ইসলামী পোশাকের মূলনীতি
মুহাম্মদ হামিদুল ইসলাম আজাদ
রাসূল সাঃ কর্তৃক নির্দেশিত পোশাকের আবশ্যিক বিধানঃ
১. পোশাক-পরিচ্ছেদ টাইট বা আঁটসাঁট হওয়া চলবে নাঃ অর্থাৎ পোশাক হতে হবে ঢিলে ঢালা। এমন পোশাক পরিধান করা যাবে না, যে পোশাক পরিধান করার পরও লজ্জাস্থানের অবয় বোঝা যায়। রাসূল সাঃ ওই সব লোকদের অভিসম্পাত করেছেন যারা পোশাক পরার পরও উলঙ্গ থাকে। পোশাক টাইট, ফিট হতে পারবে না।
২. এমন পাতলা বা ফিনফিনে কাপড় পড়া যাবে না যে কাপড় পরার পরও লজ্জাস্থান দেখা যায়ঃ হাদীস শরিফে ইরশাদ হয়েছে,
যেসব মহিলা অত্যন্ত পাতলা কাপড় পরিধান করেন, কাপড়ের ওপর দিয়ে শরীর দেখা যায় তারা জাহান্নামের কঠোর শাস্তি ভোগ করবেন। কাপড় পরিধান করা সত্ত্বেও তারা উলঙ্গ। সুতরাং এ ধরনের কাপড় পরিধান করলে উলঙ্গ ও বেপর্দা থাকার গোনাহ হবে। আর এ ধরনের কাপড় পরে নামাজ পড়লে নামাজ সহী হবে না। পোশাক পাতলা হতে পারবে না। শামি ২/৭৭, আহসানুল ফাতাওয়া ৩/৪০৩
৩. নারী-পুরুষের এবং পুরুষ-নারীর পোশাক পরিধান করা যাবে নাঃ এখন অনেক ছেলেদের দেখা যায় যারা হাতে বিভিন্ন রকমের বালা পরিধান করে, কানে দুল দেয়,গলায় মালা বা চেইন পরে, পাঞ্জাবির সাথে ওড়না পরে ইত্যাদি। অন্য দিকে মেয়েরা তাদের নিজস্ব ইসলামী পোশাক পরিধানের পরিবর্তে জিন্সের প্যান্ট, টিশার্ট, স্কিন টাইট গেঞ্জি, পাঞ্জাবি ইত্যাদি পরিধান করছে। রাসূল সাঃ ওই সব পুরুষকে লানত করেছেন যারা নারীর বেশ ধারণ করে এবং ওই সব নারীকে লানত করেছেন যারা পুরুষের বেশ ধারণ করে। মহিলাদের পোশাক পা পর্যন্ত ঢাকা হবে। সর্বোপরি পুরুষ এবং মহিলার পোশাক পৃথক বৈশিষ্ট্যের হতে হবে।
৪. পুরুষের স্বর্ণের অলঙ্কার পরা যাবে নাঃ স্বর্ণ পুরুষের জন্য হারাম। অনেক ছেলেদের দেখা যায় গলায় স্বর্ণের চেইন ব্যবহার করে। হাতে স্বর্ণের আংটি পরে। বিশেষ করে বিয়েতে মেয়ে পক্ষ ছেলেকে স্বর্ণের আংটি ও গলার চেইন দেয়া। আবু হুরাইরা রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূল সাঃ পুরুষকে স্বর্ণের আংটি পরতে নিষেধ করেছেন। শুধু আংটি নয়, পুরুষের জন্য স্বর্ণের যে কোনো অলঙ্কার হারাম।
৫. পুরুষের রেশমি কাপড় পরিধান করা যাবে নাঃ এটা পুরুষের জন্য হারাম। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি দুনিয়াতে রেশমি কাপড় পরিধান করবে আখেরাতে তার জন্য কোনো অংশ নেই। অন্য একটি হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, রেশমি কাপড় দুনিয়াতে কাফেরদের জন্য আর মুমিনদের জন্য পরকালে। তাই কোনো মুসলিম পুরুষ রেশমী পোশাক পরিধান করতে পারবে না।
