নামাজের হাকীকত
ইবাদাত:
‘ইসলামের হাকীকত’ গ্রন্থের শেষ প্রবন্ধে ‘দ্বীন’ ও ‘শরীয়াত’ এ শব্দ দু’টির প্রকৃত অর্থ এবং ব্যাখ্যা বর্ণনা করা হয়েছে। এখানে আমি ‘ইবাদাত’ শব্দটির বিস্তারিত অর্থ আপনাদের সামনে পেশ করবো। এ শব্দটি সর্বসাধারণ মুসলমান প্রায়ই বলে থাকে; কিন্তু এর প্রকৃত অর্থ অনেকেই জানে না। আল্লাহ তায়ালা কুরআন শরীফে বলেছেনঃ
(***** আরবী)
“আমি জিন ও মানব জাতিকে কেবল আমারই ইবাদাত ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি।” (সূরা আয যারিয়াতঃ ৫৬)
এ থেকে নি:সন্দেহে বুঝা গেল যে, মানুষের জন্ম, জীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য আল্লাহ তায়ালার ইবাদাত এবং বন্দেগী ছাড়া আর কিছুই নয়। এখন আপনারা সহজেই বুঝতে পারেন যে, ‘ইবাদাত’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ জেনে নেয়া আমাদের পক্ষে কতখানি জরুরী। এ শব্দটির অর্থ না জানলে যে মহান উদ্দেশ্যে আপনাকে সৃষ্টি করা হয়েছে তা আপনি কখনই লাভ করতে পারেন না। আর যে তার উদ্দেশ্য লাভ করতে পারে না তা ব্যর্থ ও নিষ্ফল হয়ে থাকে।
চিকিৎসক রোগীকে নিরাময় করতে না পারলে বলা হয় যে, সে চিকিত্সায় ব্যর্থ হয়েছে, কৃষক ভাল ফসল জন্মাতে না পারলে কৃষিকার্যে তার ব্যর্থতা সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়। তেমনি আপনারা যদি আপনাদের জীবনের উদ্দেশ্য লাভ অর্থাত্ ইবাদাত করতে না পারেন তবে বলতে হবে যে, আপনাদের জীবন ব্যার্থ হয়েছে। এজন্যই আমি আশা করি আপনারা এ ‘ইবাদাত’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ ও তাত্পর্য জানার জন্য বিশেষ মনোযোগী হবেন এবং তা আপনাদের হৃদয়-মগযে বদ্ধমূল করে নিবেন। কারন মানব জীবনের সাফল্য ও ব্যর্থতা এরই ওপর একান্তভাবে নির্ভর করে।
ইবাদাত শব্দটি আরবী ‘আবদ’ হতে উদ্ভূত হয়েছে। ‘আবদ’ অর্থ দাস ও গোলাম। অতএব ‘ইবাদাত’ শব্দের অর্থ হবে বন্দেগী ও গোলামী করা। যে ব্যক্তি অন্যের দাস সে যদি তার বাস্তবিকই মনিবের সমীপে একান্ত অনুগত হয়ে থাকে এবং তার সাথে ঠিক ভৃত্যের ন্যায় ব্যবহার করে, তবে একে বলা হয় বন্দেগী ও ইবাদাত। পক্ষান্তরে কেউ যদি কারো চাকর হয় এবং মনিবের কাছ থেকে পুরোপুরি বেতন আদায় করে, কিন্তু তবুও সে যদি ঠিক চাকরের ন্যায় কাজ না করে তবে বলতে হবে যে, সে নাফরমানী ও বিদ্রোহ করেছে। আসলে একে অকৃতজ্ঞতাই বালা বাঞ্ছনীয়। তাই সর্বপ্রথম জানতে হবে, মনিবের সামনে ‘চাকরের’ ন্যয় কাজ করা এবং তার সমীপে আনুগত্য প্রকাশ করার উপায় কি হতে পারে।
বান্দাহ বা চাকরেকে প্রথমতে মনিবকে ‘প্রভু’ বলে স্বীকার করতে হবে এবং মনে করতে হবে যে, যিনি আমার মালিক, যিনি আমাকে দৈনন্দিন রুজী দান করেন এবং যিনি আমার মালিক, যিনি আমার হেফাযত ও রক্ষণাবেক্ষণ করেন তাঁরই আনুগত হওয়া আমার কর্তব্য। তিনি ছাড়া অন্য কেউই আমার আনুগত্য লাভের অধিকারী নয়। সকল সময় মনিবের আনুগত্য করা, তাঁর হুকুম পালন করা, তার অনুবর্তিতা মূহূর্তের জন্যও পরিত্যাগ না করা, মনিবের বিরুদ্ধে মনে কোন কথার স্থান না দেয়া এবং অন্য কারো কথা পালন না করাই বান্দাহর দ্বিতীয় কর্তব্য। গোলাম সবসময়ই গোলাম; তার এথা বলার কোন অধিকার নেই যে, আমি মনিবের এ আদেশ মানবো আর অমুক আদেশ মনবো না। কিংবা আমি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মনিবের গেলাম আর অন্যান্য সময় অমি তার গোলামী হতে সম্পূর্ণ আযাদ ও মুক্ত।
মনিবের প্রতি সম্মান ও সম্ভ্রম প্রদর্শন এবং তার সমীপে আদব রক্ষা করে চলা বান্দার তৃতীয় কাজ। আদব ও সম্মান প্রকাশের যে পন্থা মনিব নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন সেই সময়ে নিশ্চিতরূপে উপস্থিত হওয়া এবং মনিবের আনুগত্য ও দাসত্ব স্বীকার করে নিজেকে প্রতিজ্ঞা ও আন্তরিক নিষ্ঠা প্রমাণ করা একান্তু আবশ্যক।
এ তিনটি প্রক্রিয়ার সমন্বয়ে যে কার্যর্টি সম্পন্ন হয়ে আরবী পরিভায়ায় তাকেই বলে ‘ইবাদাত’। প্রথমত, মনিবের দাসত্ব স্বীকার, দ্বিতীয়ত, মনিবের অনুগত্য এবং তৃতীয়ত, মনিবের সম্মান ও সম্ভ্রম রক্ষা করা।
আল্লাহ তায়ালা বলেছেন:
(***** আরবী)
এর প্রকৃত অর্থ হচ্ছে: আল্লাহ তায়ালা জি্ন ও মানব জাতিকে একমাত্র এ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন যে, তারা কেবল আল্লাহ তায়ালরই দাসত্ব করবে অন্য কারো নয়, কেবল আল্লাহর হুকুম পালন করবে, এছাড়া অন্য কারো হুকুম অনুসরন করবে না এবং কেবল তাঁরই সামনে সম্মান সম্ভ্রম প্রকাশের জন্য মাথা নত করবে, অন্য কারো সামনে নয়। এ তিনটি জিনিসকে আল্লাহ তয়ালা বুঝিয়েছেন এ ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ ‘ইবাদাত’ দ্বারা। যেসব আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ইবাদাতের নির্দেশ দিয়েছেন তার অর্থ এটাই। আমাদের শেষ নবী এবং তাঁর পূর্ববতীর্ আম্বিয়ায়ে কেরামের যাবতীয় শিক্ষার সারকথা হচ্ছে: (***** আরবী) “আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করো না” অর্থাত্ দাসত্ব ও অনুগত্য লাভের যোগ্য সারা জাহানে একজনই মাত্র বাদশাহ আছেন —- তিনি হচ্ছেন আল্লাহ তায়ালা; অনুসরণযোগ্য মাত্র একটি বিধান বা আইন আছে — তাহলো আল্লাহর দেয়া জীবনব্যবস্থা এবং একটি মাত্র সত্তাই আছে, যার পূজা-উপাসনা, আরাধনা করা যেতে পারে। আর সেই সত্তাই হচ্ছে একমাত্র আল্লাহ।
ইবাদাত শব্দের এ অর্থ আপনি স্মরণ রাখুন এবং আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে থাকুন। একটি চাকর যদি মনিবের নির্ধারিত কর্তব্য পালন না করে বরং তাঁর সামনে কেবল হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে, লক্ষ বার কেবল তার নাম জপে, তবে এ চাকরিটি সম্পর্কে আপিনি কি বলেবেন? মনিব তাকে অন্যান্য মানুষের প্রাপ্য আদায় করতে বলেন। কিন্তু সে কেবল সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে মনিবের সমনে মাথা নত করে দশবার সালাম করে এবং আবার হাত বেঁধে দাঁড়ায়। মনিব তকে অনিষ্টকর কাজগুলে বন্ধ করতে আদেশে করেন। কিন্তু সে সেখান থেকে একটুও নড়ে না। বরং কেবল সিজদাহ করে থাকে। মনিব তাকে চোরের হাত কাটতে বলেন। কিন্তু সে দিঁড়িয়ে থেকে সুললিত কণ্ঠে বিশবার পড়তে বা উচ্চরণ করত থাকে—-‘চোরের হাত কাট’ কিন্তু সে একবারও একম শাসনব্যাবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করে না যার অধীনে চোরের হাত কাঁটা সম্ভব হবে। এমন চাকর সম্পর্কে কি মন্তব্য করবেন? আপনি কি বলতে পারেন যে, সে প্রকৃতপক্ষে মনিবের বন্দেগী ও ইবাদত করছে? আপনার কোন চাকর এরূপ করলে আপনি তাকে কি বলবেন তা অমি জনি না, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আল্লাহর যে চাকর এরূপ আচরণ করে তাকে আপনি ‘বড় আবেদ’ (ইবাদাতকারী, বুজুর্গ ইত্যাদি) নামে অভিহিত করেন। এরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কুরআন শরীফে আল্লাহ তায়ালার কত শত হুকুম পাঠ করে, কিন্তু সেগুলো পালন করার এবং কাজে পরিণত করার জন্য একটু চেষ্টাও করে না। বরং কেবল নফলের পর নফল পড়তে থাকে, আল্লাহর নামে হাজার দানা তাসবীহ জপতে থাকে এবং মধুর কন্ঠে কুরআন মজীদ তেলাওয়াত করতে থাকে। আপনি তার এ ধরনের কার্যাবলী দেকেন, আর বিম্মিত হয়ে বলেনন: ‘ওহে! লোকটা কত বড় অবদ আর কত বড় পরহেযগার।’ আপনারদের এ ভুল ধরণর মূলল কারন এই যে, আপনারা ‘ইবাদাত’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ মোটেই জানেন না।
আর একজন চাকরের কথা ধরুন। সে রাত-দিন কেবল পরের কাজ করে, অন্যের আদেশ শুনে এবং পালন করে, অন্যের আইন মেনে চলে এবং তার প্রকৃত মনিবের যত আদেশ ও ফারমানই হোক না কেন, তার বিরোধিতা করে। কিন্তু ‘সালাম’ দেয়ার সময় সে তার প্রকৃত মনিবের সামনে উপস্থিত হয় এবং মুখে কেবল তার নাম জপতে থাকে। আপনাদের কারো কোন চাকর এরূপ করলে আপনারা কি করবেন? তার ‘সালাম’ কি তার মুখের ওপর নিক্ষেপ করবেন না? মুখে মুখে সে যখন অপনাকে মনিব বলে ডাকবে তখন অপনি তি তাকে একথা বলবেননা যে, তুই ডাহা মিথ্যা বাদী ও বেঈমান; তুই আমার বেতন খেয়ে অণ্যের তাবেদারী করিস, মুখে আমাকে মনিব বলে ডাকিস, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কেবল অন্যেরই কাজ করে বেড়াস? এটা যে নিতান্ত সাধারণ বুদ্ধির কথা এটা কারো কুঝতে কষ্ট হয় না। কিন্তু কি আশ্চর্যের কথা! যারা রাত-দিন আল্লাহর আইন ভঙ্গ কররে, কাফের ও মুশরিকদের আশষ অনুযায়ী কাজ করে এবং নিজেদের বাস্তব কর্মজীবনে আল্লাহর বিধানের কোন পরোয়া করে না; তাদের নামায – রোযা, তাসবীহ পাঠ, কুরআনে তেলাওয়াত, হাজ্জ, যাকাত ইত্যাদিকে আপনি ইবাদাত বলে মনে করেন। এ ভুল ধারণারও মূল কারণ ইবদাত শব্দের প্রকৃতি অর্থ না জানা।
আর এটি চাকরের উদাহরণ নিন। মনিব তার চাকরদের জন্য যে ধরণের পেশাক নির্দিষ্ট করেছেন, মাাপ-জোখ ঠিক রেখে সে ঠিক সেই ধরণের পোশাক পরিধান করে, বড় আদব ও যত্ন সহকারে সে মনিবের সামনে হাজির হয়, প্রত্যেকটি গুকুম শুনা মাত্রই মাথ নত করে শিরোধার্য করে নেয় যেন তার তুলনায় বেশী অনুগত চাকর আর কেউই নয়। ‘সালাম; দেয়ার সময় সে এককোবারে সকলের সামনে এস দাঁড়ায় এবং মনিবের নাম জপবার ব্যাপারে সমস্ত চাকরের ওপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ও নিষ্ঠা প্রমাণ করে; কিন্তু অন্যদিকে এ ব্যক্তি মনিবের দুশমন এবং বিদ্রোহীদের খেদমত করে, মনিবের বিরুদ্ধে তাদের যাবতীয় ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করে এবং মনিবের নাম পর্যন্ত দুনিয়া হতে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে তারা যে চেষ্টাই করে, এ হতভাগা তার সহযোগীতা করে; রাতের অন্ধকারে সে মনিবের ঘরে সিঁদ কাটে এবং ভোর হলে বড় অনুগত চাকরটির ন্যয় হাত বেঁধে মনিবের সামনে হাজির হয়, এ চাকরটি সম্পর্কে আপনি কি বলবেন? অপনি নিশ্চই তাকে মুনাফিক, বিদ্রোহী ও নিমকহারাম প্রভৃতি নামে অভিহিত করতে একটুও কুন্ঠিত হবেন না। কিন্তু আল্লাহর কোন চাকর যখন এ ধরনের হাস্যকর আচরণ করতে থাকে তখন তাকে আপনারা কি বলতে থাকেন? তখন আপনারা কাউকে ‘পীর সাহেব’ কাউকে ‘হযরত মাওলানা’ কাউকে বড় ‘কামেল’,’পরহেজগার’ প্রভৃতি নামে ভূষিত করেন। এর কারন এই যে, আপনারা তাদের মুখে মাপ মত লম্বা দাড়ি দেখে, তাদের পায়জামা পায়ের গিরার দু ‘ ইঞ্চি ওপরে দেখে, তাদের কপালে নামাযের কালো দাগ দেখে, এবং তাদের লম্বা লম্বা নামায ও মোটা মোটা দানার তাসবীহ দেখে, বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন; এদের কে বড় দ্বীনদার ও ইবাদাতকারী বলে মনে করেন। এ ভুল শুধু এজন্য যে, ‘ইবাদাত’ ও দ্বীনদারীর ভুল অর্থই আপনাদের মনে বদ্বমূল হয়ে রয়েছে।
আপনি হয়তো মনে করেন হাত বেঁধে কেবলামুখি হয়ে দাড়ানো, হাঁটুর ওপর হাত রেখে মাথা নত করে, মাটিতে মাথা রেখে সিজদা করা এবং কয়েকটি নির্দিষ্ট শব্দ উচ্চারণ করা- শুধু এ কয়টি কজই প্রকৃত ইবাদাত। হয়ত আপনি মনে করেন, রমযানের প্রথম দিন হতে শাওয়লের চাঁদ উঠা পর্যন্ত প্রত্যেক দিন সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহার বন্ধ রাখার নাম ইবাদাত। আপনি হয়তো এটাও মনে করেন যে, কুরআন শরীফের কয়েক রুকু, পাঠ করার নামই ইবাদাত, আপনি বুঝে থাকেন মক্কা শরীফে গিয়ে কা’বা ঘরের চারদিকে তাওয়াফ করার নামই ইবাদাত। মোটকথা, এ ধরনের বাহ্যিক রূপকে আপনারা ‘ইবাদাত’ মনে করে নিয়েছেন এবং এধরনের বাহ্যিক রূপ বজায় রেখে উপরোক্ত কাজগুলো থেকেই সমাধা করলেই আপনারা মনে করেন যে, ‘ইবাদাত’ সুসম্পন্ন করেছে এবং (***** আরবী) (ওমা খালাকতুল জিন্না ওয়াল ইনসা ইল্লা লিয়াবুদুন) এরউদ্দেশ্য পূর্ণ করেছে। তাই জীবনের অন্যান্য ব্যাপারে সে একেবারে আযাদ- নিজের খেয়াল খুশি অনুযায়ী কাজ করে যেতে পারে।
কিন্তু প্রকৃত ব্যপার এই যে, আল্লাহ তায়ালা যে ইবাদাতের জন্য আপনাকে সৃষ্টি করেছেন এবং যে ইবাদাত করার আদেশ আপনাকে দেয়া হয়েছে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। সেই ইবাদাত এই যে, আপনি আপনার জীবনের প্রত্যেকটি মুহূর্তেই আল্লাহর অনুগত্য স্বীকার করে চলবেন এবং আল্লাহর আইনের বিরোধী এ দুনিয়ায় যা কিছু প্রচলিত আছে তা অনুসরণ করতে আপনি একেবারে অস্বীকার করবেন। আপনার প্রত্যেকটি কাজ, প্রত্যেকটি গতিবিধি আল্লাহর নির্ধারিত সীমার মধ্যে হতে হবে। এ পন্থায় যে জীবনযাপন করবেন তার সবটুকুই ইবাদত বলে গন্য হবে। এ ধরনের জীবনে আপনার শয়ন-জাগরণ, পানাহার,চলা-ফিরা, কথা বলা, অলোচনা করাও ইবাদত বিবেচিত হবে। এমন কি নিজ স্ত্রীর কাছে যাওয়া এবং নিজের সন্তানদেরকে স্নেহ করাও ইবাদাতের শামিল হবে। যে সকল কাজকে আপনারা ‘দুনিয়াদারী’ বলে থাকেন তাও ‘ইবাদত’ এব ‘দ্বীনদারী’ হতে পারে —- যদি সকল বিষয় আপনি আল্লাহ নির্ধারিত সীমার মধ্যে কে আল্লাহর দেয়া বিধান অনুসারে সমাধা করেন; আর পদে পদে এদিকে লক্ষ্য রাখেন যে, আল্লাহর কাছে কোন্ টা জায়েয আর কোন্টা নাজায়েয, কি হালাল আর কি হারাম, কি ফরয আর কি নিষেধ, কোন কাজে আল্লাহ সন্তুষ্ট আর কোন কাজে হন অসন্তুষ্ট। উদাহরন হিসেবে বলা যায়, আপনি রুজি ও অর্থোপার্জনের জন্য বের হন। এ পথে হারাম উপার্জনের অসংখ্য সহজ উপায় আপনার সামনে আসবে। এখন আপনি যদি আল্লাহকে ভয় করে সেই সুযোগ গ্রহণ না করেন এবং কেবল হালাল রুজি ও অর্থ উপার্জন করেন এ কাজে যে সময় লেগেছে তা সবই ইবাদাত এবং এ হালাল উপায়ে অর্জিত অর্থ ঘরে এনে আপনি নিজে খান আর পরিবার-পরিজনের খাদ্যের ব্যবস্থা করেন, সেই সাথে যদি আল্লাহর নির্ধারিত অন্যান্য হকদারের হকও আদায় করেন, তাহলে এসব কাজেও আপনি অসীম সাওয়াব পাবেন। পথ চলার সময় আপনি পথের কাঁটা দূর করেন এ ধারণায যে, এটা দ্বারা আল্লাহর কোন বান্দাহ কষ্ট পেতে পারে তবে এটাও আপনার ইবাদত বলে গণ্য হবে। আপনি কোন রুগ্নব্যক্তিকে শুশ্রূষা করলেন, কোন ব্যক্তিকে পথচলতে সাহায্য করলেন, কিংবা বিপন্ন ব্যক্তিকে চলতে সাহায্য করলেন তবে এটাও ইবাদাত হবে। কথাবার্তা বলতে আপনি মিথ্যা, গীবত, কুত্সা রটনা, অশ্লীল কথা বলে পরের মনে আঘাত দেয়া ইত্যাদি পরিহার করেন এবং আল্লাহর ভয়ে কেবল সত্য কথাই বলেন তবে যতক্ষণ সময় অপনার এ কাজে ব্যয় হবে, তা সবই ইবাদাতে অতিবাহিত হবে।
অতএব চেতনা লাভের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আল্লাহর আইন অনুযায়ী চলা এবং তাঁরই নির্ধারিত বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করার নামই হচ্ছে আল্লাহর ইবাদাত। এ ইবাদাতের জন্য কোন সময় নেই। এ ইবাদাত সবসময়ই হওয়া চাই, এ ইবাদাতের জন্য কোন নির্দিষ্ট প্রকাশ্য রূপ নেই, কেবল প্রতিটি রূপের প্রত্যেকটি কাজেই আল্লাহর ইবাদাত হতে হবে। আপনি একথা বলতে পারেন না যে, আমি অমুক সময় আল্লাহর বান্দাহ আর অমুক সময় আল্লাহর বান্দাহ নই। আপনি এথাও বলতে পারেন না যে, অমুক সময় আল্লাহর ইবাদাতের জন্য, আর অমুক সময় আল্লাহর কোন ইবাদাত করতে হয় না। এ আলোচনা দ্বারা আপনারা ইবাদাত শব্দের অর্থ ভাল রূপে জানলেন একথা বুঝতে পারলেন যে, প্রত্যক মুহূর্তে সকল অবস্থায় আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য করে চলার নামই ইবাদাত। এখানে আপনি এ প্রশ্ন করতে পারেন যে, তাহলে এ নামায়, রোযা, হজ্জ ও যাকাত ইত্যাদিকে কি বলা যায়? উত্তরে আমি বলবো যে, এসব ইবাদত বটে, এ ইবাদাত গুলোকে আপনার ওপর ফরয করে দেয়া হয়েছে শুধু এজন্য যে, আপনার জীবনে প্রধান ও বৃহত্তম উদ্দেশ্য যে, প্রতি মূহূর্তে ও প্রত্যেক অবস্থায় আল্লাহর ইবাদাত করা, সেই বিরাট উদ্দেশ্য আপনি এসবের মাধ্যমে লাভ করবেন। নামায আপনাকে দৈনিক পাঁচরার স্মরণ করিয়ে দেয় যে, তুমি আল্লাহ তায়ালার দাস—- তাঁরই বন্দেগী করা তোমার কর্তব্য; রোযা বছরে একবার পূর্ণ একটি মাস আপনাকে এ বন্দেগী করার জন্য প্রস্তুত করে, যাকাত আপনাকে বার বার মনে করিয়ে দেয় যে, তুমি যে অর্থ উপার্জন করেছো তা আল্লাহর দান, তা কেবল তোমার খেয়াল-খুশী মত ব্যয় করতে পার না। বরং তা দ্বারা তোমার মালিকের হক আদায় করতে হবে। হজ্জ মানব মনে আল্লাহ প্রেম ও ভালবাসা এবং তাঁর শ্রেষ্টত্বের অনুভুতির এমন চিত্র অঙ্কিত করে যে, একবার তা মুদ্রিত হলে সমগ্র জীবনেও মন হতে তা মুছে যেতে পারে না। এসব বিভিন্ন ইবাদাত আদায় করার পর আপনার সমগ্র জীবন যদি আল্লাহর ইবাদাতে পরিণত হবার উপযুক্ত হয় তবেই আপনার নামায প্রকৃত নামায হবে, রোযা খাঁটি রোযা হবে, যাকাত সত্যিকার যাকাত এবং হজ্জ আসল হজ্জ হবে এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ উদ্দেশ্য হাসিল না হলে কেবল রুকু-সিজদাহ, অনাহার – উপবাস, হজ্জের অনুষ্ঠান পালনকরা এবং যাকাতের নামে টাকা ব্যায় করলে আপনার কিছুই লাভ হবে না। বাহ্যিক ও আনুষ্ঠানিক ইবাদাতগুলোকে মানুষের একটি দেহের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। এতে প্রান থাকলে এবং চলাফিরা বা কাজ – কর্ম করতে পারলে নিসন্দেহে তা জীবিত মানুষের দেহ, অন্যথায় তা একটি প্রানহীন দেহ মাত্র। লাশের চোখ, কান, হাত, পা সব কিছুই বর্তমান থাকে; কিন্তু প্রাণ থাকে না বলেই তাকে আপনারা মাটির গর্তে পুতে রাখেন। তদ্রুপ নামাযের আরকান – আহকাম যদি ঠিকভাবে আদায় করা হয় কিংবা রোযার শর্তাবলী ও যদি যাথাযথ ভাবে প্রতি পালিত হয়, কিন্তু হৃদয় মনে আল্লাহর ভয়, আল্লাহর প্রেম – ভালবাসা এবং তাঁর দাসত্ব ও আনুগত্য করার ভাবধারা বর্তমান না থাকে —- ঠিক যে জন্য এসব আপনার ওপর ফরয করা হয়েছিল, হবে তাও একটি প্রাণহীন ও আর্থহীন জিনিস হবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
আপনাদের ওপর এই যে, বিভিন্ন ইবাদাত ফরয করা হয়েছে এসব কিভাবে এবং কি উপায়ে আপনাকে সেই আসল ও বৃহত্তম ইবাদাতের জন্য প্রসু্তুত করে, সেই ইবাদাতগুলোকে যদি আপনি বুঝে শুনে আদায় করেন, তবে তা থেকে আপনার জীবনে কি প্রভাব প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে পরবতীর্ প্রবন্ধে তা বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করবো- ইনশাআল্লাহ।
নামায
পূর্ববর্তী প্রবন্ধে আমি ইবাদাতের প্রকৃত অর্থ বর্ণনা করেছি। এ ‘ইবাদাতের’ উদ্দেশ্যে অল্লাহ তায়ালা মানুষ ও জি্ন জাতি সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে আল্লাহ তায়ালার খাঁটি বান্দাহ হিসাবে প্রস্তুত করার জন্য ইসলামে কয়েকটি নির্দষ্ট ইবাদত ফরয করা হয়েছে। সুতরাং এবারে কেবল ‘নামায’ সম্পর্কে আমি সংক্ষেপে বর্ণনা করতে চাই।
অপনারা পূর্বের প্রবন্ধে জানতে পেরেছেন যে, ‘ইবাদাত’ এর আসল অর্থ বন্দেগী বা দাসত্ব করা। তাই অপনাকে যখন শুধু দাসত্ব করার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে তখন আপনি কখনো এবং কোন অবস্থাতেই অল্লাহর দাসত্ব হতে মুক্ত হতে পারেন না। ‘এত মিনিট কিংবা এত ঘন্টার জন্য আমি আল্লাহর দাস, অন্য সকল সময় তা নই’ — এ কথা আপনি যেমন বলতে পরেন না, তদ্রূপ আপনি একথাও বলতে পারেন না, ‘আমি এতক্ষণ আল্লাহর ইবাদাতে অতিবাহিত করবো এবং অন্য সময়ে আমার পূর্ণ আযাদী — তখন যা ইচ্ছা তাই করবো। যেহেতু আল্লাহর গোলাম —আল্লাহর দাস হিসেবেই আপনার জন্ম হয়েছে। কেবল তাঁর গোলামী ও দাসত্বে অতিবাহিত হওয়াই একান্ত বাঞ্চনীয়, জীবনের কোন একটি মুহুর্তও আপনি তাঁর ‘ইবাদাত’ ও দাসত্ব হতে মুক্ত হতে পরেন না।
পূর্বে একথাও আপনাকে বলেছি, যে দুনিয়ার কাজ-কর্ম পরিত্যাগ করে এক কোণায় বসে যাওয়া এবং ‘আল্লাহু’ ‘আল্লাহু’ করার নাম ইবাদাত নয়। বরং এ দুনিয়ায় অপনি যে কাজই করুন না কেন তা ঠিক আল্লাহর আইন ও বিধান অনুসারে করার অর্থই হচ্ছে ইবাদাত। আপনার শয়ন-নিদ্রা, আপনার জাগরণ ও বিশ্রাম, পানাহার, চলা-ফেরা — মোটকথা সবকিছুই আল্লাহর আইন বিধান অনুযায়ী আপনাকে করতে হবে। আপনার স্ত্রী-পুত্র, ভাই -ভগ্নি এবং আত্মীয়গণের সাথে ঠিক আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী ব্যবহার করবেন। বন্ধু – বান্ধবের সাথে হাসি-তামাশা ও কথাবার্তা বলার সময়ও আপনাকে স্মরণ রাখতে হবে যে, আমরা আল্লাহর দাসত্ব-শৃঙ্খল হতে মুক্ত নই। কামাই রোযগারে টাকা – পয়সা আদান – প্রদানের সময়ও আপনাকে প্রত্যেকটি কাজে ও কথায় আল্লাহর বিধি-নিষেধ লক্ষ্য রাখতে হবে এবং কখনো আল্লাহর নিধার্রিত সীমা অতিক্রম করতে পরেন না। রাতের অন্ধকারে কোন পাপের কাজ করা যদি খুবই সহজ হয়ে পড়ে এবং তা করলে কেউ দেখতে পাবে না বলে আপনি মনে করেন, ঠিক তখনো আপনি স্মরণ রাখবেন যে, আর কেউ দেখুক আর নাই দেখুক, আল্লাহ তায়ালা সব কিছু দেখছেন এবং আপনার মনে আল্লাহর ভয় বদ্ধমূল হওয়া উচিত, মানুষের ভয়ে নয়। গভীর জঙ্গলে বসেও যদি কোন পাপের কাজ করতে ইচ্ছা করেন এবং যদি মনে করেন পুলিশ বা অন্য কোন লোক তা দেখতে পবে না, তখনো আপনি কেবল আল্লাহকে ভয় করে পাপ পরিহার করবেন। যখন মিথ্যা কথা, দুনীর্তি, বেঈমানী, যুলুম ও শোষণ করে বহু স্বার্থ লাভ করতে পারেন এবং আপনাকে বাধা দেয়ার কোউ না থাকে, তখনো আপনি আল্লাহকে ভয় করবেন এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টির আশাংকায় এ স্বার্থের কাজ থেকে বিরত থাকবেন। পক্ষান্তরে সততা ও ন্যয়-নীতি রক্ষা করে চলায় আপনাকে যদি ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্তও হতে হয়, তথাপি আপনি কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায়ই এ ক্ষতি স্বীকার করতে বিন্দু মাত্র দ্বিধাবোধ করবেন না। অতএব দুনিয়ার বিপুল কর্মজীবন পরিত্যাগ করে (ঘর বা মসজিদের) কোণে বসে তাসবীহ পড়াকে ‘ইবাদাত’ বলা যায় না। বস্তুত দুনিয়ার এ গোলক ধাঁধায় জড়িত হয়ে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবনযাপন করার নামই ‘ইবাদাত’। মুখে কেবল ‘আল্লাহু’ ‘আল্লাহু’ শব্দ উচ্চারণ করাকেই আল্লাহর ‘যিকর ‘ বলা যায় না। দুনিয়ার কাজ-কর্ম ও ঝামেলার কঠিন জালে জড়িত হয়ে আল্লাহকে বিস্মৃত না হওয়াই আসল আলাহর যিকর। যে সকল জিনিস মানুষকে আল্লাহর কথা ভুলিয়ে দেয় তাতে জড়িত হওয়া সত্বেও তাঁকে বিস্মৃত না হওয়া, বড় বড় স্বার্থ হাসিলের লোভ এবং বিরাট ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার জন্য দুনিয়ার জীবনে আল্লাহর আইন লংঘন করার যখন সুযোগ এসে যায় তখনও আল্লাহকে স্বরণ করা এবং দৃঢ়তার সাথে তাঁর আইন অনুসরণ করে চলাই সত্যিকার ‘যিকরুলালাহ’ বা আল্লাহর যিকর। এ যিকরের দিকে ইংগিত করা হয়েছে কুরআনের নিম্নলিখিত আয়াতে:
