হাদীসের মর্যাদা ও হাদীস অমান্য করার পরিণতি
হাদীস অস্বীকার প্রসঙ্গে দুটি কথা:
সুপ্রিয় বন্ধুগণ, বর্তমান যুগে অগণিত ফিতনার মাঝে একটি বড় ফিতনা হল হাদীস অস্বীকার করা ফিতনা। এই হাদীস অস্বীকার কারীর দল তাদের নোংরা নখর বের করে সরাসরি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর স্বত্বা এবং হাদীসে রাসূলের উপর কঠিন ভাবে আক্রমণ শুরু করেছে। কারণ, হাদীস থেকে মুসলমানদের দূরে সরাতে পারলে মানুষকে ইসলাম থেকে দূরে সরানো পানির মত সোজা। এ জন্য তারা ফেসবুক, ওয়েবসাইট ও ওয়া মাহফিল, সভা ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের এই জঘন্য অপ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। মানুষকে তারা হাদীসের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে সন্দিহান করে তুলছে। হাদীসের অপব্যাখ্যা করে তার মানহানি করছে। হাদীসকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছে। তারা বলতে চায় শুধু কুরআন যথেষ্ট। হাদীস মানার প্রয়োজন নাই। হাদীস বা সুন্নাহ শব্দটি তারা শুনতে চায় না। যার কারণে এরা নিজেদেরকে নাম দিয়েছে আহলে কুরআন বা কুরআনের অনুসারী।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভবিষ্যৎ বাণী কত সত্য ভাবে প্রকাশিত হয়েছে !! তিনি বলেছেন:
(ألا إني أوتيت الكتاب ومثله معه لا يوشك رجل شبعان على أريكته يقول عليكم بهذا القرآن فما وجدتم فيه من حلال فأحلوه وما وجدتم فيه من حرام فحرموه)
“জেনে রাখ, আমি কুরআন প্রাপ্ত হয়েছি এবং তার সাথে আরও অনুরূপ আরেকটি জিনিস (তা হল হাদীস)। অচিরেই দেখা যাবে, এক লোক ভরা পেটে তার খাটের উপর থেকে বলবে: তোমরা এই কুরআনকে আঁকড়ে ধর। এতে যে সকল বস্তু হালাল পাবে সেগুলোকে হালাল মনে কর, আর যে সব বস্তুকে হারাম পাবে সেগুলোকে হারাম মনে কর।“ (আবু দাউদ, মিকদাদ ইবনে মাদিকারাব থেকে বর্ণিত, সনদ সহীহ)
উক্ত হাদীসটি আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াতের সত্যতার প্রমাণ বহন করে। কারণ, নবুওয়তের যুগ পার হওয়ার পরপরই শিয়া ও খারেজী সম্প্রদায়ের হাত ধরে বিভিন্ন দল তৈরি হয় তারা হাদীসের উপর আক্রমণ শুরু করে। তারা বলে কুরআনই যথেষ্ট এবং হাদীস ও সু্ন্নাহকে প্রত্যাখ্যান করে।
উনিশ শতকের শেষ দিকে এবং বিশ শতকের প্রথম দিকে ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশে নতুন করে এই ভ্রান্ত মতবাদের উৎপত্তি হয়। তারপর তা পাকিস্তানে জায়গা নেয়। এরপরে ক্রমান্বয়ে তা আরও বিভিন্ন মুসলিম দেশে সংক্রমিত হতে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশ তাদের জমজমাট কার্যক্রম রয়েছে। এমতের অনুসারীদের কেউ কেউ ইউরোপ-আমেরিকায় বসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে তাদের এই বিষাক্ত মতবাদ প্রচার করে যাচ্ছে। ফেসবুকে গড়ে তুলেছে বড় একটা গ্রুপ। এই পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামে হাদীসের মর্যাদা ও হাদীসের অস্বীকার কারীদের পরিণতি সম্পর্কে নিন্মোক্ত প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে যেন, বাংলাভাষী মুসলমানগণ হাদীসের মর্যাদা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করে তার হেফাজতের জন্য সর্ব শক্তি নিয়োগ করে এবং বাতিলের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সজাগ থাকে। আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদেরকে তাওফীক দান করুন।
প্রবন্ধটি লিখেছেন বিশিষ্ট কলামিস্ট, দাঈ, ও গবেষক শাইখ আব্দুল্লাহ আল কাফী। আল্লাহ তায়ালা তাকে উত্তম প্রতিদানে ভূষিত করুন। আমীন।
-সম্পাদক
লেখকের ভূমিকা: আল হামদুলিল্লাহ্ ওয়াস্ সালাতু ওয়াস্ সালামু আলা রাসূলিল্লাহ্ ওয়া আলা আলিহি ওয়া সাহবিহি ওয়া মান ওয়ালাহ।
মহানবী মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চল্লিশ বছর বয়সের পূর্বে জাতির সাধারণ মানুষদের মতই জীবন-যাপন করতেন। আল্লাহ তাকে নির্বাচিত করে পথভ্রষ্ট সমগ্র মানব জাতিকে (৩৪:২৮) সঠিক পথে আহ্বানের জন্যে রাসূল হিসেবে প্রেরণ করলেন। শিক্ষা দিলেন কুরআন ও ঈমান। তারপর দায়িত্ব দিলেন সেই পথে মানুষকে আহ্বানের। আল্লাহ বলেন:
وَكَذَلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ رُوحًا مِنْ أَمْرِنَا مَا كُنْتَ تَدْرِي مَا الْكِتَابُ وَلَا الْإِيمَانُ وَلَكِنْ جَعَلْنَاهُ نُورًا نَهْدِي بِهِ مَنْ نَشَاءُ مِنْ عِبَادِنَا وَإِنَّكَ لَتَهْدِي إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ
“আর এইভাবে আমি আপনার প্রতি ওহী করেছি রূহ (কুরআন) আমার নির্দেশে; আপনি তো জানতেন না কিতাব কি ও ঈমান কি, পক্ষান্তরে আমি একে করেছি আলো যা দ্বারা আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা হেদায়াত করে দেই। আর আপনি অবশ্যই সরল সঠিক পথে মানুষকে আহ্বান করতেই থাকবেন।”(সূরা শূরা: ৫২) আল্লাহ্ রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে আদেশ করলেন মানুষকে হেদায়াত করার, আর মানুষকে আদেশ করলেন তিনি যা বলেন তা গ্রহণ করার।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা দিয়েছেন তাই হচ্ছে হাদীছ। আল্লাহ বলেন:
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا
“রাসূল তোমাদের যা দিয়েছেন তা তোমরা গ্রহণ কর, আর তিনি যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক। (সূরা হাশর: ৭)
