্ধ প্রতিপন্ন করার জন্য যে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছেন, তার প্রকৃত কারণ এ বিদ্বেষ ছাড়া আর কিছু নয় যে, তাঁদের ধর্মগ্রন্থ এবং ধর্মীয় গুরুদের জীবনবৃত্তান্ত সম্পর্কে মোটেই কোনো সনদ বিদ্যমান নেই। তাঁদের মনের এ জ্বালার কারণেই তাঁরা ইসলাম, কুরআন এবং নবী মুহাম্মদ (সা) এর সমালোচনার ব্যাপারে বুদ্ধবৃত্তিক সততা ( ওহঃবষষবপঃধষ যড়হবং ) পরিহার করেছেন।
নবী মুহাম্মদ (সা) এর জীবনের প্রতিটি দিক ছিল সুপরিচিত ও সুবিদিত
নবী (সা) এর সিরাতের শুধু এ একটিমাত্র বৈশিষ্ট্যই নয় যে, তা আমাদের কাছে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য সূত্রে পৌঁছেছে, বরঞ্চ এটাও তাঁর এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য যে তাঁর জীবনের প্রতিটি দিকের এত বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় যে অন্য কোনো ব্যক্তির জীবন সম্পর্কে ততটা পাওয়া যায় না। তাঁর পরিবার কেমন ছিল, নবুওয়ত-পূর্ব জীবন তাঁর কেমন ছিল, কিভাবে তিনি নবুওয়ত প্রাপ্ত হলেন, কিভাবে তাঁর ওপর অহি নাজিল হতো, কিভাবে তিনি ইসলামী দাওয়াত ছড়ালেন, বিরোধিতা ও প্রতিবন্ধকতার মোকাবেলা কিভাবে করলেন, আপন সঙ্গীসাথীদের কিভাবে তরবিয়ত দিলেন, আপন পরিবারের সাথে কিভাবে জীবন যাপন করতেন, বিবি-বা””াদের সাথে তাঁর আচরণ কেমন ছিল, বন্ধু ও শত্রুর প্রতি তাঁর ব্যবহার কেমন ছিল, কোন নৈতিকতার শিক্ষা তিনি দিতেন এবং আপন চরিত্রের মাধ্যমে কোন জিনিসের নির্দেশ তিনি দিতেন, কোন কাজ করতে তিনি নিষেধ করতেন, কোন কাজ হতে দেখে তা নিষেধ করেননি, কোন কাজ হতে দেখে তা নিষেধ করেছেন এসব কিছু পুঙ্খানুপঙ্খরূপে হাদীস ও সিরাতের গ্রন্থগুলোতে বিদ্যমান রয়েছে। তিনি একজন সামরিক জেনারেলও ছিলেন এবং তাঁর অধিনায়কত্বে যত যুদ্ধ বিগ্রহাদি হয়েছে তার বিশদ বিবরণ আমরা পাই। তিনি একজন শাসকও ছিলেন এবং তাঁর শাসনের যাবতীয় বিবরণ আমরা জানতে পারি। তিনি একজন বিচারকও ছিলেন এবং তাঁর সামনে উপস্থাপিত সকল মামলা মোকদ্দমার পূর্ণ কার্যবিবরণী আমরা দেখত পাই। আমরা এটাও জানতে পারি যে, কোন মামলায় তিনি কী রায় দিয়েছেন। তিনি বাজার পরিদর্শনেও বেরুতেন এবং দেখতেন মানুষ কেনা বেচার কাজ কিভাবে করতো। ভুল কাজ দেখলে তা করতে নিষেধ করতেন এবং যে কাজ সঠিকভাবে হতে দেখতেন, তা অনুমোদন করতেন। মোট কথা, জীবনের এমন কোনো বিভাগ নেই যে সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত হেদায়াত দান করেননি।
এ কারণেই আমরা পক্ষপাতহীনভাবে পরিপূর্ণ জ্ঞান ও বিশ্বাসের সাথে এ কথা বলি যে, সকল নবী ও ধর্মীয় প্রধানদের মধ্যে নবী মুহাম্মদই (সা) একমাত্র সত্তা সমগ্র মানবজাতি হেদায়াত ও পথ নির্দেশনার জন্য যাঁর শরণাপন্ন হতে পারে। কারণ তাঁর উপস্থাপিত কিতাব তার মূল শব্দাবলিসহ সংরক্ষিত আছে এবং হেদায়াতের অত্যাবশ্যক তাঁর সিরাতের বিশদ বিবরণ নির্ভরযোগ্য সূত্রে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। এখন লক্ষণীয় এই যে, তাঁর সিরাত পাক আমাদেরকে কোন পয়গাম এবং কোন হেদায়াত দান করছে।
তাঁর পয়গাম সমগ্র মানবজাতির জন্য