৬. বিজাতীয় পোশাক পরিধান করা যাবে নাঃ অন্য ধর্মাবলম্বীদের নির্ধারিত ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহার করে এমন পোশাক পরিধান করা জায়েজ নেই। যেমন, খ্রিষ্টানদের ক্রুশ অঙ্কিত পোশাক, হিন্দুদের মতো উল্কি আঁকা, সিঁদুর পরা ইত্যাদি। রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি অন্য কোনো জাতির অনুসরণ করবে সে সেই জাতির উম্মত হিসেবে গণ্য হবে। রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন, লানত বর্ষিত হোক সেই সব নারীর ওপর যারা উল্কি এঁকে নেয় এবং যারা উল্কি আঁকায়, যারা চুল উঠিয়ে ফেলে, ভ্রু প্লাক করে সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য দাঁত কেটে চিকন করে, দাঁতের মধ্যে ফাঁক সৃষ্টি করে যা আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে পরিবর্তন এনে দেয়। এক কথায় অন্য ধর্মের ধর্মীয় পোশাক পরিধান করা যাবে না। অন্য ধর্মের ধর্মীয় পোশাক নয় এমন যে, কোনো পোশাক ইসলামের বিধান মেনে পরিধান করা জায়েজ আছে। যেমন: শাট,প্যান্ট, কোট, কমপিলিট ডেরেছ ইত্যাদি।
৭. বেশি চাকচিক্য পোশাক পরিধান করা যাবে না, যাতে বিপরীত লিঙ্গকে আকৃষ্ট করে: নারী-পুরুষ উভয়ই পর নারী বা পর পুরুষকে আকৃষ্ট করার জন্য বেশি চাকচিক্য পোশাক পরিধান করা যাবে না। বিশেষ করে নারীরা এ ব্যাপারে সতর্ক থাকবে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘তারা যেন (নারীরা) যা সাধারণত প্রকাশমান এমন সৌন্দর্য ছাড়া অতিরিক্ত সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে বেড়ায়। (আল-কুরআন)
পোশাক এমন হবে না যে ইবাদতের সময় মনোযোগ আকর্ষণ করে। কাপড়ে কোনো প্রাণীর ছবি রাখা যাবে না।
৮. পুরুষের টাকনুর নিচে পোশাক পরিধান করা যাবে না: আজকাল অধিকাংশ পুরুষকে দেখা যায় তারা তাদের প্যান্ট পায়ের পাতা পর্যন্ত ঝুল দেয়া। এর মধ্যে যারা নামাজি তারা নামাজের সময় তাদের প্যান্ট টাকনু পর্যন্ত গুছিয়ে নেয়া। আসলে টাকনু পর্যন্ত কাপড় পরা পুরুষদের সব সময়ের জন্য আবশ্যক, শুধু নামাজের সময় নয়। রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন, ‘যেসব পুরুষ অহংকারের (ফ্যাশনের) জন্য টাকনুর নিচে কাপড় পরে মহান আল্লাহ কিয়ামতের দিন তাদের দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না। সহী বুখারী
