বৈধ ও অবৈধ গীবত !

মুহাম্মদ হামিদুল ইসলাম আজাদ 
গীবত করার পরিণামঃ
গীবত কবীরা গুনাহ্ অন্তর্ভুক্ত । গীবতের পাপ সুদ অপেক্ষা বড়; বরং হাদীসে গীবতকে বড় সুদ বলা হয়েছে (সহীহ আত্তারগীব) রাসূলুল্লাহ্সাঃ এর নিকটে আয়েশা (রা) ছাফিইয়া (রা)-এর সমালোচনা করতে গিয়ে বলেনঃ হে আল্লাহ্ রাসূল সাঃ! আপনার জন্য ছাফিইয়ার এরকম এরকম হওয়াই যথেষ্ট ।
এর দ্বারা তিনি ছাফিইয়ার বেঁটে সাইজ বুঝাতে চেয়েছিলেন । এতদশ্রবণে নাবী কারীম সাঃ বললেনঃহে আয়েশা! তুমি এমন কথা বললে, যদি তা সাগরের পানির সঙ্গে মিশানো যেত তবে তার রং তা বদলে দিত আবূ দাউদ, তিরমিযী, হাদিস সহীহ্‌, সহীহুল জামেঃ ৫১৪০; মিশকাত ৪৮৪৩
গীবত জাহান্নামে শাস্তি ভোগের কারণঃ রাসূলুল্লাহ্সাঃ বলেনঃমিরাজ কালে আমি এমন কিছু লোকের নিকট দিয়ে অতিক্রম করলাম, যাদের নখগুলি পিতলের তৈরি, তারা তা দিয়ে তাদের মুখমণ্ডল বক্ষগুলিকে ছিঁড়ছিল। আমি জিজ্ঞাস করলাম, এরা কারা হে জিবরীল? তিনি বললেনঃ এরা তারাই যারা মানুষের গোশত খেত এবং তাদের ইজ্জত-আবরু বিনষ্ট করত আবূ দাউদ, মুসনাদে আহমাদ, হাদিস সহীহ্
গীবত ব্যাভিচারের চেয়েও মারাত্মক গুনাহঃ
আবু সায়িদ ও জাবের রাঃ থেকে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘গীবত ব্যাভিচারের চেয়েও মারাত্মক গুনাহসাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, এটা কিভাবে? তিনি বললেন, ব্যক্তি ব্যভিচার করার পর তওবা করলে তার গোনাহ মাফ হয়ে যায়কিন্তু গীবত যে করে তার গোনাহ আক্রান্ত প্রতিপক্ষের ক্ষমা না করা পর্যন্ত মাফ হয় না 
সুতরাং এ কথা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হল যে, গীবত একটি জঘন্য পাপাচারএ থেকে সবাইকে সতর্কতার সাথে বিরত থাকতে হবে
গীবত মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার শামিলঃ আল্লাহ্তাআলা বলেনঃ
وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا ۚ أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَن يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ  وَاتَّقُوا اللَّهَ ۚ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَّحِيمٌ
তোমাদের কেউ যেন কারো গীবত না করে, তোমাদের কেউ কি চায় যে, সে তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করবে? তোমরা তো এটাকে ঘৃণাই করে থাকো [সূরা হুজুরাতঃ ১২]
অত্র আয়াত প্রমাণ করে যে, গীবত করা মৃত ব্যক্তির গোশত ভক্ষণ করার শামিল আনাস ইবন মালেক (রা) বলেনঃ আরবরা সফরে বের হলে একে অপরের খেদমত করত । আবু বকর ওমর (রা)-এর সাথে একজন খাদেম ছিল । (একবার সফর অবস্থায়) ঘুম থেকে তারা উভয়ে জাগ্রত হয়ে দেখেন যে, তাদের খাদেম তাদের জন্য খানা প্রস্তুত করেনি, তখন তারা পরস্পরকে বললেন, দেখ এই ব্যক্তিটি বাড়ির ঘুমের ন্যায় ঘুমাচ্ছে (অর্থাৎ এমনভাবে নিদ্রায় বিভোর যে, মনে হচ্ছে সে বাড়িতেই রয়েছে, সফরে নয়) অতঃপর তারা তাকে জাগিয়ে দিয়ে বললেনঃ রাসূলুল্লাহ্সাঃ এর কাছে যাও এবং বল আবু বকর ওমর আপনাকে