প্রথম যে জিনিসটি তাঁর দাওয়াতে আমাদের চোখে পড়ে তাহলো এই যে, তিনি বর্ণ, বংশ, ভাষা ও মাতৃভূমির স্বাতন্ত্র্য উপেক্ষা করে মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্বোধন করেন এবং এমন কিছু মূলনীতি পেশ করেন যা সমগ্র মানবজাতির জন্য মঙ্গলকর। এ মূলনীতি যে ব্যক্তি মেনে নেবে সেই মুসলমান হবে এবং একটি বিশ্বজনীন উম্মতে মুসলিমার সদস্য হবে, তা সে কৃষ্ণাঙ্গ হোক অথবা শ্বেতাঙ্গ। প্রাচ্যবাসী হোক অথবা পাশ্চাত্যবাসী, আরবি হোক অথবা আজমি। যেখানেই কোনো মানুষ আছে, সে যে দেশে, যে জাতিতে এবং যে বংশেই পয়দা হোক না কেন, সে ভাষা সে বলুক এবং তার গায়ের রঙ যেমনই হোক না কেন নবী মুহাম্মদ (সা) এর দাওয়াত তারই জন্য। সে যদি তাঁর উপস্থাপিত মূলনীতি মেনে নেয়, তাহলে সমান অধিকারসহ উম্মতে মুসলিমার মধ্যে শামিল হয়ে যায়। কোনো ছঁৎ-ছাঁৎ, কোনো উঁচু-নিচু, কোনো বংশীয় বা শ্রেণিগত স্বাতন্ত্র্য, কোনো ভাষাগত, জাতিগত ও ভৌগোলিক পার্থক্য, যা বিশ্বাসের ঐক্য স্থাপিত হওয়ার পর একজন মানুষকে অন্য জন থেকে পৃথক করে দেয়, এ উম্মতের মধ্যে নেই।
বর্ণ ও বংশের গোঁড়ামির সর্বোৎকৃষ্ট প্রতিকার
আপনি চিন্তা করলে অনুধাবন করবেন যে, এ এক বিরাট নিয়ামত যা নবী মুহাম্মদ আরবি (সা) এর বদৌলতে মানবজাতি লাভ করেছে। মানুষকে যে জিনিস সবচেয়ে ধ্বংস করেছে তাহলো মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত এই স্বাতন্ত্র্য। কোথাও তাকে অপবিত্র ও অচ্ছুৎ করে রাখা হয়েছ। ব্রাহ্মণ যে অধিকার ভোগ করে তার থেকে তারা বঞ্চিত। কোথাও তাকে নির্মূল করে দেয়ার যোগ্য বলে স্থির করা হলো কারণ, সে অস্ট্রেলিয়া এবং আমেরিকায় এমন সময় জন্মগ্রহণ করে যখন বহিরাগতদের প্রয়োজন হয়েছিল তাকে ভূমি থেকে উচ্ছেদ করায়। কোথাও তাকে ধরে দাসে পরিণত করা হলো এবং তার কাছে থেকে পশুর মতো শ্রম নেয়া হলো। কারণ সে আফ্রিকায় জন্মগ্রহণ করেছিল এবং তার গায়ের রঙ ছিল কালো। মোটকথা মানবতার জন্য জাতি, মাতৃভূমি, বংশ, বর্ণ ও ভাষার এ স্বাতন্ত্র্য প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত বিরাট বিপদের কারণ হয়ে রয়েছিল। এরই ভিত্তিতে যুদ্ধবিগ্রহ হতে থাকে। এরই ভিত্তিতে এক দেশ আর এক দেশ দখল করে বসেছে। এক জাতি আর এক জাতিকে লুণ্ঠন করেছে এবং বহু বংশ সমূলে ধ্বংস করেছ। নবী মুহাম্মদ (সা) এ রোগের এমন এক প্রতিকার করেন যা ইসলামের শত্রুগণও স্বীকার করেন। তা এই যে, ইসলাম বর্ণ, বংশ ও জন্মভূমির স্বাতন্ত্র্যের সমাধানে যে সাফল্য অর্জন করেছে তা আর কেউ করতে পারেনি।
আফ্রিকা বংশোদ্ভূত আমেরিকাবাসীদের প্রখ্যাত নেতা এবং শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গদের পক্ষ থেকে চরম বিদ্বেষ প্রচারের এককালীন পতাকবাহী ম্যালকম্ এক্স ইসলাম গ্রহণের পর যখন হজে গমন করেন এবং দেখেন যে, পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ সকল দিক থেকে সকল বংশ-বর্ণ দেশ ও ভাষার লোক হজ করতে আসছে, সকলে একই ধরনের এহরামের পোশাক পরিধান করে আছে, সকলে একই স্বরে লাব্বাইক লাব্বাইক ধ্বনি উচ্চারণ করছে, একত্রে তাওয়াফ করছে, একই জামায়াতে একই ইমামের পেছনে নামায পড়ছে, তখন তিনি চিৎকার করে বলছেন, বর্ণ ও বংশের যে সমস্যা, তার সুষ্ঠু সমাধান একমাত্র এটাই। আমরা এতদিন যা করে আসছি, তা নয়। এ বেচারাকে তো জালেমেরা হত্যা করে কিন্তু তাঁর প্রকাশিত আত্মচরিত এখনো বিদ্যমান আছে। তার থেকে আপনারা জানতে পারেন যে, হজের দ্বারা কত গভীরভাবে তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন।