পুরুষের পোশাক পায়ের গিরার নিচে ঝুলানো যাবে না। পুরুষদের পোশাক পায়ের গিরার নিচে ঝুলিয়ে পরার
ক্ষেত্রে
অহংকারকে অনেকে শর্ত হিসেবে মনে করেন। বলা হয়ে থাকে, অহংকার না থাকলে ঝুলিয়ে পরা যাবে। কিš' বহু হাদিস আছে, যেখানে অহংকারকে শর্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি।
পূর্বোক্ত পোশাকের নীতিমালা মেনে চললে বর্তমানে দেশে বিরাজমান অস্তিরতা অনেকাংশে কমবে। টিনেজার ও যুব সমাজকে তাদের সঠিক পথে চালনা করা সহজ হবে। তাদেরকে চারিত্রিক অবয়, ঝরে পড়া সর্বোপরি নেশা থেকে বাঁচানোর সম্ভব হবে। তা ছাড়া আমরা আমাদের জাতি সত্তা ও ধর্মীয় সংস্কৃতি রক্ষা করতে পারব। নচেৎ আমাদের ক্রমশ ধ্বংসের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। অধিক অস্তিরতার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
মহান আল্লাহ সূরা আরাফের ২৬ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেছেন, হে বনি-আদম! আমি তোমাদের জন্য পোশাক অবতীর্ণ করেছি, যা তোমাদের লজ্জা স্থান আবৃত করে এবং অবতীর্ণ করেছি সাজ সজ্জার বস্ত্র এবং পরহেজগারির পোশাক, এটি সর্বোত্তম। অন্য দিকে বেহায়াপনা, বেল্লাপনা ও উলঙ্গপনাকে হারাম করা হয়েছে।
একই সূরার ৩৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, আপনি বলে দিন, আমার পালনকর্তা প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীল বিষয়গুলো হারাম করেছেন। এটি আল্লাহর কুদরতের অন্যতম নিদর্শন, যাতে তারা চিন্তা ভাবনা করে। সূরা আরাফঃ ৩৩
কোর্ট ও টাই পড়ায় হুকুমঃ
যদি বুখারী বা মুসলিম শরীফের পোষাক পরিচ্ছেদ অধ্যায় পড়েন তাহলে দেখবেন কোর্ট পোষাক হিসাবে ব্যবহার করা যাবে। আর যারা বলছেন কোট পড়া যাবে না তারা যদি বুখারি বা মুসলিম শরীফের পোষাক পরিচ্ছেদ অধ্যায় পড়েন দেখবেন তাদের মা বোনেরা বিপদে পরে গেছেন কারন ঐ পোষাক পরিচ্ছেদ অধ্যায় এর সাথে শাড়ী কোন ভাবে মিলাতে পারবেন না। আর সৌদি আরবে জুব্বা পরে বালুর কারনে (নবী সাঃ এর সময়) বালির মধ্য নামায পড়ে নামায শেষে জুব্বা ঝারা দিলে বালু নিমিষেই চলে যেত। টাই সর্বপ্রথম ব্যাবহিত হয় চায়না ও রোমে। ১৬১৮-১৬৪৮ সালে Croatian
Military Frontier ফ্রান্সে এইটা ব্যবহার করা হয় যাতে করে তারা তাদের সৈন্য চিনতে পারে। যা আজ মানুষ পোশাক হিসেবে ব্যবহার করছে। তাই ইসলাম যে পোশাকের মূলনীতি দিয়েছে তা মেনে কোর্ট ও টাই পড়া যায়েজ।
টুপি বা পাগড়ী পড়া বা মাথা ঢাকা কতটুকু জরুরী?