সালাম দিয়েছেন এবং আপনার কাছে তরকারী চেয়ে পাঠিয়েছেন (নাস্তা খাওয়ার জন্য) লোকটি রাসূলুল্লাহ সাঃ এর নিকটে গেলে তিনি [রাসূলুল্লাহ্সাঃ] বললেনঃ তারাতো তরকারী খেয়েছে, তখন তারা বিস্মিত হলেন এবং নাবী কারীম সাঃ এর নিকটে এসে বললেনঃ হে আল্লাহ্ রাসূল সাঃ ! আমরা আপনার নিকটে এসে লোক পাঠালাম তরকারী তলব করে, অথচ আপনি বলেছেন, আমরা তরকারী খেয়েছি? তখন নাবী কারীম সাঃ বললেনঃ তোমরা তোমাদের ভাইয়ের (খাদেমের) গোশত খেয়েছ। কসম সত্তার! যার হাতে আমার প্রাণ, নিশ্চয়ই আমি খাদেমটির গোশত তোমাদের সামনের দাঁতের ফাঁক দিয়ে দেখতে পাচ্ছি। তারা বললেনঃ [ইয়া রাসূলুল্লাহ্সাঃ] আপনি আমাদের জন্য ক্ষমা তলব করুন । আলবানী হাদিসটিকে সহিহ্বলেছেন । দ্রষ্টব্য আমাসিক আলায়কা লিসানাকা (কুয়েত ১ম সংস্করণ ১৯৯৭ইং)
আব্দুল্লাহ্ইবন মাসউদ (রা) বলেনঃ (একদা) আমরা নাবী কারীম সাঃ -এর নিকটে ছিলাম । এমতাবস্থায় একজন ব্যক্তি উঠে চলে গেল । তার প্রস্থানের পর একজন তার সমালোচনা করল । তখন রাসূলুল্লাহ্সাঃ তাকে বললেনঃ তোমার দাঁত খিলাল কর । লোকটি বললঃ কি কারণে দাঁত খিলাল করব? আমিতো কোন গোশত ভক্ষণ করিনি । তখন তিনি বললেনঃ নিশ্চয়ই তুমি তোমার ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করেছ অর্থাৎগীবতকরেছ । ত্বাবারানী, ইবন আবী শায়বা, হাদিস সহীহ্দ্রষ্টব্য গায়াতুল মারামঃ ৪২৮
গীবত কবরে শাস্তি ভোগের অন্যতম কারণঃ একদা রাসূলুল্লাহ্সাঃ দুটি কবরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন । হঠাৎ তিনি থমকে দাঁড়ালেন এবং বললেনঃএই দুই কবরবাসীকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে । তবে তাদেরকে তেমন বড় কোন অপরাধে শাস্তি দেওয়া হচ্ছেনা (যা পালন করা তাদের পক্ষে কষ্টকর ছিল) এদের একজনকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, চুগলখোরী করার কারণে এবং অন্যজনকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে পেশাবের ব্যাপারে অসতর্কতার কারনে । বুখারী, মুসলিম, সহিহ্আত-তারগীবঃ ১৫৭
অপর হাদিসে চুগলখোরীর পরিবর্তে গীবত করার কথা উল্লেখ রয়েছে । আহমাদ প্রভৃতি, সহিহ্আত-তারগীবঃ ১৬০পবিত্রতাঅধ্যায়
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এসব বাণী থেকে প্রমাণিত হয় যে, কারো বিরুদ্ধে তার অনুপস্থিতিতে মিথ্যা অভিযোগ করাই অপবাদ আর তার সত্যকির দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করা গীবত কাজ স্পষ্ট বক্তব্যের মাধ্যমে করা হোক বা ইশারা ইংগিতের মাধ্যমে করা হোক সর্বাবস্থায় হারাম অনুরূপভাবে কাজ ব্যক্তির জীবদ্দাশায় করা হোক বা মৃত্যুর পরে করা হোক উভয় অবস্থায়ই তা সমানভাবে হারাম আবু দাউদের হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, মায়েয ইবনে মালেক আসলামীর বিরুদ্ধে ব্যভিচারের অপরাধে 'রজম' করার শাস্তি কার্যকর করার পর নবী সাঃ পথে চলতে চলতে শুনলেন এক ব্যক্তি তার সংগীকে বলছেঃ লোকটার ব্যাপারটাই দেখো, আল্লাহ তার অপরাধ আড়াল করে দিয়েছিলেন