আল্লাহর পথে দাওয়াত – প্রথম পর্ব

রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে -

ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর


ভূমিকা : আল-হামদু লিল্লাহ। ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আলা রাসূলিল্লাহ। ওয়াআলা আলিহী ওয়া আসহাবিহী আজমাঈন।

আল্লাহর পথে আহবান করতেই নবী-রাসূলগণের পৃথিবীতে আগমন। মুমিনের জীবনের আন্যতম দায়িত্ব এই দাওয়াত। কোরআনুল কারিমে এ দায়িত্বকে কখনো দাওয়াত, কখনো সৎকার্যে আদেশ ও অসৎকার্যে নিষেধ, কখনো প্রচার, কখনো নসিহত ও কখনো দীন প্রতিষ্ঠা বলে অভিহিত করা হয়েছে। কোরআন ও হাদিসের আলোকে এ কাজের গুরুত্ব, এর বিধান, পুরস্কার, এ দায়িত্ব পালনে অবহেলার শাস্তি, ও কর্মে অংশগ্রহণের শর্তাবলী ও এর জন্য আবশ্যকীয় গুণাবলী আলোচনা করেছি এই পুস্তিকাটিতে। এ বিষয়ক কিছু ভুলভ্রান্তি, যেমন বিভিন্ন অজুহাতে এ দায়িত্বে অবহেলা, ফলাফলের ব্যস্ততা বা জাগতিক ফলাফল ভিত্তিক সফলতা বিচার, এ দায়িত্ব পালনে কঠোরতা ও উগ্রতা, আদেশ, নিষেধ বা দাওয়াত এবং বিচার ও শাস্তির মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়, আদেশ নিষেধ বা দাওয়াত এবং গীবত ও দোষ অনুসন্ধানের মধ্যে পার্থক্য ইত্যাদি বিষয় আলোচনা করেছি। সবশেষে এ ইবাদত পালনের ক্ষেত্রে সুন্নাতে নববী এবং এ বিষয়ক কিছু ভুলভ্রান্তির কথা আলোচনা করেছি।

হাদিসের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সহিহ বা নির্ভরযোগ্য হাদিসের উপর নির্ভর করার চেষ্টা করেছি। মুহাদ্দিসগণ অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষার মাধ্যমে হাদিসের বিশুদ্ধতা ও দুর্বলতা নির্ধারণ করেছেন, যে নিরীক্ষা-পদ্ধতি বিশ্বের যে কোনো বিচারালয়ের সাক্ষ্য-প্রমাণের নিরীক্ষার চেয়েও বেশি সূক্ষ্ম ও চুলচেরা। এর ভিত্তিতে যে সকল হাদিস সহিহ বা হাসান অর্থাৎ গ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত হয়েছে আমি আমার আলোচনায় শুধুমাত্র সে হাদিসগুলিই উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি।
অতি নগণ্য এ প্রচেষ্টাটুকু যদি কোনো আগ্রহী মুমিনকে উপকৃত করে তবে তা আমার বড় পাওয়া। কোনো সহৃদয় পাঠক দয়া করে পুস্তিকাটির বিষয়ে সমালোচনা, মতামত, সংশোধনী বা পরামর্শ প্রদান করলে তা লেখকের প্রতি তাঁর এহসান ও অনুগ্রহ বলে গণ্য হবে।
মহান আল্লাহর দরবারে সকাতরে প্রার্থনা করি, তিনি দয়া করে এ নগণ্য কর্মটুকু কবুল করে নিন এবং একে আমার, আমার পিতামাতা, স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়স্বজন ও পাঠকদের নাজাতের ওসিলা বানিয়ে দিন। আমীন!

