সিয়াম সাধনা তাকওয়ার প্রশিক্ষণ !

সিয়াম সাধনা তাকওয়ার প্রশিক্ষণ !
মুহাম্মদ হামিদুল ইসলাম আজাদ

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ


Translation: O you who believe, fasting is prescribed for you, as it was prescribed those before you, that you become the pious.

অনুবাদ: “হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর সিয়ামের ফরমান অবতীর্ণ হয়েছে যা তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির ওপরও নাজিল হয়েছিল, যাতে তোমরা তাকওয়ার গুণাবলি অর্জন করতে পার ।

নামকরণ: বাকারা- গাভী । এ সূরার ৬৭ থেকে ৭১ আয়াত পর্যন্ত আয়াতে বনি ইসরাইল জাতির মধ্যে গাভী পূজার বিষয় আলোচনা এসেছে । আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমের সূরাসমূহের নাম নির্ধারণ করেছেন । কুরআনের মধ্যে সৃষ্টির কোন স্পর্শ নেই । যে সমস্ত শব্দ নামকরণের জন্য গৃহীত বলে তাফসিরকারীরা গ্রহণ করেছেন সেগুলো অতীব গুরুত্বপূর্ণ significant and symbolic) । এমনি এ সূরার নাম বাকারা অর্থাৎ গাভী । এই সূরায় গাভীসংক্রান্ত রচনামূলক একটি বাক্যও নেই । সূরাটিতে রয়েছে তাওহিদ আর শিরকের রূপক হিসেবে গাভীকে নেয়া হয়েছে আর তাকে কতলের নির্দেশ এসেছে ।

وَإِذْ قَالَ مُوسَىٰ لِقَوْمِهِ إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَن تَذْبَحُوا بَقَرَةً ۖ قَالُوا أَتَتَّخِذُنَا هُزُوًا ۖ قَالَ أَعُوذُ بِاللَّهِ أَنْ أَكُونَ مِنَ الْجَاهِلِينَ

এরপর স্মরণ করো সেই ঘটনার কথা যখন মূসা তার জাতিকে বললো, আল্লাহ তোমাদের একটি গাভী যবেহ করা হুকুম দিচ্ছেন ৷ তারা বললো, তুমি কি আমাদের সাথে ঠাট্টা করছো ? মূসা বললো ,নিরেট মূর্খদের মতো কথা বলা থেকে আমি আল্লাহ কাছে আশ্রয় চাচ্ছি ৷
নাজিলের সময়: এই সূরার অধিকাংশ আয়াতই মাদানী হায়াতে নবীজির ওপর অবতীর্ণ । বিষয়বস্তুর সামঞ্জস্যতার কারণে কিছু মক্কী আয়াতও এর মধ্যে শামিল হয়েছে । তাকে মাদানী সূরা হিসেবে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত ।
বিষয়বস্তু: এ সূরা যেন একটি সংক্ষিপ্ত কুরআন । ইসলামী জীবনব্যবস্থার সালাত, সিয়াম, জাকাত, যুদ্ধ ও সামাজিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশিকা এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ।

তাফসিরুল আয়াত

* ﺃَﻳُّﻬَﺎ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺁﻣَﻨُﻮﺍ হে ঈমানদারগণ !
কুরআনুল কারিম যখন ‘মুমিনদের’ সম্মোধন করেন স্বাভাবিকভাবে বুঝতে হবে এরপর কোন বিধান, হুকুম অবতীর্ণ হবে । যখন ‘নাস’ কে খেতাব করা হয় তখন ঈমান গ্রহণ করার নির্দেশ দেয়া হয় । আর ঈমানদার হওয়ার জন্য শর্ত হোলো দুটি । প্রথম শর্ত তাগুতকে অস্বীকার করা । আর দ্বিতীয় শর্ত তাগুতকে অস্বীকার করে আল্লাহর ওপর ঈমান আনা । আল্লাহ তায়ালা বলেন,

لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ ۖ قَد تَّبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ ۚ فَمَن يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِن بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَىٰ لَا انفِصَامَ لَهَا ۗ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

দীনের ব্যাপারে কোন জোর-জবরদস্তি নেই ৷ ভ্রান্ত মত ও পথ থেকে সঠিক মত ও পথকে ছাঁটাই করে আলাদা করে দেয়া হয়েছে ৷ এখন যে কেউ তাগুতকে অস্বীকার করে আল্লাহর ওপর ঈমান আনে, সে এমন একটি মজবুত অবলম্বন আঁকড়ে ধরে , যা কখনো ছিন্ন হয় না ৷ আর আল্লাহ (যাকে সে অবলম্বন হিসেবে আঁকড়ে ধরেছে) সবকিছু শোনেন ও জানেন ৷ সূরা বাকারাহঃ ২৫৬
আভিধানিক অর্থে এমন প্রত্যেকটি ব্যক্তিকে 'তাগুত' বলা হবে, যে নিজের বৈধ অধিকারের সীমানা লংঘন করেছে । কুরআনের পরিভাষায় তাগুত এমন এক বান্দাকে বলা হয়, যে বন্দেগী ও দাসত্বের সীমা অতিক্রম করে নিজেই প্রভু ও খোদা হবার দাবীদার সাজে এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে নিজের বন্দেগী ও দাসত্বে নিযুক্ত করে । আল্লাহর মোকাবিলায় বান্দার প্রভূত্বের দাবীদার সাজার এবং বিদ্রোহ করার তিনটি পর্যায় আছে । প্রথম পর্যায় বান্দা নীতিগতভাবে তাঁর শাসন কর্তৃত্বকে সত্য বলে মেনে নেয় কিন্তু কার্যত তার বিধানের বিরুদ্ধাচরণ করে । একে বলা হয় ফাসেকী । দ্বিতীয় পর্যায়ে সে আল্লাহর শান কর্তৃত্বকে নীতিগতভাবে মেনে না নিয়ে নিজের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয় অথবা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কারো বন্দেগী ও দাসত্ব করতে থাকে । একে বলা হয় কুফরী । তৃতীয় পর্যায়ে সে মালিক ও প্রভুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তার রাজ্যে এবং তার প্রজাদের মধ্যে নিজের হুকুম চালাতে থাকে । এই শেষ পর্যায়ে যে বান্দা পৌছে যায় তাকেই বলা হয়া 'তাগুত' । কোন ব্যক্তি এই তাগুতকে অস্বীকার না করা পর্যন্ত কোন দিন সঠিক অর্থে আল্লাহর মু'মিন বান্দা হতে পারে না ।
কুরআন তাদেরকে মুমিন বলে যারা শুধু মুখে ঈমানের ঘোষণা দেয় না বরং তাদের হৃদয়ে ঈমানের বিষয়গুলো গেঁথে নেয় ও জীবনে তার জন্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকে । আর বিশ্বাসের মধ্যে থাকে না সন্দেহ ।