কিন্তু যতক্ষণ না তাকে কুকুরের মত হত্যা করা হয়েছে ততক্ষণ তার প্রবৃত্তি তার পিছু ছাড়েনি সামনে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে একটি গাধার গলিত মৃতদেহ দৃষ্টিগোচর হলো নবী সাঃ সেখানে থেমে গেলেন এবং দু'ব্যক্তিকে ডেকে বললেনঃ "তোমরা দু'জন ওখানে গিয়ে গাধার মৃত দেহটা আহার করো " তারা দুজনে বললোঃ হে আল্লাহর রসূল, কেউ কি তা খেতে পারে৷ নবী সাঃ বললেনঃ "তোমরা এইমাত্র তোমাদের ভাইয়ের সম্মান মর্যাদার ওপর যেভাবে আক্রমণ চালাচ্ছিলে তা গাধার মৃতদেহ খাওয়ার চেয়ে অনেক বেশী নোংরা কাজ "
যেসব ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে বা তার মৃত্যুর পর তার মন্দ দিকগুলো বর্ণনা করার এমন কোন প্রয়োজন দেখা দেয় যা শরীয়াতের দৃষ্টিতে সঠিক এবং গীবত ছাড়া প্রয়োজন পূরণ হতে পারে, আর প্রয়োজনের পূরণের জন্য গীবত না করা হলে তার চেয়েও অধিক মন্দ কাজ অপরিহার্য হয়ে পড়ে এমন ক্ষেত্রসমূহ গীবত হারাম হওয়া সম্পর্কিত নির্দেশের অন্তরভুক্ত নয় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যক্তিক্রমকে মূলনীতি হিসেবে এভাবে বর্ণনা করেছেনঃ
"কোন মুসলমানের মান-মর্যাদার ওপর অন্যায়ভাবে আক্রমণ করা জঘণ্যতম জুলুম "
বাণীতে "অন্যায়ভাবে"কথাটি বলে শর্তযুক্ত করাতে বুঝা যায় যে, ন্যায়ভাবে এরূপ করা জায়েজ নবীর সাঃ নিজের কর্মপদ্ধতির মধ্যে এমন কয়েকটি নজীর দেখতে পাই যা থেকে জানা যায় ন্যায়ভাবে বলতে কি বুঝানো হয়েছে এবং কি রকম পরিস্থিতিতে প্রয়োজন গীবত করা জায়েজ হতে পারে
একবার এক বেদুঈন এসে নবীর সাঃ পিছনে নামাযে শামিল হলো এবং নামায শেষ হওয়া মাত্রই একথা বলে প্রস্থান করলো যে, হে আল্লাহ! আমার ওপর রহম করো এবং মুহাম্মাদের ওপর রহম করো আমাদের দুজন ছাড়া আর কাউকে রহমতের মধ্যে শরীক করো না নবী সাঃ সাহাবীদের বললেনঃ "তোমরা কি বলো, লোকটাই বেশী বেকুফ, না তার উট৷ তোমরা কি শুননি সে কি বলেছিলো ৷ (আবু দাউদ)
নবীকে সাঃ তার অনুপস্থিতিতেই একথা বলতে হয়েছে কারণ সালাম ফেরানো মাত্রই সে চলে গিয়েছিল নবীর উপস্থিতিতেই সে একটি ভুল কথা বলে ফেলেছিলো তাই ব্যাপারে তাঁর নিশ্চুপ থাকা কাউকে ভ্রান্তিতে ফেলতে পারতো যে, সময় বিশেষ এরূপ কথা বলা হয় তো জায়েয তাই নবী সাঃ কর্তৃক একথার প্রতিবাদ করা জরুরী হয়ে পড়েছিলো
ফাতেমা বিনতে কায়েস নামক এক মহিলাকে দু' ব্যক্তি বিয়ের প্রস্তাব দেন একজন হযরত মুয়াবিয়া (রা) অপরজন আবুল জাহম (রা) ফাতেমা বিনতে কায়েস নবীর সাঃ কাছে এসে পরামর্শ চাইলে তিনি বললেনঃ মুয়াবিয়া গরীব আর আবুল জাহম স্ত্রীদের বেদম প্রহার করে থাকে (বুখারী মুসলিম)
এখারে একজন নারীর ভবিষ্যত জীবনের প্রশ্ন জড়িত ছিল সে নবীর সাঃ কাছে ব্যাপারে পরামর্শ চেয়েছিল এমতাবস্থায় উভয় ব্যক্তির যে দুর্বলতা দোষ-ক্রটি তাঁর জানা ছিল তা তাকে জানিয়ে দেয়া তিনি জরুরী মনে করলেন