হজ তো ইসলামের ইবাদাতগুলোর মধ্যে একটি মাত্র। যদি কেউ চক্ষু উন্মিলিত করে সামগ্রিকভাবে ইসলামের শিক্ষার প্রতি লক্ষ্য করে তাহলে তার কোথাও অঙ্গুলি সঙ্কেত করে এ কথা বলতে পারবে না যে, এ শিক্ষা কোনো বিশেষ জাতি, কোনো গোত্র, কোনো বংশ অথবা কোনো শ্রেণির স্বার্থের জন্য। গোটা দ্বীন তো এ কথার সাক্ষ্য দান করে যে, এ সমগ্র মানবজাতির জন্য এবং তার দৃষ্টিতে সকল মানুষ সমান যারা তার মূলনীতি স্বীকার করে নিয়ে তার তৈরি বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্বের মধ্যে শামিল হয়ে যায়। এ অমুসলিমের সাথেও এমন কোনো আচরণ করে না যা শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গের সাথে করেছে, যা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো তাদের শাসনাধীন জাতির সাথে করেছে, যা কমিউনিস্ট সরকারগুলো তাদের শাসনাধীনে বসবাসকারী অকমিউনিস্টদের সাথে এমনকি আপন দলের অবাঞ্ছিত সদস্যদের সাথে করেছে।
এখন আমাদের দেখতে হবে যে, মানবতার কল্যাণের জন্য সে মূলনীতি কি যা নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পেশ করেছিলেন এবং তার মধ্যে এমন কোন বস্তু রয়েছে যা শুধু মানবতার কল্যাণেরই নিশ্চয়তা দানকারী নয়, বরঞ্চ সমগ্র মানবজাতিকে এই সূত্রে গ্রথিত করে একটি উম্মতও বানাতে পারে।
আল্লাহ তাআলার একত্বের ব্যাপকতম ধারণা
এ মূলনীতির প্রধানতম বিষয় হচ্ছে, আল্লাহ তাআলার ওয়াহদানিয়াত বা একত্ব স্বীকার করে নেয়া। শুধু এ অর্থে নয় যে আল্লাহ আছেন এবং নিছক অর্থেও নয় যে, আল্লাহ শুধু এক। বরঞ্চ এ অর্থে যে, এ বিশ্বজগতের একমাত্র স্রষ্টা, মালিক, নিয়ন্তা এবং শাসক একমাত্র আল্লাহ তাআলা। সমগ্র সৃষ্টি জগতে দ্বিতীয় এমন কেউ নেই যার শাসনক্ষমতার কর্তৃত্ব অধিকার রয়েছে, যার আদেশ ও নিষেধ করার কোনো অধিকার আছে, যার হারাম করার কারণে কোনো জিনিস হারাম হয়ে যায় এবং যার হালাল করার কারণে কোনো জিনিস হালাল হয়ে যায়। এ অধিকার এখতিয়ার আল্লাহ ছাড়া আর কারো নেই। কারণ যিনি স্রষ্টা ও মালিক, প্রভু, একমাত্র তাঁরই এ অধিকার রয়েছে যে, তিনি তাঁর সৃষ্ট দুনিয়ায় তাঁর বান্দাদেরকে যে জিনিসের ইচ্ছা তা করতে আদেশ করতে পারেন এবং যে জিনিসের ইচ্ছা তার থেকে নিষেধ করতে পারেন। ইসলামের দাওয়াত এই যে, আল্লাহতাআলাকে এ হিসেবে মেনে নাও। তাঁকে এভাবে মেনে নাও যে, তিনি ব্যতীত আর কারো বান্দাহ আমরা নই, তাঁর আইনের বিপরীত আমাদের ওপর হুকুম করার অধিকার কারো নেই, আমাদের মাথা তিনি ছাড়া অন্য কারো সামনে অবনত হওয়ার জন্য সৃষ্টি করা হয়নি, আমাদের জীবন-মরণ তাঁরই এখতিয়ারাধীন। যখন ইচ্ছা তখন তিনি আমাদের মৃত্যু দান করতে পারেন। যতদিন ইচ্ছা ততদিন আমাদেরকে জীবিত রাখতে পারেন। তাঁর পক্ষ থেকে যদি মৃত্যু আসে তাহলে দুনিয়ায় এমন কোনো শক্তি নেই যে, আমাদের বাঁচাতে পারে। আর তিনি যদি জীবিত রাখতে চান তাহলে দুনিয়ার কোনো শক্তিই আমাদের ধ্বংস করতে পারে না। আল্লাহ সম্পর্কে এই হলো ইসলামের ধারণা।
