ইসলামী পোশাকের মূলনীতি
মুহাম্মদ হামিদুল ইসলাম আজাদ
আমাদের দেশে বর্তমানে সুন্নাতী লেবাস, পোশাক-পরিচ্ছেদ বলে এক ধরনের বিশেষ কাটিং ও বিশেষ পরিমানের লম্বা কোর্তা পরিধান করা হচ্ছে। প্রচার করা হচ্ছে যে, এই হলো সুন্নাতী লেবাস, পোশাক-পরিচ্ছেদ। আর যে ব্যক্তি এ সুন্নাতী লেবাস, পোশাক-পরিচ্ছেদ পরবেনা সে ফাসেক বলে বিবেচিত হবে এবং এমন ব্যক্তি যদি আলিম হয়, তাহলে তার পেছনে নামায পড়া জায়েয হবেনা। এ ধারণার করণে সমাজের এক বিশেষ শ্রেণীর লোক-আলিম ও পীরগণ এ ধরনের বিশেষ কাটিং ও বিশেষ পরিমানের লম্বা কোর্তা পরিধান করা কে সুন্নাহ মনে করেণ, সূন্নাতী লেবাস, পোশাক-পরিচ্ছেদ বলই তারা এর প্রচারও করেন। শুধু নিজেরাই তা পরিধান করে এমন নয়, বরং তারা তাঁদের অনুসারী, ছাত্র, মুরীদনকেও অনুরুপ বিশেষ কাটিং ও বিশেষ পরিমানের লম্বা কল্লিদান কোর্তা পরিধান করতে বাধ্য করে থাকেন।
কিন্তু প্রশ্ন এই যে, সুন্নাতী লেবাস, পোশাক-পরিচ্ছেদ বলতে কি বুঝায়? কোনো বিশেষ কাটিং এর এবং বিশেষ লম্বা মাপের জামা পরিধান করা কি সত্যিই সুন্নাত? সে সুন্নাত কোন দলিলের ভিত্তিতে প্রমাণিত হলো? কুরআন থেকে? হাদীস থেকে? কুরআন ও হাদীসের আলোকে আমরা বিষয়টি জানার ও বুঝার চেষ্টা করব ইনশা আল্লাহ ............
মহান আল্লাহ সূরা আরাফের ২৬ ও ২৭ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেছেন,
হে বনী আদম! তোমাদের শরীরের লজ্জাস্থানগুলো ঢাকার এবং তোমাদের দেহের সংরণ ও সৌন্দর্য বিধানের উদ্দেশ্যে আমি তোমাদের জন্য পোশাক নাযিল করেছি। আর তাকওয়ার পোশাকই সর্বোত্তম। এই আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্যতম, সম্ভবত লোকেরা এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে। সূরা আরাফঃ ২৬
হে বনী আদম! শয়তান যেন তোমাদের আবার ঠিক তেমনি ভাবে বিভ্রান্তি-র মধ্যে নিক্ষেপ না করে যেমন ভাবে সে তোমাদের পিতামাতাকে জান্নাত থেকে বের করেছিল এবং তাদের লজ্জাস্থান পরস্পরের কাছে উন্মুক্ত করে দেবার জন্যে তাদেরকে বিবস্ত্র করেছিল। সে ও তার সাথীরা তোমাদেরকে এমন জায়গা থেকে দেখে যেখান থেকে তোমরা তাদেরকে দেখতে পাও না। এ শয়তানদেরকে আমি যারা ঈমান আনে না তাদের অভিভাবক করে দিয়েছি। সূরা আরাফঃ ২৭
এ আয়াতগুলোতে যে কথাগুলো বলা হয়েছে তা থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য সুষ্পষ্ট হয়ে সামনে ভেসে উঠেছেঃ
একঃ পোশাক মানুষের জন্যে কোন কৃত্রিম জিনিস নয়। বরং এটি মানব প্রকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবী। আল্লাহ মানুষের দেহের বহির্ভাগে পশুদের মত কোন লোমশ আচ্ছাদন জন্মগতভাবে তৈরী করে দেননি। বরং লজ্জার অনুভূতি তার প্রকৃতির মধ্যে গচ্ছিত রেখে দিয়েছেন। তিনি মানুষের যৌন অংগগুলোকে কেবলমাত্র যৌনাংগ হিসেবেই তৈরী করেন না বরং এগুলোকে "সাওআত" ও বানিয়েছেন। আরবী ভাষায় "সাওআত" এমন জিনিসকে বলা হয় যার প্রকাশকে মানুষ খারাপ মনে করে। আবার এ প্রকৃতিগত লজ্জার দাবী পূরণ করার জন্যে তিনি মানুষকে কোন তৈরি করা পোষাক দেননি। বরং তার প্রকৃতিকে পোশাক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করেছেন। যাতে নিজের বুদ্ধি ব্যবহার করে সে প্রকৃতির এ দাবীটি উপলব্ধি করতে পারে এবং আল্লাহর সৃষ্ট উপাদান ও উপকারণ সমূহ কাজে লাগিয়ে নিজের জন্যে পোশাক তৈরী করতে সক্ষম হয়।