এই রাসূল আমাদেরকে যেমন কুরআন দিয়েছেন, সেই সাথে কুরআনকে কিভাবে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে হও, তাও আল্লাহর নির্দেশ মোতাকেব দিয়েছেন। আর বাস্তব জীবনের ঐ প্রয়োগটাই হচ্ছে বিদগ্ধ বিদ্বানদের ভাষায় হাদীছ। কুরআনে যা নিষেধ করা হয়েছে, তার মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে রাসূলও কিছু বিষয় নিষেধ করেছেন। যা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ আল্লাহ্ দিয়েছেন। রাসূলের আদেশ-নিষেধের কোন দরকার না থাকলে, আল্লাহ্ তাঁর কথা উল্লেখ করতেন না। বলতেন এই কুরআনে যা আছে তোমরা তা মেনে নাও, যা নিষেধ করা হয়েছে তা থেকে দূরে থাক। অথচ কুরআনকে মেনে নেয়ার ব্যাপারে আল্লাহ্ বহু জায়গায় নির্দেশ দিয়েছেন। এ স্থানে বিশেষ ভাবে রাসূলের প্রদান এবং নিষেধের কথা উল্লেখ করায় বুঝা যায় তিনিও আদেশ করেন এবং নিষেধ করেন। তবে অবশ্যই তা আল্লাহর অনুমতিক্রমে হয়ে থাকে। আর তাঁর এই আদেশ-নিষেধই হচ্ছে হাদীছ।
১) মতভেদ হলে আল্লাহর কুরআন এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর হাদীছ থেকে সমাধান নিতে হবে:
অসংখ্য আয়াতে আল্লাহর কথা মেনে নেয়ার সাথে সাথে রাসূলের কথাকেও মানতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর..।” (মুহাম্মাদঃ ৩৩) আরও সূরা নূর: ৫৪. রাসূলের কোন কথা না থাকলে আলাদাভাবে তাঁর অনুগত্য করার জন্যে أَطِيعُوا শব্দ ব্যবহারের দরকার ছিল না।
পার্থক্য লক্ষ্য করুন, সূরা নিসার ৫৯নং আয়াতে আল্লাহ্ তাঁর এবং রাসূলের অনুগত্য করার সাথে সাথে উলুল আমর তথা মুসলিম শাসকেরও আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর, রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের শাসকবর্গের।”
এখানে أَطِيعُوا শব্দটি যেমন আল্লাহর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে একইভাবে রাসূলের ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয়েছে; কিন্তু উলুল আমরের আনুগত্যের ক্ষেত্রে শব্দটিকে ব্যবহার করা হয়নি। এ থেকে বুঝা যায় আল্লাহর আনুগত্য যেমন বিনাবাক্য ব্যয়ে করতে হবে, অনুরূপ রাসূলের আনুগত্যও। কিন্তু উলুল আমরের আনুগত্য করার সময় খেয়াল রাখতে হবে তার কথা আল্লাহ এবং রাসূলের কথার সাথে মিল আছে কি না। অর্থাৎ তাঁর অনুগত্য তাঁদের আনুগত্যের মাপকাঠিতে হতে হবে।
এই জন্যে মতভেদ বা সমস্যা হলে সমাধান কিভাবে করতে হবে আয়াতের পরের অংশে আল্লাহ্ তা বলে দিয়েছেন:
فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ
“তোমরা কোন বিষয়ে মতবিরোধ করলে তার সমাধানে জন্যে আল্লাহ্ এবং রাসূলের শরণাপন্ন হবে।” এখানে আর উলুল আমরের কথা বলা হয়নি। কেননা তাদের সমাধান গ্রহণযোগ্য নয়। সমাধান আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল দিবেন। অর্থাৎ আল্লাহর কুরআন এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজে। তিনি জীবদ্দশায় নিজে সমাধান দিয়েছেন, আর তাঁর মৃত্যুর পর কুরআন এবং সেই সাথে তাঁর রেখে যাওয়া সমাধান সমূহ যার অপর নাম হাদীছ।
২) আল্লাহ যেমন ফায়সালা করেন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও তেমন করেন:
কুরআনের অনেক স্থানে রাসূলও নির্দেশ দেন ফায়সালা করেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ্ বলেন:
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا
“আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূল কোন বিষয় ফায়সালা করলে কোন ইমানদার পুরুষ ও ইমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করার কোন অধিকার নেই। যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আদেশ অমান্য করবে, সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হবে।” (সূরা আহযাবঃ ৩৬)
এখানে, আল্লাহর ফায়সালা যেমন লঙ্ঘন করার কারো অধিকার নেই, তেমনি রাসূলের আদেশ লঙ্ঘনেরও কোন অধিকার কারো নেই। আল্লাহর আদেশ অমান্য করলে যেমন পথভ্রষ্ট হতে হবে তেমনি রাসূলের আদেশ লঙ্ঘন করলেও একই পরিণতি হবে। রাসূলের কোন আদেশ নিষেধ না থাকলে তাঁর কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করা অনর্থক হয়ে যায়।
৩) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ফায়সালা না মানলে ঈমান থাকবে না:
রাসূলের ফায়সালা ও আদেশ-নিষেধের গুরুত্ব কত বেশী যে তা না মানলে মানুষ মুমিনই থাকবে না। আল্লাহ্ বলেন,
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
“আপনার পালনকর্তার শপথ তারা ইমানদার হতে পারবে যে পর্যন্ত তারা পরস্পর বিরোধের বিষয়ের সমাধানের জন্যে আপনাকে বিচারক বা ফায়সালা কারী হিসেবে মেনে না নিবে, তারপর আপনি যে ফায়সালা করবেন তা দ্বিধাহীন অন্তরে গ্রহণ না এবং তার প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ না করবে।” (সূরা নিসা: ৬৫)
এখানে ভাষার প্রয়োগ রূপটা দেখুন কিভাবে তাঁকে সম্বোধন করে ‘উপস্থিত একবচন’ শব্দ يُحَكِّمُوكَ “আপনাকে বিচারক মানবে” এবং قَضَيْتَ “আপনি ফায়সালা করেন।” আর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা বিচার বা ফায়সালা করেছেন তাই হচ্ছে হাদীছ। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর যদি কোন ফায়সালা না থাকে বা তাঁর কথার কোন দরকার না থাকে, তবে তাঁকে বিশেষভাবে সম্বোধন করে এভাবে কথা বলা অনর্থক হয়ে যায়।
৪) আল্লাহর ন্যায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও হালাল ও হারাম করেন:
আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হালাল করেন এবং হারামও করেন- আল্লাহ তাঁকে এই অনুমতি দিয়েছেন । আল্লাহ্ বলেন:
الَّذِينَ يَتَّبِعُونَ الرَّسُولَ النَّبِيَّ الْأُمِّيَّ الَّذِي يَجِدُونَهُ مَكْتُوبًا عِنْدَهُمْ فِي التَّوْرَاةِ وَالْإِنْجِيلِ يَأْمُرُهُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ وَيَضَعُ عَنْهُمْ إِصْرَهُمْ وَالْأَغْلَالَ الَّتِي كَانَتْ عَلَيْهِمْ فَالَّذِينَ آمَنُوا بِهِ وَعَزَّرُوهُ وَنَصَرُوهُ وَاتَّبَعُوا النُّورَ الَّذِي أُنْزِلَ مَعَهُ أُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