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ لَمْ يَرْتَابُوا وَجَاهَدُوا بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنفُسِهِمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ۚ أُولَٰئِكَ هُمُ الصَّادِقُونَ

প্রকৃত ঈমানদার তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের ওপর ঈমান এনেছে এবং এ ব্যাপারে পরে আর কোন সন্দেহ পোষণ করেনি ৷ তারপর প্রাণ ও অর্থ-সম্পদ দিয়ে জিহাদ করেছে ৷ তারাই সত্যবাদী ৷ সূরা হুজুরাত : ১৫

قُلْ أَتُعَلِّمُونَ اللَّهَ بِدِينِكُمْ وَاللَّهُ يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۚ وَاللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

হে নবী ! ঈমানের এ দাবীদারদের বলো, তোমরা কি আল্লাহকে তোমাদের দীনের কথা অবগত করাচ্ছো ? আল্লাহ তো আসমান ও যমীনের প্রত্যেকটি জিনিস ভালভাবে অবহিত ৷ সূরা হুজুরাত : ১৬

الَّذِينَ آمَنُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ۖ وَالَّذِينَ كَفَرُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ الطَّاغُوتِ فَقَاتِلُوا أَوْلِيَاءَ الشَّيْطَانِ ۖ إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطَانِ كَانَ ضَعِيفًا

যারা ঈমানের পথ অবলম্বন করেছে তারা লড়াই করে তাগুতের পথে ৷ কাজেই শয়তানের সহযোগীদের সাথে লড়ো এবং নিশ্চিত জেনে রাখো, শয়তানের কৌশল আসলে নিতান্তই দুর্বল ৷ সূরা নিসাঃ ৭৬
এটি আল্লাহর একটি দ্ব্যর্থহীন ফায়সালা । আল্লাহর পৃথিবীতে একমাত্র আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে লড়াই করা হচ্ছে ঈমানদারদের কাজ । যথার্থ ও সত্যিকার মুমিন এই কাজ থেকে কখনো বিরত থাকবে না । আর আল্লাহর পৃথিবীতে আল্লাহ বিরোধী ও আল্লাহদ্রোহীদের রাজত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তাগুতের পথে লড়াই করা হচ্ছে কাফেরদের কাজ । কোন ঈমানদার ব্যক্তি এ কাজ করতে পারে না ।
অর্থাৎ আপাত দৃষ্টিতে শয়তান ও তার সাথীরা বিরাট প্রস্তুতি এগিয়ে আসে এবং জবরদস্ত কৌশল অবলম্বন করে কিন্তু তাদের প্রস্তুতি ও কৌশল দেখে ঈমানদারদের ভীত হওয়া উচিত নয় অবশ্যি তাদের সকল প্রস্তুতি ও কৌশল ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে ।
* ﻛُﺘِﺐَ ﻋَﻠَﻴْﻜُﻢْ ﺍﻟﺼِّﻴَﺎﻡُ – Fasting is preseribed for you “তোমাদের ওপর সিয়ামের ফরমান অবতীর্ণ হয়েছে ।”
সিয়ামকে ﻛُﺘِﺐَ শব্দ দিয়ে ফরজ করা হয়েছে । অর্থাৎ লিখিত বিধান অবতীর্ণ হয়েছে । শব্দটি সিয়ামকে অনেক বেশি তাৎপর্যবহ করে আরও বহু নির্দেশ হতে এটিকে ভিন্ন মাত্রার সংযোজন ঘটিয়েছে । এ কঠিন শব্দটির মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা কিসাসের বিধান নাজিল করেছেন, করেছেন মিরাসের অতীব গুরুত্বপূর্ণ ফরমান ।

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِصَاصُ فِي الْقَتْلَى ۖ الْحُرُّ بِالْحُرِّ وَالْعَبْدُ بِالْعَبْدِ وَالْأُنثَىٰ بِالْأُنثَىٰ ۚ فَمَنْ عُفِيَ لَهُ مِنْ أَخِيهِ شَيْءٌ فَاتِّبَاعٌ بِالْمَعْرُوفِ وَأَدَاءٌ إِلَيْهِ بِإِحْسَانٍ ۗ ذَٰلِكَ تَخْفِيفٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَرَحْمَةٌ ۗ فَمَنِ اعْتَدَىٰ بَعْدَ ذَٰلِكَ فَلَهُ عَذَابٌ أَلِيمٌ

