মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খানমহান
আল্লাহ কিছু কিছু সময় এতটাই বরকতপূর্ণ করে বান্দাদের সামনে উপস্থাপন করেন, যে সময়ের সামান্যতম ইবাদতও তাদের আল্লাহর নৈকট্যের উচ্চ শিখরে পৌঁছে দিতে পারে। জিলহজ্ব মাসের প্রথম দশক এ ধরনেরই একটি বরকতপূর্ণ সময়। এ সময়ের রাতগুলোর গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য এখান থেকেই বোঝা যায়, আল্লাহ তায়ালা এ রাতগুলোর নামে কসম করে বলেন ‘১০টি রাতের কসম’। (সূরা ফাজর : ২)। তাই এ রাতগুলোতে মোমিন বান্দার চোখের ঘুম দূর হয়ে যাওয়া উচিত। এ কারণেই আল্লাহর খাস বান্দারা রাতের শেষ প্রহরে তাহাজ্জুদের জন্য আরামের বিছানা ছেড়ে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে যায়। সাড়া দেয় তারা আল্লাহর সেই ডাকের ‘কোথায় রিজিক সন্ধানী! আমার কাছে রিজিক চাও আমি রিজিক দেব, কোথায় অসুস্থ, যে রোগের সুস্থতা চাও, আমি সুস্থতা দান করব’। (মেশকাত)। বিশেষ করে এ রাতগুলোতে আল্লাহর মোমিন বান্দারা এশা ও ফজর নামাজ মহল্লার মসজিদে এসে জামাতের সঙ্গে আদায় করে। কারণ, তারা জানে যারা এশা এবং ফজর জামাতেরসঙ্গে আদায় করে তারা সারারাত নফল নামাজের সওয়াব পায়। (মেশকাত)।
জিলহজ্বের প্রথম দশকের দিনগুলোতে ফজিলতের কথা ব্যক্ত হয়েছে মহানবী (সা.) এর হাদিস শরিফে। এরশাদ হয়েছে, ‘বছরের অন্য কোনোদিনের ইবাদত আল্লাহর কাছে এতটুকু প্রিয় নয়, যতটুকু প্রিয় এ ১০ দিনের ইবাদত। এমন কী জিহাদের চেয়েও। তবে যারা জানমাল নিয়ে জিহাদে গিয়ে ফিরে আসেনি তাদের কথা ভিন্ন’। (বোখারি শরিফ)। এ দিনগুলো সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা নির্ধারিত দিনগুলোতে আল্লাহর জিকির করো’। (সূরা হজ্ব)। মহানবী (সা.) এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘তোমরা এ দিনগুলোতে বেশি বেশি তাহলিল, তাকবির ও তাহমিদ পাঠ কর’। (মেশকাত)। তাহলিল মানে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’। আর তাকবির ও তাহমিদ মানে ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ’। হজরত ইবনে ওমর ও আবু হুরায়রা (রা.) এ দিনগুলোর কোনো একদিন বাজারে গিয়ে দেখতে পেলেন, মানুষের মুখে কোনো তাকবির শোনা যায় না। তখন তারা চিৎকার করে এ তাকবির বলা শুরু করলে বাজারের সবাই সমস্বরে এ তাকবির বলা আরম্ভ করে দেন। বিশেষ করে ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত ২৩ ওয়াক্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ফরজ নামাজের পর একবার করে এ তাকবির পড়ার নির্দেশ এসেছে। ইমামের স্মরণ না থাকলে মুক্তাদি স্মরণ করিয়ে দেবেন। আর মহিলারা নির্জনে বসে নি¤œস্বরে পড়বেন। একে তাকবিরে তাশরিক বলা হয়। জিলহজ্বের প্রথম দশকে মহানবী (সা.) রোজা রাখতেন, অন্যদেরও রোজা রাখতে উদ্বুদ্ধ করতেন। বিশেষ করে নবম তারিখের রোজা প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) বলেন, ‘এ দিনে রোজা রাখলে আল্লাহ তায়ালা অতীতের এক বছর এবং আগামী এক বছরের গোনাহ মা করে দেবেন’। (মেশকাত)। এ সময় বেশি বেশি দান-সদকার কথাও বলা হয়েছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বছরের অন্য সময়ের চেয়ে জিলহজ্বের প্রথম দশক পৃথক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। কারণ ইসলামের পাঁচটি রোকন সমভাবে এ দশকে আদায়ের সুযোগ থাকে। রমজান মাসে রোজার সুযোগ থাকলেও তো হজ্বের সুযোগ পাওয়া যায় না। জিলহজ্বের চাঁদ উদিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি কাজের কথা মহানবী (সা.) আমাদের স্মরণ করে দিয়েছেন ‘যে ব্যক্তি জিলহজ্বের চাঁদ দেখে আর সে কুরবানি করার নিয়ত করে সে যেন তার নখ, চুল না কাটে’। (মেশকাত)। এতে তার ধ্যানমন হাজীদের চেতনায় আল্লাহর জন্য একাগ্র থাকে। হজরত ইবনে ওমর (রা.) রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় দেখতে পেলেন একজন মহিলা তার ছেলের চুল কাটছে। তিনি বললেন, ‘হে মহিলা আর ক’টা দিন অপো করে কুরবানির পর কাটলে তুমিও সওয়াব পেতে তোমার সন্তানও সওয়াব পেত’। (মুস্তাদরাক হাকেম)। এ দিনগুলোতে আল্লাহর প্রিয় বান্দারা আরাফাত, মুজদালিফা, মিনা ও মক্কা-মদিনায় আল্লাহর দরবারে হাজির থাকেন। আমরাও কুরবানির প্রস্তুতি ও কুরবানির মাধ্যমে নিজেদের চেতনাকে তাদের সঙ্গে একাকার করতে পারি। আল্লাহ পাক যেন আমাদেরও তার ঘরের জিয়ারত নসিব করেন। ইসলাম নির্দেশিত ইবাদতগুলোর মধ্যে শান্তির উপায় বিদ্যমান রয়েছে। এেেত্র হজ্ব অন্যতম। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘আজ মানুষের কাছে হজ্বের জন্য ঘোষণা দিয়ে দাও। ওরা আসবে হেঁটে ও ধাবমান উঠের পিঠে চড়ে, আসবে দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে, যাতে তারা তাদের কল্যাণ লাভ করে’। (সূরা হজ্ব : ২৭-২৮)। হজের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে কাবাগৃহ। বর্তমান বিশ্বের প্রধান তিনটি ধর্মের মানুষ এ গৃহকে সম্মান করে থাকে। এ গৃহকে কেন্দ্র করে মানবজাতির ইতিহাসে অনেক স্মরণীয় অধ্যায় রয়েছে। তাই এ গৃহের সংস্পর্শে এলে জাতিগত বিভেদের পরিবর্তে নতুন এক ঐক্যচেতনা জাগ্রত হয়। এ চেতনা বিশ্বশান্তির সহায়ক। রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘নিশ্চয়ই মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা তো বাক্কায় (মক্কার অপর নাম), তা আশীর্বাদপুষ্ট ও বিশ্বজগতের দিশারি। সেখানে বহু সুস্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে, যেমন ইবরাহিমের দাঁড়ানোর স্থান। আর যে কেউ সেখানে প্রবেশ করে সে নিরাপদ। মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সেই গৃহের হজ্ব