দুইঃ এ প্রাকৃতিক ও জন্মগত উপলব্ধির প্রেক্ষিতে মানুষের জন্যে পোশাকের নৈতিক প্রয়োজন অগ্রগণ্য। অর্থাৎ প্রথমে সে "সাওআত" তথা নিজের লজ্জাস্থান আবৃত করবে। আর তার স্বভাবগত চাহিদা ও প্রয়োজন দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত। অর্থাৎ তারপর তার পোশাক তার জন্যে "রীশ" অর্থাৎ দৈহিক সৌন্দর্য বিধান করবে এবং আবহাওয়ার প্রভাব থেকে তার দেহ সৌষ্ঠবকে রা করবে। এ পর্যায়েও মানুষ ও পশুর ব্যাপার স্বভাবতই সম্পূর্ণ ভিন্ন। পশুর শরীরের লোমশ আচ্ছাদন মূলত তার জন্যে "রীশ" অর্থাৎ তার শরীরের শোভা বর্ধন ও ঋতুর প্রভাব থেকে তাকে রা করে। তার লোমশ আচ্ছাদন তার লজ্জাস্থান ঢাকার কাজ করে না। কারণ তার যৌনাংগ আদতে তার সাওআত বা লজ্জাস্থান নয়। কাজেই তাকে আবৃত করার জন্যে পশুর স্বভাবও প্রকৃতিতে কোন অনুভূতি ও চাহিদা থাকে না এবং তার চাহিদা পূরণ করার উদ্দেশ্যে তার জন্যে কোন পোশাকও সৃষ্টি করা হয় না। কিন্তু মানুষ যখন শয়তানের নেতৃত্ব গ্রহণ করলো তখন ব্যাপারটি আর উল্টে গেলো। শয়তান তার এ শিষ্যদেরকে এভাবে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হলো যে, তোমাদের জন্যে পোশাকের প্রয়োজন পশুদের জন্য পোশাকের প্রয়োজনের সমপর্যায়ভুক্ত, আর পোশাক দিয়ে লজ্জাস্থান ঢেকে রাখার ব্যাপারটি মোটেই কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় । বরং পশুদের অংগ-প্রত্যংগ যেমন তাদের লজ্জাস্থান হিসেবে বিবেচিত হয় না, ঠিক তেমনি তোমাদের এ অংগ-পত্যংগ গুলোও লজ্জাস্থান নয় বরং এগুলো নিছক যৌনাংগ।
তিনঃ মানুষের পোশাক কেবলমাত্র তার লজ্জাস্থান আবৃত করার এবং তার শারীরিক শোভাবর্ধন ও দেহ সংরণের উপায় হবে, এতটুকুই যথেষ্ঠ নয়। বরং আসলে এ ব্যাপারে তাকে অন্তত এতটুকু মহত্তর মানে পৌছতে হবে, যার ফলে তার পোশাক তাকওয়ার পোশাকে পরিণত হয়। অর্থাৎ তার পোশাক দিয়ে সে পুরোপুরি "সতর" তথা লজ্জাস্থান ঢেকে ফেলবে। সৌন্দর্য চর্চা ও সাজসজ্জার মাধ্যমে শরীরের শোভা বর্ধন করার ক্ষেত্রে তা সীমা অতিক্রম করে যাবে না বা ব্যক্তির মর্যাদার চেয়ে নিম্ন মানেরও হবে না। তার মধ্যে গর্ব, অহংকার ও আত্মম্ভরিতার কোন প্রদর্শনী থাকবে না। আবার এমন কোন মানসিক রোগের প্রতিফলনও তাতে থাকবে না। যার আক্রমণের ফলে পুরুষ নারীসূলভ আচরণ করতে থাকে, নারী করতে থাকে পুরুষসূলভ আচরণ এবং এ জাতি নিজেকে অন্য এক জাতির সদৃশ বানাবার প্রচেষ্টায় নিজের নিজের হীনতা ও লাঞ্ছনার জীবন্ত-প্রতীকে পরিণত হয়। যেসব লোক নবীদের প্রতি ঈমান এনে নিজেদেরকে পুরোপুরি আল্লাহর পথনির্দেশনার আওতাধীন করে দেয়নি তাদের পে পোশাকের ব্যাপারে এ কাংখিত মহত্তর মানে উপনীত হওয়া কোনক্রমেই সম্ভব নয়। যখন তারা আল্লাহর পথনির্দশনা গ্রহণে অসম্মতি জানায় তখন শয়তানদেরকে তাদের পৃষ্ঠপোষক ও অভিভাবক বানিয়ে দেয়া হয় এবং এ শয়তান তাদেরকে কোন না কোনভাবে ভূল-ভ্রান্তি ও অসৎকাজে লিপ্ত করেই ছাড়ে।