হে ঈমানদারগণ! তোমাদের জন্য হত্যার ব্যাপারে কিসাসের বিধান লিখে দেয়া হয়েছে ৷ স্বাধীন ব্যক্তি হত্যা করে থাকলে তার বদলায় ঐ স্বাধীন ব্যক্তিকেই হত্যা করা হবে , দাস হত্যাকারী হলে ঐ দাসকেই হত্যা করা হবে, আর নারী এই অপরাধ সংঘটিত করলে সেই নারীকে হত্যা করেই এর কিসাস নেয়া হবে ৷ তবে কোন হত্যাকারীর সাথে তার ভাই যদি কিছু কোমল ব্যবহার করতে প্রস্তুত হয়, তাহলে প্রচলিত পদ্ধতি অনুযায়ী রক্তপণ দানের ব্যবস্থা হওয়া উচিত এবং সততার সঙ্গে রক্তপণ আদায় করা হত্যাকারীর জন্য অপরিহার্য ৷ এটা তোমাদের রবের পক্ষ থেকে দন্ড হ্রাস ও অনুগ্রহ ৷ এরপরও যে ব্যক্তি বাড়াবাড়ি করবে তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি ৷ সূরা বাকারাহঃ ১৭৮

وَلَكُمْ فِي الْقِصَاصِ حَيَاةٌ يَا أُولِي الْأَلْبَابِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

হে বুদ্ধি–বিবেক সম্পন্ন লোকেরা ! তোমাদের জন্য কিসাসের মধ্যে জীবন রয়েছে ৷ আশা করা যায়, তোমরা এই আইনের বিরুদ্ধাচরণ করার ব্যাপারে সতর্ক হবে ৷ সূরা বাকারাহঃ ১৭৯
অনুরূপভাবে ‘মিরাজের’ অতীব কঠিন ও জটিল বিষয়েও এই একই শব্দ ব্যবহার করেছে আল-কুরআন । বিষয়টিতে চিন্তাশীলদের জন্য অনেক ভাবার বিষয় লুকিয়ে রয়েছে । এই একটি শব্দ একটি গ্রন্থ সদৃশ, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে সিয়ামের গুরুত্ব ও তাৎপর্যের হাজার ইশারা ।

* ﻛَﻤَﺎ ﻛُﺘِﺐَ ﻋَﻠَﻰ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﻣِﻦْ ﻗَﺒْﻠِﻜُﻢْ : As it was prescribed those before you, “যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপরও অনুরূপ লিখিত সিয়ামের ফরমান অবতীর্ণ হয়েছিল ।”

“এ সিয়ামের বিধান শুধু উম্মতে মুহাম্মদীর ওপর নয় সকল কালের সকল নবীর শরিয়তে ফরজ করেছিলাম । এ কথাটি সংযুক্ত না হলেও সিয়াম পালন করা ফরজ হয়ে যেতো । এর মাধ্যমে সিয়ামের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ফুটে উঠেছে । এ বিধানটি এতই গুরুত্বপূর্ণ সকল নবীর শরিয়তে সিয়াম সাধনা ফরজ করা হয়েছিল
আর তা এই জন্য যে এর সাধ্যমে এমন কতগুলো গুণাবলি অর্জন হয় যা পরকালীন মুক্তি ও ইহকালীন কল্যাণ অর্জনে অপরিহার্য । শরিয়তের বহু আইন এমন রয়েছে যা এক জাতির ওপর জরুরি হলেও অপর আর এক জাতির ওপর পালনীয় ছিল না । কিন্তু সিয়াম ওই
বিধানের অন্তর্ভুক্ত যাকে আল্লাহ তায়ালা সার্বজনীন করেছেন । সময়ের প্রতিটি অধ্যায়ে সকল শ্রেণী পেশার ওপর অবশ্য পালনীয় হিসেবে নির্ধারণ করেছেন ।
এই বার আলোচনায় আনতে চাই সিয়াম সাধনা কাকে বলে এর তাৎপর্য কী? এর মধ্যে কি প্রভূত কল্যাণ নিহিত রয়েছে?
সিয়াম শব্দের অর্থ বিরত থাকা । একটি নির্দিষ্ট সময় সুবহে সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ে সময়ে পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকা সওম বা রোজা । একটি ফরফ ইবাদাত । ইহা একটি দীর্ঘমেয়াদি তারবিয়াত, যা লাগাতার এক মাস চলবে । সমগ্র দুনিয়াব্যাপী গোটা মুসলিম উম্মাহ এ পবিত্র ইবাদাতে আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত ও সওয়াবের এত বেশি বোনাস দেন যে এক নফল ইবাদত এক ফরজের সমান । যখন আকাশ থেকে ফেরেশতারা আল্লাহর হুকুমে ঘোষণা দিতে থাকেন ‘হে নেক আমলকারীগণ ! সিদ্ধান্ত নাও, ইবাদত-বন্দেগির জন্য কোমর বাঁধ । হে বদকারেরা ! অপরাধের জগৎ থেকে ফিরে আস, তাওবা কর ।” বায়হাকী
এ সাওম মানুষের মধ্যে সহানুভূতির অনুভূতিকে উজ্জীবিত করে, ধার তীব্র জ্বালা কী নিদারুণ যাতনা তা রোজাদারের মধ্যে জাগ্রত করে । এর মূল উদ্দেশ্য হলো সমস্ত অনাচার ও পাপাচার থেকে বিরত থাকা ও আল্লাহরই সন্তুষ্টি অর্জন করা ।
নবীজি সা. বলেন, মিথ্যাকথা ও সাক্ষ্য দেয়া থেকে স্বীয় জিহবাকে যারা সংযত করে না আর অন্যায় ও সীমালংঘনের কাজ থেকে যার দুই হাত বিরত থাকে না তার সিয়াম করা আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই ।” সহীহ বুখারী
এ মাসের প্রতিটি মুহূর্ত অতীব গুরুত্বপূর্ণ । এ মাসেই আল কুরআন নাজিল হয়েছে । অবতীর্ণ হয়েছে সব আসমানি বিতাব । এ মাসের মধ্যে একটি রাত আছে, যার মধ্যে আল কুরআন নাজিল হয়েছে সে একটি রাতের মর্যাদা সমস্ত মাসের চেয়েও বেশি । এ পবিত্র মাসের প্রথম দশ দিন রহমত অবতীর্ণ হয়, সিক্ত করে দেয় তামাম পৃথিবী ও পৃথিবীর অধিবাসীকে, বান্দাহরা যেন রহমত লাভে ধরনা দেয় হাত তোলে প্রভুর কাছে । মধ্য দশ রমজানে প্রভুর পক্ষ থেকে অসংখ্য বনি আদমকে মাফ করে দেয়া হয় । চোখের পানি ও তাওবার মাধ্যমে করতে হবে শবেকদরের দুর্লভ রজনীর অনুসন্ধান । এ রাত যারা হারালো তারা যেন সব কিছু হারালো ।

