কুরআন-সুন্নাহর আলোকে জামাআত ও ঐক্য
ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর
অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ
প্রশংসা মহান আল্লাহর নিমিত্ত। সালাত ও
সালাম মুহাম্মাদ (সা.), তাঁর পরিজন-অনুসারী ও সহচরগণের জন্য। উম্মাতের ঐক্য
ও ঐক্যের আহ্বান বিষয়টি আমারা অনেকেই বিভিন্ন আঙ্গিকে আলোচনা করে থাকি। এ
প্রসঙ্গে নিম্নের সংক্ষিপ্ত কয়েকটি বিষয়ের প্রতি আমি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ
করছি।
১. জামাআত: কুরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত অন্যতম ইবাদত
ঐক্য বুঝাতে আরবীতে ‘ওয়াহদাহ’, ইত্তিহাদ, তাওহীদ ইত্যাদি শব্দ বহুল প্রচলিত। তবে এ অর্থে কুরআন ও হাদীসে ‘জামা‘আত’, জামী’ বা অনুরূপ ব্যবহার করা হয়েছে। আরবী (جمع) ‘জামঅ’ শব্দটির অর্থ একত্রিত করা। ‘একত্রিত’ অর্থেও ‘জাম্অ’, জামীঅ, মাজমু’ বা জামাআত শব্দ ব্যবহৃত হয়। (ইবন মানযূর, লিসানুল আরব, জামঅ শব্দ)। আভিধানিক ব্যবহারে অল্প বা বেশি যে কোনো সংখ্যক মানুষ বা বস্তুর একত্রিত অবস্থাকে জামাআত বলা যায়। কুরআন ও সুন্নাহর ব্যবহারে মুসলিমগনের একত্রিত বা ঐক্যের অবস্থাকে জামাআত বলা হয়েছে। বর্তমানে ‘জামাআত’ শব্দটি ঐক্যের চেয়ে অনৈক্যের অর্থেই বেশি ব্যবহার করা হয়। আমরা দেখি যে, জামাআত শব্দটি বর্তমানে ‘দল’, গ্রুপ বা ফিরকা অর্থে ব্যবহার করা হয়। কুরআন কারীমে ‘জামঅ’ শব্দটিকে ফিরকা, দল বা গ্রুপের বিপরীতে একত্রিত বা ঐক্যবদ্ধতার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন:
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا وَاذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنْتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنْتُمْ عَلَى شَفَا حُفْرَةٍ مِنَ النَّارِ فَأَنْقَذَكُمْ مِنْهَا
“তোমরা আল্লাহ্র রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর ঐক্যবদ্ধভাবে এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহ্র অনুগ্রহ স্মরণ কর: তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন, ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। তোমরা অগ্নিকুন্ডের প্রান্তে ছিলে, আল্লাহ্ তা থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করেছেন। (আল-ইমরান: ১০৩)
এ আয়াত থেকে আমরা দেখি যে, ‘জামঅ’ (ঐক্যবদ্ধতা) শব্দকে ‘তার্ফারুক’ (বিভক্তি বা দলাদলি)-র বিপরীতে ব্যবহার করা হয়েছে। এ থেকে জানা যায় যে, বিভক্তিমুক্ত ঐক্যের অবস্থাই জামাআত। এ আয়াত থেকে আরো জানা যায় যে, জামাআত বা ঐক্যের অবস্থাই উখুওয়াত বা ভ্রাতৃত্ব এবং পরস্পর সম্প্রীতির অবস্থা এবং ‘পরস্পর শত্রুতা’-র অবস্থাই তার্ফারুক বা দলাদলির অবস্থা। আরো জানা যায় যে, শত্রুতা ও দলাদলি জাহান্নামের প্রান্তে নিয়ে যায় এবং ঐক্য, পারস্পরিক ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্ব তা থেকে রক্ষা করে।
বিভিন্ন হাদীসে মুসলিম উম্মাহকে জামাআতের মধ্যে থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কখনো জামাআত বলতে রাষ্ট্রীয় ঐক্যবদ্ধতা এবং কখনো উম্মাহর সাধারণ ঐক্যবদ্ধতা বুঝানো হয়েছে। ইবনু আব্বাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
مَنْ رَأَى مِنْ أَمِيرِهِ شَيْئًا يَكْرَهُهُ فَلْيَصْبِرْ عَلَيْهِ فَإِنَّهُ مَنْ فَارَقَ الْجَمَاعَةَ شِبْرًا فَمَاتَ (لَيْسَ أَحَدٌ يُفَارِقُ الْجَمَاعَةَ شِبْرًا فَيَمُوتُ) إِلا مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً
“কেউ তার শাসক বা প্রশাসক থেকে কোন অপছন্দনীয় বিষয় দেখলে তাকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। কারণ যদি কেউ জামা‘আতের (সমাজ বা রাষ্টের ঐক্যের) বাইরে এক বিঘতও বের হয়ে যায় এবং এ অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে, তাহলে সে জাহিলী মৃত্যু বরণ করল।” (বুখারী ও মুসলিম)
এ হাদীসে আমরা দেখছি যে, ‘জামাআত’-এর বিপরীতে মুফারাকাত বা বিচ্ছিন্নতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং জামাআত ও বিচ্ছিন্নতার ভিত্তি হিসেবে শাসক-প্রশাসককে উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে জানা যায় যে, মুসলিম সমাজের রাষ্ট্রীয় ঐক্যবদ্ধতা সংরক্ষণের স্বার্থে শাসক-প্রশাসকের অপছন্দনীয় কাজের বিষয়ে ধৈর্য ধারণ করে হলেও রাষ্ট্রীয় ঐক্য রক্ষা করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই ঐক্য বিনষ্ট করে বিচ্ছিন্নতার পথে যাওয়া যাবে না। অন্য হাদীসে আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
مَنْ خَرَجَ مِنْ الطَّاعَةِ وَفَارَقَ الْجَمَاعَةَ فَمَاتَ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً
“যে ব্যক্তি ‘তা‘আত’ অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় আনুগত্য থেকে বের হয়ে এবং জামা‘আত, অর্থাৎ ঐক্যবদ্ধ বা বৃহত্তর সমাজ ও জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মৃত্যু বরণ করল সে জাহিলী মৃত্যু বরণ করল।” (মুসলিম)
এ হাদীসেও ঐক্যের জন্য রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের কথা বলা হয়েছে। আরফাজা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
إِنَّهُ سَتَكُونُ هَنَاتٌ وَهَنَاتٌ فَمَنْ أَرَادَ أَنْ يُفَرِّقَ أَمْرَ هَذِهِ الأُمَّةِ وَهِيَ جَمِيعٌ فَاضْرِبُوهُ بِالسَّيْفِ كَائِنًا مَنْ كَانَ (مَنْ أَتَاكُمْ وَأَمْرُكُمْ جَمِيعٌ عَلَى رَجُلٍ وَاحِدٍ يُرِيدُ أَنْ يَشُقَّ عَصَاكُمْ أَوْ يُفَرِّقَ جَمَاعَتَكُمْ فَاقْتُلُوهُ)
“ভবিষ্যতে অনেক বিচ্যুতি-অন্যায় সংঘটিত হবে। যদি এমন ঘটে যে, এ উম্মাতের ঐক্যবদ্ধ থাকা অবস্থায় কেউ এসে সে ঐক্য বিনষ্ট করে বিভক্তি সৃষ্টি করতে চায় তবে সে যেই হোক না কেন তোমরা তাকে তরবারী দিয়ে আঘাত করবে। অন্য বর্ণনায়: তোমাদের বিষয়টি একব্যক্তির বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকা অবস্থায় কোনো ব্যক্তি যদি এসে তোমাদের ঐক্য বিনষ্ট করতে বা ‘জামাআত’ বিভক্ত করতে চায় তবে তাকে হত্যা করবে।” (মুসলিম)
নাসায়ীর বর্ণনায়:
فَمَنْ رَأَيْتُمُوهُ فَارَقَ الْجَمَاعَةَ أَوْ يُرِيدُ يُفَرِّقُ أَمْرَ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَائِنًا مَنْ كَانَ فَاقْتُلُوهُ فَإِنَّ يَدَ اللَّهِ عَلَى الْجَمَاعَةِ فَإِنَّ الشَّيْطَانَ مَعَ مَنْ فَارَقَ الْجَمَاعَةَ يَرْكُضُ
“তোমরা যাকে দেখবে যে সে ঐক্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে বা মুহাম্মাদের (সা.) উম্মাতকে বিভক্ত করতে চাচ্ছে সে যেই হোক না কেন তাকে হত্যা করবে। কারণ আল্লাহর হাত ঐক্যের উপর। আর যে ঐক্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয় শয়তান তার সাথে দৌঁড়ায়।” (আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।)
হারিস আশ‘আরী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,
أَنَا آمُرُكُمْ بِخَمْسٍ اللَّهُ أَمَرَنِي بِهِنَّ السَّمْعُ وَالطَّاعَةُ وَالْجِهَادُ وَالْهِجْرَةُ وَالْجَمَاعَةُ فَإِنَّهُ مَنْ فَارَقَ الْجَمَاعَةَ قِيدَ شِبْرٍ فَقَدْ خَلَعَ رِبْقَةَ الإِسْلامِ مِنْ عُنُقِهِ إِلا أَنْ يَرْجِعَ
“আমি তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ের নির্দেশ দিচ্ছি, যেগুলির নির্দেশ আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন: শ্রবণ, আনুগত্য, জিহাদ, হিজরত ও জামা‘আত (ঐক্য); কারণ যে ব্যক্তি জামা‘আত (ঐক্য) থেকে এক বিঘত সরে গেল সে ইসলামের রজ্জু নিজের গলা থেকে খুলে ফেলল, যদি না ফিরে আসে।” (তিরমিযী। তিরমিযী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন)
অন্য হাদীসে উমার (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
عليكم بالجماعةِ، وإِيَّاكُم والفُرْقَةَ، فَإِنَّ الشيطانَ مع الواحد، وهو من الاثنين أبعدُ، مَنْ أَراد بُحْبُوحَةَ الجنة فليلزم الجماعةَ
“তোমরা জামাআত (ঐক্য) আকড়ে ধরে থাকবে এবং দলাদলি বা বিচ্ছিন্নতা থেকে সাবধান থাকবে। কারণ শয়তান একক ব্যক্তির সাথে এবং সে দু’জন থেকে অধিক দূরে। যে ব্যক্তি জান্নাতের প্রশস্ততা চায় সে জামাআত (ঐক্য) আঁকড়ে ধরুক। (তিরমিযী। তিরমিযী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।)
অন্য হাদীসে নুমান ইবন বাশীর (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: (الجماعة رحمة والفرقة عذاب) “ঐক্য রহমত এবং বিভক্তি আযাব।” (মুসনাদ আহমদ, আলবানী সাহীহুত তারগীবে হাদীসটিকে হাসান সহীহ বলেছেন।)
আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
إن الله لا يجمع أمتي … على ضلالة ويد الله على/ مع الجماعة ومن شذ شذ إلى النار
“আল্লাহ আমার উম্মাতকে বিভ্রান্তির উপর ঐক্যবদ্ধ করবেন না। আর আল্লাহর হাত ঐক্যের উপর/ সাথে এবং যে ব্যক্তি বিচ্ছিন্ন হবে সে জাহান্নামের মধ্যে বিচ্ছিন্ন হবে।” (তিরমিযী। আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন, শেষ বাক্যটি বাদে)
২. ইফতিরাক: কুরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত নিষিদ্ধ কর্ম
উপরের আয়াত ও হাদীসগুলো থেকে আমরা দেখলাম যে, জামাআত বা ঐক্যের বিপরীতে কুরআন ও হাদীসে তাফাররুক ও ইফতিরাককে নিষিদ্ধ ও নিন্দনীয় বলা হয়েছে। ইফতিরাক, তার্ফারুক, ফারক ইত্যাদির শব্দের মূল অর্থ পার্থক্য, পৃথক, বিভক্ত বা বিচ্ছিন্ন হওয়া বা করা। আমরা আরো দেখেছি যে, তার্ফারুক, বিভক্তি বা দলাদলি মূলত পারস্পরিক শত্রুতার একটি অবস্থা। কুরআন ও হাদীসে বারবার বিভক্তি, ফিরকাবাজি বা দলাদলি থেকে সতর্ক করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন:
وَلا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ
“তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন আসার পরে বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং মতভেদ করেছে, এদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি।” (সূরা আল-ইমরান: ১০৫ আয়াত)
অন্য আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন:
وَلا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ
“এবং অন্তর্ভুক্ত হয়ো না মুশরিকদের, যারা নিজেদের দীনকে বিভক্ত করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে। প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে উৎফুল্ল।” (সূরা রূম: ৩০-৩২ আয়াত)
অন্য আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু বলেন:
إِنَّ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا لَسْتَ مِنْهُمْ فِي شَيْءٍ إِنَّمَا أَمْرُهُمْ إِلَى اللَّهِ ثُمَّ يُنَبِّئُهُمْ بِمَا كَانُوا يَفْعَلُونَ
“যারা তাদের দীনকে বিভক্ত করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের কোনো দায়িত্ব তোমার নয়; তাদের বিষয় আল্লাহর ইখতিয়ারভুক্ত। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে অবহিত করবেন।” (সূরা আন‘আম: ১৫৯ আয়াত)
অন্যত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন:
شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ
“তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন দীন, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নূহকে- আর যা আমি ওহী করেছি আপনাকে- এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা এবং ঈসাকে, এ বলে যে, তোমরা দীন প্রতিষ্ঠা কর এবং তাতে দলাদলি-বিচ্ছিন্নতা করো না।” (সূরা শুরা: আয়াত ১৩)
এখানে আমরা দেখছি যে, দীনের মধ্যে তার্ফারুক, বিভক্তি, বিচ্ছিন্নতা বা দলাদলি এমন একটি ভয়ঙ্কর বিষয় যে, সকল নবীকেই এ বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এখানে দীন প্রতিষ্ঠার বিপরীতে বিভক্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে প্রতীয়মান হয় যে, দীন প্রতিষ্ঠা বলতে দীনের বিষয়ে ঐক্যবদ্ধতার কথাই বলা হয়েছে। মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াকূব ফিরোযআবাদী (৮১৭ হি) তার সংকলিত “তানবীরুল মিকবাস” নামক তাফসীর গ্রন্থে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা) থেকে উদ্ধৃত করেছেন যে, তিনি বলেছেন:
أمر الله جملة الأنبياء أن أقيموا الدين: أن اتفقوا في الدين (وَلاَ تَتَفَرَّقُواْ فِيهِ) لا تختلفوا في الدين
“আল্লাহ সকল নবীকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, দীন প্রতিষ্ঠা কর: অর্থাৎ দীনের বিষয়ে ঐকমত হও ‘এবং তাতে দলাদলি করো না’ অর্থাৎ দীনের বিষয়ে মতভেদ করো না।” (ফিরোযআবাদী, তানবীরুল মিকবাস ২/৪)
ইমাম তাবারী ও অন্যান্য মুফাস্সির প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মুফাস্সির কাতাদা ইবনু দিআমাহ (১১৫ হি) থেকেও অনুরূপ তাফসীর উদ্ধৃত করেছেন। (তাবারী, জামিউল বায়ান ২১/৫১৩)। এ আয়াতের তাফসীরে আল্লামা ইবনু কাসীর বলেন:
أي: وصى الله تعالى جميع الأنبياء، عليهم السلام، بالائتلاف والجماعة، ونهاهم عن الافتراق والاختلاف.