চারঃ দুনিয়ার চারদিকে আল্লাহর যেসব অসংখ্য নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে এবং যেগুলো মহাসত্যের সন্ধানলাভের ব্যাপারে মানুষকে সাহায্য করে, পোশাকের ব্যাপারটিও তার অন্যতম। তবে এখানে শর্ত হচ্ছে, মানুষের নিজের তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। ওপরে আমি যেসব সত্যের দিকে ইংগিত করেছি সেগুলোকে একটু গভীর দৃষ্টিতে বিশেষণ করলে পোশাক কোন দৃষ্টিতে আল্লাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন তা সহজেই অনুধাবন করা যেতে পারে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
আমি তোমাদের জন্য পোশাক অবতীর্ণ করেছি, যা তোমাদের লজ্জা স্থান আবৃত করে এবং অবতীর্ণ করেছি সাজ সজ্জার বস্ত্র এবং পরহেজগারির পোশাক, এটি সর্বোত্তম। অন্য দিকে বেহায়াপনা, বেল্লাপনা ও উলঙ্গপনাকে হারাম করা হয়েছে।
একই সূরার ৩৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন,আপনি বলে দিন, আমার পালনকর্তা প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীল বিষয়গুলো হারাম করেছেন। এটি আল্লাহর কুদরতের অন্যতম নিদর্শন, যাতে তারা চিন্তা ভাবনা করে।
পোশাক ব্যবহারের উদ্দেশ্য বিশ্লেষণ করলে নিচের কারণগুলো আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠেঃ
১. প্রতিকুল আবহাওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করাঃ আবহাওয়ার প্রতিকূলতায় প্রকৃতি বিশ্বব্যাপী এক নয়। গরম দেশের পোশাক আর শীত প্রধান দেশের পোশাক যে এক হবে না তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। তাই প্রাথমিকভাবে মানুষ তার পরিবেশ অনুসারে পোশাক বেছে নেয়।
২. লজ্জাস্থানকে ঢাকাঃ লজ্জাস্থানের পরিমাণ বোধ ভিন্ন হতে পারে; কিন্তু লজ্জাস্থানকে আবৃত করা মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি।
৩. নিজেকে বা শ্রেণীকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করাঃ সভ্যতার একটি অবদান হলো ইউনিফর্ম। ইউনিফর্ম হিসেবে পোশাক ব্যবহার করে বিভিন্ন শ্রেণীর অভ্যন্তরীণ সৃংখলা এবং সমতা বিধান করাসহ উক্ত গোষ্ঠী বা শ্রেণীকে অন্য গোষ্ঠী বা শ্রেণী থেকে পৃথকভাবে চিহ্নিত করা হয়।
৪. সৌন্দর্য বৃদ্ধি করাঃ বেশভূষা মানুষের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। সমাজজীবনকে করে সুসৃংখল।
লিবাস বা পোশাকের সুন্নাত নিয়ে উলামায়ে কিরামের মতামত:
ইসলামী পোশাক! পোশাক মানব জীবনের এক অবিচ্ছিন্ন অংশ। পোশাক সম্বন্ধে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে বলেছেন-
