ঘুমানো এবং জাগ্রত হওয়ার আদব

রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে-


লিখেছেনঃ  আখতারুজ্জামান মুহাম্মদ সুলাইমান   
165
ঘুম আল্লাহ তাআলার একটি বিশাল নেয়ামত , এর মাধ্যমে তিনি নিজ বান্দাদের উপর বিরাট অনুগ্রহ করেছেন। এবং তাদের জন্য সহজ করে দিয়েছেন। আর নেয়ামতের দাবি হল শুকরিয়া আদায় করা তথা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। আল্লাহ তাআলা বলেন : 

وَمِنْ رَحْمَتِهِ جَعَلَ لَكُمُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ لِتَسْكُنُوا فِيهِ وَلِتَبْتَغُوا مِنْ فَضْلِهِ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ ৭৩ (القصص ৭৩)

তিনিই স্বীয় রহমতে তোমাদের জন্যে রাত ও দিন করেছেন যাতে তোমরা রাত্রে বিশ্রাম গ্রহণ কর ও তার অনুগ্রহ অন্বেষণ কর এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।  [আল কাসাস : ৭৩]

وقال سبحانه وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا.  النبأ : ৯

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন:তোমাদের নিদ্রাকে করেছি ক্লান্তি দূরকারী। [আন নাবা : ৯]
দিনের ক্লান্তিকর চলাফেরার পর রাত্রে শরীরের প্রশান্তি শরীর সুস্থ থাকাকে সাহায্য করে।অনুরূপ ভাবে শরীরের বর্ধন এবং কর্ম চাঞ্চল্যতেও সাহায্য করে। যাতে করে ঐ দায়িত্ব পালন করতে পারে যার জন্য আল্লাহ তাআলা তাকে সৃষ্টি করেছেন।

মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে যা কিছু অতি জরুরী ঘুম তার অন্যতম। মুমিন বান্দা যদি ঘুমের মাধ্যমে দেহ ও মনকে আরাম দেওয়ার নিয়ত করে , যাতে করে সে আল্লাহ তাআলার আনুগত্যের বিষয়ে আরো দৃঢ় হতে পারে। অতঃপর ঘুমের সমস্ত সুন্নত ও শরয়ী আদব পরিপূর্ণ রূপে পালন করার চেষ্টা করে , তবে তার ঘুম এবাদত হিসাবে পরিগণিত হবে এবং সে পুণ্য লাভ করবে।

সাহাবী মুআয বিন জাবাল রা. বলতেন :―

أما أنا فأنام وأقوم، فأحتسب نومتي كما أحتسب قومتي.البخاري (৩৯৯৮)

আর আমি (রাতে) ঘুমাই এবং জাগ্রত হয়ে সালাত আদায় করি, জাগ্রত থেকে সালাত আদায়ের মাধ্যমে যে ভাবে ছাওয়াবের আশা করি ঠিক তেমনি করে ঘুমানোর মাধ্যমেও ছাওয়াবের আশা করি । [বোখারি : ৩৯৯৮]

ইবনে হাজার র. বলেন এর অর্থ হল: 

قال ابن حجر رحمه اللّه: معناه أنه يطلب الثواب في الراحة كما يطلبه في التعب،

তিনি আরামের ভিতর পুণ্য আশা করতেন যেমন কষ্টের ভিতর আশা করতেন।
কেননা, আরামের উদ্দেশ্য যদি এবাদত করার জন্য সাহায্য সঞ্চয় করা হয়, তবে সে আরামের দ্বারা পুণ্য হবে। এখানে মুয়ায ইবনে জাবাল রা.-এর জাগ্রত হওয়ার দ্বারা উদ্দেশ্য হল রাতের নামায।
 ঘুমের কতিপয় আদব এবং বিধান:~
(১) অধিক রাত্রি জাগরণ না করে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়া মোস্তাহাব ―
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এশার নামাযের পূর্বে ঘুমানো এবং নামাযের পর অহেতুক গল্প-গুজব করাকে খুব অপছন্দ করতেন । [বোখারি : ৫১৪]
কিন্তু ভাল ও নেক কাজের জন্য এশার পরে জাগ্রত থাকাতে কোন ক্ষতি নেই। যেমন মেহমানের সাথে কথা বলা অথবা ইলমী আলোচনা করা অথবা পরিবারকে সময় দেওয়া ইত্যাদি। মোটকথা, যে জাগ্রত থাকা কোন ক্ষতির কারণ হবে না যেমন ফজরের নামায নষ্ট হয়ে যাওয়া, সে জাগ্রত থাকাতে কোন ক্ষতি নেই।
তাড়াতাড়ি ঘুমানোর উপরকারিতা 
  • ক) সুন্নতের অনুসরণ।
  • খ) শরীরকে আরাম দেওয়া, কেননা দিনের ঘুম রাত্রের ঘুমের ঘাটতি পূরণ করতে পারে না।
  • গ) ফজরের নামাযের জন্য খুব সহজে এবং পূর্ণ শক্তি ও চাঞ্চল্যতার সাথে জাগ্রত হওয়া যায়।
  • ঘ) তাহাজ্জুদের নামাযের জন্য শেষ রাতে জাগ্রত হতে ইচ্ছুক ব্যক্তির জন্য এটি বড় সহায়ক ।