“যারা নিরক্ষর নবী রাসূল (মুহাম্মাদ) এর অনুসরণ করে, যার কথা তারা তাদের নিকট রক্ষিত তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত পায় (সেই নিরক্ষর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মানুষকে সৎ কাজের নির্দেশ দেন ও অন্যায় করতে নিষেধ করেন। তিনি তাদের জন্যে পবিত্র বস্তু সমূহ হালাল করে দেন এবং অপবিত্র বস্তু সমূহকে তাদের জন্যে হারাম করে দেন। আর তাদের উপর চাপানো বোঝা ও বন্ধন হতে তাদের মুক্ত করেন। অতএব যেসব লোক তাঁর প্রতি ঈমান এনেছে, তাঁর সাহচর্য লাভ করেছে, তাঁকে সাহায্য করেছে এবং সেই নূরের (কুরআনের) অনুসরণ করেছে যা তাঁর নিকট নাযিল হয়েছে, শুধুমাত্র তারাই সফলতা লাভ করেছে। (সূরা আরাফ: ১৫৭)
এই আয়াতও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করছে যে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও আল্লাহর নির্দেশক্রমে কিছু বিষয় হালাল করেছেন এবং কিছু হারাম করেছেন। অচিরেই আমরা তার উদাহরণ উল্লেখ করব ইনশাআল্লাহ। এই আয়াতেও লক্ষ্য করুন প্রথম দিকে নবীজীর অনুসরণের কথা বলার পর আবার তাঁর নিকট নাযিল কৃত নূর তথা কুরআনের অনুসরণের কথা আলাদাভাবে বলা হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায় কুরআনের অনুসরণ যেমন দরকার, তেমনি কুরআন প্রচারকারী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর অনুসরণও দরকার। আর সেই অনুসরণই হচ্ছে তাঁর সীরাতের অনুসরণ তাঁর জীবনীর অনুসরণ অন্য কথায় তাঁর হাদীছের অনুসরণ।
৫) হাদীছ না মানলে কুরআন মানা হবে না:
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর অনুসরণই হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে কুরআনের অনুসরণ, কেননা তিনি কুরআনকে কিভাবে অনুসরণ করতে হবে তা নিজের জীবনে যেমন বাস্তবায়ন করেছেন, অনুরূপ তার যথাযথ তা’লীম সাহাবায়ে কেরামকেও দিয়ে গেছেন। এজন্যে আল্লাহ্ বলেছেন:
مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ
“যে রাসূলের অনুসরণ করবে সে প্রকৃত অর্থে আল্লাহরই অনুসরণ করবে।” (সূরা নিসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৮০) আর তাঁর সুন্নাত বা জীবনীর অনুসরণ না করলে কুরআনের অনুসরণ সম্ভব নয়। যদি কুরআনের অনুসরণই যথেষ্ট হত, তবে আলাদাভাবে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর অনুসরণের প্রতি তাগিদ দেয়া হত না। বরং আল্লাহর ভালবাসা পেতে চাইলে, তাঁর মাগফিরাত কামনা করলে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর অনুসরণ ছাড়া গত্যন্তর নেই। আল্লাহ বলেন,
قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ
“বলুন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবেসে থাক, তবে আমার অনুসরণ কর। তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের সমুদয় পাপ মার্জনা করবেন। আর আল্লাহ্ ক্ষমাশীল করুণাময়।” (সূরা আলে ইমরানঃ ৩১)
আলাদাভাবে রাসূলের অনুসরণের দরকার না থাকলে এখানে ي (আমার) সর্বনাম দ্বারা বাক্যটিকে উল্লেখ করার দরকার ছিল না। অতএব কুরআন অনুসরণ করতে চাইলে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর অনুসরণ দরকার। অন্যকথায় রাসূলের তথা তাঁর হাদীছের অনুসরণ না করলে আল্লাহর কুরআনের অনুসরণ হবে না, তাঁর ভালবাসা পাওয়া যাবে না এবং তাঁর মাগফিরাতও লাভ করা যাবে না।
৬) প্রশ্ন: কুরআন থাকতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কেন আদেশ-নিষেধ করবেন? আর তার অনুসরণই বা আমরা করব কেন? তাহলে কি কুরআন পরিপূর্ণ গ্রন্থ নয়?
কেন তাঁর অনুসরণ করতে হবে? তার জবাব তো পূর্বের আয়াতগুলো থেকেই বিস্তারিত ভাবে পাওয়া যাচ্ছে। বাকী থাকল কুরআন থাকতে কেন তিনি আদেশ-নিষেধ করবেন? এর জবাব হচ্ছে ইসলামকে পরিপূর্ণ করার দায়িত্ব আল্লাহর এবং তিনি তা করেছেনও। তিনি ইসলামের সবকিছু বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। আর তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে। তিনি বলেন:
يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ
“হে রাসূল! আপনার নিকট যা নাযিল করা হয়েছে তা পৌঁছিয়ে দিন।” (মায়েদাঃ ৬৭) সাথে সাথে এই পৌঁছে দেয়ার সময় যেন বিশদভাবে তা ব্যাখ্যা করে দেন। তাই আল্লাহ্ বলেন:
وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ
“নিশ্চয় আমি আপনার নিকট জিকির (কুরআন) নাযিল করেছি, যাতে করে আপনি বিশদভাবে মানুষের নিকট বর্ণনা করে দেন যা তাদের নিকট নাযিল করা হয়েছে।” (সূরা নাহাল: ৪৪)
তাঁর এই বর্ণনা দুটি পদ্ধতিতে হয়েছে। একটি মানুষকে সরাসরি কুরআন তেলাওয়াত করে শুনিয়ে দেয়ার মাধ্যমে। যে কুরআন আল্লাহ্ জিবরীল (আঃ) কর্তৃক সরাসরি নাযিল করেছেন। এটাকে বলা হয় ওহী মাতুল। অর্থাৎ এর ভাব ও ভাষা উভয়টি আল্লাহর নিকট থেকে সরাসরি এসেছে। আরেকটি পদ্ধতি কুরআনের ব্যাখ্যার মাধ্যমে। অর্থাৎ শব্দ বা বাক্যের ব্যাখ্যা উম্মতকে জানিয়ে দেয়ার মাধ্যমে। যা তিনি পরোক্ষ অহির মাধ্যমে আল্লাহর নিকট থেকে লাভ করেছেন। অর্থাৎ কুরআনের সংক্ষেপ ও সাধারণ আয়াত সমূহকে বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করেছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে সাধারণ আয়াতকে সীমাবদ্ধ করেছেন। আবার শর্তযুক্ত আয়াতকে সাধারণ করেছেন। ব্যাপক অর্থবোধক আয়াতকে বিশেষ অর্থে ব্যবহার করেছেন ইত্যাদি। আর তা হয়েছে তাঁর কথা, কাজ ও সমর্থনের মাধ্যমে। যার অপর নাম হচ্ছে হাদীছ।
তিনি এসব করার অধিকার কিভাবে পেলেন? এই অধিকার আল্লাহই তাকে দিয়েছেন যেমনটি সূরা নাহালের ৪৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে। অনুরূপভাবে তিনি নিজের পক্ষ থেকেও এটা করেননি; পরোক্ষভাবে আল্লাহর নিকট ওহী বা নির্দেশনা লাভ করেই তিনি করেছেন। যেমন আল্লাহ্ বলেন:
وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى (3) إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى
“তিনি নিজের পক্ষ থেকে প্রবৃত্তি তাড়িত হয়ে কোন কথা বলেন না, তিনি যা বলেন তা ওহী, যা তাঁর নিকট প্রেরণ করা হয়েছে।” (সূরা নাজমঃ ৩-৪)
এখানে ওহী বলতে যেমন কুরআন উদ্দেশ্য, তেমনি কুরআন বুঝানোর জন্যে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর ব্যাখ্যাও উদ্দেশ্য। যার প্রমাণ আমরা অচিরেই পেশ করছি।
৭) ওহীর নিয়ম:
আল্লাহ তিনটি নিয়মে মানুষের কাছে তথা নবী-রাসূলদের কাছে ওহী প্রেরণ করেছেন। তিনি বলেন:
وَمَا كَانَ لِبَشَرٍ أَنْ يُكَلِّمَهُ اللَّهُ إِلَّا وَحْيًا أَوْ مِنْ وَرَاءِ حِجَابٍ أَوْ يُرْسِلَ رَسُولًا فَيُوحِيَ بِإِذْنِهِ مَا يَشَاءُ
“কোন মানুষের জন্যে সমীচীন নয় যে, আল্লাহ তার সাথে কথা বলবেন; কিন্তু (১) ওহীর মাধ্যমে অথবা (২) পর্দার অন্তরাল থেকে অথবা (৩) তিনি কোন দূত প্রেরণ করবেন, অতঃপর আল্লাহ্ যা চান, সে তা তাঁর অনুমতিক্রমে পৌঁছে দেবে। (সূরা শূরা: ৫১) অর্থাৎ আল্লাহ নিজেই ওহী করেন।
মোটকথা, আল্লাহ তায়ালা তিনভাবে নবী-রাসূলদের প্রতি ওহী করেন:
১) এলহাম:
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর র অন্তরে যে বিষয়কে জাগ্রত করতেন সেটাই হল এলহাম। সেটাই হল পরোক্ষ ওহী বা ওহী গাইর মাতুল। এটা কোন ফেরেশতার মাধ্যমে ছিল না। বিষয়টি যেমন জাগ্রত অবস্থায় হত তেমনি স্বপ্ন যোগেও হত। এমতাবস্থায় সাধারণত: আল্লাহ্ তাআলার পক্ষ থেকে শব্দ বা বাক্য অবতীর্ণ হয় না; কেবল বিষয়বস্তু অন্তরে জাগ্রত হয়, যা পয়গম্বরগণ নিজের ভাষায় ব্যক্ত করেন। আর সেটাই হচ্ছে মুহাদ্দেছীনদের পরিভাষায় হাদীছ বা সুন্নাহ্।
২) পর্দার অন্তরাল থেকে সরাসরি কথা বলা:
আল্লাহ তায়ালা মুসা (আঃ)এর সাথে তূর পর্বতে পর্দার অন্তরাল থেকে সরাসরি কথা বলেছিলেন। আর আমাদের নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সাথে মেরাজে গিয়ে আরশে পাকে হয়েছিল। আল্লাহ দর্শন না দিয়ে পর্দার অন্তরাল থেকে তাঁদের সাথে কথা বলেছেন এবং ওহী করেছেন আর সে সময় পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন।
৩) জিবরাঈল (আঃ) এর মারফতে:
তৃতীয় পদ্ধতিটিই সবচেয়ে বেশী ব্যবহার হয়েছে আল্লাহর ওহী বা নির্দেশনা নাযিলের ক্ষেত্রে। আর তা হয়েছে জিবরাঈল (আঃ)এর মারফত। তাঁকে আমীনুল ওহী বলা হয়। কুরআনে রূহুল আমীন বলা হয়েছে। রাসূল কারীম (সম্মানিত দূত) বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন:
نَزَلَ بِهِ الرُّوحُ الْأَمِينُ
“বিশ্বস্ত রূহ (জিবরীল ফেরেশতা) উহা (কুরআন) নিয়ে অবতরণ করেছেন।”(সূরা শুআরাঃ ১৯৩) আল্লাহ্ আরও বলেন:
إِنَّهُ لَقَوْلُ رَسُولٍ كَرِيمٍ (19) ذِي قُوَّةٍ عِنْدَ ذِي الْعَرْشِ مَكِينٍ (20) مُطَاعٍ ثَمَّ أَمِينٍ
“নিশ্চয় উহা (কুরআন) সম্মানিত রাসূল (দূত জিবরীল (আঃ)এর আনিত বাণী। যিনি শক্তিশালী, আরশের মালিকের নিকট মর্যাদাশালী, ফেরেশতাগণের মান্যবর এবং আল্লাহর বিশ্বাসভাজন।” (সূরা তাকভীরঃ ১৯-২১) আল্লাহ আরও বলেন,
إِنَّهُ لَقَوْلُ رَسُولٍ كَرِيمٍ
“নিশ্চয় এই কুরআন একজন সম্মানিত রাসূলের আনিত বাণী।” (সূরা হাক্কাহঃ ৪০)
হাদীছ অস্বীকারকারীরা এই আয়াতগুলোতে ‘রাসূল’ বলতে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে বুঝাতে চায়। অথচ আয়াতের প্রসঙ্গতেই বুঝা যায় এখানে জিবরীল (আঃ)কে বুঝানো হয়েছে।
৮) আল্লাহ্ হাদীছ নাযিল করেছেন:
এখানে উল্লেখিত প্রথম পদ্ধতিটি হচ্ছে এমন ওহী যা আল্লাহ কোন ফেরেশতার মাধ্যম ছাড়া নাযিল করেছেন। আর সেটার সমর্থনে কুরআনে আরও অনেক আয়াত পাওয়া যায়। ইবরাহীম (আ) কাবা গৃহ নির্মাণ করার পর ইসমাঈল (আ)এর বংশের জন্যে দুআ করেছিলেন। সে সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন,
رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيهِمْ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيهِمْ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
“হে আমাদের পালনকর্তা! তাদের মধ্যে থেকে তাদের মধ্যে এমন একজন রাসূল প্রেরণ করুন, যে তাদের নিকট আপনার আয়াত সমূহ তেলাওয়াত করে শোনাবে, তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা প্রদান করবে এবং তাদেরকে শিরক ও পাপাচারের পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র করবে। নিশ্চয় আপনি মহা পরাক্রমশালী ও বিজ্ঞ।” (সূরা বাকারাঃ ১২৯)
আল্লাহ্ এই দুআ কবুল করে তাদের মধ্যে তথা ইসমাঈলের বংশধর আরব জাতির মধ্যে সেই রাসূল প্রেরণ করেছেন। সে সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:
لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِنْ أَنْفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ
“আল্লাহ্ মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন যখন তিনি তাদেরই ভিতর থেকে তাদের মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন। যে তাদেরকে তাঁর আয়াত সমূহ তেলাওয়াত করে শোনাবে, তাদেরকে পবিত্র করবে এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবে। যদিও তারা ইতোপূর্বে সুস্পষ্ট গুমরাহীতে নিমজ্জিত ছিল।” (সূরা আল ইমরান: ১৬৪)
এ দু’টি আয়াতে হিকমত হচ্ছে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর হাদীছ, তিনি যা মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন।
আল্লাহ্ যেমন কুরআন নাযিল করেছেন তেমনি হিকমত তথা হাদীছও নাযিল করেছেন। আল্লাহ্ বলেন,
وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ وَمَا أَنْزَلَ عَلَيْكُمْ مِنَ الْكِتَابِ وَالْحِكْمَةِ يَعِظُكُمْ بِهِ
“তোমাদের উপর আল্লাহর নেয়ামতের কথা স্মরণ কর, আর যে কিতাব ও হিকমত তোমাদের নিকট নাযিল করেছেন, যা দ্বারা তিনি তোমাদের উপদেশ প্রদান করেন।” (সূরা বাকারাঃ ২৩১)
এখানে হিকমত অর্থ সুন্নাত বা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদীছ যা আল্লাহ্ পরোক্ষভাবে কোন ফেরেশতার মাধ্যম ব্যতীত তাঁর নবীর কাছে নাযিল করেছেন।
ইমাম শাফেয়ী (রহঃ)বলেন, “আল্লাহ্ এই আয়াতে الْكِتَابِ উল্লেখ করেছেন তার অর্থ হচ্ছে কুরআন। আর উল্লেখ করেছেন وَالْحِكْمَةِ। আমি কুরআনের পণ্ডিতদের নিকট শুনেছি তাঁরা বলেছেন এখানে হিকমত হচ্ছে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সুন্নাত। তিনি বলেন, এখানে হিকমত অর্থ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সুন্নাত ব্যতীত অন্য কিছু করা জায়েজ হবে না। কেননা উহা কিতাবের কথা উল্লেখ করার সাথে সাথেই উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা আল্লাহ্ তাঁর নিজের আনুগত্যের সাথে সাথে তাঁর রাসূলের আনুগত্য ও অনুসরণ করা মানুষের উপর ফরয করে দিয়েছেন।
৯) হাদীছ ব্যতীত কুরআনের প্রতি আমল করা অসম্ভব:
কুরআন আল্লাহর বাণী। আল্লাহ ইহা নাযিল করেছেন মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর উপর। তিনি নিজে কুরআনের প্রতি আমল করেছেন এবং কিভাবে আমল করতে হবে তা তাঁর সাহাবায়ে কেরামকে শিখিয়েছেন। সুতরাং কুরআনের প্রতি আমল করতে চাইলে নবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর নিকট থেকেই জানতে হবে তিনি কিভাবে এই কুরআনের প্রতি আমল করেছেন। তাঁর অনুসরণ না করলে কখনই কুরআন পুরাপুরি রূপে বুঝা যাবে না এবং আমলও করা যাবে না। কেননা কুরআনের প্রতিটি কথার বিবরণ ও ব্যাখ্যার দায়িত্ব আল্লাহ্ তাআলা তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে দিয়েছেন। তিনি বলেন,
وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ
“নিশ্চয় আমি আপনার নিকট জিকির (কুরআন) নাযিল করেছি, যাতে করে আপনি বিশদভাবে মানুষের নিকট বর্ণনা করে দেন যা তাদের নিকট নাযিল করা হয়েছে।” (সূরা নাহাল: ৪৪)
আয়েশা সিদ্দীকা (রা) বলেন, “তাঁর চরিত্র ও জীবনী ছিল কুরআন।” অর্থাৎ কুরআন পাঠ করার সাথে তাঁর জীবনী পাঠ করলে এবং তাঁর হাদীছ পাঠ করলে কিভাবে তিনি কুরআনের প্রতি আমল করেছেন তা বাস্তব ভাবে বুঝা যাবে।
আইয়ুব সুখতিয়ানী থেকে বর্ণিত। জনৈক ব্যক্তি মুতাররেফ বিন আবদুল্লাহ বিন শিখ্খীরকে বলল, কুরআন ব্যতীত অন্য কিছু আমাদের নিকট বর্ণনা করবেন না। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ আমরা কুরআনের বিপরীতে কিছু চাই না। কিন্তু আমরা তাঁকে চাই যিনি কুরআন সম্পর্কে আমাদের চেয়ে বেশী জ্ঞান রাখতেন।” (ইবনে আবদুল বার্ জামে বায়ানুল ইলম ২/১১৯৩)
অতএব রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সম্পূর্ণ জীবনীর অনুসরণ না করে বাহ্যিকভাবে কুরআন মানার দাবী করা হলেও, মূলত: তা অমান্য করারই শামিল। কেননা তাঁর জীবনী আমাদের আদর্শ। (আহযাব: ৩২) তাঁকে অনুসরণ করলেই আমরা সঠিক হেদায়াত লাভ করব। (বাকারা: ১৩৫) তাঁকে অনুসরণ করলে আল্লাহকেই অনুসরণ করা হয়। (নিসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম: ৮০) তাঁকে অনুসরণ করলে আল্লাহ্ আমাদের ভালবাসবেন এবং আমাদের গুনাহ মাফ করে দিবেন। (আল ইমরান: ৩১)
১০) হাদীছ না মানলে কুরআনকে যথাযথভাবে মানা হয় না:
(১) সালাত: মুসলমানের উপর সবচেয়ে বড় ফরয ইবাদত। এই ইবাদত কার উপর, কোন কোন সময়, দিনে-রাতে কতবার, কত রাকাত, কি পদ্ধতিতে আদায় করতে হবে, রুকু-সিজদার নিয়ম ইত্যাদি কোন কিছুই কুরআনে উল্লেখ হয় নি। সালাতের জন্যে কি পদ্ধতিতে কি শব্দ উচ্চারণ করে আহ্বান করতে হবে? মানুষ মৃত্যু বরণ করলে তার জানাযা সালাত কি পড়তে হবে? দু’ঈদের সালাত বলতে কি কিছু আছে? এগুলো নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর হাদীছ থেকেই জানতে হবে।
(২) যাকাত: ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ। কোন ধরণের সম্পদ,কি পরিমাণ, কত দিন কাছে থাকলে, কি পরিমাণ যাকাত বের করতে হবে। উট, গরু, ছাগল, শস্য, স্বর্ণ-রৌপ্য ইত্যাদি সম্পদের যাকাতের বিস্তারিত বিবরণ কি? রমাযান শেষে যাকাতুল ফিতর দিতে হবে কি না? ইত্যাদি হাদীছ থেকে জানতে হবে।
(৩) পবিত্রতা: পবিত্রতার ক্ষেত্রে কুরআনে কিছুটা বিস্তারিত থাকলেও নারীদের ঋতু অবস্থায় তার সাথে কি আচরণ করতে হবে তার বিবরণ হাদীছ থেকে নিতে হবে। কুরআনের বাহ্যিক অর্থ অনুযায়ী ঐ অবস্থায় ঋতুবতীর সাথে উঠা-বসা, পানাহার, কথা বলা, শুয়ে থাকা, স্পর্শ করা কোন কিছুই করা যাবে না (২:২২২)। কিন্তু হাদীছ বলেছে, ঐ অবস্থায় শুধুমাত্র সহবাস ব্যতীত সবকিছু করা যাবে।
(৪) হজ্জ: ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ। জীবনে কয়বার হজ্জ ফরয? ইহরাম কিভাবে করতে হবে, কাবা ঘরের তওয়াফ কিভাবে, কয়বার করতে হবে? কিভাবে কতবার সাফা-মারওয়া সাঈ করতে হবে, মিনা, আরাফাত, মুযদালিফা, কুরবানী করতে হবে? ইত্যাদির বিস্তারিত বিবরণ হাদীছ থেকেই নিতে হবে।
(৫) সিয়াম: এ সম্পর্কে কিছু মাসআলা কুরআনে থাকলেও বিস্তারিত বিবরণ হাদীছ থেকেই নিতে হবে।
(৬) চুরির শাস্তি: চোরের হাত করতে হবে কুরআনে আছে। কিন্তু কি পরিমাণ সম্পদ চুরি করলে হাত কাটা যাবে আর কি পরিমাণে হাত কাটা যাবে না তার বিবরণ হাদীছ থেকে নিতে হবে। কেননা ১টাকা চুরি করা আর ১ লক্ষ টাকা চুরি করার অপরাধ কিন্তু একই। উভয় ক্ষেত্রে ব্যক্তি চোর সাব্যস্ত হবে। কিন্তু শাস্তির ক্ষেত্রে অবশ্যই এক সমান হবে না। তাছাড়া হাত কাটলে কি পরিমাণ কাটতে হবে? কব্জি থেকে না কনুই থেকে না সম্পূর্ণ হাত কাটতে হবে?