“দীন প্রতিষ্ঠা কর এবং তাতে দলাদলি করো না: অর্থাৎ মহান আল্লাহ সকল নবীকে (আলাইহিমুস সালাম) নির্দেশ দিয়েছেন ভালবাসা ও ঐক্যের এবং নিষেধ করেছেন দলাদলি ও মতভেদ থেকে।” (তাফসীর ইবন কাসীর ৭/১৯৫)
আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ বলেন:
تَفَرَّقَتْ الْيَهُودُ عَلَى إِحْدَى وَسَبْعِينَ أَوْ اثْنَتَيْنِ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً وَالنَّصَارَى مِثْلَ ذَلِكَ وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِي عَلَى ثَلاثٍ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً
“ইহূদীরা ৭১ বা ৭২ দলে বিভক্ত হয়ে যায় এবং খৃস্টানগণও অনুরূপ দলে বিভক্ত হয়ে যায়। আর আমার উম্মাত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে।” (তিরমিযী, আস-সুনান ৫/২৫। তিনি বলেন: হাদীসটি হাসান সহীহ)
কুরআন ও হাদীস থেকে জানা যায় যে, সীমালঙ্ঘন ও বিদ্বেষ বিভক্তির মূল কারণ। পূর্ববর্তী উম্মাতগুলোর মতভেদ ও বিভক্তি প্রসঙ্গে কুরআন কারীমে বারবারই বলা হয়েছে যে, জ্ঞানের আগমনের পরেও তারা বাড়াবাড়ি করে বিভক্ত হয়েছে। আল্লাহ বলেন:
وَمَا تَفَرَّقُوا إِلَّا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ
“তাদের নিকট ইলম আগমনের পরে পারস্পরিক বাড়াবাড়ি করেই শুধু তারা দলাদলি করেছে।” (সূরা শূরা ১৪ আয়াত)
যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
دَبَّ إِلَيْكُمْ دَاءُ الْأُمَمِ قَبْلَكُمْ الْحَسَدُ وَالْبَغْضَاءُ هِيَ الْحَالِقَةُ لَا أَقُولُ تَحْلِقُ الشَّعَرَ وَلَكِنْ تَحْلِقُ الدِّينَ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَا تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوا وَلَا تُؤْمِنُوا حَتَّى تَحَابُّوا أَفَلَا أُنَبِّئُكُمْ بِمَا يُثَبِّتُ ذَاكُمْ لَكُمْ أَفْشُوا السَّلَامَ بَيْنَكُمْ
“পূর্ববর্তী উম্মাতগণের ব্যাধি তোমাদের মধ্যে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে, সে ব্যাধি হলো হিংসা ও বিদ্বেষ। বিদ্বেষ মুণ্ডনকারী। আমি বলি না যে, তা মাথার চুল মুণ্ডন করে, বরং তা দীন মুণ্ডন করে। যারা হাতে আমার জীবন তার শপথ! ঈমানদার না হলে তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। আর তোমরা পরস্পরকে ভাল না বাসলে ঈমানদার হবে না। আমি কি তোমাদেরকে সে বিষয়ের কথা বলব না যা তোমাদের মধ্যে পারস্পারিক ভালবাসা প্রতিষ্ঠিতি করবে। তোমাদের মধ্যে সালামের প্রসার ঘটাও।” (তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৬৬৪। আলবানী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন)
উপরের আয়াত ও হাদীসগুলো থেকে আমরা তার্ফারুক বা ইফতিরাক, অর্থাৎ বিভক্তি, দলাদলি বা বিচ্ছিন্নতার ভয়াবহতা জানতে পারছি। এছাড়া আমরা আবারো দেখছি যে, পারস্পরিক বাড়াবাড়ি, সীমালঙ্ঘন, একে অপরের উপর জয়ী প্রাধান্য পাওয়ার আকাঙ্খা বা পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষই এ বিভক্তির মূল কারণ এবং পারস্পরিক ভালবাসা প্রতিষ্ঠাই তা দূরীকরণের উপায়।
৩. ইখতিলাফ থেকে ইফতিরাক
‘ইফতিরাক’ শব্দের নিকটবর্তী আরেকটি শব্দ ‘ইখতিলাফ’। ইফতিরাক অর্থ বিচ্ছিন্ন হওয়া বা দলে দলে বিভক্ত হওয়া। আর ইখতিলাফ অর্থ মতভেদ করা। ইখতিলাফ বা মতভেদ ইফতিরাক বা বিভক্তির অন্যতম কারণ, তবে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট। মতভেদ মানবীয় প্রকৃতি। দুজন মানুষ কখনোই শতভাগ একমত হতে পারেন না। স্বামী-স্ত্রী বা পিতা-পুত্র থেকে শুরু করে পরিবার বা সমাজ সর্বত্রই মতভেদ বিদ্যমান। কিন্তু সকল মতভেদ শত্রুতা, বিদ্বেষ, বিভক্তি বা দলাদলি নয়। মতভেদকারী ব্যক্তিগণ যখন নিজের মতকেই একমাত্র ‘হক্ক’ ও অন্য মতকে বাতিল মনে করেন এবং অন্যমতের অনুসারীদের ‘অন্যদল’ মনে করেন তখনই তা ইফতিরাক বা ‘বিচ্ছিন্নতা’-য় পরিণত হয়। ‘ইখতিলাফ’ ও ‘ইফতিরাক’-এর পাথ্যর্কের মধ্যে রয়েছে:
(১) ইফতিরাক বা ফিরকাবাজি ইখতিলাফ বা মতভেদের চূড়ান্ত ও নিন্দনীয় পর্যায়।
(২) সকল ইফতিরাকই ইখতিলাফ, অর্থাৎ সকল বিভক্তির মধ্যেই মতভেদ রয়েছে। কিন্তু সকল মতভেদই বিভক্তি নয়। ইখতিলাফ ছাড়া ইফতিরাকের অস্তিত্ব নেই তবে ইফতিরাক ছাড়াও ইখতিলাফ থাকতে পারে। এজন্য ইফতিরাককে ইখতিলাফ বলা যায়, তবে ইখতিলাফকে ইফতিরাক বলা যায় না।
(২) ইখতিলাফ সর্বদা ইফতিরাক বা দলাদলি সৃষ্টি করে না। সাহাবীগণের যুগ থেকে মুসলিম উম্মার ইমাম ও আলিমদের মধ্যে ‘মতভেদ’ বা ইখতিলাফ ছিল, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যে দলাদলি-বিচ্ছিন্নতা বা ইফতিরাক ছিল না।
(৩) শরীয়তের দৃিষ্টতে ইখতিলাফ বা মতভেদ নিষিদ্ধ নয়, বরং অনেক সময় তা প্রশস্ততা সৃষ্টি করে। পক্ষান্তরে ইফতিরাক বা দলাদলি ও বিচ্ছিন্নতা সকল ক্ষেত্রেই নিষিদ্ধ ও নিন্দনীয়।
(৪) ইখতিলাফকারী আলিম নিন্দিত নন, বরং তিনি ইখলাস ও ইজতিহাদের ভিত্তিতে প্রশংসিত ও পুরস্কার-প্রাপ্ত। মুজতাহিদ ভুল করলে একটি পুরস্কার ও সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছালে দুটি পুরস্কার লাভ করেন।
(৫) ইখতিলাফের ভিত্তি অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইলম বা জ্ঞান ও দলিল। আর ইফতিরাকের ভিত্তি সর্বদাই ব্যক্তিগত পছন্দ বা প্রবৃত্তির অনুসরণ, জিদ এবং ইখলাসের অনুপস্থিতি। ইখতিলাফের ক্ষেত্রে আলিমগণ প্রত্যেকে নিজের মতকে সঠিক, অধিকতর শুদ্ধ বলে মনে করলেও অন্য মতটিকে বিভ্রান্তি ও অন্যমতের আলিমকে ‘বিভ্রান্ত’ বলে মনে করেন না, বরং তার দলিলকে দুর্বল বলে গণ্য করেন। পক্ষান্তরে ইফতিরাকের ক্ষেত্রে প্রত্যেক আলিম নিজের মতকে একমাত্র সত্য এবং অন্য মতকে বিভ্রান্তি বলে গণ্য করেন।
(৬) ইলম, ইখলাস, ইসলামী ভ্রাতৃতবোধ ও ভালবাসার সাথে ইখতিলাফ থাকতে পারে। কিন্তু এগুলোর সাথে ‘ইফতিরাক’ থাকতে পারে না। কেবলমাত্র এগুলির অনুপস্থিতিতেই ইফতিরাক জন্ম নেয়।
৪. ঐক্য ও বিভক্তি মূলত অন্তরের কর্ম বা বিশ্বাসের অংশ
উপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান যে, জামাআত বা ঐক্য এবং তাফাররুক বা বিভক্তি মূলত ‘কালবী’ বা ‘ই’তিকাদী’ আমল’ অর্থাৎ অন্তরের বা বিশ্বাসের কর্ম। দৈহিক ঐক্যবদ্ধতা বা সকলের একস্থানে উপস্থিতি জামাআতের একটি প্রকাশ। এ অর্থে সালাতের জামাআতে উপস্থিত হতে হয়। তবে ঐকবদ্ধতা অর্থে উপরের আয়াত ও হাদীসগুলোর আলোকে সকল মুসলিম একস্থানে একত্রিত হওয়া, একটি দলে নাম লেখানো বা অনুরূপ কোনো বাহ্যিক কর্মকে জামাআত বলে মনে করা যাচ্ছে না। আমরা দেখলাম যে, পারস্পরিক ভালবাসা, প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বই জামাআত এবং পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতাবোধই বিভক্তি। এ থেকে জানা যায় যে, হৃদয়ের মধ্যে সকল মুসলিমের প্রতি ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্ব অনুভব করা, মতভেদ সত্ত্বেও মুসলিমকে নিজের দীনী ভাই এবং নিজের দলের মনে করা এবং নিজেকে সকলের সাথে ঐক্যবদ্ধ বলে মনে করাই মূলত জামাআত। এর বিপরীতে অন্য মুসলিমদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ বা শত্রুতা পোষণ করা, নিজেকে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন, পৃথক ও স্বতন্ত্র বলে মনে করাই তার্ফারুক বা ইফতিরাক।
মু‘আবিয়া (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ বলেন:
أَلا إِنَّ مَنْ قَبْلَكُمْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ (الكتابين) افْتَرَقُوا عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ مِلَّةً وَإِنَّ هَذِهِ الْمِلَّةَ سَتَفْتَرِقُ عَلَى ثَلاثٍ وَسَبْعِينَ ثِنْتَانِ وَسَبْعُونَ فِي النَّارِ وَوَاحِدَةٌ فِي الْجَنَّةِ وَهِيَ الْجَمَاعَةُ
“তোমরা জেনে রাখ! তোমাদের পূর্ববর্তী কিতাবীগণ (ইহূদী ও খৃস্টানগণ) ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল। আর এ উম্মাত ৭৩ দলে বিভক্ত হয়ে যাবে। এদের মধ্যে ৭২ দল জাহান্নামে এবং একটি দলই জান্নাতে। তারা জামা‘আত।” (আবূ দাউদ ৪/১৯৮; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/২১৮। হাকিম ও যাহাবী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। ইবনু হাজার হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। আলবানী, সাহীহাহ ১/৪০৪-৪১৪)
এখানে সুস্পষ্ট যে, জামাআত বলতে নির্ধারিত স্থানে দৈহিকভাবে একত্রিত বা আধুনিক পরিভাষায় কোনো দলের ব্যানারে একত্রিত জনগোষ্ঠীকে বুঝানো হয় নি। চেতনায় ও বিশ্বাসে ঐক্যবদ্ধ মূলধারার মুসলিমদেরকে বুঝানো হয়েছে।
৫. সমকালীন ইফতিরাকের বিভিন্ন কারণ
প্রাচীন যুগ থেকেই উম্মাতের মধ্যে বিভক্তি প্রবেশ করেছে। বর্তমানে তা অনেক বেশি প্রকট রূপ ধারণ করেছে। বিশেষ করে মূলধারার বা কুরআন, সুন্নাহ ও শরীয়াহ অনুসারী ধার্মিক মুসলিমদের মধ্যে বিভিক্তি প্রকট হয়েছে। এজন্য আমরা সংক্ষেপে সমকালীন বিভিক্তর কয়েকটি কারণ উল্লেখ করছি।
ক. আকীদার মতভেদ
উম্মাতের প্রাচীনতম বিভক্তির কারণ ছিল আকীদা বা বিশ্বাসগত মতভেদ। ইসলামের প্রথম যুগগুলোতে আকীদার ভিত্তিতে শিয়া, খারিজী, মুতাযিলী, জাহমী, কাদারী, জাবারী ইত্যাদি ফিরকার জন্ম হয়েছিল। তাদের বিপরীতে সাহাবীগণের অনুসারী মূল ধারার মুসলিমগণ নিজেদেরকে ‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত’ অর্থাৎ সুন্নাত ও ঐক্যের অনুসারী বলে গণ্য করতেন। পরবর্তী যুগে ‘আহলুস সুন্নাত’-এর অনুসারীদের মধ্যেও আকীদার ছোট বা বড় বিষয়গুলো নিয়ে বহু প্রকারের অনৈক্য ও বিভক্তির জন্ম নিয়েছে। আমরা দেখেছি যে, ঐক্য ও বিভক্তি মূলতই বিশ্বাস বা মনের কর্ম। এজন্য আকীদার মতভেদ থেকে বিভক্তি ও শত্রুতার জন্ম নেওয়াই স্বাভাবিক।
খ. ফিকহী মতভেদ
আকীদাগত মতভেদ নিয়ে বিভক্তির চেয়েও অনেক বড় ও প্রকট হয়ে পড়েছে বর্তমান যুগে ফিকহী মতভেদ কেন্দ্রিক বিভক্তি। আমরা দেখি যে, ইসলামের প্রথম যুগগুলোতে আকীদার মতভেদ নিন্দনীয় ও বিভক্তি বলে গণ্য করা হতো, তবে ফিকহী মতভেদ সহনীয় বলে গণ্য ছিল। ক্রুসেড যুদ্ধোত্তর যুগগুলোতে মাযহাবী মতভেদ এক প্রকারের বিভক্তির রূপ গ্রহণ করে। বর্তমানে মাযহাবের নামে বা হাদীসের নামে ফিকহী মতগুলো পূর্বের যুগের চেয়েও অনেক প্রকটভাবে বিভক্তির অন্যতম কারণ হিসেবে পরিণত হয়েছে।
গ. আকীদা ও ফিকহী মতভেদে সাহাবীগণের পদ্ধতি পরিত্যাগ
সমকালীন বিভক্তির অন্যতম কারণ, মতভেদের ক্ষেত্রে সাহাবীগণের কর্মধারা পরিত্যাগ করা। আমরা দেখি যে, সাহাবীগণের যুগ থেকেই উপরের দু’ প্রকারের মতভেদ বিদ্যমান ছিল। উভয় ক্ষেত্রেই তারা জামাআত বা ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের দিকে লক্ষ্য রেখেছেন।
সাহাবী-তাবিয়ীগণ আকীদা বিষয়ক মতভেদকে নিন্দনীয় ও বর্জনীয় বলে গণ্য করেছেন। কারণ আকীদা অপরিবর্তনীয় ও স্থির। এখানে কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট বক্তব্যের অতিরিক্ত ইজতিহাদ, ভিন্নমত বা নতুন মতের প্রয়োজন বা সুযোগ নেই। এরপরও তারা আকীদা বিষয়ক মতভেদ বা বিভ্রান্তিতে লিপ্তদের প্রতি জামাআত, ভ্রাতৃত্ব বা ঐক্যবোধের চেতনা লালন করতেন। খারিজীগণ সাহাবীগণকে এবং খারিজীদের সাথে শতভাগ একমত নয় এরূপ সকল মুসলিমকে অত্যন্ত খোঁড়া ও ভিত্তিহীন ‘দলিল’ দিয়ে কাফির বলে গণ্য করেন এবং ঢালাওভাবে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ও হত্যায় লিপ্ত হন। সাহাবীগণ খারিজীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ করার পাশাপাশি তাদেরকে কাফির বলা থেকে বিরত থেকেছেন। তাদের ঈমান, আমল ও আবেগের মূল্যায়ন করেছেন। যুদ্ধের ময়দানের বাইরে তাদের পিছনে সালাত আদায়-সহ তাদের সাথে ধর্মীয় ও সামাজিক সম্পর্ক রক্ষা করেছেন। (ইবনু তাইমিয়া, মাজমূউল ফাতাওয়া ৭/২১৭-২১৮; ড. নাসির আল-আকল, আল-খাওয়ারিজ, পৃ. ৪৭-৫৬)
