পূর্ণ মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না

মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব
ইসলাম কাউকে জবরদস্তিমূলক ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করে না। কিন্তু ইসলামকে খেলার পাত্র হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগও কাউকে দেয় না। আজ ইসলাম গ্রহণ করবে, কাল ইসলাম পরিত্যাগ করবে, এই সুযোগ দেয়া হলে ইসলাম একটি খেলার বস্তুতে পরিণত হয়ে যাবে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে রাসূল সা:-এর জামানায় ইহুদিরা ধরনের ষড়যন্ত্র করত। তারা বলত, ঈমানদারদের ওপর যা নাজিল হয়েছে, দিনের শুরুতে তা বিশ্বাস করো এবং দিনের শেষে তা প্রত্যাখ্যান করো, হয়তো তারা (মুমিনগণ) দ্বীন থেকে ফিরে যাবে। (সূরা আলে ইমরান : ৭২)

ইসলাম গ্রহণ করার পর ইসলামি আদর্শের ওপর অবিচল থাকা বাধ্যতামূলক। ইসলামের সব আইনকানুনকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা অপরিহার্য। কোনো আইনকানুন বাস্তবায়নে শিথিলতা দেখানো অমার্জনীয় অপরাধ। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন :
হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণরূপে ইসলামে প্রবেশ করো। সুতরাং ইসলাম পরিত্যাগ করা কঠিন অন্যায় বলে বিবেচিত। কারণেই রিদ্দাত (ইসলাম পরিত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করা বা নাস্তিক্যবাদে বিশ্বাস করা) ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্য অপরাধ। কারণ রিদ্দাতের দ্বারা ব্যক্তির আকিদা-বিশ্বাস পরিবর্তন হয়ে যায়। সে ধ্বংসাত্মক আকিদা-বিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়ে যায়। অথচ ইসলামি সমাজের মূল ভিত্তি হচ্ছে আকিদা-বিশ্বাস। আকিদা-বিশ্বাসই ইসলামি জীবনব্যবস্থার ভিত চালিকাশক্তি। কাজেই এই ভিতে হাত দেয়ার সুযোগ ইসলাম কাউকে দেয়নি। যেকোনোভাবে এই ভিতের ক্ষতিসাধন করা মারাত্মক অপরাধ বলে বিবেচিত হয়। তা ছাড়া রিদ্দাত সমাজদেহের জন্যও অতি ভয়াবহ। সমাজদেহকে ভাঙন অবক্ষয় থেকে রক্ষা করার জন্য রিদ্দাতের ঘৃণ্যতা পরিষ্কারভাবে কুরআন হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। আল কুরআন বলছে, তোমাদের মধ্যে যে কেউ স্বীয় দ্বীন ত্যাগ করে এবং কাফের রূপে মারা যায়, দুনিয়া আখিরাতে তাদের কর্ম নিষ্ফল হয়ে যায়। তারাই অগ্নিবাসী, সেখানেই তারা স্থায়ীভাবে থাকবে। (সূরা বাকারা : ২১৭)
এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর কোনো বিধিবিধান নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒ করাকে ঈমানের পর কাফের হয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা দিয়েছেন। এমনকি কোনো বিধান নিয়ে হাসিঠাট্টার ছলে হোক, কথার ছলে হোক কিংবা সিরিয়াস অবস্থায় হোক, যেকোনো অবস্থায় হোক, এগুলোর কোনো একটিকে নিয়ে বিদ্রƒ করা কুফরি। মক্কার মুনাফিকরা রাসূল সা: তাঁর সাহাবিগণকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒ করত, চোখের ইঙ্গিতে তাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করত। বিষয়টি রাসূল সা: অবহিত হলে তারা আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলত, আমরা তো কথার ছলে রসিকতা করে বলেছি। পবিত্র কুরআনে তাদের এসব অবান্তর যুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। সুতরাং নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত ইসলামের কোনো বিধানকে, তা গুরুত্বের বিবেচনায় যতই ছোট হোক না কেন অবিশ্বাস করা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, বিদ্রƒ করা, তা নিয়ে তামাশা করা, কটূক্তি করা, উপহাস করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ। যা সুস্পষ্ট কুফরি। কোনো মুসলমান ইসলামের বিধিবিধান নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒ করলে সে মুরতাদ হয়ে যাবে। প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, হে রাসূল! আপনি বলুন, তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর বিধানসমূহ এবং তাঁর রাসূলের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রƒ করছ? তোমরা কোনো ওজর পেশ করো না, তোমাদের কোনো ওজর গ্রহণযোগ্য হবে না। বস্তুত, তোমরা ঈমান আনার পর কাফের হয়ে গিয়েছ। (সূরা তাওবা : ৬৫-৬৬)
