ইসলামে আমল বা কাজ হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ধর্ম, ঈমান ও উত্তম জীবনযাপনের পাথেয় হিসেবে কাজই হলো মূল। এজন্যই ইসলাম ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের নিরাপত্তার জন্য ব্যক্তি পর্যায়ে কর্মসংস্থানের উপর জোর দিয়েছে। ইসলামের এ দিকটি বাস্তবায়নের অভাবেই আমরা বিশ্বব্যাপী বেকারত্ব ও দারিদ্র দেখতে পাই। আরব ও মুসলিম বিশ্বে অধিকাংশ জনসংখ্যাই বেকারত্ব, ক্ষুধা, দারিদ্র ও দুর্ভিক্ষের কষাঘাতে নিষ্পেষিত। তাদের অনেকেই জীবন ধারণের মৌলিক উপাদান খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত ও তারা দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করছে। অথচ এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীর বিপরীত। কেননা তিনি বলেছেন,
«كَادَ الْفَقْرُ أَنْ يَكُونَ كُفْرًا،
وَكَادَ الْحَسَدُ أَنْ يَسْبِقَ الْقَدَرَ، قُولُوا: اللَّهُمَّ رَبَّ
السَّمَوَاتِ السَّبْعِ وَرَبَّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ، اقْضِ عَنَّا
الدَّيْنَ وَأَغْنِنَا مِنَ الْفَقْرِ ».
“কখনো কখনো
দারিদ্র কুফরীতে নিয়ে যায় আর হিংসা তাকদিরকে অতিক্রম করে। সুতরাং তোমরা
আল্লাহর কাছে দু‘আ করো এবং বল, হে সাত আসমান ও আরশে আযিমের রব! আমাদের ঋণ
পরিশোধ করার তাওফিক দিন এবং দারিদ্র থেকে মুক্তি দিন”। [দু ‘আ লিত্বতাবরানী, পৃষ্ঠা ৩১৯]
ইসলামে দারিদ্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামের
গুরুত্ব স্পষ্ট ও অপরিহার্য। ইসলাম মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসের নিশ্চয়তা
দিয়েছে আর অভাব অনটনের থেকে সর্বদা পানাহ চাইতে বলেছে। এমনকি রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভাবকে কুফরীর সাথে তুলনা করেছেন। অনেক সময়
মানুষ অভাবের কারণে কুফরীতে পতিত হয়ে যায়। অভাবের ধ্বংসাত্মক ও ক্ষতিকর
প্রভাবে আজ আরব ও মুসলিম বিশ্বের মুসলমানরা পশ্চাৎপদতা, অক্ষমতা, নি:সঙ্গতা
ও দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি মহামারীতে পড়ে আছে, তাদের সামাজিক জীবনে অভাবের
প্রভাব স্পষ্ট বিদ্যমান।
দারিদ্র ও বেকারত্বের ফলে সামাজিক অবক্ষয়
দেখা দিয়েছে ও মানব সম্পদ উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বর্তমানে এটা শুধু
মুসলিম বিশ্বের আঞ্চলিক সমস্যা নয়, বরং এটা গোটা মুসলিম বিশ্বের সামষ্টিক
সমস্যা; বরং এটা অন্যান্য দেশেরও সামষ্টিক সমস্যা। বর্তমানে সাড়ে পাঁচ
কোটিরও উপরে জনসংখ্যা দৈনিক মাত্র এক ডলারেরও কম রোজগার করে। এছাড়াও মুসলিম
বিশ্বে বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ খুবই বেশি যা একসময় মারাত্মক আকার
ধারণ করবে।
>>>> কুরআনের আলোকে <<<<
আরব ও ইসলামী বিশ্বে এসব সমস্যার কারণে
