মুহাম্মদ হামিদুল ইসলাম আজাদ
জামায়াতে নামায আদায় এর গুরুত্ব অনেক। নামায আদায় করা যেমন ফরজ অনুরুপ ভাবে জামায়াতে নামায আদায় করাও ফরজ। আল্লাহ তাআলা বলেন, তোমরা নামায সুপ্রতিষ্ঠিত কর এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু কর। (সূরা বাকারা-৪৩) জামায়াতের সাথে নামাজ পড়ার আগ্রহ ও উতসাহ প্রদানে এবং তার ফযীলত সর্ম্পকে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। অপর দিকে জামায়াত র্বজন ও জামায়াতের সাথে নামায আদায়ে অবহেলাকারীর বিরুদ্ধে ও তার অবহেলার ক্ষেত্রে সর্তককারী হাদীস এসেছে।
১. জামায়াতে সালাত আদায় দ্বারা কিয়ামত দিবসে পরিপূর্ণ নূর লাভ করা যায়: রাসূল সা: বলেন, যারা অন্ধকারে (অর্থাৎ-ফজরের সালাত আদায় করার জন্য) মসজিদে গমন করে, তাদেরকে কিয়ামত দিবসে পরিপূর্ণ নূরের সুসংবাদ দিয়ে দাও। (আবূ দাঊদ, তিরমিযী)
২. সালাতের জন্য মসজিদে অপেক্ষাকারী সালাতরতই থাকে: রাসূল সা: বলেন,
তোমাদের কোন ব্যক্তি সালাতরতই থাকে যতক্ষণ সালাত তাকে বাধা দিয়ে রাখে। শুধু সালাতই তাকে নিজ গৃহে বা পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়া থেকে বিরত রাখে। (বুখারী ও মুসলিম)
৩. একাকী সালাত আদায় করার চেয়ে জামায়াতে আদায় করা অনেক উত্তম: রাসূল সা: বলেন, একাকী সালাত আদায় করার চেয়ে জামায়াতের সাথে সালাত আদায় করা পঁচিশ গুণ বেশী মর্যাদা সম্পন্ন। (বুখারী ও মুসলিম)
৪. ফেরেশতারা মুছল্লীর জন্য মাগফেরাত ও রহমতের দুয়া করেন: রাসূল সা: বলেন, তোমাদের কোন ব্যক্তি সালাত আদায় করার পর যতক্ষণ স্বীয় জায়নামাজে বসে থাকে ততক্ষণ ওযু ভঙ্গ না হওয়া পর্যন্ত ফেরেশতারা তার জন্য দুআ করতে থাকে। বলে, হে আল্লাহ তাকে ক্ষমা কর, তাকে রহম কর। (বুখারী ও মুসলিম)
৫. জামায়াতে সালাত গুনামাফের মাধ্যম: রাসূল সা: বলেন, যে ব্যক্তি সালাতের জন্য ওযু করবে এবং ওযুকে পরি পূর্ণরুপে করবে। তারপর ফরয সালাত আদায় করার জন্য পথ চলবে; অতঃপর তা মানুষের সাথে বা জামায়াতে বা মসজিদে আদায় করবে, তাহলে আল্লাহ্ তার গুনাহ্সমূহ ক্ষমা করে দিবেন। (মুসলিম)
৬. সালাতের জন্য মসজিদে গমন করলে এক পদে গুনাহ মোচন হয় অন্য পদে মর্যাদা উন্নীত হয়: রাসূল সা: বলেন, যে ব্যক্তি নিজ গৃহে ওযুর মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করে, তারপর আল্লাহ কোন এক ঘরে (মসজিদে) যায় আল্লাহ কোন একটি ফরজ সালাত আদায় করার জন্য, তবে তার পদক্ষেপ গুলোর বিনিময়ে একটি পদে একটি গুনাহ মোচন করা হয় অন্য পদে একটি মর্যাদা উন্নীত হয়। (মুসলিম)
৭. পূর্ণ রাত নফল সালাত আদায় করার ছওয়াব: রাসূল সা: বলেন, যে ব্যক্তি এশা সালাত জামায়াতের সাথে আদায় করবে, সে যেন অর্ধ রাত্রি নফল সালাত আদায় করল, এবং যে ব্যক্তি ফজর সালাত জামায়াতের সাথে আদায় করবে, সে যেন পূর্ণ রাত্রি নফল সালাত আদায় করল। (মুসলিম)
৮. মুনাফেকী এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ: রাসূল সা: বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ জন্য চল্লিশ দিন (২০০ ওয়াক্ত) জামায়াতের সাথে ইমামের তাকবীরে তাহরীমার সাথে সালাত আদায় করবে তার জন্য দুটি মুক্তি নামা লিখা হবে। (১) জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং (২) মুনাফেক্বী থেকে মুক্তি। (তিরমিযী, দ্র: ছহীহুল জামে হা/৬৩৬৫)
৯. সালাত শয়তান থেকে নিরাপদ থাকার মাধ্যম: রাসূল সা: বলেন, কোন গ্রামে যদি তিনজন লোক থাকে এবং তারা জামায়াতের সাথে সালাত প্রতিষ্ঠা না করে তবে শয়তান তাদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করে। সুতরাং তোমরা জামায়াত বদ্ধ থাক। কেননা দল ছুট একক ছাগলকে নেকড়ে বাঘ খেয়ে ফেলে। (আহমাদ, আবু দাউদ, নাসাঈ, দ্র: ছহীহুল জামে হা/৫৭০১)।
১০. পুলসিরাত পার হয়ে জান্নাতে যাওয়ার সুসংবাদ: রাসূল সা: বলেন, প্রত্যেক পরহেজগার ব্যক্তির গৃহ হচ্ছে মসজিদ। আর যে ব্যক্তির গৃহ হবে মসজিদ আল্লাহ্ তার জন্য করুণা ও দয়ার জিম্মাদার হয়ে যান এবং আরও জিম্মাদারি নেন পুলসিরাত পার হয়ে আল্লাহ সন্তষ্টি জান্নাতে যাওয়ার। (ত্ববরানী, শায়খ আলবানী হাদছটিকে ছহীহ বলেছেন।)