একদিন নবী সাঃ হযরত আয়েশার (রা) ঘরে ছিলেন এক ব্যক্তি এসে সাক্ষাতের অনুমতি প্রার্থনা করলে তিনি বললেনঃ ব্যক্তি তার গোত্রের অত্যন্ত খারাপ লোক এরপর তিনি বাইরে গেলে এবং তার সাথে অত্যন্ত সৌজন্যের সাথে কথাবার্তা বললেন নবী সাঃ ঘরে ফিরে আসলে হযরত আয়েশা  রাঃ বললেনঃ আপনি তো তার সাথে ভালোভাবে কথাবার্তা বললেন অথব যাওয়ার সময় আপনি তার সম্পর্কে কথা বলেছিলেন জবাবে নবী সাঃ বললেনঃ"যে ব্যক্তির কটু বাক্যের ভয়ে লোকজন তার সাথে উঠাবসা পরিত্যাগ করে কিয়ামতের দিন সে হবে আল্লাহ তা'আলর কাছে জঘন্যতম ব্যক্তি " (বুখারীও মুসলিম)
ঘটনা সম্পর্কে যদি চিন্তা করে তাহলে বুঝতে পারবেন ব্যক্তি সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করা সত্ত্বেও নবী সাঃ তার সাথে সুন্দরভাবে কথাবার্তা বলেছেন জন্য যে, নবীর সাঃ উত্তম স্বভাব এটিই দাবী করে কিন্তু সাথে সাথে তিনি আশংকা করলেনঃ লোকটির সাথে তাঁকে দয়া সৌজন্য প্রকাশ করতে দেখে তার পরিবারের লোকজন তাঁকে তার বন্ধু বলে মনে করে বসতে পারে তাহলে পরে কোন সময় সে এর সুযোগ নিয়ে কোন অবৈধ সুবিধা অর্জন করতে পারে তাই তিনি হযরত আয়েশাকে সতর্ক করে দিলেন যে, সে তার গোত্রের জঘণ্যতম মানুষ
এক সময় হযরত আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা বিনতে উতবা এসে নবীকে সাঃ বললো, "আবু সুফিয়ান একজন কৃপণ লোক আমার আমার সন্তানের প্রয়োজন পূরণের জন্য যথেষ্ট হতে পারে এমন অর্থকড়ি সে দেয় না " (বুখারী মুসলিম) স্বামীর অনুপস্থিতিতে স্ত্রীর পক্ষে থেকে স্বামীর ধরনের অভিযোগ যদিও গীবতের পর্যায়ে পড়ে কিন্তু নবী সাঃ তা বৈধ করে দিয়েছেন কারণ জুলুমের প্রতিকার করতে পারে এমন ব্যক্তির কাছে জুলুমের অভিযোগ নিয়ে যাওয়ার অধিকার মজলুমের আছে
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের এসব দৃষ্টান্তের আলোকে ফকীহ হাদীস বিশারদগণ বিধি প্রণয়ন করেছেন যে, গীবত কেবল তখনই বৈধ যখন একটি সংগত (অর্থাৎ শরীয়াতের দৃষ্টিতে সংগত) কোন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তার প্রয়োজন পড়ে এবং প্রয়োজন গীবত ছাড়া পূরণ হতে পারে না সুতরাং বিধির ওপর ভিত্তি করে আলেমগণ নিম্নরূপ গীবতকে বৈধ বলে ঘোষণা করেছেনঃ
একঃ যে ব্যক্তি জুলুমের প্রতিকারের জন্য কিছু করতে পারে বলে আশা করা যায় এমন ব্যক্তির কাছে জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের ফরিয়াদ
দুইঃ সংশোধনের উদ্দেশ্যে এমন ব্যক্তিদের কাছে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অপকর্মের কথা বলা যারা তার প্রতিকার করতে পারবেন বলে আশা করা যায়
তিনঃ ফতোয়া চাওয়ার উদ্দেশ্যে কোন মুফতির কাছে প্রকৃত ঘটনা বর্ণনার সময় যদি কোন ব্যক্তির ভ্রান্ত কাজ-কর্মের উল্লেখ করা প্রয়োজন হয়
চারঃ মানুষকে কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের অপকর্মের ক্ষতি থেকে রক্ষা করার জন্য সাবধান করে দেয়া