সৃষ্ট পশ্চাৎপদতা ও মানব উন্নয়নের নানা বাধা মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে
মুসলমানদের প্রতি আদেশের সাথে সাংঘর্ষিক। কেননা, আল কুরআন মানুষকে জমিনের
আবাদ ও শাসন কার্য পরিচালনার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহ বলেছেন,
﴿وَإِلَىٰ ثَمُودَ أَخَاهُمۡ صَٰلِحٗاۚ
قَالَ يَٰقَوۡمِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنۡ إِلَٰهٍ غَيۡرُهُۥۖ
هُوَ أَنشَأَكُم مِّنَ ٱلۡأَرۡضِ وَٱسۡتَعۡمَرَكُمۡ فِيهَا
فَٱسۡتَغۡفِرُوهُ ثُمَّ تُوبُوٓاْ إِلَيۡهِۚ إِنَّ رَبِّي قَرِيبٞ مُّجِيبٞ
٦١﴾ [هود: ٦١]
“আর সামূদ
জাতির প্রতি (পাঠিয়েছিলাম) তাদের ভাই সালিহকে। সে বলল, ‘হে আমার কওম, তোমরা
আল্লাহর ইবাদাত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের কোন (সত্য) ইলাহ নেই, তিনি
তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে এবং সেখানে তোমাদের জন্য আবাদের
ব্যবস্থা করেছেন । সুতরাং তোমরা তাঁর কাছে ক্ষমা চাও, অতঃপর তাঁরই কাছে
তাওবা কর। নিশ্চয় আমার রব নিকটে, সাড়াদানকারী”। [সূরা: হূদ: ৬১]
অর্থাৎ তিনি তোমাদের থেকে জমিনের আবাদ করা
চাচ্ছেন। আর আবাদের মাধ্যম হলো কাজ। কাজ ছাড়া জমিনের আবাদ করা সম্ভব নয়।
আল্লাহ সূরা আল-বাকারাতে মানুষ সৃষ্টির মূল লক্ষ্য সম্পর্কে বলেছেন,
﴿وَإِذۡ قَالَ رَبُّكَ لِلۡمَلَٰٓئِكَةِ
إِنِّي جَاعِلٞ فِي ٱلۡأَرۡضِ خَلِيفَةٗۖ قَالُوٓاْ أَتَجۡعَلُ فِيهَا مَن
يُفۡسِدُ فِيهَا وَيَسۡفِكُ ٱلدِّمَآءَ وَنَحۡنُ نُسَبِّحُ بِحَمۡدِكَ
وَنُقَدِّسُ لَكَۖ قَالَ إِنِّيٓ أَعۡلَمُ مَا لَا تَعۡلَمُونَ ٣٠﴾
[البقرة: ٣٠]
“আর স্মরণ
কর, যখন তোমার রব ফেরেশতাদেরকে বললেন, ‘নিশ্চয় আমি জমিনে একজন খলীফা সৃষ্টি
করছি’, তারা বলল, ‘আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যে তাতে ফাসাদ
করবে এবং রক্ত প্রবাহিত করবে? আর আমরা তো আপনার প্রশংসায় তাসবীহ পাঠ করছি
এবং আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। তিনি বললেন, নিশ্চয় আমি জানি যা তোমরা জান
না”। [সূরা: আল-বাকারা: ৩০]
আল্লাহ তা ‘আলা আরো বলেছেন,
﴿يَٰدَاوُۥدُ إِنَّا جَعَلۡنَٰكَ
خَلِيفَةٗ فِي ٱلۡأَرۡضِ فَٱحۡكُم بَيۡنَ ٱلنَّاسِ بِٱلۡحَقِّ وَلَا
تَتَّبِعِ ٱلۡهَوَىٰ فَيُضِلَّكَ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱلَّذِينَ
يَضِلُّونَ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِ لَهُمۡ عَذَابٞ شَدِيدُۢ بِمَا نَسُواْ
يَوۡمَ ٱلۡحِسَابِ ٢٦﴾ [ص: ٢٦]
“(হে
দাঊদ), নিশ্চয় আমি তোমাকে যমীনে খলীফা বানিয়েছি, অতএব তুমি মানুষের মধ্যে
ন্যায়বিচার কর আর প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না, কেননা তা তোমাকে আল্লাহর পথ