পৃথিবীর প্রায় সকল জাতির মধ্যে মস্তকাবরণ ব্যবহারের নিয়ম আদিকাল থেকে ছিল, আজও আছে এবং আরবদের মধ্যেও এটা ছিল।
সে কারণে সালাতের সময় উত্তম পোষাক সহ টুপি, পাগড়ী প্রভৃতি মস্তকাবরণ ব্যবহার করা রাসূল সাঃ ও সাহাবায়ে কেরামের অভ্যাসগত সুন্নাত ছিল। আরবদের মধ্যে পূর্ব থেকেই এগুলির প্রচলন ছিল, যা ভদ্র পোষাক হিসাবে গণ্য হত। ইসলাম এগুলিকে বাতিল করেনি। বরং মস্তকাবরণ ব্যবহার করা মুসলমানদের নিকট সৌন্দর্যের অন্ত-র্ভুক্ত। (সিলসিলা যঈফাহ হা/২৫৩৮-এর আলোচনা শেষে দ্রষ্টব্য)
রাসূল সাঃ শুধু টুপি অথবা টুপিসহ পাগড়ী বা টুপি ছাড়া পাগড়ী পরিধান করতেন। (যা-দুল মাআদ ১/১৩০ পৃঃ) সাহাবীগণ টুপি ছাড়া খালি মাথায়ও চলতেন। (মুসলিম হা/২১৩৮, জানায়েয অধ্যায়, রোগীর সেবা অনুচ্ছেদ) হাসান বাছরী বলেন, সাহাবীগণ প্রচন্ড গরমে পাগড়ী ও টুপির উপর সিজদা করতেন। (বুখারী, তালীক্ব হা/৩৮৫, সালাত অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২৩)
বিশেষ অবস্থায় রাসূল সাঃ মাথায় বড় রুমাল ব্যবহার করেছেন। (বুখারী হা/৫৮০৭, পোষাক অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৬) তবে তিনি বা তাঁর সাহাবীগণ এটিতে অভ্যস্ত ছিলেন না। বরং ইসলামের দুশমন খায়বারের ইহুদীদের অভ্যাস ছিল বিধায় আনাস বিন মালেক রাঃ প্রমুখ সাহাবীগণ এটিকে দারুণভাবে অপছন্দ করতেন। (যা-দুল মাআদ ১/১৩৬-৩৭) ক্বিয়ামতের প্রাক্কালে আগত দাজ্জালের সাথে সত্তুর হাযার ইহুদী থাকবে। তাদের মাথায় বড় রুমাল থাকবে বলে হাদীসে এসেছে। (মুসলিম হা/৭৩৯২/২৯৪৪, ফিতান অধ্যায়-৫২, অনুচ্ছেদ-২৫)
মহিলাদের মাথা সহ সর্বাঙ্গ আবৃত রাখা অপরিহার্য। চেহারা ও দুই হস্ততালু ব্যতীত (নূর ২৪/৩১; আবু দাঊদ, মিশকাত হা/৪৩৭২, পোষাক অধ্যায়-২২)
অতএব সূরা আরাফে (৭/৩১) বর্ণিত আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে পূর্বে বর্ণিত পোষাকের ইসলামী মূলনীতি সমূহ অক্ষুন্ন রেখে, যে দেশে যেটা উত্তম পোষাক হিসাবে বিবেচিত, সেটাই সালাতের সময় পরিধান করা আবশ্যক।
মাথায় টুপি দেয়াটাকে মুত্তাকী বা পরহেজগারদের মাপকাঠি বানিয়ে ফেলা বা ইমাম-খতীবের মাথায় টুপি না দেখে ভৎসনা করা উচিত নয়। তাকওয়ার আসল পরিচয় পোশাকে নয়, আল্লাহর ভয়ে গুনাহ বর্জনের মাধ্যমেই তাকওয়ার প্রকাশ ঘটে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলেই এমন ঘটনার অবতারণা করা হয়ে থাকে। কারণ, রাসূল সাঃ টুপি ও পাগড়ি পরেছেন এবং পরিয়েছেন আরবীয় পোশাক ও ঐতিহ্য হিসেবে। তিনি এর জন্য কাউকে নির্দেশ দেননি বা তার থেকে কোনো ফযীলতের বর্ণনা সঠিকভাবে প্রমাণিত নয়।
পুরুষের শিরোভূষণ পাগড়ি!