যেমনঃ হাদীস বর্ণনাকারী, সাক্ষী এবং গ্রন্থ প্রণেতাদের দূর্বলতা ক্রুটি-বিচ্যুতি বর্ণনা করা সর্বসম্মত মতে প্রচারণা শুধু জায়েযই নয়, বরং ওয়াজিব কেননা, ছাড়া শরীয়াতকে ভুল রেওয়ায়াতের প্রচারণা বিস্তার থেকে , আদালতসমূহকে বেইনসাফী থেকে এবং জনসাধারণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষার্থীদেরকে গোমরাহী থেকে রক্ষা করা সম্ভব নয় অথবা উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোন ব্যক্তি কারো সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে আগ্রহী কিংবা কারো বাড়ীর পাশে বাড়ী খরিদ করতে চায় অথবা কারো সাথে অংশীদারী কারবার করতে চায় অথবা কারো কাছে আমানত রাখতে চায় সে আপনার কাছে পরামর্শ চাইলে তাকে সে ব্যক্তির দোষ-ত্রুটি ভাল মন্দ সম্পর্কে অবহিত করা আপনার জন্য ওয়াজিব যাতে না জানার কারণে সে প্রতারিত না হয়
পাঁচঃ যেসব লোক গোনাহ পাপকার্যের বিস্তার ঘটাচ্ছে অথবা বিদআত গোমরাহীর প্রচার চালাচ্ছে অথবা আল্লাহর বান্দাদেরকে ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ড জুলুম-নির্যাতনের মধ্যে নিক্ষেপ করেছে তাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সোচ্ছার হওয়া এবং তাদের দুষ্কর্ম অপকীর্তির সমালোচনা করা
যেমন উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদা এক ব্যক্তি (মাখরামা ইবনে নওফেল) নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে সাক্ষাতের অনুমতি প্রার্থনা করলেনতখন তিনি বললেন, তাকে আসার অনুমতি দাও, সে গোত্রের কতই না নিকৃষ্ট লোকঅতঃপর তিনি তার সাথে প্রশস্ত চেহারায় তাকালেন এবং হাসিমুখে কথা বললেনঅতঃপর লোকটি চলে গেলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি তার সম্পর্কে এমন কথা বলেছেন, অতঃপর আপনিই প্রশস্ত চেহারায় তার প্রতি তাকালেন এবং হাসিমুখে কথা বললেনএ কথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে আয়েশা, তুমি কি কখনো আমাকে অশ্লীলভাষী পেয়েছ ? নিশ্চয়ই কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালার কাছে মর্যাদার দিক দিয়ে সর্বাধিক নিকৃষ্ট সেই লোক হবে, যাকে মানুষ তার অনিষ্টের ভয়ে ত্যাগ করেছে। (বুখারি, মুসলিম)
ছয়ঃ যেসব লোক কোন মন্দ নাম বা উপাধীতে এতই বিখ্যাত হয়েছে যে, নাম উপাধি ছাড়া অন্য কোন নাম বা উপাধি দ্বারা তাদেরকে আর চেনা যায় না তাদের মর্যাদা হানির উদ্দেশ্যে নয়, বরং পরিচায়দানের জন্য নাম উপাধী ব্যবহার করা
(বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, ফাতহুল বারী, ১০ম খন্ড, পৃষ্ঠা, ৩৬২; শরহে মুসলিম-নববী, বাবঃ তাহরীমুল গীবাত রিয়াদুস সালেহীন, বাবঃ মা ইউবাহু মিনাল গীবাত আহকামুল কুরআন-জাস্সাস রুহুল মা'আনী-লা ইয়াগতার বাদুকুম বাদান-আয়াতের তাফসীর, তাফহীমুল কুরআন, ফী যিলালিল কোরআন)
ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রগুলো ছাড়া অসাক্ষাতে কারো নিন্দাবাদ একেবারেই হারাম নিন্দাবাদ সত্য বাস্তব ভিত্তিক হলে তা গীবত, মিথ্যা হলে অপবাধ এবং দুজনের মধ্যে বিবাবদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে হলে চোখলখুরী ইসলামী শরীয়াত তিনটি জিনিসকেই হারাম করে দিয়েছেন ইসলামী সমাজে প্রত্যেক মুসলমানদের কর্তব্য হচ্ছে যদি তার সামনে অন্য কোন ব্যক্তির ওপর মিথ্যা অপবাধ আরোপ করা হতে থাকে তাহলে সে যেন চুপ করে তা না শোনে বরং তা প্রতিবাদ করে আর যদি কোন বৈধ শরিয়ী প্রয়োজন ছাড়া কারো সত্যিকার দোষ-ত্রুটিও বর্ণনা করা হতে থাকে তাহলে কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদেরকে আল্লাহর ভয় করতে এবং গোনাহ থেকে বিরত থাকতে উপদেশ দিতে হবে
নবী সাঃ বলেছেনঃ "যদি কোন ব্যক্তি এমন পরিস্থিতিতে কোন মুসলমানকে সাহায্য না করে যেখানে তাকে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে এবং তার মান-ইজ্জতের ওপর হামলা করা হচ্ছে তাহলে আল্লাহ তা'আলাও তাকে সেসব ক্ষেত্রে সাহায্য করবেন না যেখানে সে তার সাহায্যের প্রত্যাশা করে আর যদি কোন ব্যক্তি এমন পরিস্থিতিতে কোন মুসলমানকে সাহায্য করে যখন তার মান-ইজ্জতের ওপর হামলা করা হচ্ছে এবং তাকে লাঞ্ছিত হেয় করা হচ্ছে তাহলে মহান পরাক্রমশালী আল্লাহ তাকে এমন পরিস্থিতিতে সাহায্য করবেন যখন সে আল্লাহর সাহায্যের প্রত্যাশী হবে " (আবু দাউদ)
গীবতকারী ব্যক্তি যখনই উপলব্ধি করবে যে, সে গোনাহ করছে অথবা কারে ফেলেছে তখন তার প্রথম কর্তব্য হলো আল্লাহর কাছে তাওবা করা এবং হারাম কাজ থেকে বিরত থাকা এরপর তার ওপর দ্বিতীয় যে কর্তব্য বর্তায় তা হচ্ছে, যতদূর সম্ভব গোনাহের ক্ষতিপূরণ করা সে যদি কোন মৃত ব্যক্তির গীবত করে থাকে তাহলে সে ব্যক্তির মাগফিরাতের জন্য অধিক মাত্রায় দোয়া করবে যদি কোন জীবিত ব্যক্তির গীবত করে থাকে এবং তা অসত্যও হয় তাহলে যাদের সাক্ষাতে সে অপবাদ আরোপ করেছিল তাদের সাক্ষাতেই তা প্রত্যাহার করবে আর যদি সত্য বাস্তব বিষয়ে গীবত করে থাকে তাহলে ভবিষ্যতে আর কখনো তার নিন্দাবাদ করবে না তাছাড়া যার নিন্দাবাদ করেছিল তার কাছে মাফ চেয়ে নেবে একদল আলেমের মতে, যার গীবত করা হয়েছে সে যদি বিষয়ে অবহিত হয়ে থাকে, কেবল তখনই ক্ষমা চাওয়া উচিত অন্যথায় অবহিত না থাকে এবং গীবতকারী তার কাছে গিয়ে বলে, আমি তোমার গীবত করেছিলাম তাহলে তা তার জন্য মনোকষ্টের কারণ হবে
আয়াতাংশে আল্লাহ তা'আলা গীবতকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করে কাজের চরম ঘৃণিত হওয়ার ধারণা দিয়েছেন মৃতের গোশত খাওয়া এমনিতেই ঘৃণা ব্যাপার সে গোশত যখন অন্য কোন জন্তুর না হয়ে মানুষের হয়, আর সে মানুষটিও নিজের আপন ভাই হয় তাহলে তো কোন কথাই নেই তারপর উপমাকে প্রশ্নের আকারে পেশ করে আরো অধিক কার্যকর বানিয়ে দেয়া হয়েছে যাতে প্রত্যেক ব্যক্তির নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করে নিজেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে যে, সে কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে প্রস্তুত আছে৷ সে যদি তা খেতে রাজি না হয় এবং তার প্রবৃত্তি এতে ঘৃণাবোধ করে তাহলে সে কিভাবে কাজ পছন্দ করতে পারে যে, সে তার কোন মু'মিন ভাইয়ের অনুপস্থিততে তার মান মর্যাদার ওপর হামলা চালাবে যেখানে সে তা প্রতিরোধ করতে পারে