ভূমিকা : ইসলাম আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত মানবজাতির জন্য সর্বাপেক্ষা কল্যাণকর ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় মানুষের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিটি স্তর পর্যন্ত নৈতিকতা ও মানবীয় মূল্যবোধকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। ইসলাম যেমন মানুষের চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস, জীবন, ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার নিরাপত্তা বিধান করেছে, তেমনি আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের নিমিত্তে যাকাত ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে। যাকাত দ্বীন ইসলামের মৌল পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম এবং ইসলামী অর্থনীতির প্রধান উৎস। ইসলাম সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে শ্রেণী-বৈষম্যহীন সুষম নীতিমালা উপস্থাপন করেছে। ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ তায়ালা, মানুষ তার আমানতদার। যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা মানুষে মানুষে বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে পারস্পরিক সৌন্দর্য ও সম্প্রীতির বন্ধনে সকলকে আবদ্ধ করে ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত সুখী সমাজ বিনির্মাণে অনন্য ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশ মুসলিমপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও এদেশে ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী সঠিক যাকাত ব্যবস্থা পদ্ধতি গড়ে ওঠেনি। সরকারি ব্যবস্থাপনায় এ দেশে যাকাত উত্তোলন ও বণ্টনের কোনো ব্যবস্থা নেই। ব্যক্তিগত উদ্যোগে যাকাত প্রদান ও গ্রহণের যে পদ্ধতি বাংলাদেশে চালু রয়েছে, তা ইসলামের মৌল চেতনার সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। ফলে এদেশ থেকে দারিদ্র্যবিমোচন সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম একটি দরিদ্র দেশ। পরিসংখ্যান মতে, এদেশের অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। যদিও বাংলাদেশ সরকার ২০১৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার অর্ধেকের নিচে নামিয়ে আনার পরিকল্পা গ্রহণ করেছে। কিন্তু বাস্তবে দারিদ্র্যের হার ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। বক্ষমান প্রবন্ধে আমরা বাংলাদেশের যাকাত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির বাস্তবচিত্র ও এ ব্যাপারে করণীয় বিষয়ে আলোকপাত করার প্রয়াস পেয়েছি।
১. যাকাত পরিচিতি : যাকাত শব্দটির আভিধানিক অর্থ পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা, ক্রমবৃদ্ধি, আধিক্য, পরিশুদ্ধি, পরিবর্ধন, পরির্মাজন ইত্যাদি। কুরআন ও হাদীসের বিভিন্ন বর্ণনায় যাকাত শব্দের উপরোক্ত অর্থসমূহ খুঁজে পাওয়া যায়। শরীয়তের পরিভাষায় বিত্তবান মুসলমানদের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের পর উদ্বৃত্ত সম্পদে পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হলে ঐ সম্পদ থেকে অপরিহার্য অংশ নির্দিষ্ট সময়ে আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত পন্থায় বিশেষ শ্রেণীর মানুষের কল্যাণে নিঃশর্তভাবে ব্যয় করাকে যাকাত বলে। ব্যাপক অর্থে, পরিবারের বার্ষিক খরচ মেটানোর পর কোনো মুসলিম ব্যক্তির নিকট যদি ৭.৫ তোলা স্বর্ণ বা ৫২.৫ তোলা রৌপ্য বা তার সমপরিমাণ সম্পদ বর্তমান থাকে; তবে উক্ত সম্পদের ৪০ ভাগের এক ভাগ বা শতকরা ২.৫% হারে শরীয়তের সুনির্দিষ্ট বিধান মোতাবেক নির্ধারিত শ্রেণীর মানুষের মাঝে বণ্টন করার মহৎ কাজকে যাকাত বলে।