হে আদম সন্তান! নিশ্চয় আমি তোমাদিগকে পোশাক দান করেছি, যাতে তোমরা তোমাদের লজ্জা নিবারণ করতে পার এবং শোভা হিসেবেও; আর তাকওয়ার পোশাক-সে-ই তো উত্তম। এ হলো আল্লাহর নিদর্শনসমূহ হতে, আশা করা যায় তারা উপদেশ গ্রহণ করবে।' (সূরা আরাফ, আয়াত ২৬)
হাদীস শরীফে এসেছে-মান তাশাবাহা বিকওমিন ফাহওয়া মিন হুম' যারা যে ধর্ম জাতির সাদৃশ্য গ্রহণ করবে তারা তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
উপরোক্ত আযাত ও হাদীসের আলোকে মুজতাহিদ ফকীহগণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, যে সকল পোশাক কোন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বিশেষ নিদের্শন বা তাদের ধর্মীয় পোশাক সেগুলো মুসলমানদের জন্য নিষিদ্ধ। যা বিধর্মীদের (ধর্মীয়) পোশাক নয়, তা পরিধান করা জায়েজ; আমাদের দেশের উলামায়ে কিরাম জুব্বা বা গোল লম্বা জামা পছন্দ করেন। এতে আরব ও আরবীয় সংস্কৃতির সাথে সাদৃশ্য ও মহব্বত প্রকাশ পায় অনেকে পাঞ্জাবিকেও ইসলামী পোশাক মনে করেন: মূলত পাঞ্জাবি নামটি ভারত ও পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের সাথে সম্পর্কিত। ভারতীয় ধূতি, গেঞ্জি ও ফতুয়া (টিশার্ট) এর বিকল্প হিসেবে পাঞ্জাবিকে অনেকটা ইসলামী ভাবধারার মনে করা যায়। ধূতি ফতুয়া বাঙালি পোশাক হলেও লুঙ্গী পাঞ্জাবি বাঙালি মুসলমানের পোশাক হিসেবেই পরিচিত। লিবাস বা পোশাকের সুন্নাত নিয়ে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের উলামায়ে কিরামের মধ্যে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। যেমন-:
প্রথম মত হলো-: জামা গোল হতে হবে, লম্বায় কমপক্ষে নিছফ চাক (হাঁটু ও গোড়ালীর মাঝামাঝি) হতে হবে। তাদের দলিল হলো- নবীজি সাঃ কখনো একমাত্র জামা গায়ে নামায আদায় করেছেন। এখান থেকে বুঝা যায়, তা কমপক্ষে নিছফে চাক পরিমাণ লম্বা ছিল এবং গোল ছিল। তাই এটাই সুন্নাত।
দ্বিতীয় মত হলো-: জামা অবশ্যই নিছফ চাক (হাঁটু ও গোড়ীর মাঝামাঝি) হতে হবে; তবে ফাড়া হলেও চলবে। তাদের দলিল হলো- নবীজি সাঃ কখনো জামা গায়ে ঘোড়ার পিঠে চড়লে, দেখা গেছে জামার কোনা বাতাসে উড়ছে; এতে বুঝা গেল তা ফাড়া ছিল। তাই এতেও সুন্নাত আদায় হবে।
তৃতীয় মত হলো-: উভয় মতের সমন্বয়ের জন্য হাঁটুর নিচ পর্যন্ত সেলাই করা ও নিচে সামান্য ফাড়া রাখা।
চতুর্থ মত হলো-: জামায় ১টি মাত্র বুতাম হবে এবং কলার হবে না।
পঞ্চম মত হলো-: একাধিক বুতামও দেয়া যাবে এবং কলার থাকলেও ক্ষতি নেই।
ষষ্ঠ মত হলো-: যে এলাকায় যেটাকে মানুষ ইসলামী পোশাক মনে করে তাতেই হবে।
সপ্তম মত হলো-: ইসলামী পোশাক নামে নির্দিষ্ট কোন পোশাক নেই। শালীন, ভদ্র, মার্জিত ও রুচিসম্মত যে কোন পোশাকই ইসলামী পোশাক হিসেবে গণ্য হবে। যাতে লজ্জা নিবারণ, ইজ্জত আভ্রু রক্ষা ও শোভা বর্ধন হয়। যা কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে; এবং খায়রুল কুরূন তথা সাহাবায়ে কিরাম তাবিয়ীন ও তাবে তাবিয়ীনদের আমল দ্বারাও প্রমাণিত হয়। কোর্ট, প্যান্ট ও টাই বিধর্মীদের (ধর্মীয়) পোশাক কি-না? (কেউ কেউ মনে করেন এসব বিধর্মীদের ধর্মীয় পোশাক, বিশেষত টাই ক্রুসের চিহ্ন)।