রমজানের গুরুত্বপূর্ণ আমল

রোজা রাখা: রমজানে রোজা রাখা ফরজ । সেজন্য রমজানের প্রধান আমল- সুন্নাহ মোতাবেক রোজা পালন করা । মহান আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে এ মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে রোজা রাখে ।’ সূরা বাকারা : ১৮৫
জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায়: রমজানে ফরজ নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমল । অনেকে ফরজ নামাজ আদায়ে উদাসীন থাকেন, যা গ্রহণযোগ্য নয় । কোরআনে বলা হয়েছে, ‘অতএব সেই নামাজ আদায়কারীদের জন্য দুর্ভোগ, যারা নিজদের নামাজে অমনোযোগী । সূরা আল মাউন : ৪-৫
সাহরি খাওয়া: রোজা পালনে সাহরি খাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । সাহরি খাওয়ার মধ্যে বরকত রয়েছে । অনেকে সাহরি খান না, অনেকে আগ রাতে খেয়েই শুয়ে পড়েন । এটি সুন্নাহ পরিপন্থী । কারণ ইহুদি ও খ্রিস্টানরা সাহরি খায় না । হাদিসে এসেছে, রাসুল সা. বলেছেন, ‘আমাদের ও আহলে কিতাবদের রোজার মধ্যে পার্থক্য হলো সাহরি গ্রহণ ।’ মুসলিম : ২৬০৪
ইফতার করা এবং অন্যকে করানো: সিয়ামের পূর্ণ সওয়াব পাওয়ার জন্য দ্রুত ইফতার করতে হবে । সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করা বিরাট ফজিলত। অন্যদিকে হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, সে তার সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করবে, তাদের উভয়ের সওয়াব থেকে বিন্দুমাত্র হ্রাস করা হবে না ।’ ইবনে মাজাহ : ১৭৪৬
তারাবির নামাজ পড়া : তারাবির নামাজ আদায় রমজানের অন্যতম আমল । হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াব হাসিলের আশায় রমজানে কিয়ামু রমজান (সালাতুত তারাবি) আদায় করবে, তার অতীতের সব গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে ।’ বুখারী : ২০০৯
ইতিকাফ করা: ইতিকাফ অর্থ অবস্থান করা । অর্থাৎ মানুষ থেকে পৃথক হয়ে সালাত, সিয়াম, কোরআন তেলাওয়াত, দোয়া, ইসতিগফার ও অন্যান্য ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্যে একাকী কিছু সময় যাপন করা । এ ইবাদতের এত মর্যাদা যে, প্রত্যেক রমজানে রাসুল সা. শেষ ১০ দিন নিজে এবং তাঁর সাহাবিরা ইতিকাফ করতেন ।
লাইলাতুল কদর তালাশ করা: পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম ।’ সূরা কদর : ৪
রাসুল সা. আমাদের শেষ ১০ দিন লাইলাতুল কদর তালাশ করার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা রমজানের শেষ ১০ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে কদরের রাত খোঁজ ।’ বুখারী : ২০২০
বেশি বেশি দান-সদকাহ করা: রোজা-নামাজ ইত্যাদির পাশাপাশি দান-সদকার মাধ্যমেও ফজিলত অর্জন করতে হবে । আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুল সা. ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল আর রমজানে তাঁর এ দানশীলতা আরও বেড়ে যেত ।’ বুখারী: ১৯০২
বেশি বেশি দোয়া-এস্তেগফার করা: এ মাসে বেশি বেশি দোয়া-এস্তেগফার করা উচিত । হাদিসে এসেছে, ‘ইফতারের মুহূর্তে আল্লাহ তায়ালা বহু লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন । মুক্তির এ প্রক্রিয়াটি রমজানের প্রতি রাতেই চলতে থাকে ।’ আল জামিউস সাগির : ৩৯৩৩
তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া: রমজানে নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়া অত্যন্ত সওয়াবের কাজ । রমজানের কারণে এ ফজিলত বহুগুণে বেড়ে যায় । আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, ‘নবী করিম সা. বলেছেন, ‘ফরজ নামাজের পর সর্বোত্তম নামাজ হলো রাতের নামাজ অর্থাৎ তাহাজ্জুদের নামাজ । মুসলিম : ২৮১২

* ﻟَﻌَﻠَّﻜُﻢْ ﺗَﺘَّﻘُﻮﻥَ : that you become the pious
“সিয়ামের মাধ্যমে তোমরা তাকওয়ার গুণ অর্জন করতে পার ।”

আয়াতের শেষে তাকওয়া অর্জনকে সিয়ামের মূল লক্ষ্য হিসেবে স্থির করা হয়েছে । এ তাকওয়াকে কুরআন ও হাদীসে বিস্তারিত ও গুরুত্বের সাথে আলোচনা করা হয়েছে । আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সাথে তাকওয়া নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত ।
তাকওয়া সকল কল্যাণের আধার, আল-কুরআনে সর্বাধিক উল্লিখিত এক মহৎ গুণ । প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য, কাছের অথবা দূরের সকল কল্যাণের মূল হলো তাকওয়া । অনুরূপভাবে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য, কাছের অথবা দূরের সকল অন্যায় ও পাপাচারের বিরুদ্ধে তাকওয়া হলো অতন্দ্র প্রহরী, প্রতোরোধক দুর্গ ।
তাকওয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ, সাবধানতা অবলম্বন করা । শরীআতের পরিভাষায় আল্লাহর শাস্তি ও অসন্তুষ্টির কার্যকারণসমূহ থেকে নিজকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সাবধানতা অবলম্বন করা । সহজভাবে বলতে গেলে সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর ভয় হৃদয়ে পোষণ করা ।
জীবনে মূল সফলতা এ তাকওয়ার সাথে সম্পৃক্ত : কুরআন বলছে-