(৭) মীরাছ: মা অনুপস্থিত থাকলে দাদী মীরাছ পাবে কি না?
(৮) বিবাহ: স্ত্রীর ফুফু অথবা খালাকে বিবাহ করা কি বৈধ? দুগ্ধ সম্পর্কিত কোন্ কোন্ নারীকে বিবাহ করা হারাম ইত্যাদি বিবরণ কুরআনে নেই। আছে হাদীছে।
(৯) মদপান: কুরআনে মদ্যপান হারাম করা হয়েছে। এখন হেরোইন, আফিম, গাঁজা ইত্যাদি মাদকদ্রব্য কুরআনের কোন আয়াতের মাধ্যমে হারাম করবেন? হাদীছের মূলনীতির মাধ্যমে তা হারাম হবে। “যা বেশী খেলে বা সেবন করলে মাদকতা আসে, তার অল্পটাও হারাম।” (আবু দাউদ)
(১০) মৃত প্রাণী খওয়া: কুরআন বলছে মৃত প্রাণী খওয়া হারাম। কিন্তু হাদীছ বলছে পানির মাছ মৃত হলেও তা খাওয়া হালাল। কুরআনে পশুকুলের মধ্যে শুধু শুকরকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কুকুর-শিয়াল, বিড়াল, বাঁদর, বাঘ-ভল্লুক, সাপ-বিচ্ছু, পোকা-মাকড়, কিট-পতঙ্গ, ঈগল, চিল, বাজ, শুকন… ইত্যাদি হারাম হওয়ার ব্যাপারে হাদীছে মূলনীতি বেঁধে দেয়া হয়েছে। তা হচ্ছে, “দাঁত দ্বারা শিকার করে এরকম সকল হিংস্র পশু হারাম। আর থাবা দিয়ে শিকার করে এমন প্রত্যেক পাখি হারাম।” (বুখারী ও মুসলিম)
(১১) সালাত কসর করা: কুরআনে সূরা নিসায় (আয়াত ১০১) সফর অবস্থায় শত্রুর ভয় থাকলে সালাতকে কসর করতে বলা হয়েছে; অথচ রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ভয় থাকুক আর না থাকুক উভয় অবস্থায় সালাত কসর করে বলেছেন, “সালাত কসর করা আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি সদকা, অতএব তোমরা আল্লাহর সদকা গ্রহণ কর।” (মুসলিম)
(১২) পুরুষদের জন্য স্বর্ণ ও রেশম ব্যাবহার করা: কুরআন বলে, “কে আল্লাহর সৌন্দর্যকে হারাম করেছে, যা তিনি তার বান্দাদের জন্যে পাঠিয়েছেন? (আরাফ: ৩২) অথচ হাদীছে রাসূলু্ল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পুরুষদের জন্যে স্বর্ণ ও রেশম ব্যবহারকে হারাম করেছেন। (হাকেম)
এধরণেরে আরও অসংখ্য অগণিত বিষয় আছে যা কুরআনকে সামনে রেখে তার ব্যাখ্যা হাদীছ থেকেই জেনে নিতে হবে।
জনৈক মহিলা ইবনে মাসউদ (রা) কে বলল, আপনারা নাকি বলেন, “যে নারীরা (হাতে বা মুখমণ্ডলে) খোদাই করে নকশা করে এবং যারা নকশা করিয়ে নেয়, যে নারীরা ভ্রুর চুল উঠিয়ে নেয় এবং যে নারীরা দাঁত সুন্দর করার জন্যে তাতে ফাঁক সৃষ্টি করে এদের সবাইকে আল্লাহ্ লানত করেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, সত্য কথা। মহিলাটি বলল, আমি আল্লাহর কিতাব প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করেছি, কিন্তু কোথাও তো একথা পাই নি? ইবনে মাসউদ (রা) বললেন, তুমি যদি কুরআন পড়তে তবে তা পেতে। তুমি কি পড়নি আল্লাহর বাণী:
ومَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا وَاتَّقُوا
“রাসূল তোমাদের যা দেন তা গ্রহণ কর এবং যা থেকে নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক।” (হাশরঃ ৭) সে বলল, একথা তো কুরআনে আছে। তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে উক্ত কথা বলতে শুনেছি। (বুখারী ও মুসলিম)
অতএব যারা কুরআন মানার দাবী করবে,তাদের হাদীছ না মেনে উপায় নেই। হাদীছ মানলেই কুরআন মানা হবে এবং সত্যিকার অর্থে তারা কুরআনের অনুসারী হবে এবং প্রকৃত মুসলমান হবে।
মজলুম ইমাম বুখারী এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে হাদীস লেখার প্রচলন:
হাদীছের অস্বীকারকারীরা ইমাম বুখারী (রহঃ)এর উপর সবচেয়ে বেশী আক্রমণ করে। বলে যে, তিনিই নাকি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মৃত্যুর ২০০/৩০০ বছর পর সবার আগে হাদীছ লিখেছেন এবং মিথ্যা ছড়িয়েছেন! কি দুঃখজনক আশ্চর্য ধরণের মূর্খতা! সত্যিই আপনি মাজলুম হে ইমাম বুখারী! তাতে কি? ওরা তো আপনার পূর্বে নবী-রাসূলদেরকেও মিথ্যাবাদী বলতে ছাড়ে নি, আপনাকে তো বলবেই।
فَإِنْ كَذَّبُوكَ فَقَدْ كُذِّبَ رُسُلٌ مِنْ قَبْلِكَ جَاءُوا بِالْبَيِّنَاتِ وَالزُّبُرِ وَالْكِتَابِ الْمُنِيرِ
“তাছাড়া এরা যদি তোমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, তবে তোমার পূর্বেও এরা এমন বহু নবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে, যারা নিদর্শন সমূহ নিয়ে এসেছিলেন এবং এনেছিলেন সহীফা ও প্রদীপ্ত গ্রন্থ। (সূরা আলে ইমরান: ১৮৪)
যে ইমাম বুখারী হাদীছ সংকলনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন, বিশুদ্ধ হাদীছ সংগ্রহ করতে সবচেয়ে বেশী পরিশ্রম করেছেন। সেই ইমাম বুখারী (রহঃ) আজ মিথ্যা অপবাদে আক্রান্ত। ইসলামের শত্রুরা এরূপই বলে থাকে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে হাদীস লেখার প্রচলন:
আমি এখানে উল্লেখ করব যে ইমাম বুখারীই সর্বপ্রথম হাদীছ সংকলন করেননি বা লিপিবদ্ধ করেন নি; বরং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর যুগেই কিছু কিছু হাদীছ লিপিবদ্ধ শুরু হয়েছিল। যেমনটি তিনি নিজেই হাদীছ সংরক্ষণ করার তাগিদও দিয়েছিলেন।
তিনি বিদায় হজ্জে ভাষণ দেয়ার পর বলেছিলেন, আমার এই কথাগুলো যারা উপস্থিত তারা অনুপস্থিত লোকদের নিকট যেন পৌঁছে দেয়। (বুখারী ও মুসলিম)