খারিজীগণের বিষয়ে আলী (রা)-কে প্রশ্ন করা হয়: এরা কি কাফির? তিনি বলেন, এরা তো কুফরী থেকে বাঁচার জন্যই পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বলা হয়, তবে কি তারা মুনাফিক? তিনি বলেন, মুনাফিকরা তো খুব কমই আল্লাহর যিক্র করে, আর এরা তো রাতদিন আল্লাহর যিক্রে লিপ্ত। বলা হয়, তবে এরা কী? তিনি বলেন, এরা বিভ্রান্তি ও নিজ-মত পূজার ফিতনার মধ্যে নিপতিত হয়ে অন্ধ ও বধির হয়ে গিয়েছে। (ইবনুল আসীর, আন-নিহাইয়াহ ফী গারিবিল হাদীস ২/১৪৯)
ফিকহী মতভেদকে সাহাবী-তাবিয়ীগণ নিন্দনীয় বা বর্জনীয় বলে গণ্য করেন নি। এক্ষেত্রে সাধারণত তারা নিজের মতের পক্ষে দলিল পেশ করতেন, তবে ভিন্নমতকে বাতিল করতেন না। কেউ ভিন্ন মত খ-ন করলেও কখনোই তারা ফিকহী ভিন্নমতের কারণে ভিন্নমতাবলম্বীকে অবজ্ঞা করেন নি এবং তার থেকে বিমুক্তি বা বিচ্ছিন্নতার কথা বলেন নি। বরং ভিন্নমত-সহ পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব, ভালবাসা, শ্রদ্ধাবোধ ও ঐক্যবোধ লালন করেছেন।
সমকালীন বিভক্তিতে উভয় ক্ষেত্রেই প্রান্তিকতা লক্ষ্য করা যায়। আকীদার ক্ষেত্রে ছোট-বড় সকল বিষয়ে ‘বিভ্রান্ত’ মতের নিন্দার পাশাপাশি সে মতের অনুসারীকে বিভিন্ন অজুহাতে কাফির বা ইসলামের শত্রু বলে প্রমাণ এবং তার প্রতি শত্রুতা ও বিদ্বেষ প্রচারের প্রবণতা লক্ষণীয়। এর চেয়েও প্রকট ফিকহী বিষয়ক মতভেদকে নানাবিধ অজুহাতে আকীদার মধ্যে নিয়ে যাওয়া এবং ফিকহী ভিন্নমত খ-নের পাশাপাশি ভিন্ন মতের অনুসারীর প্রতি অবজ্ঞা, বিদ্বেষ, বিমুক্তি, বিচ্ছিন্নতা বা ‘ভিন্নদল’ চেতনা লালন ও প্রচার করা।
ঘ. দাওয়াত পদ্ধতির মতভেদ
সমকালীন বিভক্তির অন্যতম একটি কারণ পদ্ধতিগত ভিন্নতা। বিশেষত ইসলাম প্রচার ও প্রসারে সমকালীন মুসলিমগণ রাজনীতি, লেখনি, ময়দানী দাওয়াত, শিক্ষাবিস্তার, বিভিন্ন পদ্ধতির শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন ইত্যাদি পদ্ধতির অনুসরণ করছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রত্যেক পদ্ধতির অনুসারী নিজের পদ্ধতিকেই দীন প্রচার বা প্রতিষ্ঠার একমাত্র নির্ভুল পদ্ধতি বলে বিশ্বাস করছেন এবং অন্যান্য পদ্ধতির অনুসারীদের বিভ্রান্ত বা ভিন্নদল বলে ‘বিশ্বাস’ করছেন। নিজ পদ্ধতির অনুসারীদের প্রতি ‘ইসলামী ভ্রাতৃত্ব’ অনুভব করছেন এবং অন্যান্য পদ্ধতির অনুসারীদের প্রতি এ ভ্রাতৃত্ব অনুভব করছেন না। উপরন্তু অবজ্ঞা বা বিদ্বেষভাব অনুভব, লালন ও প্রচার করছেন।
ঙ. সমালোচনায় ইসলামী আদব লঙ্ঘন
আমরা দেখেছি যে, মতভেদ থেকে বিভক্তির আগমন ঘটে। আর এক্ষেত্রে ভিন্নমত খ-ন বা ভিন্নমতের সমালোচনার অজুহাতে ভিন্নমতের অনুসারীদের প্রতি ব্যক্তিগত বা দলগত আক্রমন বা তাদের ‘ধার্মিকতা’, ‘তাকওয়া’ বা ‘ইখলাসের’ প্রতি কটাক্ষ বিভক্তিকে তরান্বিত ও প্রকট করে। আমরা জানি, কুরআন-হাদীসে আহলে কিতাবদের সাথে বিতর্কের ক্ষেত্রে ‘উত্তম’ আচরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মুমিনদেরকে পরস্পর কটাক্ষ, উপহাস, টিপ্পনি, খারাপ উপাধি ব্যবহার ইত্যাদি থেকে নিষেধ করা হয়েছে। ধারণা বা সন্দেহ নির্ভর সিদ্ধান্ত বা বক্তব্য থেকে নিষেধ করা হয়েছে। তবে সাধারণভাবে মুসলিম আলিম, গবেষক ও প্রচারকগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ নির্দেশগুলো মানছেন না।
সমালোচনার ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, তা হলো বিশ্বাস বা কর্মের বিধান এবং উক্ত বিশ্বাস বা কর্মে লিপ্ত মুমিনের বিধানের মধ্যে পার্থক্য না করা। আমাদের বক্তব্য অনেকটা নিম্নরূপ: (১) অমুক কর্মটি বিদআত, শিরক, হারাম বা হাদীসের বিপরীত, (২) শিরক, বিদআত, হারাম বা হাদীস অস্বীকারের শাস্তি জাহান্নাম, (৩) অমুক ব্যক্তির মধ্যে উক্ত বিশ্বাস বা কর্ম বিদ্যমান, (৪) কাজেই উক্ত ব্যক্তি তার সকল অনুসারী বা সমমনা ব্যক্তি বিদআতী, মুশরিক বা জাহান্নামী। সুন্নাতে নববী, সুন্নাতে সাহাবা ও সালফ সালিহীনের কর্মপদ্ধতির আলোকে আমরা জানি যে, প্রথম তিনটি বিষয় সঠিক হলেও চতুর্থ বিষয়টি ঢালাওভাবে বলা যায় না। ব্যক্তি মুমিনের ওজর, তাবিল, ব্যাখ্যা, ইজতিহাদ, অন্যান্য কর্ম ইত্যাদির আলোকে তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ভিন্নমতের সমালোচনায় প্রকাশ্য বা প্রচ্ছন্ন তাকফীর লক্ষণীয়। আকীদা, ফিকহ, ইজতিহাদ পদ্ধতি, দাওয়াহ-পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে ভিন্নমতের মানুষদেরকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কাফির বলে দাবি করা হচ্ছে। প্রচ্ছন্ন ‘তাকফীর’-এর মধ্যে রয়েছে ইসলামের দুশমন, সুন্নাতের দুশমন, ইসলামের দুশমনদের দালাল, কাফিরদের মতই, কাফিরের চেয়েও খারাপ ইত্যাদি বলে আখ্যায়িত করা।
চ. ঈমানী ভ্রাতৃত্বের অবমূল্যায়ন
কুরআন ও হাদীসে মুমিনদেরকে পরস্পর ভাই বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন: (إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ) “মু’মিনগণ পরস্পর ভাই ভিন্ন কিছুই নয়।” (সূরা হুজুরাত, ১০ আয়াত)। আল্লাহ আরো বলেন: (وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ) “এবং মুমিন পুরুষগণ ও মুমিন নারীগণ পরস্পর পরস্পরের অভিভাব বা বন্ধু।” (সূরা তাওবা ৭১ আয়াত)
এখানে মহান আল্লাহ ‘মুসলিম’ না বলে ‘মুমিন’ বলেছেন। উভয় শব্দ সমার্থক হলেও ঈমানের মধ্যে বিশ্বাসের দিকটি এবং ইসলামের মধ্যে কর্ম ও দীন পালনের দিকটি অধিক জোরদার। এথেকে জানা যায় যে, যতক্ষণ কোনো ব্যক্তি ঈমানের সাক্ষ্য দিচ্ছেন এবং সন্দেহাতীত কুফর-শিরকে লিপ্ত হচ্ছেন না ততক্ষণ তিনি অন্য মুমিনের “দীনী ভাই” বলে গণ্য। কুরআনে রক্ত সম্পর্কের ভ্রাতৃত্বের চেয়ে “ঈমানী ভ্রাতৃত্ব”-কে অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। কুরআনে “ভাই” শব্দটির ব্যবহারের ব্যাপকতা লক্ষণীয়। হত্যাকারীকে নিহতের পরিজনের “ভাই” বলা হয়েছে। (সূরা বাকারা: ১৭৮ আয়াত) দুটি মুমিন গোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধ চলা অবস্থাতেও তাদেরকে “ভাই” বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। (সূরা হুজুরাত: ৯-১০ আয়াত) অর্থাৎ মানবীয় দুর্বলতার শিকার হয়ে একজন মুমিন অন্য মুমিনকে খুন করে ফেলার সম্ভাবনা অস্বীকার করা যায় না। দুজন মুমিনের পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনাও অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু এ কারণে তাদের কেউ কাফির হন না বা চিরশত্র“তে পরিণত হন না। ঈমান ও ঈমানী ভ্রাতৃত্ব বহাল থাকে।
উম্মাতের বিভক্তির অন্যতম কারণ বিভিন্ন অজুহাতে ঈমানের গুরুত্ব অবমূল্যায়ন করা। মুমিনের ঈমানকে স্বীকার করার পাশাপাশি তার বড় বা ছোট পাপ ও বিভ্রান্তির কারণে তার প্রতি শত্রুতা বা বিদ্বেষভাব পোষণ করা বা তার থেকে নিজেকে বিমুক্ত, বিচ্ছিন্ন বা ভিন্ন দলের বলে মনে করা ঈমানের অবমূল্যায়ন ছাড়া কিছুই নয়। আর ভিন্ন মতের কারণে মুমিনের ঈমান, সালাত, সিয়াম ও অন্যান্য সকল ইবাদতকে অবমূল্যায়ন করে তার বিরুদ্ধে অবজ্ঞা, বিদ্বেষ বা শত্রুতা পোষণ বা প্রচার করা আরো অধিক অন্যায়।
ছ. ভিন্নমতের প্রান্তিকদের অজুহাতে নিজের প্রান্তিকতার বৈধতার দাবি
বহুধা বিভক্ত উম্মাতের প্রত্যেক ধারার মধ্যেই প্রান্তিকতা বিদ্যমান। যখনই কোনো ধারার অনুসারীদের অন্য ধারার অনুসারীদের প্রতি প্রশস্ত ও সহনশীল হওয়ার জন্য কুরআন, সুন্নাহ বা সালফ সালিহীনের কর্মধারার উল্লেখ করা হয় তখনই তারা ভিন্ন ধারার প্রান্তিক কিছু বক্তব্য উল্লেখ করে তাদের নিজেদের প্রান্তিকতার বৈধতা প্রমাণের চেষ্টা করেন, যদিও সাধারণভাবে আমরা জানি যে, কোনো একটি অন্যায়ের অজুহাতে আরেকটি অন্যায়ের বৈধতা দাবি করা যায় না।
জ. সবাইকে একমতে আনার চেষ্টা
বিভক্তির একটি কারণ ঐক্যের নামে মতভেদ দূর করার চেষ্টা। এতে একটি অসম্ভব কর্মে লিপ্ত হয়ে আমরা একটি সম্ভব কর্মকে অসম্ভব করে তুলি। মতভেদ বা মতের ভিন্নতা দূর করা একটি অসম্ভব বিষয়। এটি ইসলামের নির্দেশও নয়। আমরা দেখেছি যে, ঐক্যের অর্থ একমত হওয়া নয়। ঐক্য অর্থ হৃদয়ের প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ। আর বিভক্তি অর্থ মতের ভিন্নতা নয়; হৃদয়ের শত্রুতা, দূরত্ব বা হিংসা-বিদ্বেষ। প্রথমটি দূর করা সম্ভব নয় এবং কাম্যও নয়। দ্বিতীয়টি দূর করা বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ঐক্যের নামে সবাইকে একমতে বা ‘একদলে’ আনার চেষ্টার মাধ্যমে নতুন একটি মত বা দলের উদ্ভব ছাড়া বিশেষ কোনো লাভ হয় না।
৬. শরীয়াহ অনুসারী বনাম শরীয়াহ বিমুখদের বিভক্তির তুলনা
ইসলামের প্রথম যুগগুলোতে বিদআতে লিপ্ত, বিশেষত আকীদাগত বিদআতে লিপ্ত মানুষেরা সবচেয়ে বেশি বিভক্তিতে লিপ্ত ছিলেন। এজন্য আলিমগণ তাদেরকে ‘আহলুল বিদআতি ওয়াল ইফতিরাক’ অর্থাৎ বিদআত ও বিভক্তির অনুসারী বলে আখ্যায়িত করতেন। এরা ‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত’-কে তো কাফির বা বিভ্রান্ত বলতেনই, উপরন্তু নিজ নিজ দলের ভিন্ন মতের মানুষদেরও কাফির বা বিভ্রান্ত বলে বিশ্বাস ও প্রচার করতেন। বর্তমান সময়ে আমরা এর বিপরীত চিত্র দেখতে পাই। সুস্পষ্ট বিদআত ও শিরকে লিপ্ত মানুষেরা একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার, মন্দকথন বা ফাতওয়াবাজি করছেন না। প্রত্যেকেই দাবি করছেন যে, বিশ্বে একজনই গাওসে আযম, মুজাদ্দিদে যামান, কুতুবে যামান, বা ইমামে যামান আছেন এবং তাদের গুরুই সেই ব্যক্তি। কিন্তু সমাজে বিদ্যমান অন্যান্য শতশত গাওসে আযম, মুজাদ্দিদ, কুতুব, ইমাম ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বা প্রচ্ছন্নভাবে কিছুই বলছেন না। প্রত্যেক দলই দাবি করছেন যে, তাদের জীবিত বা কবরস্থ গুরুর হাতেই আল্লাহর সকল ভা-ার রয়েছে, তবে কেউ অন্যের বিরুদ্ধে বলছেন না। এদের অনেকেই সুস্পষ্টভাবে সকল ধর্মের অনুসারীদের মুক্তির দাবি করছেন এবং ইসলামী শরীয়াহ পালনকে অপ্রয়োনীয় বলছেন। অন্য অনেকে ইসলামী শরীয়াহ পালনের গুরত্বের কথ মুখে বললেও কার্যত একে কোনো গুরুত্ব দিচ্ছেন না। প্রকাশ্য কুফর, শিরক, অশ্লীলতা, অনাচার, পাপাচার, শরীয়াহ-লঙ্ঘন ইত্যাদির বিরুদ্ধে কিছুই বলেন না। তারা সকলেই একযোগে তাওহীদ, সুন্নাহ ও শরীয়াত অনুসারীদের বিরুদ্ধে কথা বলেন।
বিপরীতে আমরা দেখছি যে, তাওহীদ, সুন্নাত ও শরীয়াতে ইসলামীর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের আবশ্যকতায় বিশ্বাসী মানুষেরা উৎকটভাবে পরস্পরের বিরুদ্ধে অবজ্ঞা, বিদ্বেষ বা শত্রুতা প্রকাশ ও প্রচার করছেন। কিছু দিন আগেও তাওহীদ ও সুন্নাতের গুরুত্বে বিশ্বসীগণ বিদআত ও শিরকের প্রচারকদের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। এখন সুস্পষ্ট শিরক, বিদআত ও কুফরের বিরুদ্ধে কথা অনেক কমে গিয়েছে। তবে অস্পষ্ট বা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ শিরক, কুফর ও বিদআতের বিরুদ্ধে কথাবার্তা অনেক বেড়েছে।
৭. আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত বনাম আহলুল বিদআত ওয়াল ইফতিরাক
সমকালীন বিভক্তির ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, এ বিভক্তি ‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত’ অনুসরণের দাবিদারদের মধ্যে। এক্ষেত্রে সাহাবী, তাবিয়ী ও পূর্ববর্তী ‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের’ ইমামগণের সাথে সমকালীন ‘আহলুস সুন্নাত ওয়ার জামাআতের’ অনুসারীদের পার্থক্য খুবই লক্ষণীয়। সাহাবী-তাবিয়ী বা সালাফ সালিহীন বিভ্রান্তদের শিরক, কুফর বা বিভ্রান্তি প্রকাশ করতেন। তবে ঈমানের দাবিদারের এ সকল কর্মের কারণে তার থেকে বিচ্ছিন্নতা, তার প্রতি শত্রুতা বা তাকে কাফির বলার প্রবণতা পরিহার করতেন। ঈমানের দাবিদারের প্রায় সুস্পষ্ট কুফরী কথার একটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য তারা ওজর খুঁজতেন। অজ্ঞতা, ব্যাখ্যা, ইজতিহাদ ইত্যাদি ওজর থাকার সম্ভাবনা মেনে নিয়ে কুফরী মত বা বক্তব্যের প্রবক্তাকে কাফির বলা থেকে বিরত থাকতেন। এটিই মূলত ‘জামাআত’ বা ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি। জামাআত বা ঐক্যবদ্ধতার অর্থ মুসলিমের অন্যায়কে ন্যায় বলা, অন্যায়কে মেনে নেয়া বা প্রশ্রয় দেয়া নয়। আমাদের ধারণায় জামাআত, ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি বিষয়ে সালাফ সালিহীনের পদ্ধতি হলো, প্রত্যেকেই নিজ ইজতিহাদ অনুসারে অন্যায়কে অন্যায় বলবেন, তবে সে অন্যায়ে লিপ্ত মুমিনের ঈমানের দাবির প্রতি শ্রদ্ধাবোধের কারণে তার প্রতি ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির অনুভূতি বহাল রাখবেন এবং তার ওজর খুঁজবেন। আলোচনা, সমালোচনা, প্রতিবাদ বা খ-ন সকল ক্ষেত্রে এ ভ্রাতৃত্ববোধ, শ্রদ্ধাবোধ ও সম্প্রীতিকে কার্যকর রাখবেন এবং ঈমানী আদব বজায় রাখবেন।
তাদের বিপরীতে পূর্ববর্তী ‘আহলুল বিদআত ওয়াল ইফতিরাক’ বা বিদআত ও বিচ্ছিন্নতার অনুসারীগণ ঈমানের দাবিদারের মতভেদীয় বক্তব্যকে বিভিন্ন ব্যাখ্যার মাধ্যমে কুফরী বলে প্রমাণ করে তার থেকে বিমুক্তি, বিচ্ছিন্নতা, বিদ্বেষ ও শত্রুতা পোষণ ও প্রচার করতেন। ব্যক্তির কারণে তার সাথে সম্পৃক্ত সকলকেই তারা এভাবে কাফির, শত্রু বা ‘ভিন্নদল’ বলে গণ্য করতেন। বর্তমানে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত অনুসরণের দাবিদারগণ অন্তত এ বিষয়ে আহলুল বিদআত ওয়াল ইফতিরাকের কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করছেন। তারা সকলেই আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনুসারী হওয়ার দাবি করছেন এবং প্রায় সকলেই অন্য সকল দল বা মতের অনুসারীদের থেকে বিমুক্তির বা বিচ্ছিন্নতার ঘোষণা দিচ্ছেন। প্রত্যেকেই অন্য সকলকে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বহির্ভুত, বিভ্রান্ত, কাফির বা কাফির পর্যায়ের বলে প্রমাণে সচেষ্ট। নফলকে ফরজের গুরুত্ব দিচ্ছেন, ফিকহকে আকীদায় নিয়ে যাচ্ছেন, আকীদার সাধারণ বিষয়কে ঈমান-কুফরের মানদ- বানাচ্ছেন, একজনের একটি ভুল, অন্যায় বা প্রান্তিক কথাকে দলিল করে সকলকেই ঢালাওভাবে কাফির, কাফির-সমতুল্য বা বিভ্রান্ত বলে গণ্য করছেন।
আমাদের কাছে মনে হয়, সাহাবী-তাবিয়ীগণ ও প্রাচীন আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের দৃষ্টিভঙ্গিতে ‘জামাআত’ হলো ‘জামি’ অর্থাৎ অন্তর্ভূক্তিমূলক বা ‘ইনক্লুসিভ’, অর্থাৎ সবাইকে অন্তর্ভুক্ত বা জমা করার প্রচেষ্টা। তাঁদের দৃষ্টিতে সকল মুসলমানই আল্লাহর দল ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অর্ন্তভুক্ত, শুধু যারা সুস্পষ্টভাবে সুন্নাত বা জামাআতকে অস্বীকার করেছেন তাদের কথা ভিন্ন। এর বিপরীতে সমকালীন আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের চেতনাটি বহিস্কারমূলক বা ‘এক্সক্লুসিভ’, অর্থাৎ সবাইকে বের করে দেওয়ার প্রচেষ্টা। প্রত্যেকেরই দাবি, সকলেই বিভ্রান্ত, শুধু যারা আমাদের সকল মত, ইজতিহাদ, ব্যাখ্যা ও দাবি নির্বিচারের পরিপূর্ণভাবে মেনে নিয়েছেন তারাই ‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত’।
৮. বিভক্তির পরিণতি: বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ ধারণা
বাংলাদেশে মুসলিমগণের বিভক্তির অবস্থা পর্যালোচনা করলে নিম্নের বিষয়গুলো দেখা যায়:
(ক) শিরক-কুফর ও খৃস্টধর্ম প্রচারের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি
আমরা দেখিছ যে, তাওহীদ, সুন্নাহ ও শরীয়াহ পালনের গুরুত্বে বিশ্বাসীগণের মধ্যে বিভক্তি প্রকটতর। এতে একদিকে শিরক, কুফর ও বিদআতের প্রচারকদের জন্য ময়দান খুবই নিরাপদ হয়েছে। শিয়া, কাদিয়ানী, বাহাঈ ইত্যাদি ধর্মের বা মতের অনুসারীরা তাদের দাওয়াতী কর্মকা- ব্যাপকভাবে এবং অনেকটা নির্বিবাদেই চালাতে পারছেন। সর্বোপরি খৃস্টান মিশনারিগণ হাজার হাজার মুসলিমকে খৃস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করছেন। দীন প্রেমিক মুসলিমগণ পরস্পরের মত খ-ন, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে ব্যস্ত থাকার কারণে এ সকল বিষয় তাদের নজর এড়িয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় নজরে আসলেও গুরুত্ব দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এমনকি অনেক সময় তারা এ সকল বিষয়ে গুরুত্ব আরোপের বিরোধিতা করছেন। কেউ বলছেন, অমুক মতের অনুসারী মূলতই কাফির, কাজেই তারা কাদিয়ানী, বাহাঈ, শিয়া বা খৃস্টান হলেই কি আর না হলেই কি! কেউ বলছেন, অমুক মতের অনুসারীরা তো মুসলিম নামের কলঙ্ক, তাদের কাদিয়ান বা খৃস্টান হয়ে যাওয়াই ভাল। হয় আমাদের মতে এসে সঠিক ইসলাম অনুসরণ করুক অথবা খৃস্টান হয়ে ইসলামের কলঙ্ক দূর করুক!
কেউ বলেন, খৃস্টান হচ্ছে হোক, পরে ওদেরকে সামাজিক প্রতিরোধের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা যাবে, এখন অমুক মত বা দল ঠেকাও!! যারা খৃস্টান হচ্ছে তারা আবার পরে আমাদের আখলাক দেখে মুসলিম হয়ে যাবে, যেভাবে হুদাইবিয়ার সন্ধির পরে কাফিররা সাহাবীগণের আখলাক দেখে মুসলিম হয়ে গিয়েছিলেন! কাজেই কাদিয়ানী, বাহাঈ বা খৃস্টান ধর্মান্তর নিয়ে এখন চিন্তা করার কোনো দরকার নেই, এখন বাতিলদেরকে ঠেকাও!! কেউ বলছেন, এগুলো নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই, অমুক বা তমুক পদ্ধতিতে দীনের প্রচার বা প্রতিষ্ঠার কাজ চালিয়ে যান, এক সময় সব ঠিক হয়ে যাবে!!!
(খ) আলিমগণ সম্পর্কে ব্যাপক কুৎসাচার
সমকালীন বিভক্তির অন্যতম দিক আলিম ও দাঈগণের বিষয়ে ব্যাপক কুৎসাচার। বিশেষত প্রযুক্তির কারণে সকলের কথা একই স্থানে ইন্টারনেটে বা টিভির পর্দায় পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের সমাজের কমবেশি ১৫/২০% মানুষ দীন পালন করেন এবং কোনো না কোনো ইসলামী ‘ধারার’ অনুসরণ করেন। বাকি প্রায় ৮০/৮৫% মুসলিম দীন পালনে অবহেলা করেন এবং কোনো ধারারই অনুসরণ করেন না। এদের অধিকাংশই দীন ও আলিমদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তারা ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা সামাজিক বিভিন্ন সমস্যায় আলিমদের পরামর্শ নেওয়ার চেষ্টা করেন। বর্তমানে এরূপ কোনো ব্যক্তি যদি ঈমানী, আমলী বা দীনী কোনো সমস্যায় সমাধানানের জন্য গ্রহণযোগ্য আলিম অনুসন্ধানের জন্য ইন্টারনেটে প্রবেশ করেন তবে তিনি দেখবেন যে, প্রসিদ্ধ প্রত্যেক আলিম ও দাঈর বিষয়েই ব্যাপক কুৎসা বা নিন্দাচার বিদ্যমান এবং প্রত্যেককেই ভিন্নমতের আলিম বা দাঈদেরকে ইসলামের দুশমন বা ইহূদী-নাসারাদের দালাল বলে চিত্রিত করেছেন। এতে প্রত্যেক দলের অনুসারী পরিতৃপ্ত বা আনন্দিত হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মুসলিমগণ এবং বিশেষত তরুণগণ খুবই সমস্যায় পড়ছেন। সমাজের আলিমগণ সকলেই খারাপ, কিছু বুঝেন না ইত্যাদি চিন্তা তরুণদেরকে সমাজবিচ্ছিন্ন ও আলিমগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করছে। এছাড়া শিয়া, বাহাঈ, কাদিয়ানী, খৃস্টান, আহলে-কুরআন ও অন্যান্য ধর্মের বা মতের প্রচারকগণ কুরআন-হাদীসের নামে এদেরকে সহজেই গ্রাস করতে পারছেন। তারা কুরআনের কিছু আয়াত অথবা বুখারী, মুসলিম বা অন্য কোনো সহীহ নামে প্রসিদ্ধ গ্রন্থের কয়েকটি হাদীস নিয়ে এসে বলছেন: (১) কুরআন-হাদীস মানতে হবে, (২) সমাজের আলিম ও ইমামগণ অযোগ্য, অসৎ ও অজ্ঞ, কাজেই আমাদের এ মতের বিষয়ে তাদের কাছে প্রশ্ন করে বা সমাধান চেয়ে লাভ নেই, (৩) আমরা কুরআন-হাদীস দেখাচ্ছি, কাজেই আমাদের মতে চলে এস…।
(গ) হানাহানি ও রক্তারক্তি
ভিন্নমত খ-নের নামে ভিন্নমত অনুসারীদের প্রতি শত্রুতা, বিদ্বেষ বা বিচ্ছিন্নতা পোষণ ও প্রচারের কারণে প্রত্যেক মতের অনুসারীদের মধ্যেও উত্তেজনা বাড়ছে। কোনো কোনো এলাকায় ইতোমধ্যেই মুসাল্লীদের মারামারির সংবাদ আমরা জেনেছি। কোথাও কোথাও সালাত পদ্ধতির মতপার্থক্যকে কেন্দ্র করে নামাযী মুসলিমগণ মারামারি করে কেউ কেউ ‘শহীদ’ (!!!) হয়েছেন বলেও আমরা জেনেছি। রাশ না টানলে কয়েক বছরের মধ্যে পুলিশ প্রহরা ছাড়া এদেশের মসজিদের সালাত আদায় অসম্ভব হয়ে যাবে বলেই মনে হয়।
৯. সমস্যার সমাধানে আমাদের করণীয়
উপরে আলোচিত বিভক্তি সমস্যা কি না সে বিষয়েও মতভেদ রয়েছে। অনেকেই এগুলোকে সমস্যা মনে করছেন না। তারা দাবি করছেন যে, তাদের নিজের পদ্ধতিতে কর্ম অব্যাহত রাখলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। অথবা সহীহ এবং হক কথা বলায় যদি বিভক্তি বা হানাহানি হয় তবে কিছু করার নেই। কারো অন্যায় প্রতিক্রিয়ার কারণে হক্ক কথা বলা বা হক্ক কাজ করা বন্ধ করা সম্ভব নয়। অনেকেই ভিন্ন মতের প্রান্তিকতাকেই দায়ী করছেন এবং নিজেদের প্রান্তিকতাকে এ অজুহাতে সঠিক বা প্রয়োজনীয় বলে দাবী করছেন। অনেকেই ভাবছেন, আমরা তো ঐক্যই চাই, আর তা হতে হবে ‘হক্ক’-এর ভিত্তিতে। আমরা যা বলছি, তাই একমাত্র হক্ক। সকলেই যখন এ ‘একমাত্র’ হক্ক মেনে নিবেন তখন তো ঐক্য হয়ে যাবেই।
বিপরীতে অনেকেই বিভক্তির এ অবস্থাকে সমস্যা বলে মনে করছেন এবং এ অবস্থা দূরীকরণে সচেষ্ট হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন। আমরা বলেছি যে, এ সমস্যা বিষয়ে সচেতন অনেকে বিভক্তি দূর করার লক্ষ্যে মতভেদ দূর করার বা সকলকে এক দলে বা এক মঞ্চে একত্রিত করার চেষ্টা করছেন।
উপরে বিভক্তির কারণ পর্যালোচনায় আমরা বিভক্তি দূরীকরণের উপায় সম্পর্কেও ধারণা প্রদানের চেষ্টা করেছি। মূলত বিভক্তির কারণগুলো দূর করলে বা কমিয়ে ফেললে বিভক্তিও কমবে বলে আমরা ধারণা করতে পারি। এ সকল কারণ দূরীকরণের জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলিম ও দাঈগণের পারস্পারিক সাক্ষাত ও সালাম বিনিময় এবং সম্ভব হলে মত বিনিময়।
আমরা দেখেছি, ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির জন্য এবং শত্রুতা ও বিদ্বেষ থেকে মুক্তি অর্জনের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) পারস্পরিক সালাম প্রসার করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এজন্য আলিমগণের পারস্পরিক সাক্ষাত ও সালাম বিনিময় উম্মাতের জন্য একটি বড় উপকারী বিষয়। আমরা জানি, সকল মতের অনুসারীদের মধ্যেই কিছু মানুষ প্রান্তিকতাকেই ভালবাসেন। কেউ তার সাথে শতভাগ একমত বা তার মতের শতভাগ অনুসারী না হলেই তাকে অপছন্দ করেন। এর পাশাপাশি সকল মতের অনুসারীদের মধ্যেই উদার ও সহনশীল আলিম ও দাঈ বিদ্যমান। তারা কুরআন ও সুন্নাহ নির্দেশিত জামাআত অর্থাৎ ঐক্যবদ্ধতা, সম্প্রীতি, ভালবাসা, ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান। তারা তার্ফারুক অর্থাৎ বিভক্তি, বিচ্ছিন্নতা, বিদ্বেষ, হিংসা, শত্রুভাবাপন্নতা দূর করতে চান। তাদের সকলেরই দায়িত্ব এরূপ মাজলিস বা সাক্ষাতের জন্য চেষ্টা করা। শুধু সাক্ষাত ও সালাম বিনিময়ের কল্যাণ অনেক। পাশাপাশি যদি নিয়মিত বা অনিয়মিত এরূপ সাক্ষাতে কিছু মত বিনিময়ের ব্যবস্থা থাকে তবে তা থেকে আরো অনেক কল্যাণ বেরিয়ে আসবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
মহান আল্লাহই ভাল জানেন। আমরা আমাদের ভুলভ্রান্তি থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। সালাত ও সালাম মুহাম্মাদ (সা.), তাঁর পরিজন-অনুসারী ও সহচরদের জন্য। প্রথমে ও শেষে সর্বদা ও সর্বত্র প্রশংসা আল্লাহর নিমিত্ত।
১. জামাআত: কুরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত অন্যতম ইবাদত
