ডা: সাখাওয়াত হুসাইন
মাদরাসা শিক্ষাকে আধুনিকায়নের নামে অভিন্ন পাঠ্যপুস্তক চালুর মাধ্যমে আলিয়া নেসাবের মাদরাসা শিক্ষার স্বাতন্ত্র্য নষ্ট করে মাদরাসা শিক্ষা অকার্যকর করার আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। আরবি সাহিত্য, কুরআন-হাদিস, ফিকহ, নাহু-ছরফসহ কয়েকটি বিষয় ছাড়া বাকি সবক্ষেত্রে স্কুলের পাঠ্যপুস্তক পড়ানো হচ্ছে। বইয়ের কাভারে ইবতেদায়ি বা দাখিল লেখা থাকলেও বই মূলত স্কুলের।
শিক্ষার্থীদের হাতে যে পাঠ্যপুস্তক তুলে দেয়া হয়েছে, তাতে মাদরাসাছাত্রদের হিন্দুত্ববাদ পড়তে বাধ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ। ইসলামি চেতনাসম্পন্ন প্রবন্ধ, গল্প ও কবিতা বাদ দিয়ে সেখানে দেয়া হয়েছে পৌত্তলিকতাবাদী ও নাস্তিক্যবাদী গল্প-কবিতা। মাদরাসার সিলেবাসেও একইভাবে পরিবর্তন আনা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলা সাহিত্য বইয়ের ১৪৪টি কবিতা ও গল্পের মধ্যে ৭৫টি অমুসলিম ও ধর্মহীন ব্যক্তিদের। বাকি ৬৯টি গল্প-কবিতার মধ্যে স্থান পায়নি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি ফররুখ আহমদ, কায়কোবাদ, গোলাম মোস্তফাসহ আরো অনেকের ইসলামি ভাবধারার গল্প-কবিতা।
এক শ্রেণীর লোক একমুখী শিক্ষার কথা বলে মাদরাসা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের কাছে আমাদের প্রশ্ন, বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ সৃষ্টির জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকে যেমন, ডাক্তারি পড়তে হলে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হতে হয়। সেখানে মেডিক্যালের বিষয়ের প্রতিই গুরুত্ব দেয়া হয়। ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় অথবা পলিটেকনিক্যাল কলেজে ভর্তি হতে হয়। সেখানে ওই বিষয়গুলো পড়লে সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়া যায়। এমনিভাবে প্রত্যেক বিষয়েই বিশেষজ্ঞ তৈরির জন্য স্ব স্ব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। তাহলে কেউ কুরআন-সুন্নাহর বিশেষজ্ঞ আলেম হতে চাইলে তাকে অবশ্যই মাদরাসায় পড়তে হবে। মাদরাসার শিক্ষার্থীরা আগে দ্বীনি ইলম অর্জনের প্রতি গুরুত্ব দেবেন, এটাই স্বাভাবিক।
সরকার মাদরাসা ও সাধারণ শিক্ষাকে একীভূত করার দিকেই এগোচ্ছে। একজন অভিভাবক বা শিক্ষার্থী যখন দেখবেন মাদরাসা ও স্কুল-কলেজের বই অভিন্ন, তখন মাদরাসায় পড়া ও পড়ানোর আগ্রহ হারাবেন। ফলে মাদরাসায় শিক্ষার্থী কমে যাবে। তখন মাদরাসা বন্ধের জন্য কোনো ঘোষণা দিতে হবে না। যারা মাদরাসাছাত্রদের ‘সমান অধিকার’ দেয়ার কথা বলে অভিন্ন সিলেবাস পড়তে বাধ্য করছেন, একজন মাদরাসার ছাত্র মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের আগের কোর্স কারিকুলাম পড়ে যে যোগ্যতা অর্জন করত সেখানে সমস্যা কী ছিল? মাদরাসার ছাত্ররা বাংলা ও ইংরেজি পড়েই তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে। উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে- দারুননাজাত সিদ্দিকীয়া কামিল মাদরাসার এক ছাত্র আরিফুল ইসলাম ২০০৯-১০ সেশনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খ ও ঘ ইউনিটে মেধা তালিকায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার ও রাজনীতি, ভূগোল ও পরিবেশ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে, অর্থনীতিতে, সাংবাদিকতায় ও লোকপ্রশাসনে মেধাতালিকায় ১ম, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন মুসলিম বিধানে মেধাতালিকায় ১ম, বিবিএতে মেধাতালিকায় ১ম ও জগন্নাথবিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে মেধা তালিকায় ছিল। এ রকম অনেক ছাত্রের নাম দেয়া যাবে যারা মাদরাসায় পড়েই মেডিক্যালে, বুয়েটে, কারিগরি, কৃষিতে ভালো ফল করছে। তাহলে মাদরাসায় অভিন্ন সিলেবাস পড়ানোর উদ্দেশ্য মাদরাসাছাত্রদের উন্নয়ন নয়, এ শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করার গভীর চক্রান্ত বলে আশঙ্কা হওয়াই স্বাভাবিক।
প্রস্তাবিত আইনে মাদরাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে দাখিল ও আলিমপর্যায়ে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ গণিত, বাংলাদেশ স্টাডিজ, জলবায়ু পরিবর্তনসহ পরিবেশ পরিচিতি এবং বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয় বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কওমি মাদরাসা শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং কওমি মাদরাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার পদক্ষেপ নেয়ার কথা আইনে উল্লেখ রয়েছে।
খসড়া শিক্ষা আইনের ৭ এর ২, ৩, ১১ ও ১২ নম্বর উপধারায় বর্ণিত নির্ধারিত পাঠ্যসূচির বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এনসিটিবির অনুমোদন ছাড়া স্কুল বা মাদরাসায় পাঠ্যবই পড়ানোর সুযোগ থাকবে না। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এর মাধ্যমে এ ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ চূড়ান্ত করা হলো।
কিভাবে বইগুলো বদলে ফেলা হয়েছে দেখা যাক।
স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে আপত্তিকর অনুপ্রবেশের বিষয়গুলো হচ্ছে- ১. দ্বিতীয় শ্রেণী- বাদ দেয়া হয়েছে ‘সবাই মিলে করি কাজ’ শিরোনামে শেষ নবী সা:-এর সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত। ২. তৃতীয় শ্রেণী- বাদ দেয়া হয়েছে ‘খলিফা হজরত আবু বকর’ শীর্ষক জীবনচরিত। ৩. চতুর্থ শ্রেণী- খলিফা হজরত ওমরের জীবনচরিত বাদ। ৪. পঞ্চম শ্রেণী- ‘বিদায় হজ’ নামক শেষ নবী সা: সংশ্লিষ্ট লেখাটি বাদ দেয়া হয়েছে। ৫. পঞ্চম শ্রেণী- বাদ দেয়া হয়েছে কাজী কাদের নেওয়াজের লিখিত ‘শিক্ষা গুরুর মর্যাদা’ নামক বিখ্যাত কবিতা। এতে বাদশাহ আলমগীরের মহত্ত্ব এবং শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত, তা বর্ণনা করা হয়েছে। ৬. পঞ্চম শ্রেণী- শহীদ তিতুমীর নামক লেখা বাদ দেয়া হয়েছে। ৭. ষষ্ঠ শ্রেণী- ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখিত ‘সততার পুরস্কার’ নামক একটি ধর্মীয় শিক্ষণীয় ঘটনা বাদ দেয়া হয়েছে। ৮. ষষ্ঠ শ্রেণী- মহাকবি কায়কোবাদের লেখা ‘প্রার্থনা’ কবিতাটি বাদ দেয়া হয়েছে। ৯. সপ্তম শ্রেণী- বাদ পড়েছে ‘মরু ভাস্কর’ নামক শেষ নবী সা:-এর সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত। ১০. অষ্টম শ্রেণী- বাদ দেয়া হয়েছে ‘বাবরের মহত্ত্ব’ কবিতাটি। ১১. অষ্টম শ্রেণী- বাদ দেয়া হয়েছে বেগম সুফিয়া কামালের লেখা ‘প্রার্থনা’ কবিতা। ১২. নবম-দশম শ্রেণী- সর্বপ্রথম বাদ দেয়া হয়েছে মধ্যযুগের বাংলা কবি শাহ মুহম্মদ সগীরের লেখা ‘বন্দনা’ নামক ইসলাম ধর্মভিত্তিক কবিতা। ১৩. নবম-দশম শ্রেণী- এরপর বাদ দেয়া হয়েছে মধ্যযুগের মুসলিম কবি ‘আলাওল’-এর ধর্মভিত্তিক ‘হামদ’ নামক কবিতাটি। ১৪. একই শ্রেণী- আরো বাদ দেয়া হয়েছে মধ্যযুগের মুসলিম কবি আব্দুল হাকিমের লেখা বিখ্যাত ‘বঙ্গবাণী’ কবিতাটি। ১৫. নবম-দশম শ্রেণী- বাদ দেয়া হয়েছে ‘জীবন বিনিময়’ কবিতাটি। এটি মুঘল বাদশাহ বাবর ও তার পুত্র হুমায়ুনকে নিয়ে লেখা। ১৬. নবম-দশম শ্রেণী- বাদ দেয়া হয়েছে নজরুলের লেখা বিখ্যাত ‘উমর ফারুক’ কবিতাটি। স্কুলের নতুন পাঠ্যবইয়ে নিচের বিষয়গুলো যুক্ত করা হয়েছে- ১. পঞ্চম শ্রেণী- হুমায়ুন আজাদ লিখিত ‘বই’ নামক কবিতা, যা মূলত পবিত্র কুরআনবিরোধী। ২. ষষ্ঠ শ্রেণী- প্রবেশ করানো হয়েছে ‘বাংলাদেশের হৃদয়’ নামক একটি কবিতা। এখানে রয়েছে ‘দেবী দুর্গা’র প্রশংসা। ৩. ষষ্ঠ শ্রেণী- সংযুক্ত হয়েছে ‘লাল গরুটা’ নামক একটি ছোট গল্প, যা দিয়ে শেখানো হচ্ছে গরু হচ্ছে মায়ের মতো। ৪. নবম-দশম শ্রেণী- প্রবেশ করেছে ‘আমার সন্তান’ নামক একটি কবিতা। এটি হিন্দুদের ধর্ম সম্পর্কিত ‘মঙ্গল কাব্য’-এর অন্তর্ভুক্ত, যা দেবী অন্নপূর্ণার প্রশংসা ও তার কাছে প্রার্থনাসূচক কবিতা। ৫. নবম-দশম শ্রেণী- অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ভারতের পর্যটন স্পট ‘পালামৌ’-এর ভ্রমণ কাহিনী। ৬. নবম-দশম শ্রেণী- পড়ানো হচ্ছে ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ শিরোনামে বাউলদের বিকৃত যৌনাচারের কাহিনী। ৭. নবম-দশম শ্রেণী- ‘সাঁকোটা দুলছে’ শিরোনামের কবিতা দিয়ে ’৪৭-এর দেশভাগকে হেয় করা হয়েছে, যা দিয়ে কৌশলে ‘দুই বাংলা এক করে দেয়া’, অর্থাৎ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী শিক্ষা দেয়া হচ্ছে।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে এই গল্প, কবিতাগুলো কেন বাদ দেয়া হলো তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। সহজেই বোঝা যায় ইসলাম, মুসলিম কিংবা ইসলামের মর্মবাণীর সাথে সম্পৃক্ত কোনো কিছু যাতে শিক্ষার্থীরা পড়তে না পারে সেই উদ্দেশ্যে এগুলো বাদ দেয়া হয়েছে। এনসিটিবি ইসলামমুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
লেখক : প্রবন্ধকার -