রমাদান, কুরআন ও তাকওয়া

সাইয়েদ কামালুদ্দীন ‘আব্দুল্লাহ জাফরী

রমাদান
আরবী চান্দ্রমাসের মধ্যে রমাদানকে শ্রেষ্ঠ মাস হিসেবে গণ্য করা হয়। কেননা, এ মাসে মানবজাতির মুক্তির দিকনির্দেশনা হিসেবে আল-কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ

“রমাদান এমন একটি মাস, যে মাসে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে।”

অর্থাৎ, মাহে রমাদানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য জড়িয়ে আছে পবিত্র কুরআনের সাথে। বিশেষ কড়ে এ মাসে এমন একটি রাত রয়েছে যে রাতকে হাজার মাসের চেয়েও উত্তম রাত হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আর তাও এজন্য যে, এ রাতে পবিত্র কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ


“এ রাতেই (লাইলাতুল কদর) আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি।”

মোটকথা, মাহে রমাদান ও লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব ও মহাত্ম্য পবিত্র কুরআনের কারণেই। তাই রমাদান মুস্লিম ঊম্মাহর মাঝে আসে এক কল্যাণময় ও তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা নিয়ে। একজন ম’মিন তার ঈমান ও ‘আমলকে উন্নত করার লক্ষ্যে এ মাসের জন্য দীর্ঘ ১১টি মাস অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। কেননা, কুরআন নাযিলের কারণে এ মাসের ‘ইবাদাত-বান্দেগীর ফযিলত অন্যান্য মাসের চাইতে অনেক গুণ বেশি। ফলে রমাদানে সিয়াম সাধনা রোজাদার ব্যক্তির অন্তরে আল্লাহ তা’য়ালার প্রতি ঐকান্তিক বিশ্বাস জাগিয়ে তোলে, প্রভুর মুহাব্বতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে রোজাদারের দেহ-মন।
কুরআন
কুরআন মানবজাতির জন্য আল্লহপাকের পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠ নেয়ামত। এর মাধ্যমে তিনি মানবজাতিকে আইন ও জীবন ব্যবস্থার পথ সুস্পষ্টরূপে বাতলে দিয়েছেন। কুরআনের পরিচয় দিতে গিয়ে আল্লাহ তা’য়ালা বলেনঃ

“কুরআন হচ্ছে মানবজাতির জন্য হেদায়াতস্বরূপ এবং পথনির্দেশনার সুস্পষ্ট দলিল ার হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য বিধানকারী।”

অর্থাৎ, কুরআন বর্ণ, বংশ, গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য অনুপম আদর্শ হিসেবে উপস্থাপিত। সামগ্রিক মানবীয় জীবনাদর্শের অনন্য গাইদ লাইন হিসেবে কুরআন যে পথনির্দেশনা প্রদান করে পৃথিবীতে অন্য কোন গ্রন্থ তা পেশ করতে পারেনি। কুরআনে যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া হয়েছেঃ

“তোমরা যদি কুরআন সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দেহে পতিত হও তাহলে কুরআনের এক্তু সূরার ন্যায় অন্য একটি সূরা রচনা করে নিয়ে আস।”

এ চ্যালেঞ্জের মকাবিলা করে আরবী সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি লাবীদ বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘এতি কোন মানব রচিত প্রন্থ নয়।’ বাস্তবিকই ঐশী প্রন্থ হিসেবে কুরআন মানুষকে দিয়েছে সঠিক পথের দিশা। উপরন্তু যুগ পরিক্রমায় সত্যের সাথে অসত্যের বেড়াজালে মানুষ যেন জড়িয়ে না পড়ে সেজন্য কুরআন সত্যকে সত্য হিসেবে এবং মিথ্যাকে মিথ্যা হিসেবে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে, যাতে করে মানুষ কুরআনের প্রকৃত মহিমা উপলদ্ধি করতে সক্ষম হয়। যদিও প্রকৃতপক্ষে কুরআন গতা মানবজাতির জন্য হেদায়াতের দিকনির্দেশিকা হিসেবে অবতীর্ণ, এতদসত্ত্বেও সকল মানুষ তার থেকে কল্যাণ অর্জন করতে পারে না। এর কারণ হচ্ছে কুরআন থেকে হেদায়াত পেতে হলে যে গুণটি প্রথমে দরকার তাহচ্ছে- তাকওয়া।