এ ধারণা অনুযায়ী জমিন থেকে আসমান পর্যন্ত সমস্ত সৃষ্টিজগৎ আল্লাহর অনুগত, আজ্ঞাবহ এবং এ সৃষ্টিজগতের মধ্যে বসবাসকারী মানুষেরও কাজ এই যে, সেও আল্লাহর অনুগত আজ্ঞাবহ হয়ে থাকবে। সে যদি স্বাধীন স্বেচ্ছাচারী হয় অথবা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো আনুগত্য গ্রহণ করে, তাহলে তার জীবনের গোটা ব্যবস্থা বিশ্বপ্রকৃতির ব্যবস্থার পরিপন্থী হয়ে পড়বে। অন্য কথায় এভাবে বুঝবার চেষ্টা করুন যে, সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতি আল্লাহর হুকুমের অধীন চলছে এবং এ প্রকৃত সত্যকে কেউ পরিবর্তন করতে পারে না। এখন যদি আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো হুকুমের অধীন চলি অথবা আপন খুশি মতো যে দিকে ইচ্ছা সে দিকে চলি, তাহলে তার অর্থ এই হবে যে, আমাদের জীবনের সমগ্র গাড়িখানি বিশ্বপ্রকৃতির গাড়ির বিপরীত দিকে চলছে। এতে করে আমাদের এবং বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে এক চিরন্তন সংঘর্ষ চলতে থাকবে।
আর একদিক দিয়ে চিন্তা করে দেখুন, ইসলামের ধারণা অনুযায়ী মানুষের জন্য সঠিক জীবনপদ্ধতি (ডধু ড়ভ ষরভব) শুধু এই যে, সে শুধু আল্লাহর আনুগত্য করবে। কারণ সে সৃষ্ট এবং আল্লাহ তার স্রষ্টা। সৃষ্টজীব হওয়ার দিক দিয়ে তার স্বাধীন স্বেচ্ছাচারী হওয়াও ভুল এবং স্রষ্টা ছাড়া অন্য কারো দাসত্ব আনুগত্য করাও ভুল। এ দু’টি পথের মধ্যে যেটিই সে অবলম্বন করবে, তা হবে সত্যের সাথে সাংঘর্ষিক এবং সত্যের সাথে সংঘর্ষের বিষময় পরিণাম সংঘর্ষকারীকেই ভোগ করতে হয়, তাতে সত্যের কোনো ক্ষতি হয় না।
আল্লাহর বন্দেগির দাওয়াত
নবী মুহাম্মদ (সা) এর দাওয়াত হলো এ সংঘর্ষ বন্ধ কর। তোমার জীবনের বিধান ও রীতি-পদ্ধতি তাই হওয়া উচিত যা সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতির। তুমি না স্বয়ং আইনপ্রণেতা সাজো, আর না অন্যের এ অধিকার স্বীকার কর যে, সে আল্লাহর জমিনের ওপর আল্লাহর বান্দাহদের ওপর তার আইন চালাবে। বিশ্বজগতের স্রষ্টার আইনই হচ্ছে সত্যিকার আইন এবং অন্যসব আইন ভ্রান্ত ও বাতিল।
রাসূলের আনুগত্যের দাওয়াত
এখন পর্যন্ত পৌঁছুবার পর আমাদের সামনে নবী মুহাম্মদ (সা) এর দাওয়াতের দ্বিতীয় দফাটি আসছে। তা হচ্ছে তাঁর এ দ্ব্যর্থহীন বর্ণনা আমি আল্লাহ তাআলার নবী এবং মানবজাতির জন্য তিনি তাঁর আইন আমারই মাধ্যমে পাঠিয়েছেন। আমি স্বয়ং সে আইনের অধীন। স্বয়ং আমারও এতে কোনো পরিবর্তন করার এখতিয়ার নেই। আমি শুধু মেনে চলার জন্য আদিষ্ট হয়েছি। নিজের পক্ষ থেকে নতুন কিছু তৈরি করার অধিকারও আমার নেই। এ কুরআন এমন আইন যা আমার ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিল করা হয়েছে। আমার সুন্নাত এমন আইন যা আমি আল্লাহর নির্দেশে জারি করি। এ আইনের সামনে সকলের প্রথমে মস্তক অবনতকারী স্বয়ং আমি।