(২) প্রত্যেক মুসলমানকে সব সময় ওযু অবস্থায়ই ঘুমাতে চেষ্টা করা উচিত। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বারা ইবনে আযেব রা.-কে বলেছিলেন―

إذا أخذت مضجعك فتوضأ وضوءك للصلاة. مسلم (৪৮৮৪)

যখন তুমি বিছানায় যাবে তখন নামাযের ওযুর মত ওযু করবে। [মুসলিম : ৪৮৮৪]
(৩) ডানদিকে পাশ ফিরে ঘুমাবে। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :― 

ثم أضطجع على شقك الأيمن.

অতঃপর ডান কাত হয়ে ঘুমাও।
(৪) উপুড় হয়ে ঘুমানো মাকরূহ। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :― 

إنها ضجعة يبغضها الله عز وجل.

এটি এমন শয়ন, যাকে আল্লাহ তাআলা খুব অপছন্দ করেন।
(৫) ঘুমানোর সময় হাদীসে বর্ণিত আযকার ও দোয়া থেকে সাধ্যানুযায়ী পড়ার চেষ্টা করবে। যিকির তথা আল্লাহর নাম নেয়া ব্যতীত ঘুমানো মাকরূহ। 
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত―

ومن اضطجع مضجعا لم يذكر الله تعالى فيه إلا كان عليه من الله تِرَة يوم القيامة أبو داود (৪৪০০)

যে ব্যক্তি আল্লাহর যিকির ছাড়া শুয়ে পড়বে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আক্ষেপের বিষয় হবে। [আবু দাউদ : ৪৪০০]

হাদীসে বর্ণিত (ঘুমানোর সময়ের) কিছু দোয়া:~

ক) আয়াতুল কুরসী পড়া। 

عن أبي هريرة قال: وكّلني رسول الله صلى الله عليه وسلم بحفظ زكاة رمضان، فأتاني آت فجعل يحثو من الطعام… وذكر الحديث، وفيه أن هذا الآتي قال له: إذا أويت إلى فراشك فاقرأ آية الكرسي، فإنه لن يزال معك من الله تعالى حافظ، ولا يقربك شيطان حتى تصبح، فقال النبي صلى الله عليه وسلم: صدقك، وهو كذوب، ذاك شيطان.البخاري (৩০৩৩)

অর্থাৎ আবু হুরাইরা রা. বলেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে রমযানের ফিতরা সংরক্ষণের দায়িত্ব দিলেন। কোন এক আগন্তুক আমার কাছে আসল, এবং অঞ্জলি ভরে খাবার (চুরি) সংগ্রহ করতে লাগল।… এরপর পূর্ণ হাদীস বর্ণনা করেন। -তাতে আছে- আগন্তুক তাকে বলল : তুমি যখন তোমার বিছানায় যাবে তো আয়াতুল কুরসী পড়বে, কেননা এর মাধ্যমে সর্বক্ষণ তোমার সাথে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে একজন হেফাজতকরী থাকবে এবং সকাল পর্যন্ত শয়তান তোমার কাছে ঘেঁসতে পারবে না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তোমাকে সত্য বলেছে অথচ সে বড় মিথ্যাবাদী। সে হচ্ছে শয়তান।[বোখারি : ৩০৩৩]

খ) সূরা এখলাস, সূরা ফালাক এবং সূরা নাস পড়া। 
আয়েশা রা. বর্ণনা করেন:

أن النبي صلى الله عليه وسلم كان إذا أوى إلى فراشه- كل ليلة – جمع كفيه ثم نفث فيهما، وقرأ فيهما قل هو الله أحد و قل أعوذ برب الفلق و قل أعوذ برب الناس، ثم مسح بهما ما استطاع من جسده، بدأ بهما على رأسه ووجهه وما أقبل من جسده، يفعل ذلك ثلاث مرات. . الترمذي (৩৩২৪)

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন প্রতি রাত্রিতে নিজ বিছানায় যেতেন দুই হাতের কবজি পর্যন্ত একত্রিত করতেন অতঃপর তারমাঝে ফু দিতেন এবং সূরা এখলাস, সূরা ফালাক ও সূরা নাস পড়তেন । অতঃপর দুই হাত যথা সম্ভব সমস্ত শরীরে মলে দিতেন। মাথা ,চেহারা এবং শরীরের সামনের অংশ থেকে শুরু করতেন। এরূপ পরপর তিনবার করতেন।  [তিরমিজি : ৩৩২৪]
গ) اللهم باسمك أموت وأحيا দোআটি পড়া।
অর্থাৎ হে আল্লাহ আপনার নামে মৃত্যবরণ করলাম এবং আপনার নামেই জীবিত হব।
ঘ) নিম্নোক্ত দোআটি পড়া।