(***** আরবী)
“নামায পূর্ণরূপে আদায় হয়ে গেলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়; আল্লাহর দান জীবিকা উপার্জনের চেষ্টা কর এবং এ প্রচেষ্টা ব্যাপদেশে আল্লাহকে খুব বেশী করে স্বরন কর। তবেই সম্ভবত তোমরা কল্যাণ লাভ করতে পারবে।”
(আল জুমআ: ১০)
‘ইবাদাতের’ এ অর্থ মনে জাগরুক রাখুন এবং গভীরভাবে চিন্তা করুন যে, এ বিরাট ও বৃহত্তম ‘ইবাদাত’ যথাযথভাবে আঞ্জাম দেয়ার জন্য কি কি জিনিস অপরিহার্য এবং নামায যে সব জিনিসকে মানুষের মধ্যে কিভাবে সৃষ্টি করে। আল্লাহর খাঁটি ‘বান্দাহ’ হওয়ার জন্য বার বার একথা স্মরণ করা আবশ্যক যে, আপনি আল্লাহর বান্দাহ এবং প্রত্যেক সময় ও প্রত্যেকটি ব্যাপারেই সেই আল্লাহর বন্দেগী করাই হচ্ছে আপনার কাজ। এ কথা বার বার স্বরণ করিয়ে দেয় এজন্য আবশ্যক যে, মনুষের মনে একটি ‘শয়তান’ সবসময়ই উপস্থিত থাকে; সে সবসময়ই মানুষকে নিজের ‘দাস’ বানাতে চেষ্টা করে।
শয়তানের প্ররোচনা ও গোলক ধাঁধার জাল ছিন্ন করার জন্য মানুষকে প্রত্যক বার বার একথা স্মরণ করিয়ে দেয়া একান্ত আবশ্যক যে, ” তুমি কেবলমাত্র আল্লাহ তায়ালার দাস, তিনি ছাড়া তুমি কারর দাস নয় — না শয়তানের, না কোন মানুষের।” একথারই অনুভূতি মানুষের মনে জাগরুক করে দেয় নামায। সকাল বেলা ঘুম ভাংতেই তা সর্বপ্রথম এবং সকল কাজের আগে আপনাকে একথা স্বরণ করিয়ে দেয় এবং দিনের বেলা যখন নানা প্রকার কাজে আপনি মশগুল থাকেন তখনো তিন-তিনবার অপানাকে মনে একথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং রাত্রিকালে যখন নিদ্রার সময় উপস্থিত হয়, তখন শেষ বারের মত এরই পুনরাবৃত্তি করে। এরূপে আল্লাহর ‘দাস’ হওয়ার কথা মানুষকে বার বার স্মরণ করিয়ে দেয়া নামাযের প্রথম উপকার। এ জন্যই কুরআন মজীদে নামাযকে ‘যিকর’ নামে অভিহিত করা হয়েছে, অর্থাত্ এর দ্বারা অল্লাহকে স্মরণ করা হয়।
তারপর অপনাকে এ জীবনের পদে পদে আল্লাহর বিধি-নিষেধ পালন করে চলতে হবে, কাজেই কর্তব্য জ্ঞান ও দায়িত্ববোধ আপনার মনে সদা জাগ্রত থাকা বাঞ্ছনীয় এবং তা পালন করার অভ্যাসও আপনার থাকা দরকার। ‘কর্তব্য’ কাকে বলে এটা যে জানে না সে কখনও আল্লাহর বিধান পালন করতে পারে না। পক্ষান্তরে কর্তব্যের অর্থ যে জানে; কিন্তু তা সত্তেও যদি উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাবে সেই কর্তব্য পালন করার কোন অগ্রহ উদ্যোগ তার না থাকে তবে রাত-তিন চব্বিশ ঘন্টার জন্য তাকে যে শত সহস্র আইন বিধান দেয়া হবে তা যে সে ঔকান্তিক নিষ্ঠা ও দৃঢ়তার সাথে পালন করবে, এমন ভরসা কিছুতেই করা যায় না।
যারা পুলিশ কিংবা সৈন্য বিভাগে কাজ করছেন তারা জানেন যে, এ দু’টি বিভাগে কর্তব্যানুভূতি এবং যথাযথভাবে কর্তব্য পালনের ট্রেনিং কত কঠোরতার সাথে দেয়া হয়। রাত-দিনের মধ্যে একাধিকাবার বিউগল বাজানো হয়। সৈনিকদেরকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে একত্র হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয় এবং তাদের দ্বারা কুচকাওয়ায করানো হয়। এসব কেবল মাত্র কর্তব্য পালনে অভ্যস্ত করার জন্য অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তাই এ সমস্ত ব্যাপারে যারা অক্ষম, নিষ্কর্মা ও অযোগ্য প্রমাণিত হয়, যারা ‘বিউগলের’ আওয়াজ শনেও ঘরে বসে থাকে কিংবা যারা কুচকাওয়াযের সময় নির্দেশ অনুসারে সাড়া না দেয় তাদেরকে প্রথমেই বরখাস্ত করা হয়। তদ্রূপ নামাযও দিন-রাত পাচঁবার ‘বিউগল’ বাজায়; যেই ‘বিউগল’ শুনা মাত্র আল্লাহর সৈণিকগন দৌঁড়িয়ে আসবে এবং প্রমাণ করবে যে, তারা সকল অবস্থাতেই আল্লাহর আদেশ পালন কতে প্রস্তুত ‘বিউগল ‘ শুনে যারা বসে থাকে, নিজ স্থান হতে একটুও নড়তে যারা প্রসু্তুত না হয়, তারা কর্তব্যের অর্থই জানে না, কিংবা কর্তব্যের অর্থ বুঝা সত্ত্বেও আল্লাহর সৈন্য বাহিনীর মধ্যে শামিল হওয়ার যোগ্যতাই তাদের নেই।
এ কারণেই হয়রত (সা) বলেছেন: “যারা আযানের আওয়াজ শুনেও নিজের ঘর হতে বের হয় না তাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিতে আমার ইচ্ছা হয়।” এবং এ জনই হাদীস শরীফে নামায পড়াকেই কুফর ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্যের প্রধান চিহ্ন বলে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। নামায পড়ার জন্য যে ব্যক্তি জামায়াতে হাজির না হতো হযরত (সা) এবং সাহাবাদের যুগে তাকে মুসলমানই বলা হত না। এমনকি যে সব মুনাফিকের মুসলমান হিসেবে পরিণত হওয়ার প্রয়োজন ছিল তারাও নামাযের জামায়াতে শামিল হতে বাধ্য হতো। এজন্যই কুরআন শরীফে মুনাফিকদেরকে এরূপ তিরষ্কার করা হয়নি যে, তারা নামায পড়ে না বরং বলা হয়েছে তারা ঐকান্তি আগ্রহ ও নিষ্ঠা সহকারে নামাযে দাঁড়ায় না, দাঁড়ায় নেহায়েত অবহেলা, অনিচ্ছাও উপেক্ষা সহকারে।
(***** আরবী)
এসব কথা দ্বারা নিসন্দেহে প্রমাণিত হচ্ছে যে, বে-নামাযীকে ‘মুসলমান’ মনে করার কোন অবকাশ নাই। কারণ, ইসলাম এক নিছক বিশ্বাসমূলক ধর্ম নয় যে, ‘কতগুলো কথা’ মনে মনে বিশ্বাস করলেই কর্তব্য পালন হয়ে যাবে। বরং এটা সম্পূর্ণ কর্মময় বাস্তব ধর্ম। এমন বাস্তব যে, প্রত্যেকটি মূহুর্ত ইসলাম অনুযায়ী কাজ করা এবং কুফরী ও ফাসেকীর বিরুদ্ধে অনবরত লড়াই করা অবশ্য কর্তব্য হয়ে পড়ে। এরূপ বিরাট কর্মময় জীবন যাপনের উদ্দেশ্যে প্রত্যেক মুসলমানের পক্ষে আল্লাহর বিধান পালনের জন্য সর্বক্ষণ প্রস্তুত থাকা অপরিহার্য। যে ব্যক্তি সেরূপ প্রস্তুত থাকে না, সে ইসলামের জন্য একেবারে নিষ্কর্মা। ঠিক এ কারণেই দিন-রাতের মধ্যে পাঁচ ওয়াক্তের নামায ফরয করে দেয়া হয়েছে। মুসলমানগণ প্রতকৃতপক্ষে মুসলমান কিনা এবং বাস্তব কর্ম জীবনে সে আল্লাহর হকুম পালন করতে প্রস্তুত কিনা, এর বাস্তব পরীক্ষা এবং প্রমাণ নেবার জনই এ পাঁচ ওয়াক্ত নামযের ব্যাবস্থা। আল্লাহর প্যারেডের ‘বিউগল’ শুনে কোন মুসলমান যদি বিন্দুমাত্র সাড়া না দেয়, তবে পরিষ্কার প্রমাণিত হবে যে, সে ইসলামের বিধান মত কর্মজীবন যাপন করতে প্রস্তুত নয়। এরপর যদি সে আল্লাহকে ও রাসূলকে বিশ্বাস করে তবে তা একেবারেই অর্থহীন। এ জন্যই কুরআন শরীফে বলা হয়েছে: (***** আরবী) (বাকারা: ৪৫)
অর্থাৎ যারা আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য স্বীকার করতে প্রস্তুত নয় কেবল সেই শ্রেণীর লোকদের পক্ষেই নামায কঠিন কাজ হয়ে পড়ে। আর যাদের কাছে নামায পড়া কঠিন কাজ বলে বিবেচিত হয়, তারা আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য স্বীকার করে জীবনযাপনের জন্য প্রস্তুত নয় এটাই প্রমাণিত হয়।
তৃতীয়ত, আল্লাহর ভয়। প্রত্যেকটি মুসলমানের মনে এ ভয় সদা-সর্বদা জাগ্রত থাকা একান্ত আবশ্যক। মুসলমান ইসলাম অনুসারে কখনই কাজ করতে পারে না, যদি না তার মনে একই দৃঢ় বিশ্বাস বদ্ধমূল হয় যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে সবসময়ই এবং সকল স্থানেই দেখছেন, তার গতিবিধি সম্পর্কে আল্লাহ সম্পূর্ণরূপে অবহিত। আল্লাহ অন্ধকারেও তাকে দেখছেন, নিতান্ত সংগীহীন অবস্থায়ও আল্লাহ তার সাথী, সমগ্র দুনিয়া হতে আত্মগোপন করা সম্ভব, কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টি হতে লুকিয়ে থাকা কিছুতেই সম্ভব নয়। সমগ্র দুনিয়ার সর্বপ্রকার শাস্তি ও শাসন হতে মানুষ বেঁচে যেতে পারে; কিন্তু আল্লাহর শাস্তি ও শাসন হতে রেহাই পাওয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এ দৃঢ়বিশ্বাসই মনুষকে আল্লাহর বিধন লংঘন করা হতে রিবত রাখে। এ বিশ্বাসের কারণেই জীবনের যাবতীয় কার্যে আল্লাহর নিধার্রিত হালাল-হারামের সীমা রক্ষা করে চলতে মানুষ বাধ্য হয়। এ বিশ্বাস যদি দূর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে মুসলমান কিছুতেই খাঁটি মুসলিম জীবনযাপন করতে পারে না। এ বিশ্বাসকে বার বার স্মরণ করার জন্য এবং ক্রমাগত স্মরণের মাধ্যমে মানব মনে এ বিশ্বাস খুব দৃঢ়তার সাথে বদ্ধমূল করা জন্যই আল্লাহ তায়ালা পাঁচ ওয়াক্তের নামায ফরয করেছেন। কুরআন শরীফে আল্লাহ তায়ালা নিজেই নামাযের এ স্বার্থকতা ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ঘোষণা করেছেন:
(***** আরবী)
“নিশ্চই নামায মানুষকে পাপ, অন্যায় ও অশ্লীলতা এবং লজ্জাহীনতার কাজ হতে বিরত রাখে।”
একথার সত্যতা আপনি নিজে চিন্তা করলেই বুঝতে পারেন: আপনি যখন নামায পড়তে যান, তখন পবিত্র হয়ে এবং অযু করে যান, আপনার শরীর যদি নাপাক হয় এবং গোসল না করেই নামাযে হাজির হন, কিংবা আপনি যদি নাপাক কাপড় পরে নামায পড়তে যান, অথবা অযু না থাকা সত্ত্বেও যদি আপনি বলেন যে, আমি অযু করে এসেছি, তাহলে দুনিয়র কোন লোকই আপনাকে ধরতে পরে না। তবুও তা কখনই করেন না।
কিন্তু কেন? এজন্য যে, আল্লাহর দৃষ্টি হতে কোন গোনাহ লুকানো সম্ভব নয়, একথা আপনি নিসন্দেহে বিশ্বাস করেন। এমনকি নামাযে যে সব দোয়া সূরা নিশব্দে পড়তে হয়, আপনি যদি তা না পড়েন তবে তাও কেউ জানতে পারে না। কিন্তু এরূপ কাজ আপনি এজন্য করেন না যে, আল্লাহ সব কিছুই শুনতে পান, তিনি আপনার একান্ত কাছে অবস্থিত। তদ্রূপ নিবিড় জঙ্গলে গিয়েও আপনি নামায পড়েন, রাতের অন্ধকারে নামায পড়েন। নিজের ঘরে যখন একেবারে একাকী থাকেন তখনও আপনি নামায পড়েন। অথচ এসব সময় আপনাকে কেউ দেখতে পায় না এবং কেউ জানতে পরে না যে, আপনি নামায পড়েছেন, কি পড়েননি। এর কারণ কি? করণ এই যে, গোপনে-সমস্ত লোক চক্ষুর আড়ালে ও অল্লাহর হুকুম লংঘন করতে অপনি ভয় পান এবং আপনি নিসন্দেহে বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহর দৃষ্টি হতে কোন অপরাধ গোপন করা সম্ভব নয়। এর দ্বারাই আপনি অনুমান করতে পরেন যে, নামায মানব মনে আল্লাহকে কিভাবে জাগ্রত রাখে এবং আল্লাহ যে হাযের-নাযের, সর্বজ্ঞ অন্তর্যামী, এ বিশ্বাস কিভবে খুবই দৃঢ়তার সাথে মানব মনে বব্ধ মূল করে দেয়। বস্তুত এ ভয় এবং এ দৃঢ় বিশ্বাস আপনার মনে বদ্ধমূল ও সদাজাগ্রত না থাকলে রাত-দিন চব্বিশ ঘন্টা আপনি আল্লাহর ইবাদাত ও বন্দেগী কিরূপে করতে পারেন? আপনার মনে এ ভয় যদি না থাকে তবে রাত-দিনের অসংখ্য কাজ-কর্মে আল্লাহকে ভয় করে ন্যায় ও পুণ্যের পথে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা এবং সকল প্রকার পাপ ও নাফরমানী হতে দূরে থাকা আপনার পক্ষে কিরূপে সম্ভব হতে পারে?
চতুর্থত, ইবাদাত করার জন্য আল্লাহর আইন পূর্ণরূপে জেনে নেয়া আপনার পক্ষে অপরিহার্য। কারণ আইন না জানলে আপনি তা অনুসরণ করবেন কিরূপে? নামাযই আপনার এ প্রয়োজন পূর্ণ করে। নামাযের মধ্যে কুরআন শরীফের আয়াত পাঠ করার বিধান এজন্যেই দেয়া হয়েছে। এর সাহায্যে দিন-রাত আপনি আল্লাহর আইন ও বিধান সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারেন। জুময়ার নামাযের পূর্বে ‘খোতবা’র নিয়মও এ উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, এর দ্বারা আপনি ইসলামের বিধান জানতে পারেন। জামায়াতের সাথে নামায ও জুমআর নামায পড়ার আর একটি উপকারিতা এই যে, এ উদ্দেশ্যে আলেম ও অশিক্ষিত লোকদের এক স্থানে বার বার একত্র হতে হয় এবং সকলের পক্ষেই আল্লাহর বিধান জানার অপূর্ব সুযোগ ঘটে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আপনারা নামাযে যা কিছু পড়েন তা থেকে আল্লাহর হুকুম জানতে চেষ্টা করেন না, জুমআর খুতবা এমন ভাবে দেয়া হয় যে, বারবার শোনার পরও ইলাম সম্পর্কে আপনাদের কোন জ্ঞান হয় না এবং জামায়াতের সাথে নামায পড়ার জন্য একত্র হওয়া সত্ত্বেও না আলেমগণ অশিক্ষিতগণকে কিছু শিক্ষা দেন, না অশিক্ষিত লোকেরা আলেমদের কাছে কিছু জিজ্ঞাসা করেন, একে দুভার্গ্য ছড়া আর কি বলা যেতে পারে? নামায আপনাদেরকে এ বিষয়ে অবাধ সুযোগ করে দেয়। আপনারা যদি তা থেকে এ উপার লাভ না করেন, তবে নামাযের অপরাধ কি?
পঞ্চমত, জীবনের এ বিরাট কর্মক্ষেত্রে মুসলমান নিসঙ্গ থাকতে পারে না বরং সমস্ত মুসলমানদের একত্রে সংঘবদ্ধ হয়ে থাকা, মিলিতভাবে আল্লাহর বিধান পালন করার তাঁর বিধান অনুযায়ী নিজেরদের জীবন গঠন করা এবং দুনিয়ায় আল্লাহর আইন জারী করার জন্য একে অপরের সহযেগীতা করা তাদের অবশ্য কর্তব্য। আপনি জনেন যে, এ জীবনে ক্ষেত্রে একদিকে মুসলমান — আল্লাহর অদেশানুগত বন্দাহ এবং অন্যদিকে আল্লাহদ্রোহী ও কাফের লোকদের দল রয়েছে। রাত-দিন আল্লাহর আদেশ পালন এবং আল্লাহদ্রোহীতার মধ্যে অবিশ্রান্ত দ্বন্দ্ব ও সংগ্রাম চলছে। কাফেরগণ আল্লাহর আইন লংঘন করতে এবং এর বিরুদ্ধে দুনিয়ায় শয়তানের আইন জারী করছে, এদের মোকাবিলায় এক একটি ‘মুসলমান’ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকলে কখনও জয় লাভ করতে পারে না। তাই আল্লাহর বান্দাদের পক্ষে একত্র হয়ে একটি মিলত ঐক্য শক্তির বলে আল্লাহর দুশমনদের সাথে মোকাবিলা করা এবং দুনিয়ায় আল্লাহর আইন জারীর চেষ্টা করা অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু নামায ভিন্ন আর কিছুই এ বিরাট ঐক্য শক্তি গঠন করতে পারে না। দিন-রাত পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জামায়াত, সাপ্তাহিক জুমআর নামাযের বড় জামায়াত, তার পর বছরে দু’ঈদের নামাযের বিরাট সম্মেলন — এসব কিছু মিলে মুসলমানদেরকে একটি সুদৃঢ় দেয়ালের মত গড়ে তোলে এবং তাদের মধ্যে চিন্তা,ভাব, মত ও কর্মের সেই ঐক্য জগিয়ে তোলে যা মুসলমানদের কে নিত্য নৈমিত্তিক কাজে পরষ্পরের সহায্যকারী রূপে গড়ে তোলার জন্য একান্ত অপরিহার্য।
পূর্ববর্তী প্রবন্ধে আমি ইবাদাতের প্রকৃত অর্থ বর্ণনা করেছি। এ ‘ইবাদাতের’ উদ্দেশ্যে অল্লাহ তায়ালা মানুষ ও জি্ন জাতি সৃষ্টি করেছেন। মানুষকে আল্লাহ তায়ালার খাঁটি বান্দাহ হিসাবে প্রস্তুত করার জন্য ইসলামে কয়েকটি নির্দষ্ট ইবাদত ফরয করা হয়েছে। সুতরাং এবারে কেবল ‘নামায’ সম্পর্কে আমি সংক্ষেপে বর্ণনা করতে চাই।
অপনারা পূর্বের প্রবন্ধে জানতে পেরেছেন যে, ‘ইবাদাত’ এর আসল অর্থ বন্দেগী বা দাসত্ব করা। তাই অপনাকে যখন শুধু দাসত্ব করার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে তখন আপনি কখনো এবং কোন অবস্থাতেই অল্লাহর দাসত্ব হতে মুক্ত হতে পারেন না। ‘এত মিনিট কিংবা এত ঘন্টার জন্য আমি আল্লাহর দাস, অন্য সকল সময় তা নই’ — এ কথা আপনি যেমন বলতে পরেন না, তদ্রূপ আপনি একথাও বলতে পারেন না, ‘আমি এতক্ষণ আল্লাহর ইবাদাতে অতিবাহিত করবো এবং অন্য সময়ে আমার পূর্ণ আযাদী — তখন যা ইচ্ছা তাই করবো। যেহেতু আল্লাহর গোলাম —আল্লাহর দাস হিসেবেই আপনার জন্ম হয়েছে। কেবল তাঁর গোলামী ও দাসত্বে অতিবাহিত হওয়াই একান্ত বাঞ্চনীয়, জীবনের কোন একটি মুহুর্তও আপনি তাঁর ‘ইবাদাত’ ও দাসত্ব হতে মুক্ত হতে পরেন না।
পূর্বে একথাও আপনাকে বলেছি, যে দুনিয়ার কাজ-কর্ম পরিত্যাগ করে এক কোণায় বসে যাওয়া এবং ‘আল্লাহু’ ‘আল্লাহু’ করার নাম ইবাদাত নয়। বরং এ দুনিয়ায় অপনি যে কাজই করুন না কেন তা ঠিক আল্লাহর আইন ও বিধান অনুসারে করার অর্থই হচ্ছে ইবাদাত। আপনার শয়ন-নিদ্রা, আপনার জাগরণ ও বিশ্রাম, পানাহার, চলা-ফেরা — মোটকথা সবকিছুই আল্লাহর আইন বিধান অনুযায়ী আপনাকে করতে হবে। আপনার স্ত্রী-পুত্র, ভাই -ভগ্নি এবং আত্মীয়গণের সাথে ঠিক আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী ব্যবহার করবেন। বন্ধু – বান্ধবের সাথে হাসি-তামাশা ও কথাবার্তা বলার সময়ও আপনাকে স্মরণ রাখতে হবে যে, আমরা আল্লাহর দাসত্ব-শৃঙ্খল হতে মুক্ত নই। কামাই রোযগারে টাকা – পয়সা আদান – প্রদানের সময়ও আপনাকে প্রত্যেকটি কাজে ও কথায় আল্লাহর বিধি-নিষেধ লক্ষ্য রাখতে হবে এবং কখনো আল্লাহর নিধার্রিত সীমা অতিক্রম করতে পরেন না। রাতের অন্ধকারে কোন পাপের কাজ করা যদি খুবই সহজ হয়ে পড়ে এবং তা করলে কেউ দেখতে পাবে না বলে আপনি মনে করেন, ঠিক তখনো আপনি স্মরণ রাখবেন যে, আর কেউ দেখুক আর নাই দেখুক, আল্লাহ তায়ালা সব কিছু দেখছেন এবং আপনার মনে আল্লাহর ভয় বদ্ধমূল হওয়া উচিত, মানুষের ভয়ে নয়। গভীর জঙ্গলে বসেও যদি কোন পাপের কাজ করতে ইচ্ছা করেন এবং যদি মনে করেন পুলিশ বা অন্য কোন লোক তা দেখতে পবে না, তখনো আপনি কেবল আল্লাহকে ভয় করে পাপ পরিহার করবেন। যখন মিথ্যা কথা, দুনীর্তি, বেঈমানী, যুলুম ও শোষণ করে বহু স্বার্থ লাভ করতে পারেন এবং আপনাকে বাধা দেয়ার কোউ না থাকে, তখনো আপনি আল্লাহকে ভয় করবেন এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টির আশাংকায় এ স্বার্থের কাজ থেকে বিরত থাকবেন। পক্ষান্তরে সততা ও ন্যয়-নীতি রক্ষা করে চলায় আপনাকে যদি ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্তও হতে হয়, তথাপি আপনি কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায়ই এ ক্ষতি স্বীকার করতে বিন্দু মাত্র দ্বিধাবোধ করবেন না। অতএব দুনিয়ার বিপুল কর্মজীবন পরিত্যাগ করে (ঘর বা মসজিদের) কোণে বসে তাসবীহ পড়াকে ‘ইবাদাত’ বলা যায় না। বস্তুত দুনিয়ার এ গোলক ধাঁধায় জড়িত হয়ে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবনযাপন করার নামই ‘ইবাদাত’। মুখে কেবল ‘আল্লাহু’ ‘আল্লাহু’ শব্দ উচ্চারণ করাকেই আল্লাহর ‘যিকর ‘ বলা যায় না। দুনিয়ার কাজ-কর্ম ও ঝামেলার কঠিন জালে জড়িত হয়ে আল্লাহকে বিস্মৃত না হওয়াই আসল আলাহর যিকর। যে সকল জিনিস মানুষকে আল্লাহর কথা ভুলিয়ে দেয় তাতে জড়িত হওয়া সত্বেও তাঁকে বিস্মৃত না হওয়া, বড় বড় স্বার্থ হাসিলের লোভ এবং বিরাট ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার জন্য দুনিয়ার জীবনে আল্লাহর আইন লংঘন করার যখন সুযোগ এসে যায় তখনও আল্লাহকে স্বরণ করা এবং দৃঢ়তার সাথে তাঁর আইন অনুসরণ করে চলাই সত্যিকার ‘যিকরুলালাহ’ বা আল্লাহর যিকর। এ যিকরের দিকে ইংগিত করা হয়েছে কুরআনের নিম্নলিখিত আয়াতে:
(***** আরবী)
“নামায পূর্ণরূপে আদায় হয়ে গেলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়; আল্লাহর দান জীবিকা উপার্জনের চেষ্টা কর এবং এ প্রচেষ্টা ব্যাপদেশে আল্লাহকে খুব বেশী করে স্বরন কর। তবেই সম্ভবত তোমরা কল্যাণ লাভ করতে পারবে।”
(আল জুমআ: ১০)
‘ইবাদাতের’ এ অর্থ মনে জাগরুক রাখুন এবং গভীরভাবে চিন্তা করুন যে, এ বিরাট ও বৃহত্তম ‘ইবাদাত’ যথাযথভাবে আঞ্জাম দেয়ার জন্য কি কি জিনিস অপরিহার্য এবং নামায যে সব জিনিসকে মানুষের মধ্যে কিভাবে সৃষ্টি করে। আল্লাহর খাঁটি ‘বান্দাহ’ হওয়ার জন্য বার বার একথা স্মরণ করা আবশ্যক যে, আপনি আল্লাহর বান্দাহ এবং প্রত্যেক সময় ও প্রত্যেকটি ব্যাপারেই সেই আল্লাহর বন্দেগী করাই হচ্ছে আপনার কাজ। এ কথা বার বার স্বরণ করিয়ে দেয় এজন্য আবশ্যক যে, মনুষের মনে একটি ‘শয়তান’ সবসময়ই উপস্থিত থাকে; সে সবসময়ই মানুষকে নিজের ‘দাস’ বানাতে চেষ্টা করে।
শয়তানের প্ররোচনা ও গোলক ধাঁধার জাল ছিন্ন করার জন্য মানুষকে প্রত্যক বার বার একথা স্মরণ করিয়ে দেয়া একান্ত আবশ্যক যে, ” তুমি কেবলমাত্র আল্লাহ তায়ালার দাস, তিনি ছাড়া তুমি কারর দাস নয় — না শয়তানের, না কোন মানুষের।” একথারই অনুভূতি মানুষের মনে জাগরুক করে দেয় নামায। সকাল বেলা ঘুম ভাংতেই তা সর্বপ্রথম এবং সকল কাজের আগে আপনাকে একথা স্বরণ করিয়ে দেয় এবং দিনের বেলা যখন নানা প্রকার কাজে আপনি মশগুল থাকেন তখনো তিন-তিনবার অপানাকে মনে একথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং রাত্রিকালে যখন নিদ্রার সময় উপস্থিত হয়, তখন শেষ বারের মত এরই পুনরাবৃত্তি করে। এরূপে আল্লাহর ‘দাস’ হওয়ার কথা মানুষকে বার বার স্মরণ করিয়ে দেয়া নামাযের প্রথম উপকার। এ জন্যই কুরআন মজীদে নামাযকে ‘যিকর’ নামে অভিহিত করা হয়েছে, অর্থাত্ এর দ্বারা অল্লাহকে স্মরণ করা হয়।
তারপর অপনাকে এ জীবনের পদে পদে আল্লাহর বিধি-নিষেধ পালন করে চলতে হবে, কাজেই কর্তব্য জ্ঞান ও দায়িত্ববোধ আপনার মনে সদা জাগ্রত থাকা বাঞ্ছনীয় এবং তা পালন করার অভ্যাসও আপনার থাকা দরকার। ‘কর্তব্য’ কাকে বলে এটা যে জানে না সে কখনও আল্লাহর বিধান পালন করতে পারে না। পক্ষান্তরে কর্তব্যের অর্থ যে জানে; কিন্তু তা সত্তেও যদি উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাবে সেই কর্তব্য পালন করার কোন অগ্রহ উদ্যোগ তার না থাকে তবে রাত-তিন চব্বিশ ঘন্টার জন্য তাকে যে শত সহস্র আইন বিধান দেয়া হবে তা যে সে ঔকান্তিক নিষ্ঠা ও দৃঢ়তার সাথে পালন করবে, এমন ভরসা কিছুতেই করা যায় না।
যারা পুলিশ কিংবা সৈন্য বিভাগে কাজ করছেন তারা জানেন যে, এ দু’টি বিভাগে কর্তব্যানুভূতি এবং যথাযথভাবে কর্তব্য পালনের ট্রেনিং কত কঠোরতার সাথে দেয়া হয়। রাত-দিনের মধ্যে একাধিকাবার বিউগল বাজানো হয়। সৈনিকদেরকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে একত্র হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয় এবং তাদের দ্বারা কুচকাওয়ায করানো হয়। এসব কেবল মাত্র কর্তব্য পালনে অভ্যস্ত করার জন্য অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তাই এ সমস্ত ব্যাপারে যারা অক্ষম, নিষ্কর্মা ও অযোগ্য প্রমাণিত হয়, যারা ‘বিউগলের’ আওয়াজ শনেও ঘরে বসে থাকে কিংবা যারা কুচকাওয়াযের সময় নির্দেশ অনুসারে সাড়া না দেয় তাদেরকে প্রথমেই বরখাস্ত করা হয়। তদ্রূপ নামাযও দিন-রাত পাচঁবার ‘বিউগল’ বাজায়; যেই ‘বিউগল’ শুনা মাত্র আল্লাহর সৈণিকগন দৌঁড়িয়ে আসবে এবং প্রমাণ করবে যে, তারা সকল অবস্থাতেই আল্লাহর আদেশ পালন কতে প্রস্তুত ‘বিউগল ‘ শুনে যারা বসে থাকে, নিজ স্থান হতে একটুও নড়তে যারা প্রসু্তুত না হয়, তারা কর্তব্যের অর্থই জানে না, কিংবা কর্তব্যের অর্থ বুঝা সত্ত্বেও আল্লাহর সৈন্য বাহিনীর মধ্যে শামিল হওয়ার যোগ্যতাই তাদের নেই।