করা তার একান্ত কর্তব্য’। (সূরা ইমরান : ৯৬-৯৭)। জাতিগত দ্বন্দ্ব, বর্ণ বৈষম্য, ভূখণ্ডগত বিভেদ ইত্যাদি বিশ্বশান্তির েেত্র সর্বাপো বড়রকমের হুমকি হিসেবে দেখা যায়। হজ্বের সময়ে বিশ্বের সব এলাকা থেকে মানুষ একত্রে, একই উদ্দেশ্যে মিলিত হয়। এতে বহুরকমের বৈষম্য-বিরোধ মীমাংসার সুযোগ সৃষ্টি হয়। তাছাড়া একই আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে এবং একই আল্লাহর দাস হিসেবে সবাই মিলে একত্রে একইরকম ইবাদতের মাধ্যমে যে একত্ববাদের চেতনা জাগ্রত হয়, তা বিশ্বশান্তির জন্য অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। বস্তুত সঠিক নিয়তে, যথার্থ উপলব্ধির সঙ্গে যথাযথভাবে হজ্ব পালন করলে একত্ববোধ সৃষ্টি হওয়াটা স্বাভাবিক। উগ্র-ভোগবাদী চেতনা বিশ্বে অশান্তি সৃষ্টির অন্যতম কারণ। মানুষের ভোগলিপ্সার শেষ নেই। তাই দেখা যায়, সম্পদশালীদেরই সম্পদের লোভ যেন বেশি। ধনী চায় আরো ধনী হতে। হজ্বের সময় যেসব মানুষ একত্রে মিলিত হয় তারা কমবেশি ধনী মানুষ। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ধনী লোকেরাই হজ্বে মিলিত হন। তারা সেখানে কৃচ্ছ্রতা সাধন করেন। ইহরাম বাঁধেন। এর মাধ্যমে বিলাসী জীবনের গর্বিত অবস্থা ছেড়ে আল্লাহর গোলাম হিসেবে তার ডাকে সাড়া দিয়ে নিজেকে অন্য সবার মাঝে একাকার করে হাজিরা দেন। ফলে ভোগবাদী জীবন চেতনা পরিবর্তিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। আর এরই ধারাবাহিকতায় সবার ঐক্যানুভূতিতে বিশ্বশান্তি ত্বরান্বিত হতে পারে। কুরবানি নিছক পশু জবাই নয়, কুরবানি হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তাঁর নির্দেশিত পন্থায় নির্ধারিত পশু তাঁর নামে উৎসর্গ করা। যেসব প্রাণী দ্বারা কুরবানি করা যায় সেসবের মধ্যেও নির্ধারিত বয়স ও বৈশিষ্ট্যের শর্ত রয়েছে। কুরবানির উপযুক্ত পশু নির্ধারিত সময়ে জবাই করা অপরিহার্য। কুরবানি একটি ইবাদত। তবে অন্য ধর্মের উপাসনার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানির নিয়ম করে দিয়েছি, যাতে আমি তাদের জীবনোপকরণস্বরূপ যেসব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছি সেগুলোর ওপর তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে’। (সূরা হজ্ব : ৩৪)। হজরত আদম (আ.) থেকে হজরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সব নবী-রাসূল ও তাদের অনুসারীরা কুরবানি করেছেন। মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম কুরবানি হলো হজরত আদম (আ.) এর দুই ছেলে হাবিল ও কাবিলের কুরবানি। কুরআনে কারিমে এরশাদ হয়েছে, ‘আর আপনি আদমের দুই ছেলের ঘটনা তাদের যথাযথভাবে শুনিয়ে দিন, যখন তারা উভয়ে কুরবানি করেছিল তখন একজনের কুরবানি কবুল হলো এবং অন্যজনের কবুল হলো না’। (সূরা মায়েদা : ২৭)। ঘটনা ছিল ‘যখন হজরত