বুখারী ও মুসলিমসহ বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থের সহীহ হাদীস সমূহের আলোকে নিশ্চিতরূপে জানা যায়, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সঙ্গী-সাহাবীরা সভা-সমাবেশ, যুদ্ধকাল ও ওয়াজ-নসীহতের সময় পাগড়ি পরিধান করতেন। ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাথায় শোভা পাচ্ছিল পাগড়ি। সাহাবী জাবির ইবন আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিজয়ের দিন ইহরাম ছাড়া মক্কায় প্রবেশ করেন তখন তাঁর মাথায় ছিল একটি কালো পাগড়ি। মুসলিম: ৩৩৭৫
খুতবা প্রদানকালে তিনি পাগড়ি পরতেন। সাহাবী আমর ইবন হুরাইস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, ‘আমি যেন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখতে পাচ্ছি, তিনি মিম্বরে বসে খুতবা দিচ্ছেন আর তাঁর মাথায় শোভা পাচ্ছে একটি কালো পাগড়ি, যার দুই প্রান্ত তিনি তাঁর দুই কাঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছেন। মুসলিম : ২/৯৯০
আরেক হাদীসে আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, তখন তাঁর গায়ে জড়ানো ছিল একটি চাদর যা দিয়ে তাঁর দুকাঁধ পেচিয়ে ছিল আর তাঁর মাথায় ছিল কালো কাপড়ের ইসাবাহ (এক ধরনের পাগড়ি)। এভাবেই তিনি মিম্বারে উপবিষ্ট হয়ে খুতবা প্রদান করলেন। বুখারী: ৩৮০০
সাধারণ সময়ও তাঁর মাথায় সৌন্দর্য বর্ধন করত এই পাগড়ি । সালাতের প্রস্তুতিপূর্বে যখন অজু করতেন তখনও এটি তার মাথায় লেপ্টে থাকত। সাহাবী মুগিরা ইবন শুবা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অজু করলেন, এতে কপালের উর্ধ্বাংশে এবং পাগড়ি ও মোজার ওপর মাসেহ করলেন। মুসলিম: ৪১২
শুধু নিজেই পরেননি, সাহাবীদের তিনি বিভিন্ন সময় পাগড়ি পরিয়েও দিয়েছেন। বিশেষত কাউকে সেনাপতি বা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণকালে তিনি তাকে নিজ হাতে পাগড়ি পরিয়ে দিয়েছেন বলে একাধিক সহীহ হাদীসে উল্লেখ রয়েছে। সাহাবায়ে কেরামের পাগড়ি: সাহাবায়ে কেরামের পাগড়ি পরিধান সম্পর্কেও বহু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। প্রখ্যাত তাবেঈ আবদুল্লাহ ইবন দিনার রহ. বলেন,
একবার হজের সফরে মক্কার পথে এক বেদুঈন আবদুল্লাহ ইবন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। আবদুল্লাহ তাঁকে সালাম দেন এবং তাকে নিজের বাহন গাধার পিঠে বসিয়ে নেন। আরনিজ মাথা থেকে পাগড়ি খুলে তাকে দিয়ে দেন। আমরা তাঁকে বললাম, এরা তো বেদুঈন, এরা তো অল্পতেই খুশি হয় (এত বড় উপহার দেয়ার কী দরকার ছিল?)। আবদুল্লাহ বললেন, এর বাবা আমার পিতা উমর ইবন খাত্তাবের বন্ধুদের অন্যতম ছিলেন। আমি রাসূল সাঃ কে বলতে শুনেছি, পিতার সেবাযতেœর পদ্ধতি হলো, পিতার প্রিয় মানুষদের সেবাযতœ করা। মুসলিম: ৬৬৭৭