এ কারণেই হয়রত (সা) বলেছেন: “যারা আযানের আওয়াজ শুনেও নিজের ঘর হতে বের হয় না তাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিতে আমার ইচ্ছা হয়।” এবং এ জনই হাদীস শরীফে নামায পড়াকেই কুফর ও ইসলামের মধ্যে পার্থক্যের প্রধান চিহ্ন বলে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। নামায পড়ার জন্য যে ব্যক্তি জামায়াতে হাজির না হতো হযরত (সা) এবং সাহাবাদের যুগে তাকে মুসলমানই বলা হত না। এমনকি যে সব মুনাফিকের মুসলমান হিসেবে পরিণত হওয়ার প্রয়োজন ছিল তারাও নামাযের জামায়াতে শামিল হতে বাধ্য হতো। এজন্যই কুরআন শরীফে মুনাফিকদেরকে এরূপ তিরষ্কার করা হয়নি যে, তারা নামায পড়ে না বরং বলা হয়েছে তারা ঐকান্তি আগ্রহ ও নিষ্ঠা সহকারে নামাযে দাঁড়ায় না, দাঁড়ায় নেহায়েত অবহেলা, অনিচ্ছাও উপেক্ষা সহকারে।
(***** আরবী)
এসব কথা দ্বারা নিসন্দেহে প্রমাণিত হচ্ছে যে, বে-নামাযীকে ‘মুসলমান’ মনে করার কোন অবকাশ নাই। কারণ, ইসলাম এক নিছক বিশ্বাসমূলক ধর্ম নয় যে, ‘কতগুলো কথা’ মনে মনে বিশ্বাস করলেই কর্তব্য পালন হয়ে যাবে। বরং এটা সম্পূর্ণ কর্মময় বাস্তব ধর্ম। এমন বাস্তব যে, প্রত্যেকটি মূহুর্ত ইসলাম অনুযায়ী কাজ করা এবং কুফরী ও ফাসেকীর বিরুদ্ধে অনবরত লড়াই করা অবশ্য কর্তব্য হয়ে পড়ে। এরূপ বিরাট কর্মময় জীবন যাপনের উদ্দেশ্যে প্রত্যেক মুসলমানের পক্ষে আল্লাহর বিধান পালনের জন্য সর্বক্ষণ প্রস্তুত থাকা অপরিহার্য। যে ব্যক্তি সেরূপ প্রস্তুত থাকে না, সে ইসলামের জন্য একেবারে নিষ্কর্মা। ঠিক এ কারণেই দিন-রাতের মধ্যে পাঁচ ওয়াক্তের নামায ফরয করে দেয়া হয়েছে। মুসলমানগণ প্রতকৃতপক্ষে মুসলমান কিনা এবং বাস্তব কর্ম জীবনে সে আল্লাহর হকুম পালন করতে প্রস্তুত কিনা, এর বাস্তব পরীক্ষা এবং প্রমাণ নেবার জনই এ পাঁচ ওয়াক্ত নামযের ব্যাবস্থা। আল্লাহর প্যারেডের ‘বিউগল’ শুনে কোন মুসলমান যদি বিন্দুমাত্র সাড়া না দেয়, তবে পরিষ্কার প্রমাণিত হবে যে, সে ইসলামের বিধান মত কর্মজীবন যাপন করতে প্রস্তুত নয়। এরপর যদি সে আল্লাহকে ও রাসূলকে বিশ্বাস করে তবে তা একেবারেই অর্থহীন। এ জন্যই কুরআন শরীফে বলা হয়েছে: (***** আরবী) (বাকারা: ৪৫)
অর্থাৎ যারা আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য স্বীকার করতে প্রস্তুত নয় কেবল সেই শ্রেণীর লোকদের পক্ষেই নামায কঠিন কাজ হয়ে পড়ে। আর যাদের কাছে নামায পড়া কঠিন কাজ বলে বিবেচিত হয়, তারা আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য স্বীকার করে জীবনযাপনের জন্য প্রস্তুত নয় এটাই প্রমাণিত হয়।
তৃতীয়ত, আল্লাহর ভয়। প্রত্যেকটি মুসলমানের মনে এ ভয় সদা-সর্বদা জাগ্রত থাকা একান্ত আবশ্যক। মুসলমান ইসলাম অনুসারে কখনই কাজ করতে পারে না, যদি না তার মনে একই দৃঢ় বিশ্বাস বদ্ধমূল হয় যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে সবসময়ই এবং সকল স্থানেই দেখছেন, তার গতিবিধি সম্পর্কে আল্লাহ সম্পূর্ণরূপে অবহিত। আল্লাহ অন্ধকারেও তাকে দেখছেন, নিতান্ত সংগীহীন অবস্থায়ও আল্লাহ তার সাথী, সমগ্র দুনিয়া হতে আত্মগোপন করা সম্ভব, কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টি হতে লুকিয়ে থাকা কিছুতেই সম্ভব নয়। সমগ্র দুনিয়ার সর্বপ্রকার শাস্তি ও শাসন হতে মানুষ বেঁচে যেতে পারে; কিন্তু আল্লাহর শাস্তি ও শাসন হতে রেহাই পাওয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এ দৃঢ়বিশ্বাসই মনুষকে আল্লাহর বিধন লংঘন করা হতে রিবত রাখে। এ বিশ্বাসের কারণেই জীবনের যাবতীয় কার্যে আল্লাহর নিধার্রিত হালাল-হারামের সীমা রক্ষা করে চলতে মানুষ বাধ্য হয়। এ বিশ্বাস যদি দূর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে মুসলমান কিছুতেই খাঁটি মুসলিম জীবনযাপন করতে পারে না। এ বিশ্বাসকে বার বার স্মরণ করার জন্য এবং ক্রমাগত স্মরণের মাধ্যমে মানব মনে এ বিশ্বাস খুব দৃঢ়তার সাথে বদ্ধমূল করা জন্যই আল্লাহ তায়ালা পাঁচ ওয়াক্তের নামায ফরয করেছেন। কুরআন শরীফে আল্লাহ তায়ালা নিজেই নামাযের এ স্বার্থকতা ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ঘোষণা করেছেন:
(***** আরবী)
“নিশ্চই নামায মানুষকে পাপ, অন্যায় ও অশ্লীলতা এবং লজ্জাহীনতার কাজ হতে বিরত রাখে।”
একথার সত্যতা আপনি নিজে চিন্তা করলেই বুঝতে পারেন: আপনি যখন নামায পড়তে যান, তখন পবিত্র হয়ে এবং অযু করে যান, আপনার শরীর যদি নাপাক হয় এবং গোসল না করেই নামাযে হাজির হন, কিংবা আপনি যদি নাপাক কাপড় পরে নামায পড়তে যান, অথবা অযু না থাকা সত্ত্বেও যদি আপনি বলেন যে, আমি অযু করে এসেছি, তাহলে দুনিয়র কোন লোকই আপনাকে ধরতে পরে না। তবুও তা কখনই করেন না।
কিন্তু কেন? এজন্য যে, আল্লাহর দৃষ্টি হতে কোন গোনাহ লুকানো সম্ভব নয়, একথা আপনি নিসন্দেহে বিশ্বাস করেন। এমনকি নামাযে যে সব দোয়া সূরা নিশব্দে পড়তে হয়, আপনি যদি তা না পড়েন তবে তাও কেউ জানতে পারে না। কিন্তু এরূপ কাজ আপনি এজন্য করেন না যে, আল্লাহ সব কিছুই শুনতে পান, তিনি আপনার একান্ত কাছে অবস্থিত। তদ্রূপ নিবিড় জঙ্গলে গিয়েও আপনি নামায পড়েন, রাতের অন্ধকারে নামায পড়েন। নিজের ঘরে যখন একেবারে একাকী থাকেন তখনও আপনি নামায পড়েন। অথচ এসব সময় আপনাকে কেউ দেখতে পায় না এবং কেউ জানতে পরে না যে, আপনি নামায পড়েছেন, কি পড়েননি। এর কারণ কি? করণ এই যে, গোপনে-সমস্ত লোক চক্ষুর আড়ালে ও অল্লাহর হুকুম লংঘন করতে অপনি ভয় পান এবং আপনি নিসন্দেহে বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহর দৃষ্টি হতে কোন অপরাধ গোপন করা সম্ভব নয়। এর দ্বারাই আপনি অনুমান করতে পরেন যে, নামায মানব মনে আল্লাহকে কিভাবে জাগ্রত রাখে এবং আল্লাহ যে হাযের-নাযের, সর্বজ্ঞ অন্তর্যামী, এ বিশ্বাস কিভবে খুবই দৃঢ়তার সাথে মানব মনে বব্ধ মূল করে দেয়। বস্তুত এ ভয় এবং এ দৃঢ় বিশ্বাস আপনার মনে বদ্ধমূল ও সদাজাগ্রত না থাকলে রাত-দিন চব্বিশ ঘন্টা আপনি আল্লাহর ইবাদাত ও বন্দেগী কিরূপে করতে পারেন? আপনার মনে এ ভয় যদি না থাকে তবে রাত-দিনের অসংখ্য কাজ-কর্মে আল্লাহকে ভয় করে ন্যায় ও পুণ্যের পথে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা এবং সকল প্রকার পাপ ও নাফরমানী হতে দূরে থাকা আপনার পক্ষে কিরূপে সম্ভব হতে পারে?
চতুর্থত, ইবাদাত করার জন্য আল্লাহর আইন পূর্ণরূপে জেনে নেয়া আপনার পক্ষে অপরিহার্য। কারণ আইন না জানলে আপনি তা অনুসরণ করবেন কিরূপে? নামাযই আপনার এ প্রয়োজন পূর্ণ করে। নামাযের মধ্যে কুরআন শরীফের আয়াত পাঠ করার বিধান এজন্যেই দেয়া হয়েছে। এর সাহায্যে দিন-রাত আপনি আল্লাহর আইন ও বিধান সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারেন। জুময়ার নামাযের পূর্বে ‘খোতবা’র নিয়মও এ উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, এর দ্বারা আপনি ইসলামের বিধান জানতে পারেন। জামায়াতের সাথে নামায ও জুমআর নামায পড়ার আর একটি উপকারিতা এই যে, এ উদ্দেশ্যে আলেম ও অশিক্ষিত লোকদের এক স্থানে বার বার একত্র হতে হয় এবং সকলের পক্ষেই আল্লাহর বিধান জানার অপূর্ব সুযোগ ঘটে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আপনারা নামাযে যা কিছু পড়েন তা থেকে আল্লাহর হুকুম জানতে চেষ্টা করেন না, জুমআর খুতবা এমন ভাবে দেয়া হয় যে, বারবার শোনার পরও ইলাম সম্পর্কে আপনাদের কোন জ্ঞান হয় না এবং জামায়াতের সাথে নামায পড়ার জন্য একত্র হওয়া সত্ত্বেও না আলেমগণ অশিক্ষিতগণকে কিছু শিক্ষা দেন, না অশিক্ষিত লোকেরা আলেমদের কাছে কিছু জিজ্ঞাসা করেন, একে দুভার্গ্য ছড়া আর কি বলা যেতে পারে? নামায আপনাদেরকে এ বিষয়ে অবাধ সুযোগ করে দেয়। আপনারা যদি তা থেকে এ উপার লাভ না করেন, তবে নামাযের অপরাধ কি?
পঞ্চমত, জীবনের এ বিরাট কর্মক্ষেত্রে মুসলমান নিসঙ্গ থাকতে পারে না বরং সমস্ত মুসলমানদের একত্রে সংঘবদ্ধ হয়ে থাকা, মিলিতভাবে আল্লাহর বিধান পালন করার তাঁর বিধান অনুযায়ী নিজেরদের জীবন গঠন করা এবং দুনিয়ায় আল্লাহর আইন জারী করার জন্য একে অপরের সহযেগীতা করা তাদের অবশ্য কর্তব্য। আপনি জনেন যে, এ জীবনে ক্ষেত্রে একদিকে মুসলমান — আল্লাহর অদেশানুগত বন্দাহ এবং অন্যদিকে আল্লাহদ্রোহী ও কাফের লোকদের দল রয়েছে। রাত-দিন আল্লাহর আদেশ পালন এবং আল্লাহদ্রোহীতার মধ্যে অবিশ্রান্ত দ্বন্দ্ব ও সংগ্রাম চলছে। কাফেরগণ আল্লাহর আইন লংঘন করতে এবং এর বিরুদ্ধে দুনিয়ায় শয়তানের আইন জারী করছে, এদের মোকাবিলায় এক একটি ‘মুসলমান’ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকলে কখনও জয় লাভ করতে পারে না। তাই আল্লাহর বান্দাদের পক্ষে একত্র হয়ে একটি মিলত ঐক্য শক্তির বলে আল্লাহর দুশমনদের সাথে মোকাবিলা করা এবং দুনিয়ায় আল্লাহর আইন জারীর চেষ্টা করা অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু নামায ভিন্ন আর কিছুই এ বিরাট ঐক্য শক্তি গঠন করতে পারে না। দিন-রাত পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের জামায়াত, সাপ্তাহিক জুমআর নামাযের বড় জামায়াত, তার পর বছরে দু’ঈদের নামাযের বিরাট সম্মেলন — এসব কিছু মিলে মুসলমানদেরকে একটি সুদৃঢ় দেয়ালের মত গড়ে তোলে এবং তাদের মধ্যে চিন্তা,ভাব, মত ও কর্মের সেই ঐক্য জগিয়ে তোলে যা মুসলমানদের কে নিত্য নৈমিত্তিক কাজে পরষ্পরের সহায্যকারী রূপে গড়ে তোলার জন্য একান্ত অপরিহার্য।
নামাযে কি পড়েন
নামায মানুষকে আল্লাহর ইবাদাত, দাসত্ব ও আনুগ্যত স্বীকার করে চলার জন্য কিভাবে প্রস্তুত করে, তা পূর্বে বিস্তারিতরূপে আলোচনা করছি। এ প্রসঙ্গে যা কিছু লেখা হয়েছে তা পাঠ করে আপনি পরিস্কারভাবে বুঝতে পেরেছেন যে একজন মানুষ যদি আল্লাহর হুকুম এবং ফরয মনে করে রীতিমতো নামায আদায় করে, তবে সে নামাযে দোআ ও সুরাগুলের কোন অর্থ বুঝতে না পারলেও এ নামাজ তার মনে আল্লাহর ভয়ে, আল্লাহর হাজের-নাযের হওয়ার কথা এবং আদালতে একদিন উপস্থিত হওয়ার বিশ্বাস নিসন্দেহে সবসময়ই জাগরুক রাখবে। সবসময় সে মনে করবে যে, সে আল্লাহ ভিন্ন অন্য কোন দাস নয়- আল্লাহই তার প্রকৃত বাদশাহ এবং প্রভু। এরই ফলে তার মধ্যে কর্তব্য পালনের অভ্যাস হবে এবং সকল অবস্থায়ই সে আল্লাহর বিধান পালন করবে চলার জন্য প্রসতুত থাকবে। মানুষের সমগ্র জীবনকে আল্লাহর বন্দেগীর অধীনে যাপন করতে এবং গোটা জীবনকে এবাদাতে পরিনত করতে হলে যে সব গুন -সিফাত অবশ্য প্রয়োজনীয় তাও এ নামাযের সাহায্যে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়। নামায দ্বারা এ উপকার কিরূপে লাভ করা যায় তাতে আপনার পৃর্বের প্রবন্ধে ভালভাবে বুঝতে পেরেছেন আশা করি।
এখন বুঝে দেখতে হবে যে, নামাযের দোআ ও সূরাগুলোর অর্থ না বুঝে নামায পড়লে যদি এতবড় উপকার লাভ করা যায়, তাহলে কেউ যদি নামায ভালোভাবে বুঝে-শুনে পড়ে, সে যা পড়ছে তা যদি সে হৃদয়-মন দিয়ে বুঝতে ও অনুভব করতে পারে তবে তার বিশ্বাস, মতবাদ, চিন্তাধারা এবং অভ্যাস ও স্বভাবের কি বিরাট পরিবর্তন সাধিত হতে পারে এবং তার গোটা জীবন কিরূপ আদর্শে গঠিত হতে পারে, এখানে আমি এ বিষয়ই পুংখানুপুংখরূপে আলোচনার চেষ্টা করবো।
সর্বপ্রথম আযান সম্পর্কে ভেবে দেখুন। দৈনিক পাঁচবার আপনাকে কি বলে ডাকা হয়? বলা হয়ঃ
(আরবী***)-‘আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ সকলের বড়।’
(আরবী***)-‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ভিন্ন আর কোন মা’বুদ নেই। বন্দেগীর যোগ্য আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই।’
(আরবী***)-‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর প্রেরিত রাসূল।’
(আরবী***)-‘নামাযের জন্য আস’
(আরবী***)-‘যে কাজে কল্যান ও মঙ্গল সেই কাজের দিকে আস।’
(আরবী***)-‘আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ সবচেয়ে বড়।’
(আরবী***)-‘আল্লাহ ভিন্ন কোনো মা’বুদ নেই।’
ভেবে দেখুন, এটা কতবড় শক্তিশালী ডাক। এ ডাক প্রত্যেক দিন পাঁচবার আপনাদেরকে একথায়ই স্মরণ করিয়ে দেয়, “পৃথিবীতে যতবড় খোদায়ীর দাবিদার দেখা যাচ্ছে, তারা সকলেই মিথ্যাবাদী, আকাশ ও পৃথিবীতে মাত্র একজনই খোদায়ী ও প্রভূত্বের অধিকারী এবং কেবল তিনি ইবাদাতের যোগ্য। আসুন আমরা সকলে মিলে তাঁরই ইবাদাত করি। ইবাদাতেই আমাদের সকলের জন্য ইহকালের ও পরকালের প্রকৃত কল্যাণ নিহিত।”
এই মর্মস্পর্শী আওয়াজ শুনে কে স্তব্দ হয়ে বসে থাকতে পারে? যার অন্তরে বিন্দুমাত্র ঈমান আছে, এতবড় নির্ভীক সাক্ষ্য এবং এত স্পষ্ট আহবান শুনে স্তব্দ হয়ে বসে থাকা তার পক্ষে কোনো মতেই সম্ভব নয় এবং প্রকৃত প্রভূ-মালিকের দরবারে হাজির হয়ে তার সামনে মাথা নত না করেও সে কিছুতেই থাকতে পারে না।
এ ডাক শুনেই আপনি উঠে পড়েন এবং সর্বপ্রথমেই আপনি চিন্তা করে দেখেন, আমি কি পবিত্র, না অপবিত্র? আমার জামা-কাপড় পাক কিনা? আমার অযু আছে কি নেই? অন্য কথায় আপনার সুস্পষ্ট অনুভূতি থাকে যে, উভয় জাহানের বাদশাহের দরবারে হাজিরা দেয়ার বিষয়টি পৃথিবীর অন্যান্য সকল বিষয় হতে সম্পূর্ণরূপে স্বতন্ত্র। অন্যান্য কাজ তো সকল অবস্থাতেই করা যায়, কিন্তু এ মহান দরবারে শুধু দেহ ও কাপড়-চোপড়ের পবিত্রতাই যথষ্ট নয় অতিরিক্ত (বিশেষ) পবিত্রতাও (অর্থাৎ অযু) একান্ত অপরিহার্য। এরূপ পবিত্রতা ছাড়া এখানে হাজিরা দেয়া ভীষণ বেয়াদবী। এ অনুভূতির সাথেই আপনি প্রথমে পবিত্র হওয়ার কথা চিন্তা করেন এবং তারপরে অযু করা আরম্ভ করেন। এ অযুর সময়ে যদি আপনি প্রতিটি অংগ-প্রত্যংগ ধোয়ার সময় এবং অযু শেষ করার পর হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিখানো দোআসমূহ পাঠ করেন এবং আল্লাহকে যথাযথরূপে স্মরণ করেন, তাহলে শুধু যে আপনার অংগ-প্রত্যংগই ধোয়া হবে তা নয়, বরং আপনার অন্তরকেও ধৌত (পবিত্র) করা হবে। অযু শেষ করার পর নিম্ন দো’আ পড়তে হবেঃ
(আরবী***)
“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এক ও অদ্বিতীয় লা-শরীক আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই এবং আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দাহ এবং রাসূল। হে আল্লাহ, তুমি আমাকে তাওবাকারীদের অন্তুর্ভূক্ত কর এবং আমাকে পবিত্রতা অবলম্বনকারী বানাও।”
এরপর আপনি নামাযের জন্য দাঁড়ান। আপনার মুখ থাকে পবিত্র কেবলার দিকে। আপনি পাক-পবিত্র হয়ে সমগ্র জাহানের বাদশাহের দরবারে হাজির হন।
সর্বপ্রথমেই আপনার মুখ থেকে বের হয়ঃ (আরবী***) ‘আল্লাহ সবচেয়ে বড়।’
মনে ও মুখে এ বিরাট অঙ্গীকার উচ্চারণ করে আপনি দুনিয়া এবং দুনিয়ার যাবতীয় জিনিস হতে নিজের সম্পর্কচ্ছেদ করার প্রতীক হিসেবে কান পর্যন্ত দু’হাত তোলেন এবং আপনার বাদশার সামনে হাত বেঁধে দণ্ডায়মান হন। এরপরে নিরতিশয় বিনয় সহকারে আপনি আরয করেনঃ
(আরবী***)
“হে আল্লাহ! আমি তোমারই পবিত্রতা বর্ণনা করছি, তোমার প্রশংসা সহকারে তোমার নামের বরকত ও মাহাত্ন্য সত্যই অতুলনীয়। তুমি সর্বশ্রেষ্ট, তোমার সম্মন সকলের উচ্চে। তুমি ছাড়া কেউ মা’বুদ নেই।”
(আরবী***)
“অভিশপ্ত মরদুদ শয়তানের কবল হতে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই।”
(আরবী***)
“মেহেরবান-দয়াময় আল্লাহর নামে শুরু করছি।”
(আরবী***)
-“সারাজাহানের পালনকর্তা মহান আল্লাহর জন্যই সমগ্র ও সর্বপ্রকার তারীফ-প্রশংসা।”
-তিনি অত্যন্ত দয়াময় ও মেহেরবান।
-তিনি বিচার দিনের একমাত্র মালিক। যেদিন মানুষের যাবতীয় কর্মের বিচার করা হবে এবং প্রত্যেককে তার কর্মের ফল ভোগ করতে হবে।
-হে মালিক! আমরা কেবল তোমারই ইবাদাত করি এবং কেবল তোমারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি।
-আমাদেরকে সহজ, সোজা, সঠিক পথ দেখাও।
-তাদের পথ, যারা তোমার অনুগ্রহ ও পুরস্কার প্রাপ্ত।
-আর যারা অভিশপ্ত ও ভ্রান্ত পথে পরিচালিত নয়।
-হে আল্লাহ! আমাদের দোআ কবুল কর, মনোবাঞ্চা পূর্ণ কর।
এরপর কুরআন শরীফের কয়েকটি আয়াত পড়তে হয়। কুরআনের প্রত্যেকটি আয়াতই অমৃতে পরিপূর্ণ। তাতে অমূল্য উপদেশ, শিক্ষা এবং সত্য পথের দিকে আহবান রয়েছে। সূরা ফাতেহায় যে সহজ ও সোজা পথের জন্য দোআ করা হয়, তাতে সেই সোজা পথেরই হেদায়াত ও বিবরণ দেয়া হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ এখানে কয়েকটি সূরার উল্লেখ করা হচ্ছেঃ
(আরবী***)
“কালের শপথ! সমগ্র মানূষ ধবংসের মুখে। কেবল তারা ছাড়া যারা ঈমানদার এবং (ঈমানের দাবি অনুযায়ী) সৎকর্মশীল এবং যারা পরস্পর পরস্পরকে সত্য পথে চলতে উপদেশ ও পরামর্শ দেয় এবং সত্য পথে দৃঢ় ও মযবুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে (কেবল তারাই ধ্বংসের পথ হতে রক্ষা পেতে পারে)।”
এ ছোট সূরাটি হতে আমরা এ শিক্ষা পাই যে, ধ্বংস ও ব্যর্থতা হতে মানুষ কেবল একটি মাত্র উপায়ে বাঁচতে পারে। তা এই যে, একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা এবং আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী আমল করাই যথেষ্ঠ নয়, বরং সাথে সাথে ঈমানদার ও সৎকর্মশীল লোকদের এমন একটা সুসংগঠিত দলও থাকা আবশ্যক, যে দল পরস্পরকে এবং দুনিয়ার সমগ্র মানুষকে সত্যের পথে- ন্যায়ের দিকে আহবান জানাবে এবং সর্বপ্রকার দুঃখ-বিপদে আল্লাহর দ্বীন ইসলামের ওপর সুদৃঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য ও সহযোগিতা করবে।
কিংবা অন্য কোনো সূরা যেমনঃ
(আরবী***)
“হিসাব-নিকাশের দিন-কেয়ামতের প্রতি অবিশ্বাসী ব্যক্তি কি রকম হয়, তা তুমি দেখেছ কি? এ ধরনের মানুষই এতিমকে বিতাড়িত করে এবং গরীব মিসকীনকে নিজেরা তো আহার দান করেই না- এমনকি অন্য লোকদেরকেও এ কাজে উৎসাহিত করার জন্য এতটুকু কষ্ট স্বীকার করে না। এমন সব নামাযী জন্য ধ্বংস (পরকালের প্রতি অবিশ্বাস করার কারনে) যারা নামাযে গাফিলতি করে, এরা নামায পড়লেও তা কেবল লোক দেখানোর জন্যই পড়ে এবং তাদের মন এত সংকীর্ণ যে, অতি সামান্য ও ছোট-খাটো জিনিসও অভাবীদেরকে দিতে কুন্ঠিত হয়।”
এ সূরাটির মূল শিক্ষা এই যে, পরকালের প্রতি বিশ্বাসস্থাপন করা ইসলামের প্রাণ স্বরূপ। (এটা না থাকলে ইসলামের কাজই প্রাণহীন দেহের মতই অর্থহীন)। এছাড়া কোনো মানুষই আল্লাহর দেখানো সহজ সরল পথে চলতে পারে না। আর একটি সূরাঃ
(আরবী***)
“অন্যের দোষ অন্বেষণ করা এবং পরকে হীন প্রতিপন্ন করে অপমানসূচক কথা বলা-ই যাদের অভ্যাস তাদের সকলের জন্য আফসোস। তারা কেবল টাকা-পয়সা জমা করে এবং (তা কি রকম বাড়ছে) বার বার গুনে দেখে। তাদের ধারণা এই যে, তাদের ধন-সম্পত্তি তাদের কাছে চিরদিন থাকবে। তা কখনই নয়। একদিন তারা নিশ্চয় মরবে এবং হুতামা নামক জাহানামে নিক্ষিপ্ত হবে। তুমি কি জান হুতামা কি? তা আল্লাহর জ্বালানো অগ্নিকুণ্ড; তার লেলিহান শিখা কলিজা পর্যন্ত ভষ্ম করে। তা বড় এবং সুউচ্চ স্তম্ভের ন্যায় অগ্নি শিখা যা তাদেরকে ঘিরে ফেলবে।”
এভাবে নামাযে কুরআন শরীফের যেসব সূরা এবং আয়াত পাঠ করা হয় তাদের মধ্যে কোনো না কোনো মূল্যবান শিক্ষা এবং উপদেশ থাকে। তা মানবকে স্পষ্ট ভাষায় বলে দেয় যে, মানূষের প্রতি আল্লাহর এ হুকুম অনুসারে দুনিয়াতে কাজ করতে হবে। এসব হেদায়াত ও উপদেশের আয়াত পড়ে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে রুকূ’তে যান। হাঁটুর ওপর হাত রেখে দুনিয়া জাহানের আল্লাহ তাআলার সামনে মাথা নত করে বারবার বলতে থাকেনঃ
(আরবী***) “অতি পবিত্র আমার মহান পালনকর্তা পরওয়ারদেগার।” তারপর সোজা হয়ে দাঁড়ান এবং বলেনঃ (আরবী***) “যে ব্যাক্তি আল্লাহর প্রশংসা ও গুনগান করলো, তার কথা আল্লাহ্ শুনতে পেয়েছেন।” এরপর ‘আল্লাহু আকবার’ বলে মাটির সাথে মাথা মিশিয়ে সেজদা করেন এবং বলেনঃ (আরবী***) “আমি মহান ও সর্বশ্রেষ্ঠ আলাহর পবিত্রতা বর্ণনা করছি।”
তা পড়ে মাথা উঠান এবং আদবের সাথে বসে পাঠ করেনঃ
(আরবী***)
-“আমাদের সব সালাম-শ্রদ্ধা, আমাদের সব নামায এবং সকল প্রকার পবিত্রতা একমাত্র আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যে।”
-হে নবী! আপনার প্রতি সালাম, আপনার ওপর আল্লাহর রহমত এবং অনুগ্রহ বর্ষিত হোক।
-আমাদের ও আল্লাহর নেক বান্দাদের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক।
-আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ প্রভূ ও মা’বুদ নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্ তাআলার বান্দাহ এবং রাসূল।”
এভাবে আপনি যখন সাক্ষ্য দেন তখন আপনাকে শাহাদাত আঙ্গুল ওঠাতে হয়। কেননা এ আঙ্গুলি সংকেত দ্বারা নামাযের মধ্যেই আপনার আকীদা ও বিশ্বাসের কথা ঘোষণা করা হয় এবং এ সাক্ষ্যের কথাটি মুখে বলার সময় বিশেষভাবে মনোযোগ স্থাপন করতে এবং মন-মগযের ওপর বিশেষ জোর দিতে হয়। এরপর আপনাকে নিম্নের দরূদ পাঠ করতে হয়ঃ
(আরবী***)
“হে আল্লাহ! দয়া ও রহমত কর আমাদের সরদার ও নেতা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি এবং তাঁর বংশধরদের প্রতি, যেমন তুমি রহমত করেছো হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও তার বংশধরদের ওপর। নিশ্চয়ই তুমি অতি উত্তম গুনের আধার এবং মহান। হে আল্লাহ! বরকত নাযিল কর আমাদের সরদার ও নেতা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহিস সালাম এবং তার বংশধরদের ওপর, যেমন তুমি হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এবং তার বংশধরদের ওপরে করেছো। নিশ্চয়ই তুমি অতীব সৎগুন বিশিষ্ট ও মহান।”
দরূদ পড়ার পরে আল্লাহর কাছে এভাবে দোআ করেনঃ
(আরবী***)