প্রথম পরিচ্ছেদ : পরিচিতি, গুরুত্ব ও বিষয়বস্তু

১. পরিচিতি: দাওয়াহ, আমর, নাহই, তাবলীগ, নসিহত, ওয়াজ

নিজের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি নিজের আশেপাশে অবস্থানরত অন্যান্য মানুষদের মধ্যে আল্লাহর দীনকে বাস্তবায়নের চেষ্টা করা মুমিনের অন্যতম দায়িত্ব। এ জন্য মুমিনের জীবনের একটি বড় দায়িত্ব হলো -আল আমরু বিল মারুফ অয়ান নাহ্ইউ আনিল মুনকার- অর্থাৎ ন্যায় কাজের আদেশ ও অন্যায় থেকে নিষেধ করা। আদেশ ও নিষেধকে একত্রে আদ-দাওয়াতু ইলাল্লাহ বা আল্লাহর দিকে আহবান বলা হয়। এ ইবাদত পালনকারীকে দায়ী ইলাল্লাহ বা আল্লাহর দিকে আহবানকারী ও সংক্ষেপে দায়ী অর্থাৎ দাওয়াতকারী বা দাওয়াত-কর্মী বলা হয়। দাওয়াত (الدعوة) শব্দের অর্থ, আহবান করা বা ডাকা। আরবিতে (الأمر) বলতে আদেশ, নির্দেশ, উপদেশ, অনুরোধ, অনুনয় সবই বুঝায়। অনুরূপভাবে নাহই (النهي) বলতে নিষেধ, বর্জনের অনুরোধ ইত্যাদি বুঝানো হয়। কোরআন-হাদিসে এই দায়িত্ব বুঝানোর জন্য আরো অনেক পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে: তন্মধ্যে রয়েছে আত-তাবলীগ (التبليغ) আন-নাসীহাহ (النصيحة) আল-ওয়াজ (الوعظ) ইত্যাদি। আত-তাবলীগ অর্থ পৌঁছানো, প্রচার করা, খবর দেওয়া, ঘোষণা দেওয়া বা জানিয়ে দেওয়া। আন-নাসীহাহ শব্দের অর্থ আন্তরিক ভালবাসা ও কল্যাণ কামনা। এ ভালবাসা ও কল্যাণ কামনা প্রসূত ওয়াজ, উপদেশ বা পরামর্শকেও নসিহত বলা হয়। ওয়াজ বাংলায় প্রচলিত অতি পরিচিত আরবি শব্দ। এর অর্থ উপদেশ, আবেদন, প্রচার, সতর্কীকরণ ইত্যাদি। দাওয়াতের এই দায়িত্ব পালনকে কোরআনুল কারিমে ইকামতে দীন বা দীন প্রতিষ্ঠা বলে অভিহিত করা হয়েছে। এগুলি সবই একই ইবাদতের বিভিন্ন নাম এবং একই ইবাদতের বিভিন্ন দিক। পরবর্তী আলোচনা থেকে আমরা তা বুঝতে পারব, ইনশাআল্লাহ।

কোরআন-হাদিসের আলোকে দাওয়াত-এর গুরুত্ব

নবী রাসূলগণের মূল দায়িত্ব: সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ, প্রচার, নসিহত, ওয়াজ বা এককথায় আল্লাহর দীন পালনের পথে আহবান করাই ছিল সকল নবী ও রাসূলের (আলাইহিমুস সালাম) দায়িত্ব। সকল নবীই তাঁর উম্মতকে তাওহিদ ও ইবাদতের আদেশ করেছেন এবং শিরক, কুফর ও পাপকাজ থেকে নিষেধ করেছেন।
মহান আল্লাহ বলেন:

যারা অনুসরণ করে বার্তাবাহক উম্মি নবীর, যাঁর উল্লেখ তারা তাদের নিকট রক্ষিত তাওরাত ও ইনজীলে লিপিবদ্ধ পায়, যিনি তাদেরকে সৎকাজের নির্দেশ দেন এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করেন। (সূরা আরাফ: ১৫৭)
এ আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কর্মকে আদেশ ও নিষেধ নামে অভিহিত করা হয়েছে। অন্যত্র এ কর্মকে দাওয়াত বা আহবান নামে অভিহিত করা হয়েছে।
আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তাআলা বলেন:

তোমাদের কি হল যে, তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আন না, অথচ রাসূল তোমাদেরকে আহবান করছেন যে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আন। (সূরা হাদীদ: ৮)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ দায়িত্বকে দাওয়াত বা আহবান বলে অভিহিত করে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন:
আপনি আপনার প্রতিপালকের দিকে আহবান করুন হিকমত বা প্রজ্ঞা দ্বারা এবং সুন্দর ওয়াজ-উপদেশ দ্বারা এবং তাদের সাথে উৎকৃষ্টতর পদ্ধতিতে আলোচনা-বিতর্ক করুন। (সূরা নাহল: ১২৫)
অন্যত্র এই দায়িত্বকেই তাবলিগ বা প্রচার বলে অভিহিত করা হয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন:
হে রাসূল! আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তা আপনি প্রচার করুন। যদি আপনি তা না করেন তাহলে আপনি আল্লাহর বার্তা প্রচার করলেন না। (সূরা মায়েদা : ৬৭)
কোরআনুল কারিমে বারবার বলা হয়েছে যে, প্রচার বা পোঁছানোই রাসূলগণের একমাত্র দায়িত্ব। নিচের আয়াতে বলা হয়েছে:
রাসূলগণের দায়িত্ব তো কেবল সুস্পষ্টভাবে প্রচার করা। (সূরা নাহল: ৩৫)
নূহ আ.- এর জবানিতে বলা হয়েছে:
আমি আমার প্রতিপলকের রিসালাতের দায়িত্ব তোমাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি এবং আমি তোমাদের নসিহত করছি। (সূরা আরাফ: ৬২)
সূরা আরাফের ৬৮, ৭৯, ৯৩ নম্বর আয়াত, সূরা হুদ-এর ৩৪ নম্বর আয়াত ও অন্যান্য স্থানে দাওয়াতকে নসিহত বলে অভিহিত করা হয়েছে
সূরা শুরার ১৩ আয়াতে বলেছেন:

তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন দীন, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নূহকে- আর যা আমি ওহী করেছি আপনাকে- এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা এবং ঈসাকে, এ বলে যে, তোমরা দীন প্রতিষ্ঠা কর এবং তাতে দলাদলি-বিচ্ছিন্নতা করো না। আপনি মুশরিকদের যার প্রতি আহবান করছেন তা তাদের নিকট দুর্বহ মনে হয়। (সূরা শুরা: ১৩)
তাবারি, ইবনু কাসির ও অন্যান্য মুফাসসির, সাহাবি-তাবিয়ি মুফাসসিরগণ থেকে উদ্ধৃত করেছেন যে, দীন প্রতিষ্ঠার অর্থ হলো দীন পালন করা। আর দীন পরিপূর্ণ পালনের মধ্যেই রয়েছে আদেশ, নিষেধ ও দাওয়াত। এ অর্থে কোনো কোনো গবেষক দীন পালন বা নিজের জীবনে দীন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অন্যদের জীবনে দীন প্রতিষ্ঠার দাওয়াতকেও ইকামতে দীন বলে গণ্য করেছেন।

উম্মতে মুহাম্মদির অন্যতম দায়িত্ব ও বৈশিষ্ট্য

দাওয়াত, আদেশ-নিষেধ, দীন প্রতিষ্ঠা বা নসিহতের এই দায়িত্বই উম্মতে মুহাম্মদির অন্যতম দায়িত্ব ও বৈশিষ্ট্য।
ইরশাদ হয়েছে:

আর যেন তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল হয়, যারা কল্যাণের প্রতি আহবান করবে, ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই সফলকাম। (সূরা আলে ইমরান: ১০৪)
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:
তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, মানবজাতির (কল্যাণের) জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে। তোমরা ন্যায়কার্যে আদেশ এবং অন্যায় কার্যে নিষেধ কর এবং আল্লাহতে বিশ্বাস কর। (সূরা আলে ইমরান: ১১০)
প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন:
তারা আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি ঈমান রাখে এবং তারা ভাল কাজের আদেশ দেয় ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করে। আর তারা কল্যাণকর কাজে দ্রুত ধাবিত হয় এবং তারা নেককারদের অন্তর্ভুক্ত। (সূরা আলে ইমরান: ১১৪)
আল্লাহ তাবারকা ওয়া তাআলা আরও বলেন:
আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা একে অপরের বন্ধু, তারা ভাল কাজের আদেশ দেয় আর অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করে, আর তারা সালাত কায়েম করে, জাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। এদেরকে আল্লাহ শীঘ্রই দয়া করবেন, নিশ্চয় আল্লাহ পরক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (সূরা তাওবা: ৭১)
সূরা তাওবার ১১২ আয়াতে, সূরা হজ্জের ৪১ আয়াতে, সূরা লুকমানের ১৭ আয়াতে ও অন্যান্য স্থানেও উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহর প্রকৃত মুমিন বান্দাদের অন্যতম বৈশিষ্ট হলো সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ।
এভাবে আমরা দেখছি যে, ঈমান, নামাজ, রোজা ইত্যাদি ইবাদতের মত সৎকাজের নির্দেশ ও অসৎকাজের নিষেধ মুমিনের অন্যতম কর্ম। শুধু তাই নয়, মুমিনদের পারস্পারিক বন্ধুত্বের দাবি হলো যে, তারা একে অপরের আন্যায় সমর্থন করেন না, বরং একে অপরকে ন্যায়কর্মে নির্দেশ দেন এবং অন্যায় থেকে নিষেধ করেন। এখানে আরো লক্ষণীয়, এ সকল আয়াতে ঈমান, নামাজ, জাকাত ইত্যাদির আগে সৎকার্যে আদেশ ও অসৎকার্যে নিষেধ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে আমরা মুমিনের জীবনে এর সবিশেষ গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি।
এই দায়িত্বপালনকারী মুমিনকেই সর্বোত্তম বলে ঘোষণা করা হয়েছে পবিত্র কোরআনে।
মহান আল্লাহ বলেন:

ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা কথায় কে উত্তম যে আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহবান করে, সৎকর্ম করে এবং বলে, আমি তো মুসলিমদের একজন। ( সূরা ফুসসিলাত: ৩৩)
আমরা দেখেছি যে, আদেশ, নিষেধ বা দাওয়াত-এর আরেক নাম নসিহত। নসিহত বর্তমানে সাধারণভাবে উপদেশ অর্থে ব্যবহৃত হলেও মূল আরবিতে নসিহত অর্থ আন্তরিকতা ও কল্যাণ কামনা। কারো প্রতি আন্তিরকতা ও কল্যাণ কামনার বহি:প্রকাশ হলো তাকে ভাল কাজের পরামর্শ দেওয়া ও খারাপ কাজ থেকে নিষেধ করা। এ কাজটি মুমিনদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি অন্যতম দায়িত্ব। বরং এই কাজটির নামই দীন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
দীন হলো নসিহত। সাহাবিগণ বললেন, কার জন্য ? বললেন, আল্লাহর জন্য, তাঁর কিতাবের জন্য, তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য, মুসলিমগণের নেতৃবর্গের জন্য এবং সাধারণ মুসলিমদের জন্য। (মুসলিম)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ নসিহতের জন্য সাহাবিগণের বাইআত তথা প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতেন। বিভিন্ন হাদিসে জারির ইবনু আব্দুল্লাহ রা. মুগিরা ইবনু শুবা রা. প্রমুখ সাহাবি বলেন:
আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট বাইয়াত বা প্রতিজ্ঞা করেছি, সালাত কায়েম, জাকাত প্রদান ও প্রত্যেক মুসলিমের নসিহত (কল্যাণ কামনা) করার উপর। (বোখারি)।
এ অর্থে তিনি সৎকার্যে আদেশ ও অসৎকার্যে নিষেধের বাইয়াত গ্রহণ করতেন। উবাদাহ ইবনু সামিত ও অন্যান্য সাহাবি রা. বলেন:
আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে বাইয়াত করি আনুগত্যের… এবং সৎকর্মে আদেশ ও অসৎকর্মে নিষেধের এবং এ কথার উপর যে, আমরা মহিমাময় আল্লাহর জন্য কথা বলব এবং সে বিষয়ে কোন নিন্দুকের নিন্দা বা গালি গালাজের তোয়াক্কা করব না। (আহমাদ, বিভিন্ন গ্রহণযোগ্য সনদে)।

ক্ষমতা বনাম দায়িত্ব এবং ফরজে আইন বনাম ফরজে কিফায়া

আদেশ নিষেধের জন্য স্বভাবতই ক্ষমতা ও যোগ্যতার প্রয়োজন। এ জন্য যারা সমাজে ও রাষ্ট্রে দায়িত্ব ও ক্ষমতায় রয়েছেন তাদের জন্য এ দায়িত্ব অধিকাংশ ক্ষেত্রে ফরজে আইন বা ব্যক্তিগতভাবে ফরজ। দায়িত্ব ও ক্ষমতা যত বেশি, আদেশ ও নিষেধের দায়িত্বও তত বেশি। আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার ভয়ও তাদের তত বেশি। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
যাদেরকে আমি পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করলে বা ক্ষমতাবান করলে তারা সালাত কায়েম করে, জাকাত দেয়, সৎকার্যে নির্দেশ দেয় এবং অসৎকার্যে নিষেধ করে। আর সকল কর্মের পরিণাম আল্লাহর এখতিয়ারে। (সূরা হজ্জ : ৪১)
এ জন্য এ বিষয়ে শাসকগোষ্ঠী, প্রশাসনের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ, আঞ্চলিক প্রশাসকবর্গ, বিচারকবর্গ, আলিমগণ, বুদ্ধিজীবিবর্গ ও সমাজের অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের দায়িত্ব অন্যদের চেয়ে বেশি, তাদের জন্য আশংকাও বেশি। তাদের মধ্যে কেউ যদি দায়িত্ব পালন না করে নিশ্চুপ থাকেন তবে তার পরিণতি হবে কঠিন ও ভয়াবহ।
অনুরূপভাবে নিজের পরিবার, নিজের অধীনস্থ মানুষগণ ও নিজের প্রভাবাধীন মানুষদের আদেশ-নিষেধ করা গৃহকর্তা বা কর্মকর্তার জন্য ফরজে আইন। কারণ আল্লাহ তাকে এদের উপর ক্ষমতাবান ও দায়িত্বশীল করেছেন এবং তিনি তাকে এদের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