হিজরী দ্বিতীয় বর্ষে সাদাকাতুল ফিতরের পর যাকাত ফরজ হয়। ঈমানের পরে দৈহিক ইবাদত হিসেবে সালাত এবং আর্থিক ইবাদত হিসেবে যাকাত সমান গুরুত্বপূর্ণ। কেননা কুরআনের বহু জায়গায় নামায ও যাকাতকে পাশাপাশি স্থান দেয়া হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘তোমাদের একসাথে আদেশ করা হয়েছে নামায কায়েম করার ও যাকাত দেয়ার জন্য। তাই কেউ যাকাত না দিলে তার নামাযও হবে না।’ যাকাত দিতে অস্বীকারকারীকে শরীয়তে কাফির ও মুশরিক বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন- ‘আর ধ্বংস ঐ সমস্ত মুশরিকদের জন্য, যারা যাকাত দেয় না এবং তারা পরকালে অবিশ্বাস করে’ (হামীম আস-সাজদা : ৬-৭)। সূরা তাওবার ৩৪ ও ৩৫নং আয়াতে মহান আল্লাহ এদের বিরুদ্ধে পরকালে কঠোর আযাবের ভয় দেখিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে রাসূলও (সা.) স্বয়ং যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন এবং পরকালে কঠিন শাস্তির ভয় প্রদর্শন করেছেন। তিনি বলেন, ‘যে লোকেরা যাকাত দিতে অস্বীকার করবে, আল্লাহ তায়ালা তাদের কঠিন ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষে নিমজ্জিত করে দেবেন।’ অন্য এক হাদীস থেকে জানা যায়, পৃথিবীতে অনাবৃষ্টির কারণ হচ্ছে যাকাত আদায় না করা। রাসূল (সা.) আরও বলেন, ‘স্থল ও জলভাগে ধন-মাল বিনষ্ট হয় শুধু যাকাত আটকে রাখার কারণে।’ যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে আবু বকর (রা.)-এর ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক ও অনন্য। তার খিলাফতকালে আরবের অনেক গোত্র যাকাত দিতে অস্বীকার করে (যদিও তারা নামায রোজাসহ ইসলামের অপরাপর বিধানাবলী পালনে সম্মত ছিল)। তাদের বিরুদ্ধে আবু বকর (রা.) দৃপ্ত কণ্ঠে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। যাকাত ইসলামের দৃষ্টিতে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, যাকাত অস্বীকারকারী প্রতিটি শক্তির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অস্ত্র ব্যবহার ও যুদ্ধ ঘোষণাকেই ইসলাম ওয়াজিব করে দিয়েছে। বস্তুত যাকাত দিতে অস্বীকারকারী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা বহুসংখ্যক সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তেমনি এর ওপর সাহাবায়ে কিরামের ঐকমত্যও (ইজমা) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অতএব যাকাত প্রদান না করা দুনিয়া এবং আখেরাত উভয় জগতে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
ইসলাম সম্পদের লাগামহীন সঞ্চয়কে নিয়ন্ত্রণ করে পুঁজিবাদের ধ্বংসাত্মক প্রভাব থেকে মানব সমাজকে মুক্ত করার নিমিত্তে যাকাতের বিধান প্রবর্তন করেছে। সম্পদের বিকেন্দ্রীকরণ সুনিশ্চিত করা, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করে সুবিচার ও ভারসাম্যপূর্ণ অর্থব্যবস্থা চালু করা, সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা, ব্যক্তির হৃদয় ও মালের পরিশুদ্ধি আনয়ন করা এবং সর্বোপরি ধনী-গরীব সকলের মাঝে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় করার জন্য মহান আল্লাহ যাকাত ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন। যাকাতের বিধান প্রবর্তনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন- ‘আপনি তাদের ধন-সম্পদ থেকে সাদকাহ (যাকাত) গ্রহণ করুন, আপনি তার দ্বারা তাদের পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন (প্রবৃদ্ধি) করবেন’ (আত-তাওবা : ১০৩)। তিনি বলেন- ‘যেন সম্পদ তোমাদের কেবল ধনীদের মাঝেই আবর্তিত না হয়’ (আল-হাশর : ০৭)। মহান আল্লাহ আরও বলেন- ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তোমরা যে যাকাত দাও, মূলত যাকাতদানকারী সম্পদ বৃদ্ধি করে’ (আর-রূম : ৩৯)। রাসূল (সা.) বলেন- ‘যাকাত ইসলামের সেতুবন্ধন।’ ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন, ‘যাকাত প্রদানের মাধ্যমে যাকাত প্রদানকারীর মন ও আত্মা পবিত্র হয়। বৃদ্ধি পায় তার ধন ও মাল।’