তারপর আমি সকল মানুষকে আহ্বান জানাচ্ছি যে, তারা যেন অন্যের আইনের আনুগত্য পরিহার করে এই আইনের আনুগত্য করে।
আল্লাহর পরে আনুগত্য লাভের অধিকারী আল্লাহর রাসূল
কারো মনে যেন এ সন্দেহ না জাগে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) স্বয়ং আপন সুন্নাতের আনুগত্য কিভাবে করতে পারেন যখন সে সুন্নাত হচ্ছে তাঁর নিজের কথা ও কাজ। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, কুরআন যেমন আল্লাহর পক্ষ থেকে, ঠিক তেমনি রাসূল হিসেবে তিনি যে হুকুম দিতেন, অথবা যা করতে তিনি নিষেধ করতেন, অথবা যে রীতি-পদ্ধতি তিনি নির্ধারিত করতেন তা-ও আল্লাহর পক্ষ থেকে হতো। একেই বলে সুন্নাতে রাসূল এবং এর আনুগত্য তিনি স্বয়ং সেভাবেই করতেন যেভাবে করা সকল ঈমানদারদের জন্য ছিল অপরিহার্য। এ কথাটি এমন অবস্থায় পুরোপরি সুস্পষ্ট হয়ে যায় যখন সাহাবায়েকিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম কোনো বিষয়ে নবী (সা) কে জিজ্ঞেস করতেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ কথা কি আপনি আল্লাহর হুকুমে বলছেন, না এ আপনার নিজের অভিমত? নবী জবাবে বলতেন, আল্লাহর হুকুমে নয়, বরঞ্চ এ আমার নিজস্ব অভিমত। এ কথা জানার পর সাহাবায়ে কিরাম নবীর কথায় একমত না হয়ে নিজেদের প্রস্তাব পেশ করতেন। তখন নবী (সা) তাঁর অভিমত পরিহার করে তাঁদের প্রস্তাব মেনে নিতেন। এভাবে এ কথা সে সময়ও পরিষ্কার হয়ে যেতো যখন নবী (সা) সাহাবায়েকিরামের সাথে পরামর্শ করতেন। এ পরামর্শ এ কথা প্রমাণ করে যে, এ ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশ আসেনি। কারণ আল্লাহর হুকুম হলে তো সেখানে পরামর্শের কোনো প্রশ্নই আসে না। এ ধরনের নবী (সা) এর জীবনে বহুবার ঘটেছে যার বিস্তারিত বিবরণ আমরা হাদীসে পাই। বরঞ্চ সাহাবায়েকিরাম (রা) বলেন, আমরা নবী (সা) থেকে অধিক পরামর্শকারী আর কাউকে দেখিনি। এ বিষয়ে চিন্তা করলে আপনারা বুঝতে পারবেন যে, এটাও নবীর সুন্নাত ছিল, যে ব্যাপারে আল্লাহর কোনো নির্দেশ নেই সে ব্যাপারে পরামর্শ করতে হবে। অন্য কোনো শাসক তো দূরের কথা আল্লাহর রাসূল পর্যন্ত তাঁর নিজস্ব অভিমতকে অপরের জন্য শিরোধার্য বলে ঘোষণা করেননি। এভাবে নবী (সা) উম্মতকে পরামর্শভিত্তিক কাজ করার প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং মানুষকে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, যে ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশ থাকবে তা দ্বিধাহীনচিত্তে মেনে চলতে হবে। আর যেখানে আল্লাহর কোনো নির্দেশ থাকবে না সেখানে স্বাধীন মতামতের অধিকার নির্ভয়ে ব্যবহার করবে।
স্বাধীনতার প্রকৃত চার্টার
এ মানবজাতির জন্য স্বাধীনতার এমন এক চার্টার যা একমাত্র দীনে হক ছাড়া আর কেউ মানবজাতিকে দান করেনি। আল্লাহর বান্দাহ শুধু এক আল্লাহরই বান্দাহ হবে। অন্য কারো বান্দাহ হবে না। এমনকি আল্লাহর রাসূলের বান্দাহও হবে না। এ চার্টার মানুষকে এক আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য সকলের বন্দেগি (দাসত্ব-আনুগত্য) থেকে স্বাধীন করে দিয়েছে এবং মানুষের ওপর থেকে মানুষের খোদায়ী বা