“হে আল্লাহ! আমি জাহান্নামের আযাব হতে বাঁচার জন্য তোমার কাছে আশ্রয় চাই। কবরের আযাব থেকে তোমার কাছে পানাহ চাই। সেই পথভ্রষ্টকারী দাজ্জালের অনিষ্ট থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই, যে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। তোমার কাছে আশ্রয় চাই জীবন ও মৃত্যুর অনিষ্ঠ থেকে । হে আল্লাহ! অন্যায় কাজ এবং ঋণ থেকেও তোমার কাছে আশ্রয় চাই।”
এ দোআ পাঠ করার পর নামায পূর্ণ হয়ে যায়। রাব্বুল আলামীনের দরবার থেকে বিদায় নিয়ে সর্বপ্রথম ডান ও বাম দিকে ফিরে উপস্থিত সকলের এবং দুনিয়ার প্রত্যেকটি জিনিসের জন্য রহমত ও শান্তি প্রার্থনা করে বলেনঃ (আরবী***) “আপনাদের প্রতি আল্লাহর শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক।” এটা যেন একটি শুভ সংবাদ; নামাযের পর আল্লাহর দরবার থেকে এটা নিয়েই আপনি ফিরে এসেছেন। এভাবেই নামায আদায় করেন অতি ভোরে উঠে দুনিয়ার সব কাজ-কর্ম শুরু করার পূর্বেই। তারপর অনেক ঘণ্টা যাবত দুনিয়ার নানা কাজে লিপ্ত থাকেন। দ্বিপ্রহরের একটু পরেই আবার আল্লাহর দরবারে হাজির হয়ে নামায আদায় করেন-তার কয়েক ঘণ্টা পরেই বেলা তৃতীয় প্রহরেও আবার এ নামায আদায় করেন। আবার কয়েক ঘণ্টা কাজ-কর্ম করার পর সূর্যাস্ত হলেই আল্লাহর দরবারে হাজির হয়ে এ নামায আদায় করেন। তারপর দুনিয়ার কাজ-কর্ম শেষ হয়ে গেলে ঘুমাবার পূর্বে শেষবারের মত আল্লাহর সামনে হাজির হন। এ শেষ নামাযের শেষ তিন রাকআতের নাম ‘বেতেরের নামায।’ এর তৃতীয় রাকআতে আল্লাহর কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিজ্ঞা করেন। এ প্রতিজ্ঞার নাম ‘দোআয়ে কুনুত।’ এ দোআর মরফতে নামাযী আল্লাহর সামনে অত্যন্ত বিনয়ী ও নম্রতার সাথে তাঁর আনুগত্য ও দাসত্বের শপথ গ্রহন করে। তাঁর অনুগত হয়ে চলার ওয়াদা করে। এ প্রতিজ্ঞায় আপনি কি বলেন মনোযোগ সহকারে শুনুনঃ
(আরবী****)
“হে আল্লাহ! আমরা তোমার কাছে সাহায্য চাই। তোমার কাছে গোনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি। তোমার প্রতি আমরা ঈমান এনেছি। আমরা কেবলমাত্র তোমার ওপরেই ভরসা করি। সর্বপ্রকার কল্যাণ ও মঙ্গলের সাথে তোমার প্রশংসা করি। আমরা তোমার শোকর আদায় করি, তোমার দানকে অস্বীকার করি না। আমরা তোমার কাছে ওয়াদা করছি যে, তোমার অবাধ্য লোকদের সাথে আমরা কোনো সম্পর্ক রাখবো না-তাদেরকে পরিত্যাগ করবো। হে আল্লাহ! আমরা তোমারই দাসত্ব স্বীকার করি। কেবলমাত্র তোমার জন্যই নামায পড়ি, কেবল তোমাকেই সিজদা করি এবং আমাদের সকল প্রকার চেষ্টা-সাধনা ও সকল কষ্ট স্বীকার কেবল তোমার সন্তুষ্টীর জন্যই। কষ্ট আমরা কেবল তোমারই রহমত লাভের আশায় করি, তোমার আযাবকে আমরা ভয় করি। নিশ্চয়ই তোমার আযাবে কেবল কাফেরগণই নিক্ষিপ্ত হবে।”
একটু ভেবে দেখুন, যে ব্যক্তি দৈনিক পাঁচবার আযানের ধ্বনি শুনে এবং চিন্তা করে দেখে যে, কত বড় কথা সেই আযানেই ঘোষণা করা হচ্ছে এবং তা দ্বারা কত বড় মহান বাদশাহর কাছে হাজির হবার জন্য আহবান হানানো হচ্ছে। প্রতিবার আযান শুনে যে ব্যক্তি তা মনে মনে অনুভব করে নিজের সকল কাজ-কর্ম ছেড়ে সারাজাহানের মালিক ও প্রভুর দরবারে হাজির হয়, প্রতি নামাযের পূর্বে অযূ করে নিজের দেহ ও মনকে পবিত্র করে নেয় এবং বারবার নামাযে উল্লেখিত রূপে সূরা ও দোয়া মনোযোগ সহকারে পাঠ করে প্রকৃতপক্ষে তার হৃদয়-মনে আল্লাহর ভয় না জেগে পারে না। আল্লাহর হুকুম অমান্য করতে তার লজ্জা না হয়ে পারে না। পাপ ও অন্যায় কাজের কালো চিহ্ন নিয়ে আল্লাহর দরবারে বারবার হাজির হতে তার অন্তরাত্না নিশ্চয় কেঁপে ওঠবে। নামাযে আল্লাহর দাসত্ব এবং তাঁর আনুগত্য করে চলার কথা বলা এবং আল্লাহকে বিচার দিনের মালিক বলে বারবার স্বীকার করার পর কোন মানুষ বাহির দুনিয়ায় নিজের কাজ-কর্মের মধ্যে ফিরে এসে মিথ্যা কথা বলা, বেঈমানী করা, পরের হক আত্নসাৎ করা, ঘুষ খাওয়া ও দেয়া , সুদ খাওয়া ও দেয়া, অন্য মানুষকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেয়া, নির্লজ্জতা, ব্যাভিচার ও অন্যায় প্রভৃতি কাজ কিছুই করতে পারে না কিংবা এগুলো করার পর পুনরায় আল্লাহর সামনে হাজির হয়ে এসব কথা মুখে স্বীকার করার দুঃসাহস করতে পারে না। আপনি জেনে বুঝে দৈনিক অসংখ্যবার আল্লাহর সামনে স্বীকার করেন, “হে আল্লাহ! আমি কেবল তোমার দাসত্ব করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি।” এটা স্বীকার করে আপনার পক্ষে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো দাসত্ব করা এবং অন্য কারো কাছে প্রার্থনা করা কেমন করে সম্ভব হতে পারে? একবার এসব স্বীকার করে তার বিরোধিতা করলে পুনরায় আল্লাহর সামনে হাজির হতে আপনার মন আপনাকে তিরস্কার করবে, লজ্জায় আপনার মাথা নত হয়ে পড়বে। আবার বিরোধীতা করলে আরো বেশী লজ্জা হবে এবং বিবেক আপনাকে আরো বেশী দংশন করবে। সমস্ত জীবন ভরে দৈনিক পাঁচবার নামায পড়া সত্ত্বেও আপনার কাজ-কর্ম ও চরিত্র ঠিক না হওয়া এবং আপনার জীবনের আমূল পরিবর্তন সূচিত না হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। এজন্যই আল্লাহ তাআলা নামাযের এ সুফল দান প্রসংগে বলেছেনঃ
(আরবী***)
“নিশ্চয়ই নামায মানুষকে লজ্জাহীনতা, অশ্লীলতা ও সর্বপ্রকার পাপকার্য হতে বিরত রাখে।”
কিন্তু মানুষের মন ও চরিত্র সংশোধন করার এতবড় উপায় থাকা সত্ত্বেও এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া সত্ত্বেও যদি কারো চরিত্র ঠিক না হয়, যদি কেউ পাপ পথ থেকে বিরত না থাকে তবে বুঝতে হবে যে, আসলে তারই স্বভাব খারাপ। সে জন্য নামাযের কোনো ত্রুটি নেই। পানি ও সাবান কাপড়ের ময়লা পরিস্কার করে বটে; কিন্তু তাতে কয়লার ময়লা দূর না হলে সে জন্য পানি ও সাবানের কোনো দোষ দেয়া যায় না-দোষ কয়লারই হবে।
কিন্তু বড়ই দুঃখের বিষয়, আমরা নামাযে যা কিছু পড়ি তা মোটেই বুঝি না বা বুঝেও পড়ি না। আমাদের নামাযে এটা একটি অতি বড় অভাব। এটা শেখার জন্য কিছু সময় ব্যয় করলেই অভাব পূরন হতে পারে-নিজেদের মাতৃভাষায় নামাযের দোআ ও সূরাগুলোর অর্থ ও ভাব অনায়াসেই আপনারা শিখতে পারেন। আমি মনে করি, এতে আপনাদের বড়ই উপকার হবে।
নামায মানুষকে আল্লাহর ইবাদাত, দাসত্ব ও আনুগ্যত স্বীকার করে চলার জন্য কিভাবে প্রস্তুত করে, তা পূর্বে বিস্তারিতরূপে আলোচনা করছি। এ প্রসঙ্গে যা কিছু লেখা হয়েছে তা পাঠ করে আপনি পরিস্কারভাবে বুঝতে পেরেছেন যে একজন মানুষ যদি আল্লাহর হুকুম এবং ফরয মনে করে রীতিমতো নামায আদায় করে, তবে সে নামাযে দোআ ও সুরাগুলের কোন অর্থ বুঝতে না পারলেও এ নামাজ তার মনে আল্লাহর ভয়ে, আল্লাহর হাজের-নাযের হওয়ার কথা এবং আদালতে একদিন উপস্থিত হওয়ার বিশ্বাস নিসন্দেহে সবসময়ই জাগরুক রাখবে। সবসময় সে মনে করবে যে, সে আল্লাহ ভিন্ন অন্য কোন দাস নয়- আল্লাহই তার প্রকৃত বাদশাহ এবং প্রভু। এরই ফলে তার মধ্যে কর্তব্য পালনের অভ্যাস হবে এবং সকল অবস্থায়ই সে আল্লাহর বিধান পালন করবে চলার জন্য প্রসতুত থাকবে। মানুষের সমগ্র জীবনকে আল্লাহর বন্দেগীর অধীনে যাপন করতে এবং গোটা জীবনকে এবাদাতে পরিনত করতে হলে যে সব গুন -সিফাত অবশ্য প্রয়োজনীয় তাও এ নামাযের সাহায্যে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়। নামায দ্বারা এ উপকার কিরূপে লাভ করা যায় তাতে আপনার পৃর্বের প্রবন্ধে ভালভাবে বুঝতে পেরেছেন আশা করি।
এখন বুঝে দেখতে হবে যে, নামাযের দোআ ও সূরাগুলোর অর্থ না বুঝে নামায পড়লে যদি এতবড় উপকার লাভ করা যায়, তাহলে কেউ যদি নামায ভালোভাবে বুঝে-শুনে পড়ে, সে যা পড়ছে তা যদি সে হৃদয়-মন দিয়ে বুঝতে ও অনুভব করতে পারে তবে তার বিশ্বাস, মতবাদ, চিন্তাধারা এবং অভ্যাস ও স্বভাবের কি বিরাট পরিবর্তন সাধিত হতে পারে এবং তার গোটা জীবন কিরূপ আদর্শে গঠিত হতে পারে, এখানে আমি এ বিষয়ই পুংখানুপুংখরূপে আলোচনার চেষ্টা করবো।
সর্বপ্রথম আযান সম্পর্কে ভেবে দেখুন। দৈনিক পাঁচবার আপনাকে কি বলে ডাকা হয়? বলা হয়ঃ
(আরবী***)-‘আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ সকলের বড়।’
(আরবী***)-‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ভিন্ন আর কোন মা’বুদ নেই। বন্দেগীর যোগ্য আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই।’
(আরবী***)-‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর প্রেরিত রাসূল।’
(আরবী***)-‘নামাযের জন্য আস’
(আরবী***)-‘যে কাজে কল্যান ও মঙ্গল সেই কাজের দিকে আস।’
(আরবী***)-‘আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ সবচেয়ে বড়।’
(আরবী***)-‘আল্লাহ ভিন্ন কোনো মা’বুদ নেই।’
ভেবে দেখুন, এটা কতবড় শক্তিশালী ডাক। এ ডাক প্রত্যেক দিন পাঁচবার আপনাদেরকে একথায়ই স্মরণ করিয়ে দেয়, “পৃথিবীতে যতবড় খোদায়ীর দাবিদার দেখা যাচ্ছে, তারা সকলেই মিথ্যাবাদী, আকাশ ও পৃথিবীতে মাত্র একজনই খোদায়ী ও প্রভূত্বের অধিকারী এবং কেবল তিনি ইবাদাতের যোগ্য। আসুন আমরা সকলে মিলে তাঁরই ইবাদাত করি। ইবাদাতেই আমাদের সকলের জন্য ইহকালের ও পরকালের প্রকৃত কল্যাণ নিহিত।”
এই মর্মস্পর্শী আওয়াজ শুনে কে স্তব্দ হয়ে বসে থাকতে পারে? যার অন্তরে বিন্দুমাত্র ঈমান আছে, এতবড় নির্ভীক সাক্ষ্য এবং এত স্পষ্ট আহবান শুনে স্তব্দ হয়ে বসে থাকা তার পক্ষে কোনো মতেই সম্ভব নয় এবং প্রকৃত প্রভূ-মালিকের দরবারে হাজির হয়ে তার সামনে মাথা নত না করেও সে কিছুতেই থাকতে পারে না।
এ ডাক শুনেই আপনি উঠে পড়েন এবং সর্বপ্রথমেই আপনি চিন্তা করে দেখেন, আমি কি পবিত্র, না অপবিত্র? আমার জামা-কাপড় পাক কিনা? আমার অযু আছে কি নেই? অন্য কথায় আপনার সুস্পষ্ট অনুভূতি থাকে যে, উভয় জাহানের বাদশাহের দরবারে হাজিরা দেয়ার বিষয়টি পৃথিবীর অন্যান্য সকল বিষয় হতে সম্পূর্ণরূপে স্বতন্ত্র। অন্যান্য কাজ তো সকল অবস্থাতেই করা যায়, কিন্তু এ মহান দরবারে শুধু দেহ ও কাপড়-চোপড়ের পবিত্রতাই যথষ্ট নয় অতিরিক্ত (বিশেষ) পবিত্রতাও (অর্থাৎ অযু) একান্ত অপরিহার্য। এরূপ পবিত্রতা ছাড়া এখানে হাজিরা দেয়া ভীষণ বেয়াদবী। এ অনুভূতির সাথেই আপনি প্রথমে পবিত্র হওয়ার কথা চিন্তা করেন এবং তারপরে অযু করা আরম্ভ করেন। এ অযুর সময়ে যদি আপনি প্রতিটি অংগ-প্রত্যংগ ধোয়ার সময় এবং অযু শেষ করার পর হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিখানো দোআসমূহ পাঠ করেন এবং আল্লাহকে যথাযথরূপে স্মরণ করেন, তাহলে শুধু যে আপনার অংগ-প্রত্যংগই ধোয়া হবে তা নয়, বরং আপনার অন্তরকেও ধৌত (পবিত্র) করা হবে। অযু শেষ করার পর নিম্ন দো’আ পড়তে হবেঃ
(আরবী***)
“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এক ও অদ্বিতীয় লা-শরীক আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই এবং আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দাহ এবং রাসূল। হে আল্লাহ, তুমি আমাকে তাওবাকারীদের অন্তুর্ভূক্ত কর এবং আমাকে পবিত্রতা অবলম্বনকারী বানাও।”
এরপর আপনি নামাযের জন্য দাঁড়ান। আপনার মুখ থাকে পবিত্র কেবলার দিকে। আপনি পাক-পবিত্র হয়ে সমগ্র জাহানের বাদশাহের দরবারে হাজির হন।
সর্বপ্রথমেই আপনার মুখ থেকে বের হয়ঃ (আরবী***) ‘আল্লাহ সবচেয়ে বড়।’
মনে ও মুখে এ বিরাট অঙ্গীকার উচ্চারণ করে আপনি দুনিয়া এবং দুনিয়ার যাবতীয় জিনিস হতে নিজের সম্পর্কচ্ছেদ করার প্রতীক হিসেবে কান পর্যন্ত দু’হাত তোলেন এবং আপনার বাদশার সামনে হাত বেঁধে দণ্ডায়মান হন। এরপরে নিরতিশয় বিনয় সহকারে আপনি আরয করেনঃ
(আরবী***)
“হে আল্লাহ! আমি তোমারই পবিত্রতা বর্ণনা করছি, তোমার প্রশংসা সহকারে তোমার নামের বরকত ও মাহাত্ন্য সত্যই অতুলনীয়। তুমি সর্বশ্রেষ্ট, তোমার সম্মন সকলের উচ্চে। তুমি ছাড়া কেউ মা’বুদ নেই।”
(আরবী***)
“অভিশপ্ত মরদুদ শয়তানের কবল হতে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই।”
(আরবী***)
“মেহেরবান-দয়াময় আল্লাহর নামে শুরু করছি।”
(আরবী***)
-“সারাজাহানের পালনকর্তা মহান আল্লাহর জন্যই সমগ্র ও সর্বপ্রকার তারীফ-প্রশংসা।”
-তিনি অত্যন্ত দয়াময় ও মেহেরবান।
-তিনি বিচার দিনের একমাত্র মালিক। যেদিন মানুষের যাবতীয় কর্মের বিচার করা হবে এবং প্রত্যেককে তার কর্মের ফল ভোগ করতে হবে।
-হে মালিক! আমরা কেবল তোমারই ইবাদাত করি এবং কেবল তোমারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি।
-আমাদেরকে সহজ, সোজা, সঠিক পথ দেখাও।
-তাদের পথ, যারা তোমার অনুগ্রহ ও পুরস্কার প্রাপ্ত।
-আর যারা অভিশপ্ত ও ভ্রান্ত পথে পরিচালিত নয়।
-হে আল্লাহ! আমাদের দোআ কবুল কর, মনোবাঞ্চা পূর্ণ কর।
এরপর কুরআন শরীফের কয়েকটি আয়াত পড়তে হয়। কুরআনের প্রত্যেকটি আয়াতই অমৃতে পরিপূর্ণ। তাতে অমূল্য উপদেশ, শিক্ষা এবং সত্য পথের দিকে আহবান রয়েছে। সূরা ফাতেহায় যে সহজ ও সোজা পথের জন্য দোআ করা হয়, তাতে সেই সোজা পথেরই হেদায়াত ও বিবরণ দেয়া হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ এখানে কয়েকটি সূরার উল্লেখ করা হচ্ছেঃ
(আরবী***)
“কালের শপথ! সমগ্র মানূষ ধবংসের মুখে। কেবল তারা ছাড়া যারা ঈমানদার এবং (ঈমানের দাবি অনুযায়ী) সৎকর্মশীল এবং যারা পরস্পর পরস্পরকে সত্য পথে চলতে উপদেশ ও পরামর্শ দেয় এবং সত্য পথে দৃঢ় ও মযবুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে (কেবল তারাই ধ্বংসের পথ হতে রক্ষা পেতে পারে)।”
এ ছোট সূরাটি হতে আমরা এ শিক্ষা পাই যে, ধ্বংস ও ব্যর্থতা হতে মানুষ কেবল একটি মাত্র উপায়ে বাঁচতে পারে। তা এই যে, একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা এবং আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী আমল করাই যথেষ্ঠ নয়, বরং সাথে সাথে ঈমানদার ও সৎকর্মশীল লোকদের এমন একটা সুসংগঠিত দলও থাকা আবশ্যক, যে দল পরস্পরকে এবং দুনিয়ার সমগ্র মানুষকে সত্যের পথে- ন্যায়ের দিকে আহবান জানাবে এবং সর্বপ্রকার দুঃখ-বিপদে আল্লাহর দ্বীন ইসলামের ওপর সুদৃঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য ও সহযোগিতা করবে।
কিংবা অন্য কোনো সূরা যেমনঃ
(আরবী***)
“হিসাব-নিকাশের দিন-কেয়ামতের প্রতি অবিশ্বাসী ব্যক্তি কি রকম হয়, তা তুমি দেখেছ কি? এ ধরনের মানুষই এতিমকে বিতাড়িত করে এবং গরীব মিসকীনকে নিজেরা তো আহার দান করেই না- এমনকি অন্য লোকদেরকেও এ কাজে উৎসাহিত করার জন্য এতটুকু কষ্ট স্বীকার করে না। এমন সব নামাযী জন্য ধ্বংস (পরকালের প্রতি অবিশ্বাস করার কারনে) যারা নামাযে গাফিলতি করে, এরা নামায পড়লেও তা কেবল লোক দেখানোর জন্যই পড়ে এবং তাদের মন এত সংকীর্ণ যে, অতি সামান্য ও ছোট-খাটো জিনিসও অভাবীদেরকে দিতে কুন্ঠিত হয়।”
এ সূরাটির মূল শিক্ষা এই যে, পরকালের প্রতি বিশ্বাসস্থাপন করা ইসলামের প্রাণ স্বরূপ। (এটা না থাকলে ইসলামের কাজই প্রাণহীন দেহের মতই অর্থহীন)। এছাড়া কোনো মানুষই আল্লাহর দেখানো সহজ সরল পথে চলতে পারে না। আর একটি সূরাঃ
(আরবী***)
“অন্যের দোষ অন্বেষণ করা এবং পরকে হীন প্রতিপন্ন করে অপমানসূচক কথা বলা-ই যাদের অভ্যাস তাদের সকলের জন্য আফসোস। তারা কেবল টাকা-পয়সা জমা করে এবং (তা কি রকম বাড়ছে) বার বার গুনে দেখে। তাদের ধারণা এই যে, তাদের ধন-সম্পত্তি তাদের কাছে চিরদিন থাকবে। তা কখনই নয়। একদিন তারা নিশ্চয় মরবে এবং হুতামা নামক জাহানামে নিক্ষিপ্ত হবে। তুমি কি জান হুতামা কি? তা আল্লাহর জ্বালানো অগ্নিকুণ্ড; তার লেলিহান শিখা কলিজা পর্যন্ত ভষ্ম করে। তা বড় এবং সুউচ্চ স্তম্ভের ন্যায় অগ্নি শিখা যা তাদেরকে ঘিরে ফেলবে।”
এভাবে নামাযে কুরআন শরীফের যেসব সূরা এবং আয়াত পাঠ করা হয় তাদের মধ্যে কোনো না কোনো মূল্যবান শিক্ষা এবং উপদেশ থাকে। তা মানবকে স্পষ্ট ভাষায় বলে দেয় যে, মানূষের প্রতি আল্লাহর এ হুকুম অনুসারে দুনিয়াতে কাজ করতে হবে। এসব হেদায়াত ও উপদেশের আয়াত পড়ে ‘আল্লাহু আকবার’ বলে রুকূ’তে যান। হাঁটুর ওপর হাত রেখে দুনিয়া জাহানের আল্লাহ তাআলার সামনে মাথা নত করে বারবার বলতে থাকেনঃ
(আরবী***) “অতি পবিত্র আমার মহান পালনকর্তা পরওয়ারদেগার।” তারপর সোজা হয়ে দাঁড়ান এবং বলেনঃ (আরবী***) “যে ব্যাক্তি আল্লাহর প্রশংসা ও গুনগান করলো, তার কথা আল্লাহ্ শুনতে পেয়েছেন।” এরপর ‘আল্লাহু আকবার’ বলে মাটির সাথে মাথা মিশিয়ে সেজদা করেন এবং বলেনঃ (আরবী***) “আমি মহান ও সর্বশ্রেষ্ঠ আলাহর পবিত্রতা বর্ণনা করছি।”
তা পড়ে মাথা উঠান এবং আদবের সাথে বসে পাঠ করেনঃ
(আরবী***)
-“আমাদের সব সালাম-শ্রদ্ধা, আমাদের সব নামায এবং সকল প্রকার পবিত্রতা একমাত্র আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যে।”
-হে নবী! আপনার প্রতি সালাম, আপনার ওপর আল্লাহর রহমত এবং অনুগ্রহ বর্ষিত হোক।
-আমাদের ও আল্লাহর নেক বান্দাদের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক।
-আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ প্রভূ ও মা’বুদ নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্ তাআলার বান্দাহ এবং রাসূল।”
এভাবে আপনি যখন সাক্ষ্য দেন তখন আপনাকে শাহাদাত আঙ্গুল ওঠাতে হয়। কেননা এ আঙ্গুলি সংকেত দ্বারা নামাযের মধ্যেই আপনার আকীদা ও বিশ্বাসের কথা ঘোষণা করা হয় এবং এ সাক্ষ্যের কথাটি মুখে বলার সময় বিশেষভাবে মনোযোগ স্থাপন করতে এবং মন-মগযের ওপর বিশেষ জোর দিতে হয়। এরপর আপনাকে নিম্নের দরূদ পাঠ করতে হয়ঃ
(আরবী***)
“হে আল্লাহ! দয়া ও রহমত কর আমাদের সরদার ও নেতা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি এবং তাঁর বংশধরদের প্রতি, যেমন তুমি রহমত করেছো হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ও তার বংশধরদের ওপর। নিশ্চয়ই তুমি অতি উত্তম গুনের আধার এবং মহান। হে আল্লাহ! বরকত নাযিল কর আমাদের সরদার ও নেতা হযরত মুহাম্মাদ সাল্লালাহু আলাইহিস সালাম এবং তার বংশধরদের ওপর, যেমন তুমি হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এবং তার বংশধরদের ওপরে করেছো। নিশ্চয়ই তুমি অতীব সৎগুন বিশিষ্ট ও মহান।”
দরূদ পড়ার পরে আল্লাহর কাছে এভাবে দোআ করেনঃ
(আরবী***)
“হে আল্লাহ! আমি জাহান্নামের আযাব হতে বাঁচার জন্য তোমার কাছে আশ্রয় চাই। কবরের আযাব থেকে তোমার কাছে পানাহ চাই। সেই পথভ্রষ্টকারী দাজ্জালের অনিষ্ট থেকে তোমার কাছে আশ্রয় চাই, যে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। তোমার কাছে আশ্রয় চাই জীবন ও মৃত্যুর অনিষ্ঠ থেকে । হে আল্লাহ! অন্যায় কাজ এবং ঋণ থেকেও তোমার কাছে আশ্রয় চাই।”
এ দোআ পাঠ করার পর নামায পূর্ণ হয়ে যায়। রাব্বুল আলামীনের দরবার থেকে বিদায় নিয়ে সর্বপ্রথম ডান ও বাম দিকে ফিরে উপস্থিত সকলের এবং দুনিয়ার প্রত্যেকটি জিনিসের জন্য রহমত ও শান্তি প্রার্থনা করে বলেনঃ (আরবী***) “আপনাদের প্রতি আল্লাহর শান্তি ও রহমত বর্ষিত হোক।” এটা যেন একটি শুভ সংবাদ; নামাযের পর আল্লাহর দরবার থেকে এটা নিয়েই আপনি ফিরে এসেছেন। এভাবেই নামায আদায় করেন অতি ভোরে উঠে দুনিয়ার সব কাজ-কর্ম শুরু করার পূর্বেই। তারপর অনেক ঘণ্টা যাবত দুনিয়ার নানা কাজে লিপ্ত থাকেন। দ্বিপ্রহরের একটু পরেই আবার আল্লাহর দরবারে হাজির হয়ে নামায আদায় করেন-তার কয়েক ঘণ্টা পরেই বেলা তৃতীয় প্রহরেও আবার এ নামায আদায় করেন। আবার কয়েক ঘণ্টা কাজ-কর্ম করার পর সূর্যাস্ত হলেই আল্লাহর দরবারে হাজির হয়ে এ নামায আদায় করেন। তারপর দুনিয়ার কাজ-কর্ম শেষ হয়ে গেলে ঘুমাবার পূর্বে শেষবারের মত আল্লাহর সামনে হাজির হন। এ শেষ নামাযের শেষ তিন রাকআতের নাম ‘বেতেরের নামায।’ এর তৃতীয় রাকআতে আল্লাহর কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিজ্ঞা করেন। এ প্রতিজ্ঞার নাম ‘দোআয়ে কুনুত।’ এ দোআর মরফতে নামাযী আল্লাহর সামনে অত্যন্ত বিনয়ী ও নম্রতার সাথে তাঁর আনুগত্য ও দাসত্বের শপথ গ্রহন করে। তাঁর অনুগত হয়ে চলার ওয়াদা করে। এ প্রতিজ্ঞায় আপনি কি বলেন মনোযোগ সহকারে শুনুনঃ
(আরবী****)
“হে আল্লাহ! আমরা তোমার কাছে সাহায্য চাই। তোমার কাছে গোনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি। তোমার প্রতি আমরা ঈমান এনেছি। আমরা কেবলমাত্র তোমার ওপরেই ভরসা করি। সর্বপ্রকার কল্যাণ ও মঙ্গলের সাথে তোমার প্রশংসা করি। আমরা তোমার শোকর আদায় করি, তোমার দানকে অস্বীকার করি না। আমরা তোমার কাছে ওয়াদা করছি যে, তোমার অবাধ্য লোকদের সাথে আমরা কোনো সম্পর্ক রাখবো না-তাদেরকে পরিত্যাগ করবো। হে আল্লাহ! আমরা তোমারই দাসত্ব স্বীকার করি। কেবলমাত্র তোমার জন্যই নামায পড়ি, কেবল তোমাকেই সিজদা করি এবং আমাদের সকল প্রকার চেষ্টা-সাধনা ও সকল কষ্ট স্বীকার কেবল তোমার সন্তুষ্টীর জন্যই। কষ্ট আমরা কেবল তোমারই রহমত লাভের আশায় করি, তোমার আযাবকে আমরা ভয় করি। নিশ্চয়ই তোমার আযাবে কেবল কাফেরগণই নিক্ষিপ্ত হবে।”