ইসলাম সংঘবদ্ধ জীবনে বিশ্বাসী। যাকাতের ক্ষেত্রেও একই মৌল ভাবধারা কার্যকর। সূরা তাওবার ১০৩নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মুহম্মদ (সা.)-কে মুসলমানদের নিকট থেকে যাকাত আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া উক্ত সূরার ৬০নং আয়াতে যাকাত আদায়ে নিযুক্ত কর্মচারীর জন্য সুনির্দিষ্ট খাত র্নিধারণ করা হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের বিত্তবানদের থেকে যাকাত আদায় করে দরিদ্রদের মাঝে তা বণ্ঠন করার জন্য আমি আদিষ্ট হয়েছি।’ উপরোক্ত দলিলসমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, যাকাত রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সমষ্টিগতভাবে আদায় ও বণ্টন করাই ইসলামের সঠিক রীতি। রাসূল (সা.) এবং খোলাফায়ে রাশিদিনের সময়ে উপরোক্ত পদ্ধতিতে যাকাত ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হতো। আমাদের দেশে ব্যক্তিগতভাবে যাকাত আদায়ের যে ব্যবস্থা প্রচলিত আছে, তা ইসলামের পদ্ধতির সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। ইসলামের সোনালী যুগে এর কোনো নজির খুঁজে পাওয়া যায় না। ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী কোনো সম্পদে যাকাত ফরজ হবার জন্য উক্ত সম্পদ হালাল হওয়া জরুরি। ঋণ পরিশোধ ও ব্যয়ভার বাদে অতিরিক্ত সম্পদের ওপর এক বছর অতিবাহিত হলে এবং তা নেসাব পরিমাণ হলে উক্ত সম্পদে যাকাত আদায় করতে হবে। চান্দ্র মাস অনুযায়ী যাকাতের হিসাব করতে হয়। হাতে নগদ বা ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, স্বর্ণ বা রৌপ্য এবং এসবের তৈরি অলঙ্কারাদি, কৃষি সম্পদ (পচনশীল ও গৌণ শস্য বাদে), বর্ধনশীল পশুসম্পদ, ব্যবসা পণ্য, খনিজ সম্পদ ইত্যাদির ওপর যাকাত ফরজ। নেসাব পরিমাণ মাল সারা বছর ওঠা-নামা করলেও বছরান্তে যদি নেসাব পূর্ণ হয় তবে যাকাত দিতে হবে। Department of Agricultural Extension (DAE), বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরোসহ সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠানসমূহে গচ্ছিত সম্পদ, কৃষি সম্পদ, আয়করভুক্ত ব্যক্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সম্পদ, স্বর্ণালঙ্কারসহ বিভিন্ন সম্পদ থেকে বছরে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি যাকাত আদায় সম্ভব। অতএব উপরোক্ত তথ্যাবলীর আলোকে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, যদি বাংলাদেশে শরীয়ত নির্ধারিত পন্থায় যাকাত আদায় ও বণ্টন করা যায়, তাহলে অনধিক পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের দারিদ্র্যবিমোচন করে এদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা সম্ভব।
২. বাংলাদেশে প্রচলিত যাকাত ব্যবস্থা পদ্ধতির ত্রুটিসমূহ : বাংলাদেশে প্রচলিত যাকাত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি পুরোপুরি শরীয়ত ও বাস্তবসম্মত নয়। ফলে যাকাতের সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। নিম্নে এ সর্ম্পকে আলোচনা পেশ করা হলো :
যাকাত আদায় ও বণ্টনে যথার্থ কর্তৃপক্ষ ও নিয়ম না থাকা : ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে যাকাত উত্তোলন ও বণ্টনের দায়িত্ব সরকারের। আল-কুরআনে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘আমি তাদের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আধিষ্ঠিত করলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে; আর প্রত্যেক কাজের পরিণাম আল্লাহরই’ (আল-হাজ্জ : ৪১)। বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও ইসলামী রাষ্ট্র না হওয়ায় এখানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় যাকাত উত্তোলন ও বণ্টনের কোনো সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ নেই। তাই এদেশের মুসলমানগণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে যাকাত প্রদান করে থাকেন। তারা মাদরাসা, লিল্লাহ বোর্ডিং কিংবা ফকির-মিসকিনকে বিচ্ছিন্নভাবে যাকাতের অর্থ প্রদান করে থাকেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ বা স্বল্প পরিমাণ নগদ অর্থ বিতরণের ফলে সমাজ থেকে দারিদ্র্যবিমোচন হচ্ছে না। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা-বিপর্যয়ও লক্ষ্য করা যায়। ২৪-০৭-২০১৪ তারিখে বসুন্ধরা গ্রুপের শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণে প্রাণহানির ঘটনাই এর বড় প্রমাণ। অন্যদিকে যদিও কোনো কোনো সংগঠন বা সংস্থা যাকাত আদায় ও বণ্টন করে থাকে তবে তাদের মাঝে পারস্পরিক সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা যায়। ফলে যাকাত যে দারিদ্র্যবিমোচন ও সামাজিক নিরাপত্তার গ্যারান্টি, তারও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। যাকাতের মূল উদ্দেশ্য হলো, যাকাত গ্রহীতাকে আত্মনির্ভরশীল করে তোলার মাধ্যমে গ্রহীতার পর্যায় থেকে দাতার পর্যায়ে উন্নীত করা। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত যাকাত পদ্ধতির ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের কোনো পরির্বতন তো হচ্ছেই না, বরং তাদের দারিদ্র্যকে লালন করা হচ্ছে।
জ্ঞানের অভাব : যাকাত প্রদান যে বাধ্যতামূলক ইবাদত এবং ইসলামী সমাজ বিনির্মাণের মুখ্য হাতিয়ার; এ ব্যাপারে জনগণের মাঝে স্বচ্ছ ধারণা নেই। এ কারণে নামায-রোজার ব্যাপারে সাধারণ জনগণ যতটা আগ্রহী বা সচেতন, সচ্ছল লোকেরা হজ্জ পালনে যতটা আগ্রহী, সে তুলনায় যাকাত প্রদানের ব্যাপারে ততটা আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় না। এ বিষয়ে পরিষ্কার ও স্বচ্ছ ধারণা না থাকাই মুখ্য কারণ বলে আমরা মনে করি। এ ব্যাপারে আলেম সমাজের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। কেননা নামায-রোজা সম্পর্কে তারা যতটা ওয়াজ করেন, যাকাতের ব্যাপারে তাদের প্রচারণাটা খুবই কম। সারা বছরের মধ্যে দু-একটি খুতবা কিংবা ওয়াজ মাহফিলে এ ব্যাপারে কথা বলেন কিনা সন্দেহ। ইসলামী পন্ডিতগণের গবেষণা ও প্রচারণাও অপ্রতুল। আধুনিক ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াসমূহে তাদের প্রচারণা সীমিত ও অনুজ্জ্বল। ফলে যাকাতের ব্যাপারে সামগ্রিকভাবে সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে না।
অসুস্থ মানসিকতা : আমাদের এদেশে যাকাত দাতা ও গ্রহীতা উভয়ের মাঝে অসুস্থ মানসিকতা লক্ষ্য করা যায়। দাতা অনুগ্রহ করে দেন এবং গ্রহীতা অসম্মানজনকভাবে দয়া হিসেবে তা গ্রহণ করেন। অথচ ইসলামের সুস্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে, যাকাত একটি ফরজ ইবাদত। এটি কোনো ঐচ্ছিক বিষয় নয়। ধনীদের সম্পদে এটা হচ্ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর নির্ধারিত অধিকার। মহান আল্লাহ বলেন- ‘তাদের ধন-মালে প্রার্থনাকারী ও বঞ্চিতদের হক রয়েছে’ (যারিয়াত : ১৯)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন- ‘সেইসব লোক মনের সঙ্কীর্ণতা থেকে মুক্ত, যাদের ধন সম্পদে প্রার্থনাকারী ও বঞ্চিতদের একটা নির্দিষ্ট হক (অধিকার) রয়েছে’ (মা’আরিজ : ২৪-২৫)। আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন- ‘ফসল কর্তনের দিনে তার নির্ধারিত হক (অধিকার) দিয়ে দাও’ (আল-আন’আম : ১৪১)। উপরোক্ত আয়াতসমূহ থেকে এটা প্রতীয়মান হয়, ধনীদের সম্পদে দরিদ্র ও অসহায় জনগোষ্ঠীর নির্ধারিত হক (অধিকার) রয়েছে। অতএব যাকাত ও উশর প্রদান দরিদ্রের প্রতি অনুগ্রহ নয়; বরং তাদের নির্দিষ্ট অধিকার প্রদান। আরও একটি বিষয় গভীরভাবে লক্ষণীয়, তা হচ্ছে কিছু কিছু বিত্তবানদের যাকাত ফাঁকি দেয়ার অসুস্থ মানসিকতা। তারা বিভিন্ন কূট-কৗশল অবলম্বন করে নিজেদের ঋণগ্রস্থ কিংবা সাহিবে নেসাব নয়, তা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেকের বাস্তব অবস্থা ও মনের অবস্থা ভালোভাবে জানেন। এ ধরনের অসুস্থ চিন্তা কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিতে মারাত্মক অপরাধ হিসেবে গণ্য। (চলবে)