আসলে কোর্ট, প্যান্ট ও টাই বিধর্মীদের (ধর্মীয়) পোশাক বলে প্রমাণিত হয় না। কারণ কোন ইয়াহুদী ধর্মযাজক (রাহেব ও রাব্বী) কখনো এ পোশাক পরেন না; অনুরূপ কোন খ্রিস্টান ধর্মযাজক (পাদ্রী ও পোপ) কখনো এ পোশাক পরেন না; এমনকি হিন্দু ধর্মযাজক (ঠাকুর ও ব্যাহ্মণ) এবং বৌদ্ধ ধর্মযাজক (ভিক্ষু ও পুরুহিত) তারাও এ পোশাক পরেন না।
এতে বুঝা গেল এসব তাদের কারোই ধর্মীয় পোশাক নয়। পরিশেষে বলতে হয়-যদি কেউ কোনো পোশাককে জ্ঞানত সুন্নাত মনে করেন; কিন্তু অনীহা বশত তা আমল না করেন বা কোন পোশাককে সুন্নাতের খেলাফ মনে করেন তথাপি বিলাসিতা ও সৌখিনতাবশত তা পরিধান করেন; তাহলে তিনি সুন্নাত তরককারী হিসেবে গণ্য হবেন; অন্যথায় নয়। উপমহাদেশের অন্যতম শ্যেষ্ঠ মনীষী হযরত আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহঃ বলেন, দুটি বিদআত মুসলমানদের চরম ক্ষতি করেছে। এর একটি হলো মুসলিম দেশের মধ্যে সীমান্ত বা ভৌগলিক বিভাজন; দ্বিতীয় টি হলো পোশাকের বিভিন্নতায় ছুতায় মুসলমানদের বিভক্ত করণ।
পোশাক ব্যবহারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কুরআনের বর্ণনাঃ
আল্লাহ তায়ালা পোশাক ব্যবহারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন,
তিনি নিজের সৃষ্টি বহু জিনিস থেকে তোমাদের জন্য ছায়ার ব্যবস্থা করেছেন, পাহাড়ে তোমাদের জন্য আশ্রয় তৈরি করেছেন এবং তোমাদের এমন পোশাক দিয়েছেন, যা তোমাদের গরম থেকে বাঁচায় আবার এমন কিছু অন্যান্য পোশাক তোমাদের দিয়েছেন যা পারস্পরিক যুদ্ধে তোমাদের হেফাজত করে এভাবে তিনি তোমাদের প্রতি তাঁর নিয়ামত সমূহ সম্পূর্ণ করেন, হয়তো তোমরা অনুগত হবে। সূরা নাহল: ৮১
হে আদাম সন্তানগণ, আমি তোমাদের পোশাক-পরিচ্ছদ দিয়েছি লজ্জাস্থান ঢাকার ও বেশভূষার জন্য। সূরা আরাফ: ২৬
আমাদের পর্যবেক্ষণ এবং আল-কুরআনে বর্ণিত উদ্দেশের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করার কথা বলে স্বয়ং আল্লাহ ভৌগোলিক কারণে বিশ্বব্যাপী পোশাকের বিভিন্নতার স্বীকৃতি দিয়েছেন। ভৌগোলিক কারণেই বিশ্বব্যাপী পোশাকের একই ডিজাইন নির্ধারণ করা ইসলাম ও বিজ্ঞানসম্মত নয়। বিজ্ঞানের আধার মহান আল্লাহ কুরআনে তা নির্দেশও করেননি।
দ্বীনের ক্ষেত্রে ইসলাম প্রতিটি বিন্দুতে অনঢ় হলেও শরিয়তি বিধানের ক্ষেত্রে ইসলাম সেভাবে অনঢ় না হয়ে সীমানা নির্ধারণ করেছে। তবে সীমানার ক্ষেত্রে অনঢ়। যেহেতু হজরত মুহাম্মদ সা. শেষ নবী, তাই ইসলাম অনাগত ভবিষ্যতের সবদিক খোলা রেখে শুধু জীবনের বিভিন্ন ব্যবহারিক দিকের চুতসীমা নির্ধারণ করেছে। সীমার ভেতর মুমিনের আছে স্বাধীনতা। ইজতিহাদ করার অধিকারও এই সীমার মধ্যে। পোশাক-পরিচ্ছেদের ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসে যে, মৌলিক বিধান বা সীমারেখা দেয়া আছে তা ঠিক রেখে আমরা স্বাধীন ভাবে আমাদের পোশাক-পরিচ্ছেদ নির্বাচন করে তা পরিধান করতে পারি। করণ ইসলাম এক্ষেত্রে আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছে। এখন আমাদের জানতে হবে পোশাক-পরিচ্ছেদের ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসে কি বিধান দেয়া আছে।
