সহীহ আক্বীদার মানদন্ডে তাবলীগী নিসাব (প্রথম পর্ব)

১। তাবলীগী জামাআতের প্রতিষ্ঠাতার পরিচিতি

হিন্দুস্থানের উত্তর পশ্চিম সীমান্তের একটি রাজ্যের এখনকার নাম হবিয়ানা পূর্বের নাম পাঞ্জাব। হিন্দুস্থানের রাজধানী দিল্লীর দক্ষিণে হরিয়ানায় একটি এলাকার নাম মেওয়াত। যার পরিধি দিল্লীর সীমান্ত থেকে রাজস্থান রাজ্যের জয়পুর জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই মেওয়াতে (১৩০৩) হিজরীতে এক হানাফী সূফি বুজুর্গের জন্ম হয়। তাঁর ঐতিহাসিক নাম ‘‘আখতার ইলিয়াস’’। কিন্তু পরবর্তিতে তিনি শুধু ‘ইলিয়াস’ নামে পরিচিত হন। ইনি ১৩২৬ হিজরীতে দেওবন্দ মাদরাসার শাইখুল হাদীস মাহমূদুল হাসান সাহেবের কাছে বুখারী ও তিরমিযী গ্রন্থদয় শ্রবণ করেন। তাঁর দু’বছর পরে ১৩২৮ হিজরীতে তিনি সাহারানপুরের মাযাহিরুল উলুমের শিক্ষক হন। ১৩৪৪ হিজরীতে তিনি দ্বীতীয় বারে হজ্জে যান। এই সময়ে মাদ্বীনায় থাকা কালীন অবস্থায় তিনি (গায়েবী) নির্দেশ পান যে, আমি তোমার দ্বারা কাজ নেব। অত:পর ১৩৪৫ হিজরীতে তিনি দেশে ফিরে এসে মেওয়াতের একটি গ্রামে ‘নাওহে’ তাবলীগী কাজ শুরু করেন। পরিশেষে ১৩৬৩ হিজরীর ২১ শে রজব মোতাবেক ১৩ই জুলাই ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন। (আবুল হাসান আলী রচিত ‘হযরত মাওঃ ইলিয়্যাস আওর উনকী দ্বীনি দাওয়াত, ৪৮, ৫৭,৬১ ও ১৯৩ পৃঃ, গৃহীত ইলিয়্যাসী তাবলীগ দ্বীন ইসলামের তাবলীগ পৃঃ ৯)



২। তাবলীগী নিসাব পরিচিতি

তাবলীগী জামাআতের মূল গ্রন্থ হলো ‘তাবলীগী নিসাব’ তাবলীগ অর্থ প্রচার এবং নিসাব অর্থ নির্দ্দিষ্ট পাঠ্যসূচী অর্থাৎ তাবলীগী নিসাবে যা কিছু আছে তা তাবলীগের অনুসারীদের জন্য নির্দিষ্ট পাঠ্যসূচি এবং পালনীয়। জামাআতের প্রতিষ্ঠাতা জনাব ইলিয়াস এর নির্দেশে ভারতেরই এক রাজ্য উত্তর প্রদেশের সাহারামপুর জেলার কান্ধেলাহ নিবাসী ও মাযাহিরুল উলুম সাহারানপুরের সাবেক শাইখুল হাদীস যাকারিয়া হানফী নয় খানা বই লেখেন উর্দু ভাষায়। বইগুলির সমষ্টিগত পূর্ব নাম তাবলীগী নিসাব এবং বর্তমান ফাযায়েলে আমাল নামে পরিচিত, নয়টি বই এর আলাদা নাম নিম্মরূপ- ১। হেকায়েতে সাহাবা। ২। ফাযায়েলে নামায, ৩। ফাযায়েলে তাবলীগ, ৪। ফাযায়েলে যিকর। ৫। ফাযায়েলে কুরআন, ৬। ফাযায়েলে রমাযান। ৭। ফাযায়েলে দরূদ। ৮। ফাযায়েলে হজ্জ। ৯। ফাযায়েলে সাদাকাত-১ম, ২য় খন্ড। পরবর্তীকালে কোন কারণ না দর্শিয়ে খলিফা ইহতিশামুল হাসান সাহেব রচিত ‘‘মুসলমান’’ কী পুস্তীকা ওযাহিদ ইলাজ’’ নামক বইটি সন্নিবেশিত করা হয়। গ্রন্থগুলি একত্রিত করে তাবলীগী নিসাব বর্তমানে দু’টি গ্রন্থের রূপ দেওয়া হয়েছে, ১ম টি ফাযায়েলে আমল যা ৮ খন্ডে মিলে একটি। আর দ্বিতীয়টি ফাযায়েলে সাদাকাত যা দু’খন্ডে মিলে একটি গ্রন্থ। দু’টি হচ্ছে আম বা অনির্দিষ্ট। এছাড়াও তাদের খাস বা নির্দিষ্ট দু’টি গ্রন্থ আছে একটি ইমাম নবভীর রচিত ‘রিয়াদুস সালেহীন’ যা শুধু আরবদের জন্য খাস বা নির্দিষ্ট গ্রন্থ। অন্যটি জনাব ইলিয়াসের পুত্র মুহাম্মাদ ইউসুফ কান্ধলভী প্রণীত ‘হায়াতুস সাহাবা’ সর্বমোট তাদের নিসাব গ্রন্থ ৫টি তার মধ্যে দুটি আসল বা আম আর দুটি খাস গ্রন্থ।

৩। গ্রন্থ চতুষ্টয়ের অবস্থা : সৌদি আরবের এক বিখ্যাত আলেম আবূ মুহাম্মাদ নাযযার ইবনে ইব্রাহীম আল জাররা বলেন, (ইলিয়াসী) তাবলীগী জামাআত তাঁদের দাওয়াতী কাজে তিনটি কিতাবের উপর নির্ভর করেন। তা হলো :

১। ইমাম নবভীর ‘রিয়াদুস সালেহীন’ যা শুধু মাত্র আরবদের জন্য নিদিষ্ট। (যেহেতু আরবরা জাল যঈফ হাদীস গ্রহণ করে না তাই তাদের জন্য এই বিশুদ্ধ হাদীস গ্রন্থখানা যার মধ্যে অধিকাংশ হাসান ও সহীহ হাদীসের সমাহার ঘটেছে যদিও সামান্য কিছু দূর্বল হাদীস মুহাক্কীকদের নিকট ধরা পড়েছে।

২। মুহাম্মাদ যাকারিয়া কান্ধালভীর ‘তাবলীগী নিসাব’ বা বর্তমান ‘ফাযায়েলের আমল’ যেটি তাবলীগী জামাআতের আসল বই। যা ভারত উপমহাদেশসহ অন্য প্রায় দেশে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। এবং মাসজিদ গুলিতে কুরআন সুন্নাহর তা‘লীমের স্থানে ঐগ্রন্থদয় পঠিত হচ্ছে (ফাযায়েলে আমাল ও সাদাকাত) এই বই এর মধ্যে কুরআনের ও হাদীসের কিছু কথা থাকলেও তার অধিকাংশ অপব্যাখ্রায় ভরপুর। এবং অনেক কথা আছে যা আল কুরআন ও সহীহ হাদীসের সাথে সংঘষিক। এছাড়া গ্রন্থদ্বয়ে বহু জাল ও যঈফ হাদীস ছাড়াও ভ্রান্ত সূফিদের স্বপ্নের কিচ্ছা কাহানীর উদ্ভট তথ্য সহ অনেক শিরক বিদআত যুক্ত ভ্রান্ত আক্বীদার বিষয়ও রয়েছে। যা আমরা সংক্ষিপ্ত হলেও আপনাদের হাতের গ্রন্থটিতে ধরিয়ে দেয়ার চিষ্ঠা করেছি।

৩। মুহাম্মাদ ইলিয়াসের পুত্র মুহাম্মাদ ইউসূফ কান্দালভী প্রনীত হায়াতুস সাহাবা। এর ত্রুটিও আগেরটির মতো মনগড়া কাহিনী এবং জাল ও যঈফ হাদীসে পরিপূর্ণ। (আকফাতুন মাআ জামাআতিত তাবলীগ, ৯-১০ পৃ:, বিয়ায ছাপা, ২য় সংস্কারণ, ১৪১০ হিজরী গৃহীত প্রাগুক্ত ১২ পৃ:)

তাবলীগী নিসাব বা ফাযায়েলে আ‘মালের মধ্যে অনেক স্থানে আমানাতের খিয়ানত

‘তাবলীগী নিসাব’ তথা ‘ফাযায়েলে আ‘মাল’ লেখক জনাব জাকারিয়া উল্লিাখিত গ্রস্থদ্বয়ে অনেক স্থানে আরবী উদ্ধৃতি দিয়েছেন এবং তার উর্দু অনুবাদ তিনি নিজেই করেছেন, অথচ উর্দু তরজমায় তিনি আমানাত দারীর পরিচয় দিতে, ব্যার্থ হয়েছেন। কারণ তিনি আরবী অনুবাদের উদ্ধৃতি সম্পূর্ণটা উর্দুতে করেননি। যেমন ‘ফাযায়েলে নামায’ বইয়ের ‘দুসরী ফাসল’ এর অধীনে সাত নম্বরে তিনি একটি লম্বা হাদীস নকল করেছেন। যার আরবী উদ্ধৃতি ডান দিকে আছে এবং উর্দু অনুবাদ বামের দিকে আছে। আরবী উদ্ধৃতি তিন পৃষ্ঠার কাছাকাছি। অথচ তিনি তিন পৃষ্ঠার অনুবাদ না করে মাত্র দু’ই পৃষ্ঠার অনুবাদ করেছেন এবং এক পৃষ্ঠারও বেশী অনুবাদ করেন নি। অথচ তার অনুবাদ না করা আরবী শব্দগুলোর মধ্যে স্পষ্ট লেখা আছে- ‘কলা ফিল মীযানে হাযা হাদীসুন বাতিলুল।’ অর্থাৎ মিযান গ্রন্থকার বলেন, এই হাদীসটি বাতিল অর্থাৎ জাল হাদীস। (ফাযায়েলে আ‘মালের অন্তর্গত ফাযায়েলে নামায, ২৯,৩০,৩১, ও ৩৭ পৃষ্ঠা গৃহীত দ্বীন ইসলামের তাবলীগ- ১২-১৩)


তাবলীগী জামাআত কী ?

তাবলীগ আরবী শব্দ যার অর্থ প্রচার করা। আর জামাআতও আরবী শব্দ যার অর্থ দল, সঙ্ঘ, সম্প্রদায় ইত্যাদি। অতএব তাবলীগ জামাআত অর্থ হলো প্রচারের দল। প্রচারকারী দল বিভিন্ন রকমের হতে পারে। ইসলাম প্রচারের দলকে ‘ইসলামী তাবলীগী জামাআত’ অথবা ‘দাওয়াতে ইসলামী’ নাম হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু দুনিয়ায় ইসলামের শত্রুরা তো বটেই এমনকি অনেক নামধারী ঈমানের দাবীদাররা ইসলাম শব্দটাকে সহ্য করতে পারে না, তাই মনে হয় তারা ইসলাম শব্দটি বাদ দিয়ে তাবলীগ জামাআত প্রচার করে তার নিসাব প্রতিষ্ঠা করার কৌশল অবলম্বণ করেছেন।

তাবলীগী জামাআত কী প্রচার করে ?

সার্বিকভাবে মূলতঃ তারা পূর্ণাঙ্গ ভাবে ইসলাম প্রচার করে না। তারা ইসলামের কথা মুখে বললেও মূলতঃ তারা মাযহাবের নামে ফিরকা ও তরীকার নামে তাসাউফের দিকে আহবান করে থাকে। ঈমানের দাওয়াতের নামে তারা মুলতঃ ওহাদাতুল ওজুদ অর্থাৎ সর্ব ইশ্বর বাদের দিকে আহবান করে যা মুলতঃ কুফর, মুসলমানদের সালাতের দাওয়াত দেন, সৎ কাজের উপদেশ দেন, ও অসৎ কাজ হতে দূরে থাকার আনুরোধ করেন। কিন্তু সমাজ সংস্কারের জন্য কুরআন জানা ও তাঁর বিধি-বিধানকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কোন চেষ্টা করা হয় না। কুরআনকে শুধু তুতার বুলিরমত তিলাওয়াত পর্যন্ত সিমাবদ্ধ রাখা হয়। তাঁকে অর্থসহ জানা ও তাফসীর জানার প্রতি উৎসাহ তো দূরের কথা উপরন্ত আরো নিরুৎসাহীত করা হয়। বরং অত্যান্ত সন্তারপনে কুরআনকে মাসজিদ থেকে বের করার ইহুদী-নাসারার চক্রান্তে তারা সহযোগী বলে মনে হয়। কারণ মাসজিদ গুলোতে এখন কুরআনের দরস বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় এখন মসজিদে ‘ফাযালেলে আ‘মলের’ তালিম হয়। আল-কুরআনের দরস তারা শুনতে চায় না বরং তারা বলে ১৫টি ভাষায় পারদর্শি না হলে কুরআন বুঝা সম্ভব নয়, এভাবে নানান অজুহাত দেখিয়ে তারা লোকদেরকে কুরআনের পথ থেকে নিবৃত করছে।


তাবলীগী জামাআতের কর্মসূচী

তাঁদের উসূল ছয়টি। যথা :

১। কলেমা ২। নামায ৩। ইলম ও যিকির ৪। ইকরামুল মুসলিমিন ৫। তাসিয়ে নিয়ত ৬। তাবলীগ।

অথচ ইসলামের মূল স্তম্ভ পাঁচটি : ১. ঈমান, ২. সালাত, ৩. যাকাত, ৪. সিয়াম ও ৫. হজ্জ। (মুত্তাফাকুন আলাই)

শুরু থেকেই তাবলীগী জামাআত ইসলামের মূল বুনিয়াদ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে যাত্রা শুরু করেছে। তবে আল কুরআনের আদর্শ বাস্তবায়ন করার জন্য এ ধরণের কর্মসূচী নিয়ে কাজ করা ইসলাম বিরোধী নয়। কিন্তু যদি কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর আদর্শকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র ঐ একই কর্মসূচী নিয়ে সারা জীবন মেহনত চলতে এবং ৬ নাম্বারের সীমাবদ্ধ কর্মসূচীকেই ইসলামের পূর্ণাঙ্গ আদর্শ মনে করে তাহলে তা হবে নেহায়েত অন্যায় এবং ইসলামের প্রতি কুঠারাঘাত। ইসলামের মৌলিক বিষয় বুঝতে হলে আল-কুরআনকে বুঝতে হবে। আল্লাহর সম্পূর্ণ আদেশ নিষেধ, ব্যক্তি জিবন থেকে অন্তর্জাতিক জিবন পর্যন্ত সব কিছুই আল কুরআনে আছে। কিন্তু তাবলীগের মুরুববীরা কুরআনকে আরবীতে পড়ে অনেক ফায়দা (ফযিলত) হাসিলের দাওয়াত দিলেও আল-কুরআন কে বুঝার ব্যাপারে সাধারণ মুসলিম ভাই বোনদেরকে নিরুৎসাহিত করেন এভাবে যে মুফতি মুফস্সীর না হলে এবং ১৫ ভাষায় পান্ডীত্য না থাকলে কুরআন বুঝার চেষ্টা করা ঠিক নয়। অথচ মহান রববুল আলামীন আমাদের কে তাঁর কলাম বুঝার জন্য বার বার উৎসাহীত করেছেন, এবং তিনি বলেছেন- ‘তারা কুরআন নিয়ে কেন গবেষণা করে না, তাদের অন্তরে কি তালা লেগে গেছে?’। (সূরা মুহাম্মদ-২৪)

সূরা কমারে ৪বার তিনি বলেন, ‘আমি বুঝার জন্য কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি কেউ বুঝতে চায়’ অথচ আমাদের তাবলীগী মুরুবিবরা বলেন কুরআর বুঝা সহজ নয়। এভাবে তারা অত্যন্ত সন্তরপনে সুকৌশলে মুসলিম হৃদয় থেকে আল কুরআনকে বিদায় দিয়ে মাসজিদের মধ্যে থেকে আল-কুরআনের দারস বন্ধ করে তাবলীগী নিসাব বা ফাযায়েলে আমালের তা‘লীম প্রতিষ্ঠা করার ইহুদী ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। অথচ আল্লাহ তার নাবী কে মাসজিদে, ঘরে, সর্বত্র আল-কুরআন ও আল হাদীসের তা‘লীম চালু করার নির্দেশ দিয়েছেন। (সূরা জুম‘আহ-২, আহযাব-৩৪)

তারা যে কুরআন বিমুখ জামাআত তা যদি বিশ্বাস না হয় তাহলে লক্ষ করে দেখুন মাসজিদের মিম্বারে আর মেহরাবে এখন আল-কুরআনের পরিবর্তে তাবলীগী নিসাব দেখা যায়, এমন কি অনেক স্থানে আল-কুরআনের উপরে মাসজিদের মধ্যে ঐ কিতাব খানা দেখেছি অনেক বার এবং নিজ হাতে নিচেই রেখেছি। আমার কথার সত্যতা যদি যাচাই করতে চান তাহলে তাবলীগে গিয়ে মুরুবিবদের বলুন আমার চিল্লায় শুধু কুরআনের তাফসীর এবং বুখারী শরীফের তা‘লীম করব তাহলে আপনারা জানতে পারবেন এরা কুরআন বিমূখ জামাত কি না?

তাবলীগী নিসাবের লেখক পরিচিতি

১। জাকারীয়া বিন ইয়াহিয়া ১৩১৫ হিজরী রমযানুল মুবারাক। প্রথম নাম মুহাম্মাদ মুসা প্রসিদ্ধ নাম জাকারীয়া, প্রাথমি শিক্ষা গাংগুহ থেকে বাকী শিক্ষা সাহারানপুর শেষ।

২। মুজাহেরুল উলুম সাহারানপুরে ১৩৩৫হিঃ ১৫ টাকা বেতনে কর্ম বা চাকুরী জীবন শুরু করেন।

৩। ৬ বার হজ্জ পালন করেছেন অতপর ১৯৭৩ সনে মদিনা মুনাওয়ারায় স্থায়ি কিয়াম করেন।

৪। প্রথম স্ত্রীরির ইন্তেকালের পর দ্বিতীয় বিবাহ করেন। ১টি ছেলে ৫টি মেয়ে জন্ম দেন তাদের নাম নিম্নরূপ :

(১) মৌলভী মোঃ তালহা

(২) জাকীয়া, স্ত্রী জনাব ইউসূফ

(৩) জাকেরাহ, স্বামী জনাব ইনামুল হাসান

(৪) শাকেরাহ স্বামী মৌলভী আহমাদ হাসান

(৫) রাশেদা, স্ত্রী মৌলভী সাইদুর রহমান

(৬) শাহেদাহ, স্ত্রী হাকিম মুহাম্মাদ ইলিয়াস

২৪শে ১৯৮২ মদিনা মুনাওয়ারায় মৃত্যু বরণ করেন এবং বাকী কবরস্থানে রশিদ আহমাদ গাঙ্গুহির পাশে দাফন করা হয়।

জনাব জাকারীয়া সর্বমোট ৬৭ টি ছোট বড় গ্রন্থ লিখেছেন, যার মধ্যে তাবলীগী নিসাব অন্যতম যার অপর নাম ফাযায়েলে আ‘মাল ও ফাযায়েলে সদাকাত উল্লিখিত গ্রন্থদ্বয় নিয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