وَمَن يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَل لَّهُ مَخْرَجًا

যে ব্যক্তিই আল্লাহকে ভয় করে চলবে আল্লাহ তার জন্য কঠিন অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় সৃষ্টি করে দেবেন ৷ 

وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ ۚ وَمَن يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ ۚ إِنَّ اللَّهَ بَالِغُ أَمْرِهِ ۚ قَدْ جَعَلَ اللَّهُ لِكُلِّ شَيْءٍ قَدْرًا

এবং এমন পন্থায় তাকে রিযিক দেবেন যা সে কল্পনাও করতে পারে না৷ যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর নির্ভর করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট ৷ আল্লাহ তাঁর কাজ সম্পূর্ণ করে থাকেন ৷ আল্লাহ প্রতিটি জিনিসের জন্য একটা মাত্রা ঠিক করে রেখেছেন ৷ সূরা তালাক : ২-৩
“আল্লাহ তায়ালা মুত্তাকিদের জন্য জীবন চলার পথ বের করে দেন আর ধারণার অতীত জায়গা থেকে রিজিকের ব্যবস্থা করেন ।
বান্দাদের সম্মান, মর্যাদা এর সাথে সম্পর্কিত: আল্লাহর কাছে সাদা-কালো, ধনী-দরিদ্র, আরব-অনারব, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের ভিত্তিতে কারো মূল্যায়ন হয় না; বরং মূল্যায়নের ভিত্তি হলো তাকওয়া । আল্লাহ তাআলা বলেন,

يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُم مِّن ذَكَرٍ وَأُنثَىٰ وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا ۚ إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ

হে মানব জাতি, আমি তোমাদেরকে একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি ৷ তারপর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে দিয়েছি যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার ৷ তোমাদের মধ্যে যে অধিক পরহেজগার সে-ই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদার অধিকারী ৷ নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও সবকিছু সম্পর্কে অবহিত ৷ সূরা হুজরাতঃ ১৩
তাকওয়ার গুরুত্ব বোঝাতে পবিত্র কোরআনে আড়াই শর বেশি আয়াত আনা হয়েছে । কেবল সুরা বাকারাতেই প্রায় ৩০ বার তাকওয়া শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে । মূলত তাকওয়াই হলো ইবাদতের প্রাণশক্তি । এ জন্য পবিত্র কোরআনে প্রায় প্রতিটি বিধিবিধানের পরই তাকওয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে । এমনকি
তাকওয়াবিবর্জিত ইবাদত আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয় : আল্লাহ তাআলা বলেন,

إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ

'নিঃসন্দেহে আল্লাহ কেবল মুত্তাকিদের আমলই কবুল করেন ।' সুরা মায়েদা : ২৭
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,

لَن يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَٰكِن يَنَالُهُ التَّقْوَىٰ مِنكُمْ 

আল্লাহর কাছে (তোমাদের কোরবানির) গোশত বা রক্ত কোনোটিই পৌঁছে না; কিন্তু তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া পৌঁছে । সুরা হজ: ৩৭
তাকওয়া এমন এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়-আল্লাহ তাআলা যার নির্দেশ-উপদেশ পূর্বের ও পরের সকল জাতিকেই দিয়েছেন : ইরশাদ হয়েছে 

: وَلَقَدْ وَصَّيْنَا الَّذِينَ أُوتُواْ الْكِتَابَ مِن قَبْلِكُمْ وَإِيَّاكُمْ أَنِ اتَّقُواْ اللَّهَ

আর তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদেরকে এবং তোমাদেরকে আমি নির্দেশ দিয়েছি যে, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর’ । সূরা আন-নিসা: ১৩১
তাকওয়া হলো নবীদের দাওয়াতের বিষয়: আল্লাহর ওলীদের শিআর বা নির্দশন । প্রত্যেক নবীই তার কাওমকে বলেছেন:

إِذْ قَالَ لَهُمْ أَخُوهُمْ نُوحٌ أَلَا تَتَّقُونَ

স্মরণ কর যখন তাদের ভাই নূহ তাদেরকে বলেছিল, তোমরা কি তাকওয়া অবলম্বন করবে না’? সূরা আশ-শুআরা: ১০৬
আর আল্লাহর ওলী তো তারাই যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে ও তাকওয়া অবলম্বন করেছে ।
তাকওয়া আসলে বান্দা ও পাপাচারের মাঝে প্রতিরক্ষা-প্রাচীর দাঁড় করিয়ে দেয় । অর্থাৎ বান্দাকে সার্বক্ষণিকভাবে পাপাচার থেকে রক্ষা করতে পারে । আর আল্লাহ তাআলাই হলেন ‘আহলুত্তাকওয়া’ তথা বান্দার তাকওয়া পাওয়ার একমাত্র অধিকারি । একমাত্র আল্লাহ তাআলাই বান্দার সর্বোচ্চ তাযীম, ভক্তি, ভয় ও সম্মান পাওয়ার অধিকারি । তাকওয়া কাকে বলে, আলী রাযি.