সাবধান! তোমরা সকলেই অভিভাবকত্বের দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং প্রত্যেকেই তার দায়িত্বাধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। মানুষদের উপর দায়িত্বপ্রাপ্ত শাসক বা প্রশাসক, অভিভাবক এবং তাকে তার অধীনস্ত জনগণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। বাড়ির কর্তাব্যক্তি তার পরিবারের সদস্যদের দায়িত্বপ্রাপ্ত অভিভাবক এবং তাকে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে। স্ত্রী তার স্বামীর বাড়ি ও তার সন্তান-সন্ততির দায়িত্বপ্রাপ্তা এবং তাকে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে। (বোখারি ও মুসলিম)।
কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, অন্যায় ও অসৎকর্মের প্রতিবাদ করা শুধুমাত্র এদেরই দায়িত্ব। বরং তা সকল মুসলমানের দায়িত্ব। যিনি অন্যায় বা গর্হিত কর্ম দেখবেন তার উপরেই দায়িত্ব হয়ে যাবে সাধ্য ও সুযোগমত তার সংশোধন বা প্রতিকার করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
তোমাদের কেউ যদি কোনো অন্যায় দেখতে পায় তবে সে তাকে তার বাহুবল দিয়ে প্রতিহত করবে। যদি তাতে সক্ষম না হয় তবে সে তার বক্তব্যের মাধ্যমে (প্রতিবাদ) তা পরিবর্তন করবে। এতেও যদি সক্ষম না হয় তা হলে অন্তর দিয়ে তার পরিবর্তন (কামনা ) করবে। আর এটা হলো ঈমানের দুর্বলতম পর্যায়। (মুসলিম)।
এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, প্রত্যেক মুমিনেরই দায়িত্ব হলো, অন্যায় দেখতে পেলে সাধ্য ও সুযোগ মত তার পরিবর্তন বা সংশোধন করা। এক্ষেত্রে অন্যায়কে অন্তর থেকে ঘৃণা করা এবং এর অবসান ও প্রতিকার কামনা করা প্রত্যেক মুমিনের উপরেই ফরজ। অন্যায়ের প্রতি হৃদয়ের বিরক্তি ও ঘৃণা না থাকা ঈমান হারানোর লক্ষণ। আমরা অগণিত পাপ, কুফর, হারাম ও নিষিদ্ধ কর্মের সয়লাবের মধ্যে বাস করি। বারংবার দেখতে দেখতে আমাদের মনের বিরক্তি ও আপত্তি কমে যায়। তখন মনে হতে থাকে, এ তো স্বাভাবিক বা এ তো হতেই পারে। পাপকে অন্তর থেকে মেনে নেওয়ার এ অবস্থাই হলো ঈমান হারানোর অবস্থা। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা নিষেধ করেছেন বা যা পাপ ও অন্যায় তাকে ঘৃণা করতে হবে, যদিও তা আমার নিজের দ্বারা সংঘটিত হয় বা বিশ্বের সকল মানুষ তা করেন। এ হলো ঈমানের নূন্যতম দাবী।
উপরের আয়াত ও হাদিস থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে ক্ষমতার ভিত্তিতে এই ইবাদতটির দায়িত্ব বর্তাবে। এ জন্য ফকীহগণ উল্লেখ করেছেন যে, দীন প্রতিষ্ঠা বা দাওয়াত ও আদেশ নিষেধের এ ইবাদতটি সাধারণভাবে ফরজে কিফায়া।
যদি সমাজের একাধিক মানুষ কোনো অন্যায় বা শরিয়ত বিরোধী কর্মের কথা জানতে পারেন বা দেখতে পান তাহলে তার প্রতিবাদ বা প্রতিকার করা তাদের সকলের উপর সামষ্টিকভাবে ফরজ বা ফরজে কিফায়া। তাদের মধ্য থেকে কোনো একজন যদি এ দায়িত্ব পালন করেন তবে তিনি ইবাদতটি পালনের সাওয়াব পাবেন এবং বাকিদের জন্য তা মূলত: নফল ইবাদতে পরিণত হবে। বাকি মানুষেরা তা পালন করলে সাওয়াব পাবেন, তবে পালন না করলে গোনাহগার হবেন না। আর যদি কেউই তা পালন না করেন তাহলে সকলেই পাপী হবেন।
দুইটি কারণে তা ফরজে আইন বা ব্যক্তিগত ফরজে পরিণত হয়:
  • প্রথমত: ক্ষমতা। যদি কেউ জানতে পারেন যে, তিনিই এ অন্যায়টির প্রতিকার করার ক্ষমতা রাখেন তাহলে তার জন্য তা ফরজে আইন-এ পরিণত হয়। পরিবারের অভিভাবক, এলাকার বা দেশের রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও নেতৃবৃন্দের জন্য এ দায়িত্বটি এ পর্যায়ে ফরজে আইন। এ ছাড়া যে কোনো পরিস্থিতিতে যদি কেউ বুঝতে পারেন যে, তিনি হস্তক্ষেপ করলে বা কথা বললে অন্যায়টি বন্ধ হবে বা ন্যায়টি প্রতিষ্ঠিত হবে তবে তা তার জন্য ফরজে আইন বা ব্যক্তিগতভাবে ফরজ হবে।
  • দ্বিতীয়ত: দেখা। যদি কেউ জানতে পারেন যে, তিনি ছাড়া অন্য কেউ অন্যায়টি দেখেনি বা জানেনি, তবে তার জন্য তা নিষেধ করা ও পরিত্যাগের জন্য দাওয়াত দেওয়া ফরজে আইন বা ব্যক্তিগত ফরজ এ-পরিণত হয়। সর্বাবস্থায় এ প্রতিবাদ, প্রতিকার ও দাওয়াত হবে সাধ্যানুযায়ী হাত দিয়ে মুখ দিয়ে বা অন্তর দিয়ে।
আল্লাহর পথে দাওয়াত-এর বিষয়বস্তু দাওয়াত, আদেশ, নিষেধ, ওয়াজ, নসিহত ইত্যাদির বিষয়বস্তু কী? আমরা কোন কোন বিষয়ের দাওয়াত বা আদেশ-নিষেধ করব? কোন বিষয়ের কতটুকু গুরুত্ব দিতে হবে? আমরা কি শুধুমাত্র নামাজ রোজা ইত্যাদি ইবাদতের জন্য দাওয়াত প্রদান করব? নাকি চিকিৎসা, ব্যবসা, শিক্ষা, সমাজ, মানবাধিকার, সততা ইত্যাদি বিষয়েও দাওয়াত প্রদান করব? আমরা কি শুধু মানুষদের জন্যই দাওয়াত প্রদান করব? নাকি আমরা জীব-জানোয়ার, প্রকৃতি ও পরিবেশের কল্যাণেও দাওয়াত ও আদেশ-নিষেধ করব?
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। ঈমান, বিশ্বাস, ইবাদত, মুআমালাত ইত্যাদি সকল বিষয়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর বিস্তারিত নির্দেশনা রয়েছে। সকল বিষয়ই দাওয়াতের বিষয়। কিছু বিষয় বাদ দিয়ে শুধুমাত্র কিছু বিষয়ের মধ্যে দাওয়াতকে সীমাবদ্ধ করার অধিকার মুমিনকে দেওয়া হয়নি। তবে গুরুত্বগত পার্থক্য রয়েছে। দাওয়াতের সংবিধান কোরআনুল কারিম ও হাদিস শরিফে যে বিষয়গুলির প্রতি দাওয়াতের বেশি গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে, মুমিনও সেগুলির প্রতি বেশি গুরুত্ব প্রদান করবেন।
আমরা জানি যে, কোরআন ও হাদিসে প্রদত্ত গুরুত্ব অনুসারে মুমিন জীবনের কর্মগুলিকে বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। ফরজে আইন, ফরজে কিফায়া, ওয়াজিব, সুন্নাত, মুসতাহাব, হারাম, মাকরূহ, মুবাহ ইত্যাদি পরিভাষাগুলি আমাদের নিকট পরিচিত। কিন্তু অনেক সময় আমরা ফজিলতের কথা বলতে যেয়ে আবেগ বা অজ্ঞতা বসত এক্ষেত্রে মারাত্মক ভুল করে থাকি। নফল-মুসতাহাব কর্মের দাওয়াত দিতে যেয়ে ফরজ, ওয়াজেব কর্মের কথা ভুলে যাই বা অবহেলা করি। এছাড়া অনেক সময় মুসতাহাবের ফজিলত বলতে যেয়ে হারামের ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা বলা হয় না।
কোরআন-হাদিসের দাওয়াত পদ্ধতি থেকে আমরা দাওয়াত ও দীন প্রতিষ্ঠার আদেশ নিষেধের বিষয়াবলীর গুরুত্বের পর্যায় নিম্নরূপ দেখতে পাই।
  • প্রথমত: তাওহিদ ও রিসালাতের বিশুদ্ধ ঈমান অর্জন ও সর্ব প্রকার শিরক, কুফর ও নিফাক থেকে আত্মরক্ষা সকল নবীরই দাওয়াতের বিষয় ছিল প্রথমত: এটি। কোরআন-হাদিসে এ বিষয়ের দাওয়াতই সবচেয়ে বেশি দেওয়া হয়েছে। একদিকে যেমন তাওহিদের বিধানাবলী বিস্তারিত বর্ণনা করে তাওহিদ প্রতিষ্ঠার দাওয়াত দেওয়া হয়েছে, তেমনি বারংবার শিরক, কুফর ও নিফাকের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে তা থেকে নিষেধ করা হয়েছে।বর্তমান সময়ে দীনের পথে দাওয়াতে ব্যস্ত অধিকাংশ দায়ী এই বিষয়টিতে ভয়ানকভাবে অবহেলা করেন। আমরা চিন্তা করি যে, আমরা তো মুমিনদেরকেই দাওয়াত দিচ্ছি। কাজেই ঈমান-আকিদা বা তাওহিদের বিষয়ে দাওয়াত দেওয়ার বা শিরক-কুফর থেকে নিষেধ করার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। অথচ মহান আল্লাহ বলেন:
    তাদের অধিকাংশ আল্লাহর উপর ঈমান আনায়ন করে, তবে (ইবাদতে) শিরক করা অবস্থায়। (সূরা ইউসুফ: ১০৬ )
    হাদিস শরিফে মুমিনদেরকে বারংবার শিরক কুফর থেকে সাবধান করা হয়েছে। শিরক, কুফর ও নিফাক মুক্ত বিশুদ্ধ তাওহিদ ও রিসালাতের ঈমান ছাড়া নামাজ, রোজা, দাওয়াত, জিহাদ, জিকর, তাযকিয়া ইত্যাদি সকল ফরজ বা নফল ইবাদতই অর্থহীন।
  • দ্বিতীয়ত: বান্দার বা সৃষ্টির অধিকার সংশ্লিষ্ট হারাম বর্জনআমরা জানি ফরজকর্ম দুই প্রকার, করণীয় ফরজ ও বর্জনীয় ফরজ। যা বর্জন করা ফরজ তাকে হারাম বলা হয়। হারাম দুই প্রকার, প্রথম প্রকার হারাম, মানুষ ও সৃষ্টির অধিকার নষ্ট করা বা তাদের কোনো ক্ষতি করা বিষয়ক হারাম। এগুলি বর্জন করা সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ।পিতামাতা, স্ত্রী, সন্তান, অধীনস্ত, সহকর্মী, প্রতিবেশী, দরিদ্র, এতিম ও অন্যান্য সকলের অধিকার সঠিকভাবে আদায় করা, কোনোভাবে কারো অধিকার নষ্ট না করা, কাউকে জুলুম না করা, গীবত না করা, ওজন-পরিমাপ ইত্যাদিতে কম না করা, প্রতিজ্ঞা, চুক্তি, দায়িত্ব বা আমানত আদায়ে আবহেলা না করা, হারাম উপার্জন থেকে আত্মরক্ষা করা, নিজের বা আত্মীয়দের বিরুদ্ধে হলেও ন্যয় কথা বলা ও ন্যয় বিচার করা, কাফির শত্রুদের পক্ষে হলেও ন্যয়ানুগ পন্থায় বিচার-ফয়সালা করা ইত্যাদি বিষয় কোরআন ও হাদিসের দাওয়াত ও আদেশ নিষেধের অন্যতম গুরিত্বপূর্ণ বিষয়।এমনকি রাস্তাঘাট, মজলিস, সমাজ বা পরিবেশে কাউকে কষ্ট দেওয়া এবং কারো অসুবিধা সৃষ্টি করাকেও হাদিস শরিফে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। সৃষ্টির অধিকার বলতে শুধু মানুষদের অধিকারই বুঝানো হয়নি। পশুপাখির অধিকার সংরক্ষণ, মানুষের প্রয়োজন ছাড়া কোনো প্রাণীকে কষ্ট না দেওয়া ইত্যাদি বিষয়ে অত্যন্ত কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়েছে। দাওয়াতের ক্ষেত্রে অনেক সময় এ বিষয়গুলি অবহেলিত। এমনকি অনেক দায়ী বা দাওয়াতকর্মীও এ সকল অপরাধে জড়িত হয়ে পড়েন।
    যেকোনো কর্মস্থলে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীর জন্য কর্মস্থলের দায়িত্ব পরিপূর্ণ আন্তরিকতার সাথে সঠিকভাবে পালন করা ফরজে আইন। যদি কেউ নিজের কর্মস্থলে ফরজ সেবা গ্রহণের জন্য আগত ব্যক্তিকে ফরজ সেবা প্রদান না করে তাকে পরদিন আসতে বলেন বা একঘন্টা বসিয়ে রেখে চাশতের নামাজ আদায় করেন বা দাওয়াতে অংশ গ্রহণ করেন তাহলে তিনি মূলত: ঐ ব্যক্তির মত কর্ম করছেন, যে ব্যক্তি পাগড়ির ফজিলতের কথায় মোহিত হয়ে লুঙ্গি খুলে উলঙ্গ হয়ে পাগড়ি পরেছেন।
    অধিকার ও দায়িত্ব বিষয়ক আদেশ-নিষেধ কোরআন হাদিসে বেশি থাকলেও আমরা এ সকল বিষয়ে বেশি আগ্রহী নই। কর্মকর্তা, কর্মচারী, শিক্ষক, ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্যদেরকে কর্মস্থলে দায়িত্ব পালন ও আন্তরিকতার সাথে সেবা প্রদানের বিষয়ে দাওয়াত ও আদেশ নিষেধ করতে আমরা আগ্রহী নই। অবৈধ পার্কিং করে, রাস্তার উপর বাজার বসিয়ে, রাস্তা বন্ধ করে মিটিং করে বা অনুরূপ কোনোভাবে মানুষের কষ্ট দেওয়া, অপ্রয়োজনীয় ধোঁয়া, গ্যাস, শব্দ ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের বা জীব জানোয়ারের কষ্ট দেওয়া বা প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা, দাওয়াত বা আদেশ-নিষেধ করাকে আমরা অনেকেই আল্লাহর পথে দাওয়াতের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করি না। বরং এগুলিকে জাগতিক, দুনিয়াবী বা আধুনিক বলে মনে করি।