ঐক্য বুঝাতে আরবীতে ‘ওয়াহদাহ’, ইত্তিহাদ, তাওহীদ ইত্যাদি শব্দ বহুল প্রচলিত। তবে এ অর্থে কুরআন ও হাদীসে ‘জামা‘আত’, জামী’ বা অনুরূপ ব্যবহার করা হয়েছে। আরবী (جمع) ‘জামঅ’ শব্দটির অর্থ একত্রিত করা। ‘একত্রিত’ অর্থেও ‘জাম্অ’, জামীঅ, মাজমু’ বা জামাআত শব্দ ব্যবহৃত হয়। (ইবন মানযূর, লিসানুল আরব, জামঅ শব্দ)। আভিধানিক ব্যবহারে অল্প বা বেশি যে কোনো সংখ্যক মানুষ বা বস্তুর একত্রিত অবস্থাকে জামাআত বলা যায়। কুরআন ও সুন্নাহর ব্যবহারে মুসলিমগনের একত্রিত বা ঐক্যের অবস্থাকে জামাআত বলা হয়েছে। বর্তমানে ‘জামাআত’ শব্দটি ঐক্যের চেয়ে অনৈক্যের অর্থেই বেশি ব্যবহার করা হয়। আমরা দেখি যে, জামাআত শব্দটি বর্তমানে ‘দল’, গ্রুপ বা ফিরকা অর্থে ব্যবহার করা হয়। কুরআন কারীমে ‘জামঅ’ শব্দটিকে ফিরকা, দল বা গ্রুপের বিপরীতে একত্রিত বা ঐক্যবদ্ধতার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন:
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا وَاذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنْتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنْتُمْ عَلَى شَفَا حُفْرَةٍ مِنَ النَّارِ فَأَنْقَذَكُمْ مِنْهَا
“তোমরা আল্লাহ্র রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর ঐক্যবদ্ধভাবে এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহ্র অনুগ্রহ স্মরণ কর: তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন, ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে। তোমরা অগ্নিকুন্ডের প্রান্তে ছিলে, আল্লাহ্ তা থেকে তোমাদেরকে রক্ষা করেছেন। (আল-ইমরান: ১০৩)
এ আয়াত থেকে আমরা দেখি যে, ‘জামঅ’ (ঐক্যবদ্ধতা) শব্দকে ‘তার্ফারুক’ (বিভক্তি বা দলাদলি)-র বিপরীতে ব্যবহার করা হয়েছে। এ থেকে জানা যায় যে, বিভক্তিমুক্ত ঐক্যের অবস্থাই জামাআত। এ আয়াত থেকে আরো জানা যায় যে, জামাআত বা ঐক্যের অবস্থাই উখুওয়াত বা ভ্রাতৃত্ব এবং পরস্পর সম্প্রীতির অবস্থা এবং ‘পরস্পর শত্রুতা’-র অবস্থাই তার্ফারুক বা দলাদলির অবস্থা। আরো জানা যায় যে, শত্রুতা ও দলাদলি জাহান্নামের প্রান্তে নিয়ে যায় এবং ঐক্য, পারস্পরিক ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্ব তা থেকে রক্ষা করে।
বিভিন্ন হাদীসে মুসলিম উম্মাহকে জামাআতের মধ্যে থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কখনো জামাআত বলতে রাষ্ট্রীয় ঐক্যবদ্ধতা এবং কখনো উম্মাহর সাধারণ ঐক্যবদ্ধতা বুঝানো হয়েছে। ইবনু আব্বাস (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
مَنْ رَأَى مِنْ أَمِيرِهِ شَيْئًا يَكْرَهُهُ فَلْيَصْبِرْ عَلَيْهِ فَإِنَّهُ مَنْ فَارَقَ الْجَمَاعَةَ شِبْرًا فَمَاتَ (لَيْسَ أَحَدٌ يُفَارِقُ الْجَمَاعَةَ شِبْرًا فَيَمُوتُ) إِلا مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً
“কেউ তার শাসক বা প্রশাসক থেকে কোন অপছন্দনীয় বিষয় দেখলে তাকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। কারণ যদি কেউ জামা‘আতের (সমাজ বা রাষ্টের ঐক্যের) বাইরে এক বিঘতও বের হয়ে যায় এবং এ অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে, তাহলে সে জাহিলী মৃত্যু বরণ করল।” (বুখারী ও মুসলিম)
এ হাদীসে আমরা দেখছি যে, ‘জামাআত’-এর বিপরীতে মুফারাকাত বা বিচ্ছিন্নতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং জামাআত ও বিচ্ছিন্নতার ভিত্তি হিসেবে শাসক-প্রশাসককে উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে জানা যায় যে, মুসলিম সমাজের রাষ্ট্রীয় ঐক্যবদ্ধতা সংরক্ষণের স্বার্থে শাসক-প্রশাসকের অপছন্দনীয় কাজের বিষয়ে ধৈর্য ধারণ করে হলেও রাষ্ট্রীয় ঐক্য রক্ষা করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই ঐক্য বিনষ্ট করে বিচ্ছিন্নতার পথে যাওয়া যাবে না। অন্য হাদীসে আবু হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
مَنْ خَرَجَ مِنْ الطَّاعَةِ وَفَارَقَ الْجَمَاعَةَ فَمَاتَ مَاتَ مِيتَةً جَاهِلِيَّةً
“যে ব্যক্তি ‘তা‘আত’ অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় আনুগত্য থেকে বের হয়ে এবং জামা‘আত, অর্থাৎ ঐক্যবদ্ধ বা বৃহত্তর সমাজ ও জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মৃত্যু বরণ করল সে জাহিলী মৃত্যু বরণ করল।” (মুসলিম)
এ হাদীসেও ঐক্যের জন্য রাষ্ট্রীয় আনুগত্যের কথা বলা হয়েছে। আরফাজা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
إِنَّهُ سَتَكُونُ هَنَاتٌ وَهَنَاتٌ فَمَنْ أَرَادَ أَنْ يُفَرِّقَ أَمْرَ هَذِهِ الأُمَّةِ وَهِيَ جَمِيعٌ فَاضْرِبُوهُ بِالسَّيْفِ كَائِنًا مَنْ كَانَ (مَنْ أَتَاكُمْ وَأَمْرُكُمْ جَمِيعٌ عَلَى رَجُلٍ وَاحِدٍ يُرِيدُ أَنْ يَشُقَّ عَصَاكُمْ أَوْ يُفَرِّقَ جَمَاعَتَكُمْ فَاقْتُلُوهُ)
“ভবিষ্যতে অনেক বিচ্যুতি-অন্যায় সংঘটিত হবে। যদি এমন ঘটে যে, এ উম্মাতের ঐক্যবদ্ধ থাকা অবস্থায় কেউ এসে সে ঐক্য বিনষ্ট করে বিভক্তি সৃষ্টি করতে চায় তবে সে যেই হোক না কেন তোমরা তাকে তরবারী দিয়ে আঘাত করবে। অন্য বর্ণনায়: তোমাদের বিষয়টি একব্যক্তির বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকা অবস্থায় কোনো ব্যক্তি যদি এসে তোমাদের ঐক্য বিনষ্ট করতে বা ‘জামাআত’ বিভক্ত করতে চায় তবে তাকে হত্যা করবে।” (মুসলিম)
নাসায়ীর বর্ণনায়:
فَمَنْ رَأَيْتُمُوهُ فَارَقَ الْجَمَاعَةَ أَوْ يُرِيدُ يُفَرِّقُ أَمْرَ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَائِنًا مَنْ كَانَ فَاقْتُلُوهُ فَإِنَّ يَدَ اللَّهِ عَلَى الْجَمَاعَةِ فَإِنَّ الشَّيْطَانَ مَعَ مَنْ فَارَقَ الْجَمَاعَةَ يَرْكُضُ
“তোমরা যাকে দেখবে যে সে ঐক্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে বা মুহাম্মাদের (সা.) উম্মাতকে বিভক্ত করতে চাচ্ছে সে যেই হোক না কেন তাকে হত্যা করবে। কারণ আল্লাহর হাত ঐক্যের উপর। আর যে ঐক্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয় শয়তান তার সাথে দৌঁড়ায়।” (আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।)
হারিস আশ‘আরী (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,
أَنَا آمُرُكُمْ بِخَمْسٍ اللَّهُ أَمَرَنِي بِهِنَّ السَّمْعُ وَالطَّاعَةُ وَالْجِهَادُ وَالْهِجْرَةُ وَالْجَمَاعَةُ فَإِنَّهُ مَنْ فَارَقَ الْجَمَاعَةَ قِيدَ شِبْرٍ فَقَدْ خَلَعَ رِبْقَةَ الإِسْلامِ مِنْ عُنُقِهِ إِلا أَنْ يَرْجِعَ
“আমি তোমাদেরকে পাঁচটি বিষয়ের নির্দেশ দিচ্ছি, যেগুলির নির্দেশ আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন: শ্রবণ, আনুগত্য, জিহাদ, হিজরত ও জামা‘আত (ঐক্য); কারণ যে ব্যক্তি জামা‘আত (ঐক্য) থেকে এক বিঘত সরে গেল সে ইসলামের রজ্জু নিজের গলা থেকে খুলে ফেলল, যদি না ফিরে আসে।” (তিরমিযী। তিরমিযী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন)
অন্য হাদীসে উমার (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
عليكم بالجماعةِ، وإِيَّاكُم والفُرْقَةَ، فَإِنَّ الشيطانَ مع الواحد، وهو من الاثنين أبعدُ، مَنْ أَراد بُحْبُوحَةَ الجنة فليلزم الجماعةَ
“তোমরা জামাআত (ঐক্য) আকড়ে ধরে থাকবে এবং দলাদলি বা বিচ্ছিন্নতা থেকে সাবধান থাকবে। কারণ শয়তান একক ব্যক্তির সাথে এবং সে দু’জন থেকে অধিক দূরে। যে ব্যক্তি জান্নাতের প্রশস্ততা চায় সে জামাআত (ঐক্য) আঁকড়ে ধরুক। (তিরমিযী। তিরমিযী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।)
অন্য হাদীসে নুমান ইবন বাশীর (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: (الجماعة رحمة والفرقة عذاب) “ঐক্য রহমত এবং বিভক্তি আযাব।” (মুসনাদ আহমদ, আলবানী সাহীহুত তারগীবে হাদীসটিকে হাসান সহীহ বলেছেন।)
আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
إن الله لا يجمع أمتي … على ضلالة ويد الله على/ مع الجماعة ومن شذ شذ إلى النار
“আল্লাহ আমার উম্মাতকে বিভ্রান্তির উপর ঐক্যবদ্ধ করবেন না। আর আল্লাহর হাত ঐক্যের উপর/ সাথে এবং যে ব্যক্তি বিচ্ছিন্ন হবে সে জাহান্নামের মধ্যে বিচ্ছিন্ন হবে।” (তিরমিযী। আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন, শেষ বাক্যটি বাদে)
২. ইফতিরাক: কুরআন-সুন্নাহ নির্দেশিত নিষিদ্ধ কর্ম
উপরের আয়াত ও হাদীসগুলো থেকে আমরা দেখলাম যে, জামাআত বা ঐক্যের বিপরীতে কুরআন ও হাদীসে তাফাররুক ও ইফতিরাককে নিষিদ্ধ ও নিন্দনীয় বলা হয়েছে। ইফতিরাক, তার্ফারুক, ফারক ইত্যাদির শব্দের মূল অর্থ পার্থক্য, পৃথক, বিভক্ত বা বিচ্ছিন্ন হওয়া বা করা। আমরা আরো দেখেছি যে, তার্ফারুক, বিভক্তি বা দলাদলি মূলত পারস্পরিক শত্রুতার একটি অবস্থা। কুরআন ও হাদীসে বারবার বিভক্তি, ফিরকাবাজি বা দলাদলি থেকে সতর্ক করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন:
وَلا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ
“তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন আসার পরে বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং মতভেদ করেছে, এদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি।” (সূরা আল-ইমরান: ১০৫ আয়াত)
অন্য আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন:
وَلا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ
“এবং অন্তর্ভুক্ত হয়ো না মুশরিকদের, যারা নিজেদের দীনকে বিভক্ত করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে। প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে উৎফুল্ল।” (সূরা রূম: ৩০-৩২ আয়াত)
অন্য আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু বলেন:
إِنَّ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا لَسْتَ مِنْهُمْ فِي شَيْءٍ إِنَّمَا أَمْرُهُمْ إِلَى اللَّهِ ثُمَّ يُنَبِّئُهُمْ بِمَا كَانُوا يَفْعَلُونَ
“যারা তাদের দীনকে বিভক্ত করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের কোনো দায়িত্ব তোমার নয়; তাদের বিষয় আল্লাহর ইখতিয়ারভুক্ত। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে অবহিত করবেন।” (সূরা আন‘আম: ১৫৯ আয়াত)
অন্যত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন:
شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ
“তিনি তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন দীন, যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি নূহকে- আর যা আমি ওহী করেছি আপনাকে- এবং যার নির্দেশ দিয়েছিলাম ইবরাহীম, মূসা এবং ঈসাকে, এ বলে যে, তোমরা দীন প্রতিষ্ঠা কর এবং তাতে দলাদলি-বিচ্ছিন্নতা করো না।” (সূরা শুরা: আয়াত ১৩)
এখানে আমরা দেখছি যে, দীনের মধ্যে তার্ফারুক, বিভক্তি, বিচ্ছিন্নতা বা দলাদলি এমন একটি ভয়ঙ্কর বিষয় যে, সকল নবীকেই এ বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এখানে দীন প্রতিষ্ঠার বিপরীতে বিভক্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে প্রতীয়মান হয় যে, দীন প্রতিষ্ঠা বলতে দীনের বিষয়ে ঐক্যবদ্ধতার কথাই বলা হয়েছে। মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াকূব ফিরোযআবাদী (৮১৭ হি) তার সংকলিত “তানবীরুল মিকবাস” নামক তাফসীর গ্রন্থে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা) থেকে উদ্ধৃত করেছেন যে, তিনি বলেছেন:
أمر الله جملة الأنبياء أن أقيموا الدين: أن اتفقوا في الدين (وَلاَ تَتَفَرَّقُواْ فِيهِ) لا تختلفوا في الدين
“আল্লাহ সকল নবীকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, দীন প্রতিষ্ঠা কর: অর্থাৎ দীনের বিষয়ে ঐকমত হও ‘এবং তাতে দলাদলি করো না’ অর্থাৎ দীনের বিষয়ে মতভেদ করো না।” (ফিরোযআবাদী, তানবীরুল মিকবাস ২/৪)
ইমাম তাবারী ও অন্যান্য মুফাস্সির প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মুফাস্সির কাতাদা ইবনু দিআমাহ (১১৫ হি) থেকেও অনুরূপ তাফসীর উদ্ধৃত করেছেন। (তাবারী, জামিউল বায়ান ২১/৫১৩)। এ আয়াতের তাফসীরে আল্লামা ইবনু কাসীর বলেন:
أي: وصى الله تعالى جميع الأنبياء، عليهم السلام، بالائتلاف والجماعة، ونهاهم عن الافتراق والاختلاف.