এছাড়া ঈদের দিনে সাহাবায়ে কেরাম সবিশেষ পাগড়ি পরতেন বলে কোনো কোনো হাদীসে বিশেষভাবে উল্লেখ রয়েছে। মুসান্নাফ ইবন আবী শায়বা: ৫/১৭৮; বাইহাকী: ৫/১৭
আরবদের মধ্যে মাথায় (আবা) নামক বড় রুমাল ব্যবহারের ব্যাপকতা দৃষ্ট হয়। যা প্রাচীন যুগ থেকে সে দেশে ভদ্র পোষাক হিসাবে বিবেচিত। (মুসলিম, মিশকাত হা/২১০ ইলম অধ্যায়-২, পরিচ্ছেদ-১)
তবে সালাতের সময় রাসূল সাঃ বা সাহাবায়ে কেরাম কখনো বড় রুমাল মাথায় দিয়েছেন বলে জানা যায় না। এতে বরং সালাতের চাইতে রুমাল ঠিক করার দিকেই মনোযোগ বেশী যায় এবং এর মধ্যে রিয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকে। পাগড়ীর পরিমাপ বা রংয়ের কোন বাধ্যবাধকতা নেই। রাসূল সাঃ কালো পাগড়ী ব্যবহার করতেন। (মুসলিম, মিশকাত হা/১৪১০, জুমআর খুৎবা ও সালাত অনুচ্ছেদ; ইবনু মাজাহ হা/২৮২১-২২, জিহাদ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২২)
মদীনার সাতজন শ্রেষ্ঠ ফক্বীহ-এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ তাবেঈ বিদ্বান খারেজাহ (মৃঃ ৯৯ হিঃ) বিন যায়েদ বিন সাবেত রাঃ সাদা পাগড়ী ব্যবহার করতেন। তাবাক্বাতে ইবনে সাদ (বৈরূত: দার ছাদের ১৪০৫/১৯৮৫/৫/২৬২ পৃঃ)
যেভাবে পাগড়ি পরতেন: তাবেঈ আবু আবদুস সালাম রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘আমি আবদুল্লাহ ইবন উমরকে জিজ্ঞেস করলাম, রাসূল সাঃ কিভাবে পাগড়ি পরিধান করতেন? তিনি বললেন,“পাগড়ি তিনি মাথায় পেচিয়ে নিতেন, পেছন দিক থেকে গুজে দিতেন এবং প্রান্তদ্বয় উভয় কাঁধের মাঝ বরারব ঝুলিয়ে দিতেন।”মাজমাউয-যাওয়ায়েদ: ৫/১২০; হাদীসটির সূত্র গ্রহণযোগ্য
জ্ঞাতব্য: জনগণের মধ্যে পাগড়ীর ফযীলত বিষয়ে বেশ কিছু হাদীছ প্রচলিত আছে। যেমন ১. ‘পাগড়ীসহ দুরাকআত সালাত পাগড়ীবিহীন ৭০ রাকআত সালাতের চেয়ে উত্তম ২. পাগড়ী সহ একটি সালাত পঁচিশ সালাতের সমান। ৩. পাগড়ীসহ সালাতে ১০ হাযার নেকী রয়েছে। ৪. পাগড়ীসহ একটি জুমআ পাগড়ীবিহীন ৭০টি জুমআর সমতুল্য। ৫. ফেরেশতাগণ পাগড়ী পরিহিত অবস্থায় জুমআর দিন হাযির হন এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত পাগড়ী পরিহিত মুছল্লীদের জন্য দোআ করতে থাকেন। ৬.আল্লাহর বিশেষ একদল ফেরেশতা রয়েছে, যাদেরকে জুমআর দিন জামে মসজিদ সমূহের দরজায় নিযুক্ত করা হয়। তারা সাদা পাগড়ীধারী মুছল্লীদের জন্য আল্লাহর নিকটে মা প্রার্থনা করে থাকে। (সিলসিলা যঈফাহ ওয়াল মওযূআহ, হা/১২৭-২৯, ৩৯৫)