পোশাকের কুরআনিক মৌলিক বিধানঃ
১. লজ্জাস্থান তথা সতর আবৃতকারী পোশাক হতে হবেঃ মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে বলেছেন- নবী! মুমিন পুরুষদের বলে দাও তারা যেন নিজেদেও দৃষ্টি সংযত করে রাখে এবং নিজেদেও লজ্জাস্থানসমূহের হেফাজতকরে? এটি তাদেও জন্য বেশী পবিত্র পদ্ধতি? যা কিছু তারা কওে আল্লাহ তা জানেন? সূরা আন নূর: ৩০
লজ্জা স্থানের হেফাজত অর্থ নিছক প্রবৃত্তির কামনা থেকে দূরে থাকা নয় বরং নিজের লজ্জাস্থানকে অন্যের সামনে উন্মুক্ত করা থেকে দূরে থাকাও বুঝা।
পুরুষদের সতরের সীমানাঃ
পুরুষের জন্য সতর তথা লজ্জাস্থানের সীমানা রাসূল সাঃ নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত- নির্ধারণ করেছেন। তিনি বলেছেনঃ ''পুরুষের সতর হচ্ছে তার নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত-''। (দারু কুতনী ও বাইহাকী)
শরীরের এ অংশ স্ত্রী ছাড়া কারোর আমনে ইচ্ছা কৃত ভাবে খোলা হারাম। আসহাবে সুফ্ফার দল ভুক্ত জারহাদে আসলামী রাঃ বর্ণনা করেছেন, এক বার রাসূল সাঃ এর মজলিসে আমার রান খোলা অবস্থায় ছিল্ নবী করীম সাঃ বললেনঃ'' তুমি কি জানোনা, রান ঢেকে রাখার জিনিস''। (তিরমিযী, আবু দাউদ, মুআত্তা)
আলী রাঃ বর্ণনা করেন, রাসূল সাঃ বলেছেনঃ ''নিজের রান কখনো খোলা রাখবেনা।'' (আবু দাউদ ও হবনে মাজাহ)
কেবল অন্যের সামনে নয়, একান্তে-ও উলংগ থাকা নিষিদ্ধ। তাই নবী করীম সাঃ বলেছেনঃ ''সাবধান, কখনো উলংগ থেকো না। কারণ তোমাদেও সাথে এমন সত্তা আছে যারা কখনো তোমাদের থেকে আলাদা হয় না (অর্থাৎ কল্যাণকর রহমতের ফেরেশতা), তোমরা যখন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দাও অথবা স্ত্রীদেও কাছে যাও সে সময় ছাড়া, কাজেই তাদের থেকে লজ্জা করো এবং তাদের কে সম্মান করো।''(তিরমিযী)
অন্য একটি হাদীসে নবী করীম সাঃ বলেনঃ ''নিজের স্ত্রী ছাড়া বাকি সবার থেকে নিজের সতরের হেফাজত করো।' এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করে, আর যখন আমরা একাকী থাকি? জবাবদেনঃ ''এঅবস্থায় আল্লাহ থেকে লজ্জা করা উচিত, তিনিই এর বেশী হক দার।' আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ।
নারীদের সতরের সীমানাঃ