জুবাইর বিন মুততেম (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদায় হজ্জে, মিনার মসজিদে খায়ফে আমাদের সম্মুখে বক্তব্য রাখলেন। তিনি বললেন:
مَنْ لَمْ يَسْمَعْهَا فَرُبَّ حَامِلِ فِقْهٍ لا فِقْهَ لَهُ ، وَرُبُّ حَامِلِ فِقْهٍ إِلَى مَنْ هُوَ أَفْقَهُ مِنْهُ
“আল্লাহ সেই বান্দাকে উজ্জ্বলতা দান করুন, যে আমার কথা শুনেছে, মুখস্থ করেছে ও ধারণ করে রেখেছে। অতঃপর যারা তা শুনে নি তাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছে। কেননা কতক জ্ঞান বহনকারী, নিজে জ্ঞানী নয়। আর কতক জ্ঞান বহনকারী ব্যক্তি তার চেয়ে বেশী জ্ঞানীর নিকট তা পৌঁছিয়ে থাকে।” (ত্বাবরানী)
১) আবু হুরাইরা (রা) বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর সাহাবীদের মধ্যে আমার চেয়ে বেশী কেউ হাদীছ বর্ণনা করেন নি। তবে আবদুল্লাহ বিন আমরের কথা ভিন্ন। কারণ তিনি হাদীছ লিখে রাখতেন, আর আমি লিখতাম না। (সহীহ্ বুখারী, ১/১৯৩)
২) রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মক্কা বিজয়ের পর একটি ভাষণ দিলেন এবং মুসলিম জাতির জন্যে কিছু বিধি-বিধান আলোচনা করলেন। তাঁর ভাষণ শেষ হলে আবু শাহ্ নামে জনৈক ব্যক্তি যে ইয়েমেনে থেকে এসেছিল বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এগুলো লিখে দিন। তখন রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)বললেন, اكْتُبُوا لِأَبِي شَاهٍ তোমরা আবু শাহকে হাদীছ লিখে দাও।(বুখারী ৮/২৯৩, হা/২২৫৪)
৩) আবু জুহাইফা বলেন, আমি আলী (রা)কে প্রশ্ন করলাম, আল্লাহর কিতাব ব্যতীত কোন কিতাব কি আপনাদের নিকট আছে? তিনি বললেন, আল্লাহর কিতাব ব্যতীত কোন কিতাব আমার নিকট নেই। তবে আল্লাহর কিতাবের জ্ঞান যা কোন মুসলমানকে আল্লাহ দিয়েছে এবং এই সহীফা (দফতর)এর ভিতর যা লিখা আছে। আমি বললাম, সহীফাতে কি লিখা আছে? তিনি বললেন, রক্তপণ, বন্দী মুক্তির নিয়ম, আরও লিখা আছে, কাফেরকে হত্যা করার কারণে মুসলিমকে হত্যা করা যাবে না।
৪) বুখারীর অন্য বর্ণনায় আলী (রা) থেকে আরও উল্লেখ আছে, সহীফাতে আরও লিখা আছে কেউ কাউকে জখম করলে তার বিচার কি পন্থায় করতে হবে, উটের বয়স কত হলে যাকাত দিতে হবে, মদীনা শরীফের হারাম এলাকার সীমানা কতদূর? কোন মুসলমান যদি কাউকে নিরাপত্তা দেয় তার বিধান কি? আর ঐ নিরাপত্তা লঙ্ঘন করলে তার করণীয় কি? ইত্যাদি। (দীর্ঘতার ভয়ে পূরা হাদীছটি উল্লেখ করলাম না) (দ্রঃ বুখারী ১/১৯১,হা/১০৮ ও ১০/৪৩৪ হা/২৯৩৬ হাদীছটি আরও বর্ণনা করেছেন ইমাম মুসলিম, হা/১৩৭০। ইমাম আহম)
৫) ইমাম আহমাদ এবং হাকেম আরও বর্ণনা করেছেন যে, আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা) এর নিকট একটি কিতাব ছিল, যা তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর নিকট থেকে লিখে রেখেছিলেন। ঐ কিতাবটির নাম ছিল ‘সাহীফা সাদেকা। (ঐ)
এই সকল বর্ণনা থেকে একথা স্পষ্ট হয় যে, সাহাবীয়ে কেরাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীছ লিপিবদ্ধ করতেন। তাঁদের মধ্যে আলী (রা) আবদুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা), জাবের বিন আবদুল্লাহ (রা) অন্যতম। এছাড়া আরও অনেক সাহাবী হাদীছ লিখে রেখেছিলেন। তাদের প্রত্যেকের নিকট সহীফা ছিল।
বিশিষ্ট গবেষক ও মুহাদ্দিস মুহাম্মদ মোস্তফা আযামী ‘দেরাসাহ্ ফীল হাদীছ আন্ নববী ওয়া তারিখে তাদভীনেহী’ (পৃঃ ৯২-১৪২) নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, প্রায় ৫২জন সাহাবী হাদীছ লিপিবদ্ধ করেছেন। সাহাবায়ে কেরামের পর তাবেঈদের মধ্যেও অনেকে হাদীছ লিপিবদ্ধ করেছেন এবং তাদের নিকট সহীফা ছিল। আর তাঁদের সংখ্যা প্রায় ১৫২ ছিল।
হাদীছ না লিখার দলীল:
বিরুদ্ধবাদীরা হাদীছ লিপিবদ্ধ না করা সংক্রান্ত একটি হাদীছ পেয়ে খুবই লাফালাফি করে বলে যে হাদীছ লিখতে নিষেধ করা হয়েছে। হাদীছটি নিম্নরূপ:
আবু সাঈদ খুদরী (রা) বলেন,রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)বলেছেন, “তোমরা আমার নিকট থেকে কোন কিছু লিখিও না। যে ব্যক্তি আমার নিকট থেকে কুরআন ব্যতীত অন্য কিছু লিখবে সে যেন তা মিটিয়ে দেয়। আর তোমরা আমার নিকট থেকে হাদীছ বর্ণনা কর অসুবিধা নেই। যে ব্যক্তি আমার উপর মিথ্যা রোপ করবে সে তার ঠিকানা জাহান্নামের নির্ধারণ করে নিবে।” (মুসনাদে আহমাদ, ১৭/৪৪৩ হা/১১৩৪৪, মুসলিম ১৪/২৯১)
তাদের দাবী যেহেতু এই হাদীছে কুরআন ব্যতীত অন্য কিছু লিখা নিষেধ করা হয়েছে, সুতরাং পরবর্তী যুগেও হাদীছ লিখা নিষেধ। তারা যে হাদীছটিকে তাদের মতের পক্ষের পায়, সেটি উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হয়। তাদের নিকট এই হাদীছটি যদি সত্য বলে গণ্য হয়, তবে উপরে উল্লেখিত হাদীছগুলোও সত্য। মতের পক্ষে কিছু পাওয়া গেলে গ্রহণ করতে হবে, আর বিপক্ষের সঠিক কথা গেলেও তা গ্রহণ করা যাবে না, এটা তো সুবিধাবাদীদের নীতি।
কিন্তু সঠিক নীতি হল, সবগুলো হাদীছের প্রতি আমল করতে চাইলে উভয় ধরণের হাদীছের মাঝে সামঞ্জস্য বিধান করতে হবে। কোন্ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে হাদীছগুলো বলা হয়েছে তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে।