সহীহ আক্বীদার মানদন্ডে তাবলীগী নিসাব

এই হাকীকাত বা বাস্তবতাকে কিভাবে অস্বীকার করা যায় যে, ছোট একটি তাবলীগী জামা‘আত দ্বীনের দা‘ওয়াত নিয়ে হিন্দুস্থানের বতী জনপদ (দিল্লীর) নিজামউদ্দ্বীন থেকে সর্বপ্রথম কাজ শুরু করে এবং পরবর্তীতে ক্রমান্বয়ে গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। এখন প্রত্যেক গ্রামে-গঞ্জে, জনপদে গাস্তের প্রচলন এবং রাতের বেলায় মাসজিদে কিয়াম (অবস্থান) বা শবগুযারী প্রসিদ্ধ। এছাড়া বাংলাদেশের রাজধানীর তুরাগ নদীর তীরে টুঙ্গির ইজতেমায় লক্ষ লক্ষ মানুষের যে গণজমায়েত, পাকিস্তানের শহর লাহোর সংলগ্ন রায়েবন্ডের ইজতিমায় যে জনসমুদ্র দেখা যায়, তা কোন দুনিয়াবী বা পার্থিব উদ্দেশ্যে জমা হয় না। বরং সকলের অন্তরে একটাই পিপাসা বা ব্যাকুলতা আর বাসনা। তা হল আমাদের রব আমাদের প্রতি খুশী হয়ে যাক এবং নাবী (সাঃ) -এর বারাকাতময় তরীকা আমাদের জিন্দেগীতে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এই পথভোলা বা বিপথগামী মানুষগুলো যাতে পুনরায় সঠিক পথের সন্ধান পায় অর্থাৎ সিরাতে মুস্তাকিমের পথ পাক সেই জযবা বা আবেগ ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য তাদেরকে মাজবুর বা বাধ্য করে। স্বীয় মাল সম্পদ খরচ করা, নিজের বিছানা নিজে উঠানো, অলি-গলিতে আল্লাহর যিক্র করা এবং মুখালিফ বা বৈরীর সঙ্গে সদাচরণ ও সহানুভূতি, জযবায়ে ঈছার আত্মদান ও দ্বীনের জন্য ত্যাগ ছাড়াও এই ধরনের অন্যান্য সৎগুণ তাবলীগ জামা‘আতের সাথীদের মধ্যে পাওয়া যায়। এই জাতীয় গুণাবলী একজন মুসলিমের মধ্যে থাকা দরকার বা আবশ্যক। কিন্তু এই সকল গুণাবলী সত্ত্বেও একটি অত্যাবশ্যকীয় এবং মৌলিক বিষয়ে ভুল থেকে যায়, আর তা হল আক্বীদার সংশোধন বা বিশুদ্ধ আক্বীদাহ। আক্বীদাহ যদি সঠিক না হয়, তাহলে সমস্ত নেক ‘আমাল নিস্ফল হয়ে যায়। আর নেক ‘আমালের গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে তাওহীদের বা একত্ববাদের উপর। কারণ তাওহীদ নেই তো কিছুই নেই। মহান আল্লাহ বলেন :

{وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ}

‘‘আপনার প্রতি এবং আপনার পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছে আপনিও যদি আল্লাহ সাথে শরীক স্থাপন করেন তবে আপনার সকল কর্ম নিস্ফল হয়ে যাবে এবং আপনি হবেন ক্ষতিগ্রস্তদের একজন।’’ (সূরা আল-যুমার ৬৫)

চিন্তা করুন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে মনোনীত মা’সুম রসূল (সাঃ) -এর থেকে সুন্দর ‘আমাল আর কার হতে পারে? কিন্তু তাঁর ‘আমালও শির্কের উপস্থিতিতে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হচ্ছে শির্ক মিশ্রিত ‘আমাল তা যতই ভাল হোক না কেন আল্লাহ তা‘আলা তা কখনও গ্রহণ করবেন না। অন্যত্র এই বাস্তবতাকে আল্লাহ তা‘আলা এভাবে ইরশাদ করেন :

{الَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُولَئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُمْ مُهْتَدُونَ}

‘‘যারা ঈমান এনেছে এবং স্বীয় বিশ্বাসকে যুল্ম দ্বারা কলুষিত করেনি, নিরাপত্তা তাদের জন্য এবং এরাই সৎপথপ্রাপ্ত।’’ (সূরা আল-আনআম ৮২)

আলোচ্য আয়াত দ্বারা বুঝা যাচ্ছে শাস্তির কবল থেকে নিরাপদ ও নিশ্চিত এবং হিদায়াতে রাববানির হাক্বদার তারাই, যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, অতঃপর বিশ্বাসের সাথে কোনরূপ যুল্ম এবং শির্ককে মিশ্রিত করে না। [হাদীসে বর্ণিত যে, উক্ত আয়াত নাযিল হলে সহাবায়ে কিরাম (রাযি.) চমকে উঠলেন এবং আরয করলেন : হে আল্লাহর রসূল (সাঃ)! আমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে, পাপের মাধ্যমে যুল্ম করে নি?]

উপরোক্ত আয়াতের শাস্তির কবল থেকে নিরাপদ হওয়ার জন্য বিশ্বাসের সাথে যুল্মকে মিশ্রিত না করার শর্ত বর্ণিত হয়েছে। এমতাবস্থায় আমাদের মুক্তির উপায় কি? মহানাবী (সাঃ) উত্তরে বললেন, তোমরা আয়াতের প্রকৃত অর্থ বুঝতে সক্ষম হওনি, আয়াতে যুল্ম দ্বারা শির্ক বুঝানো হয়েছে। যেমন সূরা লুক্বমানে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

{إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ}

‘‘নিশ্চয়ই শির্ক বড় যুল্ম।’’ (লুক্বমান ১৩)

সুতরাং আয়াতের অর্থ এই যে, যে ব্যক্তি বিশ্বাস স্থাপন করে, অতঃপর আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলীতে কাউকে অংশীদার না করে, সে শাস্তির কবল থেকে নিরাপদ ও সুপথপ্রাপ্ত। হায়! তাবলীগী জামা‘আত যদি আক্বীদাহ সংশোধনের জন্য কিছু কাজ করত! নেক ‘আমালের সঙ্গে সঙ্গে আক্বীদাও কিছু সংশোধন করত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এ সম্পর্কে কোন কাজ হচ্ছে না। তাবলীগী নিসাবের অনেক স্থানে শির্কী কথার বর্ণনা রয়েছে, আমাদের ভয় হয় এগুলো পাঠকের কেউ যেন সঠিক হিসাবে গ্রহণ না করে। যদি এমন করা হয় তাহলে রাবেব কারীমের বর্ণনা শুনুন :

{عَامِلَةٌ نَاصِبَةٌ، تَصْلَى نَاراً حَامِيَةً}

‘‘কর্মক্লান্ত পরিশ্রান্তভাবে (বহু ‘আমালকারীরা) তারা প্রবেশ করবে জ্বলন্ত আগুনে।’’ (সূরা আল-গাশিয়া ৩-৪)

বহু মুজাহাদা, মেহনত এবং কষ্ট করে চিল্লা লাগিয়ে, ঘরবাড়ী ছেড়ে মুসিবাত বরদাস্ত করে মিলল কি? আগুন!!!

অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন :

{قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالاً، الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعاً}

‘‘(হে নাবী!) আপনি বলে দিন, আমি কি তোমাদের ক্ষতিগ্রস্ত ‘আমালকারীদের সম্পর্কে খবর দিব? দুনিয়ার জীবনে যাদের সমস্ত ‘আমাল বরবাদ হয়েছে অথচ তারা ভাবে যে, তারা সুন্দর ‘আমাল করে যাচ্ছে।’’ (সূরা কাহাফ ১০৩-১০৪)

হায় আফসোস! তাবলীগী জামা‘আতের মুরুববীগণ যদি তাবলীগী নিসাব থেকে শির্ক ও বিদ‘আতগুলো বের করে দিত এবং এই নিসাবকে পুনরায় নতুন করে সংশোধন করে সংকলন করত, তাহলে অতী উত্তম হত। এই নিসাবের প্রত্যেকটি বর্ণনাকে (জারাহ তা’দীল অনুযায়ী) শুদ্ধকরণের মাধ্যমে কুরআন মাজীদ এবং সহীহ হাদীসের মানদন্ডে যাচাই করে, যে সকল বিষয়গুলি ভ্রান্ত প্রমাণিত হয় তা বাদ দিয়ে মিথ্যা বর্ণনা এবং যঈফ (দুর্বল) বর্ণনা দ্বারা মানুষের আক্বীদাহ খারাপ না করে এবং বিচ্ছিন্ন মাযহাব থেকে যদি বিরত থাকে, তাহলেই আশা করা যায় যে, দ্বীন দুনিয়ার সফলতা বা কামিয়াবী অর্জিত হবে।

{وَلاَ تَهِنُوا وَلا تَحْزَنُوا وَأَنْتُمُ الأَ<عْلَوْنَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ}

‘‘তোমরা হীন বল হয়ো না, চিন্তিত হয়ো না, তোমরাই জয়ী হবে যদি তোমরা মু’মিন হও।’’ (সূরা আলু ইমরান ১৩৯)

এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনদের সঙ্গে জয়ী এবং কামিয়াবীর ওয়াদা করেছেন। মুশরিকদের সঙ্গে নয়। বুঝা যাচ্ছে আজ আমরা লাঞ্ছনা, অপমান, নিপীড়ন, শোষণ-বঞ্চনার শিকার কারণ আমাদের অধিকাংশই দাবিতে ঈমানদার এবং ভৌগলিক মু’মিন কিন্তু ঈমান শূন্য। যেমন মহান আল্লাহ বলেন :

{وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللهِ إِلاَّ وَهُم مُّشْرِكُونَ}

‘‘তাদের অধিকাংশ আল্লাহকে বিশ্বাস করে কিন্তু তাঁর শরীক করে।’’ (সূরা ইউসূফ ১০৬)

আর যদিও ঈমান কিছু থাকে, তা শির্কের চাদরে আবৃত। এ জাতীয় ঈমান মূলত ঈমানই নয়। এখন তাবলীগী নিসাব থেকে সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করছি। অপরদিকে এর মুকাবিলায় কুরআন এবং সহীহ হাদীস পেশ করছি। এ বিষয়গুলি ফয়সালার ভার আমি পাঠকের উপর অর্পণ করছি।

‘ইল্মে গায়িব বা অদৃশ্যের জ্ঞান

‘‘শায়েখ আবু ইয়াকুব ছনুছী (রহঃ) বলেন, আমার একজন মুরীদ আমার নিকট আসিয়া বলিল আমি আগামী কাল জোহরের সময় মরিয়া যাইব। তাহার কথা মত অপর দিন জোহরের সময় সে হারাম শরীফে আসিল ও তওয়াফ করিল এবং কিছু দূরে গিয়া মরিয়া গেল। আমি তাহকে গোছল দিলাম ও দাফন করিলাম। যখন তাহাকে কবরে রাখিলাম তখন সে চোখ খুলিল। আমি বলিলাম মউতের পরেও কি জীবিত থাকা যায় না কি? সে বললি আমি জীবিত আছি এবং আল্লাহর প্রতিটি প্রেমিকই জীবিত থাকেন।’’ ([রওজ] ফাজায়েলে সাদাকাত বাংলা ২য় খন্ড-২৭০ পৃঃ)

‘‘জনৈক বুজুর্গ বলেন, আমি একজন মুর্দাকে গোছল দিতে ছিলাম। সে আমার বৃদ্ধাঙ্গুলি ধরিয়া ফেলিল, আমি বলিলাম ছাড়িয়া দাও। আমি জানি যে তুমি মর নাই। সে ছাড়িয়া দিল। বিখ্যাত বুজুর্গ এবনুল জালা (রহঃ) বলেন, আমার পিতার যখন এন্তেকাল হয় তাঁহাকে গোছল দিবার জন্য তখতির উপর রাখিতেই তিনি হাসিয়া উঠেন। ইহা দেখিয়া আর কাহাও গোছল দিতে সাহস হইল না। অতঃপর তাঁহার জনৈক বুজুর্গ বন্ধু আসিয়া তাঁহাকে গোছল দিলেন। মৃতুর পরও আনন্দ করার এইরূপ অনেক ঘটনা ছাহেবুর রওজ বর্ণনা করিয়াছেন।’’

(ফাজায়েলে সাদাকাত বাংলা ২য় খন্ড-২৭০ পৃঃ)

দ্বিতীয় আর একটি ঘটনা যা এর সাথে হুবহু মিল আছে :

‘‘আবূ আলী রোদবারী (রহঃ) বলেন, ঈদের দিন একজন ফকির আসিয়া আমাকে বলিল এখানে এমন কোন পরিস্কার জায়গা আছে কি? যেখানে কোন ফকির মরিতে পারে। আমি তাহাকে বাজে কথা মনে করিয়া বলিলাম আস ভিতরে আসিয়া যেখানে ইচ্ছা সেখানে মর। সে ভিতরে আসিয়া অজু করিয়া কয়েক রাকাত নামাজ পড়িল ও মরিয়া গেল। আমি তাহার কাফন দাফনের ব্যবস্থা করি। দাফনের পর আমার খেয়াল হইল দেখতে হবে কাফন হটাইয়া তাহার মুখ খুলিতেই সে চোখ খুলিয়া ফেলিল। আমি বলিলাম মৃত্যুর পরেও জীবন? সে বলিল আমি জীবিত ও আল্লাহর প্রত্যেক আশেকই জীবিত থাকেন। আমি কাল ক্বেয়ামতে স্বীয় প্রতিপত্তিতে তোমার সাহায্য করিব। (ফাজায়েলে সাদাকাত ২য় খন্ড- ২৮০ পৃঃ)

পাঠকবৃন্দ! চিন্তা করে দেখুন যে, এ কিস্সাদ্বয় দ্বারা কিভাবে কুরআন হাকীমের ইনকার অস্বীকার অত্যাবশ্যকীয় বা অপরিহার্য হয় বা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন :

{إِنَّ اللهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الأَ<رْحَامِ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَاذَا تَكْسِبُ غَداً وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ إِنَّ اللهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ}

‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছেই ক্বিয়ামাতের জ্ঞান রয়েছে। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং গর্ভাশয়ে যা থাকে তিনি তা জানেন। কেউ জানে না আগামীকল্য সে কি উপার্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন জায়গায় সে মৃত্যুবরণ করবে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত।’’ (সূরা লুক্বমান ৩৪)

সহীহ বুখারীতে আছে যে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) উক্ত আয়াত তিলাওয়াত করে তার ব্যাখ্যায় বলেন :

{لاَ يَعْلَمُهُنَّ اِلاَّ الله}

‘‘এসব গায়িবের কথা, এগুলো আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। কিন্তু তাবলীগী নিসাবের উপরোক্ত ঘটনা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, একজন মুরিদ এই কথা বলল আগামী দিন যুহরের সময় মরে যাব, আর হলও তাই। সে মুরিদ দ্বিতীয় দিন যুহরের সময় মারা গেল। যেন আগামীদিনের ‘ইল্ম বা জ্ঞান ঐ মুরিদের ছিল। দ্বিতীয় ঘটনায় বর্ণনা করা হয়েছে যে, একজন ফকীরের মৃত্যু জ্ঞান পূর্ব থেকেই ছিল। সে তার নিজের মৃত্যুর জন্য নিজেই জায়গা নির্ধারণ করে নিল এবং যথাস্থানে মরল। এছাড়া দু’টি ঘটনায় এটাও আছে যে, মৃত্যুর পরেও চক্ষু খুলল, কথা বলল এবং বলল, আমি জীবিত এবং আল্লাহর প্রত্যেক বান্দা জীবিত থাকে। শুধু কি তাই শাইখুল হাদীস লিখেছেন, ‘‘জনৈক বুযুর্গ বলেন, আমি একজন মুর্দাকে গোসল দিচ্ছিলাম, সে আমার বৃদ্ধাঙ্গুলি ধরে ফেলিল, আমি বলিলাম, ছাড়িয়া দাও। আমি জানি যে তুমি মর নাই এটা এক ঘর থেকে অন্য ঘরে স্থানান্তর। সে ছেড়ে দিল।’’ (ফাজায়েলে সাদাকাত ২৭০)

পাঠকবৃন্দ! লক্ষ্য করুন, দ্বীন ইসলামে রিওয়ায়াত বর্ণনা করার পদ্ধতি কি এমন? যে জনৈক বুযুর্গ বলেছেন’ অথচ তার নাম নিশানা পর্যন্ত নেই। শেষ পর্যন্ত রিওয়ায়াত বা বর্ণনা করার জন্য কোন উসূলতো বা মূলনীতি থাকা দরকার। পরবর্তীতে আরও লিখেছেন :

‘‘বিখ্যাত বুযুর্গ ইবনুল জালা (রহ:) বলেন, আমার পিতার যখন এন্তেকাল হয় তাঁহাকে গোছল দিবার জন্য তখতির উপর রাখিতেই তিনি হাসিয়া উঠেন। ইহা দেখিয়া আর কাহারও গোছল দিতে সাহস হইল না। অতঃপর তাঁহার জনৈক বুজুর্গ বন্ধু আসিয়া তাঁহাকে গোছল দিলেন। মৃত্যুর পরও আনন্দ করার এইরূপ অনেক ঘটনা ছাহেবুর রওজ বর্ণনা করিয়াছেন।’’ (ফাজায়েলে সাদাকাত ২য় খন্ড- ২৭০)

এ ঘটনা তাবলীগী নিসাবে স্পষ্টত উল্লেখ করা হয়েছে। এর সত্যায়নকারী শাইখুল হাদীস যাকারিয়া। বড়ই আফসোস ও পরিতাপের বিষয় এই ঘটনাগুলির প্রমাণাদিও যদি কুরআন হাদীস থেকে দিত! পাঠক এই ঘটনাগুলি মান্য করলে কুরআনুল কারীমকে সরাসরি অস্বীকার করার মত দৃষ্টতা প্রদর্শন নয় কি? মালিকুল মুল্ক (রাজাধিরাজ) মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ

{إِنَّكَ لا تُسْمِعُ الْمَوْتَى وَلا تُسْمِعُ الصُّمَّ الدُّعَاءَ إِذَا وَلَّوْا مُدْبِرِينَ}

‘‘হে নাবী! আপনি আহবান (কথা) শুনাতে পারবেন না মৃতদেরকে।’’ (সূরা আল-নামল ৮০)

অর্থাৎ যারা কবরস্থ হয়ে গেছে, তাদেরকে আপনি শুনাতে পারবেন না। আল্লাহর নাবী (সাঃ) মুর্দাদের শুনাতে পারেন না। কিন্তু বর্তমানে কোন কোন বুযুর্গ মুর্দাদের শুধু শুনাচ্ছে না, উপরন্তু তাদের সাথে কথোপকথন হচ্ছে এবং মুর্দাও খুব অদূভত মুর্দা সে জিন্দার সঙ্গে কৌতুকও করে এবং হাসি-তামাশাও করে। আর আঙ্গুলও ধরে তারপর যখন এ কথা শুনে যে, ‘তুমি মর নাই’ তখন আঙ্গুল ছেড়ে দেয়।

মহান আল্লাহ বলেন,

{وَمَا يَسْتَوِي الأَ<حْيَاء وَلاَ الأَ<مْوَاتُ}

‘‘আর সমান নয় জীবিত ও মৃত।’’ (সূরা আল-ফাতির ২২)

কিন্তু এখানে জীবিতও কথা বলে এবং মৃতও কথা বলে। জিন্দাও জীবিত এবং মুর্দাও জীবিত অর্থাৎ উভয়েই সমান। পাঠক আপনারা বিবেকের কষ্টি পাথরে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখুন, এরূপ আক্বীদাহ কি উপরোক্ত আয়াতে রাববানীর বিরুদ্ধে নয়? আর কুরআন বিরোধী আক্বীদাহ কি শির্ক নয়? জেনে শুনে শির্কে বিশ্বাসীরা কি মুশরিক নয়? আর যারা উক্ত নিসাবের দা‘ওয়াত দেয়, তারা কি শির্কের দিকে আহবানকারী নয়? যে শির্ক সমূলে উৎপাটিত করার জন্য প্রথম নাবী আদম (‘আ.) থেকে শুরু করে শেষ নাবী মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (সাঃ) পর্যন্ত সকলকেই আল্লাহ রাববুল আলামীন আমাদের মাঝে প্রেরণ করেছেন, আমাদের শির্কমুক্ত জীবন পরিচালনা করার জন্য। অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছি সেই শির্কের দিক নিদের্শনাপূর্ণ বিষয়। এটাই শেষ নয়, শাইখুল হাদীস (রহ.) আরো লিখেছেন নিম্নোক্ত ঘটনা তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ :
মৃত্যুর পরেও দান

‘‘আরবের একটি জমাত কোন এক বিখ্যাত দাতার কবর জেয়ারত করিতে যায়। দূরের পথ ছিল তাই সেখানেই তাহারা রাত্রি যাপন করিল। তন্মধ্যে এক ব্যক্তি সেই কবরওয়ালাকে স্বপ্নে দেখিল যে তিনি বলিতেছেন তুমি আমার বখতি উটের পরিবর্তে তোমার উট বিক্রি করিতে পার? (বখতি উট শ্রেষ্ঠ উটকে বলা হয় যাহা মৃত ব্যক্তি ত্যাজ্য সম্পত্তি হিসাবে রাখিয়া গিয়াছিল) লোকটি ঘুমের মধ্যে রাজী হইল ও বেচা বিক্রি ঠিক হইয়া গেল। নিদ্রা হইতে জাগিয়াই দেখে যে তাহার উটের রক্ত প্রবাহিত হইতেছে। উটটি বাঁচার আশা না দেখিয়া সে নিজেই উট জবেহ করিয়া দিল ও সাথীদের সবাইকে গোশ্ত বন্টন করিয়া দিল। খাওয়া দাওয়ার পর তাহারা রওয়ানা হইয়া যখন সামনের মঞ্জিলে পৌঁছিল তখন বখ্তি উটে ছওয়ার হইয়া এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করিল তোমাদের মধ্যে অমুক ব্যক্তি আছে কি? খাবওয়ালা বলিল ইহাত আমার নাম। সে বলিল আপনি কি বকরওয়ালার নিকট কিছু বিক্রি করিয়োছেন? তিনি স্বপ্নের ঘটনা তাহাকে শুনাইলেন। লোকটি বলিল সেটা আমার পিতার কবর ছিল। তিনি স্বপ্নযোগে আমাকে জানাইয়াছেন তুমি যদি আমার আওলাদ হও তবে আমার বখতি উট অমুক নামের ব্যক্তিকে দিয়া দিও। এই বলিয়া সে উট দিয়া চলিয়া গেল। ছাখাওয়াতের ইহাই হইল চরম সীমা, কবরে থাকিয়াও শ্রেষ্ঠ উট বিক্রি করিয়া মেহমানদারী। তবে এই প্রশ্ন অবান্তর যে ইহা কি করিয়া হতে পারে? কেননা আলমে রুহে এইরূপ ঘটনা সংঘটিত হওয়া সম্ভব।’’ (ফাজায়েলে সাদাকাত ২য় খন্ড-৩১৮ পৃঃ)

পাঠক মহোদয়! ঘটনাটি পুনরায় পড়ুন এবং কুরআন হাদীসের সমাধানের দিকে একটু লক্ষ্য করুন। উক্ত ঘটনা কুরআন হাদীস অস্বীকার করার জন্য যথেষ্ট নয় কি? যখন কুরআন এবং হাদীসের সমন্বিত বা সম্মিলিত মীমাংসা ফায়সালা এই যে, মৃত্যুর পর কেউ এ ধরাতে আর ফিরে আসতে পারে না। শহীদ, যে সাধারণ মুর্দার উপর শ্রেষ্ঠত্ব রাখে, তাকেও দুনিয়াতে পুনরায় প্রত্যাবর্তন করার অনুমতি প্রদান করা হয় না। যদিও সে শাহাদাতের তামান্নায় (আকাঙ্ক্ষায়) দুনিয়াতে বার বার ফিরে আসতে চায়। সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে, মহান আল্লাহ তিনবার শহীদকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার আর কোন কামনা বা বাসনা আছে কি? তোমরা কি কোন কিছুর আকাঙ্ক্ষা কর?