এর নিম্নবর্ণিত কথা থেকে তা সুস্পষ্ট

الْخُوْفُ مِنَ الْجَلِيْلِ، وَالْعَمَلُ بِالتَّنْزِيْلِ، وَالْقَنَاعَةُ بِالْقَلْيِلِ، وَالاسْتِعْدَادُ لِيَوْمِ الرَّحِيْلِ 

‘মহামহিমকে ভয় করা, কুরআন অনুযায়ী আমল করা, অল্পে তুষ্ট থাকা এবং মৃত্যুদিনের জন্য প্রস্তুতি নেয়া’ ।
তাকওয়া শব্দটির অর্থ বেঁচে থাকা, পরহেজ করা এবং সাবধান হওয়া । তাকওয়া বলতে আল্লাহভীতিকে বোঝায় । তাই আল্লাহর ভয়ে ও তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যাবতীয় নাফরমানি থেকে পরহেজ করে চলাই তাকওয়ার মূল উদ্দেশ্য । এর পরিধি সমগ্র জীবনের সবকিছুতে বিস্তৃত । যারা নিজ জীবনে তাকওয়ার অনন্য বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে তারা মুত্তাকি । কুরআনুল কারিম মুত্তাকিদের বৈশিষ্ট্য আলোচনা দিয়ে আল- কুরআনের সূচনা করেছেন ।

ذَٰلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ ۛ فِيهِ ۛ هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ

এটি আল্লাহর কিতাব, এর মধ্যে কোন সন্দেহ নেই ৷ এটি হিদায়াত সেই ‘মুত্তাকী’দের জন্য

الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ

যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে , নামায কায়েম করে এবং যে রিযিক আমি তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে খরচ করে ৷

وَالَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنزِلَ مِن قَبْلِكَ وَبِالْآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ

আর যে কিতাব তোমাদের ওপর নাযিল করা হয়েছে (অর্থাৎ কুরআন) এবং তোমার আগে যেসব কিতাব নাযিল করা হয়েছিল সে সবগুলোর ওপর ঈমান আনে আর আখেরাতের ওপর একীন রাখে ৷

أُولَٰئِكَ عَلَىٰ هُدًى مِّن رَّبِّهِمْ ۖ وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ

এ ধরনের লোকেরা তাদের রবের পক্ষ থেকে সরল সত্য পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং তারা কল্যান লাভের অধিকারী ৷ সূরা বাকারা : ২-৫
তাকওয়া শুধু অন্তরে সীমিত থাকার বিষয় নয় । বরং সত্যিকার তাকওয়াধারীর অন্তর ছাপিয়ে তাকওয়া তার সৌরভ ছড়ায় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে, কর্মে ও আমলে । মুত্তাকির গুণাবলীর মধ্যে কয়েকটি হলো ঈমান বিল গায়েব বা অদৃশ্যের প্রতি ঈমান । যথার্থরূপে নামাজ আদায় । আল্লাহর পথে অর্থসম্পদ ব্যয় । আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার প্রতি বিশ্বাস, আখিরাতের প্রতি ইয়াকীন । মুত্তাকীদের এ গুণগুলো উপরের আয়াতে অত্যন্ত উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠেছে ।
তাকওয়া সফলতার মানদন্ড এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা সূরা আল মায়েদায় বলেন :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ وَجَاهِدُوا فِي سَبِيلِهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

হে ঈমানদারগণ ! আল্লাহকে ভয় করো, তাঁর দরবারে নৈকট্যলাভের উপায় অনুসন্ধান করো এবং তাঁর পথে প্রচেষ্টা ও সাধনা করো, সম্ভবত তোমরা সফলকাম হতে পারবে ৷ আল মায়েদাহ: ৩৫
অঙ্গীকার পূরণ করা ও কষ্ট দুর্দশায় ধৈর্যধারণ করাও মুত্তাকীদের গুণাবলীর মধ্যে শামিল । ইরশাদ হয়েছে:

وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آَمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَى حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّائِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُوا وَالصَّابِرِينَ فِي الْبَأْسَاءِ وَالضَّرَّاءِ وَحِينَ الْبَأْسِ أُولَئِكَ الَّذِينَ صَدَقُوا وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ.