“দীন প্রতিষ্ঠা কর এবং তাতে দলাদলি করো না: অর্থাৎ মহান আল্লাহ সকল নবীকে (আলাইহিমুস সালাম) নির্দেশ দিয়েছেন ভালবাসা ও ঐক্যের এবং নিষেধ করেছেন দলাদলি ও মতভেদ থেকে।” (তাফসীর ইবন কাসীর ৭/১৯৫)
আবূ হুরাইরা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ বলেন:
تَفَرَّقَتْ الْيَهُودُ عَلَى إِحْدَى وَسَبْعِينَ أَوْ اثْنَتَيْنِ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً وَالنَّصَارَى مِثْلَ ذَلِكَ وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِي عَلَى ثَلاثٍ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً
“ইহূদীরা ৭১ বা ৭২ দলে বিভক্ত হয়ে যায় এবং খৃস্টানগণও অনুরূপ দলে বিভক্ত হয়ে যায়। আর আমার উম্মাত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে।” (তিরমিযী, আস-সুনান ৫/২৫। তিনি বলেন: হাদীসটি হাসান সহীহ)
কুরআন ও হাদীস থেকে জানা যায় যে, সীমালঙ্ঘন ও বিদ্বেষ বিভক্তির মূল কারণ। পূর্ববর্তী উম্মাতগুলোর মতভেদ ও বিভক্তি প্রসঙ্গে কুরআন কারীমে বারবারই বলা হয়েছে যে, জ্ঞানের আগমনের পরেও তারা বাড়াবাড়ি করে বিভক্ত হয়েছে। আল্লাহ বলেন:
وَمَا تَفَرَّقُوا إِلَّا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ
“তাদের নিকট ইলম আগমনের পরে পারস্পরিক বাড়াবাড়ি করেই শুধু তারা দলাদলি করেছে।” (সূরা শূরা ১৪ আয়াত)
যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন:
دَبَّ إِلَيْكُمْ دَاءُ الْأُمَمِ قَبْلَكُمْ الْحَسَدُ وَالْبَغْضَاءُ هِيَ الْحَالِقَةُ لَا أَقُولُ تَحْلِقُ الشَّعَرَ وَلَكِنْ تَحْلِقُ الدِّينَ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَا تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ حَتَّى تُؤْمِنُوا وَلَا تُؤْمِنُوا حَتَّى تَحَابُّوا أَفَلَا أُنَبِّئُكُمْ بِمَا يُثَبِّتُ ذَاكُمْ لَكُمْ أَفْشُوا السَّلَامَ بَيْنَكُمْ
“পূর্ববর্তী উম্মাতগণের ব্যাধি তোমাদের মধ্যে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে, সে ব্যাধি হলো হিংসা ও বিদ্বেষ। বিদ্বেষ মুণ্ডনকারী। আমি বলি না যে, তা মাথার চুল মুণ্ডন করে, বরং তা দীন মুণ্ডন করে। যারা হাতে আমার জীবন তার শপথ! ঈমানদার না হলে তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না। আর তোমরা পরস্পরকে ভাল না বাসলে ঈমানদার হবে না। আমি কি তোমাদেরকে সে বিষয়ের কথা বলব না যা তোমাদের মধ্যে পারস্পারিক ভালবাসা প্রতিষ্ঠিতি করবে। তোমাদের মধ্যে সালামের প্রসার ঘটাও।” (তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৬৬৪। আলবানী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন)
উপরের আয়াত ও হাদীসগুলো থেকে আমরা তার্ফারুক বা ইফতিরাক, অর্থাৎ বিভক্তি, দলাদলি বা বিচ্ছিন্নতার ভয়াবহতা জানতে পারছি। এছাড়া আমরা আবারো দেখছি যে, পারস্পরিক বাড়াবাড়ি, সীমালঙ্ঘন, একে অপরের উপর জয়ী প্রাধান্য পাওয়ার আকাঙ্খা বা পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষই এ বিভক্তির মূল কারণ এবং পারস্পরিক ভালবাসা প্রতিষ্ঠাই তা দূরীকরণের উপায়।
৩. ইখতিলাফ থেকে ইফতিরাক
‘ইফতিরাক’ শব্দের নিকটবর্তী আরেকটি শব্দ ‘ইখতিলাফ’। ইফতিরাক অর্থ বিচ্ছিন্ন হওয়া বা দলে দলে বিভক্ত হওয়া। আর ইখতিলাফ অর্থ মতভেদ করা। ইখতিলাফ বা মতভেদ ইফতিরাক বা বিভক্তির অন্যতম কারণ, তবে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট। মতভেদ মানবীয় প্রকৃতি। দুজন মানুষ কখনোই শতভাগ একমত হতে পারেন না। স্বামী-স্ত্রী বা পিতা-পুত্র থেকে শুরু করে পরিবার বা সমাজ সর্বত্রই মতভেদ বিদ্যমান। কিন্তু সকল মতভেদ শত্রুতা, বিদ্বেষ, বিভক্তি বা দলাদলি নয়। মতভেদকারী ব্যক্তিগণ যখন নিজের মতকেই একমাত্র ‘হক্ক’ ও অন্য মতকে বাতিল মনে করেন এবং অন্যমতের অনুসারীদের ‘অন্যদল’ মনে করেন তখনই তা ইফতিরাক বা ‘বিচ্ছিন্নতা’-য় পরিণত হয়। ‘ইখতিলাফ’ ও ‘ইফতিরাক’-এর পাথ্যর্কের মধ্যে রয়েছে:
(১) ইফতিরাক বা ফিরকাবাজি ইখতিলাফ বা মতভেদের চূড়ান্ত ও নিন্দনীয় পর্যায়।
(২) সকল ইফতিরাকই ইখতিলাফ, অর্থাৎ সকল বিভক্তির মধ্যেই মতভেদ রয়েছে। কিন্তু সকল মতভেদই বিভক্তি নয়। ইখতিলাফ ছাড়া ইফতিরাকের অস্তিত্ব নেই তবে ইফতিরাক ছাড়াও ইখতিলাফ থাকতে পারে। এজন্য ইফতিরাককে ইখতিলাফ বলা যায়, তবে ইখতিলাফকে ইফতিরাক বলা যায় না।
(২) ইখতিলাফ সর্বদা ইফতিরাক বা দলাদলি সৃষ্টি করে না। সাহাবীগণের যুগ থেকে মুসলিম উম্মার ইমাম ও আলিমদের মধ্যে ‘মতভেদ’ বা ইখতিলাফ ছিল, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যে দলাদলি-বিচ্ছিন্নতা বা ইফতিরাক ছিল না।
(৩) শরীয়তের দৃিষ্টতে ইখতিলাফ বা মতভেদ নিষিদ্ধ নয়, বরং অনেক সময় তা প্রশস্ততা সৃষ্টি করে। পক্ষান্তরে ইফতিরাক বা দলাদলি ও বিচ্ছিন্নতা সকল ক্ষেত্রেই নিষিদ্ধ ও নিন্দনীয়।
(৪) ইখতিলাফকারী আলিম নিন্দিত নন, বরং তিনি ইখলাস ও ইজতিহাদের ভিত্তিতে প্রশংসিত ও পুরস্কার-প্রাপ্ত। মুজতাহিদ ভুল করলে একটি পুরস্কার ও সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছালে দুটি পুরস্কার লাভ করেন।
(৫) ইখতিলাফের ভিত্তি অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইলম বা জ্ঞান ও দলিল। আর ইফতিরাকের ভিত্তি সর্বদাই ব্যক্তিগত পছন্দ বা প্রবৃত্তির অনুসরণ, জিদ এবং ইখলাসের অনুপস্থিতি। ইখতিলাফের ক্ষেত্রে আলিমগণ প্রত্যেকে নিজের মতকে সঠিক, অধিকতর শুদ্ধ বলে মনে করলেও অন্য মতটিকে বিভ্রান্তি ও অন্যমতের আলিমকে ‘বিভ্রান্ত’ বলে মনে করেন না, বরং তার দলিলকে দুর্বল বলে গণ্য করেন। পক্ষান্তরে ইফতিরাকের ক্ষেত্রে প্রত্যেক আলিম নিজের মতকে একমাত্র সত্য এবং অন্য মতকে বিভ্রান্তি বলে গণ্য করেন।
(৬) ইলম, ইখলাস, ইসলামী ভ্রাতৃতবোধ ও ভালবাসার সাথে ইখতিলাফ থাকতে পারে। কিন্তু এগুলোর সাথে ‘ইফতিরাক’ থাকতে পারে না। কেবলমাত্র এগুলির অনুপস্থিতিতেই ইফতিরাক জন্ম নেয়।
৪. ঐক্য ও বিভক্তি মূলত অন্তরের কর্ম বা বিশ্বাসের অংশ
উপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান যে, জামাআত বা ঐক্য এবং তাফাররুক বা বিভক্তি মূলত ‘কালবী’ বা ‘ই’তিকাদী’ আমল’ অর্থাৎ অন্তরের বা বিশ্বাসের কর্ম। দৈহিক ঐক্যবদ্ধতা বা সকলের একস্থানে উপস্থিতি জামাআতের একটি প্রকাশ। এ অর্থে সালাতের জামাআতে উপস্থিত হতে হয়। তবে ঐকবদ্ধতা অর্থে উপরের আয়াত ও হাদীসগুলোর আলোকে সকল মুসলিম একস্থানে একত্রিত হওয়া, একটি দলে নাম লেখানো বা অনুরূপ কোনো বাহ্যিক কর্মকে জামাআত বলে মনে করা যাচ্ছে না। আমরা দেখলাম যে, পারস্পরিক ভালবাসা, প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বই জামাআত এবং পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতাবোধই বিভক্তি। এ থেকে জানা যায় যে, হৃদয়ের মধ্যে সকল মুসলিমের প্রতি ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্ব অনুভব করা, মতভেদ সত্ত্বেও মুসলিমকে নিজের দীনী ভাই এবং নিজের দলের মনে করা এবং নিজেকে সকলের সাথে ঐক্যবদ্ধ বলে মনে করাই মূলত জামাআত। এর বিপরীতে অন্য মুসলিমদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ বা শত্রুতা পোষণ করা, নিজেকে তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন, পৃথক ও স্বতন্ত্র বলে মনে করাই তার্ফারুক বা ইফতিরাক।
মু‘আবিয়া (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ বলেন:
أَلا إِنَّ مَنْ قَبْلَكُمْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ (الكتابين) افْتَرَقُوا عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ مِلَّةً وَإِنَّ هَذِهِ الْمِلَّةَ سَتَفْتَرِقُ عَلَى ثَلاثٍ وَسَبْعِينَ ثِنْتَانِ وَسَبْعُونَ فِي النَّارِ وَوَاحِدَةٌ فِي الْجَنَّةِ وَهِيَ الْجَمَاعَةُ
“তোমরা জেনে রাখ! তোমাদের পূর্ববর্তী কিতাবীগণ (ইহূদী ও খৃস্টানগণ) ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল। আর এ উম্মাত ৭৩ দলে বিভক্ত হয়ে যাবে। এদের মধ্যে ৭২ দল জাহান্নামে এবং একটি দলই জান্নাতে। তারা জামা‘আত।” (আবূ দাউদ ৪/১৯৮; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/২১৮। হাকিম ও যাহাবী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। ইবনু হাজার হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। আলবানী, সাহীহাহ ১/৪০৪-৪১৪)
এখানে সুস্পষ্ট যে, জামাআত বলতে নির্ধারিত স্থানে দৈহিকভাবে একত্রিত বা আধুনিক পরিভাষায় কোনো দলের ব্যানারে একত্রিত জনগোষ্ঠীকে বুঝানো হয় নি। চেতনায় ও বিশ্বাসে ঐক্যবদ্ধ মূলধারার মুসলিমদেরকে বুঝানো হয়েছে।
৫. সমকালীন ইফতিরাকের বিভিন্ন কারণ
প্রাচীন যুগ থেকেই উম্মাতের মধ্যে বিভক্তি প্রবেশ করেছে। বর্তমানে তা অনেক বেশি প্রকট রূপ ধারণ করেছে। বিশেষ করে মূলধারার বা কুরআন, সুন্নাহ ও শরীয়াহ অনুসারী ধার্মিক মুসলিমদের মধ্যে বিভিক্তি প্রকট হয়েছে। এজন্য আমরা সংক্ষেপে সমকালীন বিভিক্তর কয়েকটি কারণ উল্লেখ করছি।
ক. আকীদার মতভেদ
উম্মাতের প্রাচীনতম বিভক্তির কারণ ছিল আকীদা বা বিশ্বাসগত মতভেদ। ইসলামের প্রথম যুগগুলোতে আকীদার ভিত্তিতে শিয়া, খারিজী, মুতাযিলী, জাহমী, কাদারী, জাবারী ইত্যাদি ফিরকার জন্ম হয়েছিল। তাদের বিপরীতে সাহাবীগণের অনুসারী মূল ধারার মুসলিমগণ নিজেদেরকে ‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত’ অর্থাৎ সুন্নাত ও ঐক্যের অনুসারী বলে গণ্য করতেন। পরবর্তী যুগে ‘আহলুস সুন্নাত’-এর অনুসারীদের মধ্যেও আকীদার ছোট বা বড় বিষয়গুলো নিয়ে বহু প্রকারের অনৈক্য ও বিভক্তির জন্ম নিয়েছে। আমরা দেখেছি যে, ঐক্য ও বিভক্তি মূলতই বিশ্বাস বা মনের কর্ম। এজন্য আকীদার মতভেদ থেকে বিভক্তি ও শত্রুতার জন্ম নেওয়াই স্বাভাবিক।
খ. ফিকহী মতভেদ
আকীদাগত মতভেদ নিয়ে বিভক্তির চেয়েও অনেক বড় ও প্রকট হয়ে পড়েছে বর্তমান যুগে ফিকহী মতভেদ কেন্দ্রিক বিভক্তি। আমরা দেখি যে, ইসলামের প্রথম যুগগুলোতে আকীদার মতভেদ নিন্দনীয় ও বিভক্তি বলে গণ্য করা হতো, তবে ফিকহী মতভেদ সহনীয় বলে গণ্য ছিল। ক্রুসেড যুদ্ধোত্তর যুগগুলোতে মাযহাবী মতভেদ এক প্রকারের বিভক্তির রূপ গ্রহণ করে। বর্তমানে মাযহাবের নামে বা হাদীসের নামে ফিকহী মতগুলো পূর্বের যুগের চেয়েও অনেক প্রকটভাবে বিভক্তির অন্যতম কারণ হিসেবে পরিণত হয়েছে।
গ. আকীদা ও ফিকহী মতভেদে সাহাবীগণের পদ্ধতি পরিত্যাগ
সমকালীন বিভক্তির অন্যতম কারণ, মতভেদের ক্ষেত্রে সাহাবীগণের কর্মধারা পরিত্যাগ করা। আমরা দেখি যে, সাহাবীগণের যুগ থেকেই উপরের দু’ প্রকারের মতভেদ বিদ্যমান ছিল। উভয় ক্ষেত্রেই তারা জামাআত বা ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের দিকে লক্ষ্য রেখেছেন।
সাহাবী-তাবিয়ীগণ আকীদা বিষয়ক মতভেদকে নিন্দনীয় ও বর্জনীয় বলে গণ্য করেছেন। কারণ আকীদা অপরিবর্তনীয় ও স্থির। এখানে কুরআন ও হাদীসের সুস্পষ্ট বক্তব্যের অতিরিক্ত ইজতিহাদ, ভিন্নমত বা নতুন মতের প্রয়োজন বা সুযোগ নেই। এরপরও তারা আকীদা বিষয়ক মতভেদ বা বিভ্রান্তিতে লিপ্তদের প্রতি জামাআত, ভ্রাতৃত্ব বা ঐক্যবোধের চেতনা লালন করতেন। খারিজীগণ সাহাবীগণকে এবং খারিজীদের সাথে শতভাগ একমত নয় এরূপ সকল মুসলিমকে অত্যন্ত খোঁড়া ও ভিত্তিহীন ‘দলিল’ দিয়ে কাফির বলে গণ্য করেন এবং ঢালাওভাবে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ও হত্যায় লিপ্ত হন। সাহাবীগণ খারিজীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ করার পাশাপাশি তাদেরকে কাফির বলা থেকে বিরত থেকেছেন। তাদের ঈমান, আমল ও আবেগের মূল্যায়ন করেছেন। যুদ্ধের ময়দানের বাইরে তাদের পিছনে সালাত আদায়-সহ তাদের সাথে ধর্মীয় ও সামাজিক সম্পর্ক রক্ষা করেছেন। (ইবনু তাইমিয়া, মাজমূউল ফাতাওয়া ৭/২১৭-২১৮; ড. নাসির আল-আকল, আল-খাওয়ারিজ, পৃ. ৪৭-৫৬)