নারীদের সতরের সীমানা পুরুষদের থেকে আলাদা। তা ছাড়া মেয়েদের সতর মেয়েদের ও পুরুষদের জন্য আবার ভিন্নভিন্ন। পুরুষদের জন্য মেয়েদের সতর হাত ও মুখ ছাড়া তার সারা শরীর। স্বামী ছাড়া অন্য কোন পুরুষ এমন কি বাপ ও ভাইয়ের সামনেও তা খোলা উচিত নয়। মেয়েদের এমন পাতলা বা চোস্ত- পোশাক পরা উচিত নয় যার মধ্য দিয়ে শরীর দেখা যায় বা শরীরের গঠন কাঠামো ভেতরে থেকে ফুটে উঠতে থাকে। আয়েশা রাঃ বর্ণনা করেন, তাঁর বোন আসমা বিনতে আবু বকর রাসূল সাঃ এর সামনে আসেন। তখন তিনি পাত্লা কাপড় পড়ে ছিলেন। রসূল সাঃ সংগে সংগেই মুখ ফিরিয়ে নেন এবং বলেনঃ ''হে আসমা! কোন মেয়ে যখন বালেগ হয়ে যায় তখন তার মুখ ও হাত ছাড়া শরীরের কোন অংশ দেখা জায়েয নয়।'' আবু দাউদ
এ ধরনের আর একটি ঘটনা ইবনে জারীর আয়েশা থেকে উদ্ধৃত করেছেনঃ তাঁর কাছে তাঁর বৈপিত্রেয় ভাই আবদুল্লাহ ইবনু ততোফায়েলের মেয়ে আসেন। রাসূল সাঃ ঘরে প্রবেশ করে তাকে দেখেই মুখ ফিরিয়ে নেন। আযেশা রাঃ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এ হচ্ছে আমার ভাইয়ের মেয়ে। তিনি বলেনঃ ''মেয়ে যখন বালেগ হয়ে যায় তখন তার জন্য নিজের মুখ ও হাত ছাড়া আর কিছু বের করে রাখা হালাল নয়, আর নিজের কব্জির ওপর হাত রেখে হাতের সীমানা তিনি এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, তাঁর মুঠি ও হাতের তালুর মধ্যেমাত্র এক মুঠি পরিমাণ জায়গা খালি থাকে।'
এব্যাপারে শুধুমাত্র এতটুকুসুযোগ আছে যে, ঘরে কাজ কর্ম করার জন্য মেয়েদের শরীরের যতটুকু অংশ খোলার প্রয়োজন দেখা দেয় নিজেদের মুহাররাম আত্মীয়দের (যেমন বাপ-ভাই ইত্যাদি) সামনে মেয়েরা শরীরের কেবল মাত্র ততটুকু অংশই খুলতে পারে। যেমন আটা মাখার সময় হাতের আস্তি-নগুটনো অথবা ঘরেরমেঝে ধুয়ে ফেলার সময় পায়ের কাপড় কিছু ওপরের দিকে তুলেনেয়া।
আর মহিলদের জন্য মহিলাদের সতরের সীমারেখা হচ্ছে পুরুষদের জন্য পুরুষদের সতরের সীমারেখার মতই। অর্থাৎ নাভী ও হাঁটুর মাঝ খানের অংশ। এর অর্থ এনয় যে, মহিলাদের সামনে মহিলারা অর্ধউলংগ থাকবে।
২. পোশাক অপচয় ও অহমিকাপূর্ণ হবে নাঃ মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে বলেছেন- হে বনী আদম! প্রত্যেক ইবাদাতের সময় তোমরা নিজ নিজ সুন্দর সাজে সজ্জিত হও? আর খাও ও পানকরো কিন্তু সীমা অতিক্রম করে যেয়োনা, আল্লাহ সীমা অতিক্রমকারীদের কে পছন্দ করেন না। সূরা আরাফ: ৩১
এখানে সুন্দর সাজ বলতে পূর্ণ পোশাক-পরিচ্ছেদের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহর ইবাদত করার জন্যে দাঁড়াবার সময় কে বল মাত্র লজ্জাস্থান ঢাকাই যথেষ্ট হবেনা। বরং একই সংগে সামর্থ অনুযায়ী নিজের পূর্ণ পোশাক পরে নিতে হবে, যার মাধ্যমে লজ্জা স্থান আবৃত হবার সাথে সাথে সৌন্দর্যের প্রকাশও ঘটবে। মূর্খ ও অজ্ঞ লোকেরা নিজেদের ভ্রান্তি-নীতির ভিত্তিতে ইবাদতের ক্ষেত্রে যে সব কাজ করতো এবং এখনো করে চলছে এনির্দেশে তার প্রতিবাদ করা হয়েছে। তারা মনে করতো উলংগ বা অর্ধ-উলংগ হয়ে এবং নিজেদের আকার, আকৃতি ও বেশ ভুষাবিকৃত করে আল্লাহর ইবাদত করা উচিত। আল্লাহ বলেন, নিজেকে সুন্দর সাজেসজ্জিত করে এমন আকার আকৃতি ধারণ করে ইবাদত করতে হবে যার মধ্যে উলংগ পনাতো দূরের কথা অশ্লীলতার লেশমাত্রও যেন না পাওয়া যায়।