ভালো কাজ এটা নয় যে, তোমরা তোমাদের চেহারা পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ফিরাবে; বরং ভালো কাজ হল যে ঈমান আনে আল্লাহ, শেষ দিবস, ফেরেশতাগণ, কিতাব ও নবীগণের প্রতি এবং যে সম্পদ প্রদান করে তার প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও নিকটাত্মীয়গণকে, ইয়াতীম, অসহায়, মুসাফির ও প্রার্থনাকারীকে এবং বন্দিমুক্তিতে । আর সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং যারা অঙ্গীকার করে তা পূর্ণ করে, যারা ধৈর্যধারণ করে কষ্ট ও দুর্দশায় ও যুদ্ধের সময়ে । তারাই সত্যবাদী এবং তারাই মুত্তাকী’ । সূরা আল বাকারা: ১৭৭
মুত্তাকীদের গুণাবলীর মধ্যে একটি হলো, কৃত পাপ ও গুনাহের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া । ইস্তিগফার করা । ইরশাদ হয়েছে :
وَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ . الَّذِينَ يُنْفِقُونَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ. وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللَّهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ وَمَنْ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللَّهُ وَلَمْ يُصِرُّوا عَلَى مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ.
আর তোমরা দ্রুত অগ্রসর হও তোমাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও জান্নাতের দিকে, যার পরিধি আসমানসমূহ ও যমীনের সমান, যা মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে । যারা সুসময়ে ও দুঃসময়ে ব্যয় করে এবং ক্রোধ সংবরণ করে ও মানুষকে ক্ষমা করে । আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন । আর যারা কোন অশ্লীল কাজ করলে অথবা নিজদের প্রতি যুলম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে, অতঃপর তাদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে । আর আল্লাহ ছাড়া কে গুনাহ ক্ষমা করবে? আর তারা যা করেছে, জেনে শুনে তা তারা বার বার করে না’ । সূরা আলে ইমরান: ১৩৩-১৩৫
তাকওয়া ও সিয়াম সাধনা তাকওয়া মূলত একটি ভালো গুণের নাম নয় বরং তা অনেক গুণের সমষ্টি । শত শত উন্নত নৈতিক গুণাবলি এ তাকওয়ার জঠরে জন্ম নেয় । কুরআনুল কারিম এ অনন্য গুণাবলি অর্জনে সিয়াম সাধনাকে জরুরি করেছে । সিয়াম যেন তাকওয়ার গুণ অর্জনের খোদায়ি রহরহম. মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও মানব হৃদয়ের ওপর সিয়ামের প্রভাব অনন্য । পাপাচার ও সীমালংঘনের রয়েছে অসংখ্য পথ, তবে তিনটি মৌলিক প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রে মানবের সীমাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি যেন খুলে দিয়েছে গুনাহের হাজার রুদ্ধদ্বার । আর তা হলো
১. মানুষের জীবন ধারণের জন্য ‘খাদ্য পানীয়’ অপরিহার্য প্রয়োজন । এ ক্ষেত্রে যদি মানুষ একান্ত প্রয়োজনের ওপর সন্তুষ্ট না হয়ে আরও উন্নত খাদ্য ও পানীয় চায় তবে সীমা অতিক্রম করতে বাধ্য হবে । এ ক্ষেত্রে কোন খাদ্য ও উপাদেয় বস্তু তার পেটের অতৃপ্ত খুধার আগুন নেভাতে পারবে না । তার বৈধ আয় রোজগার ও একটি প্রয়োজন পূরণে ব্যর্থ হবে তাকে বাধ্য করবে হারামের সীমাহীন পথে বিচরণ করতে । কিন্তু সিয়াম তাকে ঞৎধরহরহম দেবে ‘না’ বলতে । একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পেটের, জিহবার তামাম চাহিদা খাদ্য পানীয়কে হারাম করে দিয়ে বিরত থাকার প্রশিক্ষণ কার্যকরী করে সিয়াম সাধনা ।
২. মানুষের জীবনে এবং সৃষ্টির স্বাভাবিক নিয়মের মধ্যে স্বীয় বংশ বিস্তারের এক জরুরি প্রয়োজন লুক্কায়িত রয়েছে । এর জন্য স্রষ্টা নারী-পুরুষের মধ্যে দৈহিক মিলনের ও যৌন খুধা নিবারণের প্রয়োজন বলবৎ করে দিয়েছেন । সমগ্র প্রাণী জগতের মধ্যে বংশ বিস্তারের এ বিশেষ প্রয়োজনে বিশেষ সময়ে তারা তাদের স্ত্রীদের সাথে মিলন করে । কোন প্রাণী সপ্তাহে, মাসে, বছরে এমনকি কেউ জীবনে একবার অথবা স্রষ্টার বেঁধে দেয়া সময়ে বংশ রক্ষার প্রয়োজনে এ দৈহিক মিলনে মিলিত হয় । আশ্চার্য যে শূকর ও কুকুরের মতো প্রাণীরা ছাড়া সকল পশু-পাখি পর্যন্ত এ ক্রিয়া সম্পাদন করে সংগোপনে ও সীমিতভাবে । আফসোস-আশারাফুল মাখলুকাত এর জন্য, মানবেরা এ বিষয়ে নৈতিকতার সীমা ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে । বলাৎকার, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ এ জাতীয় কোনো অপরাধ পশুর জগতেও নেই অথচ পৃথিবী আজ এ পাপের ভার সইতে পারছে না । দেশের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি, পার্লামেন্ট সদস্য, সুশীলসমাজের সদস্যদের একটি বিরাট অংশ যৌন রোগে আক্রান্ত, সাধারণদের কথা বলাই বাহুল্য । এক্ষেত্রে সীমালংঘন এ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে পাশ্চাত্য দুনিয়ায় আজ পুরুষে পুরুষে, নারীতে-নারীতে যৌনাচার হচ্ছে । পত্রিকার পাতায় ঞঠ পযধহহবষ এ আসছে কিভাবে একজন নারী কুকুরের সাথে যৌন মিলন করছে । মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ কী? কোথায় চলছে আধুনিকতা? ভাবতেও লোম শিউরে ওঠে । ইসলাম তো এ ব্যবস্থাকে পবিত্র রাখার জন্য বিবাহকে বৈধ পন্থা বলেছে । সমস্ত নবীগণ বিবাহিত। এমনকি প্রয়োজনে একাধিক বিবাহও পুরুষের জন্য অনুমতি দিয়েছে । আর ‘সিয়াম’ একটি সময় পর্যন্ত এ প্রশিক্ষণকে দীর্ঘায়িত করেছে মানুষেরা যেন নিয়ন্ত্রিত ও বিরত থাকার ব্যাপারে অভ্যস্ত হতে পারে । যৌন সীমা সংরক্ষণে এ তারবিয়াত সকলধর্মে স্বীকৃত রয়েছে ।