কুরআনের প্রারম্ভেই বলা হয়েছে, “এ কুরআন হচ্ছে মুত্তাকীন্দের জন্য হেদায়াতস্বরূপ।” তাত্ত্বিক অর্থে, আল-কুরআন সকলকেই অন্ধকারে পথের দিশা দিয়ে থাকে। কিন্তু অন্ধ ব্যক্তির দৃষ্টিশক্তি না থাকার কারণে সে আলো থাকা সত্ত্বেও পথ চলতে পারে না। এর জন্য দোষটা আলোর নয়, তার দৃষ্টিহীনতার। এমনি কুরআনের হেদায়াত তথা আলো পেতে হলে সর্বকাজে আল্লহকে ভয় করতে হবে। তাই কুরআনের আলো ধারণ করার জন্য চাই অন্তরে সর্বদা আল্লহকে ভয় করার জাগ্রত চেত্না। প্রতিটি কাজেকর্মে আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলা। রমাদান মানুষের মাঝে এ খোদাভীতি অর্জনের প্রেরণা সৃষ্টি করে, যা কিনা তাকওয়ারই নামান্তর।

সিয়াম

সিয়াম ইসলামের একটি অন্যতম রুকন। আত্মশুদ্ধির শ্রেষ্ঠ উপায় হিসেবে মহান প্রভু আমাদের উপর সিয়াম সাধনা করা অত্যাবশ্যকীয় করে দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে:

“অতঃপর যে ব্যক্তি এ মাসটি পায় সে যেন সিয়াম সাধনা করে।”

অন্যত্র বলা হয়েছেঃ

“তোমরা যারা ঈমান এনেছো! তোমাদের উপর সিয়ামের বিধান দেয়া হয়েছে, যেমনিভাবে দেয়া হয়েছিলো তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।”

অতএব বলা যায়, সিয়ামের গুরুত্ব ও মর্যাদা কুরআনের জন্য আর কুরআন মানবজাতির একমাত্র গাইড বুক। এ গাইড বুক পেতে হলে দরকার তাকওয়ার। আর এ তাকওয়া অর্জনে সিয়াম বিশেষ ভুমিকা পালন করে।
তাকওয়া
তাকওয়া একজন মুমিনের শ্রেষ্ঠ গুণ। তাকওয়ার তথা খোদাভীতি অন্তরে না থাকলে মানুষ যে কোন গর্হিত কাজ করতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করে না। আল্লাহপাক রোজার প্রাসঙ্গিক আয়াতে ‘লা’আল্লাকুম তাত্তাকুন’ শব্দটি ব্যবহার করে তাকওয়া অর্জনের এ অন্যতম উপায়টি সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন। আল্লহকে উপস্থিত জেনে প্রতিটি কাজে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনই তাকওয়ার মূল কথা।

তাকওয়ার পরিচয় প্রদান প্রসঙ্গে হযরত উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) এর বর্ণনা বিশেষভাবে উল্লেখ্যঃ

ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) এর নিকট তাকওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনি কি কণ্টকাকীর্ণ পথে চলেন? তিনি জবাবে বললেন, হ্যা। উবাই ইবনে কা’ব (রাঃ) বললেন, তখন আপনি কিভাবে চলেন? তিনি বললেন, “খুব সতর্কতার সাথে কাঁটার আচড় থেকে শরীর ও কাপড় বাঁচিয়ে চলি। উবাই (রাঃ) বলেন, এটাই তাকওয়া।

আমাদের পথচলার প্রতিটি বাঁকে বাঁকে রয়েছে দুর্গম বাঁধা। আজ অসত্যের সামনে সত্য বিলুপ্ত হওয়ার উপক্রম। মানুষ আজ আল্লহভীতি নামক মহৎ গুণটি হারিয়ে দুনিয়ার রংতামাশায় মত্ত। রমাদান প্রতিবছরই আমাদের মাঝে তাকওয়ার শিক্ষা ব্যে আনলেও তা আমরা মনে-প্রাণে কতটুকু গ্রহণ করতে পারছি সেটা আজ ভেবে দেখা দরকার। আমাদের অন্তরের উপলদ্ধি কি প্রহেলিকায় আচ্ছন্ন? সত্যিকার অর্থে আমরা যদি দীর্ঘ একটি মাস অন্তরের গভীর উচ্ছ্বাস ও পুণ্যপ্রাপ্তির প্রত্যাশায় সিয়াম সাধনা করে তাহলে (ইন শা আল্লাহ) তাকওয়া অর্জনে সফলতা লাভ করতে পারব, যার গ্যারান্টি আল্লাহপাক নিজেই দিয়েছেন। ফলে আমাদের অন্তর কুরআনের আলো ধারণ করার উপযোগী হয়ে উঠবে।