একটু ভেবে দেখুন, যে ব্যক্তি দৈনিক পাঁচবার আযানের ধ্বনি শুনে এবং চিন্তা করে দেখে যে, কত বড় কথা সেই আযানেই ঘোষণা করা হচ্ছে এবং তা দ্বারা কত বড় মহান বাদশাহর কাছে হাজির হবার জন্য আহবান হানানো হচ্ছে। প্রতিবার আযান শুনে যে ব্যক্তি তা মনে মনে অনুভব করে নিজের সকল কাজ-কর্ম ছেড়ে সারাজাহানের মালিক ও প্রভুর দরবারে হাজির হয়, প্রতি নামাযের পূর্বে অযূ করে নিজের দেহ ও মনকে পবিত্র করে নেয় এবং বারবার নামাযে উল্লেখিত রূপে সূরা ও দোয়া মনোযোগ সহকারে পাঠ করে প্রকৃতপক্ষে তার হৃদয়-মনে আল্লাহর ভয় না জেগে পারে না। আল্লাহর হুকুম অমান্য করতে তার লজ্জা না হয়ে পারে না। পাপ ও অন্যায় কাজের কালো চিহ্ন নিয়ে আল্লাহর দরবারে বারবার হাজির হতে তার অন্তরাত্না নিশ্চয় কেঁপে ওঠবে। নামাযে আল্লাহর দাসত্ব এবং তাঁর আনুগত্য করে চলার কথা বলা এবং আল্লাহকে বিচার দিনের মালিক বলে বারবার স্বীকার করার পর কোন মানুষ বাহির দুনিয়ায় নিজের কাজ-কর্মের মধ্যে ফিরে এসে মিথ্যা কথা বলা, বেঈমানী করা, পরের হক আত্নসাৎ করা, ঘুষ খাওয়া ও দেয়া , সুদ খাওয়া ও দেয়া, অন্য মানুষকে অন্যায়ভাবে কষ্ট দেয়া, নির্লজ্জতা, ব্যাভিচার ও অন্যায় প্রভৃতি কাজ কিছুই করতে পারে না কিংবা এগুলো করার পর পুনরায় আল্লাহর সামনে হাজির হয়ে এসব কথা মুখে স্বীকার করার দুঃসাহস করতে পারে না। আপনি জেনে বুঝে দৈনিক অসংখ্যবার আল্লাহর সামনে স্বীকার করেন, “হে আল্লাহ! আমি কেবল তোমার দাসত্ব করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি।” এটা স্বীকার করে আপনার পক্ষে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো দাসত্ব করা এবং অন্য কারো কাছে প্রার্থনা করা কেমন করে সম্ভব হতে পারে? একবার এসব স্বীকার করে তার বিরোধিতা করলে পুনরায় আল্লাহর সামনে হাজির হতে আপনার মন আপনাকে তিরস্কার করবে, লজ্জায় আপনার মাথা নত হয়ে পড়বে। আবার বিরোধীতা করলে আরো বেশী লজ্জা হবে এবং বিবেক আপনাকে আরো বেশী দংশন করবে। সমস্ত জীবন ভরে দৈনিক পাঁচবার নামায পড়া সত্ত্বেও আপনার কাজ-কর্ম ও চরিত্র ঠিক না হওয়া এবং আপনার জীবনের আমূল পরিবর্তন সূচিত না হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। এজন্যই আল্লাহ তাআলা নামাযের এ সুফল দান প্রসংগে বলেছেনঃ
(আরবী***)
“নিশ্চয়ই নামায মানুষকে লজ্জাহীনতা, অশ্লীলতা ও সর্বপ্রকার পাপকার্য হতে বিরত রাখে।”
কিন্তু মানুষের মন ও চরিত্র সংশোধন করার এতবড় উপায় থাকা সত্ত্বেও এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়া সত্ত্বেও যদি কারো চরিত্র ঠিক না হয়, যদি কেউ পাপ পথ থেকে বিরত না থাকে তবে বুঝতে হবে যে, আসলে তারই স্বভাব খারাপ। সে জন্য নামাযের কোনো ত্রুটি নেই। পানি ও সাবান কাপড়ের ময়লা পরিস্কার করে বটে; কিন্তু তাতে কয়লার ময়লা দূর না হলে সে জন্য পানি ও সাবানের কোনো দোষ দেয়া যায় না-দোষ কয়লারই হবে।
কিন্তু বড়ই দুঃখের বিষয়, আমরা নামাযে যা কিছু পড়ি তা মোটেই বুঝি না বা বুঝেও পড়ি না। আমাদের নামাযে এটা একটি অতি বড় অভাব। এটা শেখার জন্য কিছু সময় ব্যয় করলেই অভাব পূরন হতে পারে-নিজেদের মাতৃভাষায় নামাযের দোআ ও সূরাগুলোর অর্থ ও ভাব অনায়াসেই আপনারা শিখতে পারেন। আমি মনে করি, এতে আপনাদের বড়ই উপকার হবে।
জামায়াতের সাথে নামায
আগের প্রবন্ধগুলোতে আমি শুধু নামাযের বৈশিষ্ট্য এবং উপকারিতার কথাই বলেছি। তা দ্বারা আপনারা নিশ্চই বুঝতে পেরেছেন যে, এটা কত বড় গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। এ নাময মনুষের মধ্যে জীবন ব্যাপী বন্দেগীর ভাবধারা কেমন করে জন্মায় এবং কেমন করে তাকে এ বন্দেগীর হক আদায়ের যোগ্য করে তোলে – সে কথাও অপনারা বুঝতে পেরেছেন। এক্ষণে আমি জামায়াতের সাথে নামায আদায়ের উপকারিতার কথা আপনাদেরকে বলবো। তা দ্বারা আপনারা খুব ভাল করে বুঝতে পারবেন যে, আল্লাহ দয়া ও অনুগ্রহ করে এ একই জিনিসের মধ্যে সবরকমের নিয়ামত কিভাব জমা করে রেখেছেন। শুধু নামাযই আমাদেও পক্ষে কম ছিল না; কিন্তু সেই সাথে জামায়াতের সাথে নামায আদায়ের আদেশ কররে আল্লাহ পাক এটাকে দ্বিগুণ উপকারিতার ভান্ডার করে দিয়েছেন এবং তাতে এক অপূর্ব শক্তি দান করেছেন, যা মনুষের মধ্যে আমূল পরিবর্তন সৃষ্টি করতে অতুলনীয়।
পূর্বেই বলেছি, জীবনের সর্বক্ষণ নিজেকে আল্লাহর বান্দাহ বলে মনে করা, অনুগত গোলামের ন্যায় মালিকের অধীন হয়ে থাকা এবং মালিকের হুকুম পালনের জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকার নামই হচ্ছে ইবাদাত, আর নামায মানুষকে এ ইবাদাতের জন্যই প্রস্তুত করে। এরূপ ইবাদাতের জন্য মানুষের মধ্যে যতগুলো গুণের দরকার, নামায তার সবই মনুষের মধ্যে সৃষ্টি করে। দাস হওয়ার অনুভূতি, আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং তাঁর কিতাবের প্রতি ঈমান, পরকালের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস, আল্লাহভীতি, আল্লাহকে ‘আলেমুল গায়েব’ বলে স্বীকার করা, তাকে সবসময়ই নিজের কাছে অনুভব করা, আল্লাহর হুকুম পালনের জন্য সর্বদা নিজেকে প্রস্তুত রাখা, আল্লাহর গুকুমগুলো ভাল করে জানা — নামায এ ধরনের বহু গুণই মনুষের মধ্যে সৃষ্টি করে এব তাকে আল্লাহ তালার খাঁটি বান্দাহরূপে গড়ে তোলে।
একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন যে, মানুষ নিজে যতই গুণসম্পন্ন হোক না কেন, অন্যান্য মানুষ যতক্ষণ তাঁর সহযোগী ও সাহায্যকারী না হবে ততক্ষণ সে আল্লাহর বন্দেগীর ‘হক’ পূর্ণরূপে আদায় করতে পারবে না। মানুষ যাদের সাথে দিন-রাত জীবনযাপন করে সবসময় যাদের সাথে একত্রে কাজ করে, আল্লাহর ফরমাবরদারী করার ব্যাপারেও তারা যদি সহযেগীতা না করে, হবে সে কিছুতেই আল্লাহর হুকুম পালনে সমর্থ হয় না।
মানুষ দুনিয়ায় একাকী আসেনি। একাকী থেকে সে কিছু করতেও পারে না। সে পাড়া-প্রতিবেশী ও সহকমীর্ এবং জীবন পথেও সঙ্গী-সাথীদেও সাথে নানাভাবে জড়িত। আল্লাহর হুকুম আহকামও কোন নিসঙ্গ একটি মানুষের জন্য নয়, বরং সকল মানুষের জন্য — জীবনের সকল প্রকার সম্পর্ক সম্বন্ধ সঠিকভাবে বজায় রাখার জন্যই তা আল্লাহর তরফ থেকে এসেছে। এখন আল্লাহর হুকুম পালন করার ব্যাপারে যদি সবাই পরস্পরকে সাহায্য করে, সহযোগগিতা করে, তবেই তারা এক সাথে আল্লাহর হুকুম পালনকারী হতে পারে। পক্ষন্তরে সকলে মিলে যদি আল্লাহ নাফরমানী শুরু করে কিংবা তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক যদি এমন হয় যে, আল্লাহর আদেশ পালনে পরস্পর সহযোগিতার না না করে, তবে একজন লোকের পক্ষে সঠিকভাবে নিয়মিত আল্লাহর হুকুম পালন করা এবং আল্লাহর বিধান অনুসারে কাজ করা একেবারেই অসম্ভব।
আপনারা যদি বিশেষ লক্ষ্যের সাথে কুরআন পাঠ করেন, তাহলে জানতে পারবেন যে, আল্লাহর তায়ালা কেবল আপনাকে আল্লাহর অধীন ও অনুগত হতে এবং আল্লাহর হুকুম পালন করে চলতে বলেন নি। বরং সেই সাথে আপনাক এ আদেশও দেওয়া হয়েছে, আপনি সমগ্র দুনিয়াকে আল্লাহর অধীনের অনুগত করে দিবেন, দুনিয়াতে আল্লাহর আইন জারী করবেন। দুনিয়ার যেখানে যেখানে ‘শয়তানের’ আইন চলছে, তা বন্ধ করবেন এবং সে স্থানে এক ও লা-শরীক আল্লাহ তাআলার আইনের হুকুমাত কায়েম করবেন। আপনার প্রতি আল্লাহ এতে যে, বিরাট খেদমতের আদেশ দিয়েছেন একজন লোকের পক্ষে এ কাজ সমাধা করা কিছুতেই সম্ভব হতে পারে না। এ মতে বিশ্বাসী কোটি কোটি মুসলমানও যদি হয়ে আর তার বিভিন্ন ও বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকে — তাদের মধ্যে কোন যোগাযোগ বা সম্পর্ক না থাকে তবে তারাও ‘শয়তানের’ সুশৃংখলিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত শক্তিকে কিছুতেই পরাজিত করতে পারবে না। এজন্যই মুসলমানদেও দলবব্ধ হওয়া ও পরস্পরকে সহায্য করা, একে অন্যেও পৃষ্ঠ-পোষক ও সমর্থক হয়ে দাড়ান এবং সকলে একই উদ্দেশ্যে হাসিল করার জন্য সম্মিলতভাবে সংগ্রাম-সাধনা করা অপরিহার্য।
একটু গভীরভাবে দেখলে একথাও পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এতবড় বিরাট উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মুসলমানদের কেবল মিলিত ও একতাবদ্ধ হওয়াই যথেষ্ট নয়। তাদের মিলিত হতে হবে ঠিক পন্থা অনুসারে অর্থাত্ এমনভাবে মুসলমানদের একটি জামায়াত গঠন করতে হবে, যেন তাদের পরস্পরের সাথে সঠিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় — তাদের পরস্পরের সম্পর্কেও মধ্যে যেন কোনরূপ দোষ-ত্রুটি না থাকে। তাদের মত, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কর্মনীতির পূর্ণ ঐক্য বর্তমান থাকা চাই। তাদের একজন অমির ও নেতা হওয়া দরকার, তাদের মধ্যে সেই নেতার ইশারা অনুসারে কাজ করার আভ্যাস ও স্পৃহা থাকা চই। তাদের কে নেতার হুকুম পালন করতে হবে আর তা কত দূরইবা করতে হবে এবং কোন্ কারণে ঘটলে নেতার বিরধিতাও করা যেতে পারে — তাও তাদের ভাল করে বুঝে নেয়া আবশ্যক। এ গুলো মনে রখুন এৰং জামায়াতর সাথে নামায পড়লে এসব গুরুত্বপূর্ণ ভাবধারা নামাযীদেও মধ্যে কেমন করে জেগে উঠে তা চিন্তা করে দেখুন।
আযান শোনা মাত্রই সবকাজ-কর্ম ছেড়ে মসজিদের দিকে যাওয়ার হুকুম দেয়া হয়েছে। কাজেই আযানের সাথে সাথেই মুসলমানদেও নিজ নিজ কাজ ত্যাগ করা এবং একই কেন্দ্রেও (সমজিদ) দিকে সকলের অগ্রসর হওয়া একটি বিরাট সৈন্যবহিনীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সৈন্য শিবিরে ‘বিউগলের’ আওয়ায হওয়ার সাথে সাথেই প্রত্যেকটি সৈনিক বুঝতে পারে যে, সেনাপতি সকলকে ডাকছেন। এ সময় সকলের মনে একই ভাব উদয় হয়। সেই ভাব হচ্ছে সেনাপতির নির্দেশ পালনের কর্তব্য ও দায়িত্ব। একথা মনে হওয়ার সাথে সাথে সকলে একই কাজ করে, অর্থাৎ যে যে খানে আছে সেখানে হতে সে আওয়ায শোনা মাত্র নির্দিষ্ট স্থানের দিকে দৌঁড়াতে থাকে। সৈন্যদেও জন্য এ অনন্য পন্থা কেন গ্রহণ করা হয়ছে।? প্রথম এজন্য যে যেন আলাদাভাবে প্রত্যেকটি সৈনিকের মধ্যে হুকুম পালন করার এবং হুকুম পলনের জন্য সবসময়ই প্রস্তুত থাকার অভ্যাস হবে। দ্বিতীয়ত, সেই সাথে এ ধরনের সকল অনুগত সিপাহীদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী দল গঠিত হবে এবং সেনাপতির আদেশে একই সময় একই স্থানে সমবেত হওয়ার অভ্যাস হবে। এ অভ্যাসটি এজন্য দরকার যে, হঠাত্ কোন ঘটনা যদি দেখা দেয় তখন যেন সকল সিপাহী এই আওয়াযে একইস্থানে হাজির হয়ে কাজ করতে পারে। প্রত্যেক সৈনিক ব্যক্তিগতভাবে যদি খুব বড় বাহাদুর হয়, কিন্তু কাজের সময় ডাকলে অবিলম্বে উপস্থিত হয়ে যদি লড়াই করতে না পারে, তাহলে তাদেরর বাহাদুরিগিরি কোন মূল্য থাকে ন। ডাক দেয়া মাত্র সৈন্যগন যদি একত্র না হয়ে বরং নিজ নিজ ইচ্ছামত একেক দিকে চলে যায়, তবে এ ধরনের হাজার বীর সৈনিকককে শত্রপক্ষের পঞ্চাশটি সৈনিকের এশটি শৃংখলাবদ্ধ দল নাস্তানাবুদ করে দিতে পারে।
ঠিক এ নিয়মেই আযান শুনা মাত্রই কাজ-কর্ম ছেড়ে নিকটস্থ মসজিদে হাজির হবার জন্য মুসলমানকে আদেশ করা হয়েছে যেন সব মুসলমান মিলে আল্লাহর একটি সৈন্যদলে পরিনত হতে পারে। এভাবে দৈনিক পাঁচবার আযান শুনামাত্র হাজির হওয়ার অভ্যাস করানো হয় এজন্য যে, দনিয়ার সকল প্রকার সৈনিকের তুলনায় এ খোদায়ী সেনাদেও কর্তব্য অনেক বেশী, অনেক কঠোর। অন্যান্য ফৌজের পক্ষে বহুকাল পরেও হয়ত যুদ্ধ করার প্রয়োজন পড়েনি এবং কবে কোন্ সময় যুদ্ধ বাধবে সে জন্য বহু পূর্বে থেকেই এত সব ট্রেনিং দেয় হয়। কিন্তু এ খোদায়ী ফৌজকে প্রত্যেক মুহূর্তেই শয়তানী শক্তির সাথে লড়াই করতে হয় এবং প্রত্যেকটি মুহূর্তেই সেনাপতির আদেশ পালনের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। এজন্য মুসলমানদের দিন-রাতের মধ্য পাঁচবার খোদায়ী ‘বিউগল’ —- আযানের আওয়াযে আল্লাহর শিবির মসজিদের দিকে ছুটতে হয়, বলতে হবে, দায়িত্ব ও কর্তব্যেও তুলনায় তাদের প্রতি এটাকে অনেক অনুগ্রহ করা হয়েছে সন্দেহ নেই।
এ যাবত শুধু আযানের সৌন্দর্যের কথাই আলোচনা করা হয়েছে। আযান শুনে সকল মুসলমান মসজিদে হাজির হয় কেবল সে জামায়েতের মধ্যেই অনেক সৌন্দর্য-সার্থকতা নিহিত ওয়েছে। এখানে মিলিত হয় মসলমানগণ পরস্পরকে দেখতে পান, চিনতে ও পরিচয় লাভ করতে পারেন।
কিন্তু আপনারা পরস্পরের সাথে এই যে মিলিত ও পরিচিত হন, তা কোন্ সূত্রে? এ সূত্রে যে, আপনারা এক আল্লাহর বান্দাহ, এক রাসূলের অনুসরণকারী, এক কুরআন শরীফই আপনাদের সকলেরই কিতাব—- জীবন বিধান এবং আপনাদের সকলেরই জীবনের উদ্দেশ্য এক। সেই একই উদ্দেশ্য লাভ করার জন্য আপনারা মসজিদে একত্রিত হয়েছেন এবং এখানে থেকে ফিরে যাওয়ার পর ও অপনারা প্রত্যোকেই সে একই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য চেষ্টা করবেন; বস্তুত এ ধরনের পরিচয় এবং এরূপ সাহচর্য স্বাভাবিক ভাবে আপনদের মনে এ খেয়াল জাগিয়ে দেয় যে, আপনার সকলেই একটি জাতির অন্তুভূক্ত, একই ফৌজের সিপাহী আপনারা। আপনাদের একে অপরের ভাই। দুনিয়ায় আপনাদের জীবেনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক, আপনাদের লাভ-লোকসানে সকলেই আপনারা শরীক ও অপনাদের পরস্পরের জীবন একে অপরের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত।
আপনারা যখন পরস্পরের দিকে তাকাবেন তখন ঠিক চোখ-মন অন্তর খুলে উদার দৃষ্টিতে তাকাবেন। শত্রু যে দৃষ্টিতে দেখে থাকে অপনারা কারো প্রতি সেভাবে তাকান না বরং বন্ধু যেরূপ বন্ধুর দিকে তাকায়, ভাই যে চোখে ভাইয়ের দিকে তাকায়, ঠি্ক সেই দৃষ্টিতেই একজন অপরজেনের প্রতি তাকিয়ে থাকেন। এভাবে তাকাবার ফলে আপনি যখন কোন ভাইকে পুরাতন ও ছেড়া কাপড় পরিহিত দেখতে পাবেন, কাউকে বিশেষ চিন্তিত বিপদগ্রস্ত বা ক্ষুধার্ত দেখবেন, কাইকে দেখবেন অক্ষম-পংগু, পক্ষাঘাতগ্রস্ত ও অন্ধ তখন অপনার অন্তরে আপনা আপনিই সহানভুতি ও দয়ার উদ্রেক হবে। অপনারা ধনী লোকেরা গরীব ও অসহায় দুঃস্থদের দুঃখ অনুভব করবেন, ফকীর-মিসকিন লোকেরা ধনীদের কাছে পৌঁছে নিজেদের দুরবস্থার কথা বলার সহস পবে। কারো সম্পর্কে যদি আপনি জানতে পারেন, যে সে অসুস্থ কিংবা বিপদগ্রস্ত বলে মসিজিদে আসতে পারেন নি তখন তাকে দেখতে যাবার জন্যু্য অপানার মনে অগ্রহ হবে। কারো মৃত্যুর্ সংবাদ পেলে জানাযা পড়তে যেতে পারেন এবং তার শোকসন্তপ্তপরিবারবর্গের পৃতি সমবেদনা প্রকাশ করতে পারেন। বস্তুত এ কাজই আপনাদের পরস্পরের মধ্যে গভীর ভালবাসা ও সহানুভুতি সৃস্টি করবে।
আর একটু ভেবে দেখুন — অপনারা যেখানে একত্র হন তা একটি পাক পবিত্র স্থান। এ পাক স্থানে মহান উদ্দেশ্য নিয়ৈ অপনারা একত্রিত হয়ে থাকেন। চোর-ডাকত, শরাবী আর জুয়াড়ী দলও একস্থানে একত্র হয় বটে; কিন্তু তাদের সকলের মন অসত্ ইচ্ছায় পরিপুর্ণ থাকে। কিন্তু অপনাদের সমবেত হওয়াকে এদর সাথে তুলনা করা যায় না। কারণ এখনে আল্লাহর খাঁটি বান্দাগণই একতি হয়ে থাকেন — আল্লাহর ইবাদাদতের জন্য আপনাদের এ সম্মেলন আল্লাহর ঘরে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। আল্লাহর সামনে বন্দেগী ও দাসত্বের খালেছ মনে স্বীকার করার জন্যি এখনে সকলে সবমসেত হন। এমতাতাবস্থায় ইমানদার লোকদের মনে অপানা আপনি নিজ নিজ গুনাহের জন্য লজ্জার অনুভূতি জেগে উঠে। অন্য দিকে যদি কোন মানুষ অন্য কারো সামনে কোন গুনাহের কাজ করে থাকে, আর সেই ব্যক্তি যদি মসজিদে হাজির হয়, তাহলে কেবল এতেই গুনাহগার ব্যক্তি লজ্জায় মরে যায়। উপরন্তু মুসলমানদের মনে পরস্পরকে উপদেশ দেয়ার ভাবও যদি বর্তমান থাকে এবং সে যদি দরদ ভালবাসা ও সহানুভুতির সাথে একজনের দোষত্রুটি কেমন করে দূর করা যায়, তা ভাল করে জেনে নেয়, তবে তাদের এ সম্মেলনের প্রতি আল্লাহর অশেষ রহমত ও বরকত নাযিল হবে— তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এভাবে জামায়াতে নামায পড়ার সুযোগে এক মুসলমান অন্য মুসলমানের দোষ-ত্রুটি সংশোধন করতে পারবেন— একজন অন্যজনের অভাব পূরণ করবেন। ফলে ধীরে ধীরে গোটা সমাজই সৎ ও নেককার হতে পারবে।
মসজিদে কেবল মিলিত হওয়ার মধ্যেই এ বিরাট বরকত রয়েছে। এরপর জামায়াতের সাথে নামায পড়ার উপকারিতা ও বরকত যে কত অসীম তাও ভেবে দেখুন। নামাযীগণ সকলে একই সারিতে সমানভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন। তাদের কেউ বড় নয়, কেউ ছোট নয়, কেউ উচ্চ নয়, কেউ নীচু নয়- আল্লাহর দরবারে, আল্লাহর সামনে সকল মানুষ একেবার সমান। কারো হাত লাগলে বা কারো স্পর্শ লাগলে তাদের কেউ নাপাক হয়ে যায় না। এখানে অস্পৃশ্যতার কোনো অবকাশ নেই। তাদের সকলেই পাক এবং পবিত্র; কারণ এরা সকলেই মানুষ, সকলেই এক আল্লাহর বান্দাহ: একই দ্বীন ইসলামের অনুগামী। এ নামাযীদের মধ্যে বংশ, পরিবার, গোত্র, দেশ আর ভাষায় আদৌ কোনো পার্থক্য নেই। ব্যক্তিগতভাবে এদের কেউ সাইয়েদ, কেউ পাঠান, কেউ খাঁ সাবেহ, কেউ হাওলাদার আর কেউ চৌধুরী সাহেবও হতে পারেন। আবার এদের একজন হয়ত এক দেশের অধিবাসী আর একজন অন্য দেশের অধিবাসী। কেউ এক ভাষায় কথা বলে, কেউ অন্য ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহর ইবাদাত করে। এর অর্থ এই যে, তারা সকলেই এক জাতির লোক। এখানে বংশ-গোত্র, দেশ-অঞ্চল ও জাতীয়তার প্রভেদ পার্থক্য একেবারে মিথ্যে। মানুষের পরস্পরের মধ্যে সবচেয়ে বড় সম্পর্ক হচ্ছে আল্লাহর বন্দেগী, আল্লাহর ইবাদাত। এ ব্যাপারে আপনারা সকলেই যখন এক তখন অন্যান্য ব্যাপারেও আপনাদের ভিন্ন ভিন্ন ও বিচ্ছিন্ন কোনোই কারণ থাকতে পারে না।
আপনারা যখন সারি বেঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ান, তখন মনে হয় যেন একটি বিরাট সৈন্যবাহিনী বাদশাহের সামনে কর্তব্য পালনের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। কাতার বেঁধে দাঁড়ানোর এবং একত্রে মিলে ওঠাবসা করায় নামাযীদের মনে পরম ঐক্যভাবের সৃষ্টি হয়। এভাবে নামাযের ভিতর দিয়ে সকলকে আল্লাহর বন্দেগী করার অভ্যাস করানো হয়-তাদের সকলের হাত একত্রে ওঠবে, সকলের পা এক সাথে চলবে। তাতে পরিস্কার মনে হবে যে, নামাযীরা বিশজন বিশজন কিংবা একশজন নয়-তারা একত্রে মিলে একটি অখন্ড মানুষে পরিণত হয়েছে।
জামায়াত ও কাতারবন্দী হওয়ার পরে কি করা হয়? সকল নামাযী একই ভাষায় আল্লাহর সামনে একই আরয জানায়: اِيَّاكَ وَاِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُহে আল্লাহ আমরা কেবল তোমারই ইবাদাত করি এবং কেবল তোমারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি। اِهْدِنَا الصِّرَاظَ الْمُسْتَقِيْمَ হে আল্লাহ আমাদেরকে সহজ সঠিক পথ দেখাও। رَبِّنَا لَكَ الْحَمْدُ হে আল্লাহ! সব তারীফ প্রশংসা কেবল তোমারই জন্য। اَلسَّلاََمُ عَلَيْنَا وَعَلى عِبَادِ اللهِ الصَّالِحِيْنَ ـ আমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক এবং আল্লাহর নেক বান্দাদের ওপরও। তারপরে নামায শেষ করে একে অপরকে এ বলে সালাম করে اَلسَّلاَمُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ ـ এর অর্থ এই যে, নামাযীদের প্রত্যেকেই পরষ্পর কল্যাণকামী এবং সকলে মিলে একই মালিকের কাছে সকলের মঙ্গল দাবী করেছে। কোনো নামাযী একাকী নয়, তাদের কেউই কেবলমাত্রই নিজের জন্য কল্যাণ কামনা করে না। বরং সকলের মুখে এ দোআ যে, হে আল্লাহ! আমাদের সকলেরই প্রতি তোমার অনুগ্রহ ও কল্যাণ বর্ষিত হোক, সকলকে একই সহজ ও সোজা পথে চলার তৌফিক দাও, সকলের ওপরেই শান্তি বর্ষিত হোক। নামায এভাবে সকল নামাযীর দিলকে পরস্পরের সাথে মিলিয়ে দেয়, সকলের মনে একই খেয়াল ও একই চিন্তাধারা জাগরিত করে, তাদের পরস্পরের মধ্যে গভীর ভালবাসা, ঐক্য ও মংগলাকাংখার সৃষ্টি হয়।
কিন্তু মনে রাখবেন, জামায়াতের সাথে ইমাম ছাড়া পড়া যায় না। দু’জন মিলে পড়লেও তাদের মধ্যে একজনকে ইমাম ও অপরজনকে মোকতাদী হতে হয়। জামায়াত শুরু হলে তা থেকে আলাদা হয়ে একাকী নামায পড়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। বরং হুকুম রয়েছে যে, জামায়াত আরম্ভ হওয়ার পর যেই আসবে, তাকে সেই ইমামের পিছেনেই (একতেদা করে) দাঁড়াতে হবে। এসব কাজ কেবল নামাযের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, আসলে এটা দ্বারা একটি বড় শিক্ষা এই দেয়া হচ্ছে যে, মুসলমান হিসেবে জীবন যাপন করতে হলে এভাবে জামায়তবন্দী হয়ে থাকতে হবে। আর আপনাদের মধ্যে একজন যদি ইমাম না হয় তাহলে আপনাদের সেই জামায়াত গঠনই হতে পারে না। জামায়াত গঠন হওয়ার পরেও তা থেকে আলাদা হয়ে থাকলে আপনাদের জীবন মোটেই ইসলামী জীবন নয়। মুসলিম জীবনরে সাথে এর আদৌ সম্পর্ক নেই।
এখানেই শেষ নয়। জামায়াতের সাথে নামায পড়ার মাধ্যমে ইমাম ও মোকতাদীদের মধ্যে একটা বিরাট মযবুত সম্পর্ক সৃষ্টি হয়-যার সাহায্যে প্রত্যেকটি মুসলমানই জানতে পারে যে, এ ছোট্ট মসজিদের বাইরে পৃথিবী নামক বিরাট মসজিদে ইমামের মর্যাদা কি? তার কর্তব্য কি? তাঁর কি কি হক আছে? সেই বড় মসজিদেরে ইমামের অনুসরণ আপনাকে কিভাবে করতে হবে, সে ভুল করলে আপনি কি করবেন? তার ভুলকে আপনি কতক্ষণ বরদাশত করবেন? কখন আপনি তার ভুল ধরতে পারবেন? আর তা শোধরাবার দাবী করতে পারবেন? আর কোন অবস্থায় ইমামকে পদচ্যুত করতে পারবেন? এ সমস্ত কথা
ছোটখাটোভাবে প্রত্যেক মুসলিমকে মসজিদের মধ্যে জামায়াতের সাথে নামায পড়ার ভিতর দিয়ে শিক্ষা দেয়া হয়। এক কথায় মসজিদে একটি ছোটখাট রাজ্য চালাবার নিয়ম-কানুন দৈনিক পাঁচবার শিক্ষা দেয়া হয় এবং তার অভ্যাস করানো হয়।
একথাগুলো বিস্তারিতভাবে বলার অবকাশ এখানে নেই। সংক্ষেপে কয়েকটি প্রয়োজনীয় কথা বলে রাখছি।
শরীয়াতের আদেশ এই যে, সমাজের লোকদের মধ্যে যে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশী পরহেযগার হবে, ইলম যার বেশী হবে কুরআন শরীফ যে সকলের অপেক্ষা ভাল করে পড়তে ও বুঝতে পারবে এবং সেই সাথে যার উপযুক্ত বয়স হয়েছে, ঠিক তাকেই নামাযের ইমাম বানাতে হবে। কর্মক্ষেত্রে যারা জাতির নেতা হবে তাদের মধ্যে কি কি গুণ থাকা অবশ্য দরকার-উক্ত ব্যবস্থা দ্বারা পরিস্কারভাবে তারই শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
