হানাফি মাযহাবে কি কিছু কিছু মাদক দ্রব্য হালাল ?


হানাফি মাযহাবে কি কিছু কিছু মাদক দ্রব্য হালাল ?

প্রশ্ন : হেদায়া তৃতীয় ও চতুর্থ খণ্ড অধ্যয়নরত জনৈক ছাত্র কয়েকদিন আগে আমার কাছে আসে এবং ঐ কিতাবের এক জায়গা বুঝিয়ে দেয়ার জন্য আমাকে অনুরোধ জানায়। আমি একটু সময় চেয়ে নিয়ে বললাম, জায়গাটা আমি আগে পড়ে দেখি তারপর বুঝিয়ে দেবো। দু:খের বিষয়, আমি নিজে এখনো ঐ জায়গাটা বুঁঝতে পারিনি। আর সে জন্য আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। লক্ষ্য করুণ, মাদক দ্রব্য সংক্রান্ত অধ্যয় :

"উল্লেখিত বক্তব্যটি থেকে সুস্পষ্টভাবে জানা যায় যে, ইমাম আবু হানিফার মতে গম, জব, মধু ও ভুট্টা দিয়ে যে উত্তেজক পানীয় তৈরি করা হয়, তা যদি মাদকতা আনে , তবুও তা হালাল এবং তা পানকারি নেশাগ্রস্ত হলেও মদখোরের জন্য নির্ধারিত দণ্ডে সে দণ্ডিত হবেনা। এবং ঘুমন্ত লোকের তালাক যেমন স্ত্রীর উপর কার্যকর হয়না, এই মাদক সেবির প্রদত্ত তালাকও কার্যকর হবেনা।" অথচ আল্লাহর রসূল সা. বলেছেন :
---------------------------------------------------------------------------------
"প্রত্যেক মাদক দ্রব্যই হারাম। মদ হারাম করা হয়েছে, আর যে জিনিস মাদকতা আনে, সেটাই মদ।"
বস্তুত, এই কারণেই যারা কুরআন ও হাদিসের প্রকাশ্য বক্তব্য অনুসরণের পক্ষপাতি এবং কোনো মাযহাবের ধার ধারেননা, সেই 'আসহাবুজ জাওয়াহের' গোষ্ঠির লেখকগণ লিখেছেন যে, হানাফি মাযহাবে মদ হালাল। (নাউজুবিল্লাহ) অনুগ্রহপূর্বক এ বিষয়টি বুঝিয়ে দেবেন।

জবাব : হেদায়া থেকে আপনি যে অংশটুকু উদ্ধৃত করেছেন তা থেকে পুরো বক্তব্য স্পষ্ট হয়না। বক্তব্যটি শুরু থেকে এ রকম :
"জামে সগির গ্রন্থের মূল বক্তব্য এতোটুকুই যে, ইমাম আবু হানিফার মতে আঙ্গুর ও খেজুর দিয়ে যে মাদক তৈরি করা হয়, তা ছাড়া অন্যান্য পানীয় দ্রব্যে আপত্তি নেই।" এর পরের যে অংশটুকু আপনি উদ্ধৃত ও অনুবাদ করেছেন, তা ইমাম আবু হানিফার বক্তব্য নয়। ওটা অন্যান্য লোকদের নিজস্ব গবেষণাপ্রসূত বক্তব্য। বিশেষত: 'তা পানকারি নেশাগ্রস্ত হ'লেও শাস্তিযোগ্য নয়।'
এই উক্তিটাতো জামে সগিরেও নেই, আর ইমাম সাহেবের বক্তব্যের এরূপ মর্ম উদ্ধার করারও কোনো অবকাশ নেই। কিছু দূরে গিয়ে হেদায়া গ্রন্থে বলা হয়েছে :
---------------------------------------------------------------------------------
অর্থাৎ জামে সগির গ্রন্থের প্রণেতা ইমাম মুহাম্মদ বলেন যে, গম, জব, মধু, চাল ইত্যাদি থেকে যে মাদক পানীয় তৈরি হয়, তাও হারাম এবং তা খেয়ে যে ব্যক্তি মাতাল হবে সেও অন্যান্য হারাম মাদক সেবির মতোই শাস্তিযোগ্য হবে। পররর্তীতে আরো বলা হয়েছে :
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
উপরোক্ত অংশ থেকে বুঝা গেলো বিবিধ রকমের নির্যাসও ইমাম আবু হানিফা ও আবু ইউসুফের মতে কেবল তখনই হালাল, যখন তা কোনো প্রমোদ ফূর্তির উদ্দেশ্যে সেবন করা হবেনা, (বরং কোনো অনিবার্য পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র পুষ্টি ও শক্তি আরহণের জন্য সেবন করা হবে)। এখান থেকে এ কথাও জানা গেলো যে, ইমাম মুহাম্মদ সব ধরণের মাদক সেবনকেই শাস্তিযোগ্য বলে বায় দিয়েছেন এবং খাদ্যশস্য থেকে নির্যাসকৃত ও জ্বাল দিয়ে প্রস্তুত করা মাদক পানীয়কেও মদ বলে গণ্য করেছেন। কেননা সুস্পষ্ট ও পথচারী লোকেরা এগুলোর কাছে ব্যাপকভাবে ভিড় জমায়। দুররুল মুখতার গ্রন্থের নিম্মোক্ত উক্তি থেকে এ বক্তব্যের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় :
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
"খেজুর ও কিসমিসের নির্যাস সামান্য আঁচে জ্বাল দিলে যদি ঘন হয়ে যায়, তবুও তা সেবন করা বৈধ, যদি তা আমোদ ফূর্তির উদ্দেশ্যে পান না করা হয় এবং যদি তা মাদকতা না আনে। কিন্তু যদি আমোদ ফূর্তির উদ্দেশ্যে খাওয়া হয়, তবে তা কম বা বেশি যা-ই খাওয়া হোক, হারাম। আর যে পরিমাণ খেলে মাদকতা আসবে বলে প্রবল ধারণা জন্মে তা হারাম হবে।"