মুরতাদ শব্দটি একটি আরবি শব্দ। বাংলায় শব্দটির প্রচলন খুব বেশি দিনের নয়। বাংলায় এটিকে নাস্তিক বলা যেতে পারে। এমন কিছু কাজ আছে যা করার দ্বারা বা বলার দ্বারা একজন মুসলমান ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যায়। ইসলাম পরিত্যাগ করে অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করা, আল্লাহর অস্তিত্বে সন্দেহ পোষণ করা, আল্লাহ তায়ালা বা তাঁর রাসূলকে গালি দেয়া, নবী-রাসূলকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক কর্থাবার্তা বলা বা কাজ করা, কুরআন হাদিস তাফসির অপবিত্র স্থানে ফেলে দেয়া, ইসলামের কোনো নিদর্শনকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করা, কুরআন-হাদিসভিত্তিক জীবনধারার চেয়ে অন্য কোনো জীবনাদর্শকে শ্রেষ্ঠ মনে করা, হালালকে হারাম মনে করা, হারামকে হালাল মনে করা, বিধর্মীদের দেব-দেবীর পূজা-অর্চনায় অংশগ্রহণ করা, ধরনের সব কাজই রিদ্দাতের কাজ। এর কোনো একটিতে লিপ্ত হলে ব্যক্তি আর মুসলমান থাকে না। সে ইসলামের গণ্ডির বাইরে চলে যায়। ইসলামের দৃষ্টিতে সে তখন মুরতাদ হয়ে যায়। চাই এসব কর্ম সে ইসলামের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন হয়ে করুক, উপহাস হিসেবে করুক বা নিজ বিশ্বাস অনুসারে করুক তাতে কোনো পার্থক্য নেই। রিদ্দাত হচ্ছে কুফরির চেয়ে জঘন্য অন্যায়। মুরতাদ হওয়ার সাথে সাথে সে ব্যক্তি কেবল মৃত্যুদণ্ড পাওয়ারই যোগ্য নয়; বরং তার সব ধরনের পারিবারিক সামাজিক বন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। বিবাহবন্ধন ছিন্ন হয়ে যায়। স্ত্রীর সাথে মেলামেশা করা জিনা বলে বিবেচিত হয়। কারণেই কোনো মুসলমানকে কাফের বা মুরতাদ ফতোয়া দেয়ার আগে যথেষ্ট সতর্কতা প্রয়োজন। ব্যাপারে কোনো সন্দেহ-সংশয় থাকলে তার ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকতে হবে। কোনো ব্যক্তি মুরতাদ কি না ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবেন কুরআন-হাদিসের গভীর জ্ঞান অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ইসলামি আইনবিশেষজ্ঞ বা মুফতি। অন্য কারো জন্য ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার সুযোগ নেই। 
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া তার লিখিত গ্রন্থ আসসারিমুল মাসলুল- উল্লেখ করেন, রিদ্দাত দুই ভাগে বিভক্ত। রিদ্দাতে আম্মাহ (সাধারণ রিদ্দাত), রিদ্দাতে মুগাল্লাজা (কঠিন রিদ্দাত) নিছক ধর্মান্তরিত হওয়া অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করাকে রিদ্দাতে আম্মাহ বা সাধারণ রিদ্দাত বলা হয়। আর ইসলাম ত্যাগ করার সাথে আল্লাহ তাঁর নবীর বিরুদ্ধে মুহারাবা (যুদ্ধ) ফ্যাসাদ (ধ্বংসাত্মক কাজে) লিপ্ত হওয়াকে বলে রিদ্দাতে মুগাল্লাজা। এক শ্রেণীর মানুষ অর্থের প্রলোভনে বা সামাজিক অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা লাভের আশায় অথবা ইসলাম সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের অভাবে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করে। এই শ্রেণীর মানুষ পরবর্তীকালে ইসলামের ক্ষতি করে না। কারণ তারা যা পাওয়ার তা পেয়ে যায়। ইসলাম নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। আরেক শ্রেণীর ধর্মত্যাগকারী আছে, যারা ধর্ম ত্যাগ করে শত্রুদের প্ররোচনা প্রলোভনে পড়ে ইসলামের বিরুদ্ধে কাজ করে থাকে। নিজেদের শক্তি মেধা ব্যয় করে ইসলাম মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে কাজ করে থাকে, শ্রেণীর রিদ্দাত হচ্ছে রিদ্দাতে মুগাল্লাজা। এতে লিপ্ত ব্যক্তিরা অতি ভয়াবহ। ধরনের ব্যক্তিদের দ্বারাই ইসলামের খুব বেশি ক্ষতি হতে পারে। তারা ইসলাম ইসলামি ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে সমাজ মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। সাধারণ মানুষের মন-মানসিকতাকে বিষিয়ে তুলতে পারে। ইসলামি সমাজকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারে। বস্তুত যারা ইসলামের লেবাস ধারণ করে ইসলামের ক্ষতিসাধন করে তারা শুধু মুরতাদই নয়; বরং মুনাফিকও বটে। মুনাফিকদের সম্পর্কে কুরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, মুনাফিকেরা জাহান্নামের নি¤œতর স্তরে থাকবে। (সূরা নিসা : ১৪৫)