উত্তরে শহীদগণ বলবে :

يا رب نريد ارواحنا في اجسادنا حتى نقتل في سبيلك مرة أخرى فلما رآى ان ليس لهم حاجة تركوا (صحيح مسلم)

‘‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের আকাঙ্ক্ষা এই যে, আপনি আমাদের রূহ্কে পুনরায় আমাদের শরীরে ফিরিয়ে দিন, যেন আমরা পুনরায় কতল হই। যখন আল্লাহ দেখবেন এদের কোন অভিলাষ নেই তখন জিজ্ঞেস করা ছেড়ে দিবেন।’’ (সহীহ মুসলিম- কিতাবুল ঈমান)

জাবির (রাযি.)-এর পিতা আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করেছিলেন :

يارب يحيينى فاقتل فيك ثانية

‘‘হে প্রতিপালক! আমাকে জীবিত করে দিন যেন আমি দ্বিতীয়বার শহীদ হতে পারি।’’ আল্লাহ বলেন :

إنه قد سبق منى انهم لايرجعون (ترمذى ابواب تفسير القران سنده حسن)

‘‘আমার পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্ত প্রথমেই হয়ে গেছে যে, দুনিয়াতে পুনঃপ্রত্যাবর্তন করতে পারবে না।’’ (তিরমিযী, তাফসীর অধ্যায়)

সুপ্রিয় পাঠক! ভেবে দেখুন, দুনিয়াতে আসার অনুমতিই যদি না থাকে তাহলে উক্ত বুযুর্গ কি করে দুনিয়াতে এসে উট যবাহ করেন এবং কিভাবে মেহমানকে দা‘ওয়াত করেন। রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন :

إذا مات الإنسان انقطع عنه عمله الا من ثلاثة من صدقة جارية أو علم ينتفع به أو ولد صالح يدعوله

অর্থাৎ ‘‘যখন কোন মানুষ মারা যায়, তখন তার ‘আমালনামা বন্ধ হয়ে যায় তিনটি ক্ষেত্র ব্যতীত :

(১) সদাকায়ে জারিয়া।

(২) ‘ইল্ম, যার দ্বারা অন্যের উপকার হয় এবং

(৩) নেক সন্তান যে, তার জন্য দু‘আ করে।’’ (সহীহ মুসলিম)

মোটকথা ‘আমালের সিলসিলা যখন বন্ধ হয়ে গেছে, এমতাবস্থায় উক্ত মুর্দা কিভাবে উট যবহ করে এবং কিভাবে মেহমানদারী করে? বলা হয়েছে, এটা আলমে আরওয়াহ অর্থাৎ রূহের জগতের ব্যাপার। কিন্তু পাঠকগণ, একটু ভেবে দেখুন এটা কোথাকার ঘটনা? আরবের ঐ জামা‘আত কি আলমে আরওয়াতে গিয়েছিল? আর উটের গোশ্ত তারা আলমে আরওয়ায় বসে খেয়েছে কি? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর কি এটাই যে, কথাটা শাইখুল হাদীস লিখেছে। সুতরাং সহীহ হবে (?) পাঠক বলুন, এই উত্তর কি ঠিক? এই জাতীয় আর একটি ঘটনার দিকে আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করছি।

শ্রেষ্ঠ দাতা কে ?

তাবলীগী-নিসাবের ফাযায়েলে সদাকাতের ২৪নং শিরোনামে জনাব যাকারীয়া লিখেছেন :

‘‘মিশরে একজন নেক বখত লোক ছিলেন। অভাব গ্রস্থ হইয়া লোক লোক তাহার নিকট আসিলে তিনি চাঁদা উসুল করিয়া তাহাকে দিয়া দিতেন। একদা জনৈক ফকীর আসিয়া বলিল আমার একটা ছেলে হইয়াছে। তাহার এছলাহের ব্যবস্থার জন্য আমার নিকট কিছুই নাই। এই ব্যক্তি উঠিল ও ফকীরকে অনেক লোকের নিকট লইয়া গিয়াও ব্যর্থ হইয়া ফিরিল। অবশেষে নৈরাশ হইয়া একজন দানবীর ব্যক্তির কবরের নিকট গিয়া সমস্ত কথা তাহাকে শুনাইল। অতঃপর সেখান হইতে ফিরিয়া নিজের পকেট হইতে একটা দ্বীনার বাহির করিয়া উহাকে ভাঙ্গাইয়া অর্ধেক নিজে রাখিল ও বাকী অর্ধেক ফকীরকে কর্জ দিয়া বলিল ইহা দ্বারা প্রয়োজন মিটাও। আবার তোমার হাতে পয়সা আসিলে আমার পয়সা আমাকে দিয়া দিও। রাত্রি বেলায় সেই লোকটি কবরওয়াকে স্বপ্নে দেখিল যে সে বলিতেছে আমি তোমার যাবতীয় অভিযোগ শুনিয়াছি কিন্তু বলিবার অনুমতি দেওয়া হয় নাই। তুমি আমার ঘরে গিয়া পরিবারস্থ লোকদিগকে বল ঘরের অমুক অংশে যেখানে চুলা রহিয়াছে, উহার নীচ একটা চীনা বরতনে পাঁচ শত আশরাফী রহিয়াছে তাহারা যেন উহা উঠাইয়া সেই ফকীরকে দিয়া দেয়। ভোর বেলায় সেই কবরওয়ালার বাড়ীতে গেল ও তাহাদিগকে তাহার স্বপ্নের কথা শুনাইল। তাহারা বাস্তবিকই সেখান হইতে পাঁচশত আশরাফী উঠাইয়া ফকীরকে দিয়া দিল। লোকটি বলিল ইহা একটি স্বপ্ন মাত্র। শরীয়ত মতে ইহাতে আমল জরুরী নয়। তোমরা ওয়ারিশ হিসাবে ইহা তোমাদের হক্ব। তারা বলিল, বড়ই লজ্জার ব্যাপার, তিনি মৃত হইয়া দান করিতেছেন আর আমরা জীবিত হইয়াও দান করিব না? অতএব সে টাকা লইয়া ফকীরকে দিয়া দিল ফকীর সেখান হইতে একটা দ্বীনারের অর্ধেক নিজে রাখিল ও অর্ধেক তাহার ঋণ পরিশোধ করিল, তারপর বলিল আমার জন্য একদ্বীনারই যথেষ্ট বাকীগুলি দিয়া আমি কি করিব? সে ঐ গুলি ফকীরদের মধ্যে বণ্টন করিয়া দিল। ছাহেবে এতহাফ্ বলেন, এখানে চিন্তা করিবার বিষয় এই যে সবচেয়ে বড় দাতা হইল কে? কবর ওয়ালা না তার ওয়ারিশান? না ফকীর? আমাদের নিকটতো ফকীরই সবচেয়ে বড় দাতা, সে যেহেতু নিজে ভীষন অভাব গ্রস্থ হওয়া সত্ত্বেও অর্ধেক দ্বীনারের বেশী নিল না।’’ (ফাজায়েলে সাদাকাত ২য় খন্ড-৩২২ পৃঃ)

পাঠকবৃন্দ! চিন্তা করে দেখুন, এ ঘটনাটা কি এই শিক্ষা দেয় না যে, যখন জীবিতদের থেকে নিরাশ হয়ে যাবে আর কোথাও কিছু না পাবে, তখন কোন দানশীলের ক্ববরের নিকট গিয়ে সমস্ত পেরেশানির কথা বর্ণনা কর। কারণ দানশীল ব্যক্তি মৃত্যুর পরেও শুনতে পায় এবং আহবানেও সাড়া দিতে পারে। অথচ এটা সম্পূর্ণরূপে কুরআন হাদীস পরিপন্থী বিশ্বাস এবং যা শির্কে আকবর। মহান আল্লাহ বলেন :

{إِنَّكَ لاَ تُسْمِعُ الْمَوْتٰى}

‘‘(হে নাবী!) আপনি মুর্দাদের কথা শুনাতে পারবেন না।’’ (সূরা নামল ৮০)

সম্মানিত পাঠক! সমস্ত সংকীর্ণতা দূর করে হৃদয়কে উদার করে স্বীয় জ্ঞান দ্বারা বিবেককে প্রশ্ন করুন, দেখবেন উপরোক্ত ঘটনাগুলো দ্বারা মাযার পূজার সবক শিখানো হয়েছে, যা প্রকাশ্য শির্ক। যাকে বলে زيارة الاستعانة বা ক্ববরবাসীর নিকট সাহায্য কামনার্থে যিয়ারাত। যেমন যুদ্ধ জয়, নির্বাচনে বিজয়লাভ, কোনরূপ সম্পদ লাভ কিংবা বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য তাদের নিকট সাহায্য কামনা করা শির্ক। শায়খ হাম্মাদ ইবনু ইয়াহ্ইয়া আন্ নাজমী বলেন, শির্কযুক্ত ক্ববর যিয়ারাত হচ্ছে এমন যিয়ারাত যাতে ক্ববরস্থ ব্যক্তিকে ডাকা হয়। তার কাছে প্রয়োজন পূরণ, বিপদ দূর করা ও সমস্যা সমাধান করার প্রার্থনা করা হয়। এই ধরনের যিয়ারাতকারীই ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত। (তাওহীদ জিজ্ঞাসার জবাব ৬৪ পৃঃ)

এছাড়া এটা زيارة لدعاء الأموات বা সরাসরি ক্ববরবাসীর নিকট কিছু প্রার্থনা করার নিমিত্তে যিয়ারাত বুঝায় অথচ প্রার্থনাও ‘ইবাদাত। যেমন রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন : الدعاء هو العبادة দু‘আ-ই হচ্ছে ‘ইবাদাত- (সহীহ আবূ দাউদ ১৩২৯) যা শুধু আল্লাহর জন্য নিবেদন করতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য তাবলীগী নিসাবের তালিম দ্বারা অনেক মুসলিম এমন ভ্রান্ত বিশ্বাস করে থাকে যে, তথাকথিত জীবিত বা মৃত গাউস-কুতুব, আবদাল ও মৃত সাধারণ ওলী-আউলিয়াদের বিরাট ক্ষমতা রয়েছে। তারা বিপদ-আপদে হস্তক্ষেপ করতে পারে। এজন্য এদের ক্ববরে বা মাযারে গিয়ে সরাসরি প্রার্থনা জানায়। এটা সরাসরি শির্কে আকবার।

মহান আল্লাহ বলেন :

{وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّن يَدْعُوا مِن دُونِ اللهِ مَن لاَّ يَسْتَجِيبُ لَه” إِلَى يَومِ الْقِيَامَةِ وَهُمْ عَن دُعَآائِهِمْ غَافِلُونَ}

অর্থাৎ ‘‘ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা অধিক বিভ্রান্ত কে যে আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুকে ডাকে যা ক্বিয়ামাত দিবস পর্যন্তও তার ডাকে সাড়া দিতে পারবে না? এবং এগুলো তাদের প্রার্থনা সম্বন্ধে অবহিতও নয়।’’ (সূরা আহকাফ ৫)

এজন্য আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের বাতিল উপাস্যদের লক্ষ্য করে বলেন :

{إِنَّ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِن دُونِ اللهِ عِبَادٌ أَمْثَالُكُمْ}

‘‘আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে তোমরা যাদেরকে ডাকো, তারা সবাই তোমাদের মত বান্দা।’’ (সূরা আল-আ‘রফ ১৯৪)

আল্লাহ আরো বলেন :

{أَمْوَاتٌ غَيْرُ أَحْيَآءٍ وَمَا يَشْعُرُونَ أَيَّانَ يُبْعَثُونَ}

‘‘তারা মৃত প্রাণহীন এবং কবে পুনরুত্থিত হবে জানে না।’’ (সূরা নাহাল ২১)

মুশরিকরা যে আউলিয়াদের ডাকে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন :

{وَإِذَا حُشِرَ النَّاسُ كَانُوا لَهُمْ أَعْدَاء وَكَانُوا بِعِبَادَتِهِمْ كَافِرِينَ}

‘‘ক্বিয়ামাতের দিন যখন মানুষকে একত্রিত করা হবে তখন তারা যাদেরকে ডাকত (ওদের যারা ডাকত তাদের) শত্রুতে পরিণত করা হবে।’’ (সূরা আহকাফ ৬)

পাঠক! এখন প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে তাবলীগী নিসাবের প্রতি বিশ্বাসী এত কোটি কোটি লোক সবাই কি মুশরিক? তার জবাব আল্লাহর ভাষায় শুনুন :

{وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللهِ إِلاَّ وَهُم مُّشْرِكُونَ}

‘‘অনেক মানুষ আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে কিন্তু সাথে সাথে শির্কও করে।’’ (সূরা ইউসুফ ১০৬)

এরপরেও প্রশ্ন থেকে যায়, এত বড় শাইখুল হাদীস, এত বড় বুযুর্গদের অনুসরণ করছি আমরা এরা কি সব ভ্রান্ত? মনে রাখা দরকার বুযুর্গদের অনুসরণ করছি, মানুষের এসব ওজর ক্বিয়ামাতে মাঠে গ্রহণযোগ্য হবে না। মহান আল্লাহ বলেন :

{وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِنْ بَنِي آدَمَ مِنْ ظُهُورِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَأَشْهَدَهُمْ عَلَى أَنْفُسِهِمْ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ قَالُوا بَلَى شَهِدْنَا أَنْ تَقُولُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّا كُنَّا عَنْ هَذَا غَافِلِينَ، أَوْ تَقُولُوا إِنَّمَا أَشْرَكَ آبَاؤُنَا مِنْ قَبْلُ وَكُنَّا ذُرِّيَّةً مِنْ بَعْدِهِمْ أَفَتُهْلِكُنَا بِمَا فَعَلَ الْمُبْطِلُونَ}

‘‘স্মরণ কর, যখন তোমার প্রতিপালক আদম সন্তানদের পৃষ্ঠ হতে তাদের বংশধরদের বের করলেন আর তাদেরকেই সাক্ষী বানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই?’ তারা বলল, ‘হ্যাঁ; এ ব্যাপারে আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি।’ (এটা এজন্য করা হয়েছিল) যাতে তোমরা ক্বিয়ামাতের দিন না বল যে, ‘এ সম্পর্কে আমরা একেবারেই বে-খবর ছিলাম’। অথবা তোমরা এ কথা না বল যে, ‘পূর্বে আমাদের পূর্ব-পুরুষরাই শিরক্ করেছে আর তাদের পরে আমরা তাদেরই সন্তানাদি (অতএব বুযুর্গদের যা করতে দেখেছি তাই করছি) তাহলে ভ্রান্ত পথের অনুসারীরা যা করেছে তার জন্য কি আপনি আমাদেরকে ধ্বংস করবেন?’’ (সূরা আ’রাফ ১৭২-১৭৩)

এই সূত্র থেকে বুঝা গেল যে, গাফিল এবং বুযুর্গ তথা বাপদাদার অনুসরণ করার ওযর ক্বিয়ামাতের মাঠে গ্রহণ করা হবে না।


রমাযানের ফাযীলাত (প্রথম পরিচ্ছেদ)


শায়খ সাহেব ফাজায়েলে রমজানের প্রথম পরিচ্ছেদের প্রথমেই একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং তার শেষে আরবীতে মন্তব্য লিখেছেন। কিন্তু উর্দূতে তার অনুবাদ করেন নি এবং বাংলায় যিনি অনুবাদ করেছেন তিনি হলেন মোঃ সাখাওয়াত উল্লাহ (এম, এ রিসার্চ স্কলার) তিনিও আরবী মন্তব্যটির অনুবাদ করেন নি। আমরা তার লিখিত অনুবাদটি হুবহু তুলে ধরছি এবং হাদীসটি সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণের মতামত পাঠকের সামনে তুলে ধরছি-

‘‘হযরত ছালমান (রাঃ) হইতে বর্ণিত আছে তিনি বলেন, প্রিয় নবীয়ে করীম (ছঃ) শা’বানের শেষ তারিখে আমাদিগকে নছীহত করিয়াছেন যে, তোমাদের মাথার উপর এমন একটি মর্যাদাশীল মোবারক মাস চায়া স্বরূপ আসিতেছে যাহার মধ্যে শবে ক্বদর নামে একটি রাত্রি আছে যাহা সহস্র মাস হইতেও উত্তম। আল্লাহ তা‘আলা রোজা তোমাদের উপর ফরজ করিয়াছেন এবং রাত্রি জাগরণ অর্থাৎ তারাবীহ পড়কে তোমাদের জন্য পুণ্যের কাজ দিয়াছেন। যে ব্যক্তি এই মাসে কোন নফল আদায় করিল সে যেন রমজানের বাহিরে একটি ফরজ আদায় করিল। আর যে এই মাসে একটি ফরজ আদায় করিল সে যেন অন্য মাসে সত্তরটি ফরজ আদায় করিল।

হুজুর (ছঃ) আরও বলেন, ইহা ছবরের মাস এবং ছবরের পরিবর্তে আল্লাহ পাক বেহেশত রাখিয়াছেন। ইহা মানুষের সহিত সহানুভূতি করিবার মাস। এই মাসে মোমেন লোকদের রিজিক বাড়াইয়া দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করাইবে সে ব্যক্তির জন্য উহা গুনাহ মাফের ও দোজখের অগ্নি হইতে নাজাতের কারণ হইয়া দাঁড়াইবে এবং উক্ত রোজাদাদের ছাওয়াবের সমতুল্য ছওয়াব সে ব্যক্তি লাভ করিবে অথচ সেই রোজাদারের ছওয়াব বিন্দুমাত্রও কম হইবে না। ছাহাবারা জিজ্ঞাসা করিলেন হে আল্লাহ নাবী! আমাদের মধ্যে অনেকেরই এই সামর্থ নাই যে সে অপরকে ইফতার করাইবে অর্থাৎ পেট ভর্তি করিয়া খাওয়াইবে, হুজুর (ছঃ) বলেন, পেট ভর্তি করিয়া খাওয়ানো জরুরী নয়, যে ব্যক্তি কাহাকেও একটি খেজুর দ্বারা ইফতার করাইবে আল্লাহ পাক তাহাকেও উক্ত ছওয়াব প্রদান করিবেন।