১১. আগেভাগে সালাতে আসার মর্যাদা: রাসূল সা: বলেন, মানুষ যদি জানত আজান দেয়া এবং প্রথম কাতারে সালাত আদায় করার প্রতিদান কি, তাহলে (কে আজান দেবে বা কে প্রথম কাতারে সালাত আদায় করবে তা নির্ধারণ করার জন্য) তারা পরস্পর লটারি করতে বাধ্য হত। তারা যদি জানত আগেভাগে সালাতে আসাতে কি প্রতিদান রয়েছে তবে, তারা প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ত। (বুখারী ও মুসলিম)
১২. জামায়াতে সালাতই কিয়ামত দিবসে আরশের নীচে ছায়া লাভের মাধ্যম: রাসূল সা: বলেন, কিয়ামত দিবসে সাত ধরণের ব্যক্তিকে আরশের নীচে ছায়া দান করা হবে যে দিন আল্লাহ আরশের ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না-তাদের মধ্যে একজন হচ্ছে এমন ব্যক্তি যার হৃদয় লটকানো থাকে মসজিদে। অর্থাৎ যখনই সালাতের সময় হয় সে ছুটে যায় মসজিদের পানে। (বুখারী ও মুসলিম)
রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছা করে নামাজ ত্যাগ করল সে কুফরী করল। আরেকটি হাদীসে এসেছে, কাফির ও মুসলমানের পার্থক্য হলো নামায। যারা নামায পড়ে না অথবা নামাযে অবহেলা, গড়িমসি বা শিথিলতা প্রদর্শন করে তাদের ব্যাপারে কুরআন বলছে: সে সব শ্রেণীর লোকদের জন্য নামায অত্যন্ত কঠিন কাজ, যারা আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য করতে প্রস্তুত নয়। (সূরা বাকারা-৪৫)
আমাদের জানা দরকার, নামাজ পড়া বা না পড়া ব্যক্তিগত ব্যাপার তো নিই, নামাজ একা একা আদায় করারও সুযোগ নেই। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ সা. বলেন: যে ব্যক্তি আজান শুনে ওজর ছাড়া মসজিদে না গিয়ে একাকী নামায আদায় করল, তার নামাজ কবুল করা হবে না। লোকেরা বলল, ওজর কী? রাসূলুল্লাহ সা. বললেন: ভয় ও রোগ। (আবু দাউদ)
এ হাদীস থেকে বোঝা যায়, নামায একাকী নয়, বরং জামায়াতের সাথেই পড়তে হবে। হযরত জিবরাইল আ: রাসূলুল্লাহ সা.-কে নামাযের শিক্ষা দেয়ার সময়ও জামায়াতের ব্যবস্থাপনার সাথে নামায বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। তা ছাড়া কুরআনেও যতবার নামাযের প্রসঙ্গ এসেছে ততবারই নামায কায়েম করার কথাই এসেছে। নামায কায়েম একটি ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ। নামাজ কায়েমের একটি অন্যতম শর্ত হচ্ছে জামায়াতের সাথে নামায আদায় করা। কেউ ব্যক্তিগতভাবে নামাজ আদায় করলে নামায কায়েম হয়েছে এ কথা বলা যাবে না।
সূরা বাকারার প্রথম পাঁচটি আয়াতে মুত্তাকিদের যে বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে সেখানে দ্বিতীয় গুণটি হলো: যারা (ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রিয় জীবনে) নামাজ প্রতিষ্ঠা করে। এখানেও নামাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। আর কোনো কিছু প্রতিষ্ঠা করতে গেলে তা একা একা সম্ভব নয়, সেখানে সঙ্ঘবদ্ধতা তথা জামায়াত ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন।
ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ নামাজ এমন এক গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক আমল যে, রাসূলুল্লাহ সা. ও সাহাবাদের যুগে তা আমল করার জন্য যদি কেউ জামায়াতে শামিল না হতো তবে তাকে মুসলমানই মনে করা হতো না। সে সময় মুনাফিকরা পর্যন্ত নিজেদের মুসলিম হিসেবে জাহির করার জন্য নামাযের জামায়াতে শামিল হতো। কুরআন ও হাদীসের উল্লেখিত বাণী থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, জামায়াতে নামায আদায়ের গুরুত্ব কত। তাই আসুন, জামায়াতে নামায আদায়ের মাধ্যমে একটি জামায়াতবদ্ধ জিন্দেগি গড়ে তুলে আল্লাহর রজ্জুকে ঐক্যবদ্ধভাবে আঁকড়ে ধরি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে জামায়াতবদ্ধ জীবন-যাপন করার তাওফীক দান করুন। আমীন!