হাদীসের নামে প্রচলিত উপরোক্ত কথাগুলি জাল ও ভিত্তিহীন। এগুলি ছাড়াও পাগড়ীর ফযীলত বিষয়ে কথিত আরও অনেক হাদীস ও আছার সমাজে চালু আছে, যার সবগুলিই বাতিল, মিথ্যা ও বানোয়াট। আল্লাহভীরু মুসলিমের জন্য এসব থেকে দূরে থাকা কর্তব্য। বর্তমানে মুসলিম নারী-পুরুষের টুপী, পাগড়ী ও বোরক্বা-র মধ্যেও তারতম্য দেখা যায়। এ বিষয়ে সর্বদা হুঁশিয়ার থাকতে হবে, তা যেন অমুসলিমদের এবং মুসলিম নামধারী মুশরিক ও বিদআতীদের সদৃশ না হয়।
পাগড়ির রঙ: উপর্যুক্ত মুসলিম ও বুখারীর বর্ণনাসহ অধিকাংশ হাদীসে দেখা যায়, রাসূল সাঃ মদীনায়, সফরে ও যুদ্ধেক্ষেত্রে কালো রঙের পাগড়ি পরেছেন। কালো রঙ ছাড়া হলুদ রঙের পাগড়ি পরেছেন বলেও কিছু দুর্বল সূত্রের হাদীছ উল্লেখ রয়েছে। তবে সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে হলুদ পাগড়ির প্রচলন ছিল। বদরের যুদ্ধে তাঁরা ফেরেশতাদের মাথায় হলুদ পাগড়ি দেখেছেন বলেও গ্রহণযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। সাহাবীদেরকে রাসূল সাঃ সাদা রঙের পাগড়ি পরিয়েছেন এবং একে সমর্থন করেছেন বলেও হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। আবদুর রহমান ইবন আউফ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে সেনাপতি বানানোর সময় তিনি সাদা পাগড়ি পরিয়েছেন। মুসনাদ আহমদ: ৪/৫৮৩
এছাড়া সাহাবায়ে কেরাম সবুজ ও লাল রঙের পাগড়ি পরেছেন বলেও হাদীসে উল্লিখিত হয়েছে। পাগড়ির ফযীলত সম্পর্কে বিশেষত নামাজের জন্য পাগড়ির ব্যবহার সম্পর্কে কোনো গ্রহণযোগ্য সনদের হাদীস পাওয়া যায় না। কিন্তু যেহেতু রাসূল সাঃ নিজে পাগড়ি পরেছেন, অন্যদের পরিয়েছেন এবং সাহাবায়ে কেরাম ও সবযুগের পুণ্যবানরা পাগড়ি পরেছেন তাই এবং নামাজে আল্লাহ তায়ালা যে সৌন্দর্য অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন তার অংশ হিসেবে পাগড়ি ব্যবহার করা হলে তা অবশ্যই কাম্য ও উত্তম বলে গণ্য হবে। এ কথা বলাবাহুল্য যে একজন আল্লাহর প্রতি সমর্পিত ও তাঁর রাসূল সাঃ এর প্রকৃত অনুসারীর বেলায় পাগড়ি ব্যবহার ও এতে উৎসাহিত হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে তার প্রিয় রাসূল সাঃ এটি পরেছেন এবং অন্যদের পরিয়েছেন আর তাঁর প্রকৃষ্ট অনুসারী শ্রেষ্ঠ মানুষদের কাফেলা সাহাবায়ে কেরামও তার অনুকরণ করেছেন।
তবে এটাকে মুত্তাকী বা পরহেজগারদের মাপকাঠি বানিয়ে ফেলা বা ইমাম-খতীবের মাথায় পাগড়ি না দেখে ভৎসনা করা উচিত নয়। তাকওয়ার আসল পরিচয় পোশাকে নয়; আল্লাহর ভয়ে গুনাহ বর্জনের মাধ্যমেই তাকওয়ার প্রকাশ ঘটে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলেই এমন ঘটনার অবতারণা করা হয়ে থাকে। কারণ, রাসূল সাঃ পাগড়ি পরেছেন এবং পরিয়েছেন আরবীয় পোশাক ও ঐতিহ্য হিসেবে। তিনি এর জন্য কাউকে নির্দেশ দেননি বা তার থেকে কোনো ফযীলতের বর্ণনা সঠিকভাবে প্রমাণিত নয়।