হুজুর (ছঃ) আরও বলেন, ইহা এমন একটি মাস যাহার প্রথম দিকে আল্লাহর রহমত অবতীর্ণ হয়, দ্বিতীয়াংশে মাগফেরাত ও তৃতীয়াংশে দোযখ হইতে মুক্তি দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি উক্ত মাসে আপন গোলাম ও মজদুর হইতে কাজের বোঝা হালকা করিয়া দেয়, আল্লাহ পাক তাহাকে মাফ করিয়া দিবেন......। বাইহাকী ইবনু খুযাইমাহর বরাতে উল্লিখিত হাদীসটির শেষে ‘ফায়েদার’ মধ্যে শায়খ জাকারিয়া লিখেছেন, উক্ত হাদীছের কোন কোন বর্ণনাকারী, সম্পর্কে মুহাদ্দেসীনেগণ কিছুটা মত বিরোধ করিলেও ফজীলত সম্পর্কীয় হাদীসে ঐ সব দুর্বলতা গ্রহণযোগ্য নয়, (ফাজায়েলে রমজান- ৪৭৪-৭৫ পৃঃ)

শাইখ স্বীকার করেছেন যে, উক্ত হাদীস সম্পর্কে মুহাদ্দিসীনগণ কিছুটা মতবিরোধ করেছেন এবং দুর্বল বলেছেন। তথাপিও তিনি ফায়ায়িলের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস চলে বলে কথাটি উড়িয়ে দিয়েছেন। এ বিষয় আমার পাঠকবর্গকে এই বইয়ের যঈফ হাদীস মানার শর্ত সংক্রান্ত অধ্যায় পড়ার অনুরোধ করছি এবং হাদীসটি সম্পর্কে মুহাদ্দিসীনের মতামত তুলে ধরছি।

হাদীসটি মুনকার : (মারফূ হাদীসের বিপরীতে অধিকতর দুর্বল হাদীসকে মুনকার বলা হয়। মুনকার হাদীস ত্রুটিযুক্ত) সহীহ ইবনে খুযাইমাহ ক্রমিক নং, ১৮৮৭। তাহক্বীক ড. মুহাম্মাদ মুস্তাফা আল-আযমী, তিনি হাদীসের সনদকে যঈফ বলেছেন। আলবানী ‘‘ফাতহুর রববানী’ ৯/২৩৩ গ্রন্থে বলেছেন, হাদীসটি ইবনে খুযাইমাহ তার ‘সহীহ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন; অতঃপর বলেছেন যে, (ان صح الخبر) হাদীসটি অনুরূপ বর্ণনা করেছেন আবূ শাইখ ইবনে হিববান ‘সওয়াব’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন হাদীসের সনদে আলী ইবনে যায়েদ বিন জাদআন যঈফ রাবী। এছাড়াও হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে, মিশকাত ক্রমিক নং ১৯৬৫ হাতক্বীকে আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদীসিয যঈফ, ৮৭১।

আল্লামা নাসিরুদ্দিন আলবানী বলেন, হাদীসের সনদটি আলী বিন যায়েদ বিন জাদআন এর কারণে যঈফ। কেননা সে হলো যঈফ রাবী। ইমাম আহমাদ ও অন্যান্যরাও তাকে যঈফ বলেছেন। এর কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে ইবনু খুযাইমাহ বলেছেন, তার স্মৃতি দুর্বলতার কারণে তার দ্বারা দলীল গ্রহণ করা যাবে না।’’ (গৃহীত সহীহ ও যঈফ হাদীসের আলোকে সিয়াম ও রমাযান পৃঃ- ২৩)

সাহারী ও ইফতার নিয়ে বাড়াবাড়ী

‘‘হজরত ছহল বিন আবদুল্লাহ তছ্তরী (রহ:) পনের দিনে একবার খানা খাইতেন, তবে ছুন্নত হিসাবে রমজানের ভিতর প্রতিদিন এক লোকমা খাইতেন ও শুধু পানি দ্বারা ইফতার করিতেন। হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (রহ.) হামেশা রোজা রাখিতেন কিন্তু কোন আল্লাহর অলি মেহমান হইলে রোজা ভাঙ্গিতেন এবং বলিতেন এই রকম বন্ধুর সহিত খাওয়া রোজার চেয়ে কম মর্যাদা রাখে না।’’ (ফাজায়েলে রমজান- ৪৯৫ পৃঃ)

‘‘এবনে দাক্বীকুল ঈদ বলেন, ছেহরী খাওয়া রোজার উদ্দেশ্যকে সফল করে না। কারণ রোজার উদ্দেশ্য উদর ও লজ্জা স্থানের কামভাবকে ধ্বংশ করা, কিন্তু ছেহরী উহাকে আরও শক্তিশালী করে।’’ (ফাজায়েলে রমজান- ৪৯৫ পৃঃ)

অথচ আল্লাহর নাবী (সাঃ) সাহারী খাওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছেন এবং তার মধ্যে বরকত রয়েছে এবং ইয়াহূদী-খৃষ্টানদের বিরোধিতা করতে বলেছেন। কেননা তারা সাহারী করে না। শাইখ সাহেব উক্ত হাদীসগুলো তার গ্রন্থে উল্লেখ করেও সূফীবাদের বৈরাগ্যবাদের কথা মনে হয় ছাড়তে পারেন নি। তা না হলে আল্লাহর রসূলের হাদীস উল্লেখ করেও কেন যে এসব হিন্দু, খৃষ্টান, বৈরাগ্যবাদীদের ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন, আমাদের বোধগম্য নয়। রসূলের ব্যাখ্যা কি আমাদের জন্য যথেষ্ট নয়? তার হাদীস কি ঐ সমস্ত সূফীবাদের মুখাপেক্ষী? সাহারীতে কামভাব কমে কি বাড়ে এবং রোজার উদ্দেশ্য সফল হয় কি না তা মনে হয় আল্লাহর নাবী বুঝতে সক্ষম হন নি। ইবনে দাক্বীকুল ঈদের মত সূফীর ব্যাখ্যার প্রয়োজন দেখা দিল? এবার দেখুন বিশ্বের সেই সর্বশ্রেষ্ঠ আল্লাহর প্রিয় নাবী কি বলেছেন :

عن انس ابن مالك قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم تسحروا فإن في السحور بركة

আনাস বিন মালিক হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, তোমরা সাহরী খাও, কেননা সাহরীর মধ্যে বরকত রয়েছে। (বুখারী, মুসলিম, সহীহ ইবনে মাজাহ- তাহক্বীকে আলবানী)

عن عمر ابن العاص قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم ان فصل ها بين صيامنا أهل الكتاب اكلة السحر

‘আমর ইবনুল আস হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমাদের ও আহলি কিতাবের (ইয়াহূদী-খৃষ্টানদের) সওমের পার্থক্য হলো সাহরী খাওয়া। (মুসলিম, সহীহ আবূ দাঊদ- তাহক্বীক আলবানী- সওম অধ্যায়, সহীহ নাসাঈ- ২১৬৫)

ইফতারের সময় পঠিতব্য দু‘আ

দারুল উলূম দেওবন্দের পরেই সাহারানপুর মাদরাসার স্থান। সেই মাদরাসার সনামধন্য শাইখুর হাদীস ‘ফাযায়িলে ‘আমাল’-এর লেখক জনাব যাকারিয়া সম্ভবত সজ্ঞানে হাদীসের শব্দে বাড়াবাড়ি করেছেন। যেমন তিনি তাবলীগী নিসাবে লিখেছেন :

اَللَّهُمَّ لَكَ صُمْتُ وَبِكَ اওمَنْتُ وَعَلَيْكَ تَوَكَّلْتُ وَعَلىও رِزْقِكَ اَفْطَرْتُ

আয় আল্লাহ! আমি তোমারই জন্য রোজা রাখিয়াছি এবং তোমার উপর বিশ্বাস স্থাপন করিয়াছি এবং তোমার উপর ভরসা করিয়াছি ও তোমারই প্রদত্ত নেয়ামত দ্বারা ইফতার করিতেছি।

অতঃপর তিনি লিখেছেন,

‘‘হাদীছে আরও সংক্ষিপ্ত দোয়া বর্ণিত আছে।’’ (ফাজায়েলে রমজান- ৪৯১ পৃঃ)

শাইখ সাহেব নিজেই স্বীকার করেছে যে, তার লিখিত ইফতারের মশহূর দু‘আতে এমন কতগুলো বাড়তি শব্দ আছে, যা পৃথিবীর কোন হাদীসে নেই। হাদীস ঘাটলে বোঝা যায় যে, একটি যঈফ বর্ণনায় ইফতারের দু‘আ এরূপ আছে।

اللهم لك صمت وعلى رزقك افطرت

হে আল্লাহ! আমি তোমার নামে রোযা রেখেছি এবং তোমার দেয়া রিযক দ্বারাই ইফতার করিছ (সনদ যঈফ)। আবূ দাঊদ- সওম অধ্যায়, ‘ইফতারের সময় যা বলতে হয়’ ক্রমিক নং ২৩৫৮, বায়হাকী , সুনানে কুবরা ৪/২৩৯; সুনানে ‘সগীর’ হাদীস ১৪২৮, তাহক্বীক; আব্দুল্লাহ ‘উমার আল- হাসানাইন, বায়হাক্বী সুনানে কুবরা, হাদীস; ৮১৩৪- তাহক্বীক- মুহাম্মাদ আব্দুল কাদীর আত্বা; দারা কুতনী। সুনান- ২/১৮৫ (২৪০); তাবারানী, সগীর ভিন্ন সনদে, হাদ্বীন নং ৯১৩; হাইসামী (রহ.) মাজমাউয যাওয়ায়েদ গ্রন্থে (৩৬৯) বলেছেন, তাবারানী ‘আওসাত’ গ্রন্থে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। তাতে দাউদ বিন যাবারকান রয়েছে আর সে হলো যঈফ। এছাড়া আল্লামা আলবানী (রহ.) হাদীসটিকে যঈফ বলেছেন (ইরওয়াউল গালীল ৪/৩৮, হাদীস ৯১৯)। ইমাম যাহাবী ‘আযযুআফা’ গ্রন্থে বলেছেন, একজন ব্যতীত সকলেই দাউদ বিন যাবারকান কে যঈফ বলেছেন। ইমাম আবূ দাউদ বলেছেন, (গৃহীত প্রগুক্ত- ৫৬ পৃ:) সে পরিত্যাক্ত।

পাঠক! তাবলীগী জামা‘আতের ২নং আমীর মুহাম্মাদ ইঊসূফ সাহেব সাহারানপুর মাসরাসায় আবূ দাঊদ পড়েছেন (হায়াতুস সাহ-বাহ, ঊর্দূ ২য় পৃষ্ঠা) ভাবতে আশ্চর্য লাগে, যে শাইখুল হাদীস সাহেব বছরের পর বছর আবু দাঊদ পড়িয়েছেন, তিনি যঈফ হাদীসটি শুধু বর্ণনা করেন নি বরং উক্ত সংক্ষিপ্ত দু‘আর সাথে ‘আবিকা আ-মানতু ওয়া আলাইকা তাওয়াককালতু’ শব্দ বাড়িয়ে হাদীস বিকৃত করেছেন। এটা কি তাকলীদে শাখসীর কুফল নয়? আমাদের হানাফী ভাইয়েরা সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘উদ (রাঃ)-কে একটু বেশী গুরুত্ব দান কারেন। এই ইবনে মাস‘উদ (রাঃ) যখন কোন হাদীস বয়ান করতেন তখন (রসূল (সাঃ)-এর শব্দাবলী কম বেশী হয়ে যাবার ভয়ে) তাঁর চোখ দু'টো লাল হয়ে যেত তাঁর শিরাগুলো ফুলে উঠতো ফলে তিনি বলতেন, নাবী (সাঃ) এরূপ বলেছেন কিংবা একটু কম বলেছেন অথবা একটু বেশি বলেছেন, নতুবা এর কাছাকাছি বলেছেন। (ইবনে মাজাহ ৪র্থ পৃষ্ঠা)

তাই বলছি, রসূলের হাদীস বর্ণনার ব্যাপারে একটি শব্দ রেফের হওয়ার ভয়ে ইবনে মাস‘উদের মত সাহাবী যদি ভয়ে কেঁটে উঠেন, তাহলে আজকের শাইখুল হাদীসদের হাদীসের শব্দে বাড়াবাড়ি করার ব্যাপারে মুখে তালা মারা এবং কলমের নিভ ভেঙ্গে ফেলা উচিৎ নয় কি? কিন্তু হায় তাক্বলীদে সাখসী! অর্থাৎ অন্ধ ব্যক্তি পূজার জন্য মুকাল্লিদ্বীনরা কুরআন হাদীসের কতই না বিকৃতি করল তার কোন পরিসংখ্যান করা যাবে কি?

ইফতারের সময় পঠিতব্য সঠিক দু‘আটি হচ্ছে :

ইবনে ‘উমার (রাঃ) বলেন, নাবী (সাঃ)যখন ইফতার করতেন তখন বলতেন :

ذَهَبَ الظَّمَاءُ وَابْتَلَّتِ الْعُرُوْقُ وَثَبَتَ الْاَجْرُ اِنْ شَاءَ اللهُ

অর্থ : পিপাসা দূর হল, শিরা-উপশিরা সিক্ত হল এবং নেকী নির্ধারিত হল ইনশাআল্লাহ। (আবূ দাঊদ, মিশকাত হা ১৯৯ ‘সিয়াম’ অধ্যায়, সনদ হাসান; ইরওয়া হা /৯২০, ৮/৩৯ পৃঃ হাকিম ‘মুসতাদরাক’ ১/৪২২ (তিনি বলেন হাদীসটি বুখারী ও মুসলিমের শর্তে বিশুদ্ধ)।

ই‘তিকাফ প্রসঙ্গ

عن ابن عباس رضى الله عنه أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال في المعتكف هو يعتكف الذنوب ويجرى له من الحسنات كعامل الحسنات كلها (مشكوة عن ابن ماجة)

অর্থঃ হুজুর (ছঃ) এরশাদ করেন, এ’তেকাফকারী সকল পাপ হইতে মুক্ত থাকে এবং তাহার জন্য এত বেশী নেকী লিখিত হয় যেন স্বয়ং সে সর্বপ্রকার সৎকাজ করিয়াছে। ([মেশকাত] তাবলীগী নিসাব- ফাজায়েলে রমাযান- ৫২০)

হাদীসটি যঈফ, যঈফ ইবনে মাজাহ- তাহক্বীক আলবানী, মিশকাত ২১০৮ আলবানী তাহক্বীকে সানী- ৭, তা’লীকে আলা ইবনে মাজাহ।

ই‘তিকাফ সংক্রান্ত আর একটি যঈফ হাদীস

من اعتكف عشرا في رمضان كان كحجتين وعمرتين

রসূললুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি রমাযানের দশ দিন ই‘তিকাফ করলো সে যেন দুই হাজ্জ ও দুই উমরাহ করলো।

হাদীসটি জাল : বায়হাকী ‘আস-শু‘আব’ গ্রন্থে হুসাইন বিন আলী (রাঃ) হতে হাদীসটি মারফূ‘ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। হাদীসের সনদ দুর্বল। সনদে বর্ণনাকারীদের একজন মুহাম্মাদ বিন যাযান পরিত্যাক্ত রাবী। তার সম্পর্কে ইমাম বুখারী (রহ.) বলেছেন, তার থেকে কেউ হাদীস লিখবে না। সনদে আরো রয়েছে, আন্বাসা ইবনু আব্দুর রহমান। তার সম্পর্কে ইমাম বুখারী (রহ.) বলেছেন, মহাদ্দিসগণ তাকে পরিত্যাগ করেছেন। ইমাম যাহাবী ‘‘আয-যেয়াফা’’ গন্থে বলেছেন: তিনি মাতরূক তাকে জাল করার দোষে দোষী করা হয়েছে।স ‘‘ফায়যুল কাদীর’’ গ্রন্থে এরূপই এসেছে। (যইফ ও জাল হাদীস সিরিজ ২য় খন্ড হা ৫১৮ পৃ: ৭৭-৭৮)

পাঠক মহোদয়! হাদীসটিতে তো ১০ দিনে ফযীলত বর্ণনা করা হয়েছে, এবার লক্ষ্য করুন। শাইখুল হাদীস সাহেব তাঁর ফাজায়েলে রমজানের ৫২২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন :

‘‘আল্লামা শারানী (রহ.) বর্ণনা করেন, রমজানের ১ দিন এতেকাফ করা দুই হজ্ব ও ওমরার সমকক্ষ। এবং যে ব্যক্তি জমাতের মসজিদে মাগরিব হইতে এশা পর্যন্ত এতেকাফ করে ও জিকির এবং তেলাওয়াত করে তাহার জন্য জান্নাতে একটি বালাখানা তৈয়ার করা হয়।’’(ফাজায়েলে রমজান- ৫২২)

অবশ্য শাইখ হাদীসটির কোন সনদ বর্ণনা করেন নি এমনকি কোন কিতাবের নামও উদ্ধৃতি উল্লেখ করেন নি। এটা বিশ্ব দাওয়াত ও তাবলীগের নামে যে জামা‘আত চলছে, তাদেরকে জাল হাদীসের খপ্পরে ফেলার ষড়যন্ত্র নয় তো? আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সুমতি দিন।

প্রাসঙ্গিক আলোচনা

ই’তিকাফ তিন প্রকার লিখতে গিয়ে শাইখুল হাদীস সাহেব তৃতীয় নাম্বারে লিখেছেন :

‘‘তৃতীয় নফল যার জন্য কোন সময় নাই। এমন কি সারা জীবনের নিয়ত করিলেও জায়েজ অবশ্য কম সময়ের মধ্যে মতভেদ আছে। ইমাম আবূ হানিফার নিকট এক দিনের কম নাজায়েজ। ইমা মোহাম্মদের নিকট অল্প সময়ও করা চলে। উহার উপর ফতুয়া। এই জন্য প্রত্যেক ব্যক্তির উচিৎ মসজিদে প্রবেশ করিলেই যেন এতেকাফের নিয়ত করিয়া লয়।’’(তাবলীগী নিসাব ফাজায়েলে রমজান- ৫১৭ পৃষ্ঠা)

ফাজায়েলের কিতাবে মাসায়েল লিখতে গিয়ে শাইয় লিখেছেন :

‘‘মেয়েলোকদের জন্য ঘরের কোণে নির্জন স্থানে বসিয়া এতেকাফ করিতে হইবে। মেয়েদের জন্য বড় সুবর্ণ সুযোগ। ঘরে বসিয়া অন্যের দ্বারা কাজ কর্ম ও করাইতে পারে অথচ বিরাট ছওয়াবও পাইয়া গেল। ইহা সত্বেও আমাদের নারীগণ উক্ত ছুন্নত হইতে প্রায়ই বঞ্চিত থাকে। আফছোছ। (ফাজায়েলে রমজান- ৫১৮)

সম্মানিত মুসলিম ভ্রাতাগণ! শাইখ বর্ণিত উল্লিখিত উদ্ধৃতিহীন বক্তব্যের দ্বারা বুঝা যায় যে, যে কোন সময় ই‘তিকাফ করা যায়। অর্থাৎ মাসজিদে ঢুকলেই ই‘তিকাফের নিয়ত করলেই ই‘তিকাফ হয়, তার জন্য সিয়াম অবস্থায় থাকা যরূরী নয়। তাইতো আমরা দেখি তাবলীগী ভাইগণ আদাবে মাসজিদের বয়ানে বলেন, মাসজিদে ঢুকলেই এভাবে নিয়ত করবে ‘‘নাওয়াইতুয়ান সুন্নাতাল ই‘তিকাফ মাদামতু হাযাল মাসজিদ’’ এখন লক্ষ্য করুন সহীহ হাদীসের সিদ্ধান্ত কি? ‘আয়িশাহ ˆ বলেন, ই‘তিকাফকারীর জন্য সুন্নাত হ’ল, সে যেন কোন অসুস্থকে দেখতে না যায়, জানাযায় শরীক না হয়, স্ত্রী ম্পর্শ না করে, তার সাথে সহবাস না করে এবং ই‘তিকাফের স্থান তেকে মানবীয় প্রয়োজন ব্যতীত বের না হয়। সিয়াম ছাড়া ই‘তিকাফ হয় না। আর জামে মাসজিদ ব্যতীত অন্য জায়গায় ই‘তিকাফ হয় না। (বায়হাক্বী, সহীহ সনদে এবং আবূ দাঊদ হাসান সনদে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। গৃহীত, আত্-তাহরীক, অষ্টোবর ২০০৪, পৃষ্ঠা ১৩)। ইমাম ইবনুল কাইয়িম ‘যাদুল মা‘আ’দ গ্রন্থে বলেছেন, রসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে বর্ণিত নেই যে, তিনি সিয়াম ব্যতীত ই‘তিকাফ করেছেন। বরং ‘আয়িশাহ ˆ বলেছেন, সিয়াম ব্যতীত ই‘তিকাফ হবে না। আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং ই‘তিকাফকে সিয়ামের সাথেই বর্ণনা করেছেন। আর রসূলুল্লাহ (সাঃ)ও সিযামের সাথেই ই‘তিকাফ করেছেন। অতএব সওম ও ই‘তিকাফের জন্য শর্ত এটাই হল জমহূর সালাফ ও আল্লামা ইবনে তাইমিয়ার অভিমত। এ কথা উপর ভিত্তি করে বলা যেতে পারে যে, যে সলাতে আসবে, তার জন্য সে মাসজিদে থাকাকালীন ই‘তিকাফের নিয়ত করা বৈধ হবে না। শাইক ইবনে তাইমিয়াও তাই বলেছেন। (প্রাগুক্ত, ১৩ পৃষ্ঠা)