শরীয়াত ব্যবস্থা করা হয়েছে যে, নামাযের ইমাম এমন ব্যক্তিকে বানাতে হবে, যে সকল নামাযীর অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখে নামায পড়বে। কারণ নামাযদের মধ্যে অনেক রুগ্ন, বৃদ্ধ, অসুস্থ আর দুর্বল লোকও থাকতে পারে। এমতবস্থায় কেবল যুবক, শক্তিমান আর অবসর বিশিষ্ট মানুষদের প্রতি লক্ষ্য রেখে নামাযে লম্বা লম্বা কেরাত পড়লে এবং লম্বা লম্বা রুকূ সেজদা করতে থাকলে অন্যের পক্ষে অনেক কষ্ট ও অসুবিধা হতে পারে। তাই ইমামের মনে রাখতে হবে যে, নামাযীদের মধ্যে অনেক বৃদ্ধ আছে, রুগ্ন ও দুর্বল ব্যক্তি আছে, রুগ্ন ও দুর্বল ব্যক্তি আছে এবং এমন অনেক লোক যারা তাড়াতাড়ি নামায পড়ে নিজ নিজ কাজে ফিরে যেতে চায়। হযরত নবী করীম (সা) এ ব্যাপারে অনেক সহানুভূতি দেখিয়েছেন। নামায পড়াবার সময় কোন শিশুর কান্নার আওয়ায শুনতে পেলেও তিনি নামায অনেক সংক্ষেপ করতেন। কারণ শিশুর মাতা (কিংবা পিতা) এ জামায়াতে শরীক থাকলে তার মনে কষ্ট হতে পারে-তাই নামাযের ব্যাঘ্যত হতে পারে। এ নিয়ম দ্বারা জাতির নেতৃবৃন্দকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে, তখন প্রত্যেক কাজেই জাতির সকল প্রকার লোকের প্রতি তার লক্ষ্য থাকা বাঞ্চনীয়। শরীয়াতের ব্যবস্থা এই যে, নামায পড়াবার সময় ইমামের যদি এমন কোনো অবস্থা হয়, যাতে সে আর নামায পড়াতে পারছে না, তাহলে অবিলম্বে তার সরে গিয়ে অন্য এক ব্যক্তিকে ইমাম পড়াতে পারছে না, তাহলে অবিলম্বে তার সরে গিয়ে অন্য এক ব্যক্তিকে ইমাম করে দেয়া আবশ্যক। এ থেকে এ নির্দেশ পাওয়া যায় যে, জাতির নেতা যখন নিজ পার্থক্য পালনে অক্ষম হবে, তখন সে নিজেই পদত্যাগ করে অন্য কোনো উপযুক্ত লোককে সেখানে নিযুক্ত করার ব্যবস্থা করবে। এটা করা তার পক্ষে ফরয। এ কাজে তার কোনো লজ্জা হওয়া উচিত হয়, এতে স্বার্থপরতাও নেই।
শরীয়াতের আদেশ এই যে, ইমাম যা করবে মোকতাদীগণও তার অনুসরণ করতে বাধ্য থাকবে। ইমামের কোনো কাজ করার আগে মোকতাদীর তা করা একেবারে নিষিদ্ধ। এমনকি হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইমামের আগে কেউ রুকূ বা সিজদা করলে কিয়ামতের দিন তাকে গাধা বানিয়ে ওঠানো হবে। নেতাকে অনুসরণ করে চলা অবশ্য কর্তব্য এখানে মুসলিম জাতেকে তাই শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
নামাযের মধ্যে ইমাম কোনো ভুল করলে অর্থাৎ যখন দাঁড়ান দরকার তখন বসলে, কিংবা যখন বসা দরকার তখন দাঁড়ালে সুবহানাল্লাহ বলে তার ভুল ধরে দেয়া মোকতাদীগণকে পক্ষে অবশ্য কর্তব্য। সুবহানাল্লাহ অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তাআলা পাক ও মহান। ইমামের ভুল ধরার সময় সুবহানাল্লাহ বলার তাৎপর্য এই যে, কেবল আল্লাহ তাআলাই সকল প্রকার ভুল-ত্রুটি হতে পবিত্র; তুমি মানুষ, তোমার ভুল হওয়া কোনো অসম্ভব ব্যাপার নয়। ইমামের ভুল ধরার জন্য ইসলামে এটাই নিয়ম করা হয়েছে।
নামাযের মধ্যে ইমাম কোনো ভুল করলে অর্থাৎ যখন দাঁড়ান দরকার তখন বসলে, কিংবা যখন বসা দরকার তখন দাঁড়ালে সুবহানাল্লাহ বলে তার ভুল ধরে দেয়া মোকতাদীগণের পক্ষে অবশ্য কর্তব্য। সুবহানাল্লাহ অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তাআলা পাক ও মহান। ইমামের ভুল ধরার সময় সুবহানাল্লাহ বলার তাৎপর্য এই যে, কেবল আল্লাহ তাআলাই সকল প্রকার ভুল ত্রুটি হতে পবিত্র; তুমি মানুষ, তোমার ভুল হওয়া কোনো অসম্ভব ব্যাপার নয়। ইমামের ভুল ধরার জন্য ইসলামে এটাই নিয়ম করা হয়েছে।
এ নিয়মে যখনই ইমামের ভুল ধরা হবে, তখন কোনো প্রকার লজ্জা-শরমের প্রশ্রয় না দিয়ে তার নিজ ভুল সংশোধন করে নেয়া উচিত। অবশ্য ভুল ধরে দেয়ার পরেও ইমাম যদি নিসন্দেহে মনে করে যে, তার কোন ভুল হয়নি সে ঠিক কাজ করেছে, তখন সে নিজ বিশ্বাস অনুসারে যতারীতি নামায সমাধা করবে। এমতবস্থায় জামায়াতের লোকদের পক্ষে ইমামের ভুলকে ভুল মনে করেও তার অনুসরণ করা কর্তব্য। নামায শেষ হওয়ার পরে ইমামের সামনে তার ভুল প্রমাণ করে পুনরায় নামায পড়াবার দাবী করার অধিকার সকল নামাযীরই আছে।
ইমামের সাথে জামায়াতের লোকদের এরূপ ব্যবহার মাত্র ছোটখাট ভুলের ব্যাপারে হবে। কিন্তু ইমাম যদি নবীর সুন্নাতের খেলাফ নামায পড়াতে শুরু করে কিংবা নামাযের মধ্যে জেনে বুঝে কুরআন শরীফ ভুল পড়ে অথবা নামায পড়াবার সময় কোনো কুফরী, শিরকী বা প্রকাশ্য গুনাহের কাজ করে বসে-তখন নামায ছেড়ে দিয়ে সেই ইমাম পরিত্যাগ করা প্রত্যেক নামাযীর পক্ষেই ফরয।
মুসলমান সমাজকে জাতীয় জীবনে তাদের নেতাদের সাথে কিরূপ ব্যবহার করতে হবে, নামায সম্পর্কে শরীয়াতের এসব হেদায়াত দ্বারা তা চমৎকারভাবে শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
জামায়াতের সাথে নামায পড়ার সার্থকতা ও সুফলের কথা এখানে বলা হলো-তা দ্বারা আপনারা পরিস্কারভাবে জানতে পারলেন যে, আল্লাহ তাআলার এ একটি কথা মাত্র ইবাদাত-যা দিন ও রাতে পাঁচবার মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য করতে হয়-তাতে মুসলমানদের জন্য দুনিয়া আখেরাতে সকল স্থানেই বড় কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তা দ্বারা বুঝতে পারা যায় যে, মাত্র এ একটি জিনিস মুসলমানকে যথার্থ ভাগ্যবান করে দিতে পারে এবং এটা কেমন করে মুসলমানকে আল্লাহর গোলামী এবং দুনিয়ায় নেতৃত্ব করার জন্য তৈরি করে দেয়। এখন আপনাদের মনে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, নামায যখন সকল কল্যাণে পরিপূর্ণ তখন বর্তমান সময় এর এতসব কল্যাণ কোথায় গেল? এ প্রশ্নের জবাব পরবর্তী প্রবন্ধে দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ।
আগের প্রবন্ধগুলোতে আমি শুধু নামাযের বৈশিষ্ট্য এবং উপকারিতার কথাই বলেছি। তা দ্বারা আপনারা নিশ্চই বুঝতে পেরেছেন যে, এটা কত বড় গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। এ নাময মনুষের মধ্যে জীবন ব্যাপী বন্দেগীর ভাবধারা কেমন করে জন্মায় এবং কেমন করে তাকে এ বন্দেগীর হক আদায়ের যোগ্য করে তোলে – সে কথাও অপনারা বুঝতে পেরেছেন। এক্ষণে আমি জামায়াতের সাথে নামায আদায়ের উপকারিতার কথা আপনাদেরকে বলবো। তা দ্বারা আপনারা খুব ভাল করে বুঝতে পারবেন যে, আল্লাহ দয়া ও অনুগ্রহ করে এ একই জিনিসের মধ্যে সবরকমের নিয়ামত কিভাব জমা করে রেখেছেন। শুধু নামাযই আমাদেও পক্ষে কম ছিল না; কিন্তু সেই সাথে জামায়াতের সাথে নামায আদায়ের আদেশ কররে আল্লাহ পাক এটাকে দ্বিগুণ উপকারিতার ভান্ডার করে দিয়েছেন এবং তাতে এক অপূর্ব শক্তি দান করেছেন, যা মনুষের মধ্যে আমূল পরিবর্তন সৃষ্টি করতে অতুলনীয়।
পূর্বেই বলেছি, জীবনের সর্বক্ষণ নিজেকে আল্লাহর বান্দাহ বলে মনে করা, অনুগত গোলামের ন্যায় মালিকের অধীন হয়ে থাকা এবং মালিকের হুকুম পালনের জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকার নামই হচ্ছে ইবাদাত, আর নামায মানুষকে এ ইবাদাতের জন্যই প্রস্তুত করে। এরূপ ইবাদাতের জন্য মানুষের মধ্যে যতগুলো গুণের দরকার, নামায তার সবই মনুষের মধ্যে সৃষ্টি করে। দাস হওয়ার অনুভূতি, আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং তাঁর কিতাবের প্রতি ঈমান, পরকালের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস, আল্লাহভীতি, আল্লাহকে ‘আলেমুল গায়েব’ বলে স্বীকার করা, তাকে সবসময়ই নিজের কাছে অনুভব করা, আল্লাহর হুকুম পালনের জন্য সর্বদা নিজেকে প্রস্তুত রাখা, আল্লাহর গুকুমগুলো ভাল করে জানা — নামায এ ধরনের বহু গুণই মনুষের মধ্যে সৃষ্টি করে এব তাকে আল্লাহ তালার খাঁটি বান্দাহরূপে গড়ে তোলে।
একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন যে, মানুষ নিজে যতই গুণসম্পন্ন হোক না কেন, অন্যান্য মানুষ যতক্ষণ তাঁর সহযোগী ও সাহায্যকারী না হবে ততক্ষণ সে আল্লাহর বন্দেগীর ‘হক’ পূর্ণরূপে আদায় করতে পারবে না। মানুষ যাদের সাথে দিন-রাত জীবনযাপন করে সবসময় যাদের সাথে একত্রে কাজ করে, আল্লাহর ফরমাবরদারী করার ব্যাপারেও তারা যদি সহযেগীতা না করে, হবে সে কিছুতেই আল্লাহর হুকুম পালনে সমর্থ হয় না।
মানুষ দুনিয়ায় একাকী আসেনি। একাকী থেকে সে কিছু করতেও পারে না। সে পাড়া-প্রতিবেশী ও সহকমীর্ এবং জীবন পথেও সঙ্গী-সাথীদেও সাথে নানাভাবে জড়িত। আল্লাহর হুকুম আহকামও কোন নিসঙ্গ একটি মানুষের জন্য নয়, বরং সকল মানুষের জন্য — জীবনের সকল প্রকার সম্পর্ক সম্বন্ধ সঠিকভাবে বজায় রাখার জন্যই তা আল্লাহর তরফ থেকে এসেছে। এখন আল্লাহর হুকুম পালন করার ব্যাপারে যদি সবাই পরস্পরকে সাহায্য করে, সহযোগগিতা করে, তবেই তারা এক সাথে আল্লাহর হুকুম পালনকারী হতে পারে। পক্ষন্তরে সকলে মিলে যদি আল্লাহ নাফরমানী শুরু করে কিংবা তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক যদি এমন হয় যে, আল্লাহর আদেশ পালনে পরস্পর সহযোগিতার না না করে, তবে একজন লোকের পক্ষে সঠিকভাবে নিয়মিত আল্লাহর হুকুম পালন করা এবং আল্লাহর বিধান অনুসারে কাজ করা একেবারেই অসম্ভব।
আপনারা যদি বিশেষ লক্ষ্যের সাথে কুরআন পাঠ করেন, তাহলে জানতে পারবেন যে, আল্লাহর তায়ালা কেবল আপনাকে আল্লাহর অধীন ও অনুগত হতে এবং আল্লাহর হুকুম পালন করে চলতে বলেন নি। বরং সেই সাথে আপনাক এ আদেশও দেওয়া হয়েছে, আপনি সমগ্র দুনিয়াকে আল্লাহর অধীনের অনুগত করে দিবেন, দুনিয়াতে আল্লাহর আইন জারী করবেন। দুনিয়ার যেখানে যেখানে ‘শয়তানের’ আইন চলছে, তা বন্ধ করবেন এবং সে স্থানে এক ও লা-শরীক আল্লাহ তাআলার আইনের হুকুমাত কায়েম করবেন। আপনার প্রতি আল্লাহ এতে যে, বিরাট খেদমতের আদেশ দিয়েছেন একজন লোকের পক্ষে এ কাজ সমাধা করা কিছুতেই সম্ভব হতে পারে না। এ মতে বিশ্বাসী কোটি কোটি মুসলমানও যদি হয়ে আর তার বিভিন্ন ও বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকে — তাদের মধ্যে কোন যোগাযোগ বা সম্পর্ক না থাকে তবে তারাও ‘শয়তানের’ সুশৃংখলিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত শক্তিকে কিছুতেই পরাজিত করতে পারবে না। এজন্যই মুসলমানদেও দলবব্ধ হওয়া ও পরস্পরকে সহায্য করা, একে অন্যেও পৃষ্ঠ-পোষক ও সমর্থক হয়ে দাড়ান এবং সকলে একই উদ্দেশ্যে হাসিল করার জন্য সম্মিলতভাবে সংগ্রাম-সাধনা করা অপরিহার্য।
একটু গভীরভাবে দেখলে একথাও পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এতবড় বিরাট উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মুসলমানদের কেবল মিলিত ও একতাবদ্ধ হওয়াই যথেষ্ট নয়। তাদের মিলিত হতে হবে ঠিক পন্থা অনুসারে অর্থাত্ এমনভাবে মুসলমানদের একটি জামায়াত গঠন করতে হবে, যেন তাদের পরস্পরের সাথে সঠিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় — তাদের পরস্পরের সম্পর্কেও মধ্যে যেন কোনরূপ দোষ-ত্রুটি না থাকে। তাদের মত, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কর্মনীতির পূর্ণ ঐক্য বর্তমান থাকা চাই। তাদের একজন অমির ও নেতা হওয়া দরকার, তাদের মধ্যে সেই নেতার ইশারা অনুসারে কাজ করার আভ্যাস ও স্পৃহা থাকা চই। তাদের কে নেতার হুকুম পালন করতে হবে আর তা কত দূরইবা করতে হবে এবং কোন্ কারণে ঘটলে নেতার বিরধিতাও করা যেতে পারে — তাও তাদের ভাল করে বুঝে নেয়া আবশ্যক। এ গুলো মনে রখুন এৰং জামায়াতর সাথে নামায পড়লে এসব গুরুত্বপূর্ণ ভাবধারা নামাযীদেও মধ্যে কেমন করে জেগে উঠে তা চিন্তা করে দেখুন।
আযান শোনা মাত্রই সবকাজ-কর্ম ছেড়ে মসজিদের দিকে যাওয়ার হুকুম দেয়া হয়েছে। কাজেই আযানের সাথে সাথেই মুসলমানদেও নিজ নিজ কাজ ত্যাগ করা এবং একই কেন্দ্রেও (সমজিদ) দিকে সকলের অগ্রসর হওয়া একটি বিরাট সৈন্যবহিনীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সৈন্য শিবিরে ‘বিউগলের’ আওয়ায হওয়ার সাথে সাথেই প্রত্যেকটি সৈনিক বুঝতে পারে যে, সেনাপতি সকলকে ডাকছেন। এ সময় সকলের মনে একই ভাব উদয় হয়। সেই ভাব হচ্ছে সেনাপতির নির্দেশ পালনের কর্তব্য ও দায়িত্ব। একথা মনে হওয়ার সাথে সাথে সকলে একই কাজ করে, অর্থাৎ যে যে খানে আছে সেখানে হতে সে আওয়ায শোনা মাত্র নির্দিষ্ট স্থানের দিকে দৌঁড়াতে থাকে। সৈন্যদেও জন্য এ অনন্য পন্থা কেন গ্রহণ করা হয়ছে।? প্রথম এজন্য যে যেন আলাদাভাবে প্রত্যেকটি সৈনিকের মধ্যে হুকুম পালন করার এবং হুকুম পলনের জন্য সবসময়ই প্রস্তুত থাকার অভ্যাস হবে। দ্বিতীয়ত, সেই সাথে এ ধরনের সকল অনুগত সিপাহীদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী দল গঠিত হবে এবং সেনাপতির আদেশে একই সময় একই স্থানে সমবেত হওয়ার অভ্যাস হবে। এ অভ্যাসটি এজন্য দরকার যে, হঠাত্ কোন ঘটনা যদি দেখা দেয় তখন যেন সকল সিপাহী এই আওয়াযে একইস্থানে হাজির হয়ে কাজ করতে পারে। প্রত্যেক সৈনিক ব্যক্তিগতভাবে যদি খুব বড় বাহাদুর হয়, কিন্তু কাজের সময় ডাকলে অবিলম্বে উপস্থিত হয়ে যদি লড়াই করতে না পারে, তাহলে তাদেরর বাহাদুরিগিরি কোন মূল্য থাকে ন। ডাক দেয়া মাত্র সৈন্যগন যদি একত্র না হয়ে বরং নিজ নিজ ইচ্ছামত একেক দিকে চলে যায়, তবে এ ধরনের হাজার বীর সৈনিকককে শত্রপক্ষের পঞ্চাশটি সৈনিকের এশটি শৃংখলাবদ্ধ দল নাস্তানাবুদ করে দিতে পারে।
ঠিক এ নিয়মেই আযান শুনা মাত্রই কাজ-কর্ম ছেড়ে নিকটস্থ মসজিদে হাজির হবার জন্য মুসলমানকে আদেশ করা হয়েছে যেন সব মুসলমান মিলে আল্লাহর একটি সৈন্যদলে পরিনত হতে পারে। এভাবে দৈনিক পাঁচবার আযান শুনামাত্র হাজির হওয়ার অভ্যাস করানো হয় এজন্য যে, দনিয়ার সকল প্রকার সৈনিকের তুলনায় এ খোদায়ী সেনাদেও কর্তব্য অনেক বেশী, অনেক কঠোর। অন্যান্য ফৌজের পক্ষে বহুকাল পরেও হয়ত যুদ্ধ করার প্রয়োজন পড়েনি এবং কবে কোন্ সময় যুদ্ধ বাধবে সে জন্য বহু পূর্বে থেকেই এত সব ট্রেনিং দেয় হয়। কিন্তু এ খোদায়ী ফৌজকে প্রত্যেক মুহূর্তেই শয়তানী শক্তির সাথে লড়াই করতে হয় এবং প্রত্যেকটি মুহূর্তেই সেনাপতির আদেশ পালনের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। এজন্য মুসলমানদের দিন-রাতের মধ্য পাঁচবার খোদায়ী ‘বিউগল’ —- আযানের আওয়াযে আল্লাহর শিবির মসজিদের দিকে ছুটতে হয়, বলতে হবে, দায়িত্ব ও কর্তব্যেও তুলনায় তাদের প্রতি এটাকে অনেক অনুগ্রহ করা হয়েছে সন্দেহ নেই।
এ যাবত শুধু আযানের সৌন্দর্যের কথাই আলোচনা করা হয়েছে। আযান শুনে সকল মুসলমান মসজিদে হাজির হয় কেবল সে জামায়েতের মধ্যেই অনেক সৌন্দর্য-সার্থকতা নিহিত ওয়েছে। এখানে মিলিত হয় মসলমানগণ পরস্পরকে দেখতে পান, চিনতে ও পরিচয় লাভ করতে পারেন।
কিন্তু আপনারা পরস্পরের সাথে এই যে মিলিত ও পরিচিত হন, তা কোন্ সূত্রে? এ সূত্রে যে, আপনারা এক আল্লাহর বান্দাহ, এক রাসূলের অনুসরণকারী, এক কুরআন শরীফই আপনাদের সকলেরই কিতাব—- জীবন বিধান এবং আপনাদের সকলেরই জীবনের উদ্দেশ্য এক। সেই একই উদ্দেশ্য লাভ করার জন্য আপনারা মসজিদে একত্রিত হয়েছেন এবং এখানে থেকে ফিরে যাওয়ার পর ও অপনারা প্রত্যোকেই সে একই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য চেষ্টা করবেন; বস্তুত এ ধরনের পরিচয় এবং এরূপ সাহচর্য স্বাভাবিক ভাবে আপনদের মনে এ খেয়াল জাগিয়ে দেয় যে, আপনার সকলেই একটি জাতির অন্তুভূক্ত, একই ফৌজের সিপাহী আপনারা। আপনাদের একে অপরের ভাই। দুনিয়ায় আপনাদের জীবেনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক, আপনাদের লাভ-লোকসানে সকলেই আপনারা শরীক ও অপনাদের পরস্পরের জীবন একে অপরের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত।
আপনারা যখন পরস্পরের দিকে তাকাবেন তখন ঠিক চোখ-মন অন্তর খুলে উদার দৃষ্টিতে তাকাবেন। শত্রু যে দৃষ্টিতে দেখে থাকে অপনারা কারো প্রতি সেভাবে তাকান না বরং বন্ধু যেরূপ বন্ধুর দিকে তাকায়, ভাই যে চোখে ভাইয়ের দিকে তাকায়, ঠি্ক সেই দৃষ্টিতেই একজন অপরজেনের প্রতি তাকিয়ে থাকেন। এভাবে তাকাবার ফলে আপনি যখন কোন ভাইকে পুরাতন ও ছেড়া কাপড় পরিহিত দেখতে পাবেন, কাউকে বিশেষ চিন্তিত বিপদগ্রস্ত বা ক্ষুধার্ত দেখবেন, কাইকে দেখবেন অক্ষম-পংগু, পক্ষাঘাতগ্রস্ত ও অন্ধ তখন অপনার অন্তরে আপনা আপনিই সহানভুতি ও দয়ার উদ্রেক হবে। অপনারা ধনী লোকেরা গরীব ও অসহায় দুঃস্থদের দুঃখ অনুভব করবেন, ফকীর-মিসকিন লোকেরা ধনীদের কাছে পৌঁছে নিজেদের দুরবস্থার কথা বলার সহস পবে। কারো সম্পর্কে যদি আপনি জানতে পারেন, যে সে অসুস্থ কিংবা বিপদগ্রস্ত বলে মসিজিদে আসতে পারেন নি তখন তাকে দেখতে যাবার জন্যু্য অপানার মনে অগ্রহ হবে। কারো মৃত্যুর্ সংবাদ পেলে জানাযা পড়তে যেতে পারেন এবং তার শোকসন্তপ্তপরিবারবর্গের পৃতি সমবেদনা প্রকাশ করতে পারেন। বস্তুত এ কাজই আপনাদের পরস্পরের মধ্যে গভীর ভালবাসা ও সহানুভুতি সৃস্টি করবে।
আর একটু ভেবে দেখুন — অপনারা যেখানে একত্র হন তা একটি পাক পবিত্র স্থান। এ পাক স্থানে মহান উদ্দেশ্য নিয়ৈ অপনারা একত্রিত হয়ে থাকেন। চোর-ডাকত, শরাবী আর জুয়াড়ী দলও একস্থানে একত্র হয় বটে; কিন্তু তাদের সকলের মন অসত্ ইচ্ছায় পরিপুর্ণ থাকে। কিন্তু অপনাদের সমবেত হওয়াকে এদর সাথে তুলনা করা যায় না। কারণ এখনে আল্লাহর খাঁটি বান্দাগণই একতি হয়ে থাকেন — আল্লাহর ইবাদাদতের জন্য আপনাদের এ সম্মেলন আল্লাহর ঘরে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। আল্লাহর সামনে বন্দেগী ও দাসত্বের খালেছ মনে স্বীকার করার জন্যি এখনে সকলে সবমসেত হন। এমতাতাবস্থায় ইমানদার লোকদের মনে অপানা আপনি নিজ নিজ গুনাহের জন্য লজ্জার অনুভূতি জেগে উঠে। অন্য দিকে যদি কোন মানুষ অন্য কারো সামনে কোন গুনাহের কাজ করে থাকে, আর সেই ব্যক্তি যদি মসজিদে হাজির হয়, তাহলে কেবল এতেই গুনাহগার ব্যক্তি লজ্জায় মরে যায়। উপরন্তু মুসলমানদের মনে পরস্পরকে উপদেশ দেয়ার ভাবও যদি বর্তমান থাকে এবং সে যদি দরদ ভালবাসা ও সহানুভুতির সাথে একজনের দোষত্রুটি কেমন করে দূর করা যায়, তা ভাল করে জেনে নেয়, তবে তাদের এ সম্মেলনের প্রতি আল্লাহর অশেষ রহমত ও বরকত নাযিল হবে— তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এভাবে জামায়াতে নামায পড়ার সুযোগে এক মুসলমান অন্য মুসলমানের দোষ-ত্রুটি সংশোধন করতে পারবেন— একজন অন্যজনের অভাব পূরণ করবেন। ফলে ধীরে ধীরে গোটা সমাজই সৎ ও নেককার হতে পারবে।
মসজিদে কেবল মিলিত হওয়ার মধ্যেই এ বিরাট বরকত রয়েছে। এরপর জামায়াতের সাথে নামায পড়ার উপকারিতা ও বরকত যে কত অসীম তাও ভেবে দেখুন। নামাযীগণ সকলে একই সারিতে সমানভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন। তাদের কেউ বড় নয়, কেউ ছোট নয়, কেউ উচ্চ নয়, কেউ নীচু নয়- আল্লাহর দরবারে, আল্লাহর সামনে সকল মানুষ একেবার সমান। কারো হাত লাগলে বা কারো স্পর্শ লাগলে তাদের কেউ নাপাক হয়ে যায় না। এখানে অস্পৃশ্যতার কোনো অবকাশ নেই। তাদের সকলেই পাক এবং পবিত্র; কারণ এরা সকলেই মানুষ, সকলেই এক আল্লাহর বান্দাহ: একই দ্বীন ইসলামের অনুগামী। এ নামাযীদের মধ্যে বংশ, পরিবার, গোত্র, দেশ আর ভাষায় আদৌ কোনো পার্থক্য নেই। ব্যক্তিগতভাবে এদের কেউ সাইয়েদ, কেউ পাঠান, কেউ খাঁ সাবেহ, কেউ হাওলাদার আর কেউ চৌধুরী সাহেবও হতে পারেন। আবার এদের একজন হয়ত এক দেশের অধিবাসী আর একজন অন্য দেশের অধিবাসী। কেউ এক ভাষায় কথা বলে, কেউ অন্য ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহর ইবাদাত করে। এর অর্থ এই যে, তারা সকলেই এক জাতির লোক। এখানে বংশ-গোত্র, দেশ-অঞ্চল ও জাতীয়তার প্রভেদ পার্থক্য একেবারে মিথ্যে। মানুষের পরস্পরের মধ্যে সবচেয়ে বড় সম্পর্ক হচ্ছে আল্লাহর বন্দেগী, আল্লাহর ইবাদাত। এ ব্যাপারে আপনারা সকলেই যখন এক তখন অন্যান্য ব্যাপারেও আপনাদের ভিন্ন ভিন্ন ও বিচ্ছিন্ন কোনোই কারণ থাকতে পারে না।
আপনারা যখন সারি বেঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ান, তখন মনে হয় যেন একটি বিরাট সৈন্যবাহিনী বাদশাহের সামনে কর্তব্য পালনের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। কাতার বেঁধে দাঁড়ানোর এবং একত্রে মিলে ওঠাবসা করায় নামাযীদের মনে পরম ঐক্যভাবের সৃষ্টি হয়। এভাবে নামাযের ভিতর দিয়ে সকলকে আল্লাহর বন্দেগী করার অভ্যাস করানো হয়-তাদের সকলের হাত একত্রে ওঠবে, সকলের পা এক সাথে চলবে। তাতে পরিস্কার মনে হবে যে, নামাযীরা বিশজন বিশজন কিংবা একশজন নয়-তারা একত্রে মিলে একটি অখন্ড মানুষে পরিণত হয়েছে।
জামায়াত ও কাতারবন্দী হওয়ার পরে কি করা হয়? সকল নামাযী একই ভাষায় আল্লাহর সামনে একই আরয জানায়: اِيَّاكَ وَاِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُহে আল্লাহ আমরা কেবল তোমারই ইবাদাত করি এবং কেবল তোমারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি। اِهْدِنَا الصِّرَاظَ الْمُسْتَقِيْمَ হে আল্লাহ আমাদেরকে সহজ সঠিক পথ দেখাও। رَبِّنَا لَكَ الْحَمْدُ হে আল্লাহ! সব তারীফ প্রশংসা কেবল তোমারই জন্য। اَلسَّلاََمُ عَلَيْنَا وَعَلى عِبَادِ اللهِ الصَّالِحِيْنَ ـ আমাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হোক এবং আল্লাহর নেক বান্দাদের ওপরও। তারপরে নামায শেষ করে একে অপরকে এ বলে সালাম করে اَلسَّلاَمُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ ـ এর অর্থ এই যে, নামাযীদের প্রত্যেকেই পরষ্পর কল্যাণকামী এবং সকলে মিলে একই মালিকের কাছে সকলের মঙ্গল দাবী করেছে। কোনো নামাযী একাকী নয়, তাদের কেউই কেবলমাত্রই নিজের জন্য কল্যাণ কামনা করে না। বরং সকলের মুখে এ দোআ যে, হে আল্লাহ! আমাদের সকলেরই প্রতি তোমার অনুগ্রহ ও কল্যাণ বর্ষিত হোক, সকলকে একই সহজ ও সোজা পথে চলার তৌফিক দাও, সকলের ওপরেই শান্তি বর্ষিত হোক। নামায এভাবে সকল নামাযীর দিলকে পরস্পরের সাথে মিলিয়ে দেয়, সকলের মনে একই খেয়াল ও একই চিন্তাধারা জাগরিত করে, তাদের পরস্পরের মধ্যে গভীর ভালবাসা, ঐক্য ও মংগলাকাংখার সৃষ্টি হয়।
কিন্তু মনে রাখবেন, জামায়াতের সাথে ইমাম ছাড়া পড়া যায় না। দু’জন মিলে পড়লেও তাদের মধ্যে একজনকে ইমাম ও অপরজনকে মোকতাদী হতে হয়। জামায়াত শুরু হলে তা থেকে আলাদা হয়ে একাকী নামায পড়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। বরং হুকুম রয়েছে যে, জামায়াত আরম্ভ হওয়ার পর যেই আসবে, তাকে সেই ইমামের পিছেনেই (একতেদা করে) দাঁড়াতে হবে। এসব কাজ কেবল নামাযের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, আসলে এটা দ্বারা একটি বড় শিক্ষা এই দেয়া হচ্ছে যে, মুসলমান হিসেবে জীবন যাপন করতে হলে এভাবে জামায়তবন্দী হয়ে থাকতে হবে। আর আপনাদের মধ্যে একজন যদি ইমাম না হয় তাহলে আপনাদের সেই জামায়াত গঠনই হতে পারে না। জামায়াত গঠন হওয়ার পরেও তা থেকে আলাদা হয়ে থাকলে আপনাদের জীবন মোটেই ইসলামী জীবন নয়। মুসলিম জীবনরে সাথে এর আদৌ সম্পর্ক নেই।