৩. মহিলাদের পোশাকে মাথা, বক্ষ এবং গ্রীবা আবৃতকারী কাপড় থাকতে হবেঃ আল্লাহ রব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে বলেছেন- আর হে নবী! মুমিন মহিলাদের বলে দাও তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত করে রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানগুলোর হেফাজত করে আর তাদের সাজসজ্জা না দেখায়, যা নিজে নিজে প্রকাশ হয়ে যায় তা ছাড়া। আর তারা যেন তাদের ওড়নার আঁচল দিয়ে তাদের বুক ঢেকে রাখে। তারা যেন তাদের সাজসজ্জা প্রকাশ না করে। সূরা আন নূর: ৩১
কুরআনিক বিধানের পর আমরা পাই রাসুল সাঃ সুন্নাহ থেকে পোশাকের ব্যবহারিক সীমা। অনেকে মনে করেন রাসুলের সাঃ পোশাক ছিল ৬ষ্ঠ শতাব্দীর আরবের প্রচলিত পোশাক। প্রকৃত ঘটনা তা নয়। রাসূল সাঃ এর পোশাক এক ছিল না। রাসুল সা. পোশাক ছিল এক আল্লাহতে বিশ্বাসী তাকওয়ার পোশাক; কিন্তু একই আবহাওয়া ও দেশে বাস করার পরও কাফিরদের পোশাক ছিল মুশরিকি চিন্তায় সিক্ত।
রাসূল সাঃ এবং সাহাবিগণ যে একটিমাত্র ডিজাইনের পোশাক পরতেন এমন নয়। হাদিস শাস্ত্র অধ্যয়ন করলে আমরা অনেক ধরনের পোশাকের নাম দেখতে পাই। যেমন কামিস (জামা), কাবা বা কোর্তা (কোট জাতীয় জামা), ইজার (সেলাইবিহীন লুঙ্গি) রিদা (চাদর), তুব্বান (হাফ প্যান্ট বা হাফ পায়জামা, জাঙ্গিয়া), জুব্বা, সারাবিল (পায়জামা, ফুলপ্যান্ট, সালোয়ার), খিমার (ওড়না), জেলবাব ইত্যাদি। রাসূল সা. নিজেও যুদ্ধে, সফরে, অনুষ্ঠানে, ঈদগাহ, মেহমানদের সাথে সাক্ষাতের সময় সুবিধাজনক পোশাক পরিধান করেছেন ।
তবে দৈনন্দিন জীবনে রাসূল সাঃ প্রায় সময় ইজার (সেলাইবিহীন লুঙ্গি) এবং রিদা (চাদর) পরিধান করতেন। আবু বুরদাহ রাঃ বর্ণনা করেছেন, আয়েশা রাঃ একখানা চাদর ও মোটা কাপড়ের একটি ইজার নিয়ে আমাদের নিকট এলেন এবং বললেন, যখন নবী সাঃ ওফাত যান, তখন এ দুটি পোশাক তার পরিধানে ছিল। সহি বুখারী বিভিন্ন বর্ণনা থেকে এটা খুবই স্পষ্ট যে, রাসূল সা. তত্কালীন আরব দেশের পোশাককে বাতিল না করে প্রথমত ইসলামী আকিদার আলোকে সংশোধন বা সংস্কার করেছেন। দ্বিতীয়ত: বৈসাদৃশ্য সৃষ্টির মৌলিক নীতির ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী সব সম্প্রদায় থেকে মুসলমানদের পোশাককে পৃথক করেছেন।
আল্লাহ রব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে বলেছেন- যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করলো সে আসলে আল্লাহরই আনুগত্য করলো? সূরা নিসা: ৮০
তাই রাসূল সাঃ নির্দেশ অবশ্য পালনীয়। পরিভাষায় ওয়াজিব বা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা যাই বলা হোক না কেন, যে বিষয়ে রাসূল সাঃ এর সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে, সেটি অমান্য করার কোনো সুযোগ নেই।
চলবে ইনশাআল্লাহ...........................................................
চলবে ইনশাআল্লাহ...........................................................