এরপরে জনাব শাইখ লিখেছেন যে, নারীগণ নিজ গৃহের কোন ই’তিকাফ করবে। অথচা উক্ত মাসআলাটিরও কুরআন ও হাদীসের সাথে কোন মিল নেই। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

وَلاَ تُبَاشِرُوهُنَّ وَأَنتُمْ عَاكِفُونَ فِي الْمَسَاجِدِ

অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা ই‘তিকাফ অবস্থায় মাসজিদে অবস্থান কর, ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রীদের সাথে মিশো না।

অর্থাৎ স্ত্রী সহবাস কর না। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘মুবাশারাত’ মুআমালাত এবং ‘মাস’ সবক’টি শব্দের উদ্দেশ্য হল স্ত্রী সহবাস। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা যা ইচ্ছা ইঙ্গিতে বলে থাকেন। (দ্রঃ বায়হাক্বী ৪/৩২১ পৃঃ সনদ সহীহ, বাকারাহ- ১৮৭)

ইমাম বুখারী উক্ত আয়াত দ্বারা আমার যা বলছি তার প্রমাণ পেশ করেছেন। হাফিয ইবনে হাজার বলেছেন, আয়াত দ্বারা প্রমাণ পেশ করা যায় এভাবে যে, যদি ই’তিকাফ মাসজিদ ব্যতীত অন্য জায়গায় সহীহ হ’ত তাহলে স্ত্রী সহবাস হারাম হওয়কে মাসজিদের সাথে সংশ্লিষ্ট করত না। কারণ সর্বসম্মতিক্রমে স্ত্রী সহবাস হ‘ল ই‘তিকাফ বিনষ্টকারী। তাই মাসজিদ উল্লেখ করা একথাই বুঝায় যে, মাসজিদ ব্যতীত ই‘তিকাফ হবে না। (গৃহীত প্রাগুক্ত- ১২) তা ছাড়া দলীল হিসাবে একটি হাদীস পেশ করা হল লক্ষ্য করুন।

كان النبى الله عليه وسلم يعتكف العشر الاواخر من رمضان حتى توفاه الله ثم اعتكف ازواجه من بعده

উম্মুল মু’মিনীন ‘আয়িশাহ ˆ বলেন নাবী (সাঃ) মৃত্যুর পূর্বে মুহূর্ত পর্যন্ত রমাযান মাসের শেষ দশকে ই‘তিকাফ করেছেন। তাঁর পর তাঁর স্ত্রীগণ (শেষ দশকে) ই‘তিকাফ করতেন। (বুখারী, মুসলিম দ্রঃ ইরওয়া হাঃ ৯৬৬)

এই হাদীসে মহিলাদের ই‘তিকাফ বৈধ হওয়ার দলীল পাওয়া যায়। এবং তা মাসজিদের হতে হবে। তবে এর জন্য তাদের অভিভাবকগণের অনুমতি থাকতে হবে। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে হবে এবং পুরুষদের সাথে মেলামেশা সম্ভবনামুক্ত হতে হবে। আল্লাহ আমাদের সত্য বুঝার তাওফীক্ব দিন।


যে সমস্ত জাল যঈফ হাদীস তাবললীগ জামা‘আতে বহুল প্রচারিত


সম্মানিত পাঠক! এ প্রবেন্ধ আমরা ঐ সমস্ত জাল ও যঈফ হাদীস তুলে ধরছি যা তাবলীগ জামা‘আতের মুরুবিব এবং তাদের মুবাল্লিগরা অহরহ বর্ণনা করে। আমার কথায় বিশ্বাস না হলে তাবলীগী মারকায অথবা তাবলীগী ভাইদের বয়ান ও তাদের সাথে অনন্ত তিন দিন সময় দিয়েছেন অথবা যারা এক চিল্লা তিন চিল্লা সময় জামা‘আতে লাগিয়েছেন তারা যদি আল্লাহকে ভয় করেন তাহলে মনে হয় আমার কথা সত্য প্রামণিত হবে এবং তা তারা অবশ্যই স্বীকার করবেন। এ সমস্ত হাদীস নামের মিথ্যা বর্ণনা অনেকবার আমি আমার নিজ কানে তাবলীগে সময় দিয়ে শুনেছি। সম্মানিত পাঠক! আমি নিজে তাবলীগ জামা‘আতের সাথে পাকিস্তানের রায়বন্ড থেকে (......সালের অর্থাৎ এক সৎসর) জামা‘আতের সাথে সময় লাগাই ও নিজামউদ্দিনে এ অধম কিছু সময় অতিবাহিত করে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতার ফল আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।

من عرف نفسه فقد عرف ربه

‘‘ যে ব্যক্তি নিজেকে চিনতে পেরেছে, সে আপন প্রতিপালকের পরিচয় লাভ করেছে।’’

উপরোক্ত উক্তিটি কোন হাদীস নয়; অবশ্য এ বাক্যের অর্থ ও ভাব সঠিক বলে মনে হয়। মনে হয় এ কারণে মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন :

{وَفِي أَنْفُسِكُمْ أَفَلا تُبْصِرُونَ}

‘‘তোমার নিজের মধ্যেও (আল্লাহর কুদরাতের নির্দেশনাবলী রয়েছে) তোমরা কি তা অনুধাবন কর না?’’ (সূরা যারিয়াত- ২১)

সুতরাং এটি কোন বিদ্বানের বাণী মাত্র; একে রসূলের হাদীস বলে চলান আদৌ ঠিক নয়। কারণ তার পরিণাম জাহান্নাম। মুত্তাফাকুন আলাইহ)

ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.)-কে উক্ত উক্তিটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি এটিকে জাল আখ্যা দিয়েছে। তিনি বলেন :

ليس هذا من كلام النبى ولا هو في شيئ من كتاب الحديث ولا يعرف له إسناده

এটি রসূল (সাঃ)-এর বাণী নয়, হাদসসের কোন গ্রন্থেও তা নেই এবং তার কোন সনদও নেই। (মাজমুউ ফাতওয়া ইবনে তাইমিয়া ১৬/৩৪৯, গৃহীত প্রচলিত জার হাদীস, ১৫৩ পৃঃ)

শতাব্দীর বিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা নাসিরুদ্দ্বীন আলবানী বলেছেন, হাদীসটির কোন ভিত্তি নেই। বিস্তারিত দেখুন : যঈফ জাল হাদীস সিরিজ ১ম খন্ড, পৃ: ১১৯।

اطلبوا العلم من المهد إلى اللحد

‘‘দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত ইলম অন্বেষণ কর।’’

আমাদের তাবলীগী ভাইদের তাদের ৬ নং এর ইলম ও যিকরের বর্ণনায় এটিকে হাদীস বলে চালিয়ে দিতে আমি অনেক বার শুনেছি। ইসলামে ইলমে দ্বীন অন্বেষণের প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। ইলমের যেমন কোন শেষ নেই, তেমনি তা শিক্ষা করার জন্য কোন সময়ও নির্দিষ্ট নেই। শৈশবকাল থেকে আমরণ ইলম অর্জন করে যেতে হবে, এটাই ইলমের দাবী। তবে ‘‘দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত ইলম অন্বেষণ কর’ কথাটি একটি প্রবাদ ও হিতোপদেশ মাত্র; রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হাদীস নয়। যদিও অনেকের নিকট তা হাদীস হিসাবেই প্রসিদ্ধ। শাইখ আব্দুল ফাত্তাহ আবূ গুদ্দ (রহ.) এ সম্পর্কে বলেন :

‘‘এটি হাদীসে নাবী নয়; বরং একটি প্রবাদ বাক্যমাত্র। এটিকে রসূল (সাঃ)-এর প্রতি সম্বন্ধিত করা মোটেও বৈধ হবে না। ( যেমন শুধু তাবলীগী ভাইগণ নয়; বরং অনেকে কথিত আলেমের মুখ থেকেও শুনা যায় রসূলের দিকে সম্বন্ধিত করতে)। কেননা তাঁর প্রতি শুধু সেটিকে সম্বন্ধিত করা যাবে যা তিনি বলেছেন, করেছেন অথবা সমর্থন জানিয়েছেন। যে কোন ভাল কথা ভাল মনে হলেই তাকে হাদীসে রসূল বলা জায়িয হবে না, যদিও কথাটি সঠিক হোক না কেন। কেননা এতে কোন সন্দেহ নেই যে, সকল হাদীসে নাববীই হক তথা সত্য; কিন্তু দুনিয়ার সকল সঠিক কথাই হাদীসে নাববী নয়। বিষয়টি ভালভাবে বুঝা উচিৎ।

(কীসাতুয যামান ইন্দাল উলামা : ৩০ টীকা, গৃহীত প্রচলিত জাল হাদীস ৮৯-৯১ পৃঃ)

اطلبوا العلم ولو بالصين

‘‘জ্ঞানের অনুসন্ধান করো যদি তা চীনে গিয়েও হয়।’’

হাদীসটি আমাদের তাবলীগী ভাইয়েরা অনেক সময় তাদের ৬ পয়েন্টে বর্ণনা করতে দেখা যায়। এছাড়াও কথিত আলিমদেরকেও হাদীস বলে চালিয়ে দিতে দেখা যায়।

তাই সম্মানিত পাঠক! এটি কেমন হাদীস তা লক্ষ্য করুন :

ইবনে যাওযী লিখেছেন যে, এই হাদীসের সম্বন্ধ রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে সহীহভাবে যুক্ত হয় নি। এর একজন রাবী হাসান বিন আতিয়াকে আবূ হাতীম রাযী যঈফ বলেছেন এবং অতঃপর মুনকার বলেছেন। ইবনে হিববান বলেছেন, এ হাদীস বাতিল ও ভিত্তিহীন। (কিতাবুল মাওযুয়াত, জিলদ- ১, পৃঃ ২১৬)

আল্লামা আলবানী বলেন, এ হাদীস বাতিল। (যঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ ১ম খন্ড হা: ৪১৬, পৃঃ ৩৬৭)

রওজা পাক যিয়ারাত করার আদব

শাইখ সাহেব তার ফাযায়েলে হজ্বের মধ্যে রওজা পাক যিয়ারাতের ৬১টি আদব লিখেছেন যার অধিকাংশই ভিত্তিহীন ও মনগড়া তন্মধ্যে ১৪ নং এ লিখেছেন :

‘‘যখন বহু আকাঙ্ক্ষিত সেই ‘কোবায়ে খাজরা’ অর্থাৎ সবুজ গম্বজ নজরে পড়িবে, তখন হুজুরের আজমত এবং উঁচু শান ইত্যাদি মনের মধ্যে হাজির করিয়া এই কথা চিন্তা করিবে যে, সারা মাখলুকের সেরা মানব, আম্বিয়ায়ে কেরামের সর্দার ফেরেশতাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ জাত এই কবরে শায়িত আছেন। আরও মনে করিবে, যেই জায়গা হুজুরে পাক (ছঃ)-এর শরীর মোবারকের সহিত মিলিত আছে, উহা আল্লাহ পাকের আরশ হইতেও শ্রেষ্ঠ, কা’বা হইতেও শ্রেষ্ঠ, কুরছী হইতেও শ্রেষ্ঠ, এমনকি আছমান জমিনের মধ্যে অবস্থিত যে কোন স্থান হইতেও শ্রেষ্ঠ। (তাবলীগী নিসাব ফাজায়েলে হজ্ব- ১৩৩ পৃঃ)

পাঠক! এতবড় একটা দাবী বিনা দলীলে করা হয়েছে। একথা না আল-কুরআনের কোথাও বর্ণিত হয়েছে আর না কোন সহীহ হাদীসে পাওয়া যায়। তাহলে লেখক এটা কিভাবে জানলেন? দ্বীনের ক্ষেত্রে কি এই রকম বিভ্রান্তিকর কথা বলা যায়? কবরের স্থানটি কা’বা, আরশ ও কুরসীর চেয়ে উৎকৃষ্ট হওয়া খোলাখুলিভাবে বিতর্ক সৃষ্টি করা ও নিকৃষ্ট ধরনের ভুল। এ ধরনের কথা বলা থেকে বিতর থাকা উচিৎ নয় কি? এর মাধ্যমে আয়াতুল কুরসীর দ্বারা যে আক্বীদাহ মুসলিম হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত তা ভুলণ্ঠিত করে নাবীর মর্যাদাকে আল্লাহ চেয়ে বাড়িয়ে দেয়ার শামিল, যা সম্পূর্ণ তাওহীদ পরিপন্থী। এ বিশ্বাস কি কোন মুসলিম করতে পারে? তা ছাড়া এ জাতীয় আক্বীদাহ রসূলের নির্দেশেরও পরিপন্থী। তিনি (সাঃ) বলেন :

لاَتَطْرُوْنِىْ كَمَا اَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدٌ فَقُوْلُوْا عَبْدُ اللهِ وَرَسُوْلُهُ (متفق عليه)

‘‘তোমরা আমাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি কর না, যেভাবে নাসারাগণ ঈসা (‘আ.) সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করেছ, (জেয়ারতে মদ্বীনা) আমি তো একজন বান্দা বৈ আর কিছুই নই। তোমরা বল যে, আমি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রসূল। (বুখারী, মুসলিম)

শাইক তার তাবলীগী নিসাবে ফাজায়েলে হজ্বের অষ্টম পরিচ্ছেদে উল্লেখ করেন :

عن ابن عمر رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من زار قبرى وجبت له شفاعتى (درقطنى)

‘‘হুজুর (ছঃ) এরশাদ করেন, যেই ব্যক্তি আমার জেয়ারত করিল তাহার জন্য আমার সুপারিশ ওয়াজিব হইয়া গেল। (দারে কুরনীর উদ্ধৃতিতে ফাজায়েলে হজ্ব ১১৫ পৃঃ)

এই হাদীসটি সহীহ ইবনে খুযাইমা রিওয়ায়েত করেছেন এবং এটা যঈফ হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। (কাশফুল খফা ২/২৪৪ পৃঃ)

আল্লাহ ইবনে তাইমিয়া বলেন, ‘‘রসূল (সাঃ)-এর কবর যিয়ারাত সম্পর্কে সকল হাদীসই যঈফ। দ্বীনের ব্যাপারে সেগুলোর কোনটাতেও বিশ্বাস করা যায় না। এজন্য সহীহ সুনান হাদীসের সঙ্কলকগণ ঐগুলোর মধ্যে কোনটাই উদ্ধৃত করেন নি। ঐগুলোকে যঈফ হাদীস বর্ণনাকারীরাই বর্ণনা করেছেন। যেমন দারাকুতনী, বাযযার প্রভৃতি। (মাজুমুয়ায়ে ফাতওয়া ইবনে তাইমিয়া ১/২৩৪ পৃঃ)

আল্লাহ নাসিরুদ্দ্বীন আলবানী তো ঐ হাদীসকে মওজু (মনগড়া জাল) বলে ঘোষণা করেছেন।

(যাঈফুল জামিউস সগীর ৫/২০ পৃঃ আল-আহদীসুয যাঈফা- ১/৬৪ পৃষ্ঠা, গৃহীত মওযু ও যঈফ হাদীসের প্রচলন পৃষ্ঠা- ২৩)

এখন প্রশ্ন হল যে, যদি এটা রসূলের বাণী হত তাহলে এত গুরুত্বপূর্ণ বাণী নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের নিকট কিভাবে অজ্ঞাত রইল? এমন একটি হাদীস যার সমর্থন না আল-কুরআনে আর না সহীহ হাদসি থেকে পাওয়া যায়, তা যঈফ রাবীরা কিভাবে পেল? প্রকৃত অবস্থা হল যে, শাফা‘আত লাভের ব্যাপারে কুরআন অত্যন্ত কঠিন শর্তারোপ করেছে, কিন্তু যঈফ হাদীসগুলো সেটাকে হালকা করে দিয়েছে। বুঝা যায় যে, আক্বীদাহ ‘আমালের পরওয়া না করে শুধু রওযা যিয়ারাত করলেই নাবীর শাফায়াত প্রাপ্ত হবে এবং জান্নাত লাভ করবে। তাছাড়া শাইখ সাহেব উক্ত ফাজায়েলে হজ্বের অষ্টম পরিচ্ছেদের শুরুতেই চার মাযহাবের ওলামায়ে কিরামের ঐকমত্য বর্ণনা করেছেন। তাঁরা নাকি রসূলের কবর যিয়ারাত করা ওয়াজিব লিখেছেন। (প্রগুক্ত- ১১৫)

কোথায় পেয়েছেন তার উদ্ধৃতি তিনি উল্লেখ করেন নাই। হাজ্জের ৫টি ওয়াজিব লিখেছেন (ফিকহু সুন্নায়) তার মধ্যে আমরা রওযা যিয়ারাত পাই নি রবং হকপন্থী উলামায়ে কিরাম রসূলের রওজা যিয়ারাতকে হাজ্জের কোন আরকানের মধ্যে গণ্য করেননি। এটাকে ঐচ্ছিক ব্যাপারে গণ্য করেছেন। তাছাড়া খোদ ফাজায়েলে হজ্বের অনুবাদক মোঃ শাখাওয়াত উল্লাহ মোমতাজুল মোহাদ্দেসীন, রিসার্চ স্কলার সাহেব হাজ্জের ৬টি ওয়াজিব বর্ণনা করেছেন পাঠকদের জ্ঞাতার্থে আমরা তুলে ধরলাম তার মধ্যেও মাদ্বীনাহ যিয়ারাত ওয়াজিব বলেননি। অথচ শাইখ সাহেব এটা কোথায় পেলেন তা আমাদের বোধগম্য নয়।

১. মুজদালিফার ময়দানে অবস্থান, ২. সাফা মারওয়া পর্বত দ্বয়ের মধ্যে দৌঁড়ানো, ৩. শায়তানকে কঙ্কর মারা, ৪. বিদেশীদের জন্য বিদায়ী তাওয়াফ করা, ৫. মাথা মুড়ানো অথবা চুল ছাঁটা স্ত্রীলোকের চুল হইতে কিছু কর্তণ করা, ৬। কাফ্ফারা বা হজ্জে ত্রুটি কার্যসমূহে বিচ্যুতির জন্য দম বা কুরবারী করা।

উপরোল্লিখিত ফরযও ওয়াজিব কার্যবলী ব্যতীত অন্যান্য সকল আমাল ছুন্নাত ও মোস্তাহাব। (ফাজায়েলে হজ্ব বাংলা ২১৬ পৃঃ)

ফাযায়েলে দরূদ-এর ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ী

‘‘হুজুর (ছঃ) এরশাদ, ‘‘যে ব্যক্তি জুমার দিন আমার উপর আশী বার দরূদ শরীফ পাঠ করিবে তার আশী বৎসরের গোনাহ মাফ হইয়া যাইবে।’’ (তাবলীগী নিসাব, ফাজায়েলে দরূদ শরীফ- ৪৮ পৃঃ)

শাইখ উল্লিখিত হাদীসটি কোন উদ্ধৃতি ছাড়াই উল্লেখ করেছেন। মুসলিম ভ্রাতাগণ এবার লক্ষ করুন! হাদীসটি সম্পর্কে মুহাদ্দীসিনগণ কি মন্তব্য করেছেন। এই হাদীটি শুধু যঈফই নয়; বরং আল্লামা আলবানী যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, সেই অনুসারে জালও বটে। (দেখুন : সিলসিলাতুল আহদীসুয যাঈফা- ১/১২৫ বিস্তারিত দেখুন বাংলা যঈফ ও ও জাল হাদীস সিরিজ ১ম খন্ড হা,২১৫, পৃষ্ঠা ২৩৪)

তাছাড়া এই হাদীসটা জাল হওয়ার প্রমাণ এর বিষয় বস্ত্তর মধ্যেই রয়েছে। কেননা এতে জুমার দিন আশিবার দরূদ পড়ার পুরষ্কার এই বলা হয়েছে যে, আশি বৎসরের গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। অথচ আল-কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন :

{مَنْ جَاءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا}

‘‘যে একটি নেকী নিয়ে আসবে তার জন্য দশগুণ পুরস্কার।’’ (সূরা আল-আন‘আম- ১৬০)