তাই দেখা যাচ্ছে, একটিমাত্র ডিজাইনের পোশাক সবার জন্য হবে, এমনটি নয়। বরং বলা যায়, বিশ্বের সব প্রান্তের পোশাকই ইসলামী পোশাক, যদি তা ইসলামী আকিদার বা ইসলামী পোশাকের সাথে সাংঘর্ষিক না হয় পোশাকটি যদি কুরআন এবং সুন্নাহ বর্ণিত সীমা অতিক্রম না করে এবং পোশাক পরিধান করলে অন্য কোনো সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে মনে না হয়। আমরা আমাদের পোশাক দিয়ে ইসলামী সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করতে না পারলে, আমাদের স্বকীয়তা রক্ষায় ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হতে বাধ্য। অতএব আমাদের পোশাক অন্তত এতটুকু অবশ্যই হতে হবে, যেন আপনাকে-আমাকে দেখে অন্য সম্প্রদায়ের লোক মনে না হয়।
একটি প্রশ্ন ও তার উত্তরঃ
প্রশ্নঃ দাঁড়ি রাখার বিধান কি? দাঁড়ি লম্বা রাখার সীমা বা পরিমান কতো টুকুন?
উত্তরঃ দাঁড়ি ইসলামের একটি অন্যতম নিদর্শন ও দায়েমী সূন্নাত। কুরআনের কোনো আয়াতে দাঁড়ি রাখার ব্যাপারে কোনো নির্দেশ দেয়া নেই।
হাদীস শরীফে দাঁড়ির বিধানঃ আয়েশা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ বলেছেনঃ দশটি বিষয সকল নবী রাসূলগণের সুন্নাত। তন্মধ্যে গোঁফ ছোট করা এবং দাঁড়ি লম্বা করা অন্যতম। মুসলিম শরীফ: ১২৯
আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ বলেছেনঃ তোমরা গোঁফ কাট এবং দাঁড়ি লম্বা কর, আর অগ্নি পূজকদের বিরোধিতা কর। মুসলিম শরীফ: ১২৯
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ বলেছেনঃ মুশরিকদের বিরোধিতরা কর, দাঁড়ি লম্বা কর, আর গোঁফ ছোট কর। বুখারী শরীফ: ৮৭৫
আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত, রাসূল সাঃ বলেছেনঃ দাড়ি বাড়াও, গোঁফ কাট এবং এক্ষেত্রে ইহুদী-খ্রীষ্টানদের সাদৃশ্য অবলম্বন করোনা। মাসনাদে আহমদ
দাঁড়ি রাখা দায়েমী সূন্নাত তবে কিছু আলিম দাঁড়ি রাখাকে ওয়াজিব বলেছেন।
দাঁড়ি লম্বা রাখার সীমাঃ রাস্লূ সাঃ দাঁড়ি লম্বা আর গোঁফ কে ছোট করার কথা বলেছেন কিন্তু কি পরিমান দাঁড়ি লম্বা হবে তা তিনি বলেনি। তাই দাঁড়ির ব্যাপারে ইসলামের মূলনীতি হলো গোঁফের চেয়ে দাঁড়ি লম্বা হলেই সুন্নাত আদায় হয়ে যাবে। দাঁড়ির ব্যাপারে ইসলামী মূলনীতি ঠিক রেখে ব্যক্তি এক মষ্টি পরিমান, এক মুষ্টির কম, এক মুষ্টির বেশি দাঁড়ি রেখে বাকি অংশ কেটে ফেলতে পারবেন। আবার ব্যক্তি যদি মনে করেন তিনি গোঁফ ছোট করে দাঁড়ি না কেটে এক বারে ছেরে দেবেন তাও করতে পানে। আল্লাহ আমাদেরকেৃ শরীয়তের সব বিষয়ে সঠিক অবস্থান জানার ও আমল করার তাওফীক দান করুণ। আমীন