আদম ও হাওয়া (আ.) পৃথিবীতে আগমন করেন এবং তাদের সন্তান প্রজনন ও বংশবিস্তার আরম্ভ হয়, তখন প্রতি গর্ভ থেকে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে এরূপ যমজ সন্তান জন্মগ্রহণ করত। অথচ ভাইবোন পরস্পর বিয়ে-বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না। আল্লাহ তায়ালা উপস্থিত প্রয়োজনের খাতিরে আদম (আ.) এর শরিয়তে বিশেষভাবে এ নিদের্শ জারি করেন, একই গর্ভ থেকে যে যমজ ছেলে ও মেয়ে জন্মগ্রহণ করবে, তারা পরস্পর সহোদর ভাইবোন গণ্য হবে। তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হবে হারাম। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন গর্ভ থেকে জন্মগ্রহণকারী ভাইবোন সহোদর হিসেবে গণ্য হবে না। তাদের মধ্যে পরস্পরেরর বিয়ে-বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ। কিন্তু ঘটনাচক্রে কাবিলের সহজাত সহোদর বোনটি ছিল পরমা সুন্দরী এবং হাবিলের সহজাত বোনটি ছিল কুশ্রী ও কদাকার। বিয়ের সময় হলে শরিয়তের নিয়মানুযায়ী হাবিলের অসহজাত কুশ্রী বোন কাবিলের ভাগে পড়ল। এতে কাবিল অসন্তুষ্ট হয়ে হাবিলের শত্রু হয়ে গেল। সে জেদ ধরল, আমার সহজাত বোনকেই আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে হবে। হজরত আদম (আ.) তার শরিয়তের আইন অনুযায়ী কাবিলের আবদার প্রত্যাখ্যান করলেন। অতঃপর হজরত আদম (আ.) হাবিল ও কাবিলের মতভেদ দূর করার উদ্দেশ্যে বললেন; তোমরা উভয়েই আল্লাহর জন্য নিজ নিজ কুরবানি পেশ কর, যার কুরবানি গৃহীত হবে, তার দাবি সত্য বলে গণ্য হবে। তৎকালে কুরবানি গৃহীত হওয়ার একটি স্পষ্ট নিদর্শন ছিল এই যে, আকাশ থেকে একটি অগ্নিশিখা এসে কুরবানিকে ভস্মীভূত করে আবার অন্তর্হিত হয়ে যেত। যে কুরবানি অগ্নি ভস্মীভূত করত না, তাকে প্রত্যাখ্যাত মনে করা হতো। হাবিল ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদি পশু পালন করত। সে একটি উৎকৃষ্ট দুম্বা কুরবানি করল। আর কাবিল করত কৃষিকাজ। সে কিছু শস্য, গম ইত্যাদি কুরবানির জন্য পেশ করল। অতঃপর নিয়মানুযায়ী আকাশ থেকে অগ্নি শিখা অবতরণ করে হাবিলের কুরবানিটি ভস্মীভূত করে দিল এবং কাবিলের কুরবানি যেমন ছিল তেমনই পড়ে রইল। এ অকৃতকার্যতায় কাবিলের দুঃখ ও ােভ আরো বেড়ে গেল। সে আত্মসংবরণ করতে পারল না এবং প্রকাশ্যে তার ভাইকে বলল, অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব। হাবিল তখন ক্রোধের জবাবে ক্রোধ প্রদর্শন না করে একটি মার্জিত ও নীতিগত বাক্য উচ্চারণ করল; এতে কাবিলের প্রতি তার সহানুভূতি ও শুভেচ্ছা ফুটে উঠেছিল। হাবিল বলেছিল, তিনি আল্লাহ-ভীরু পরহেজগারের কর্মই গ্রহণ করেন। সুতরাং তুমি পরহেজগারি অবলম্বন করলে তোমার কুরবানিও গৃহীত হতো। তুমি তা করনি, তাই তোমার কুরবানি প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এতে আমার