থেকে বিচ্যুত করবে। নিশ্চয় যারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয় তাদের জন্য
কঠিন আযাব রয়েছে। কারণ তারা হিসাব দিবসকে ভুলে গিয়েছিল”। [সূরা সোয়াদ: ২৬]
উক্ত আয়াতসমূহ থেকে একথা স্পষ্টরূপে
প্রতীয়মান হয় যে, ব্যক্তি ও সমষ্টির উপর কাজ করা ও সমাজ উন্নয়ন করা ফরয।
এছাড়াও কর্মের উন্নয়ন সাধনও এ থেকে বুঝা যায়।
>>>> হাদীসের আলোকে <<<<
ইসলাম নিজ হাতের কাজকে সর্বোত্তম হালাল রিযিক বলে আখ্যায়িত করেছে। হাদীসে এসেছে,
«مَا أَكَلَ أَحَدٌ طَعَامًا قَطُّ،
خَيْرًا مِنْ أَنْ يَأْكُلَ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ، وَإِنَّ نَبِيَّ اللَّهِ
دَاوُدَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ، كَانَ يَأْكُلُ مِنْ عَمَلِ يَدِهِ».
“নিজ হাতে উপার্জিত জীবিকার খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য কখনো কেউ খায় না। আল্লাহর নবী দাউদ আলাইহিস সালাম নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন”।
«أَنَّ دَاوُدَ النَّبِيَّ عَلَيْهِ السَّلاَمُ، كَانَ لاَ يَأْكُلُ إِلَّا مِنْ عَمَلِ يَدِهِ».
“আল্লাহর নবী দাউদ আলাইহিস সালাম নিজ হাতে উপার্জন থেকেই খেতেন।”
«لَأَنْ يَحْتَطِبَ أَحَدُكُمْ حُزْمَةً عَلَى ظَهْرِهِ، خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَنْ يَسْأَلَ أَحَدًا، فَيُعْطِيَهُ أَوْ يَمْنَعَهُ».
“তোমাদের
কারো পক্ষে এক বোঝা লাকড়ি সংগ্রহ করে পিঠে বহন করে নেওয়া উত্তম, কারো কাছে
সাওয়াল করার চাইতে। (যার কাছে যাবে) সে দিতেও পারে অথবা নাও দিতে পারে”।
«كَانَ أَصْحَابُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى
اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عُمَّالَ أَنْفُسِهِمْ، وَكَانَ يَكُونُ لَهُمْ
أَرْوَاحٌ، فَقِيلَ لَهُمْ: لَوِ اغْتَسَلْتُمْ».
“রাসূলূল্লাহ্
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীগণ নিজেদের কাজ-কর্ম নিজেরা
করতেন। ফলে তাদের শরীর থেকে ঘামের গন্ধ বের হতো। সেজন্য তাদের বলা হলো, যদি
তোমরা গোসল করে নাও (তবে ভালো হয়)।”
সুতরাং, উপরোক্ত কুরআন ও হাদীসের আলোকে
বলা যায় যে, কাজের গুরুত্বের দিক থেকে মুসলিম বিশ্বের চেয়ে অন্যান্যরা
এক্ষেত্রে আছে। তাদের স্বাধীন চিন্তাশক্তি, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা,
উচ্চাকাঙ্ক্ষার ফলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তারা আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে
যাচ্ছে। তাই আমাদের পুনরায় কাজের গুরুত্ব অনুধাবন করা উচিত। ব্যক্তি ও সমাজ
পর্যায়ে সংস্কৃতিক উন্নয়ন, উৎপাদনে অগ্রগামীতা, কর্মের দক্ষতা, ব্যক্তিকে
কাজের প্রতি আগ্রহী করে গড়ে তোলা খুবই দরকার। কাজই হলো উৎপাদনের মূল
উপাদান।
লিখেছেনঃ সাজ্জাদ সালাদীন