সহীহ হাদীসে একবার দরূদ পড়লে দশগুণ সওয়াবের কথা বলা হয়েছে।

من صلى على وحد صلى الله عليه عشرا (مسلم)

যে আমার উপর একবার দরূদ পড়ে আল্লাহ তার উপর দশবার রহমাত নাযিল করেন। (মুসলিম)

পাঠক! লক্ষ্য করুন কুরআন এবং সহীহ হাদীসে কি অপূর্ব মিল। যারা কুরআন ও হাদীসের মধ্যে বিরোধ আছে মনে করেন তাদের জন্য এখানে একটি বড় সবক রয়েছে তাহলে, কুরআন ও সহীহ হাদীসে কোন গড়মিল নেই। কারণ যার উপর কুরআন অবতীর্ণ তিনি কুরআনের বিপক্ষে বলতে পারেন না। এর দ্বারা এটাও প্রমাণিত হয় যে, যত গরমিল ও মতবিরোধ আমার দেখতে পাই তার মূল কারণই হচ্ছে জাল ও যঈফ হাদীস। অথচ জাল যঈফ হাদীস শরী‘আতের উৎস নয় এবং তা গ্রহণযোগ্যও নয়। এছাড়া সওয়াবের ব্যাপারে বিতর্ক সৃষ্টি করে তা অবশ্যই বর্জন করা প্রয়োজন। কারণ এতে দ্বীনের প্রকৃত অবস্থা বিকৃত হয় এবং এর জন্য মানুষ তার নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্থাৎ ফারায়িজ থেকে গাফিল হয়ে পড়ে। যা আমরা সহজেই পার্থক্য করতে পারি, তাবলীগী ভাইদের আমালের মধ্যে, যার গুরুত্ব নেই সেটাকে বড় করে দেখা হয় এই জামা‘আতে। যেমন উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় :

صلاة بعمامة تعدل خمسا وعشرين صلاة بغير عمامة

‘‘পাগড়ী পরে একটি সলাত কায়িম করা বিনা পাগড়ীতে পঁচিশবার সলাত কায়িমের সমতুল্য।’’

এই হাদীসটি জাল। অন্য বর্ণনায় দুই রাকাত পাগড়ীসহ ৭০ রাকাতের সওয়াব বিনা পাগড়ীর চেয়ে উত্তম বলা হয়েছে। তাও জাল (দেখুন জাল ও যঈফ হাদীস সিরিজ, ১ম খন্ড, ১৬৪-৬৫ পৃষ্ঠা)। অথচ তাবলীগী ভাইদের এ জাতীয় ভিত্তিহীন ফযীলাত নিয়ে বাড়াবাড়ী করতে দেখা যায়। মনে রাখতে হবে পাগড়ীর ফাযীলাত সংক্রান্ত হাদীসগুলো সবই যঈফ, তবে আল্লাহর রসূল পাগড়ী পরিধান করতেন এই মর্মে বহু সহীহ হাদীস আছে।

‘‘হুজুর (ছঃ) এরশাদ করেন আমার উপর শুক্রবার দিন বেশী বেশী করিয়া দরূদ শরীফ পড়িতে থাক কেননা উহা এমন একটি মুবারাক দিন যে দিন ফেরেশতা আবতরণ করে এবং যে ব্যক্তি আমার উপর দরূদ পাঠ করে সে দরূদ শেষ করার সাথে সাথেই আমার নিকট উহা পেশ হয়। হজরত আবূ দারদাহ (রাঃ) বলেন, আমি আরজ করলাম, জুহুর (ছঃ) আপনার ইন্তেকালের পরও কি ঐরূপ হইবে। জুহুর (ছঃ) বললেন, ইন্তেকালের পরেও ঐরূপ হইবে। কেননা আল্লাহ পাক মাটির জন্য নবীদের শরীরকে খাওয়া হারাম করিয়া দিয়াছেন। নবীগণ কবরে জীবিত আছেন এবং তাঁহাদের নিকট রিযিক পৌঁছিয়া থাকে।’’ (ফাজায়েলে দরূদ- ৪৫-৪৬ পৃঃ)

ফায়েদায় শাইখ সাহেব বলেন, আল্লাহ পাক নাবীদের শরীরকে মাটির জন্য হারাম করিয়া দিয়াছেন, সুতরাং তাঁহাদরে হায়াত এবং মাউতের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। (ফাজায়েলে দরূদ- ৪৫ পৃঃ)

শাইখ উক্ত হাদীস খানায় তারগীব ও ইবনে মাযাহ উদ্ধৃতি দিয়েছেন। হাদীসটি যাচাই করতে আমি পারি নি, তবে জুমু‘আর দিনে দরূদের ফাযীলাত সংক্রান্ত অনুরূপ একটি হাদীস আমরা পেয়েছি সেখানে বলা হয়েছে :

اكثروا الصلاة على يوم الجمعة فإنه ليس يصلى احد يوم الجمعة الا عرض على الصلاة

অর্থ : জুমু‘আর দিন আমার উপর বেশি বেশি দরূদ পড়। কেননা তোমাদের মধ্যে যে কোন ব্যক্তি জুমু‘আর দিনে আমার উপর দরূদ পড়লে তার দরূদ আমার কাছে পেশ করা হয়। (মুস্তাদারাক হাকিম হাঃ ৩৬৩৪, ২/৪৯৫ পৃঃ সহীহল জামে হাঃ ১২০৮, পৃঃ ২৩৬ সহীহ হাদীস।) আর শাইখ বর্ণিত হাদীসের রেখাযুক্ত যে অংশটুকু সহীহ হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত তা হল :

ان الله عزوجل قد حرم على الأرض ان تاكل اجساد الانبياء

‘আল্লাহ তা‘আলা যমীনের উপর আম্বিয়ায়ে কিরামের শরীর খাওয়া হারাম করে দিয়েছেন।’

(আবূ দাঊদ- সলাত অধ্যায়, জুমু‘আর দিনের ফাযীলাত অনুচ্ছেদ, হাঃ ১০৪৭, ১/২৯০)

উক্ত হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, নাবীগণ স্ব স্ব কবরে স্বশরীরে জীবিত আছে এবং ইবাদাতে রত আছেন। মাটি তাদের পবিত্র শরীর স্পর্শ করে না। উল্লেখ থাকে যে, নাবীদের জন্য উক্ত হাদীসগুলো দ্বারা ইন্তিকালের পর যে জীবন প্রমাণিত হয়েছে, এটা দুনিয়াবী জীবন নয়; বরং এটা বারযাখী জীবন। এ জীবনের ধরন, পদ্ধতি, আকৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে আল্লাহ পাকই ভাল জানেন। সুতরাং কেউ যদি নাবীদের কবরে জীবিত থাকার অর্থ এই বলেন যে, তারা বাস্তবে মৃত্য বরণ করেন না, (যা শাইখ সাহেব তার ফায়দায় উল্লেখ করেছেন যে, তাঁদের হায়াত-মাউতের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই) আমাদের মত খানাপিনা করেন, চলাফেরা করেন, স্ত্রী সহবাস ইত্যাদি করে থাকেন, আমাদের সভা মজলিসে উপস্থিত হন, আমাদের চলাফেরা দেখতে পান এবং আমাদের সালাম দরূদ নিজ কানে শুনেন, তাহলে এটি হবে কুরআন-হাদীস বিরোধী অনৈসলামিক এবং মস্তবড় ভ্রান্ত ও বাতিল আক্বিদাহ। আম্বিয়ায়ে কিরাম বা ওয়ালীদের সম্পর্কে মুসলিমদের এ ধরনের ভয়ানক ও বিভ্রান্তিকর এরূপ আক্বীদাহ পোষণ করা শিরক-বিদ‘আত ছাড়া কিছুই নয়। এজাতীয় আক্বীদাহ থেকে সর্তক থাকা উচিৎ। শাইখ সাহেব ফাজায়েল গ্রন্থের মধ্যে এ ধরনের বহু বিভ্রান্তিকর আক্বীদাহ স্পষ্ট। যেমন এই হাদীসের ফায়েদায় তিনি লিখেছেন নাবীদের হায়াত ও মাওতের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। অথচ আল্লাহ আরো বলেন :

{وَمَا يَسْتَوِي الْأَحْيَاءُ وَلا الْأَمْوَاتُ إِنَّ اللهَ يُسْمِعُ مَنْ يَشَاءُ وَمَا أَنْتَ بِمُسْمِعٍ مَنْ فِي الْقُبُورِ }

‘‘সমান নয় জীবিত ও মৃত। আল্লাহ যকে ইচ্ছা শ্রবণ করান আর তুমি শুনাতে সমর্থ হবে না যারা কবরে রয়েছে তাদেরকে।’’ (সূরা ফাতির ২২)

মহান আল্লাহ আরো বলেন :

{إِنَّكَ لا تُسْمِعُ الْمَوْتَى }

অর্থ : ‘‘(হে নাবী) তুমি মৃতদের কোন কিছু শুনাতে পারবে না।’’ (সূরা আন-নামল-৮০)

ومن ورائهم برزخ إلى يوم يبعثون

অর্থ : তাদের (মৃতদের) সম্মুখে রয়েছে বারযাখ (পর্দা) থাকবে, পুনঃউত্থান দিবস পর্যন্ত।

মহান আল্লাহ বলেন :

{إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُم مَّيِّتُونَ}

হে নাবী! তুমি তো মরণশীল এবং তারাও মরণশীল। (সূরা আয-যুমার : ৩০)

উল্লিখিত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হল যে, নাবীসহ মুর্দা এবং জীবিত উভয়ে সমান নয়। এ বিতর্কের অবসান আবূ বাকর (রাঃ) করেছিলেন সাহাবাদের মাঝে রসূল (সাঃ)-এর ইন্তিকালের সঙ্গে সঙ্গে সূরা আল-ইমরনের ১৪৪ নং আয়াতের মাধ্যমে। অন্যদের যে জীবন তাহল বারযাখী জীবন, যে সম্পর্কে আমাদের কোন জ্ঞান নেই, এমনকি শহীদ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন যে, যারা আল্লাহর পতে নিহত হয় তাদেরকে মৃত বল না; বরং তারা জীবিত কিন্তু তোমরা উপলদ্ধি করতে পার না।

ولكن لا تشعرون

এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা একথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, তাদের জীবনকে আমরা উপলদ্ধি করতে পারব না। সেটা তিনিই ভাল জানেন। কিন্তু শাইখ লিখিত আক্বীদাহ দ্বারা আমার মনে হয় মাযারপূঁজার দ্বার উন্মুক্ত করা হয়েছে। কারণ উল্লিখিত বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় যে, নাবী ওয়ালীগণ তাদের কবরে জীবিত দুনিয়ার জীবনের মত। আর যার জন্য তারা সালাম শুনেন এবং উত্তর প্রদান করেন এবং সকলে তা শুনতে পান। এটা কত বড় ভয়ানক বিশ্বাস যা তাবলীগী নিসাবের মাধ্যমে শাইখ সাহেব দিতে চেয়েছে তার প্রমাণ নিন :

‘‘বিখ্যাত ছুফী ও বুজুর্গ হজরত শায়েখ আমদ রেফায়ী (রঃ) ৫৫৫ হিজরী সনে হজ্ব সমাপন করিয়া জেয়ারতের জন্য মদ্বীনায় হাজির হন। তিনি কবর শরীফের সামনে দাঁড়াইয়া এই দুইটা বয়াত পড়েন-

ِفِيْ حَالَةِ الْبُعْدِ رُوْحِىْ كُنْتُ اُرْسِلُهَا * تُقَبِّلُ الاَ(রাঃ)رْضَ عَنِّي وَهِىَ نَائِبَتِيْ وَهَذِهৃ دَوْلَةً الاَ(রাঃ)شْبَاحِ قَدْ حَضَرَتْ * فَاَمْدُ وَيَمْنِيَكَ كي تَحْظِيَ بِهَا شَفَتِي

‘‘দূরে থাকা অবস্থায় আমি আমার রুহকে হুজুরের খেদমতে পাঠাইয়া দিতাম; সে আমার নায়েব ইহয়া আস্তানা শরীফে চুম্বন করিত। আজ আমি সশরীরে দরবারে হাজির হইয়াছি। কাজেই হুজুর আপন হস্ত মোবারক বাড়াইয়া দিন যেন আমার ঠোঁট তাহা চুম্বন করিয়া তৃপ্তি হাছেল করিতে পারে।’’

বয়াত পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কবর শরীফ হইতে হাত মোবারক বাহির হইয়া আসে এবং হজরত রেফায়ী (রঃ) তাহা চুম্বন করিয়া ধন্য হন। বলা হয়, সেই সময় সমজিদে নববীতে নববই হাজার লোকের সমাগম ছিল। সকলেই বিদ্যুতের মত হাত মোবারকের চমক দেখিতে পায়। তাঁহাদের মধ্যে মাহবূবে ছোবহানী হজরত আবদুল কাদের জীলানী (রঃ)ও ছিলেন।’’ (ফাজায়েলে হজ্ব- ১৫৮ পৃঃ)

عن ابى هريرة رضى الله قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من صلى على عند قبرى سمعته ومن صلى على نائيا ابلغته

‘‘হুজুরে আকরাম (ছঃ) এরশাদ করেন যে ব্যক্তি আমার কবরের নিকট দাঁড়াইয়া আমার উপর দরূদ পাঠ করে আমি তাহা শুনিয়া থাকি আর যে ব্যক্তি দূর হইতে আমার উপর দরূদ পড়িয়া থাকে তাহা আমার নিকট পৌঁছান হয়।’’ (ফাজায়েলে দরূদ শরীফ-২৫ পৃঃ)

ইবনে জাওযী লিখেছেন, এই হাদীস সহীহ নয়, এর রাবী মুহাম্মাদ বিন মুরান সিদ্দী সম্বন্ধে ইবনে নুমাইর বলেছন যে, সে মিথ্যাবাদী এবং নাসাঈ বলেছেন যে, সে পরিত্যাক্ত।(কিতাবুল মাওযুয়াত; ১ম খন্ড, ৩০৩ পৃষ্ঠা, গৃহীত মওযু যঈফ হাদীসের প্রচলন ১৭ পৃঃ)

অনুরূপ আরো একটি হাদীস ফাজায়েলে হজ্বে শাইখ আবূ হুরাইরা সূত্রে বর্ণনা করেছেন।

قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من صلى على عند قبرى سمعته ومن صلى على نائبا كفى امكرد نياه واخرته وكنت له شهيدا وشفيعا يوم القيامة

হুজুর (ছঃ) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আমার কবরের পাশে দাঁড়াইয়া আমার উপর দরূদ পড়ে, আমি স্বয়ং তাহা শ্রবণ করিয়া থাকি। আর যে দূর হইতে আমার উপর দরূদ পড়ে, আল্লাহ পাক তাহার দুনিয়া আখেরাতের যাবতীয় প্রয়োজন মিটাইয়া দেন এবং কেয়ামতের দিন আমি তাহার জন্য সাক্ষী দিব, তাহার জন্য সুপারিশ করিব (ফাজায়েলে হজ্ব-১২১ পৃঃ)

আল্লামা আলবানী বলেন, হাদীসটি এভাবে জাল। হাদীসটি সাম‘উন ‘আল-আমালী’ গ্রন্থে (২/১৯৩/২) খতীব বাগদাদী তার ‘‘আত-তারীখ’’ গ্রন্থে (৩/২৯১-২৯২)এর ইবনু আসাকির (১৬/৭০/২) মুহাম্মাদ ইবনু মারওয়ান সূত্রে আ‘মাশ হতে এবং তিনি আবূ সালেহ হতে বর্ণনা করেছেন। আলবানী বলেন : মুহাম্মাদ ইবনু তাইমিয়া ‘‘মাজমুয়ায়ে ফাতাওয়া’’ গ্রন্থে বলেছেন (২৭/২৪১) এ হাদীসটি বানোয়াট, এটি মারওয়ান আ‘মাশ হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি সকলের ঐক্যমতে মিথ্যুক বলেন মোট কথা যে, অংশটুকুতে বলা হয়েছে যে, সালাম দিলে তার নিকট পৌঁছে দেয়া হয়, এ অংশটুকু সহীহ, বাকী অংশটুকু সহীহ নয়; বরং সেগুলো বানোয়াট।

(দেখুন মূল সিলসিলা যঈফা ১ম খন্ড, ২০৩ পৃঃ যঈফ জাল হাদীস সিরিজ ১ম খন্ড, ২২৬ পৃষ্ঠা)

সম্মানিত পাঠক! আমাদের ভাবতে অবাক লাগে যে, শাইখুল হাদীসের মত এত বড় একজন পন্ডিত ব্যক্তি কি করে রসূল (সাঃ)-এর নামে জাল হাদীস বর্ণনা করেছেন, অথচ হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা ফরয। আমরা মনে করি যে, নিম্নোক্ত কারণসমূহের ভিত্তিতে হাদীস বর্ণনা ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা ফরয :

ক) যে কোন বর্ণনার ক্ষেত্রে শারী‘আতের বিধান হল, বর্ণনার পূর্বে যাচাই করে দেখা, তা বর্ণনা যোগ্য কিনা; হাদীসের ব্যাপারেটি তো সঙ্গত কারণেই আরো গুরুত্বপূর্ণ।

খ) বর্ণনার ক্ষেত্রে অসর্কতা মিথ্যারোপের শামিল, যা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের নিকট নিন্দনীয়। আর হাদীসের ব্যাপারে মিথ্যারোপ করা তো আরো ভয়ঙ্কর, যা বলার অপেক্ষাই রাখে না।

গ) হাদীসের সম্পর্ক দ্বীনের সাথে; বরং এটি অন্যতম দলীল এবং দ্বীনি বিধানবলীর ভিত্তি। সুতরাং হাদীসের ব্যাপার অসর্তকতা দ্বীন নিয়ে খেল- তামাশা করার নামান্তর। যার অশুভ পরিণতি কারো অজানা নয়।

ঘ) হাদীসের সম্পর্ক সরাসরি রসূল (সাঃ)-এর সাথে তাঁর মর্যাদা সৃষ্টি জীবের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর একথা স্বতঃসিদ্ধ যে, যে ব্যক্তি যত বড় হন, তাঁর ব্যাপারে মিথ্যারোপ এবং তাঁর বাণী বর্ণনার ক্ষেত্রে অসতর্কতা ততবড় অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। একথাই হাদীসে এরশাদ হচ্ছে :

ان كذبا على ليس ككذب على احدكم

‘আমার ব্যাপারে মিথ্যারোপ তোমাদের কারো ব্যাপারে মিথ্যারোপের মত নয়’’ (বরং তার ভয়াবহতা সাধারণ মিথ্যারোপ থেকে অনেক বেশী) ।

ঙ) রসূল (সাঃ) যেহেতু দ্বীনি ব্যাপারে ওয়াহী ছাড়া কোন কথা বলতেন না, তাই কোন কথা হাদীসে নাববী হওয়ার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, এটি তার প্রতি আল্লাহ তা‘আলার ওয়াহী ও পয়গাম। সুতরাং যদি কোন কথা রসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেন নি; তথাপি তার বরাত দেয়া হয়, তাহলে তার মাঝে খারাবী ও ক্ষতি শুধু এতটুকুই নয় যে, এটি রসূলের উপর মিথ্যারোপ করা হচ্ছে; বরং পরোক্ষভাবে আল্লাহ তা‘আলার উপরও মিথ্যারোপ করা হচ্ছে। আর আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করা কত জঘন্য অপরাধ তা অজানা নয়। এরশাদ হচ্ছে :

{وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَر‘ى عَلى‘ اللهِ كَذِباً أُولَئِكَ يُعْرَضُونَ عَلى‘ رَبِّهِمْ وَيَقُولُ الْأَشْهَادُ هَؤُلاءِ الَّذِينَ كَذَبُوا عَلى‘ رَبِّهِمْ أَلا لَعْنَةُ اللهِ عَلَى الظَّالِمِينَ}

‘‘আর ঐ ব্যক্তিদের চেয়ে বড় যালিম কে যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে। তাদেরকে তাদের পালনকর্তার সম্মুখীন করা হবে, আর সাক্ষীগণ বলতে থাকবে, এরাই ঐ লোক যারা আপন পালনকর্তার প্রতি মিথ্যারোপ করেছিল। সাবধান! যালিমদের উপর আল্লাহর অভিশাপ রয়েছে।’’ (সূরা হুদ- ১৮)