  • তৃতীয়ত: পরিবার ও অধীনস্তদেরকে ইসলাম অনুসারে পরিচালিত করাবান্দার হক, বা মানবাধিকার বিষয়ক দায়িত্ব সমূহের অন্যতম হলো নিজের দায়িত্বাধীনদেরকে দীনের দাওয়াত দেওয়া ও দীনের পথে পরিচালিত করা। দাওয়াতকর্মী বা দায়ী নিজে যেমন এ বিষয়ে সতর্ক হবেন, তেমনি বিষয়টি দাওয়াতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে গ্রহণ করবেন। 
  • চতুর্থত: অন্যান্য হারাম বর্জন করাহত্যা, মদপান, রক্তপান, শুকরের মাংস ভক্ষণ, ব্যভিচার, মিথ্যা, জুয়া, হিংসা-বিদ্বেষ, অহংকার, রিয়া ইত্যাদিও হারাম। দায়ী বা দাওয়াতকর্মী নিজে এ সব থেকে নিজের কর্ম ও হৃদয়কে পবিত্র করবেন এবং এগুলি থেকে পবিত্র হওয়ার জন্য দাওয়াত প্রদান করবেন। আমরা দেখতে পাই যে, কুরাআন ও হাদিসে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বারংবার বিভিন্নভাবে এবিষয়ক দাওয়াত প্রদান করা হয়েছে।
  • পঞ্চমত: পালনীয় ফরজ-ওয়াজিবগুলি আদায় করানামাজ, জাকাত, রোজা, হজ্জ, হালাল উপার্জন, ফরজে আইন পর্যায়ের ইলম শিক্ষা ইত্যাদি এ জাতীয় ফরজ ইবাদত এবং দাওয়াতের অন্যতম বিষয়।
  • ষষ্ঠত: সৃষ্টির উপকার ও কল্যাণমূলক সুন্নাত-নফল ইবাদত করাসকল সৃষ্টিকে তার অধিকার বুঝে দেওয়া ফরজ। অধিকারের অতিরিক্ত সকলকে যথাসাধ্য সাহায্য ও উপকার করা কোরআন হাদিসের আলোকে সর্বশ্রেষ্ঠ নফল ইবাদত এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সবচেয়ে সহজ ও প্রিয়তম পথ। ক্ষুধার্তকে আহার দেওয়া, দরিদ্রকে দারিদ্রমুক্ত করা, বিপদগ্রস্থকে বিপদ হতে মুক্ত হতে সাহায্য করা, অসুস্থকে দেখতে যাওয়া, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং যে কোনোভাবে যে কোনো মানুষের বা সৃষ্টির কল্যাণ, সেবা বা উপকারে সামান্যতম কর্ম আল্লাহর নিকট অত্যন্ত প্রিয়। কোরআন ও হাদিসে এ সকল বিষয়ে বারংবার দাওয়াত ও আদেশ নিষেধ করা হয়েছে।
  • সপ্তমত: আল্লাহ ও তাঁর বান্দার মধ্যকার সুন্নত-নফল ইবাদত করানফল নামাজ, রোজা, যিকির, তিলাওয়াত, ফরজে কিফায়া বা নফল পর্যায়ের দাওয়াত, তাবলিগ, জিহাদ, নসিহত, তাযকিয়া ইত্যাদি এ পর্যায়ের। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দাওয়াতে রত মুমিনগণ ষষ্ঠ পর্যায়ের নফল ইবাদতের চেয়ে সপ্তম পর্যায়ের নফল ইবাদতের দাওয়াত বেশি প্রদান করেন। বিশেষত, দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান তৈরি, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, চিকিৎসা সেবা প্রদান ইত্যাদি বিষয়ের দাওয়াত প্রদানকে আমরা আল্লাহর পথে দাওয়াত বলে মনেই করি না। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মানুষ ছাড়া অন্য কোনো জীব-জানোয়ারও যদি কোনো অন্যায় বা ক্ষতির কর্মে লিপ্ত থাকে সাধ্য ও সুযোগমত তার প্রতিকার করাও আদেশ নিষেধ ও কল্যাণ কামনার অংশ। যেমন কারো পশু বিপদে পড়তে যাচ্ছে বা কারো ফসল নষ্ট করছে দেখতে পেলে মুমিনের দায়িত্ব হল সুযোগ ও সাধ্যমত তার প্রতিকার করা। তিনি এই কর্মের জন্য আদেশ-নিষেধ ও নসিহতের সাওয়াব লাভ করবেন। পূর্ববর্তী যুগের প্রাজ্ঞ আলেমগণ এ সকল বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে অনেকেই এ সকল বিষয়কে আল্লাহর পথে দাওয়াত বা দীন প্রতিষ্ঠার অংশ বলে বুঝতে পারেন না। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর সন্তুষ্টির পথে পরিচালিত করুন।