ত্যাগের শিক্ষা কুরবানীর শিক্ষা

শরীফ আবদুল গোফরান : ত্যাগের মহিমা ছাড়া দুনিয়ায় বড় কিছু হয়নি। মানবজাতির পিতা হযরত ইবরাহীম (আঃ) ও হযরত ঈসমাইল (আঃ) ত্যাগের যে মহিমা দেখিয়েছেন কেউ কি আর তা দেখাতে পারবে? বিশ্ব ইতিহাসে এ ঘটনার অন্ত নাই। কিন্তু এমন চমকপ্রদ ঘটনা আর দ্বিতীয়টি কি আছে ? মনকাড়া হৃদয়স্পর্শী ঘটনারও কোন শেষ নাই। কিন্তু এমন অতল তুলনাহীন হৃদয় স্পর্শী ঘটনা আর কখনো ঘটবেও না। স্রষ্টার প্রতি আনুগত্যের কাহিনীতে বিশ্ব ইতিহাসের পাতা ভরপুর। কিন্তু এমন নিখাদ পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণকারী আনুগত্যের কাহিনী আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
পিতা-পুত্রের দরদী আলাপ ? তারও কী কোন ঠিক-ঠিকানা আছে ? কিন্তু এমন একাত্ম, মধুর ও বিনীত আলাপনের কোন নমুনা আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এমন একটা অদ্বিতীয় মহান ঘটনার উত্তরাধিকারী আমরা। ত্যাগের মহিমায় আমাদের অতীত, সত্যি সমুজ্জ্বল। আলোকিত। প্রাণবন্ত। এ জন্য সত্যি সত্যি আমরা গর্ব করতে পারি।

গর্ব করতে করতে অনেকটা কাল পারও হয়ে গেছে। ত্যাগের দীপ শিখা মাঝে মাঝে প্রজ্জ্বলিত হলেও কাল বা সময়কে আমরা আলোকিত করতে পারিনি। এখন আলোকিত করার সময়। আতশবাজির ক্ষণিক আলোক নয়। দিবালোকের আলো। সূর্যালোকের আলো।
কে কি কুরবানী দিলাম। কিভাবে দিলাম। কে দিতে পারলেন না, এসব বড় কথা নয়। বড় কথা হলো, শাশ্বত ত্যাগের মহিমায় আমরা সমুজ্জ্বল হতে পারলাম কি না। তাই। ত্যাগ। শুধু ত্যাগ নয়, আল্লাহর পথে ত্যাগ। আল্লাহর পথে ত্যাগ বা কুরবানী ছাড়া মানবতার মুক্তি নাই।
এখন প্রশ্ন হলো, আল্লাহর পথ কোনটি? আল্লাহর পথ আর মানুষের পথ কি আলাদা? না, আলাদা নয়। আলাদা ছিল না। আমরাই না বুঝে আলাদা করেছি। স্রষ্টা ও সৃষ্টির একটিই পথ। যে পরিকল্পনা নিয়ে স্রষ্টা মানুষসহ যাবতীয় সৃষ্টির মেলা বসিয়েছেন সেই পরিকল্পনাও সৃষ্টির ধারাক্রমই আল্লাহর পথ। এ পথেই মানুষের আগমন। এ পথেই মানুষের বিকাশ, সমৃদ্ধি ও উন্নতি। এ পথেই মানুষের শেষে অভীষ্ট যাত্রা। মানুষ সৃষ্টির পরিকল্পনারই একটা বড় অংশ। সুতরাং মানুষের পথ আল্লাহ্ই তৈরি করে দিয়েছেন। তৈরি করা সেই পথে মানুষ একতাবদ্ধভাবে চলবেন সেই চলাই হবে আল্লাহর পথে চলা। আল্লাহর দেয়া সে পথে চললে দুনিয়ায় শান্তি নেমে আসবে। সাথে সাথে আসবে অনন্ত অসীম জীবনে মুক্তি। এ পথ ভোগের পথ নয়, এ পথ ত্যাগের পথ, কুরবানীর পথ। যার সাধ্য ও সামর্থ্য যত বেশি, সে তত বেশী কুরবানী করবে। এই কুরবানীর ফলে দুনিয়ার জীবন থেকে অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কুসংস্কার, দরিদ্রতা, অনাচার অবিচার দূর হবে। দুনিয়ার জীবনটা শান্তি সুষমায় ভরে ওঠবে।
কুরবানী করা মানে নিজের স্বার্থ ত্যাগ করা। আমরা সবাই যদি নিজ নিজ স্বার্থ ত্যাগ করি তাহলে প্রকারান্তরে অন্যদের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়ে যায়। আমার যে অংশটি আমি ত্যাগ করি, সেই অংশটি অন্য কেউ পায়। সুতরাং একজনের ত্যাগ আরেকজনের প্রাপ্তি। এই প্রাপ্তিযোগই দুনিয়ার মানুষকে দরিদ্রতা থেকে, অজ্ঞানতা থেকে, মুক্তি দিতে পারে।
কুরবানীর গোস্তকে আমরা সমান সমান তিন ভাগে ভাগ করি। এক ভাগ নিজের একান্ত পরিবারের জন্য। একভাগ দীন দরিদ্র মানুষের জন্য। আর এক ভাগ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও পাড়া প্রতিবেশীর জন্য।
আমাদের সমস্ত মেধা, উদ্যোগ, শ্রম ও সম্পদ যদি কুরবানীর গোশতের মত তিন ভাগে ভাগ করে বিতরণ করতে পারি তবেই সম্পদের বিকেন্দ্রীয়করণ হবে। সম্পদ বণ্টনের এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে সবার কাছে সম্পদ পৌঁছে গেলে হানাহানি, মারামারি, হিংসা-বিদ্বেষ কমে যাবে। একটা সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক সমাজের ভিত রচিত হবে। এবারের কুরবানী থেকে এ শিক্ষাই আমরা গ্রহণ করবো।