৩. জীবন যাপনে আরাম ও আয়াসের প্রতি রয়েছে মানবের চির দুর্বলতা । এর প্রয়োজন পূরণে সৃষ্ট হচ্ছে সভ্যতার হাজারো উপাদান ও উপকরণ । মানুষ যদি এ ষীঁঁৎরবং বিলাসসামগ্রীর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে, হতে বাধ্য । তার পৃথিবীতে আগমন কী উদ্দেশ্যে তা ভাবার সময় থাকবে না জীবন শুধু বিলাস উপকরণ সংগ্রহের ও ভোগের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে । মানুষকে কর্মক্ষম করতে ও মোটামুটি আরামে থাকতে যা প্রয়োজন তাতে সন্তুষ্ট হতে হবে । বিলাসিতাকে পরিহার করে সাদাসিধা জীবন যাপনে অভ্যস্ত হতে উম্মতকে নবীজি সা. উপদেশ দিয়েছেন আর পরিশ্রমী হওয়াকে মুমিনের গুণ বলা হয়েছে । ‘সিয়াম’ পালনকারীগণ রাতে কান্ত দেহে অতিরিক্ত সালাত আদায় করতে হয় আবার শেষ রাতে তাহাজ্জুদ ও সেহেরির জন্য উঠতে হয় । অতিরিক্ত আরামের পথে সিয়াম বাধা হয় । শিক্ষা দেয় কঠোর পরিশ্রমী হতে । তাকওয়া অর্জনে সিয়াম সাধনার চেয়ে কার্যকর আর কোনো বিধান নেই । তাই কুরআন শরীফ তাকওয়ার উচ্চশিখরে আরোহণ করার জন্য সিয়ামকে বলছে মাধ্যম ও সিঁড়ি হিসেবে। যে সিয়াম মুত্তাকি তৈরির এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম সে সিয়াম হতে হবে অবশ্যই যথার্থ ও আল্লাহর পছন্দমত । রাসূল সা. বলেন, উপবাস রোজা নয়
নবীজি সা. বলেন, “অনেক রোজাদার এমন রয়েছে যাদের রোজা শুধু উপবাসের যাতনা ছাড়া আর কিছুই নয়, আবার অনেক তাহাজ্জুদ গুজার ব্যক্তির রাত জাগরণ অনিদ্রার কষ্ট ছাড়া আর কিছু নেই ।” দারামী
নবীজি সা. আবার বলেন, “যে রোজাদারকে মিথ্যা কথা বলা ও পাপকর্ম থেকে তার সিয়াম বিরত রাখতে পারেনি তার শুধু খাদ্য ও পানীয় বর্জন করার উপবাস আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই । ”সহীহ বুখারী
শিক্ষণীয় বিষয়ঃ
১. আল্লাহ তায়ালার দৃষ্টিতে তারাই মুমিনে হক যারা আল্লাহ, রাসূল ও পরকালে একিন পোষণ করে, তাতে সন্দেহ করে না ও জিহাদকে গ্রহণ করে সর্বস্থায় ।
২. ‘সিয়াম’ এর বিধানকে সকল যুগে সকল উম্মতের ওপর ফরজ করা হয়েছেএবং এ ব্যাপারে আল্লাহর লিখিত ফরমান এসেছে ।
৩. জান্নাতে যাওয়ার জন্য আল্লাহ ‘তাকওয়া’কে জরুরি করেছেন । আর তিনিই ‘তাকওয়া’ অর্জনের জন্য ‘সিয়াম’ জরুরি করেছেন ।
৪. যে রোজাদার বা সিয়াম পালনকারী অন্যায় ও পাপাচার থেকে বিরত থাকেনি তার সিয়াম গ্রহণযোগ্য নয় ।
উপসংহার : খোদাহীনতা, অনৈতিকতা, দুর্নীতি, মানবতার ওপর জুলুম পৃথিবীকে যেন মানব বাসের অযোগ্য করে তুলেছে । সীমালংঘনের প্রকার ও বহু মাত্রিকতার উল্লাস দেখে সভ্যতা মানবিকতা আজ কোণঠাসা । সত্য ও সত্যের ধারকেরা মিথ্যার দাপটের নিকট আজ কম্পমান । সমস্ত পরাশক্তি ও তাদের দালালদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা, তাদের অঢেল অর্থ ও বৈভব আর অপরিমেয় মারণাস্ত্র অসহায় মুসলিম ও ইসলামের দিকে তাক করে রয়েছে । তাদের বোমার আগুনে মরছে অগণিত মুসলিম নারী ও শিশু, আগুনের লেলিহান শিখা পড়ে ভস্মীভূত করছে বিশ্বাসীদের জনপদ । এ দৃশ্যপট পরিবর্তনের সময় আসন্ন বলে মনে হচ্ছে । ঞ.ঝ. ঊষরড়ঃ বলেন, ”. মজলুমদের চোখের পানি আর ঘুরে দাঁড়ানোর বিশ্বব্যাপী প্রস্তুতি যেন আর একটি সুবহে সাদিকের ।
সূচনা: এ সময়ে প্রয়োজন ‘তাকওয়ার’ হাতিয়ার যা আমাদের হৃদয় থেকে সৃষ্টির সমস্ত খাওফ বিদূরিত করে আল্লাহর ভয়কে গালেব করবে । যে ভয় দিয়ে সকল ভয়কে আমরা জয় করব । সে সিয়াম সাধনার মাস আমাদের দারে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের সওগাত নিয়ে উপস্থিত । এ পবিত্র মাহে রমজানে এক একটি মুহূর্ত সময়ও অনেক মূল্যবান । হাজার হাজার বছরের নফল ইবাদত একত্র করলেও একটি ফরজের সমান হবে না । কিন্তু এ মাসের একটি নফল ইবাদত একটি ফরজতুল্য সুবহানআল্লাহ । ঈমান ওইহতেসাবের সাথে পালন করতে হবে এক একটি রোজা । ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিতে হবে সকল পাপাচার থেকে । তারাবিহ ও তাহাজ্জুদ নিয়মিত আদায় করতে হবে । রহমতের মাসে সবচেয়ে বড় আল্লাহর অনুগ্রহ আল-কুরআন । অর্থসহ এক খতম কুরআন পড়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে সবাইকে এ মাসের মধ্যে । হাজার ব্যস্ততার পরও রাসূলুল্লাহ সা. প্রতি রমজানে ইতিকাফ করেছেন । আসুন আমরা কঠিন এক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি এ পবিত্র মাসে । আমিন


বাংলাদেশ ইসলামী দাওয়াহ সেন্টার
www.bidcenter.blogspot.com