اللهم أسلمت نفسي إليك، وفوّضت أمري إليك، وألجأت ظهري إليك، رغبة ورهبة إليك، لا ملجأ ولا مَنجى منك إلا إليك، آمنت بكتابك الذي أنزلت، ونبيّك الذي أرسلت.البخاري (৫৮৩৬)

অর্থাৎ, হে আল্লাহ আমি নিজেকে আপনার কাছে সঁপে দিয়েছি। আমার বিষয় আপনার কাছে সোপর্দ করেছি। আমার পিঠ আপনার সাহায্যে দিয়েছি আপনার প্রতি আশা এবং ভয় নিয়ে, আশ্রয় নেয়ার ও আপনার শাস্তি থেকে বাঁচার মত জায়গা আপনি ছাড়া আর কেউ নেই। আমি ঈমান এনেছি আপনার অবতীর্ণ কিতাবের প্রতি এবং আপনার প্রেরিত নবীর প্রতি।    [বোখারি : ৫৮৩৬]
(৬) ঘুমের মাঝে অনাকাংখীত ও অপছন্দনীয় কিছু দেখলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঁচটি কাজ করতে বলেছেন।
  • ক) বাম দিকে তিন বার থুতু ফেলবে।
  • খ) أعوذ بالله من الشيطان الرجيم বলে আল্লাহ তাআলার কাছে আশ্রয় চাইবে।
  • গ) এ স্বপ্নের কথা কাউকে বলবে না।
  • ঘ) যে কাতে শোয়া ছিল সে কাত থেকে ঘুরে শোবে অর্থাৎ পার্শ্ব পরিবর্তন করে শোবে।
  • ঙ) নামাজে দাঁড়িয়ে যাবে।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম র. এ পাঁচটি কাজ উল্লেখ করে বলেন : যে এই কাজগুলো করবে খারাপ স্বপ্ন তার ক্ষতি করতে পারবে না বরং এ কাজ তার ক্ষতি দূর করে দেবে।
(৭) সন্তানদের বয়স দশ বছর হয়ে গেলে তাদের বিছানা আলাদা করে দেয়া একান্ত আবশ্যক।রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
مروا أولادكم بالصلاة وهم أبناء سبع سنين، واضربوهم عليها وهم أبناء عشر، وفرّقوا بينهم في المضاجعأبوداود ( ৪১৮)
অর্থাৎ তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে নামাযের আদেশ দাও যখন তাদের বয়স সাত বৎসর হবে এবং এর জন্য তাদেরকে শাস্তি দাও যখন তাদের বয়স দশ বৎসর হবে এবং তাদের বিছানা আলাদা করে দাও। [আবু দাউদ : ৪১৮]
(৮) মুসলমান অবশ্যই সর্বদা ফজরের নামাযের পূর্বে জাগ্রত হবে যেন নামায সময় মত জামাতের সাথে ঠিকভাবে আদায় করতে পারে। এ ব্যাপারে চেষ্টা করা এবং এতে সহায়তাকারী উপকরণাদি গ্রহন করা তার জন্য ওয়াজিব।

سئل النبي عن رجل نام حتى أصبَح؟  ্ذاك رجل بال الشيطان في أذنيهالنسائي (১৫৯০)

এক ব্যক্তি ফজর পর্যন্ত ঘুমিয়ে ছিল তার সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করা হল। রাসূল বললেন : ঐ ব্যক্তির কর্ণ-দ্বয়ে শয়তান প্রস্রাব করে দিয়েছে।     [নাসায়ী : ১৫৯০]
(৯) মুসলমান ব্যক্তি ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর নিম্নোক্ত দোয়া পড়া মোস্তাহাব:

الحمد لله الذي أحيانا بعد ما أماتنا وإليه النشور.

الحمد لله الذي ردّ علي روحي وعافاني في جسدي، وأذِن لي بذكره،

সকল প্রশংসা ঐ আল্লাহর জন্য যিনি আমাকে মৃত্যু দেয়ার পর জীবিত করে দিয়েছেন এবং তার কাছেই ফিরে যাব। 
সমস্ত প্রশংসা ঐ আল্লা¬র জন্য যিনি আমার আত্মাকে আমার নিকট ফিরিয়ে দিয়েছেন , আমার শরীরেকে সুস্থ রেখেছেন এবং আমাকে তার স্মরণের অনুমতি দিয়েছেন।
অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুকরণে মিসওয়াক করবে।