তাবলীগী ভাইয়েরা হয়তো বলতে পারেন যে, বাজারে বিভিন্ন দ্বীনি গ্রন্থের মধ্যে অগণিত ভুল-ভ্রান্তি থাকা সত্ত্বেও কেন আমি এই নিসাবের পিছনে লেগেছি, যে কিতাবখানা সারাবিশ্বে কুরআনের মত পড়া হয় প্রত্যেক মাসজিদে প্রতিদিন। এর দ্বারা কোটি কোটি লোক উপকৃত হচ্ছে। তাদের নিকট আমার বক্তব্য হল, উপরে উল্লিখিত কারণ আমাকে এই কাজে উদ্বুদ্ধ করেছে। আমি নিজে যেহেতু তাবলীগী জামা‘আতের সাথে করাচি পাকিস্তান এবং নিজাম উদ্দিন থেকে জড়িত ছিলাম, কতলোক এপথে এসেছে আমার দাওয়াতে তাদের ভুল ভাঙ্গানোর জন্য আমার এ লেখা কাফফারা স্বরূপ। আল্লাহ তা‘আলার কাছে প্রার্থনা আল্লাহ পাক যেন আমার এবং আমার মুসলিম ভাইদের ভুল সংশোধন করে সঠিক পথে চলার তৌফিক দান করেন। (আমিন)

উল্লেখ্য যে, আম্বিয়াগণ (‘আ.) চিরদিনের জন্য দুনিয়ায় আসতেন না। তাদেরও মৃত্যু হয়েছে। (শুধু ঈসা (‘আ.) ব্যতীত) দেখুন : বাকারাহ ১৩৩, আল-ইমরান-১৪৪, আম্বিয়া- ৮-৩৪, শুয়ারা- ৮১, আন‘আম- ১৬২, ইউনূস- ৪৬, রা’দ- ৪০, মারইয়াম- ১৫-৩৩, সাবা- ১৪, যুমার- ৩০, মু’মিন- ৩৪-৭৭। মৃত্যুর পরে শাস্তি ও শান্তি (দরূদ পৌঁছান) সত্য, কিন্তু এগুলোর স্থান হলো, বারযাখ দুনিয়ার কবরে নয়। দেখুন : আল-ইমরান- ১২৯, আন‘আম- ৯৩, আনফাল- ৫০-৫২, তাওবাহ- ১০১, ইউনূস- ৯২, নাহাল- ২৮-২৯, ৩২, মু’মিনুন- ৯৯-১০০, ইয়াসিন- ২৬-২৭, মু’মিন- ৪৫-৪৬, মুহাম্মাদ- ২৭, ওয়াকিয়া- ৮৩-৯৫, তাহরীম- ১০, আফস- ২১।

মাকামে মাহমুদের ব্যাখ্যা

‘‘রুহুর বয়ানে বর্ণিত আছে আল্লাহ পাকের দরূদ পড়ার অর্থ হইল হুজুরে আকরাম (ছঃ) কে মোকামে মাহমুদ অর্থাৎ সুপারিশের মোকামে পৌঁছান।’’ (ফাজায়েলে দরূদ শরীফ- ১০)

মাকামে মাহমুদের ব্যাখ্যায় শায়খ লিখেছেন :

‘‘কেহ বলেন, উহা হইল আল্লাহ পাক কর্তৃক তাহাকে রোজ কেয়ামাতে আরশের উপর বসান অথবা কুরছীর উপর বসান। আবার কেহ কেহ বলেন উহার অর্থ হইল শাফায়াত। কেননা সমস্ত মাখলুক সেখানে হুজুরের প্রশংসা করিবে। আল্লামা ছাখাবী ও তাহার ওস্তাদ হাফেজ এবনে হাজার বলেন এই কয়েকটি রেওয়ায়েতের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই কেননা সম্ভবনা আছে আরশে এবং কুরছীতে বসাইয়া শাফায়াতের অনুমতি দিবেন ও তারপর হামদের পতাকা হুজুরের হাতে দিবেন।’’ (ফাজায়েল দরূদ শরীফ- ৫৬-৫৭ পৃষ্ঠা)

সম্মানিত পাঠক! যদিও শাইখ এ কথার স্বপক্ষে কোন উদ্ধৃতি দেন নি তথাপিও একথা যেই বলুক সে অত্যন্ত ঔদ্ধত্ব সহকারে নিকৃষ্টতম মিথ্যা আল্লাহর প্রতি আরোপ করেছেন। নাবী (সাঃ)-কে এত উঁচুতে তোলা হয়েছে যে, তাঁকে আরশ কূরসীতে বসানো হবে বলা খুবই গুস্থাখিপূর্ণ কথা এবং এতে তাওহীদী বিশ্বাস আহত হয়। আশ্চর্যের ব্যাপার যে, মুসলিমদের ইসলাহ করার জন্য যে গ্রন্থ লেখা হয় তাতে এরকম ভিত্তিহীন বেপরওয়া কথা উদ্ধৃত করা হয়! যখন আক্বীদাই সংশোধন হল না, তখন আর কিবা সংশোধন হতে পারে? এই সব কথা তো বাতিল করার জন্য উল্লেখ করা যেতে পারে। তাবলীগ বা প্রচার করার জন্য নয়। ইমাম রাযী তাঁর তাফসীরে উক্ত কথাকে দলীল সহকারে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং শেষে লিখেছেন, ‘সুতরাং প্রামাণিত হল যে, এ কথা অত্যন্ত নিকৃষ্ট ও বাতিল। এর দিক ঐ ব্যক্তিই আকৃষ্ট হতে পারে যার না বিবেক বুদ্ধি আছে আর না দ্বীনের জ্ঞান আছে। আল্লাহ ভাল জানেন। (তাফসীরে কাবীর ২১ খন্ড ৩২ পৃষ্ঠা)

মূলতঃ এ কথাটিকে মুজাহিদের প্রতি আরোপ করা হয়েছে, যিনি একজন বিশিষ্ট তাবেয়ী ও মুফাসসির। এরকম অর্থহীন কথা তিনি কিভাবে বলতে পারেন! কিন্তু দায়িত্বহীন রাবীরা মিথ্যা তৈরী করে তাঁর নামে প্রচার করেছে। সুতরাং তাফসীরে তাবারীতে এই রিওয়ায়েতে উবাদ বিন ইয়াকুব আসদী থেকে বর্ণিত হয়েছে। (তাফসীরে তাবারী, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৯)

উবাদ বিন ইয়াকুব আসদীর সম্পর্কে জানা যায় যে, সে শী‘আ ও প্রচন্ড ধরনের বিদ‘আতী ছিল। আসমাউর রিজাল গ্রন্থ ‘‘তাহযীবুত তাহযীব’’ এ হাফিজ ইবনে হাজার, ইবনে আদীর উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে, উবাদের মধ্যে শী‘আ মনোভাবের প্রধান্য ছিল। আর সে ফাযীলাতের ব্যাপারে মুনকার রিওয়ায়েত বর্ণনা করতো এভাবে হিববানের কথা নকল করেছেন যে, তিনি রাফিযী ছিলেন এবং প্রখ্যাত রাবীর হওলা দিয়ে মুনকার রেওয়ায়েত বর্ণনা করতেন। তাই তা প্রত্যাখ্যানযোগ্য।ঃ (তাহযীবুত তাহযীব, ৫ম খন্ড, ১০৯ পৃষ্ঠা, গৃহীত মওযু ও যঈফ হাদীসের প্রচলন, ১৯ পৃঃ)

উপসংহারে বলতে চাই শাইখ কি উল্লিখিত শী‘আ মনোভাব নিয়ে রাফেজী মতবাদ প্রচার করতে চেয়েছেন? শেষ পর্যন্ত বর্ণনা করার ভঙ্গি কি এই যে, কেউ কেউ বলেছেন তার কোন নাম ঠিকানা নেই। তার পরও আমরা বিষয়টি উদ্ধার করে উদ্ধৃতিসহ মুসলিম ভাইদের নিকট পেশ করলাম। আল্লাহ তা‘আলা যেন আমাদের এই শ্রমটুকু তার শাহী দরবারে প্রহণ করেন। আমীন!

উল্লেখ্য যে, একথা মুশরিকগণও স্বীকার কতর যে মহাআরশ অধিপতি শুধুমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা। (সূরা মু’মিনুন- ৮৬-৮৭)

একটি যুবকের কাশ্ফের বয়ান ও সত্তর হাজার বার কালিমা পড়ার ফাযীলাত


শায়েখ আবু করতবী (রহঃ) বলেন, আমি শুনিয়াছি, যে ব্যক্তি সত্তর হাজার বার কালেমা পড়িবে সে দোজখ হইতে নাজাত পাইবে। ইহা শুনিয়া আমি নিজের জন্য সত্তর হাজার বার ও আমার স্ত্রীর জন্য সত্তর হাজার বার এবং এইরূপে এই কালেমা কয়েক নেছাব আদায় করিয়া পরকালের ধন সংগ্রহ করি। আমাদের নিকটেই একজন যুবক কাশফওয়ালা বলিয়া খ্যাতি লাভ করিয়াছিল। সে নাকি বেহেশেত ও দোজখ দেখিতে পাইত আমি উহাতে সন্দেহ করিতাম। এক সময় ঐ যুবক আমার সহিত আহার করিতে বসিয়া হঠাৎ চিৎকার করিয়া উঠিল ও বলিল, আমার মা দোজখে জ্বলিতেছেন। তাহার অবস্থা আমি দেখিতে পাইতেছি। যুবকের অস্থিরতা দেখিয়া করতবী (রহ.) বলেন, আমি মনে মনে সত্তর হাজার বার পড়ার একটা নেছাব ঐ যুবকের মায়ের জন্য বখশিশ করিয়া দিলাম, কিন্তু এক আল্লাহ ব্যতীত আমার এই আমলের কথা আর কাহারও জানা ছিল না। হঠাৎ যুবক বিলয়া উঠিল চাচা! আমার মা দোজখের আযাব হতে নাজাত পাইয়া গেলেন। করতবী বলেন, কেচ্ছা দ্বারা আমার দুইটি বিষয়ে জ্ঞান লাভ হইল। প্রথমতঃ ৭০ হাজার বার কালেমা পড়ার বরকত দ্বিতীয়তঃ ঐ যুবকের কাশফের সত্যতাও প্রমাণিত হইল। (ফাজায়েলে আমলের জিকির অধ্যয় ৩৫৪ পৃঃ)

পাঠকগণ! লক্ষ্য করুন উক্ত ঘটনা কি মানুষের জন্য ‘ইল্মে গায়িবের প্রমাণ করে না? এই ঘটনার কয়েকটি লক্ষণীয় বিষয় দেখুন :

১) শায়খ আবূ কুরতুবী (রহ.) বলেন, আমি শুনেছি, যে ব্যক্তি সত্তর হাজার বার কালিমা পড়বে বলে যে উল্লেখ আছে তা আবূ কুরতুবী কোথা থেকে শুনেছেন? এ ধরনের কথা তো রসূল (সাঃ) কোন সহাবীকে বলতে পারতেন?

২) আফসোস! কোন হাদীসের গ্রন্থে এ ধরনের কথা পাওয়া যায় না তাহলে কুরতুবী সাহেব এটা পেলেন কোথায়?

৩) কুরতুবী সাহেবের অভিজ্ঞতার দ্বারা যে সবক (নাসীহাত) পাওয়া গেল তা হল নিসাব জমা করতে হবে। আর মুর্দার প্রতি বখশিশ করাতে হবে।

৪) এছাড়া কাশ্ফ (অর্থাৎ উঠান বা উন্মোচন করা) জান্নাত এবং জাহান্নাম যা আল্লাহ তা‘আলা গায়িবে (অদৃশ্যে) রেখেছেন তার পর্যবেক্ষণ করা, নিজ মাকে জাহান্নামে দেখা এবং তার মাগফিরাত (ক্ষমা) দেখা ইত্যাদি সব ‘ইল্মে গায়িব অর্থাৎ অদৃশ্য জগতের কথা নয় কি? যা কাশ্ফের মাধ্যমে জানা হয়েছে। উদ্দেশ্য এই যে, শাইখুল হাদীস সাহেবের বর্ণনানুযায়ী এই উম্মাতের মধ্যে ‘ইল্মে গায়িব অর্থাৎ অদৃশ্যের জ্ঞান রাখনেওয়ালার সংখ্যা অগণিত। অথচ কুরআন মাজীদে আছে যে, আল্লাহ ছাড়া গায়িব কেউ জানে না। মহান আল্লাহ বলেন :

{قُلْ لاَ يَعْلَمُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلاَّ اللهُ وَمَا يَشْعُرُونَ أَيَّانَ يُبْعَثُونَ}

‘‘বলুন, আল্লাহ ব্যতীত নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে কেউ গায়িবের খবর জানে না এবং তারা জানে না যে, তারা কখন পুনরুজ্জীবিত হবে।’’ (সূরা আন-নাম্ল ৬৫)

নাবী মুহাম্মাদ (সাঃ) -এর মাধ্যমে আল্লাহ ঘোষণা দেন :

{قُلْ لاَ أَقُولُ لَكُمْ عِنْدِي خَزَائِنُ اللهِ وَلاَ أَعْلَمُ الْغَيْبَ}

‘‘হে নাবী! আপনি বলুন, আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ধন-ভান্ডার রয়েছে এবং আমি গায়িবের খবর জানি।’’ (সূরা আন‘আম ৫০)

মহান আল্লাহ আরও বলেন :

{وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لاَ سْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ}

‘‘হে নাবী! আপনি বলুন, আমি যদি গায়িবের খবর জানতাম তাহলে আমি আমার বহু মঙ্গল সাধন করতাম এবং কোন অমঙ্গল আমাকে স্পর্শ করতে পারত না।’’ (সূরা আল-আ’রাফ ১৮৮)

তাছাড়া সূফী নামধারী ব্যক্তিরাই এটাকে হাদীস বলে চালিয়ে দিয়েছেন, যেহেতু শাইখুল হাদীস সাহেব বর্ণনা করেছেন । সেহেতু অনেকের এটা হাদীস ভাবারই কথা যেমন : من هلل سبعين الف مرة واهده للميت يكون براءة للميت من النار (لا اله الا الله) অর্থাৎ সত্তর হাজার বার কালিমা ‘লা- ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ করে এর সওয়াব মৃত ব্যক্তির নামে উৎসর্গ করলে সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে।’’ এ কথাটি অনেকের মুখে হাদীসে রসূল (সাঃ) হিসাবে প্রসিদ্ধ। তাবলীগী মুবাল্লিগসহ বহু এলাকার মানুষকে তা বলতে শোনা যায়; অথচ তা রসূল (সাঃ)-এর হাদীস হিসাবে প্রমাণিত নয়। ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রহ.)-কে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন : ليس هذا حديث صحيحا و لا ضعيفا ‘‘এটি সহীহ বা যঈফ কোন সনদে বর্ণিত নেই।’’(মাজমুয়ায়ে ফাতাওয়া ইবনু তাইমিয়াহ ২৪/৩২৩- গৃহীত, প্রচলিত জাল হাদীস পৃঃ ১৬২)

উল্লেখিত বর্ণনা দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, এটি জাল হাদীস কারণ তার কোন সূত্র নেই। আর জাল বা ভিত্তিহীন রিওয়ায়াত বর্ণনা করা কবীরা গুনাহ। তাই বিষয়টি হালকা করে দেখার কোন অবকাশ নেই। প্রমাণহীন কোন কিছুকে রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হাদীস বলে দাবী করা ইসলামে জঘন্যতম কবীরা গুনাহ বলে সাব্যস্ত। তাই এ ব্যাপারে তাঁর পক্ষ থেকে জাহান্নামের হুঁশিয়ারী পর্যন্ত এসেছে। তিনি (সাঃ) বলেন :

من كذب على متعمدا فليتبوا مقعده من النار (متفق عليه)

‘‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক আমার উপর মিথ্যারোপ করবে, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা খুঁজে নেয়।’’ (সহীহ বুখারী ১/২১, হাঃ ১১০; সহীহ মুসলিম ১/৭, হাঃ ৩)

অন্য হাদীসে আছে :

ان كذبا على ليس ككذب على احد فمن كذب على متعمد فليتبوا مقعده من النار

‘‘আমার উপর মিথ্যারোপ করা, অন্য কারো উপর মিথ্যারোপ করার মত নয়। যে আমার উপর মিথ্যারোপ করবে, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা বানিয়ে নেয়।’’ (সহীহুল বুখারী ১/৭২, হাঃ ১২৯১; সহীহ মুসলিম ১/৭, হাঃ ৪)

রসূলুল্লাহ (সাঃ) যেহেতু দ্বীনী ব্যাপারে ওয়াহী ছাড়া কোন কথা বলতেন না, তাই কোন কথা হাদীসে নাববী হওয়ার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, এটি তাঁর প্রতি আল্লাহ তা‘আলার ওয়াহী ও পয়গাম। সুতরাং যদি কোন কথা রসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করেননি; তথাপিও তার বরাত দেয়া হয়, তাহলে তার মধ্যে খারাবী ও ক্ষতি শুধু এতটুকু নয় যে, এটি রসূলের উপর মিথ্যারোপ করা হচ্ছে, বরং পরোক্ষভাবে আল্লাহ তা‘আলার উপরও মিথ্যারোপ করা হচ্ছে। আর আল্লাহ তা‘আলার উপর মিথ্যারোপ করা কত জঘন্য অপরাধ তা কারো অজানা নয়। ইরশাদ হচ্ছে :

{وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَر‘ى عَلَى اللهِ كَذِباً أُولَئِكَ يُعْرَضُونَ عَلَى رَبِّهِمْ وَيَقُولُ الأَ<شْهَادُ هَؤُلاءِ الَّذِينَ كَذَبُوْا عَلٰى رَبِّهِمْ أَلاَ لَعْنَةُ اللهِ عَلٰى الظَّالِمِينَ}

‘‘আর ঐ ব্যক্তির চেয়ে যালিম কে যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে। তাদেরকে তাদের পালনকর্তার সম্মুখীন করা হবে, আর সাক্ষীগণ বলতে থাকবে, এরাই ঐলোক যারা আপন পালনকর্তার প্রতি মিথ্যারোপ করেছিল। সাবধান যালিমদের উপর আললাহর অভিসম্পাত রয়েছে।’’ (সূরা আল-হূদ ১৮)

এসব কারণেই হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা ফরয সতর্কতার একমাত্র পথ এই যে, হাদীস বিশেষজ্ঞদের নিকট সে সব, কিতাবের নাম জেনে নেয়া যেগুলোতে শুধু সহীহ হাদীস বর্ণিত আছে। (যেমন সহীহ আল-বুখারী, সহীহ মুসলিম)

এতদ্ভিন্ন অন্য কিতাব থেকে হাদীস গ্রহণের সময় বিশেষজ্ঞদের নিকট জেনে নেয়া যে হাদীসটি সহীহ কিনা। (যেমন বর্তমান শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস সুনানে আরবায়া’র সহীহ ও যঈফ হাদীসগুলিকে যাচাই বাছাই করে আলাদা গ্রন্থ রচনা করেছেন যা আরব বিশ্বে বহুল প্রচলিত। যে সূর্য আমাদের দেশে এখান উদিত হয়নি।) উম্মাতের সচেতন ব্যক্তিদের মাঝে আজও এ নিয়মই বিদ্যমান আছে। যেমন আল্লামাহ নাসীরুদ্দ্বীন (রহ:) সুনানে আরবায়া’ তথা আবূ দাউদ, তিরমিযী নসাঈ ও ইবনু মাজাহ জাল ও যঈফ হাদীস গুলো পৃথক করে যে স্বতন্ত্র গ্রন্থে একত্রিত করেছেন, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ হল। আবূ দাউদে ১১২৭ টি যঈফ তিরমিযীতে ৮২৮ টি যঈফ, নাসাঈতে ৪৪০ টি যঈফ এবং ইবনু মাজাহতে ৯৪৮ টি যঈফ হাদীস রয়েছে মোট যঈফ হাদীস ৪টি গ্রন্থে ৩৩৪৪ টি। (মাসিক আত-তাহরীক ডিসেম্বর ২০০৭, ৩য় সংখ্যা পৃষ্ঠা ১৪)

হাদীস যাচাইয়ে স্বপ্ন বা কাশ্ফ গ্রহণযোগ্য নয়

শায়খের শেষোক্ত কথা দ্বারা জানা যায় হয় যে, কাশ্ফের মাধ্যমে উল্লেখিত হাদীসটি সহীহ প্রমাণিত হয়েছে। অথচ যা বিদ‘আতী ও ‘ইল্মহীন পীরদের দৌরাত্মের এ যুগে ভয় হয়, যেসব রিওয়ায়াতকে এ কিতাবে হাদীস বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতিতে জাল বা ভিত্তিহীন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে বা হবে, সেগুলো সম্পর্কে কেউ এই টাল-বাহানা না করে যে, যদিও এগুলো হাদীস বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে মাওযূ‘ তথা জাল; কিন্তু আমি বা আমার পীর সাহেব খাব, কাশ্ফ বা ইলহামের মাধ্যমে এগুলো সঠিক বলে জানতে পেরেছি।