প্রভুত্ব কর্তৃত্ব চিরদিনের জন্য খতম করে দিয়েছে। এর সাথে এক মহানতম নিয়ামত যা এ পয়গাম মানুষকে দান করেছে তা এমন এক আইনের শ্রেষ্ঠত্ব যা বাতিল করার, বিকৃত করার এবং রদবদল করার অধিকার কোনো বাদশাহ, ডিক্টেটর অথবা কোনো গণতান্ত্রিক আইনসভা অথবা ইসলাম গ্রহণকারী কোনো জাতির নেই। এ আইন ভালো ও মন্দের এক শাশ্বত মূল্যবোধ (চবৎসধহবহঃধষঁবং) মানুষকে দান করে যা পরিবর্তন করে ভালোকে মন্দ এবং মন্দকে ভালো করা যায় না।
আল্লাহর নিকট জবাবদিহির ধারণা
তৃতীয় যে জিনিসটি নবী মুহাম্মদ (সা) মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন তা এই যে, তোমাকে আল্লাহর সামনে জবাবদিহি করতে হবে। তোমাকে দুনিয়ায় লাগামহীন পশুর মতো ছেড়ে দেয়া হয়নি যে, যা খুশি তাই করবে। খুশিমতো যে কোনো ক্ষেত-খামারে চরতে থাকবে এবং তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার কেউ থাকবে না। বরঞ্চ তোমার এক একটি কথা এবং তোমার গোটা স্বেচ্ছামূলক জীবনের ক্রিয়াকর্মের হিসাব তোমাকে তোমার স্রষ্টা ও প্রভুকে দিতে হবে। মৃত্যুর পর তোমাকে পুনর্জীবিত হতে হবে এবং আপন প্রভুর সামনে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাজির হতে হবে। এ এমন এক বিরাট নৈতিক শক্তি যে, তা যদি মানুষের বিবেকের মধ্যে স্থান লাভ করে তাহলে তার অবস্থা এমন হবে যেন তার সাথে সর্বদা একজন চৌকিদার লেগে আছে যে দুষ্কৃতির প্রতিটি প্রবণতার জন্য তাকে সতর্ক করে দেয় এবং প্রত্যেক পদক্ষেপে তাকে বাধা দেয়। বাইরে কোনো পাকড়াওকারী পুলিশ এবং শাস্তিদানকারী সরকার থাকুক বা থাকুক, তার ভেতরে এমন এক ছিদ্রান্বেষী সমালোচক বসে থাকবে যার দ্বারা ধরা পড়ার ভয়ে সে কখনো নিভৃতে, বন-জঙ্গলে গভীর অন্ধকারে অথবা কোনো জনমানবহীন স্থানেও আল্লাহর নাফরমানী করতে পাবে না। মানুষের নৈতিক সংস্কার সংশোধন এবং তার মধ্যে এক মজবুত চরিত্র তৈরি করার এর চেয়ে উৎকৃষ্টতম উপায় আর কিছু নেই। অন্য যে কোনো উপায়েই চরিত্র গঠনের চেষ্টা করুন না কেন, এর চেয়ে অধিক অগ্রসর হতে পারবেন না যে সৎকাজ দুনিয়ার জীবনে মঙ্গলকর হবে এবং অসৎ কাজ অমঙ্গলকর হবে এবং ঈমানদারি একটা মহৎ নীতি। তার অর্থ এ হলো যে, নীতিগতভাবে যদি অসৎ কাজ এবং বেঈমানী মঙ্গলকর হয় এবং তাতে ক্ষতির কোনো আশঙ্কা না থাকে তাহলে বিনা দ্বিধায় তা করে ফেলা যায়। এ দৃষ্টিকোণের পরিণাম তো এই যে, যারা ব্যক্তিগত জীবনে সৎ আচরণের অধিকারী তারাই জাতীয় আচার আচরণে চরম পর্যায়ের বেঈমানী, প্রতারক, লুণ্ঠনকারী, জালেম ও স্বৈরাচারী হয়ে পড়ে। বরঞ্চ ব্যক্তিগত জীবনেও কোনো কোনো ব্যাপারে তারা সৎ হলেও অন্যান্য ব্যাপারে চরম অসৎ হয়ে পড়ে। আপনারা দেখতে পাবেন যে, একদিকে তারা লেনদেনে সৎ এবং আচার-আচরণে ভদ্র, অপরদিকে মদ্যপায়ী, ব্যভিচারী, জুয়াড়ি, অত্যন্ত চরিত্রহীন এবং কলুষিত ও কলঙ্কিত। তাদের কথা এই যে, মানুষের ব্যক্তিজীবন এক জিনিস এবং সমাজজীবন বা লোক জীবন (চঁনষরপ ষরভব) অন্য জিনিস। ব্যক্তিজীবনের কোনো দোষ ধরলে তারা ত্বরিত জবাব দেয়, আপন চরকায় তেল দাও।