না, এমনকি সে জানেও না যে, তাকে বেইজ্জতি করা হচ্ছে আয়াতাংশ থেকে একথাও জানা গেল যে, গীবত হারাম হওয়ার মূল কারণ যার গীবত করা হয়েছে তার মনোকষ্ট নয় বরং কোন ব্যক্তির অসাক্ষাতে তার নিন্দাবাদ করা আদতেই হারাম , চাই সে সম্পর্কে অবহিত হোক বা না হোক কিংবা কাজ দ্বারা সে কষ্ট পেয়ে থাক বা না থাক সবারই জানা কথা, মৃত ব্যক্তির গোশত খাওয়া জন্য হারাম নয় যে, তাতে মৃত ব্যক্তির কষ্ট হয় মৃত্যুর পর কে তার লাশ ছিঁড়ে খাবলে খাচ্ছে তা মৃত্যুর জানার কথা নয় কিন্তু সেটা আদতেই অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ অনুরূপ , যার গীবত করা হয়েছে , কোনভাবে যদি তার কাছে খবর না পৌছে তাহলে কোথায় কোন ব্যক্তি কখন কাদের সামনে তার মান-ইজ্জতের ওপর হামলা করেছিল এবং তার ফলস্বরূপ কার কার দৃষ্টিতে সে নীচ হীন সাব্যস্ত হয়েছিল, তা সে সারা জীবনেও জানতে পারবে না না জানার কারণে গীবত দ্বারা সে আদৌ কোন কষ্ট পাবে না কিন্তু এতে অবশ্যই তার মর্যাদাহানি হবে তাই ধরণ প্রকৃতির দিক থেকে কাজটি মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া থেকে ভিন্ন কিছু নয় ।
গীবত থেকে বেঁচে থাকার উপায়ঃ

গীবত থেকে বেঁচে থাকা অত্যন্ত জরুরিএ থেকে বাঁচার প্রথম উপায় হচ্ছে অপরের কল্যাণ কামনা করাকেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘দীন হচ্ছে নিছক কল্যাণ কামনা করা
দ্বিতীয়ত, আত্মত্যাগ অর্থাৎ যেকোনো প্রয়োজনে অপর ভাইকে অগ্রাধিকার দেয়া
যেমন আল্লাহ সূরা হাশরের ৯ নম্বর আয়াতে এরশাদ করেছেন,
وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ ﴿9﴾
তারা নিজের ওপর অন্যদের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেয়, যদিও তারা অনটনের মধ্যে থাকে
তৃতীয়ত, অপরের অপরাধকে ক্ষমা করে দেয়া
চতুর্থত, মহৎ ব্যক্তিদের জীবনী বেশি বেশি করে অধ্যয়ন করা
শেষ কথা আমাদের সব সময় আল্লাহতায়ালার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে তিনি যেন অনুগ্রহ করে গীবতের মতো জঘন্য সামাজিক ব্যাধিতে আমাদের নিমজ্জিত হতে না দেন ক্ষেত্রে জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে সর্বাগ্রেকেননা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
বান্দা যখন ভোরে নিদ্রা থেকে জাগ্রত হয় তখন শরীরের সব অঙ্গ জিহ্বার কাছে আরজ করে, তুমি আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো, আল্লাহর নাফরমানি কাজে পরিচালিত করো নাকেননা, তুমি যদি ঠিক থাক, তবে আমরা সঠিক পথে থাকবকিন্তু যদি তুমি বাঁকা পথে চলো, তবে আমরাও বাঁকা হয়ে যাবো। (তিরমিজি)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যত্র বলেছেন,
যে ব্যক্তি আমার জন্য তার জিহ্বা ও লজ্জাস্থানের জিম্মাদার হবে, আমি তার জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হবো ’ (বুখারি)
তাই সকল মুসলমানের উচিৎ গীবত থেকে বেচে চলা । আল্লাহ তাআলা আমাদের কে গীবত থেকে বেচে চলার তাওফীক দান করুন । আমীন…………………