এখানেই শেষ নয়। জামায়াতের সাথে নামায পড়ার মাধ্যমে ইমাম ও মোকতাদীদের মধ্যে একটা বিরাট মযবুত সম্পর্ক সৃষ্টি হয়-যার সাহায্যে প্রত্যেকটি মুসলমানই জানতে পারে যে, এ ছোট্ট মসজিদের বাইরে পৃথিবী নামক বিরাট মসজিদে ইমামের মর্যাদা কি? তার কর্তব্য কি? তাঁর কি কি হক আছে? সেই বড় মসজিদেরে ইমামের অনুসরণ আপনাকে কিভাবে করতে হবে, সে ভুল করলে আপনি কি করবেন? তার ভুলকে আপনি কতক্ষণ বরদাশত করবেন? কখন আপনি তার ভুল ধরতে পারবেন? আর তা শোধরাবার দাবী করতে পারবেন? আর কোন অবস্থায় ইমামকে পদচ্যুত করতে পারবেন? এ সমস্ত কথা
ছোটখাটোভাবে প্রত্যেক মুসলিমকে মসজিদের মধ্যে জামায়াতের সাথে নামায পড়ার ভিতর দিয়ে শিক্ষা দেয়া হয়। এক কথায় মসজিদে একটি ছোটখাট রাজ্য চালাবার নিয়ম-কানুন দৈনিক পাঁচবার শিক্ষা দেয়া হয় এবং তার অভ্যাস করানো হয়।
একথাগুলো বিস্তারিতভাবে বলার অবকাশ এখানে নেই। সংক্ষেপে কয়েকটি প্রয়োজনীয় কথা বলে রাখছি।
শরীয়াতের আদেশ এই যে, সমাজের লোকদের মধ্যে যে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশী পরহেযগার হবে, ইলম যার বেশী হবে কুরআন শরীফ যে সকলের অপেক্ষা ভাল করে পড়তে ও বুঝতে পারবে এবং সেই সাথে যার উপযুক্ত বয়স হয়েছে, ঠিক তাকেই নামাযের ইমাম বানাতে হবে। কর্মক্ষেত্রে যারা জাতির নেতা হবে তাদের মধ্যে কি কি গুণ থাকা অবশ্য দরকার-উক্ত ব্যবস্থা দ্বারা পরিস্কারভাবে তারই শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
শরীয়াত ব্যবস্থা করা হয়েছে যে, নামাযের ইমাম এমন ব্যক্তিকে বানাতে হবে, যে সকল নামাযীর অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখে নামায পড়বে। কারণ নামাযদের মধ্যে অনেক রুগ্ন, বৃদ্ধ, অসুস্থ আর দুর্বল লোকও থাকতে পারে। এমতবস্থায় কেবল যুবক, শক্তিমান আর অবসর বিশিষ্ট মানুষদের প্রতি লক্ষ্য রেখে নামাযে লম্বা লম্বা কেরাত পড়লে এবং লম্বা লম্বা রুকূ সেজদা করতে থাকলে অন্যের পক্ষে অনেক কষ্ট ও অসুবিধা হতে পারে। তাই ইমামের মনে রাখতে হবে যে, নামাযীদের মধ্যে অনেক বৃদ্ধ আছে, রুগ্ন ও দুর্বল ব্যক্তি আছে, রুগ্ন ও দুর্বল ব্যক্তি আছে এবং এমন অনেক লোক যারা তাড়াতাড়ি নামায পড়ে নিজ নিজ কাজে ফিরে যেতে চায়। হযরত নবী করীম (সা) এ ব্যাপারে অনেক সহানুভূতি দেখিয়েছেন। নামায পড়াবার সময় কোন শিশুর কান্নার আওয়ায শুনতে পেলেও তিনি নামায অনেক সংক্ষেপ করতেন। কারণ শিশুর মাতা (কিংবা পিতা) এ জামায়াতে শরীক থাকলে তার মনে কষ্ট হতে পারে-তাই নামাযের ব্যাঘ্যত হতে পারে। এ নিয়ম দ্বারা জাতির নেতৃবৃন্দকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে, তখন প্রত্যেক কাজেই জাতির সকল প্রকার লোকের প্রতি তার লক্ষ্য থাকা বাঞ্চনীয়। শরীয়াতের ব্যবস্থা এই যে, নামায পড়াবার সময় ইমামের যদি এমন কোনো অবস্থা হয়, যাতে সে আর নামায পড়াতে পারছে না, তাহলে অবিলম্বে তার সরে গিয়ে অন্য এক ব্যক্তিকে ইমাম পড়াতে পারছে না, তাহলে অবিলম্বে তার সরে গিয়ে অন্য এক ব্যক্তিকে ইমাম করে দেয়া আবশ্যক। এ থেকে এ নির্দেশ পাওয়া যায় যে, জাতির নেতা যখন নিজ পার্থক্য পালনে অক্ষম হবে, তখন সে নিজেই পদত্যাগ করে অন্য কোনো উপযুক্ত লোককে সেখানে নিযুক্ত করার ব্যবস্থা করবে। এটা করা তার পক্ষে ফরয। এ কাজে তার কোনো লজ্জা হওয়া উচিত হয়, এতে স্বার্থপরতাও নেই।
শরীয়াতের আদেশ এই যে, ইমাম যা করবে মোকতাদীগণও তার অনুসরণ করতে বাধ্য থাকবে। ইমামের কোনো কাজ করার আগে মোকতাদীর তা করা একেবারে নিষিদ্ধ। এমনকি হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইমামের আগে কেউ রুকূ বা সিজদা করলে কিয়ামতের দিন তাকে গাধা বানিয়ে ওঠানো হবে। নেতাকে অনুসরণ করে চলা অবশ্য কর্তব্য এখানে মুসলিম জাতেকে তাই শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
নামাযের মধ্যে ইমাম কোনো ভুল করলে অর্থাৎ যখন দাঁড়ান দরকার তখন বসলে, কিংবা যখন বসা দরকার তখন দাঁড়ালে সুবহানাল্লাহ বলে তার ভুল ধরে দেয়া মোকতাদীগণকে পক্ষে অবশ্য কর্তব্য। সুবহানাল্লাহ অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তাআলা পাক ও মহান। ইমামের ভুল ধরার সময় সুবহানাল্লাহ বলার তাৎপর্য এই যে, কেবল আল্লাহ তাআলাই সকল প্রকার ভুল-ত্রুটি হতে পবিত্র; তুমি মানুষ, তোমার ভুল হওয়া কোনো অসম্ভব ব্যাপার নয়। ইমামের ভুল ধরার জন্য ইসলামে এটাই নিয়ম করা হয়েছে।
নামাযের মধ্যে ইমাম কোনো ভুল করলে অর্থাৎ যখন দাঁড়ান দরকার তখন বসলে, কিংবা যখন বসা দরকার তখন দাঁড়ালে সুবহানাল্লাহ বলে তার ভুল ধরে দেয়া মোকতাদীগণের পক্ষে অবশ্য কর্তব্য। সুবহানাল্লাহ অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তাআলা পাক ও মহান। ইমামের ভুল ধরার সময় সুবহানাল্লাহ বলার তাৎপর্য এই যে, কেবল আল্লাহ তাআলাই সকল প্রকার ভুল ত্রুটি হতে পবিত্র; তুমি মানুষ, তোমার ভুল হওয়া কোনো অসম্ভব ব্যাপার নয়। ইমামের ভুল ধরার জন্য ইসলামে এটাই নিয়ম করা হয়েছে।
এ নিয়মে যখনই ইমামের ভুল ধরা হবে, তখন কোনো প্রকার লজ্জা-শরমের প্রশ্রয় না দিয়ে তার নিজ ভুল সংশোধন করে নেয়া উচিত। অবশ্য ভুল ধরে দেয়ার পরেও ইমাম যদি নিসন্দেহে মনে করে যে, তার কোন ভুল হয়নি সে ঠিক কাজ করেছে, তখন সে নিজ বিশ্বাস অনুসারে যতারীতি নামায সমাধা করবে। এমতবস্থায় জামায়াতের লোকদের পক্ষে ইমামের ভুলকে ভুল মনে করেও তার অনুসরণ করা কর্তব্য। নামায শেষ হওয়ার পরে ইমামের সামনে তার ভুল প্রমাণ করে পুনরায় নামায পড়াবার দাবী করার অধিকার সকল নামাযীরই আছে।
ইমামের সাথে জামায়াতের লোকদের এরূপ ব্যবহার মাত্র ছোটখাট ভুলের ব্যাপারে হবে। কিন্তু ইমাম যদি নবীর সুন্নাতের খেলাফ নামায পড়াতে শুরু করে কিংবা নামাযের মধ্যে জেনে বুঝে কুরআন শরীফ ভুল পড়ে অথবা নামায পড়াবার সময় কোনো কুফরী, শিরকী বা প্রকাশ্য গুনাহের কাজ করে বসে-তখন নামায ছেড়ে দিয়ে সেই ইমাম পরিত্যাগ করা প্রত্যেক নামাযীর পক্ষেই ফরয।
মুসলমান সমাজকে জাতীয় জীবনে তাদের নেতাদের সাথে কিরূপ ব্যবহার করতে হবে, নামায সম্পর্কে শরীয়াতের এসব হেদায়াত দ্বারা তা চমৎকারভাবে শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
জামায়াতের সাথে নামায পড়ার সার্থকতা ও সুফলের কথা এখানে বলা হলো-তা দ্বারা আপনারা পরিস্কারভাবে জানতে পারলেন যে, আল্লাহ তাআলার এ একটি কথা মাত্র ইবাদাত-যা দিন ও রাতে পাঁচবার মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য করতে হয়-তাতে মুসলমানদের জন্য দুনিয়া আখেরাতে সকল স্থানেই বড় কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তা দ্বারা বুঝতে পারা যায় যে, মাত্র এ একটি জিনিস মুসলমানকে যথার্থ ভাগ্যবান করে দিতে পারে এবং এটা কেমন করে মুসলমানকে আল্লাহর গোলামী এবং দুনিয়ায় নেতৃত্ব করার জন্য তৈরি করে দেয়। এখন আপনাদের মনে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, নামায যখন সকল কল্যাণে পরিপূর্ণ তখন বর্তমান সময় এর এতসব কল্যাণ কোথায় গেল? এ প্রশ্নের জবাব পরবর্তী প্রবন্ধে দেয়া হবে ইনশাআল্লাহ।
নামাযের ফল পাওয়া যায় না কেন
পূর্বের প্রবন্ধগুলোতে নামাযের যে উপকারিতা ও সুফল দানের কথা আমি নানাভাবে ব্যক্ত করেছি, সেই নামায থেকে বর্তমানে লোকেরা সেই রকম সুফল লাভে সক্ষম হচ্ছে না, এখানে এ প্রশ্নের জবাব দিতে চেষ্টা করবো। বর্তমান যুগে নামায পড়ার পরেও মুসলমান এত লাঞ্চিত ও দুর্বল কেন, তাদের চরিত্র উন্নত হচ্ছে না কেন, একটি অপরাজেয় শক্তিধর আল্লাহর সেনাবাহিনীতে পরিণত হচ্ছে না কেন, দুনিয়ার মধ্যে কাফেরদের বিপক্ষে তারা এত শক্তিহীন ও অবহেলিত কেন? এটা সত্যিই একটি কঠিন প্রশ্ন।
এ প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত জবাব এ হতে পারে যে, মুসলমানগণ আসলে নামাযই পড়ে না, আর পড়লেও ঠিক সেভাবে এবং সেই নিয়মে পড়ে না, যেভাবে আর যে নিয়মে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল পড়তে আদেশ করেছেন। কাজেই যে নামায ঈমানদার ব্যক্তিকে উন্নতির চরম সীমায় পৌঁছাতে পারে, আজিকার মুসলমানগণ বর্তমানের এ নামায হতে সেরূপ সুফল লাভের আশা করতে পারে না। কিন্তু আমি জানি, এতটুকু সংক্ষিপ্ত জবাবে আপনারা পরিতৃপ্ত হবেন না। কাজেই একটু বিস্তারিতভাবেই এর জবাব এর জবাব দেয়া আবশ্যক।
এই যে (মসজিদে) একটি দেয়াল ঘড়ি ঝুলছে, আপনি জানেন যে, এতে অনেক যন্ত্রাংশ একটি অন্যটির সাথে জড়িত রয়েছে। এতে যখন চাবি দেয়া হয়, তখন প্রত্যেকটি যন্ত্রাংশ নিজ নিজ কাজ শুরু করে এবং সেই সাথে বাইরের কাঁটায় ভিতরের যন্ত্রাংশগুলোর কাজের ফল প্রকাশ হতে থাকে। অর্থাৎ দু’টি কাঁটা ঘুরে ঘুরে সেকেন্ডর পর সেকেন্ড মিনিটের পর মিনিট বানিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বানাতে থাকে। এখন চিন্তা করে দেখুন, ঘড়ি বানাবার উদ্দেশ্য কি? ঠিকভাবে সময় জানানই যে তার একমাত্র উদ্দেশ্য, একথা সকলেই জানেন। এজন্যই সঠিক সময় নির্দেশ করতে পারে এমন সব ছোট ছোট যন্ত্রাংশ এর মধ্যে একত্র করা হয়েছে। তারপর সেগুলোকে পরস্পর জুড়ে দেয়া হয়েছে। যেন সবগুলো মিলে যথারীতি চলতে থাকে এবং প্রত্যেকটি অংশ যেন সঠিক সময় জানাবার জন্য যতটুকু কাজ করা দরকার ঠিক ততটুকু কাজ করে-বেশী নয়, কমও নয়। পুনরায় তাতে চাবি দিবার নিয়ম করা হয়েছে। কেননা, চাবি না দিলে যন্ত্রাংশগুলো থেকে যাবে, তা সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে না। তাই নির্দিষ্ট সময়ের পরে চাবি দিয়ে তাকে গতিশীল করে দেয়া হয়। ফলে সবগুলো যন্ত্রাংশ চলতে শুরু করে। এগুলোকে যখন ঠিকাভাবে জুড়ে দেয়া হয় এবং তাতে চাবি দেয়া হয়, ঠিক তখনই যে উদ্দেশ্যে তা তৈরী হয়েছে তা এ ঘড়ি দ্বারা লাভ করা যেতে পারে। কিন্তু যদি ঠিকমত চাবি দেয়া না হয়, তবে তা ঠিকভাবে সময় নির্দেশ করতে পারবে না। যদি চাবি দেয়াও হয়, কিন্তু নিয়মানুসারে না দেয়া হয়, তাহলে ঘড়ি বন্ধ হয়ে যাবে কিংবা চললেও ঠিকমত সময় নির্দেশ করতে পারবে না। যদি এর কোন কোনো অংশ বের করে দিয়ে চাবি দেয়া হয়, তবে সে চাবি দেয়ায় কোনো ফলই হবে না। আর যদি এর কোনো অংশ বের করে সেখানে সিঙ্গার সেলাই মেশিনের অংশ লাগিয়ে দেয়া হয় এবং চাবি দেয় হয়, তথাপি তা সময় নির্দেশ করতে পারবে না; ওদিকে কাপড় সেলাই করার কাজও তার দ্বারা সম্ভব হবে না। এর সবগুলো যন্ত্রাংশ যদি একটিকে অন্যটি থেকে আলাদা করে এর মধ্যে রাখা হয়, তবে চাবি দিলেও তা চলবে না। প্রকাশ্যভাবে দেখতে গেলে তো বলতে হবে যে, ঘড়ির সব যন্ত্রাংশই এর মধ্যে আছে, কিন্তু যন্ত্রাংশ কেবল এর মধ্য কেবল এর মধ্যে থাকলেই তো আর এর উদ্দেশ্য হাসিল হতে পারে না। কারণ, এদের পরস্পরের সাথে কোন যোগ নেই এবং শ্রেণীবিন্যাস করে সেগুলোকে ঠিকমত সাজানও হয়নি। তাই সেগুলো পরস্পর চলতে পারছে না। এখানে যেসব অবস্থার কথা বলা হলো তাতে যদিও ঘড়িটি কোনো কাজ করবে না এবং তাতে চাবি দেয়া নিষ্ফল হবে তবুও বাইরের লোক তা দেখে কিছুই বুঝতে পারবে না যে, এটা দেখতে ঠিক ঘড়ির মতোই এবং সে জন্য ঘড়ি দ্বারা যে উদ্দেশ্য লাভ হয়, তাই পাওয়ার আশা করবে এজন্যই দূর থেকে তারা যখন দেখবে যে, আপনি ঘড়িতে ঠিক তাই পাওয়ার আশা করবে। কিন্তু এর ভিতর যখন ঘড়ির ঠিক অবস্থা বর্তমান নেই তখন বাহির থেকে ঘড়ির মত দেখালে কি হবে? এর দ্বারা আসল ঘড়ির কাজ পাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়।
ঘড়ির যে উদাহরণ আপনাদের সামনে পেশ করলাম, তা দ্বারা আপনারা সমস্ত ব্যাপারটা পরিস্কারভাব বুঝতে পারলেন। ইসলামকে এ ঘড়ির মত মনে করুন, ঘড়ির উদ্দেশ্য যেমন সঠিক সময় নির্দেশ করা, তেমনি ইসলামেরও উদ্দেশ্য এই যে, মানুষ এ দুনিয়াতে আল্লাহর খলীফা- আল্লাহর সৈনিকরূপে বসবাস করবে। নিজেরা আল্লাহর হুকুম অনুসারে চলবে, অন্যকেও আল্লাহর বিধানের অধীন পরিচালিত করবে।
কুরআন শরীফে একথাটি পরিস্কার বলা আছে:
كُنْتُمْ خَيْرَ اُمَّةٍ اُخْرِجََتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَ تَنْهَوْنَ عِنْ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ ط ـ عمران:
তোমরা সেই সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি, যাদেরকে সমগ্র মানুষের কল্যাণের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমাদের কাজ এই যে, তোমরা সকল মানুষকে ন্যায় কাজের আদেশ করবে, সকল অন্যায় কাজ থেকে মানুষকে ফিরাবে এবং আল্লাহর প্রতি মযবুতভাবে ঈমান রাখবে। সূরা ইমরান: ১১০
وَكَذَلِكَ جَعَلْنَكُمْ وَّسَطًا لَتِكُوْنُوْا شُهَدَا ءَ عَلَى النَّاسِ ـ
আর এরূপে আমরা তোমাদেরকে (সর্বশ্রেষ্ঠ) জাতিতে পরিণত করেছি, যাতে তোমরা সকল মানুষ সম্পর্কে সাক্ষ্য দিতে পার।
সূরা আল বাকারা:১৪৩
وَعَدَ اللهُ الَّذِيْنَ امَنُوْا مِنْكُمْ وَعَمِلُوْا الصلِحتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِيْ الاَرْضِ النُوْر: 55
তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনবে এবং নেক কাজ করবে তাদের কাছে আল্লাহ ওয়াদা করেছেন যে, নিশ্চয়ই তিনি তাদের যমীনের বুকে তার খলীফা বানাবেন। সূরা আন নূর: ৫৫
وَقَاتِلُوْهُمْ حَتّى لاَتَكُوْنَ فِتْنَةٌ وَّيَكُوْنَ الدِّيْنُ كُلُّهُ لِلَّهِ ـ
এই কাফেরদের সাথে লড়াই করো, যেন শেষ পর্যন্ত ফেতনা খতম হয়ে যায় এবং দ্বীন পুরোপুরিভাবে আল্লাহরই জন্য হয়ে যায়। সূরা আনফাল: ৩৯”
এ উদ্দেশ্য সফল করার জন্য ঘড়ির যন্ত্রাংশের ন্যায় ইসলামেও অনেক কলকজা জমা করা হয়েছে। ইসলামের আসল উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সেগুলো যেমন দরকারী, তেমনি পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণও। ইসলামের মৌলিক মতবাদ, আকায়েদ, নৈতিক চরিত্রের নিয়ম-নীতি, কাজ-কারবার, আদান-প্রদানের কায়দা-কানুন, আল্লাহর হক, মানুষের হক, নিজের হক, কামাই-রোযগার এবং খরচ করার রীতিনীতি, যুদ্ধ-জিহাদের নিয়ম-পন্থা, সন্ধি-সমঝোতার নিয়ম প্রণালী, রাষ্ট্র পরিচালনার বিধান-পদ্ধতি এবং ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনতা স্বীকার করে বসবাস করার নিয়ম-এসবগুলোই ইসলামের অঙ্গ-ইসলামের ছোট ছোট যন্ত্রাংশ এবং এগুলোকে ঘড়ির যন্ত্রাংশের ন্যায় একটির সাথে অন্যটিকে এমনভাবে জুড়ে দেয়া হয়েছে যে, চাবি দিলেই তার সবগুলো ঠিকভাবে চলতে শুরু করে-আর এগুলো মিলিতভাবে চলার ফলে এর আসল উদ্দেশ্য ইসলামের প্রাধান্য ও প্রভুত্ব এবং দুনিয়ায় আল্লাহর বিধানের প্রতিষ্ঠা এমন সুন্দর ও ধারাবাহিকতভাবে লাভ হতে থাকে, যেমন ঘড়ির যন্ত্রগুলো চলার ফলে বাইরের সময় নির্দেশকারী কাঁটা সঠিক সময় জ্ঞাপন করে। ঘড়ির বিভিন্ন অংশগুলোকে পরস্পর জুড়ে দেবার জন্য কয়েকটি লোহার পাত ও ছোট ছোট লোহার কাঁটা ব্যবহার করা হয়েছে। ঠিক তেমনি ইসলামের বিভিন্ন কাজকে পরস্পরকে সাথে যুক্ত রাখার জন্য এবং সেগুলোর সামঞ্জস্যপূর্ণ শ্রেণী বিন্যাস করার জন্য জামায়াত গঠনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মুসলমানদের এ জামায়াতের এমন একজন নেতা হবে যার মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও বোধশক্তি এবং তাকওয়া-পরহেযগারীর বৈশিষ্ট্য বর্তমান থাকবে; জামায়াতের কর্মীগণ তার কথা মেনে চলবে, তার কথা অনুসারে কাজ করবে। নেতা তাদের মিলিত শক্তির সাহায্যে লোকদের ওপর ইসলামী আইন জারী করবে এবং তাদের ইসলামী আইনের বিরোধিতা হতে বিরত রাখবে। এভাবে ইসলামের সবগুলো অংশ যখন পরষ্পর যুক্ত হবে সেগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্যপূর্ণ শ্রেণীবিন্যাস কায়েম করা হবে, তখন তাতে গতি আনার জন্য সেগুলোকে ঠিকমত চালাবার জন্য তাতে চাবি দেয়া আবশ্যক হয়। বস্তুত ইসলামী জীবনব্যবস্থায় নামায সেই চাবির কাজ করে। দিন-রাত পাঁচবার করে এ এ চাবি দেয়ার কাজ করতে হয়। তারপর এ ঘড়িকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করাও দরকার। সে জন্য রোযা ফরয করা হয়েছে। বছরে একবার করে ত্রিশ দিনের জন্য এটা সেই কাজ সমাধা করে। এ ঘড়িতে তেল দেয়া আবশ্যক, বছরে একবার যাকাত আদায় করে এ তেল দেয়ার কাজ করা হয়। এ তেল বাইর থেকে আমদানী করা হয় না, এ ঘড়িরই কোনো অংশ এটা তৈরি করে এবং অন্যান্য শুকনা অংশগুলোকে চলাবার যোগ্য করে দেয়। ঘড়িকে মাঝে মাঝে ওভারহল করাও দরকার হয়, জীবনে একবার হজ্জ করলে এ ওভারহলিং এর কাজ সম্পন্ন হয়।
এখন সকলেই বুঝতে পারেন, এ চাবি দেয়া, পরিস্কার করা, তেল দেয়া এবং ওভারহলিং করা ঠিক তখনি সার্থক হতে পারে, যখন এ ঘড়ির মধ্যে কেবল ঘড়িরই অংশগুলো পরস্পর যুক্ত ও সুবিন্যস্ত থাকবে, যেভাবে ঘড়ির নির্মাতা তা সাজিয়ে দিয়েছে। ঠিক এমন অবস্থায় চাবি দিলেই তা সঠিকভাবে চলতে পারে এবং ঠিকমত সময় নির্দেশ করতে পারে। একটু চিন্তা করলে বুঝতে পারবেন যে, বর্তমান সময় ইসলামের অবস্থা এদিক দিয়ে বড়ই খারাপ। প্রথমত যে জামায়াত গঠনের সাহায্যে ইসলামের সমস্ত অংশ পরস্পর জুড়ে দেয়া হয়েছিল, সেই জামায়াতের অস্তিত্ব এখন নেই। ফলে সব অংশেগুলোই আলাদা আলাদা হয়ে গেছে। ঐক্য শক্তি বিলুপ্ত হয়েছে। এখন যার যা ইচ্ছা সে তাই করে যাচ্ছে। কেউ বাধা দেবার নেই, সঠিক পথ দেখাবার কেউ নেই। ইচ্ছা হলে ইসলামের আইন মেনে চলে, না হয় ইসলাম ত্যাগ করে ভিন্ন পথ অনুসরণ করে আজকের মুসলমান এখানেই ক্ষান্ত হয়নি। বরং তারা এ ঘড়ির অনেকগুলো অংশ বের করে নিজ নিজ ইচ্ছামত অনেক অংশ এতে যোগ করেছে, যা কোনক্রমেই এ ঘড়ির অংশ হতে পারে না। কেউ সিঙ্গার মেশিনের অংশ ঢুকিয়ে দিয়েছে, কেউ আটা কলের এক অংশ তাতে লাগিয়ে দিয়েছে, আবার কেউ কেউ মোটর গাড়ীর কতক অংশ তাতে লাগিয়ে দিয়েছে, আবার কেউ কেউ মোটর গাড়ীর কতক অংশ নিজের পছন্দ অনুসারে সন্ধান করে এনে এতে জুড়ে দিয়েছে। এখন এর একদিকে মুসলমান, অন্যদিকে সুদী কারবার চালাচ্ছে, ইন্সিওরেন্স কোম্পানীতে জীবন বীমা করেছে, ইংরেজী আইনের ভিত্তিতে গড়া আদালতে মিথ্যা মোকদ্দমা চালাচ্ছে। কাফেরদের অনুগত হয়ে তাদের খেধমত করছে। নিজেদের মেয়ে, বোন আর স্ত্রীদেরকে মেম বানাচ্ছে। নিজেদের সন্তানদেরকে জড়বাদী শিক্ষা দান করছে। এদিকে মার্কস ও লেলিনের অনুকরণ করাচ্ছে এবং অন্যদিকে বৃটেন ও আমেরিকার নীতিও স্বীকার করাচ্ছে। মোটকথা, ইসলাম বিরোধী অসংখ্য জিনিস এনে স্বয়ং মুসলমানগণই ইসলামের এ ঘড়ির সাথে জুড়ে দিয়েছে।
এসব অবাঞ্ছনীয় কাজ করার পরওযদি কেউ আশা করে যে, চাবি দিলেই ঘড়ি ঠিকমত চলবে, আর যে উদ্দেশ্যে ঘড়ি বানানো হয়েছে, সেই উদ্দেশ্যও এটা দ্বারা হাসিল হবে, আর পরিচ্ছন্ন করে তেল দেয়া এবং ওভারহলিং করায় যে ফল পাওয়া উচিত, তাও যদি কেউ এটা দ্বারা পেতে চায়, তবে তাকে চরম নির্বোধ ছাড়া কি-ই বা বলা যেতে পারে। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই অনায়াসে বুঝা যায় যে, বর্তমানে এ ঘড়ির (ইসলামের) যে দশা হয়েছে, তাতে জীবন ভর চাবি দিলে, সাফ করলে এবং তেল দিতে থাকলেও এর আসল উদ্দেশ্য কিছুতেই হাসিল হতে পারে না। কাজই যতক্ষণ পর্যন্ত অন্য মেশিনের অংশগুলো এর মধ্যে থেকে বের করা না হবে এবং সেই স্থানে এর আসল অংশগুলো এর মধ্যে থেকে বের করা না হবে এবং সেই স্থানে এর আসল অংশগুলো যতক্ষণ পর্যন্ত ঠিকভাবে সাজিয়ে দেয়া না হবে-প্রথম ঘড়ি প্রস্তুত করার সময় যেমন সাজান হয়েছিল-ততক্ষণ পর্যন্ত এর দ্বারা প্রকৃত উদ্দেশ্য লাভ করার কোনো আশাই করা যায় না।
বিষয়টি খুব ভাল করে বুঝে নেয়া আবশ্যক। মুসলমানদের নামায, রোযা এবং হজ্জ ও যাকাত সম্পূর্ণরূপে নিষ্ফল হওয়ার কারণ এটাই। প্রথমত তাদের মধ্যে খুব কম লোকই রীতিমত নামায আদায় করে, রোযা রাখে, যাকাত দেয় ও হজ্জ করে। জামায়াতী বন্ধন ও শৃংখলা চূর্ণ হয়ে যাওয়ার ফলে সমাজের প্রত্যেকটি মানুষ একেবারে স্বেচ্ছাচারী হয়ে গিয়েছে। ইসলামের এ ফরযগুলো কেউ আদায় করছে কিনা তা জিজ্ঞেস করার কেউ নেই। অতপর যারা তা আদায় করে তারাইবা কিভাবে আদায় করে। আজ জামায়াতের সাথে নামায পড়ার প্রচলন প্রায় নেই, কোথাও জামায়াতের ব্যবস্থা থাকলেও সেখানকার মসজিদে এমন লোককে ইমাম নিযুক্ত করা হয়, যার দ্বারা দুনিয়ার অন্য কোনো কাজ সমাধা হতে পারে না-সেই যোগ্যতা ও তার নেই। যারা মসজিদের রুটি খায়, দ্বীনি ফরয পালন করাকে যারা একটি রোযগারের উপায় বলে মনে করে, যারা জ্ঞান ও ইলমের ক্ষেত্রে পশ্চাদপদ, নৈতিক শক্তিহীন এবং চরিত্রের দিক দিয়ে বড় অনগ্রসর, অধিকাংশ সেই শ্রেণীর লোকদেরকেই ধরৈ মসজিদের ইমাম বানিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ সকল মুসলমানকে আল্লাহর খাঁটি খলীফা আর দুনিয়ার আল্লাহর দৈনিক পরিণত করার উদ্দেশ্যেই এ ইমাম নিযুক্তির নিয়ম করা হয়েছিল। এভাবে নামায, রোযা, যাকাত ও হজ্জের যে অবস্থা আজকাল হয়েছে, তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়।
এতসব সত্ত্বেও অনেকে বলতে পারে যে, আজকাল অনেক মুসলমান ফরয আদায় করছে, আপন আপন কর্তব্য যথারীতি পালন করছে। কিন্তু ওপরে যেমন বলা হয়েছে, ঘড়ির কতক অংশ বের করে দিয়ে সেই স্থানে অন্য মেশিনের কতকগুলো অংশ জুড়ে দেয়ার পরে তাতে চাবি দেয়া না দেয়া, সাফ করা না করা এবং তেল দেয়া না দেয়া একই কথা-সবই একেবারে নিষ্ফল এবং অর্থহীন। দূর হতে দেখলে তো এটাকে ঘড়ি বলেই মনে হবে। বাহির থেকে কেউ দেখে অবশ্যই বলবে যে, এটাই ইসলাম এবং আপনারা মুসলমান। আপনারা যখন এ ঘড়িতে চাবি দেন বা তা সাফ করেন, তখন দূর থেকে দেখে লোকজন মনে করে যে, আপনারা ঠিক মতই চাবি দিচ্ছেন আর সাফ করছেন। কেউ বলতে পারে না যে, এটা নামায নয়, এটা রোযা নয় কিন্তু এর ভিতরে যে কি আছে, তা বাহির থেকে যারা দেখবে তারা কেমন করে বুঝবে?