ঠিক এর বিপরীত হচ্ছে, আখেরাতের আকিদা-বিশ্বাস। তাহলে এই যে, পাপ সব সময়ই পাপ দুনিয়ার জীবনে তা কল্যাণকর হোক অথবা অনিষ্টকারী। যে ব্যক্তি আল্লাহর সামনে জবাবদিহির অনুভূতি পোষণ করে তার জীবনে ব্যক্তি ও সমাজের দুটি বিভাগ স্বতন্ত্র হতে পারে না। সে ঈমানদারি অবলম্বন করলে এ জন্যও করে না যে, এ একটা উত্তম নীতি।
বরঞ্চ তার অস্তিত্বের মধ্যেই ঈমানদারি শামিল হয়ে যায় এবং সে চিন্তাই করতে পারে না যে বেঈমানী করাটা তার পক্ষে কখনো সম্ভব হতে পারে। তার আকিদা-বিশ্বাস তাকে এ কথা শিক্ষা দেয় যে, যদি সে বেঈমানী করে তাহলে সে পশুরও নিম্নস্তরে গিয়ে পৌঁছুবে। যেমন কুরআনে এরশাদ হয়েছে ‘‘আমরা মানুষকে সর্বোৎকৃষ্ট আকার, আকৃতিতে পয়দা করেছি। অতঃপর তাকে উল্টিয়ে ফিরিয়ে সর্ব নিম্নস্তরের করে দিয়েছি।”
এভাবে নবী মুহাম্মদ (সা) এর নেতৃত্বে মানুষ শুধু শাশ্বত নৈতিক মূল্যবোধ সম্বলিত একটা অপরিবর্তনীয় আইনই লাভ করেনি, বরঞ্চ ব্যক্তিগত ও জাতীয় চরিত্র ও আচার আচরণের জন্য এমন একটি বুনিয়াদও লাভ করেছে যা একেবারে অনড় ও অটল। এ আইন এ জিনিসের মুখাপেক্ষী নয় যে, কোনো সরকার, কোনো পুলিশ, কোনো আদালত যদি থাকে তাহলে আপনি সৎ পথে চলতে পারবেন, নতুবা অপরাধী হয়ে থাকতে হবে।
বৈরাগ্যবাদের পরিবর্তে দুনিয়াদারিতে চরিত্রের ব্যবহার
নবী মুহাম্মদ (সা) এর দাওয়াত আমাদেরকে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দান করে। তা এই যে, চরিত্র সংসারবিরাগীদের নিভৃত কক্ষের জন্য নয়, দরবেশদের খানকার জন্য নয়, বরঞ্চ দুনিয়ার জীবনের সকল বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য। দুনিয়া ফকির এবং দরবেশদের মধ্যে যে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নতি তালাশ করে, আল্লাহর রাসূল (সা) তাকে রাষ্ট্রীয় মসনদে এবং বিচারালয়ের আসনে এনে রেখেছিলেন। তিনি ব্যবসায় বাণিজ্যে আল্লাহভীতি ও দিয়ানতদারির সাথে কাজ করার শিক্ষা দিয়েছেন, পুলিশ ও সৈনিককে তাকওয়া ও আল্লাহভীতির শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষের এ ভ্রান্ত ধারণা দূর করে দিয়েছেন যে, আল্লাহর অলি সেই হতে পারে যে দুনিয়াকে বর্জন করে শুধু আল্লাহ আল্লাহ করতে থাকবে। তিনি বলেন, অলিত্ব এটার নাম নয়, বরঞ্চ প্রকৃত অলিত্ব হচ্ছে এই যে, মানুষ একজন শাসক, একজন বিচারক, একজন সেনাধ্যক্ষ, একজন থানার দারোগা, একজন ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি এবং অন্যান্য সকল দিক দিয়ে এক পুরো দুনিয়াদার হলেও প্রতি মুহূর্তে আল্লাহভীরু এবং সৎ ও বিশ্বস্ত হওয়ার প্রমাণ দেবে সেখানে তার ঈমান অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হবে। এভাবে তিনি চরিত্র ও আধ্যাত্মিকতাকে বৈরাগ্যবাদের নিভৃত কোণ থেকে টেনে বের করে অর্থনীতিতে ও সামাজিকতায়, রাজনীতিতে ও বিচারালয়ে এবং যুদ্ধ ও সন্ধির ময়দানে নিয়ে এসেছেন। তারপর এসব স্থানে পূর্ণ পূতঃচরিত্রের শাসন কায়েম করেছেন।
নবী (সা) এর হেদায়াতের উত্তম প্রভাব