মুরতাদের শাস্তি :
মুরতাদ যে শুধু আখিরাতে শাস্তি পাবে তা নয়; বরং দুনিয়াতেও তার জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। মুরতাদের শাস্তি হলো তার মৃত্যুদণ্ড। ব্যাপারে চার মাজহাবের কোনো ইমাম দ্বিমত পোষণ করেননি। যেকোনো সভ্যসমাজে অপরাধের শাস্তি নির্ণীত হয় অপরাধের মাত্রা কম-বেশির নিরিখে। যেহেতু রিদ্দাত একটি মারাত্মক জঘন্য অপরাধ, তাই তার শাস্তিও মৃত্যুদণ্ড। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত, তিন শ্রেণীর লোক ছাড়া অন্য কোনো লোককে মৃত্যুদণ্ড দেয়া যায় না। এরা হলো, বিবাহিত জিনাকারী, হত্যাকারী এবং দ্বীন পরিত্যাগকারী (সহি বুখারি শরিফ, সহি মুসলিম শরিফ) অন্য হাদিসে আছে, হজরত ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি আপন দ্বীন পরিত্যাগ করেছে, তাকে কতল করো (সহি বুখারি শরিফ)
মুরতাদের তাওবা : কথা স্বীকৃত যে, তাওবার মাধ্যমে বান্দা মাফ পেয়ে যায়। তবে প্রশ্ন হচ্ছে তাওবা দ্বারা কি মুরতাদ মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই পেতে পারে? সম্পর্কে ইসলামি শরিয়তের নির্দেশ হচ্ছে, গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত মুরতাদ যদি অনুতপ্ত হয় এবং তাওবা করে তবে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। তবে গ্রেফতার হওয়ার পর তার তাওবা কবুল করা হবে কি না, বিষয়ে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। হাদিসের কোনো কোনো বর্ণনায় দেখা যাচ্ছে রাসূলুল্লাহ সা: মুরতাদ গ্রেফতার হওয়ার পর তাওবার কারণে তাকে মুক্তি দিয়েছেন। আবার কোনো কোনো বর্ণনায় দেখা যাচ্ছে, তাওবার পরও তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। ওলামায়ে কেরাম হাদিসের বৈপরীত্বের কারণ বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, অপরাধের গুণগত পার্থক্যের কারণে শাস্তির মাত্রা কম-বেশি হতে পারে। তাই যারা প্রথম প্রকার রিদ্দাতে লিপ্ত হয়েছে, অর্থাৎ কাফের হয়ে যাওয়ার পর ইসলামের কোনো ক্ষতি করে না, তাদের তাওবা কবুল করা হবে। আর যারা দ্বিতীয় প্রকার রিদ্দাত অর্থাৎ কাফের হয়ে যাওয়ার পরও ইসলামের ক্ষতি সাধনে লিপ্ত থাকে, তাদের তাওবা কবুল করা হবে না। (আসসারিমুল মাসলুল) অর্থাৎ প্রথম শ্রেণীর মুরতাদ আইনি প্রক্রিয়ায় আসার পরও শাস্তি থেকে অব্যাহতি পেতে পারে। কিন্তু দ্বিতীয় প্রকারের মুরতাদ অব্যাহতি পাবে না। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া দীর্ঘ আলোচনা করে দেখিয়েছেন, প্রথম শ্রেণীর মুরতাদের শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়ার সুযোগ আছে, তাদের তাওবা কবুল করা হয়। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণীর মুরতাদের তাওবাও কবুল হয় না এবং তার শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো সুযোগও নেই। কারণ তারা ধর্ম ত্যাগ করার সাথে সাথে ধর্মের ক্ষতিসাধনেও লিপ্ত হয়। মিকয়াস ইবনে সাবাবা নামক এক ব্যক্তি মুরতাদ হওয়ার পর জনৈক মুসলমানকে হত্যা করে তার সম্পদ লুণ্ঠন করেছিল
মক্কা বিজয়ের দিন রাসূল সা: তার তাওবা কবুল করেননি। ইবনে খাতাল নামক জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সা:কে গালি দিয়েছিল এবং একজন মুসলমানকে হত্যা করেছিল। সেও ক্ষমা পায়নি। উরানা নামক গোত্রের লোকেরা মুরতাদ হওয়ার পর হত্যা, লুণ্ঠন, ভর্ৎসনা, মিথ্যা রটনা, অপপ্রচার ইত্যাদি দোষে দোষী ছিল। নিজেদের পাপের জন্য তারাও মৃত্যুদণ্ড ভোগ করেছিল। ইবনে আবি সারাহ নামক এক ব্যক্তি মুরতাদ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সা: সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ রটনা করেছিল, তাকেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। সুতরাং ধর্ম ত্যাগ করার সাথে সাথে যারা ধর্মের ক্ষতিসাধন করে, মৃত্যুদণ্ড ছাড়া তাদের অন্য কোনো শাস্তি গ্রহণযোগ্য নয়
লেখক : প্রবন্ধকার