খারিজীগণের বিষয়ে আলী (রা)-কে প্রশ্ন করা হয়: এরা কি কাফির? তিনি বলেন, এরা তো কুফরী থেকে বাঁচার জন্যই পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বলা হয়, তবে কি তারা মুনাফিক? তিনি বলেন, মুনাফিকরা তো খুব কমই আল্লাহর যিক্র করে, আর এরা তো রাতদিন আল্লাহর যিক্রে লিপ্ত। বলা হয়, তবে এরা কী? তিনি বলেন, এরা বিভ্রান্তি ও নিজ-মত পূজার ফিতনার মধ্যে নিপতিত হয়ে অন্ধ ও বধির হয়ে গিয়েছে। (ইবনুল আসীর, আন-নিহাইয়াহ ফী গারিবিল হাদীস ২/১৪৯)
ফিকহী মতভেদকে সাহাবী-তাবিয়ীগণ নিন্দনীয় বা বর্জনীয় বলে গণ্য করেন নি। এক্ষেত্রে সাধারণত তারা নিজের মতের পক্ষে দলিল পেশ করতেন, তবে ভিন্নমতকে বাতিল করতেন না। কেউ ভিন্ন মত খ-ন করলেও কখনোই তারা ফিকহী ভিন্নমতের কারণে ভিন্নমতাবলম্বীকে অবজ্ঞা করেন নি এবং তার থেকে বিমুক্তি বা বিচ্ছিন্নতার কথা বলেন নি। বরং ভিন্নমত-সহ পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব, ভালবাসা, শ্রদ্ধাবোধ ও ঐক্যবোধ লালন করেছেন।
সমকালীন বিভক্তিতে উভয় ক্ষেত্রেই প্রান্তিকতা লক্ষ্য করা যায়। আকীদার ক্ষেত্রে ছোট-বড় সকল বিষয়ে ‘বিভ্রান্ত’ মতের নিন্দার পাশাপাশি সে মতের অনুসারীকে বিভিন্ন অজুহাতে কাফির বা ইসলামের শত্রু বলে প্রমাণ এবং তার প্রতি শত্রুতা ও বিদ্বেষ প্রচারের প্রবণতা লক্ষণীয়। এর চেয়েও প্রকট ফিকহী বিষয়ক মতভেদকে নানাবিধ অজুহাতে আকীদার মধ্যে নিয়ে যাওয়া এবং ফিকহী ভিন্নমত খ-নের পাশাপাশি ভিন্ন মতের অনুসারীর প্রতি অবজ্ঞা, বিদ্বেষ, বিমুক্তি, বিচ্ছিন্নতা বা ‘ভিন্নদল’ চেতনা লালন ও প্রচার করা।
ঘ. দাওয়াত পদ্ধতির মতভেদ
সমকালীন বিভক্তির অন্যতম একটি কারণ পদ্ধতিগত ভিন্নতা। বিশেষত ইসলাম প্রচার ও প্রসারে সমকালীন মুসলিমগণ রাজনীতি, লেখনি, ময়দানী দাওয়াত, শিক্ষাবিস্তার, বিভিন্ন পদ্ধতির শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন ইত্যাদি পদ্ধতির অনুসরণ করছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রত্যেক পদ্ধতির অনুসারী নিজের পদ্ধতিকেই দীন প্রচার বা প্রতিষ্ঠার একমাত্র নির্ভুল পদ্ধতি বলে বিশ্বাস করছেন এবং অন্যান্য পদ্ধতির অনুসারীদের বিভ্রান্ত বা ভিন্নদল বলে ‘বিশ্বাস’ করছেন। নিজ পদ্ধতির অনুসারীদের প্রতি ‘ইসলামী ভ্রাতৃত্ব’ অনুভব করছেন এবং অন্যান্য পদ্ধতির অনুসারীদের প্রতি এ ভ্রাতৃত্ব অনুভব করছেন না। উপরন্তু অবজ্ঞা বা বিদ্বেষভাব অনুভব, লালন ও প্রচার করছেন।
ঙ. সমালোচনায় ইসলামী আদব লঙ্ঘন
আমরা দেখেছি যে, মতভেদ থেকে বিভক্তির আগমন ঘটে। আর এক্ষেত্রে ভিন্নমত খ-ন বা ভিন্নমতের সমালোচনার অজুহাতে ভিন্নমতের অনুসারীদের প্রতি ব্যক্তিগত বা দলগত আক্রমন বা তাদের ‘ধার্মিকতা’, ‘তাকওয়া’ বা ‘ইখলাসের’ প্রতি কটাক্ষ বিভক্তিকে তরান্বিত ও প্রকট করে। আমরা জানি, কুরআন-হাদীসে আহলে কিতাবদের সাথে বিতর্কের ক্ষেত্রে ‘উত্তম’ আচরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মুমিনদেরকে পরস্পর কটাক্ষ, উপহাস, টিপ্পনি, খারাপ উপাধি ব্যবহার ইত্যাদি থেকে নিষেধ করা হয়েছে। ধারণা বা সন্দেহ নির্ভর সিদ্ধান্ত বা বক্তব্য থেকে নিষেধ করা হয়েছে। তবে সাধারণভাবে মুসলিম আলিম, গবেষক ও প্রচারকগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ নির্দেশগুলো মানছেন না।
সমালোচনার ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, তা হলো বিশ্বাস বা কর্মের বিধান এবং উক্ত বিশ্বাস বা কর্মে লিপ্ত মুমিনের বিধানের মধ্যে পার্থক্য না করা। আমাদের বক্তব্য অনেকটা নিম্নরূপ: (১) অমুক কর্মটি বিদআত, শিরক, হারাম বা হাদীসের বিপরীত, (২) শিরক, বিদআত, হারাম বা হাদীস অস্বীকারের শাস্তি জাহান্নাম, (৩) অমুক ব্যক্তির মধ্যে উক্ত বিশ্বাস বা কর্ম বিদ্যমান, (৪) কাজেই উক্ত ব্যক্তি তার সকল অনুসারী বা সমমনা ব্যক্তি বিদআতী, মুশরিক বা জাহান্নামী। সুন্নাতে নববী, সুন্নাতে সাহাবা ও সালফ সালিহীনের কর্মপদ্ধতির আলোকে আমরা জানি যে, প্রথম তিনটি বিষয় সঠিক হলেও চতুর্থ বিষয়টি ঢালাওভাবে বলা যায় না। ব্যক্তি মুমিনের ওজর, তাবিল, ব্যাখ্যা, ইজতিহাদ, অন্যান্য কর্ম ইত্যাদির আলোকে তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ভিন্নমতের সমালোচনায় প্রকাশ্য বা প্রচ্ছন্ন তাকফীর লক্ষণীয়। আকীদা, ফিকহ, ইজতিহাদ পদ্ধতি, দাওয়াহ-পদ্ধতি ইত্যাদি বিষয়ে ভিন্নমতের মানুষদেরকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কাফির বলে দাবি করা হচ্ছে। প্রচ্ছন্ন ‘তাকফীর’-এর মধ্যে রয়েছে ইসলামের দুশমন, সুন্নাতের দুশমন, ইসলামের দুশমনদের দালাল, কাফিরদের মতই, কাফিরের চেয়েও খারাপ ইত্যাদি বলে আখ্যায়িত করা।
চ. ঈমানী ভ্রাতৃত্বের অবমূল্যায়ন
কুরআন ও হাদীসে মুমিনদেরকে পরস্পর ভাই বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন: (إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ) “মু’মিনগণ পরস্পর ভাই ভিন্ন কিছুই নয়।” (সূরা হুজুরাত, ১০ আয়াত)। আল্লাহ আরো বলেন: (وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ) “এবং মুমিন পুরুষগণ ও মুমিন নারীগণ পরস্পর পরস্পরের অভিভাব বা বন্ধু।” (সূরা তাওবা ৭১ আয়াত)
এখানে মহান আল্লাহ ‘মুসলিম’ না বলে ‘মুমিন’ বলেছেন। উভয় শব্দ সমার্থক হলেও ঈমানের মধ্যে বিশ্বাসের দিকটি এবং ইসলামের মধ্যে কর্ম ও দীন পালনের দিকটি অধিক জোরদার। এথেকে জানা যায় যে, যতক্ষণ কোনো ব্যক্তি ঈমানের সাক্ষ্য দিচ্ছেন এবং সন্দেহাতীত কুফর-শিরকে লিপ্ত হচ্ছেন না ততক্ষণ তিনি অন্য মুমিনের “দীনী ভাই” বলে গণ্য। কুরআনে রক্ত সম্পর্কের ভ্রাতৃত্বের চেয়ে “ঈমানী ভ্রাতৃত্ব”-কে অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। কুরআনে “ভাই” শব্দটির ব্যবহারের ব্যাপকতা লক্ষণীয়। হত্যাকারীকে নিহতের পরিজনের “ভাই” বলা হয়েছে। (সূরা বাকারা: ১৭৮ আয়াত) দুটি মুমিন গোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধ চলা অবস্থাতেও তাদেরকে “ভাই” বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। (সূরা হুজুরাত: ৯-১০ আয়াত) অর্থাৎ মানবীয় দুর্বলতার শিকার হয়ে একজন মুমিন অন্য মুমিনকে খুন করে ফেলার সম্ভাবনা অস্বীকার করা যায় না। দুজন মুমিনের পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনাও অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু এ কারণে তাদের কেউ কাফির হন না বা চিরশত্র“তে পরিণত হন না। ঈমান ও ঈমানী ভ্রাতৃত্ব বহাল থাকে।
উম্মাতের বিভক্তির অন্যতম কারণ বিভিন্ন অজুহাতে ঈমানের গুরুত্ব অবমূল্যায়ন করা। মুমিনের ঈমানকে স্বীকার করার পাশাপাশি তার বড় বা ছোট পাপ ও বিভ্রান্তির কারণে তার প্রতি শত্রুতা বা বিদ্বেষভাব পোষণ করা বা তার থেকে নিজেকে বিমুক্ত, বিচ্ছিন্ন বা ভিন্ন দলের বলে মনে করা ঈমানের অবমূল্যায়ন ছাড়া কিছুই নয়। আর ভিন্ন মতের কারণে মুমিনের ঈমান, সালাত, সিয়াম ও অন্যান্য সকল ইবাদতকে অবমূল্যায়ন করে তার বিরুদ্ধে অবজ্ঞা, বিদ্বেষ বা শত্রুতা পোষণ বা প্রচার করা আরো অধিক অন্যায়।
ছ. ভিন্নমতের প্রান্তিকদের অজুহাতে নিজের প্রান্তিকতার বৈধতার দাবি
বহুধা বিভক্ত উম্মাতের প্রত্যেক ধারার মধ্যেই প্রান্তিকতা বিদ্যমান। যখনই কোনো ধারার অনুসারীদের অন্য ধারার অনুসারীদের প্রতি প্রশস্ত ও সহনশীল হওয়ার জন্য কুরআন, সুন্নাহ বা সালফ সালিহীনের কর্মধারার উল্লেখ করা হয় তখনই তারা ভিন্ন ধারার প্রান্তিক কিছু বক্তব্য উল্লেখ করে তাদের নিজেদের প্রান্তিকতার বৈধতা প্রমাণের চেষ্টা করেন, যদিও সাধারণভাবে আমরা জানি যে, কোনো একটি অন্যায়ের অজুহাতে আরেকটি অন্যায়ের বৈধতা দাবি করা যায় না।
জ. সবাইকে একমতে আনার চেষ্টা
বিভক্তির একটি কারণ ঐক্যের নামে মতভেদ দূর করার চেষ্টা। এতে একটি অসম্ভব কর্মে লিপ্ত হয়ে আমরা একটি সম্ভব কর্মকে অসম্ভব করে তুলি। মতভেদ বা মতের ভিন্নতা দূর করা একটি অসম্ভব বিষয়। এটি ইসলামের নির্দেশও নয়। আমরা দেখেছি যে, ঐক্যের অর্থ একমত হওয়া নয়। ঐক্য অর্থ হৃদয়ের প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ। আর বিভক্তি অর্থ মতের ভিন্নতা নয়; হৃদয়ের শত্রুতা, দূরত্ব বা হিংসা-বিদ্বেষ। প্রথমটি দূর করা সম্ভব নয় এবং কাম্যও নয়। দ্বিতীয়টি দূর করা বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ঐক্যের নামে সবাইকে একমতে বা ‘একদলে’ আনার চেষ্টার মাধ্যমে নতুন একটি মত বা দলের উদ্ভব ছাড়া বিশেষ কোনো লাভ হয় না।
৬. শরীয়াহ অনুসারী বনাম শরীয়াহ বিমুখদের বিভক্তির তুলনা
ইসলামের প্রথম যুগগুলোতে বিদআতে লিপ্ত, বিশেষত আকীদাগত বিদআতে লিপ্ত মানুষেরা সবচেয়ে বেশি বিভক্তিতে লিপ্ত ছিলেন। এজন্য আলিমগণ তাদেরকে ‘আহলুল বিদআতি ওয়াল ইফতিরাক’ অর্থাৎ বিদআত ও বিভক্তির অনুসারী বলে আখ্যায়িত করতেন। এরা ‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত’-কে তো কাফির বা বিভ্রান্ত বলতেনই, উপরন্তু নিজ নিজ দলের ভিন্ন মতের মানুষদেরও কাফির বা বিভ্রান্ত বলে বিশ্বাস ও প্রচার করতেন। বর্তমান সময়ে আমরা এর বিপরীত চিত্র দেখতে পাই। সুস্পষ্ট বিদআত ও শিরকে লিপ্ত মানুষেরা একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার, মন্দকথন বা ফাতওয়াবাজি করছেন না। প্রত্যেকেই দাবি করছেন যে, বিশ্বে একজনই গাওসে আযম, মুজাদ্দিদে যামান, কুতুবে যামান, বা ইমামে যামান আছেন এবং তাদের গুরুই সেই ব্যক্তি। কিন্তু সমাজে বিদ্যমান অন্যান্য শতশত গাওসে আযম, মুজাদ্দিদ, কুতুব, ইমাম ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বা প্রচ্ছন্নভাবে কিছুই বলছেন না। প্রত্যেক দলই দাবি করছেন যে, তাদের জীবিত বা কবরস্থ গুরুর হাতেই আল্লাহর সকল ভা-ার রয়েছে, তবে কেউ অন্যের বিরুদ্ধে বলছেন না। এদের অনেকেই সুস্পষ্টভাবে সকল ধর্মের অনুসারীদের মুক্তির দাবি করছেন এবং ইসলামী শরীয়াহ পালনকে অপ্রয়োনীয় বলছেন। অন্য অনেকে ইসলামী শরীয়াহ পালনের গুরত্বের কথ মুখে বললেও কার্যত একে কোনো গুরুত্ব দিচ্ছেন না। প্রকাশ্য কুফর, শিরক, অশ্লীলতা, অনাচার, পাপাচার, শরীয়াহ-লঙ্ঘন ইত্যাদির বিরুদ্ধে কিছুই বলেন না। তারা সকলেই একযোগে তাওহীদ, সুন্নাহ ও শরীয়াত অনুসারীদের বিরুদ্ধে কথা বলেন।
বিপরীতে আমরা দেখছি যে, তাওহীদ, সুন্নাত ও শরীয়াতে ইসলামীর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের আবশ্যকতায় বিশ্বাসী মানুষেরা উৎকটভাবে পরস্পরের বিরুদ্ধে অবজ্ঞা, বিদ্বেষ বা শত্রুতা প্রকাশ ও প্রচার করছেন। কিছু দিন আগেও তাওহীদ ও সুন্নাতের গুরুত্বে বিশ্বসীগণ বিদআত ও শিরকের প্রচারকদের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। এখন সুস্পষ্ট শিরক, বিদআত ও কুফরের বিরুদ্ধে কথা অনেক কমে গিয়েছে। তবে অস্পষ্ট বা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ শিরক, কুফর ও বিদআতের বিরুদ্ধে কথাবার্তা অনেক বেড়েছে।
৭. আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত বনাম আহলুল বিদআত ওয়াল ইফতিরাক