দোষ কোথায় ...? পরবর্তী ঘটনায় কাবিল হাবিলকে হত্যা করে। তারপর আল্লাহর নবী হজরত নুহ (আ.), হজরত ইয়াকুব (আ.) ও হজরত মুসা (আ.) এর সময়ও কুরবানির প্রচলন ছিল। মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহ-প্রেমে স্বীয় ছেলেকে কুরবানি করার মহাপরীায় উত্তীর্ণ হয়ে এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস সৃষ্টি করেন। প্রায় কয়েক হাজার বছর আগে হজরত ইবরাহিম (আ.) স্বপ্নযোগে সবচেয়ে প্রিয় বস্তু ত্যাগের জন্য আদিষ্ট হন। তিনি পর পর তিন দিন উট কুরবানি করেন। কিন্তু তা কবুল হলো না, বারবার আদেশ হলো, ‘তোমার প্রিয় বস্তু কুরবানি করো’। শেষ পর্যন্ত তিনি বুঝতে পারলেন, প্রাণপ্রিয় শিশু ছেলে হজরত ইসমাঈল (আ.) কে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করতে হবে। হজরত ইসমাইল (আ.) নিজের জানকে আল্লাহর রাহে উৎসর্গ করতে নির্দ্বিধায় সম্মত হয়ে আত্মত্যাগের বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। হজরত ইবরাহিম (আ.) এর প্রতি এটা ছিল আল্লাহর পরীা। তাই বাবার ধারালো ছুরি শিশু ছেলের একটি পশমও কাটতে পারেনি; পরিবর্তে আল্লাহর হুকুমে দুম্বা জবাই হয়। পৃথিবীর বুকে এটাই ছিল আল্লাহর প্রেমের সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ কুরবানি। আত্মত্যাগের সুমহান ও অনুপম দৃষ্টান্তকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য আল্লাহ তায়ালা উম্মতে মুহাম্মদির জন্য পশু কুরবানি করাকে ওয়াজিব করে দিয়েছেন। তাদের স্মরণে এ বিধান অনাদিকাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে, আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না তাদের (কুরবানির) গোশত এবং রক্ত; বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি এদের তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো’। (সূরা হজ্ব : ৩৭)। কুরবানির দিনে প্রত্যেক সজ্ঞান, সামর্থ্যবান, সাবালক, মুকিম মুসলিমের জন্য কুরবানি করা ওয়াজিব। আল্লাহর সন্তুটিই যার একমাত্র উদ্দেশ্য। রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যারা কুরবানি করে না, তারা যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩১২৩)। কুরবানির সময় মোট তিন দিন ১০, ১১ ও ১২ জিলহজ্ব। ১০ জিলহজ্ব ঈদের নামাজের পর থেকে ১২ জিলহজ্ব সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত কুরবানি করা যায়। তবে প্রথম দিন করাই উত্তম। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোনো কারণে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কুরবানি করতে না পারলে একটি মধ্যম মানের ছাগলের মূল্য সদকা করা ওয়াজিব। পরবর্তী বছর কাজা কুরবানি করা জরুরি নয়। (ফাতাওয়া শামী : ৯/৪৫২; বাদায়ে সানায়ে : ৪/২০২; খুলাসাতুল ফাতাওয়া : ৪/৩০৯)। কুরবানির জন্য দিনের বেলাটাই অধিক উপযোগী। অযথা রাতেরবেলা কুরবানি করা সমীচীন নয়, মাকরুহ। এতে অঙ্গহানিসহ পশুর অধিকাংশ রগ না কাটার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। তাই দিনেরবেলা করাই শ্রেয়। তবে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকলে রাতেও করার অবকাশ রয়েছে। (ফাতাওয়া শামী : ৬/৩২০; ফাতাওয়া কাজিখান : ৩/৩৪৫)। কুরবানি একটি মহত ইবাদত। নিছক লৌকিকতা বা অহঙ্কারের জন্য কুরবানি করলে তা কখনোই কবুল হয় না। সেজন্য কুরবানি হওয়া চাই একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির ল্েয। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন, ‘আল্লাহর কাছে (কুরবানির) রক্ত গোশত কিছুই পৌঁছে না। পৌঁছে কেবল তোমাদের সদিচ্ছা-তাকওয়া’। (সূরা হজ্ব : ৩৭)। এজন্য কবুলিয়তের ল্েয মনে মনে নিয়ত করা জরুরি। তবে পশু জবাই করার সময় মুখে নাম উচ্চারণ করা বা পড়ে শোনানো জরুরি নয়। (সূত্র : ফাতাওয়া শামী : ৬/৩১৫; বাদায়ে সানায়ে : ৫/৬৩-৬৪; কিফায়াতুল মুফতি : ৮/১৮৬-১৮৭)। হাদিস শরিফে সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কুরবানির কথা এসেছে। সে হিসেবে নিজ বাড়ির পালিত পশু দ্বারা কুরবানি করা চাই। তা না হলে সামর্থ্যানুযায়ী ভালো পশু কিনেও করা যাবে। আর মহব্বত ও ভালোবাসার কারণেই কুরবানির পশু নিজ হাতে জবাই করা উত্তম। তা না হলে অন্তত জবাইয়ের সময় উপস্থিত থাকা কর্তব্য। (বাদায়ে সানায়ে : ৫/৭৯; ফাতাওয়া কাজিখান : ৩/৩৫৫)। কোনো কারণে কুরবানির পশু নিজে জবাই করতে না পারলে সতর্কতা অত্যন্ত জরুরি। কেননা জবাইকারী মুসলমান হওয়া আবশ্যক। কোনো অমুসলিম বা বিধর্মী দ্বারা জবাই করালে কুরবানি সহিহ হবে না। আবার জবাইয়ের সময় জবাইকারী ও তার ছুরি চালনায় সহযোগীদের বিসমিল্লাহ বলাও জরুরি। ইচ্ছাকৃতভাবে বিসমিল্লাহ না বললে কুরবানি সহিহ হবে না। এমনকি তার গোশত খাওয়াও বৈধ হবে না। বরং সেটি মৃত প্রাণী বলেই বিবেচিত হবে। (সূত্র : ফাতাওয়া শামী : ৬/২৯৬; আল ইখতিয়ার : ১/৫১)। জবাইকালে ছুরিটি তীè, ধারালো হওয়া বাঞ্ছনীয়। ভোঁতা বা কম ধারালো ছুরি দ্বারা জবাই করলে পশু কষ্ট পায়। সেজন্য এরূপ ছুরি দ্বারা জবাই করা মানবতা পরিপন্থী ও মাকরুহ। তেমনি পশুর কমপে তিনটি রগ (খাদ্যনালি, শ্বাসনালি ও শাহ রগ দুটির যে কোনো একটি) কাটা জরুরি। এর ব্যত্যয় ঘটলে কুরবানি সহিহ হবে না। (সূত্র : আল ইখতিয়ার : ১/৫১)। কুরবানির সময় উটকে নহর আর গরু-মহিষ, ছাগল-ভেড়া ইত্যাদিকে জবাই করা মুস্তাহাব। জবাইয়ের ত্রে হলো পশুর চোয়াল ও বুকের মাঝামাঝি স্থান অর্থাৎ গলা। এজন্য পশুর ঘাড় বাঁ পিঠের দিক থেকে জবাই করা মাকরুহ। এতে পশু কষ্ট পায়। আবার অধিকাংশ েেত্রই রগ কাটার আগেই প্রাণীটির মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। সে