একজন ঈমানদার দা‘ঈর বর্জিত গুণাবলি পর্ব ৪

রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে- 


ক্রোধ পরিচিতি
গজব (غضب) শব্দটি আরবী। যার আভিধানিক অর্থ রাগ, ক্রোধ, রোষ, কোজ, ক্রুদ্ধ ইত্যদি। রাগ বা গোস্সা হওয়াকে গজব বলে। এটি লেনফসিহী মাজমুম (নিন্দনীয়) কিন্তু লি-অজহিল্লাহ মাজমুম নয় বরং মাহমূদ তথা প্রশংসনীয়।
ক্রোধের কারণ ও শ্রেণীবিভাগ

ক্রোধের কারণসমূহ

মানবীয় গুণে রাগের উদয় কয়েকটি কারণে হতে পারে। যেমন :

(ক) স্বভাবগত ক্রোধ

(খ) অহংকারের ফলে উদ্ভূত ক্রোধ

(গ) ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের লালসা জনিত ক্রোধ

(ঘ) অনর্থক কলহ বশত: ক্রোধ

(ঙ) অত্যধিক হাসি মজাক ও ঠাট্টা বিদ্রুপ

জনিত ক্রোধ
ক্রোধের শ্রেণীবিণ্যাস

ক্রোধ বিভিন্ন প্রকার। নিম্নে তার সার বর্ণনা করা হল।

(ক) প্রশংসনীয় ক্রোধঃ যেমন আল্লাহর প্রতি মহব্বত পোষণকারী কোন মুসলিম যখন আল্লাহদ্রোহী কোন কাজ হতে দেখে, তখন সে ক্রুদ্ধ হয়। এই ক্রোধ প্রশংসনীয়। এমন ব্যক্তি আল্লাহর নিকট পুরস্কৃত হবে।

আল্লাহ তাআলা বলেন:

ذَلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ حُرُمَاتِ اللَّهِ فَهُوَ خَيْر لَهُ عِنْدَ رَبِّهِ

এটাই বিধান। আর কেউ আল্লাহর সম্মানযোগ্য বিধানাবলীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলে পালনকর্তার নিকট তা তার জন্য উত্তম।৩৭

(খ) নিন্দনীয় ক্রোধঃ এ এমন ক্রোধ যা হতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন। যেমন নিজের অন্যায় দাবী প্রতিষ্ঠা করার জন্য ক্রুদ্ধ হওয়া। এ প্রকারের ক্রোধান্ধ ব্যক্তি আল্লাহর নিকট ঘৃণিত।

(গ) স্বভাবগত ক্রোধঃ যেমন কারো স্ত্রী তার কথা অমান্য করলে সে ক্রুদ্ধ হয়, এই প্রকারের ক্রোধ হালাল, কিন্তু এর কু-পরিণামের কারণে এই ক্রোধ থেকেও বারণ করা হয়েছে। একে রাসূলের নিষিদ্ধ ক্রোধের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।৩৮
ক্রোধের পরিণতি
ক্রোধ বুদ্ধিমান ব্যক্তির বুদ্ধি নির্ভুলভাবে প্রয়োগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, ফলে উত্তেজনার বশীভূত হয়ে অন্যায়ের নির্দেশ প্রদান করে। অত:পর যখন ক্রোধ থেমে যায়, তখন এর জন্য লজ্জিত হয়। যেমন কেউ ক্রোধে অস্থির হয়ে স্ত্রীকে তালাক দিয়ে ফেলল। বা নিজ সন্তানকে অথবা আপনজনকে এমন প্রহার করল যে, সে রক্তাক্ত হয়ে গেল। এহেন ক্রোধের কারণে নিশ্চয় পরবর্তীতে সে লজ্জিত হবে।
ক্রোধান্ধ ব্যক্তি থেকে মানুষ পলায়ন করে, বর্জন করে তার আশপাশ। ফলে সে কখনো মানুষের শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতা লাভ করতে পারে না, বঞ্চিত হয় মানুষের সু-দৃষ্টি হতে। বরং সব সময় মানুষের নিকট সে ঘৃণিত হয়ে থাকে।
ক্রোধ হল মানুষের মাঝে শয়তানের প্রবেশদ্বার। এ পথে প্রবেশ করে মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি নিয়ে সে খেলা করে।
ক্রোধ পাপ কাজের দ্বার উন্মুক্তকারী।
ক্রোধ সমাজে বিরাজমান পারস্পরিক আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্যকে ভেঙে দিয়ে বিশৃঙ্খলা ও অমানবিকতা সৃষ্টি করে।
ক্রোধ স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। কেননা অত্যধিক ক্রোধ মস্তিষ্ক যা সম্পূর্ণ শরীরের নিয়ন্ত্রক-এর উপর আঘাত হানে। ফলে তা বহু মূত্র, রক্তের বায়ুচাপ, ও হার্টের দুর্বলতাসহ অনেক রোগের কারণ হয়।
ক্রোধের পরিণামফল হল, নিজের সম্পদ ধ্বংস করা ও মানুষের রোষানলে পতিত হওয়া।
ক্রোধ নিবারণ করার সুফল

রাগান্বিত হলে তা সাথে সাথে দমন করা একটি বুদ্ধিমান ও বিবেকবান ব্যক্তির পরিচয়। শুধ তাই নয়, এ মহৎগুণ অর্জন করার পেছনে ইসলামের উৎসাহও বিদ্যমান। এ প্রসঙ্গে হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে :

عن أبي هريرة- رَضِيَ اللهُ عَنْهُ- أَنَّ رَجُلاً قَالَ لِلنَّبِيُّ- صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ: أوْصِنِيْ قَالَ : لَا تَغْضَبْ، فَرَدَّدَ مِرَارًا، قَالَ : لَا تَغْضَبْ

“আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেন, জনৈক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে এসে বললেন, আমাকে কিছু উপদেশ দিন। রাসূল বললেন, ক্রুদ্ধ হয়ো না। সে ব্যক্তি বারংবার উপদেশ চাইলে রাসূল (একই উত্তর দিয়ে) তাকে বললেন, ক্রদ্ধ হয়ো না।”৩৯

ক্রোধান্বিত হওয়ার মতো কোন ঘটনা ঘটলে তা থেকে নিস্কৃতি লাভের জন্য পবিত্র কুর’আন ও হাদীসে ক্রোধ সংবরণের মর্যাদা সংক্রান্ত উক্তির কথা স্মরণ করতে হবে। তাহলে ক্রোধের সার্বিক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বা অনিষ্টতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। মহান আল্লাহ তায়ালা মুত্তাকী বা পরহেযগারদের চরিত্র উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন :

“আর যারা নিজেদের রাগকে সংবরণ করে এবং মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে।”৪০

হাদীসের এক বর্ণনায় এসেছে :

من كظم غيظا و هو قادر على أن ينفذه دعاه الله على رءوس الخلائق حتى يخيره من الحور العين يزوجه منها ما شاء

“যে ব্যক্তি ক্রোধ প্রকাশ ও তদনুযায়ী কাজ করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তা দমন করল আল্লাহ তা‘আলা তাকে (কিয়ামত দিবসে) সৃষ্টিকূলের সামনে ডেকে পাঠাবেন এবং তার পছন্দমতো হুরের সাথে তাকে বিয়ে দিবেন।”৪১
ক্রোধ থেকে বাঁচার উপায়

এ ভয়ানক ক্ষতিকর পরিণতির বিষয়টি থেকে পরিত্রাণের কয়েকটি উপায় রয়েছে। যেমন :

(ক) যে সমস্ত কারণে মানুষ ক্রুদ্ধ হয় সেগুলো থেকে দূরে থাকা।

(খ) মুখ ও অন্তর দ্বারা আল্লাহর যিকির করা। কেননা, ক্রোধ হল শয়তানের কু-প্রভাবের বিষক্রিয়া। তাই যখন মানুষ আল্লাহর যিকির করে তখন শয়তানের প্রভাব মুক্ত হয়ে যায়।

(গ) ক্রোধ পরিত্যাগ ও মানুষকে ক্ষমার সওয়াবের কথা স্মরণ করা। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন :

তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে ছুটে যাও, যার সীমানা হচ্ছে, আসমান জমিন, যা তৈরি করা হয়েছে মুত্তাকীদের জন্য। যারা সচ্ছলতায় ও অভাবের সময় ব্যয় করে, যারা নিজেদের রাগকে সম্বরণ করে, আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস্তুত: আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরকেই ভালোবাসেন।৪২

(ঘ) ক্রোধের মন্দ পরিণতির কথা স্মরণ করা। ক্রোধান্ধ ব্যক্তি যদি ক্রুদ্ধ অবস্থায় নিজ অশোভণীয় বিকৃত আকৃতি দেখতে পেত তাহলে লজ্জায় তখনি ক্ষান্ত হয়ে যেত।

(চ) ক্রুদ্ধ ব্যক্তির অবস্থার পরিবর্তন করা, যে অবস্থায় ছিল তার পরিবর্তে অন্য অবস্থা গ্রহণ করা।

(ছ) ওজু করা, তা এই জন্য যে, ক্রোধ হল শয়তানের পক্ষ থেকে। আর শয়তান আগুনের তৈরি। আর আগুন পানি দ্বারা নির্বাপিত হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে রাসূলের সুস্পষ্ট বাণী রয়েছে।

(জ) যখন ক্রোধ আসবে, তখন أعوذ بالله من الشيطان الرجيم পড়ে নিতে হবে।

মু‘মিনের বিশেষ গুণ হল সে সব সময় উভয় জগতের মঙ্গলজনক কাজে সচেষ্ট থাকে, যেমন হাদিসে বর্ণিত ব্যক্তি উপদেশের জন্য রাসূলের উপস্থিতিকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে রাসূল থেকে বারংবার উপদেশ চাচ্ছিলেন, যা তার জীবনের পাথেয় হবে। বর্তমান যুগে আল্লাহর পথে আহ্বায়ক ও আলেম সম্প্রদায়ের উপস্থিতি আল্লাহর অনুগ্রহ মনে করে তাদের শিক্ষা, আদেশ ও উপদেশ থেকে উপকৃত হওয়া উচিত।


৩৭. সূরা আল-হজ্জ, আয়াত : ৩০
৩৮. ইমাম আল-গাজ্জালী, কিমিয়ায়ে সা‘আদাত, খণ্ড ১, পৃ. ৪
৩৯. বুখারী, হাদীস নং-৫৬৫১
৪০. সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৩৪
৪১. আলবানী, সহীহুল জামে, ২য় খণ্ড, পৃ. ১১১২, হাদীস নং- ৬৫২২
৪২.সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৩৩, ১৩৪


প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না

লেখক:মুহাম্মদ শাহিদুল ইসলাম