মধ্যযুগের মুসলিম লেখক ও বাংলা সাহিত্য



মোজাফফর হোসেন
যেকোনো ভাষার উন্নত সাহিত্য মানবজীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনাকে গভীর থেকে অনুভব করার ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে সময়ের ব্যবধানে সাহিত্য একটি সমাজকে অনায়াসে বদলেও দিতে পারে একটি জাতির মানস গঠনেও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে সাহিত্য সুতরাং সাহিত্য তার লেখককে কখনোই অবহেলার দৃষ্টিতে দেখার অবকাশ নেই
সাহিত্য মানুষের মনের দুয়ার খুলে দেয়। মনের ভেতরে লুকায়িত সুপ্ত আবেগ অনুভূতিকে জাগিয়ে তোলে সাহিত্য। যেকোনো ভাষার উন্নত সাহিত্য মানবজীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনাকে গভীর থেকে অনুভব করার ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে। সময়ের ব্যবধানে সাহিত্য একটি সমাজকে অনায়াসে বদলেও দিতে পারে। একটি জাতির মানস গঠনেও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে সাহিত্য।
সুতরাং সাহিত্য তার লেখককে কখনোই অবহেলার দৃষ্টিতে দেখার অবকাশ নেই। কয়েকজন লেখক যদি একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সাহিত্য রচনা করেন তাহলে সে উদ্দেশ্য সমাজে বাস্তব রূপ লাভ করতে পারে। সে কারণে সঙ্ঘবদ্ধ লেখকগোষ্ঠী যদি ভেতরে ভেতরে সমাজের একটি আদর্শকে সরিয়ে দিয়ে ভিন্ন নতুন একটি আদর্শ বা সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠিত করার মানসে সাহিত্য রচনা করতে থাকেন তাহলে সে পরিশ্রমের ফসল তারা ঘরে তুলতে পারবেন সহজেই। প্রমথ চৌধুরীর ভাষায় বলা যায় সাহিত্য মানুষের মন বদলাতে পারে অতি সহজেই। সে কারণেই মুসলিম লেখকের কর্তৃক রচিত বাংলা সাহিত্য মধ্যযুগের বাঙালিমানস পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল।
দ্বাদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ। সময়ের বাংলা সাহিত্যে মুসলমান লেখকেরা সরব উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমে বাংলা মুসলিম সুলতানদের অধীনে চলে আসে। ফলে প্রাচীন যুগ থেকে চলে আসা বাংলা সাহিত্যে ব্রাহ্মণ্যবাদের একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব হয়। মুসলিমদের সংস্পর্শে এসে বাংলা ভাষা সাহিত্য এক নতুন রূপ এবং আঙ্গিক গ্রহণে প্রস্তুত হয়ে ওঠে। উদারপন্থী মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চার বিষয়টি সমাজের সর্বস্তরের অধিকারে চলে আসে। তৈরি হয় নতুন চেতনার সমাজ সাহিত্যের জগৎ নির্মাণের কাজ। প্রাচীন ধারার সংস্কৃতি আর অন্য চেতনায় আবদ্ধ মানুষের মনকে বদলানোর লক্ষ্যেই কলম ধরেছিলেন মুসলিম লেখকেরা। মধ্যযুগের এসব মুসলিম লেখকেরা মনে করেছিলেন দেশে ইসলামি সংস্কৃতির ধারা বিস্তার লাভ করুক। কেননা সপ্তম শতক থেকেচর্যাপদ’-এর মাধ্যমে চলে আসা বাংলা সাহিত্য গড়ে উঠেছে বৌদ্ধ ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে আশ্রয় করে। চর্যার ছেচল্লিশটি পদের চব্বিশ জন পদকর্তার সবাই ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী পণ্ডিত। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম নিদর্শনশ্রীকৃষ্ণকীর্তনকাব্য। কাব্যের লেখকও ছিলেন ব্রাহ্মণ্য বড়চণ্ডীদাস। ছাড়া যাবতীয় মঙ্গল কাব্যের লেখক ছিলেন ব্রাহ্মণ্যবাদী পণ্ডিতরা। দুঃখের বিষয় ব্রাহ্মণ্যবাদে বাংলা সাহিত্যচর্চার অধিকার ছিল সীমাবদ্ধ। অধিকার সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল না। ধর্মীয় বিষয়বস্তু নির্ভর সাহিত্য রচনার ধরাবাঁধা নিয়মে সর্বসাধারণ ছিল উপেক্ষিত। শুধু সংস্কৃত ভাষাতে সাহিত্যচর্চা ছিল সমাদৃত। সে সময় সংস্কৃত ভাষা দেব ভাষা হিসেবে গণ্য হতো এবং দেব ভাষা ব্যতীত সাহিত্যচর্চা পাপের বলে মনে করা হতো। জন্য দেবভাষায় অব্রাহ্মণদের কোনো অধিকার ছিল না এবং সমাজের বেশির ভাগ জনে ব্যবহৃত বাংলা ভাষা পুঁথিপুস্তকে জায়গা করে নিতে ব্যর্থ হতো। দৈন্য থেকে বাংলা সাহিত্যকে মুক্ত করে সাহিত্যচর্চার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন মুসলিম লেখক পৃষ্ঠপোষকেরা। সময় থেকে সর্বসাধারণের মুখের ভাষা বাংলাকে সাহিত্যের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। মধ্যযুগ থেকেই বাংলা সাহিত্য তার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল। মুসলিমদের সান্নিধ্যে এসে হিন্দু লেখকেরাও তাদের মতামত পরিবর্তন করতে পেরেছিলেন। পুরাতন চেতনাকে ঝেড়ে ফেলে নতুন চেতনায় তারা নিজেদেরকে তৈরি করে নেন। ফলে বাংলা সাহিত্যের নানা দিক উন্মোচিত হতে থাকে। মুসলিম হিন্দু উভয় লেখকেরাই নিজ নিজ ধর্মের বিষয়কে অবলম্বন করে কাব্যচর্চা করেছেন বিনা প্রতিবন্ধকতায়। এর ফলে বাংলা সাহিত্যে বিভিন্ন শাখার উৎপত্তি বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে উন্নত ফারসি সাহিত্যের সংযোগ ঘটে মুসলিম লেখকদের কল্যাণে। সৃষ্টি হতে থাকে অনুবাদ সাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলি, মঙ্গলকাব্য, প্রণয় উপাখ্যান ইত্যাদি। ইসলামি সংস্কৃতির মৌলিক উপাদান কুরআন হাদিসের বিষয়কে কেন্দ্র করে মুসলিম লেখকেরা রচনা করতে থাকেন অনুবাদ সাহিত্য, প্রণয় উপাখ্যান, জীবনী সাহিত্য, সুফি সাহিত্য, জঙ্গনামা বা যুদ্ধকাব্য সওয়াল সাহিত্য। আর হিন্দু লেখকেরা রামায়ণ, মহাভারত ভাগবতের অনুবাদ করেন, রচনা করেন শাক্তপদাবলি, শিবায়ন, কালিকামঙ্গল, লৌকিক দেবতা পাঁচালী সাহিত্য।
মধ্যযুগে মুসলিম লেখকেরা সাহিত্যচর্চার অন্যতম সাধনা ছিল ইসলাম ধর্মের মর্মবাণী প্রচার করা। ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা দূর করে সমাজকে ইসলামের ছায়াতলে আবদ্ধ কল্পে মুসলিম লেখকেরা যে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তাতে বাংলা সাহিত্যও হতে পেরেছিল সমৃদ্ধ। মুসলমান লেখকেরা ধর্মীয় বিষয়াদি অনুবাদ করে ধর্মসাহিত্যের বিকাশ ঘটিয়েছেন। একই সাথে ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে জনগণকে সচেতনও করেছেন। সওয়াল সাহিত্য চরিতকথার মাধ্যমে ধর্মীয় বিষয়ের প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে। পীর পাঁচালী জাতীয় রচনার মধ্যেও ধর্মকে স্থান করে দিয়েছেন মুসলিম লেখকেরা। বিশেষ করে মুসলিম লেখকেরা কর্তৃক অনুবাদকৃত প্রণয় উপাখ্যান জাতীয় রচনাগুলো হিন্দু মুসলিম উভয় সমাজেই বেশ সমাদৃত হয়ে উঠেছিল। এতে করে হিন্দু লেখকদের লেখা রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার সাহিত্য স্বাদকে আস্বাদন করার পরিবর্তে মুসলিম সমাজ তাদের নিজস্ব প্রণয় উপাখ্যান শাহ্ মুহম্মদ সগীরের লেখাইউসুফ জোলেখাকে উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছেন। হিন্দু কবি মালাধর বসু কর্তৃক রচিতশ্রীকৃষ্ণবিজয়’-এর পরিবর্তে মুসলিম লেখক জৈনুদ্দিন রচিতরসূলবিজয়মুসলিম সমাজে অধিক প্রিয় হয়ে উঠেছে। ছাড়া মুসলিম কবিরা রচনা করেনমধুমালতী, বিদ্যাসুন্দর, লায়লী মজনু, সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ এবং মহা কবি আলাওল মালিক মুহম্মদ জায়সীরপদুমাবতঅবলম্বনে রচনা করেনপদ্মাবতীকাব্য।
যেসব মুসলিম লেখক মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন শেখ ফয়জুল্লাহ, সাবিরিদ খান, দৌলত উজির বাহরাম খান, মুহম্মদ কবীর, দোনা গাজী, কাজী দৌলত, নওয়াজিস খান, শরিফ শাহ, আবদুল হাকিম, সৈয়দ হামজা, ফকির গরীবুল্লাহ, আবদুর রাজ্জাক, শেখ পরানসহ আরো অনেকে। এসব লেখকসহ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে অন্তত শতাধিক মুসলিম লেখক অবদান রেখেছেন। যাদের কঠোর পরিশ্রমে বাংলা ভাষা সাহিত্য হয়ে উঠেছে জগৎখ্যাত। মুসলিম লেখকদের সাহিত্যচর্চার ফলে বাংলা ভাষায় প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দের সমাবেশ ঘটেছে। আরবি-ফারসি শব্দের প্রাচুর্যের কারণে মধ্যযুগের বাংলা ভাষাকে মুসলমানি বাংলাভাষা হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে। মুসলমানি বাংলা ছিলো আরবি-ফারসি শব্দবহুল। কাজেই বাংলা ভাষার প্রাণ প্রতিষ্ঠায় আরবি-ফারসি শব্দের অবদান অনস্বীকার্য। যেমনঅজু,’ ‘শহীদ,’ ‘নামাজ,’ ‘মুহুরি,’ ‘আইন,’ ‘হিসাবঈদএসবের বাংলা প্রতিশব্দ পাওয়া যায় না। রকম বহু আরবি-ফারসি শব্দ মুসলিম লেখকদের সাহিত্যচর্চার কারণে বাংলা ভাষাতে অনুপ্রবেশ করেছে। মধ্যযুগের মুসলিম লেখকেরা যদি বাংলা ভাষা সাহিত্যের চর্চা না করত তা হলে হয়তো বাংলা সাহিত্যের দেব ভাষার গণ্ডি থেকে বের হয়ে আসতে আরো কয়েক শত বছর লেগে যেত।
মধ্যযুগের মুসলিম লেখকেরা তাদের লেখার মধ্য দিয়ে নব্য মুসলিম সমাজকে ধর্মের আবেশে ধরে রাখতে যেমন সহায়তা করেছেন তেমনি গ্রন্থ রচনা করে বাংলা সাহিত্যের উন্নয়নেও অবদান রেখেছেন সমানতালে। সদ্য ধর্মান্তরিত নবমুসলিমদেরকে ইসলামের শাশ্বত বাণী ইসলাম ধর্মের নিয়মকানুন, বিধিবিধান সাহিত্যের মাধ্যমে তুলে ধরার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। ফলে ধর্মাচারও প্রচার হয়েছে এবং সাহিত্যচর্চাও হয়েছে। এসব লেখকের কারণে নবমুসলিমদের জীবনাচরণের পরিবর্তন হয়েছে এবং ইসলামি সংস্কৃতি ধীরে ধীরে মুসলিম সমাজে দানা বেঁধেছে। তা না হলে ধর্মান্তরিত এসব মুসলিমের জীবনাচরণ সনাতনি বৌদ্ধ-ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির আবর্তে নিমজ্জিত হতে পারত। ধর্মান্তরিত মুসলিম নামে মুসলিম থাকত আর জীবনাচরণে তারা হয়তো পূর্বগামী হতো। অন্তত এই বিপর্যয় থেকে নবমুসলিমদের রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন মধ্যযুগের মুসলিম লেখকেরা। দুঃখের বিষয় মধ্যযুগের এইসব মুসলিম লেখকের মূল্যায়ন হয়েছে অনাড়ম্বরভাবে। বাংলা সাহিত্যে তাদের অবদানকে খাটো করে দেখার প্রবণতা লক্ষ করা যায় যা কখনোই কাম্য ছিল না