সমকালীন বিভক্তির ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, এ বিভক্তি ‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত’ অনুসরণের দাবিদারদের মধ্যে। এক্ষেত্রে সাহাবী, তাবিয়ী ও পূর্ববর্তী ‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের’ ইমামগণের সাথে সমকালীন ‘আহলুস সুন্নাত ওয়ার জামাআতের’ অনুসারীদের পার্থক্য খুবই লক্ষণীয়। সাহাবী-তাবিয়ী বা সালাফ সালিহীন বিভ্রান্তদের শিরক, কুফর বা বিভ্রান্তি প্রকাশ করতেন। তবে ঈমানের দাবিদারের এ সকল কর্মের কারণে তার থেকে বিচ্ছিন্নতা, তার প্রতি শত্রুতা বা তাকে কাফির বলার প্রবণতা পরিহার করতেন। ঈমানের দাবিদারের প্রায় সুস্পষ্ট কুফরী কথার একটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য তারা ওজর খুঁজতেন। অজ্ঞতা, ব্যাখ্যা, ইজতিহাদ ইত্যাদি ওজর থাকার সম্ভাবনা মেনে নিয়ে কুফরী মত বা বক্তব্যের প্রবক্তাকে কাফির বলা থেকে বিরত থাকতেন। এটিই মূলত ‘জামাআত’ বা ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি। জামাআত বা ঐক্যবদ্ধতার অর্থ মুসলিমের অন্যায়কে ন্যায় বলা, অন্যায়কে মেনে নেয়া বা প্রশ্রয় দেয়া নয়। আমাদের ধারণায় জামাআত, ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি বিষয়ে সালাফ সালিহীনের পদ্ধতি হলো, প্রত্যেকেই নিজ ইজতিহাদ অনুসারে অন্যায়কে অন্যায় বলবেন, তবে সে অন্যায়ে লিপ্ত মুমিনের ঈমানের দাবির প্রতি শ্রদ্ধাবোধের কারণে তার প্রতি ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির অনুভূতি বহাল রাখবেন এবং তার ওজর খুঁজবেন। আলোচনা, সমালোচনা, প্রতিবাদ বা খ-ন সকল ক্ষেত্রে এ ভ্রাতৃত্ববোধ, শ্রদ্ধাবোধ ও সম্প্রীতিকে কার্যকর রাখবেন এবং ঈমানী আদব বজায় রাখবেন।
তাদের বিপরীতে পূর্ববর্তী ‘আহলুল বিদআত ওয়াল ইফতিরাক’ বা বিদআত ও বিচ্ছিন্নতার অনুসারীগণ ঈমানের দাবিদারের মতভেদীয় বক্তব্যকে বিভিন্ন ব্যাখ্যার মাধ্যমে কুফরী বলে প্রমাণ করে তার থেকে বিমুক্তি, বিচ্ছিন্নতা, বিদ্বেষ ও শত্রুতা পোষণ ও প্রচার করতেন। ব্যক্তির কারণে তার সাথে সম্পৃক্ত সকলকেই তারা এভাবে কাফির, শত্রু বা ‘ভিন্নদল’ বলে গণ্য করতেন। বর্তমানে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত অনুসরণের দাবিদারগণ অন্তত এ বিষয়ে আহলুল বিদআত ওয়াল ইফতিরাকের কর্মপদ্ধতি অনুসরণ করছেন। তারা সকলেই আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনুসারী হওয়ার দাবি করছেন এবং প্রায় সকলেই অন্য সকল দল বা মতের অনুসারীদের থেকে বিমুক্তির বা বিচ্ছিন্নতার ঘোষণা দিচ্ছেন। প্রত্যেকেই অন্য সকলকে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বহির্ভুত, বিভ্রান্ত, কাফির বা কাফির পর্যায়ের বলে প্রমাণে সচেষ্ট। নফলকে ফরজের গুরুত্ব দিচ্ছেন, ফিকহকে আকীদায় নিয়ে যাচ্ছেন, আকীদার সাধারণ বিষয়কে ঈমান-কুফরের মানদ- বানাচ্ছেন, একজনের একটি ভুল, অন্যায় বা প্রান্তিক কথাকে দলিল করে সকলকেই ঢালাওভাবে কাফির, কাফির-সমতুল্য বা বিভ্রান্ত বলে গণ্য করছেন।
আমাদের কাছে মনে হয়, সাহাবী-তাবিয়ীগণ ও প্রাচীন আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের দৃষ্টিভঙ্গিতে ‘জামাআত’ হলো ‘জামি’ অর্থাৎ অন্তর্ভূক্তিমূলক বা ‘ইনক্লুসিভ’, অর্থাৎ সবাইকে অন্তর্ভুক্ত বা জমা করার প্রচেষ্টা। তাঁদের দৃষ্টিতে সকল মুসলমানই আল্লাহর দল ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অর্ন্তভুক্ত, শুধু যারা সুস্পষ্টভাবে সুন্নাত বা জামাআতকে অস্বীকার করেছেন তাদের কথা ভিন্ন। এর বিপরীতে সমকালীন আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের চেতনাটি বহিস্কারমূলক বা ‘এক্সক্লুসিভ’, অর্থাৎ সবাইকে বের করে দেওয়ার প্রচেষ্টা। প্রত্যেকেরই দাবি, সকলেই বিভ্রান্ত, শুধু যারা আমাদের সকল মত, ইজতিহাদ, ব্যাখ্যা ও দাবি নির্বিচারের পরিপূর্ণভাবে মেনে নিয়েছেন তারাই ‘আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআত’।
৮. বিভক্তির পরিণতি: বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ ধারণা
বাংলাদেশে মুসলিমগণের বিভক্তির অবস্থা পর্যালোচনা করলে নিম্নের বিষয়গুলো দেখা যায়:
(ক) শিরক-কুফর ও খৃস্টধর্ম প্রচারের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি
আমরা দেখিছ যে, তাওহীদ, সুন্নাহ ও শরীয়াহ পালনের গুরুত্বে বিশ্বাসীগণের মধ্যে বিভক্তি প্রকটতর। এতে একদিকে শিরক, কুফর ও বিদআতের প্রচারকদের জন্য ময়দান খুবই নিরাপদ হয়েছে। শিয়া, কাদিয়ানী, বাহাঈ ইত্যাদি ধর্মের বা মতের অনুসারীরা তাদের দাওয়াতী কর্মকা- ব্যাপকভাবে এবং অনেকটা নির্বিবাদেই চালাতে পারছেন। সর্বোপরি খৃস্টান মিশনারিগণ হাজার হাজার মুসলিমকে খৃস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করছেন। দীন প্রেমিক মুসলিমগণ পরস্পরের মত খ-ন, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে ব্যস্ত থাকার কারণে এ সকল বিষয় তাদের নজর এড়িয়ে যাচ্ছে। অনেক সময় নজরে আসলেও গুরুত্ব দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এমনকি অনেক সময় তারা এ সকল বিষয়ে গুরুত্ব আরোপের বিরোধিতা করছেন। কেউ বলছেন, অমুক মতের অনুসারী মূলতই কাফির, কাজেই তারা কাদিয়ানী, বাহাঈ, শিয়া বা খৃস্টান হলেই কি আর না হলেই কি! কেউ বলছেন, অমুক মতের অনুসারীরা তো মুসলিম নামের কলঙ্ক, তাদের কাদিয়ান বা খৃস্টান হয়ে যাওয়াই ভাল। হয় আমাদের মতে এসে সঠিক ইসলাম অনুসরণ করুক অথবা খৃস্টান হয়ে ইসলামের কলঙ্ক দূর করুক!
কেউ বলেন, খৃস্টান হচ্ছে হোক, পরে ওদেরকে সামাজিক প্রতিরোধের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা যাবে, এখন অমুক মত বা দল ঠেকাও!! যারা খৃস্টান হচ্ছে তারা আবার পরে আমাদের আখলাক দেখে মুসলিম হয়ে যাবে, যেভাবে হুদাইবিয়ার সন্ধির পরে কাফিররা সাহাবীগণের আখলাক দেখে মুসলিম হয়ে গিয়েছিলেন! কাজেই কাদিয়ানী, বাহাঈ বা খৃস্টান ধর্মান্তর নিয়ে এখন চিন্তা করার কোনো দরকার নেই, এখন বাতিলদেরকে ঠেকাও!! কেউ বলছেন, এগুলো নিয়ে চিন্তা করে লাভ নেই, অমুক বা তমুক পদ্ধতিতে দীনের প্রচার বা প্রতিষ্ঠার কাজ চালিয়ে যান, এক সময় সব ঠিক হয়ে যাবে!!!
(খ) আলিমগণ সম্পর্কে ব্যাপক কুৎসাচার
সমকালীন বিভক্তির অন্যতম দিক আলিম ও দাঈগণের বিষয়ে ব্যাপক কুৎসাচার। বিশেষত প্রযুক্তির কারণে সকলের কথা একই স্থানে ইন্টারনেটে বা টিভির পর্দায় পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের সমাজের কমবেশি ১৫/২০% মানুষ দীন পালন করেন এবং কোনো না কোনো ইসলামী ‘ধারার’ অনুসরণ করেন। বাকি প্রায় ৮০/৮৫% মুসলিম দীন পালনে অবহেলা করেন এবং কোনো ধারারই অনুসরণ করেন না। এদের অধিকাংশই দীন ও আলিমদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তারা ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা সামাজিক বিভিন্ন সমস্যায় আলিমদের পরামর্শ নেওয়ার চেষ্টা করেন। বর্তমানে এরূপ কোনো ব্যক্তি যদি ঈমানী, আমলী বা দীনী কোনো সমস্যায় সমাধানানের জন্য গ্রহণযোগ্য আলিম অনুসন্ধানের জন্য ইন্টারনেটে প্রবেশ করেন তবে তিনি দেখবেন যে, প্রসিদ্ধ প্রত্যেক আলিম ও দাঈর বিষয়েই ব্যাপক কুৎসা বা নিন্দাচার বিদ্যমান এবং প্রত্যেককেই ভিন্নমতের আলিম বা দাঈদেরকে ইসলামের দুশমন বা ইহূদী-নাসারাদের দালাল বলে চিত্রিত করেছেন। এতে প্রত্যেক দলের অনুসারী পরিতৃপ্ত বা আনন্দিত হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মুসলিমগণ এবং বিশেষত তরুণগণ খুবই সমস্যায় পড়ছেন। সমাজের আলিমগণ সকলেই খারাপ, কিছু বুঝেন না ইত্যাদি চিন্তা তরুণদেরকে সমাজবিচ্ছিন্ন ও আলিমগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করছে। এছাড়া শিয়া, বাহাঈ, কাদিয়ানী, খৃস্টান, আহলে-কুরআন ও অন্যান্য ধর্মের বা মতের প্রচারকগণ কুরআন-হাদীসের নামে এদেরকে সহজেই গ্রাস করতে পারছেন। তারা কুরআনের কিছু আয়াত অথবা বুখারী, মুসলিম বা অন্য কোনো সহীহ নামে প্রসিদ্ধ গ্রন্থের কয়েকটি হাদীস নিয়ে এসে বলছেন: (১) কুরআন-হাদীস মানতে হবে, (২) সমাজের আলিম ও ইমামগণ অযোগ্য, অসৎ ও অজ্ঞ, কাজেই আমাদের এ মতের বিষয়ে তাদের কাছে প্রশ্ন করে বা সমাধান চেয়ে লাভ নেই, (৩) আমরা কুরআন-হাদীস দেখাচ্ছি, কাজেই আমাদের মতে চলে এস…।
(গ) হানাহানি ও রক্তারক্তি
ভিন্নমত খ-নের নামে ভিন্নমত অনুসারীদের প্রতি শত্রুতা, বিদ্বেষ বা বিচ্ছিন্নতা পোষণ ও প্রচারের কারণে প্রত্যেক মতের অনুসারীদের মধ্যেও উত্তেজনা বাড়ছে। কোনো কোনো এলাকায় ইতোমধ্যেই মুসাল্লীদের মারামারির সংবাদ আমরা জেনেছি। কোথাও কোথাও সালাত পদ্ধতির মতপার্থক্যকে কেন্দ্র করে নামাযী মুসলিমগণ মারামারি করে কেউ কেউ ‘শহীদ’ (!!!) হয়েছেন বলেও আমরা জেনেছি। রাশ না টানলে কয়েক বছরের মধ্যে পুলিশ প্রহরা ছাড়া এদেশের মসজিদের সালাত আদায় অসম্ভব হয়ে যাবে বলেই মনে হয়।
৯. সমস্যার সমাধানে আমাদের করণীয়
উপরে আলোচিত বিভক্তি সমস্যা কি না সে বিষয়েও মতভেদ রয়েছে। অনেকেই এগুলোকে সমস্যা মনে করছেন না। তারা দাবি করছেন যে, তাদের নিজের পদ্ধতিতে কর্ম অব্যাহত রাখলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। অথবা সহীহ এবং হক কথা বলায় যদি বিভক্তি বা হানাহানি হয় তবে কিছু করার নেই। কারো অন্যায় প্রতিক্রিয়ার কারণে হক্ক কথা বলা বা হক্ক কাজ করা বন্ধ করা সম্ভব নয়। অনেকেই ভিন্ন মতের প্রান্তিকতাকেই দায়ী করছেন এবং নিজেদের প্রান্তিকতাকে এ অজুহাতে সঠিক বা প্রয়োজনীয় বলে দাবী করছেন। অনেকেই ভাবছেন, আমরা তো ঐক্যই চাই, আর তা হতে হবে ‘হক্ক’-এর ভিত্তিতে। আমরা যা বলছি, তাই একমাত্র হক্ক। সকলেই যখন এ ‘একমাত্র’ হক্ক মেনে নিবেন তখন তো ঐক্য হয়ে যাবেই।
বিপরীতে অনেকেই বিভক্তির এ অবস্থাকে সমস্যা বলে মনে করছেন এবং এ অবস্থা দূরীকরণে সচেষ্ট হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন। আমরা বলেছি যে, এ সমস্যা বিষয়ে সচেতন অনেকে বিভক্তি দূর করার লক্ষ্যে মতভেদ দূর করার বা সকলকে এক দলে বা এক মঞ্চে একত্রিত করার চেষ্টা করছেন।
উপরে বিভক্তির কারণ পর্যালোচনায় আমরা বিভক্তি দূরীকরণের উপায় সম্পর্কেও ধারণা প্রদানের চেষ্টা করেছি। মূলত বিভক্তির কারণগুলো দূর করলে বা কমিয়ে ফেললে বিভক্তিও কমবে বলে আমরা ধারণা করতে পারি। এ সকল কারণ দূরীকরণের জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলিম ও দাঈগণের পারস্পারিক সাক্ষাত ও সালাম বিনিময় এবং সম্ভব হলে মত বিনিময়।
আমরা দেখেছি, ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্ব বৃদ্ধির জন্য এবং শত্রুতা ও বিদ্বেষ থেকে মুক্তি অর্জনের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) পারস্পরিক সালাম প্রসার করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এজন্য আলিমগণের পারস্পরিক সাক্ষাত ও সালাম বিনিময় উম্মাতের জন্য একটি বড় উপকারী বিষয়। আমরা জানি, সকল মতের অনুসারীদের মধ্যেই কিছু মানুষ প্রান্তিকতাকেই ভালবাসেন। কেউ তার সাথে শতভাগ একমত বা তার মতের শতভাগ অনুসারী না হলেই তাকে অপছন্দ করেন। এর পাশাপাশি সকল মতের অনুসারীদের মধ্যেই উদার ও সহনশীল আলিম ও দাঈ বিদ্যমান। তারা কুরআন ও সুন্নাহ নির্দেশিত জামাআত অর্থাৎ ঐক্যবদ্ধতা, সম্প্রীতি, ভালবাসা, ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান। তারা তার্ফারুক অর্থাৎ বিভক্তি, বিচ্ছিন্নতা, বিদ্বেষ, হিংসা, শত্রুভাবাপন্নতা দূর করতে চান। তাদের সকলেরই দায়িত্ব এরূপ মাজলিস বা সাক্ষাতের জন্য চেষ্টা করা। শুধু সাক্ষাত ও সালাম বিনিময়ের কল্যাণ অনেক। পাশাপাশি যদি নিয়মিত বা অনিয়মিত এরূপ সাক্ষাতে কিছু মত বিনিময়ের ব্যবস্থা থাকে তবে তা থেকে আরো অনেক কল্যাণ বেরিয়ে আসবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
মহান আল্লাহই ভাল জানেন। আমরা আমাদের ভুলভ্রান্তি থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি। সালাত ও সালাম মুহাম্মাদ (সা.), তাঁর পরিজন-অনুসারী ও সহচরদের জন্য। প্রথমে ও শেষে সর্বদা ও সর্বত্র প্রশংসা আল্লাহর নিমিত্ত।