মনে রাখবেন এ সকল দাবী সম্পূর্ণ বাতিল। হাদীসে রসূল ছেড়ে কিংবা তা অস্বীকার করে তদস্থলে অন্যদের কথা ও মতকে দ্বীনে অনুপ্রবেশ করানোর পথকে সুগম করার এটি একটি ইবলীসী চক্রান্ত। হাদীস বিশেষজ্ঞগণ শারী‘আতের উসূল ও মূলধারার ভিত্তিতেই কোন রিওয়ায়াতের উপর ভিত্তিহীন বা জাল হওয়ার হুকুম আরোপ করে থাকেন। তাই শারী‘আতের বিধি মোতাবেক এই হুকুম মেনে নেয়া একান্ত অপরিহার্য। এর বিপরীতে কারো স্বপ্ন, কাশ্ফ ও ইলহাম শারী‘আতে ধর্তব্য নয়। উম্মাতের ইজমা এবং শারী‘আতের অন্যান্য দলীল মোতাবেক এগুলো দ্বীনি ব্যাপারে বিশেষত হাদীসের শুদ্ধতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে প্রমাণ হতে পারে না। এগুলোর পিছনে পড়ার অর্থ যা দ্বীন নয় তাকে দ্বীন বানানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত হওয়া। এখানে শারী‘আতের দৃষ্টিতে স্বপ্ন কাশ্ফ ও ইলহামের মান সম্পর্কে দলীলভিত্তিক আলোচনার স্বল্প হলেও প্রয়োজনবোধ করছি। যাতে গোড়া থেকেই এই ভ্রান্ত ধারণা খতম হয়ে যায়। কারণ এ নিসাব গ্রন্থে অনেক স্থানে স্বপ্ন, কাশ্ফ ও ইলহামের বর্ণনা আছে যা বুঝার জন্য পাঠকের আর দলীলের প্রয়োজন না হয় শুধু এ অধ্যায় স্মরণ রাখলে যথেষ্ট হবে। অনুরূপভাবে পরবর্তিতে তাসাওউফ তত্ত্ব সম্পর্কে যেমন মোটামুটি বিস্তারিত আলোচনা করেছি যাতে ঐ বিষয়েও পাঠকের জন্য আর দলীলের প্রয়োজন না হয়। কারণ নিসাব গ্রন্থে তাসাওউফ ও সূফীদের কথাও কম নয়।

কাশ্ফ ও ইলহাম

কাশ্ফ ও ইলহামকেও তথাকথিত কতিপয় তরীকাপন্থী বড় করে দেখে। কাশ্ফের মাধ্যমে কোন কথা জানতে পারাকে বুযুর্গীর সনদ মনে করে থাকে। আর কেউ কেউ তো কাশ্ফ ও ইলহামকে শারী‘আতের সনদই গণ্য করে থাকে এবং শুধু কাশফ ও ইলহাম অর্জন করার জন্য সুন্নাত নয়, এমন অনেক মুজাহাদায় লিপ্ত হয়। অথচ কুরআন-সহীহ হাদীসে কাশ্ফ ও ইলহামকে দ্বীনী ব্যাপারে কখনও দলীলের মর্যাদা দেয়া হয়নি। দুনিয়াবী কর্মকান্ডেও কাশ্ফ ও ইলহামের উপর ‘আমাল করার জন্য শর্তারোপ করা হয়েছে যে, সেগুলোর বিষয়বস্তু কুরআন-সুন্নাহর পরিপন্থী যেন না হয় এবং সে মোতাবেক ‘আমাল করতে গিয়ে শারী‘আতের কোন ধারা যেন খন্ডিত না হয়। (প্রচলিত জাল হাদীস ৫৯)

কাশ্ফের পরিচয়

অদৃশ্য জগতের কোন কথা প্রকাশিত হওয়াকে কাশ্ফ বলা হয়। এ কাশ্ফ কখনও সঠিক হয় আবার কখনও মিথ্যা হয়, তাই এটি শারী‘আতের কোন দলীল তো নয়ই উপরন্তু একে শারী‘আতের কষ্টিপাথরে যাচাই করা যরূরী। এমনিভাবে কাশ্ফ কোন ইচ্ছাধীন কোন কিছু নয় যে, তা অর্জন করা শারী‘আতের কাম্য হবে অথবা সওয়াবের কাজ হবে। অনুরূপ কাশ্ফ হওয়ার জন্য বুযুর্গ হওয়াও শর্ত নয়। কাশ্ফ তো ইবনুস সায়্যাদের মত দাজ্জালেরওহত (মিথ্যা নবুয়াতের দাবীদার গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীরও হত) সুতরাং কাশ্ফ আল্লাহ্ওয়ালা হওয়ার দলীল হতে পারে না।

(মাওকিফুল ইসলাম মিনাল ইলহাম ওয়াল কাশফি ওয়াররূইয়া ১১-১১৪, রূহুলমাআনি ১৬/১৭-১৯, শরীয়াত ও তরীকত কা তালাযুম ১৯১-১৯২, শরীয়ত ও তরীকত ৪১৬-৪১৮, আত কাশশুফ আন মুহিম্মাতিত তাসাওউফ ৩৭৫-৪১৯- গৃহীত প্রচলিত জাল হাদীস ৫৯)

এ সম্পর্কে মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রহ.) তার মাকতুবাতে বলেন : অনুরূফ কাশ্ফ ও ইলহামকে কিতাব ও সুন্নাহর মানদন্ডের যাচাইয়ের পূর্ব পর্যন্ত অর্ধ যব তুল্য হওয়াও পছন্দ করি না। (ইরশাদাতে মুজাদ্দিদে আলফেসানী ১২৪, মাকতুব ২০৭। গৃহীত প্রাগুক্ত পৃঃ ৬০)

সূফীকুল শিরোমনি শায়খ সারী সাকতী (রহ.) [মৃত ২৫৩ হিঃ] বলেন :

من ادعى باطن علم ينقصه طاهر حكم فهو غالط

যে ব্যক্তি এমন বাতেনি ‘ইল্মের অর্থাৎ (কাশ্ফ ইলহাম) দাবী করে থাকে, যাহিরী শারী‘আত প্রত্যাখ্যান করে, সে ব্যক্তি ভ্রান্তির শিকার। (রুহুলমানি ১৬/১৯)

এই হল শারী‘আতে স্বপ্ন কাশ্ফ ও ইলহামের অবস্থান। যদি এটি ভালভাবে বোধগম্য হয়ে থাকে, তাহলে কোন দ্বীনী ব্যাপারে বিশেষত হাদীসের সহীহ যঈফ নির্ণয়ের মত মৌলিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কেউ এগুলো প্রমাণ হিসাবে পেশ করার কথা কল্পনাই করতে পারবে না। তাছাড়া এ ব্যাপারে সকল ইমামগণ ঐক্যমত যে, হাদীস জানার জন্য হাদীস গ্রন্থের শরণাপন্ন হওয়া জরুরী এবং হাদীস যাচাইয়ের জন্য হাদীস বিশেষজ্ঞদের কাছে যাওয়া অপরিহার্য। এ সম্পর্কে কাশ্ফওয়ালা বুযুর্গের কাশ্ফভিত্তিক রায় ধর্তব্য নয়। এ কথা সুস্পষ্ট যে, হাদীসের সহীহ যঈফ তথা মান নির্ণয়ের ভিত্তি যদি স্বপ্ন, কাশ্ফ বা ইলহাম হত, তাহলে উসূলে হাদীস সংক্রান্ত ‘ইল্মের কোন প্রয়োজন ছিল না। প্রয়োজন ছিল না রিজালশাস্ত্রের জ্ঞানের এবং জাল, দুর্বল ও মাতরূক রিওয়ায়াত সম্পর্কিত শাস্ত্রসমূহের। স্বর্ণযুগ থেকে এ পর্যন্ত উক্ত বিষয়গুলোর উপর শত শত নয় হাজারো গ্রন্থ রচিত হয়েছে। যা মুসলিমদের নিকট উৎস হিসাবে সমাদৃত। যদি এর ভিত্তি কাশ্ফ বা ইলহাম হত, তাহলে হাদীস যাচাই বাছাই ও শুদ্ধতা নির্ণয়ের কাজ মুজতাহিদ্বীন ও মুহাদ্দিসীনের পরিবর্তে সূফীদের হাতে ন্যস্ত হত এবং এ ব্যাপারে একেজনের একেক রায় থাকত। প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্বপ্ন, কাশ্ফ বা ইলহামের ভিত্তিতে ফায়সালা করত। বলাবাহুল্য যদি ব্যাপারটি এমনই হত তাহলে এর চেয়ে বলগাহীনতা আর কিছুই হত না! কিংবা দ্বীনের উৎসসমূহ নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করার ক্ষেত্রে এর চেয়ে নিকৃষ্ট পদ্ধতি আর কিছুই হত না।

সূফী মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ (রহ.) ‘ফাতহুল আলিয়্যিল মালিক’-এ তার শায়খ আবূ ইয়াহ্ইয়া (রহ.) থেকে বর্ণনা করেন :

من المعلوم لكل احد ان الاحاديث لا تثبت الا بالاسانيد لا ينحو الكشف وانوار القلب ولو لا ية والكرامات لا دخل لها هنا انما المرجع للحفاظ العارفين بهذا الشان

‘‘এ কথা সর্বজনবিদিত যে, হাদীস সনদের মাধ্যমেই প্রমাণিত হয়, বাতিনী নূর ইত্যাদির মাধ্যমে নয়। এক্ষেত্রে বুযুর্গী বা কারামতের সামান্যতম দখল নেই। বরং এ শাস্ত্রে পারদর্শী বিশেষজ্ঞগণ এর একমাত্র উৎস।’’ (ফাতহুল আলিয়্যিল মালিক ১/৪৫, আলমামনু ফী মারেফাতিল হাদীসিল মাওযু ২১৬ টীকা দ্রঃ গৃহীত প্রাগুক্ত ৬৬ পৃঃ)

কাশ্ফের মাধ্যমে হাদীস যাচাই প্রসঙ্গে প্রখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ রুহুলমানি এর প্রণেতা আল্লামা আলুসী (রহ.) একটি হাদীসের মান যাচাই সম্পর্কে বলেন :

قال : ابن تيمية : إنه ليس من كلام النبى صلى الله عليه وسلم ولا يعرف له سند صحيح ولا ضعيف وكذا قال الزركشى والحافظ ابن حجر وغيرهما ومن يرويه من الصوفية معترف بعدم ثبوته نقلا لكن يقول : إنه ثابت كشفأ....... والتصحيح الكشفى شنشة لهم

অর্থাৎ ‘‘ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রহ.) বলেছেন যে, এটি রসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হাদীস নয়। সহীহ কিংবা যঈফ কোন প্রকার সূত্রই এর নেই। আল্লামা যারকাশী, হাফিয ইবনু হাজার (রহ.) এবং অন্যরাও অনুরূপ মত ব্যক্ত করেছেন। আর সূফীদের যারা এটি বর্ণনা করে থাকেন তারা এ কথা স্বীকার করেন যে, এটি সনদের মাধ্যমে প্রমাণিত নয়, তবে কাশ্ফের মাধ্যমে প্রাপ্ত বাণী। আর তাসহীহে কাশ্ফী তথা কাশ্ফের মাধ্যমে হাদীসের মান যাচাই প্রক্রিয়া সূফীদের চিরাচরিত খাসলত।’’ (তাফসীরে রুহুল মাআনি ২৭/২১-২২। গৃহীত প্রচলিত জাল হাদীস ৮১-৮২)

সম্মানিত মুসলিম ভ্রাতৃমন্ডলী হাদীস বর্ণনায় সূফীদের সম্পর্কে নিশ্চয়ই কিছুটা অবগত হয়েছেন। শায়খ সাহেবের বর্ণনা কতটুকু সত্য আপনারা ভেবে দেখুন এবং তাবলীগী জামা‘আতের বাণী মৌঃ ইলিয়াসও সূফী ছিলেন। আর সূফীদের তত্ত্ব দিয়েই তাবলীগী নিসাবটি ভরপুর, এবার বুঝুন নিসাব গ্রন্থের মান শারী‘আতে কোন পর্যায়ের। আরো শুনুন শাইখ তার ফাজায়েলে দরূদে লিখেছেন :

‘‘আমার একজন বিশ্বস্ত বন্ধু আমার নিকট লাখনোর একজন বিখ্যাত কাতেবের ঘটনা বর্ণনা করেন যে, তার অভ্যাস ছিল প্রতি দিন সকাল বেলায় লেখা আরম্ভ করিবার শুরুতেই একটি সাদা খাঁতায় একবার দরূদ শরীফ লিখিয়া রাখিত তারপর লেখার কাজ শুরু করিত। উক্ত লোকটি যখন মৃত্যু শয্যায় শায়িত তখন আল্লাহর ভয়ে কম্পিত হয়ে বলতে থাকে হায়! সেখানে আমার কি উপায় হবে। ইত্যবসরে একজন মাজযুব সেখানে উপস্থিত হয়ে বলতে লাগল বাবা তুমি কেন ঘাবড়াইতেছ? তোমার সেই সাদা খাঁতাটা যেখানে দরূদ শরীফ লেখা হইত উহা সেই দরবারে পেশ করা হইয়েছে।’’ (তাবলীগী নিসাব, ফাজায়েলে দরূদ শরীফ ৯১ পৃঃ)

ভেবে দেখুন ঐ মাজযুব (পাগল) কি তাহলে ‘ইল্মে গায়িব কে চোষণ করে নিয়েছিল? সে কেমন করে বলল ঘাবড়ানোর প্রয়োজন নেই। তোমার দরূদ রসূল (সাঃ) কবূল করেছেন। এখন আর কম্পিত হওয়ার প্রয়োজিন নাই।

আরো শুনুন : ‘‘ইব্রাহীম খা’ওয়াস (রহ.) বলেনঃ একবার আমি জঙ্গল অতিক্রম করছিলাম। আমার বহু কষ্ট করা লাগল এবং মুসিবত এর কারণে আমি দুর্ঘটনার সম্মুখীন হলাম। যাকে আমি বরদাশত করলাম এবং প্রফুল্লচিত্তে তার পরে সবর করলাম। আমি যখন মাক্কায় প্রবেশ করলাম। তখন আমার এই কীর্তির (কারনামর) পরে এক ধরনের (উয্ব) অহঙ্কার পয়দা হল। তওয়াফের মধ্যেই পিছন থেকে একবুড়ি আওয়াজ দিল। হে ইব্রাহীম! ঐ জঙ্গলে এই বান্দিও তোমার সাথে ছিল। কিন্তু আমি তোমার সঙ্গে এজন্য কোন কথা বলিনি যে, আল্লাহ জাল্লাহ সানুহু থেকে তোমার ধ্যান অন্য দিকে চলে যাবে। এই ওয়াসওয়াসা যা তোমার এই সময় এসেছে তা স্বীয় অন্তর হতে বের করে দাও। ([রওজ] ফাজায়েলে হাজ্জ, মূল উর্দু ২৫৫ পৃঃ, গৃহীত তাবলীগী নিসাব আওর শির্ক)

উপরোল্লিখিত ঘটনা কি এ শিক্ষা দেয় না? যে অলি আল্লাহ যদিও (নজরের) দৃষ্টি থেকে আড়ালে থাকেন, কিন্তু সাথে সাথে থাকেন। অথচ কুরআন মাজীদে এভাবে আছে :

{وَاللهُ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ}

‘‘অন্তরে যা আছে আল্লাহ সে সম্পর্কে বিশেষভাবে অবহিত।’’ (সূরা আল-‘ইমরান ১৫৪)

মহান আল্লাহ আরো বলেন :

{وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْأِنْسَانَ وَنَعْلَمُ مَا تُوَسْوِسُ بِهِ نَفْسُهُ وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ}

‘‘আমিই মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং তার প্রবৃত্তি তাকে যে কুমন্ত্রণা দেয় তা আমি জানি। আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনী অপেক্ষাও নিকটতর।’’ (সূরা আল-কাফ ১৬)

অন্তরের ভেদ জানা বা খবর রাখা এটা আল্লাহর গুণ। বান্দা কেমন করে তার এই গুণাবলীতে শরীক হতে পারে? অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন :

{وَمِنْ أَهْلِ الْمَدِينَةِ مَرَدُوا عَلَى النِّفَاقِ لاَ تَعْلَمُهُمْ نَحْنُ نَعْلَمُهُمْ}

‘‘এবং মাদ্বীনাবাসীদের মধ্যেও কেউ কেউ তারা কপটতায় সিদ্ধ। (হে নাবী) তুমি তাদেরকে জানো না, আমি তাদেরকে জানি।’’ (সূরা আত-তাওবাহ ১০১)

চিন্তা করে দেখুন যে, আল্লাহর রসূল (সাঃ) মুনাফিকদের হাল সম্পর্কে জ্ঞাত নন। সহীহুল বুখারীতে আছে মুনাফিকরা তাঁকে অর্থাৎ রসূল (সাঃ)-কে ধোকা দিয়েছে।

বিরে মাউনার স্থানে সত্তরজন ক্বারী সহাবীকে মুনাফিকরা নির্মমভাবে শহীদ করেছিল। যদি নাবী (সাঃ) অন্তরের অবস্থা জানতেন, তাহলে কেন তিনি (সাঃ) তাদের ধোকায় নিপতিত হলেন?

আগে শুনুন : ‘‘শাইখ বানান বলেন : আমি মিশর থেকে হাজ্জে যাচ্ছিলাম। আমার পাথেয় অর্থাৎ পথ খরচ আমার সঙ্গে ছিল। রাস্তায় একটি মহিলার সঙ্গে আমার সাক্ষাত, সে বলল বানান তুমি দেখি (হাম্মাল) মজদুর (শ্রমিক) মনে হচ্ছে। পথের সামগ্রী বহন করে নিয়ে চলেছ। তোমার কি এই সন্দেহ লাগে যে, সে (আল্লাহ) তোমাকে রিয্ক দিবেন না। আমি তার কথা শুনে স্বীয় পাথেয় ফেলে দিলাম। তিনদিন পর্যন্ত আমি খাবার পেলাম না। রাস্তার মধ্যে চলতে চলতে আমি একটি পাঁয়জোর অর্থাৎ নুপুর পরিত্যক্ত অবস্থায় পেলাম। আমি এই মনে করে উঠিয়ে নিলাম যে, এর মালিক পাইলে আমি তাকে দিয়ে দিব। হতে পরে সে এর বিনিময় আমাকে হয়তো কিছু দিয়ে দিবে। অতঃপর ঐ মহিলাটি পুনরায় সামনে আসল এবং বলতে লাগল তুমি তো দোকানদার মনে হচ্ছে। যে নুপুরের বিনিময় কিছু দিয়ে দেয়। এরপরে ঐ মহিলা আমার দিকে কিছু দিরহাম ছুড়ে মারল। বলল এগুলো খরচ করতে থাকো। আমি ওগুলো খরচ করতে থাকি এবং ফিরার পথে মিশর পর্যন্ত তা আমার কাজে আসে’’। (ফাজায়েলে হাজ্জ, মূল উর্দু ২৫৭ পৃঃ, গৃহীত প্রাগুক্ত)

এ ঘটনা প্রথম ঘটনার সমপর্যায়ের যে, এক মহিলার আন্তরিক খেয়াল সম্পর্কে ভৎর্সনা করল এবং সে মহিলা বানান সাহেবের সঙ্গেই ছিল কিন্তু বানান সাহেব তাকে তখন দেখত, যখন সে জাহির হত। উপরন্তু এ ঘটনা শিক্ষা দেয় পাথেয় সাথে না রাখা উচিৎ। অথচ এ বিষয়টি কুরআন মাজীদের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। মহান আল্লাহ বলেন, তোমরা পাথেয়ের ব্যবস্থা কর :

{وَتَزَوَّدُواْ}

‘‘পাথেয় সঙ্গে রাখিও।’’ (সূরা বাক্বারাহ ১৯৭)

পাঠকের খিদমতে এ দশটি ঘটনা তাবলীগী নিসাব থেকে নকল করলাম। তাবলীগী নিসাবে এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা বর্ণিত আছে। আফসোস তাবলীগকারীগণ এ ধরনের ঘটনাগুলো যদি তাবলীগী নিসাব থেকে বাদ দিতেন এবং উক্ত স্থানে কুরআন ও সহীহ হাদীসের মাধ্যমে বিশুদ্ধ ঘটনাগুলো তুলে ধরতেন, তাহলে তাদের এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে অসংখ্য, অগণিত মানুষ শির্ক, বিদ‘আত ও কুফরের পথ থেকে মুক্তি পেতেন। আমরা আশাবাদী উলামায়ে হাক্ব এদিকে মনোযোগ দিবেন।


চলবে ইনশা আল্লাহ .................................