মধু, গম, জব ইত্যাদির ব্যাপারেও একই মত ব্যক্ত করার পর ঐ গ্রন্থে বলা হয় :
---------------------------------------------------------------------------------
"অর্থাৎ খাদ্য হিসেবে বা ওষুধ হিসেবে ছাড়া নিছক সখের বশে খাওয়া সর্বসম্মতভাবে হারাম।" ইমাম আবু হানিফার এই অভিমত বিশ্লেষণ করার পর এতে আরো বলা হয় :
---------------------------------------------------------------------------------
"এই বক্তব্য থেকে বুঝা যায় যে, এ ধরণের সকল মাদক পানীয় পরিমাণ নির্বিশেষে সম্পর্ণরূপে হারাম।"
এই সমগ্র আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, ইমাম আবু হানিফা বা হানাফি ফকীহগণের মধ্য হতে কেউ কেউ এ ব্যাপারে কোনো তারতম্য করে থাকলেও তার উদ্দেশ্য অকাট্যভাবে নিষিদ্ধ মদের সাথে ইজতিহাদি প্রক্রিয়ায় নিষিদ্ধ ঘোষিত অন্যান্য মাদক দ্রব্যের পার্থক্য ব্যক্ত করা ছাড়া আর কিছু নয়। অন্যান্য মাদক দ্রব্য যতোক্ষণ অনাচার ও দুষ্কর্মের প্ররোচনা না দেয়, ততোক্ষণ তারা তাকে হালাল ও নির্দোষ আখ্যায়িত করেছেন। এটা কেবল একটা আইনগত ব্যবধান ছিলো এবং এটাই তারা তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। নচেত তারা এক বা দু'ধরণের মদ বাদে আর সকল মাদক দ্রব্যকে হালাল করে দেবেন এমন উদ্দেশ্য তাদের কখনো ছিলো না। ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টির একমাত্র কারণ হলো, জামে সগিরের উক্তির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হেদায়ার গ্রন্থকার ----------- "যদিও তাতে মাদকতা আসে" এই কথাটা লিখে দিয়েছেন। এ কথাটা তিনি কিসের ভিত্তিতে লিখলেন তা অজ্ঞাত। তাছাড়া ------------ ('তারা বলেছেন' এবং 'বলা হয়েছে') কথাটা দ্বারা হেদায়াতে কাদের মতামত লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তাও বুঝা যায়না।

সার কথা এই যে, ইমাম আবু হানিফা বা হানাফি ইমামদের বরাত দিয়ে এ কথা বলা কোনোক্রমেই সঠিক নয় যে, তারা শুধু আঙ্গুর বা খেজুরজাত মদকেই হারাম বলে রায় দিতেন আর বাদ বাকী সকল মাদক দ্রব্যকে শর্তহীনভাবে ও সর্বোতভাবে হালাল বলে অভিহিত করতেন। [তরজমানুল কুরআন, মার্চ ১৯৫৮]