এ ছিল তাঁরই হেদায়াত ও পথ নির্দেশনার মহৎ প্রভাব যে, নবুওয়তের সূচনালগ্নে যারা ছিল ডাকাত তাদেরকে তিনি এমন অবস্থায় রেখে গেলেন যে তারা আমানতদার এবং মানুষের জানমাল ও ইজ্জত আবরুর রক্ষক হয়ে পড়লো। যাদেরকে তিনি পেয়েছিলেন পরসম্পদ হরণকারী, তাদেরকে অধিকার দানকারী, অধিকার রক্ষক এবং অন্যান্যকে অপরের অধিকার প্রদানে উদ্বুদ্ধকারী হিসেবে রেখে গেলেন। তাঁর পূর্বে দুনিয়া শুধু ঐসব শাসকদের সম্পর্কে অবগত ছিল যারা যুলুম নিষ্পেষণের মাধ্যমে প্রজাদেরেকে দমিত করে রাখতো এবং আকাশচুম্বী প্রাসাদে বসবাস করে নিজেদের কর্তৃত্ব-প্রভুত্ব খাটাতো। নবী মুহাম্মদ (সা) সে দুনিয়াকেই এমন সব শাসকের সাথে পরিচিত করে দিলেন, যারা হাটে-বাজারে সাধারণ মানুষের মতো চলাফেরা করতেন এবং ন্যায়-নীতি ও সুবিচার দিয়ে মানুষের মন জয় করতেন। তাঁর পূর্বে দুনিয়া ঐসব সৈনিককে জানতো যারা কোনো দেশে প্রবেশ করলে চারদিকে হত্যাকা- চালাতো, জনপদগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিত এবং বিজিত জাতির নারীদের সম্ভ্রাম সতীত্ব বিনষ্ট করতো, তিনি সেই দুনিয়াকেই আবার এমন সেনাবাহিনীর সাথে পরিচিত করে দিলেন যারা কোনো শহরে বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করলে দুশমনের সেনাবাহিনী ছাড়া কারো ওপর কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করতো না এবং বিজিত শহর থেকে আদায়কৃত কর পর্যন্ত তাদেরকে ফেফেরত দিয়ে দিত। মানব ইতিহাস বিভিন্ন দেশ ও নগর বিজয়ের কাহিনীতে ভরপুর। কিন্তু মক্কা বিজয়ের কোনো দৃষ্টান্ত ইতিহাসে পাওয়া যাবে না। যে শহরের লোকেরা তের বছর যাবৎ নবী মুহাম্মদ (সা) এর ওপর যুলুম নিষ্পেষণ করেছে সে শহরেই বিজয়ীর বেশে তাঁর প্রবেশ এমনভাবে হয়েছিল যে, আল্লাহর সামনে অবনত মস্তকে তিনি চলছিলেন। তাঁর কপাল উটের হাওদা ছোঁয়া ছোঁয়া হচ্ছিল এবং তাঁর আচরণে গর্ব অহঙ্কারের কোনো লেশ ছিল না। ঐসব লোক, যারা তের বছর ধরে অত্যাচার-উৎপীড়ন করতে থাকে, যারা রাসূলকে হিজরত করতে বাধ্য করে এবং হিজরতের পরও তাঁর বিরুদ্ধে আট বছর পর্যন্ত যুদ্ধ করে, তারা পরাজিত হয়ে যখন তাঁর সামনে হাজির হয়ে করুণা ভিক্ষা করে, তখন নবী মুহাম্মদ (সা) প্রতিশোধ নেয়ার পরিবর্তে বলেন ‘আজ তোমাদের কোনো পাকড়াও নেই। যাও, তোমাদেরকে ছেড়ে দেয়া হলো।’
নবী মুহাম্মদ (সা) এর আদর্শের প্রভাব মুসলিম উম্মাহর ওপর পড়েছে, তা যদি কেউ ধারণা করতে চায় তাহলে ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে দেখুন। সে দেখতে পাবে যে, মুসলমান যখন বিজয়ীর বেশে স্পেনে প্রবেশ করে তখন তাদের আচরণ কিরূপ ছিল এবং খ্রিষ্টানগণ যখন তাদের ওপর বিজয়ী হয় তখন তারা কোন ধরনের আচরণ করেছিল। ক্রুসেড যুদ্ধকালে যখন খ্রিস্টানগণ বায়তুল মাকদিস প্রবেশ করে তখন তারা মুসলমানদের সাথে কিরূপ আচরণ করে এবং মুসলমানগণ যখন বায়তুল মাকদিস খ্রিস্টানদের নিকট থেকে পুনঃদখল করে তখন খ্রিস্টানদের প্রতি তাদের আচরণ কিরূপ ছিল। নবী করীম (সা)-এর সিরাত এমন এক মহাসমুদ্র যা কোনো গ্রন্থেও সমাবিষ্ট করা সম্ভব নয়। আর একটি বক্তৃতায় তার চিন্তাও করা যায় না। তথাপি আমি যথাসম্ভব সংক্ষেপে তার কিছু উল্লেখযোগ্য দিকের প্রতি আলোকপাত করলাম। তাঁরাই ভাগ্যবান যাঁরা এই একমাত্র হেদায়াতের মাধ্যমে জীবনের পথনির্দেশনা লাভ করবে।