আজ মুসলমানদের দ্বীনি কাজ-কর্ম নিষ্ফল হচ্ছে কেন? তার মূল কারণ আমি আপনাদের সামনে স্পষ্টভাবেই প্রকাশ করলাম। একথাও বুঝিয়ে দিলাম যে, মুসলমানগণ নামায পড়ে আর রোযা রেখেও আল্লাহর সৈনিক হতে পারছে না কেন; বরং তারা কাফেরদের খাদেম ও অন্ধভাবে তাদের পদাংক অনুসরণকারী এবং নানাভাবে মযলুম হচ্ছে কেন? যদি কিছু মনে না করেন তাহলে এটা অপেক্ষাও অনেক দু:খের কথা আমি বলতে পারি। বর্তমান দুরবস্থার জন্য মুসলমানদের দিলে নিশ্চয়ই দু:খ বা কষ্ট আছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এটাও সত্য যে, বর্তমান মুসলমানদের মধ্যে হাজারে নয়শত নিরানব্বইজন বরং তার চেয়েও বেশী লোক রয়েছে যারা এ দুরবস্থা দূর করার জন্য চেষ্টা করতে মোটেই রাজি নয়। ইসলামের এ ঘড়ির ভিতরের কলকজা পরষ্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং প্রত্যেকেই নিজেদের মর্জী মত এক একটা নূতন অংশ এতে লাগিয়ে দিয়েছে, একে সংশোধন করতে অর্থাৎ অন্য মেশিনেরর অংশগুলো বের করে এবং এর আসল অংশগুলোকে যথাযথ সাজিয়ে একে ঠিক করতে আজ মুসলমানগণ সম্পূর্ণ নারাজ। এমনকি, কেউ তা করতে চাইলেও এরা তাকে বরদাশত পর্যন্ত করতে পারবে না। কারণ অন্য মেশিনের জিনিসগুলো যখন এর মধ্যে থেকে বের করা হবে, তখন প্রত্যেকরেই প্রিয় জিনিস বের হয়ে যাবে। কিন্তু অপর লোকদের প্রিয় জিনিস তা তাতে থাকতে দেয়া হবে, এটা তো হতে পারে না। এভাবে তার আসল অংশগুলো যখন ঠিকমত সাজিয়ে মযবুত করে বাঁধা হবে তখন সেই সাথে নিজেরাও বন্দী হয়ে পড়বে বলে এদের ভয় হচ্ছে। কেননা, সকলকে শক্ত করে বাঁধলে একজনকেও নিশ্চয়ই মুক্ত ও অবাধ রাখা যেতে পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য তারা চায় যে, এ ঘড়ি যেমন আছে তেমনি ঝুলতে থাকুক, আর দূর হতে লোকের দেখে এটাকে ঘড়ি মনে করে প্রতারিত হতে থাকুক। পক্ষান্তরে যারা এহেন অকর্মণ্য ঘড়িকে অত্যন্ত ভালোবাসে, তারা এতে খুব ঘন ঘন চাবি দিতে আর একে সাফ করতেই মশগুল। কিন্তু কোনো দিন ভুলক্রমে এর অংশগুলো ঠিকমত সাজাতে এবং অন্য মেশিনের জিনিসগুলো বের করে ফেলতে প্রস্তুত হবে না, এটা সত্যই দু:খের কথা।
আমি যদি আপনাদের এরূপ মতে সায় দিতে পারতাম তাহলে কোনো কথা ছিল না। কিন্তু আমি তা পারছি না। যে সত্য আমি জানতে পেরেছি, তার বিরুদ্ধে কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি, বর্তমান অবস্থায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সাথে তাহাজ্জুদ, এশরাক, চাশত প্রভৃতি নামাযও যদি পড়া হয়, পাঁচ ঘন্টা করে দৈনিক কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করা হয়, রমযান শরীফ ছাড়াও বছরে অবশিষ্ট এগার মাসের সাড়ে পাঁচ মাসও যদি রোযা রাখা হয় তবুও কোনো ফল হবে না। তবে ঘড়ির মধ্যে তার আসল কলকজা রেখে ঠিকমত সাজানোর পরে সামান্য একটু চাবি দিলেই তা চলতে থাকবে, আর সঠিকভাবে সময়ও নির্দেশ করতে পারবে। তখন খানিকটা সাফ করা আর কয়েক ফোটা তেল দিলেও অনেক সুফল লাভ করা যাবে। অন্যথায় সারাজীবন ভরে চাবি দিলেও এ ঘড়ি কখনো চলবে না এবং এর দ্বারা আসল উদ্দেশ্য লাভ করাও যাবে না।
পূর্বের প্রবন্ধগুলোতে নামাযের যে উপকারিতা ও সুফল দানের কথা আমি নানাভাবে ব্যক্ত করেছি, সেই নামায থেকে বর্তমানে লোকেরা সেই রকম সুফল লাভে সক্ষম হচ্ছে না, এখানে এ প্রশ্নের জবাব দিতে চেষ্টা করবো। বর্তমান যুগে নামায পড়ার পরেও মুসলমান এত লাঞ্চিত ও দুর্বল কেন, তাদের চরিত্র উন্নত হচ্ছে না কেন, একটি অপরাজেয় শক্তিধর আল্লাহর সেনাবাহিনীতে পরিণত হচ্ছে না কেন, দুনিয়ার মধ্যে কাফেরদের বিপক্ষে তারা এত শক্তিহীন ও অবহেলিত কেন? এটা সত্যিই একটি কঠিন প্রশ্ন।
এ প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত জবাব এ হতে পারে যে, মুসলমানগণ আসলে নামাযই পড়ে না, আর পড়লেও ঠিক সেভাবে এবং সেই নিয়মে পড়ে না, যেভাবে আর যে নিয়মে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল পড়তে আদেশ করেছেন। কাজেই যে নামায ঈমানদার ব্যক্তিকে উন্নতির চরম সীমায় পৌঁছাতে পারে, আজিকার মুসলমানগণ বর্তমানের এ নামায হতে সেরূপ সুফল লাভের আশা করতে পারে না। কিন্তু আমি জানি, এতটুকু সংক্ষিপ্ত জবাবে আপনারা পরিতৃপ্ত হবেন না। কাজেই একটু বিস্তারিতভাবেই এর জবাব এর জবাব দেয়া আবশ্যক।
এই যে (মসজিদে) একটি দেয়াল ঘড়ি ঝুলছে, আপনি জানেন যে, এতে অনেক যন্ত্রাংশ একটি অন্যটির সাথে জড়িত রয়েছে। এতে যখন চাবি দেয়া হয়, তখন প্রত্যেকটি যন্ত্রাংশ নিজ নিজ কাজ শুরু করে এবং সেই সাথে বাইরের কাঁটায় ভিতরের যন্ত্রাংশগুলোর কাজের ফল প্রকাশ হতে থাকে। অর্থাৎ দু’টি কাঁটা ঘুরে ঘুরে সেকেন্ডর পর সেকেন্ড মিনিটের পর মিনিট বানিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বানাতে থাকে। এখন চিন্তা করে দেখুন, ঘড়ি বানাবার উদ্দেশ্য কি? ঠিকভাবে সময় জানানই যে তার একমাত্র উদ্দেশ্য, একথা সকলেই জানেন। এজন্যই সঠিক সময় নির্দেশ করতে পারে এমন সব ছোট ছোট যন্ত্রাংশ এর মধ্যে একত্র করা হয়েছে। তারপর সেগুলোকে পরস্পর জুড়ে দেয়া হয়েছে। যেন সবগুলো মিলে যথারীতি চলতে থাকে এবং প্রত্যেকটি অংশ যেন সঠিক সময় জানাবার জন্য যতটুকু কাজ করা দরকার ঠিক ততটুকু কাজ করে-বেশী নয়, কমও নয়। পুনরায় তাতে চাবি দিবার নিয়ম করা হয়েছে। কেননা, চাবি না দিলে যন্ত্রাংশগুলো থেকে যাবে, তা সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে না। তাই নির্দিষ্ট সময়ের পরে চাবি দিয়ে তাকে গতিশীল করে দেয়া হয়। ফলে সবগুলো যন্ত্রাংশ চলতে শুরু করে। এগুলোকে যখন ঠিকাভাবে জুড়ে দেয়া হয় এবং তাতে চাবি দেয়া হয়, ঠিক তখনই যে উদ্দেশ্যে তা তৈরী হয়েছে তা এ ঘড়ি দ্বারা লাভ করা যেতে পারে। কিন্তু যদি ঠিকমত চাবি দেয়া না হয়, তবে তা ঠিকভাবে সময় নির্দেশ করতে পারবে না। যদি চাবি দেয়াও হয়, কিন্তু নিয়মানুসারে না দেয়া হয়, তাহলে ঘড়ি বন্ধ হয়ে যাবে কিংবা চললেও ঠিকমত সময় নির্দেশ করতে পারবে না। যদি এর কোন কোনো অংশ বের করে দিয়ে চাবি দেয়া হয়, তবে সে চাবি দেয়ায় কোনো ফলই হবে না। আর যদি এর কোনো অংশ বের করে সেখানে সিঙ্গার সেলাই মেশিনের অংশ লাগিয়ে দেয়া হয় এবং চাবি দেয় হয়, তথাপি তা সময় নির্দেশ করতে পারবে না; ওদিকে কাপড় সেলাই করার কাজও তার দ্বারা সম্ভব হবে না। এর সবগুলো যন্ত্রাংশ যদি একটিকে অন্যটি থেকে আলাদা করে এর মধ্যে রাখা হয়, তবে চাবি দিলেও তা চলবে না। প্রকাশ্যভাবে দেখতে গেলে তো বলতে হবে যে, ঘড়ির সব যন্ত্রাংশই এর মধ্যে আছে, কিন্তু যন্ত্রাংশ কেবল এর মধ্য কেবল এর মধ্যে থাকলেই তো আর এর উদ্দেশ্য হাসিল হতে পারে না। কারণ, এদের পরস্পরের সাথে কোন যোগ নেই এবং শ্রেণীবিন্যাস করে সেগুলোকে ঠিকমত সাজানও হয়নি। তাই সেগুলো পরস্পর চলতে পারছে না। এখানে যেসব অবস্থার কথা বলা হলো তাতে যদিও ঘড়িটি কোনো কাজ করবে না এবং তাতে চাবি দেয়া নিষ্ফল হবে তবুও বাইরের লোক তা দেখে কিছুই বুঝতে পারবে না যে, এটা দেখতে ঠিক ঘড়ির মতোই এবং সে জন্য ঘড়ি দ্বারা যে উদ্দেশ্য লাভ হয়, তাই পাওয়ার আশা করবে এজন্যই দূর থেকে তারা যখন দেখবে যে, আপনি ঘড়িতে ঠিক তাই পাওয়ার আশা করবে। কিন্তু এর ভিতর যখন ঘড়ির ঠিক অবস্থা বর্তমান নেই তখন বাহির থেকে ঘড়ির মত দেখালে কি হবে? এর দ্বারা আসল ঘড়ির কাজ পাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়।
ঘড়ির যে উদাহরণ আপনাদের সামনে পেশ করলাম, তা দ্বারা আপনারা সমস্ত ব্যাপারটা পরিস্কারভাব বুঝতে পারলেন। ইসলামকে এ ঘড়ির মত মনে করুন, ঘড়ির উদ্দেশ্য যেমন সঠিক সময় নির্দেশ করা, তেমনি ইসলামেরও উদ্দেশ্য এই যে, মানুষ এ দুনিয়াতে আল্লাহর খলীফা- আল্লাহর সৈনিকরূপে বসবাস করবে। নিজেরা আল্লাহর হুকুম অনুসারে চলবে, অন্যকেও আল্লাহর বিধানের অধীন পরিচালিত করবে।
কুরআন শরীফে একথাটি পরিস্কার বলা আছে:
كُنْتُمْ خَيْرَ اُمَّةٍ اُخْرِجََتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَ تَنْهَوْنَ عِنْ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ ط ـ عمران:
তোমরা সেই সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি, যাদেরকে সমগ্র মানুষের কল্যাণের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমাদের কাজ এই যে, তোমরা সকল মানুষকে ন্যায় কাজের আদেশ করবে, সকল অন্যায় কাজ থেকে মানুষকে ফিরাবে এবং আল্লাহর প্রতি মযবুতভাবে ঈমান রাখবে। সূরা ইমরান: ১১০
وَكَذَلِكَ جَعَلْنَكُمْ وَّسَطًا لَتِكُوْنُوْا شُهَدَا ءَ عَلَى النَّاسِ ـ
আর এরূপে আমরা তোমাদেরকে (সর্বশ্রেষ্ঠ) জাতিতে পরিণত করেছি, যাতে তোমরা সকল মানুষ সম্পর্কে সাক্ষ্য দিতে পার।
সূরা আল বাকারা:১৪৩
وَعَدَ اللهُ الَّذِيْنَ امَنُوْا مِنْكُمْ وَعَمِلُوْا الصلِحتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِيْ الاَرْضِ النُوْر: 55
তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনবে এবং নেক কাজ করবে তাদের কাছে আল্লাহ ওয়াদা করেছেন যে, নিশ্চয়ই তিনি তাদের যমীনের বুকে তার খলীফা বানাবেন। সূরা আন নূর: ৫৫
وَقَاتِلُوْهُمْ حَتّى لاَتَكُوْنَ فِتْنَةٌ وَّيَكُوْنَ الدِّيْنُ كُلُّهُ لِلَّهِ ـ
এই কাফেরদের সাথে লড়াই করো, যেন শেষ পর্যন্ত ফেতনা খতম হয়ে যায় এবং দ্বীন পুরোপুরিভাবে আল্লাহরই জন্য হয়ে যায়। সূরা আনফাল: ৩৯”
এ উদ্দেশ্য সফল করার জন্য ঘড়ির যন্ত্রাংশের ন্যায় ইসলামেও অনেক কলকজা জমা করা হয়েছে। ইসলামের আসল উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সেগুলো যেমন দরকারী, তেমনি পরস্পর সামঞ্জস্যপূর্ণও। ইসলামের মৌলিক মতবাদ, আকায়েদ, নৈতিক চরিত্রের নিয়ম-নীতি, কাজ-কারবার, আদান-প্রদানের কায়দা-কানুন, আল্লাহর হক, মানুষের হক, নিজের হক, কামাই-রোযগার এবং খরচ করার রীতিনীতি, যুদ্ধ-জিহাদের নিয়ম-পন্থা, সন্ধি-সমঝোতার নিয়ম প্রণালী, রাষ্ট্র পরিচালনার বিধান-পদ্ধতি এবং ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনতা স্বীকার করে বসবাস করার নিয়ম-এসবগুলোই ইসলামের অঙ্গ-ইসলামের ছোট ছোট যন্ত্রাংশ এবং এগুলোকে ঘড়ির যন্ত্রাংশের ন্যায় একটির সাথে অন্যটিকে এমনভাবে জুড়ে দেয়া হয়েছে যে, চাবি দিলেই তার সবগুলো ঠিকভাবে চলতে শুরু করে-আর এগুলো মিলিতভাবে চলার ফলে এর আসল উদ্দেশ্য ইসলামের প্রাধান্য ও প্রভুত্ব এবং দুনিয়ায় আল্লাহর বিধানের প্রতিষ্ঠা এমন সুন্দর ও ধারাবাহিকতভাবে লাভ হতে থাকে, যেমন ঘড়ির যন্ত্রগুলো চলার ফলে বাইরের সময় নির্দেশকারী কাঁটা সঠিক সময় জ্ঞাপন করে। ঘড়ির বিভিন্ন অংশগুলোকে পরস্পর জুড়ে দেবার জন্য কয়েকটি লোহার পাত ও ছোট ছোট লোহার কাঁটা ব্যবহার করা হয়েছে। ঠিক তেমনি ইসলামের বিভিন্ন কাজকে পরস্পরকে সাথে যুক্ত রাখার জন্য এবং সেগুলোর সামঞ্জস্যপূর্ণ শ্রেণী বিন্যাস করার জন্য জামায়াত গঠনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মুসলমানদের এ জামায়াতের এমন একজন নেতা হবে যার মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও বোধশক্তি এবং তাকওয়া-পরহেযগারীর বৈশিষ্ট্য বর্তমান থাকবে; জামায়াতের কর্মীগণ তার কথা মেনে চলবে, তার কথা অনুসারে কাজ করবে। নেতা তাদের মিলিত শক্তির সাহায্যে লোকদের ওপর ইসলামী আইন জারী করবে এবং তাদের ইসলামী আইনের বিরোধিতা হতে বিরত রাখবে। এভাবে ইসলামের সবগুলো অংশ যখন পরষ্পর যুক্ত হবে সেগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্যপূর্ণ শ্রেণীবিন্যাস কায়েম করা হবে, তখন তাতে গতি আনার জন্য সেগুলোকে ঠিকমত চালাবার জন্য তাতে চাবি দেয়া আবশ্যক হয়। বস্তুত ইসলামী জীবনব্যবস্থায় নামায সেই চাবির কাজ করে। দিন-রাত পাঁচবার করে এ এ চাবি দেয়ার কাজ করতে হয়। তারপর এ ঘড়িকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করাও দরকার। সে জন্য রোযা ফরয করা হয়েছে। বছরে একবার করে ত্রিশ দিনের জন্য এটা সেই কাজ সমাধা করে। এ ঘড়িতে তেল দেয়া আবশ্যক, বছরে একবার যাকাত আদায় করে এ তেল দেয়ার কাজ করা হয়। এ তেল বাইর থেকে আমদানী করা হয় না, এ ঘড়িরই কোনো অংশ এটা তৈরি করে এবং অন্যান্য শুকনা অংশগুলোকে চলাবার যোগ্য করে দেয়। ঘড়িকে মাঝে মাঝে ওভারহল করাও দরকার হয়, জীবনে একবার হজ্জ করলে এ ওভারহলিং এর কাজ সম্পন্ন হয়।
এখন সকলেই বুঝতে পারেন, এ চাবি দেয়া, পরিস্কার করা, তেল দেয়া এবং ওভারহলিং করা ঠিক তখনি সার্থক হতে পারে, যখন এ ঘড়ির মধ্যে কেবল ঘড়িরই অংশগুলো পরস্পর যুক্ত ও সুবিন্যস্ত থাকবে, যেভাবে ঘড়ির নির্মাতা তা সাজিয়ে দিয়েছে। ঠিক এমন অবস্থায় চাবি দিলেই তা সঠিকভাবে চলতে পারে এবং ঠিকমত সময় নির্দেশ করতে পারে। একটু চিন্তা করলে বুঝতে পারবেন যে, বর্তমান সময় ইসলামের অবস্থা এদিক দিয়ে বড়ই খারাপ। প্রথমত যে জামায়াত গঠনের সাহায্যে ইসলামের সমস্ত অংশ পরস্পর জুড়ে দেয়া হয়েছিল, সেই জামায়াতের অস্তিত্ব এখন নেই। ফলে সব অংশেগুলোই আলাদা আলাদা হয়ে গেছে। ঐক্য শক্তি বিলুপ্ত হয়েছে। এখন যার যা ইচ্ছা সে তাই করে যাচ্ছে। কেউ বাধা দেবার নেই, সঠিক পথ দেখাবার কেউ নেই। ইচ্ছা হলে ইসলামের আইন মেনে চলে, না হয় ইসলাম ত্যাগ করে ভিন্ন পথ অনুসরণ করে আজকের মুসলমান এখানেই ক্ষান্ত হয়নি। বরং তারা এ ঘড়ির অনেকগুলো অংশ বের করে নিজ নিজ ইচ্ছামত অনেক অংশ এতে যোগ করেছে, যা কোনক্রমেই এ ঘড়ির অংশ হতে পারে না। কেউ সিঙ্গার মেশিনের অংশ ঢুকিয়ে দিয়েছে, কেউ আটা কলের এক অংশ তাতে লাগিয়ে দিয়েছে, আবার কেউ কেউ মোটর গাড়ীর কতক অংশ তাতে লাগিয়ে দিয়েছে, আবার কেউ কেউ মোটর গাড়ীর কতক অংশ নিজের পছন্দ অনুসারে সন্ধান করে এনে এতে জুড়ে দিয়েছে। এখন এর একদিকে মুসলমান, অন্যদিকে সুদী কারবার চালাচ্ছে, ইন্সিওরেন্স কোম্পানীতে জীবন বীমা করেছে, ইংরেজী আইনের ভিত্তিতে গড়া আদালতে মিথ্যা মোকদ্দমা চালাচ্ছে। কাফেরদের অনুগত হয়ে তাদের খেধমত করছে। নিজেদের মেয়ে, বোন আর স্ত্রীদেরকে মেম বানাচ্ছে। নিজেদের সন্তানদেরকে জড়বাদী শিক্ষা দান করছে। এদিকে মার্কস ও লেলিনের অনুকরণ করাচ্ছে এবং অন্যদিকে বৃটেন ও আমেরিকার নীতিও স্বীকার করাচ্ছে। মোটকথা, ইসলাম বিরোধী অসংখ্য জিনিস এনে স্বয়ং মুসলমানগণই ইসলামের এ ঘড়ির সাথে জুড়ে দিয়েছে।
এসব অবাঞ্ছনীয় কাজ করার পরওযদি কেউ আশা করে যে, চাবি দিলেই ঘড়ি ঠিকমত চলবে, আর যে উদ্দেশ্যে ঘড়ি বানানো হয়েছে, সেই উদ্দেশ্যও এটা দ্বারা হাসিল হবে, আর পরিচ্ছন্ন করে তেল দেয়া এবং ওভারহলিং করায় যে ফল পাওয়া উচিত, তাও যদি কেউ এটা দ্বারা পেতে চায়, তবে তাকে চরম নির্বোধ ছাড়া কি-ই বা বলা যেতে পারে। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই অনায়াসে বুঝা যায় যে, বর্তমানে এ ঘড়ির (ইসলামের) যে দশা হয়েছে, তাতে জীবন ভর চাবি দিলে, সাফ করলে এবং তেল দিতে থাকলেও এর আসল উদ্দেশ্য কিছুতেই হাসিল হতে পারে না। কাজই যতক্ষণ পর্যন্ত অন্য মেশিনের অংশগুলো এর মধ্যে থেকে বের করা না হবে এবং সেই স্থানে এর আসল অংশগুলো এর মধ্যে থেকে বের করা না হবে এবং সেই স্থানে এর আসল অংশগুলো যতক্ষণ পর্যন্ত ঠিকভাবে সাজিয়ে দেয়া না হবে-প্রথম ঘড়ি প্রস্তুত করার সময় যেমন সাজান হয়েছিল-ততক্ষণ পর্যন্ত এর দ্বারা প্রকৃত উদ্দেশ্য লাভ করার কোনো আশাই করা যায় না।
বিষয়টি খুব ভাল করে বুঝে নেয়া আবশ্যক। মুসলমানদের নামায, রোযা এবং হজ্জ ও যাকাত সম্পূর্ণরূপে নিষ্ফল হওয়ার কারণ এটাই। প্রথমত তাদের মধ্যে খুব কম লোকই রীতিমত নামায আদায় করে, রোযা রাখে, যাকাত দেয় ও হজ্জ করে। জামায়াতী বন্ধন ও শৃংখলা চূর্ণ হয়ে যাওয়ার ফলে সমাজের প্রত্যেকটি মানুষ একেবারে স্বেচ্ছাচারী হয়ে গিয়েছে। ইসলামের এ ফরযগুলো কেউ আদায় করছে কিনা তা জিজ্ঞেস করার কেউ নেই। অতপর যারা তা আদায় করে তারাইবা কিভাবে আদায় করে। আজ জামায়াতের সাথে নামায পড়ার প্রচলন প্রায় নেই, কোথাও জামায়াতের ব্যবস্থা থাকলেও সেখানকার মসজিদে এমন লোককে ইমাম নিযুক্ত করা হয়, যার দ্বারা দুনিয়ার অন্য কোনো কাজ সমাধা হতে পারে না-সেই যোগ্যতা ও তার নেই। যারা মসজিদের রুটি খায়, দ্বীনি ফরয পালন করাকে যারা একটি রোযগারের উপায় বলে মনে করে, যারা জ্ঞান ও ইলমের ক্ষেত্রে পশ্চাদপদ, নৈতিক শক্তিহীন এবং চরিত্রের দিক দিয়ে বড় অনগ্রসর, অধিকাংশ সেই শ্রেণীর লোকদেরকেই ধরৈ মসজিদের ইমাম বানিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ সকল মুসলমানকে আল্লাহর খাঁটি খলীফা আর দুনিয়ার আল্লাহর দৈনিক পরিণত করার উদ্দেশ্যেই এ ইমাম নিযুক্তির নিয়ম করা হয়েছিল। এভাবে নামায, রোযা, যাকাত ও হজ্জের যে অবস্থা আজকাল হয়েছে, তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়।
এতসব সত্ত্বেও অনেকে বলতে পারে যে, আজকাল অনেক মুসলমান ফরয আদায় করছে, আপন আপন কর্তব্য যথারীতি পালন করছে। কিন্তু ওপরে যেমন বলা হয়েছে, ঘড়ির কতক অংশ বের করে দিয়ে সেই স্থানে অন্য মেশিনের কতকগুলো অংশ জুড়ে দেয়ার পরে তাতে চাবি দেয়া না দেয়া, সাফ করা না করা এবং তেল দেয়া না দেয়া একই কথা-সবই একেবারে নিষ্ফল এবং অর্থহীন। দূর হতে দেখলে তো এটাকে ঘড়ি বলেই মনে হবে। বাহির থেকে কেউ দেখে অবশ্যই বলবে যে, এটাই ইসলাম এবং আপনারা মুসলমান। আপনারা যখন এ ঘড়িতে চাবি দেন বা তা সাফ করেন, তখন দূর থেকে দেখে লোকজন মনে করে যে, আপনারা ঠিক মতই চাবি দিচ্ছেন আর সাফ করছেন। কেউ বলতে পারে না যে, এটা নামায নয়, এটা রোযা নয় কিন্তু এর ভিতরে যে কি আছে, তা বাহির থেকে যারা দেখবে তারা কেমন করে বুঝবে?
আজ মুসলমানদের দ্বীনি কাজ-কর্ম নিষ্ফল হচ্ছে কেন? তার মূল কারণ আমি আপনাদের সামনে স্পষ্টভাবেই প্রকাশ করলাম। একথাও বুঝিয়ে দিলাম যে, মুসলমানগণ নামায পড়ে আর রোযা রেখেও আল্লাহর সৈনিক হতে পারছে না কেন; বরং তারা কাফেরদের খাদেম ও অন্ধভাবে তাদের পদাংক অনুসরণকারী এবং নানাভাবে মযলুম হচ্ছে কেন? যদি কিছু মনে না করেন তাহলে এটা অপেক্ষাও অনেক দু:খের কথা আমি বলতে পারি। বর্তমান দুরবস্থার জন্য মুসলমানদের দিলে নিশ্চয়ই দু:খ বা কষ্ট আছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এটাও সত্য যে, বর্তমান মুসলমানদের মধ্যে হাজারে নয়শত নিরানব্বইজন বরং তার চেয়েও বেশী লোক রয়েছে যারা এ দুরবস্থা দূর করার জন্য চেষ্টা করতে মোটেই রাজি নয়। ইসলামের এ ঘড়ির ভিতরের কলকজা পরষ্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং প্রত্যেকেই নিজেদের মর্জী মত এক একটা নূতন অংশ এতে লাগিয়ে দিয়েছে, একে সংশোধন করতে অর্থাৎ অন্য মেশিনেরর অংশগুলো বের করে এবং এর আসল অংশগুলোকে যথাযথ সাজিয়ে একে ঠিক করতে আজ মুসলমানগণ সম্পূর্ণ নারাজ। এমনকি, কেউ তা করতে চাইলেও এরা তাকে বরদাশত পর্যন্ত করতে পারবে না। কারণ অন্য মেশিনের জিনিসগুলো যখন এর মধ্যে থেকে বের করা হবে, তখন প্রত্যেকরেই প্রিয় জিনিস বের হয়ে যাবে। কিন্তু অপর লোকদের প্রিয় জিনিস তা তাতে থাকতে দেয়া হবে, এটা তো হতে পারে না। এভাবে তার আসল অংশগুলো যখন ঠিকমত সাজিয়ে মযবুত করে বাঁধা হবে তখন সেই সাথে নিজেরাও বন্দী হয়ে পড়বে বলে এদের ভয় হচ্ছে। কেননা, সকলকে শক্ত করে বাঁধলে একজনকেও নিশ্চয়ই মুক্ত ও অবাধ রাখা যেতে পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য তারা চায় যে, এ ঘড়ি যেমন আছে তেমনি ঝুলতে থাকুক, আর দূর হতে লোকের দেখে এটাকে ঘড়ি মনে করে প্রতারিত হতে থাকুক। পক্ষান্তরে যারা এহেন অকর্মণ্য ঘড়িকে অত্যন্ত ভালোবাসে, তারা এতে খুব ঘন ঘন চাবি দিতে আর একে সাফ করতেই মশগুল। কিন্তু কোনো দিন ভুলক্রমে এর অংশগুলো ঠিকমত সাজাতে এবং অন্য মেশিনের জিনিসগুলো বের করে ফেলতে প্রস্তুত হবে না, এটা সত্যই দু:খের কথা।
আমি যদি আপনাদের এরূপ মতে সায় দিতে পারতাম তাহলে কোনো কথা ছিল না। কিন্তু আমি তা পারছি না। যে সত্য আমি জানতে পেরেছি, তার বিরুদ্ধে কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি নিশ্চয় করে বলতে পারি, বর্তমান অবস্থায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের সাথে তাহাজ্জুদ, এশরাক, চাশত প্রভৃতি নামাযও যদি পড়া হয়, পাঁচ ঘন্টা করে দৈনিক কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করা হয়, রমযান শরীফ ছাড়াও বছরে অবশিষ্ট এগার মাসের সাড়ে পাঁচ মাসও যদি রোযা রাখা হয় তবুও কোনো ফল হবে না। তবে ঘড়ির মধ্যে তার আসল কলকজা রেখে ঠিকমত সাজানোর পরে সামান্য একটু চাবি দিলেই তা চলতে থাকবে, আর সঠিকভাবে সময়ও নির্দেশ করতে পারবে। তখন খানিকটা সাফ করা আর কয়েক ফোটা তেল দিলেও অনেক সুফল লাভ করা যাবে। অন্যথায় সারাজীবন ভরে চাবি দিলেও এ ঘড়ি কখনো চলবে না এবং এর দ্বারা আসল উদ্দেশ্য লাভ করাও যাবে না।