এখানে তিন ধরণের সমাধান উল্লেখ করা যেতে পারে:
প্রথমত: প্রাধান্য দেয়া। অনুমতি সংক্রান্ত হাদীছগুলোকে নিষেধের হাদীছের উপর প্রাধান্য দিতে হবে। কেননা হাফেয ইবনে হাজার উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম বুখারী ও আবু দাউদ এই হাদীছের একজন রাবী ‘হাম্মাম’ হাদীছটিকে মারফূ’ সূত্রে বর্ণনা করে ভুল করেছেন। হাদীছটি মাওকূফ হিসেবেই সঠিক। অর্থাৎ ইহা আবু সাঈদ খুদরী (রা) এর কথা। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর কথা নয়। তখন আর কোন সমস্যা থাকে না। হাদীছ লিখার অনুমতির ক্ষেত্রে যে মারফূ’ হাদীছ সমূহ আছে তাই প্রাধান্য পাবে।
দ্বিতীয়ত: রহিত। অর্থাৎ হাদীছ লিখার অনুমতি সংক্রান্ত হাদীছ দ্বারা নিষিদ্ধতার হাদীছ রহিত হয়ে গেছে। কেননা অনুমতি সংক্রান্ত হাদীছগুলো পরের। অর্থাৎ বিদায় হজ্জের সময়ের, যা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর তিরোধানের অল্পকিছু দিন পূর্বে ছিল।
তৃতীয়ত: সামঞ্জস্য বিধান। ইমাম বাইহাকী বলেন, সম্ভবত: ভুলে যাওয়া যে সকল সাহাবীর ব্যাপারে আশংকা করা হয়েছিল তাদেরকে লিখতে অনুমতি দিয়ো হয়েছে। আর যার স্মরণ শক্তি দৃঢ় তাকে লিখতে নিষেধ করা হয়েছে। অথবা যারা কুরআন থেকে হাদীছকে পার্থক্য করতে পারবে না বা যাদের কাছে কুরআন ও হাদীছ সংমিশ্রণ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল তাদেরকে লিখতে নিষেধ করা হয়েছে। আর যাদের ক্ষেত্রে ঐ সম্ভাবনা নেই তাদেরকে অনুমতি দেয়া হয়েছে।
ইমাম যারকাশী সামঞ্জস্য বিধানের আরও কয়েকটি মত উল্লেখ করেছেন:
(১) নিষেধের হাদীছ শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর জীবদ্দশার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কেননা রহিত করণ তখনও হতেই ছিল। তখন হাদীছ লিখলে রহিত কারী হাদীছ ও রহিত কৃত হাদীছ সংমিশ্রিত হয়ে যাবে, তাই নিষেধ করা হয়েছিল। দেখুন না, বিদায় হজ্জের খুতবায় ‘আবু শাহ’ নামক লোকটিকে হাদীছ লিখে দিতে অনুমতি দেয়া হয়েছে।
(২) নিষেধের কারণ ছিল, যাতে করে লিখক শুধু হাদীছের লিখিত বস্তুর উপর ভরসা করবে, ফলে মুখস্থ করার প্রবণতা হ্রাস পাবে।
(৩) যাতে করে কুরআনের সমতুল্য আরেকটি কিতাব না রাখা হয়। তাই নিষেধ করা হয়েছিল।
এই মতবিরোধ শুধু প্রথম যুগের জন্যে প্রযোজ্য ছিল। পরবর্তীতে উম্মতে মুসলিমার সকলেই হাদীছ লিপিবদ্ধ করার বিষয়ে ঐকমত পোষণ করেন।
তাই গ্রন্থাকারে ইমাম মালিক (রহঃ) সর্বপ্রথম হাদীছের গ্রন্থ লিখেছেন, যা ‘মুআত্বা’ নামে মুসলমান সমাজে পরিচিত। আজ পর্যন্ত সেই কিতাব মুসলমানদের নিকট নির্ভরযোগ্য সমাদৃত হাদীছ গ্রন্থ। তিনি ৯৩হিঃ সনে জন্ম গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ ইমাম বুখারীর জন্মের প্রায় একশত বছর পূর্বে। আর ইমাম মালিক ‘রাবীয়া’র নিকট থেকে হাদীছ নিয়েছেন। যিনি মৃত্যু বরণ করে ১৩৬ হি: সনে। রাবীয়া অসংখ্য সাহাবীর সাথে সাক্ষাৎ করে তাদের থেকে হাদীছ নিয়েছিলেন।
ইমাম মালিক ইবনে শিহাব যুহরী থেকেও হাদীছ সংগ্রহ করেছেন। যিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর দশের অধিক সাহাবীর সাক্ষাত লাভ করেছেন এবং তাদের নিকট থেকে হাদীছ সংগ্রহ করেছেন।
ইমাম মালিক ‘নাফে’ থেকে ৮০টি হাদীছ সংগ্রহ করেছেন। তিনি বড় তাবেঈদের অন্যতম ছিলেন। তিনি সাহাবী ইবনে ওমার (রা)এর তিরিশ বছর খেদমত করেছেন এবং তাঁর নিকট থেকে হাদীছ নিয়েছেন। নাফে আরও হাদীছ নিয়েছেন আবু সাঈদ খুদরী, আয়েশা, উম্মে সালামা, আবু হুরাইরা (রা) প্রমুখ থেকে। নাফে’ মদীনায় মৃত্যু বরণ করেন ১৫৯হিজরিতে। অর্থাৎ ইমাম বুখারীর জন্মের ২৫বছর পূর্বে।
পঞ্চম খলীফা নামে পরিচিত ওমার বিন আবদুল আযীয যখন খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১০১ হিজরিতে অর্থাৎ ইমাম বুখারীর জন্মের ৯৩ বছর পূর্বে, তখন তিনি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর হাদীছ সংগ্রহের জন্যে অধ্যাদেশ জারি করেন।
এই আলোচনার পর সত্য উদ্ঘাটন হয়েছে অতএব فَمَاذَا بَعْدَ الْحَقِّ إِلَّا الضَّلَالُ “সত্য প্রকাশিত হওয়ার পর গুমরাহী ব্যতীত কিছু বাকী থাকে না।” (সূরা ইউনুস: ৩২) يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ حَسْبُكَ اللَّهُ وَمَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ “হে নবী আল্লাহই আপনার জন্যে যথেষ্ট এবং আপনার অনুসরণকারী মু’মিনগণ।” (সূরা আনফালঃ ৬৪)
আফসোস হাদীছ অস্বীকারকারীদের জন্যে তারা বলল না:سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ “শুনলাম ও মানলাম, তোমার ক্ষমা চাই হে আমাদের পালনকর্তা, তোমার কাছেই ফিরে যেতে হবে।” (২:২৮৫) বরং তারা বলল سَمِعْنَا وَعَصَيْنَا وَاسْمَعْ غَيْرَ مُسْمَعٍ وَرَاعِنَا لَيًّا بِأَلْسِنَتِهِمْ وَطَعْنًا فِي الدِّينِ “শুনলাম ও অমান্য করলাম, আরও বলে শোন, না শোনার মত। আর তারা স্বীয় জিহ্বা কুঞ্চিত করে ও ধর্মের প্রতি দোষারোপ করে বলে ‘রয়েনা’। (৪:৪৬)
লেখক: শাইখ আব্দুল্লাহ আল কাফী
সম্পাদক: শাইখ আব্দুল্লাহিল হাদী