জন্য গলার দিক থেকেই জবাই করা বাঞ্ছনীয়। (আল ইখতিয়ার : ১/৫১)। জবাইয়ের সময় পশুর দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও কুরবানি সহিহ হবে এবং তার গোশতও খাওয়া যাবে। তবে বিনা প্রয়োজনে এমনটা করা মাকরুহ। এতে পশুকে অযথা কষ্ট দেয়া হয়। তবে এ কারণে কুরবানিতে কোনো প্রভাব পড়বে না। (আল ইখতিয়ার : ৫/১২; মুখতাসারুল কুদুরি : ২৭৬)। ঘটনাক্রমে কুরবানির দিনগুলোতে শক্তিশালী কোনো গরু-মহিষের কাছে যাওয়া সম্ভব না হলে বা কূপ কিংবা খাদে পড়ে যাওয়া কোনো পশু জীবিত ওঠানো সম্ভব না হলে ধারালো অস্ত্র দ্বারা দূর থেকে আঘাত করে রক্ত প্রবাহিত করলেও তা বৈধ হবে এবং তার গোশত খাওয়া হালাল হবে। (আল বাহরুর রায়েক : ৮/১৭১; ফাতাওয়া শামী : ৬/৩০৩; আল ইখতিয়ার : ১/৫১)। উন্নত বিশ্বের কোথাও কোথাও মেশিনে জবাইয়ের প্রচলন রয়েছে। কুরবানির পশু এভাবে জবাই করা সমীচীন নয়। হক্কানি ওলামায়ে কেরাম এটাকে ভালো মনে করেন না। সে জন্য এ থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। তবে কোথাও যদি এমনটা করতেই হয় তাহলে সুইচদাতাকে অবশ্যই মুসলমান হতে হবে এবং বিসমিল্লাহ বলে সুইচ অন করতে হবে। নতুবা কুরবানি সহিহ হবে না। তার গোশত খাওয়াও হালাল হবে না। (ফাতাওয়া শামী : ৯/৪২৭; আল ইখতিয়ার : ৫/৯; আপকে মাসাইল : ৪/১৩০)। জবাইয়ের পর পশুটি নিস্তেজ হওয়ার আগেই তার রগ কাটা বা চামড়া ছিলতে শুরু করা মানবতা-বিবর্জিত ও মাকরুহ। এতে পশুর অসম্ভব কষ্ট হয়। সুতরাং নিস্তেজ হওয়া পর্যন্ত বিলম্ব করা জরুরি। (সূত্র : সুনানে নাসায়ি : ৪৪১৭; কিতাবুল ফাতাওয়া : ৪/১৮৮)। মানবতার খাতিরে ঈদের দিন সবাই পরস্পরকে সহযোগিতা করে। ইমাম পশুটি জবাই করে দিয়ে যান। মহল্লা ও সমাজের কেউ কেউ পশুর চামড়া ছেলা ও গোশত বানানোর কাজে সহযোগিতা করেন। সে জন্য তাদের প্রত্যেককেই কিছু সম্মানী দেয়া কর্তব্য। সেটা ঈদ বোনাসের নামেও হতে পারে। কেননা ঈদের দিন কাউকে দিয়ে ফ্রি শ্রম নেয়া সমীচীন নয়। তাই অন্যের মাধ্যমে জবাই করালে, সহযোগিতা নিলে তাদের যথোপযুক্ত সম্মানী দেয়া একান্ত কর্তব্য। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ৪/৪৫৪; কিফায়াতুল মুফতি : ৮/২৪৩)। অথচ কাজ শেষে দেখা যায়, তাদের কাউকে মাথা, রান, ভুঁড়ি বা সামান্য পরিমাণ গোশত দেয়া হয়। আবার কখনো হুজুরকে চামড়া দিয়েই বিদায় করা হয়। আসলে এমনটা কাম্য নয়। এেেত্র মাসয়ালা হলো : কুরবানির কোনো অংশ পারিশ্রমিক বা বিনিময় হিসেবে দিলে সেটা বৈধ হয় না। কারণ কুরবানির পশুর কোনো অংশ বিক্রয় বা বিনিময়যোগ্য নয়। তবে হাদিয়া হিসেবে দেয়া যেতে পারে। (ফাতাওয়া শামী : ৯/৪৭৫; বাদায়ে সানায়ে : ৫/৮১; ফাতহুল কাদির : ৮/৪৩৭)।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও কলামিস্ট, পাঠান পাড়া, খানবাড়ি.কদমতলী সিলেট।