ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর
অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
ওসীলা বিষয়ে অনেক বিভ্রান্তি ও অস্পষ্টতা সমাজে বিদ্যমান। ওসীলা কখনো ইসলাম
নির্দেশিত বা সুন্নাত-সম্মত কর্ম, কখনো সুন্নাত বহির্ভুত বা সুন্নাতের
ব্যতিক্রম কর্ম এবং কখনো তা আল্লাহর রুবূবিয়্যাতে বা উলূহিয়্যাতে শিরকের
পর্যায়ে চলে যায়। এজন্য এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন বলে মনে করছি।
মহান আল্লাহর কাছে তাঁর মহান গুণাবলি, তাঁর পবিত্র নামসমূহ এবং তাঁর প্রিয়
হাবীব মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ঈমানের ওসীলা দিয়ে সকাতরে
আর্জি করি যে, তিনি যেন সঠিকভাবে বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করার এবং ব্যাখ্যা করার
তাওফীক আমাকে প্রদান করেন।
‘ওসীলা’ শব্দটির বিষয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা এর অর্থের পরিবর্তন ও বিবর্তন।
ভাষাতত্ত্বের সাথে পরিচিত সকলেই জানেন যে, বিভিন্ন ভাষায় ব্যবহৃত শব্দের
অর্থের পরিবর্তন ও বিবর্তন ঘটে। সময়ের আবর্তনের কারণে একই ভাষার মধ্যে
শব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটতে পারে। আবার এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় গমনের
কারণেও অর্থের পরিবর্তন ঘটে। যেমন বাংলা ভাষায় এক শতাব্দী আগে ‘সন্দেশ’
শব্দটির অর্থ ছিল সংবাদ। কিন্তু বর্তমানে শব্দটির অর্থ বিশেষ ধরনের
মিষ্টান্ন। কুরআন-হাদীসে ব্যবহৃত আরবী ভাষায় ‘লাবান’ অর্থ দুধ। কিন্তু
বর্তমানে আরব দেশে ‘লাবান’ অর্থ ঘোল।
ভাষান্তরের কারণে অর্থের পরিবর্তন খুবই বেশি। আরবীতে ‘জিন্স’ অর্থ শ্রেণী
বা লিঙ্গ, কিন্তু বাংলায় ‘জিনিস’ অর্থ এগুলির কিছুই নয়, বরং বাংলায় এর অর্থ
দ্রব্য বা বস্তু। আরবীতে ও ফার্সীতে নেশা বা নাশওয়া অর্থ ‘মাতলামী’ বা
মাদকতা। কিন্তু বাংলায় শব্দটির অর্থ মাদকতা হয় আবার অভ্যস্ততাও হয়। একারণে
অনেক সময় আমরা অস্পষ্টতার মধ্যে পড়ে যায়। কেউ বলেন, নেশা হারাম। উত্তরে
অন্যে বলেন, ভাত, চা ইত্যাদিও তো নেশা? বস্তুত বাংলা ‘নেশা’ বা অভ্যস্ততা
হারাম নয়, বরং ফার্সী নেশা বা মাতলামী ও মাদকতা হারাম। অভ্যস্ততা হারাম বা
হালাল হবে অভ্যাসের বিষয়ের বিধান অনুসারে, আর মাদকতা সর্বাবস্থায় হারাম।
কুরআন ও হাদীসের ভাষায় ওসীলা
‘ওসীলা’ শব্দটির অর্থের মধ্যে এরূপ বিবর্তন ঘটার কারণে এ বিষয়ে অনেক
বিভ্রান্তি জন্ম নিয়েছে। ফলে সুন্নাত ও ইসলাম সম্মত ব্যবহার থেকে ওসীলা
শব্দটি কখনো কখনো শিরকের পর্যায়ে চলে যায়। এজন্য এ বিষয়ে একটু বিস্তারিত
আলোচনা প্রয়োজন।
কুরআন ও হাদীসে ব্যবহৃত প্রাচীন আরবী ভাষায় ওসীলা শব্দের অর্থ নৈকট্য।
পরবর্তীকালে আরবী ভাষাতেই ওসীলা শব্দটির অর্থ হয় ‘যদ্বারা নৈকট্য চাওয়া হয়’
বা ‘নৈকট্যের উপকরণ’। আধুনিক যুগে আরবীতে এবং বিশেষ করে বাংলায় ওসীলা
শব্দটি ‘উপকরণ’, মধ্যস্থতা, যন্ত্র, হাতিয়ার, দূত ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত
হয়। অর্থের পরিবর্তনের কারণে শব্দটির বিষয়ে অনেক বিভ্রান্তি জন্ম নিয়েছে।
প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ ইবনু ফারিস (৩৯৫ হি) বলেন: “ওয়াও, সীন ও লাম: দুটি পরস্পর
বিরোধী অর্থ প্রকাশ করে: প্রথম অর্থ: আগ্রহ ও তালাশ। … দ্বিতীয় অর্থ চুরি
করা।”
প্রসিদ্ধ মুফাস্সির ও ভাষাবিদ রাগিব ইসপাহানী (৫০৭) বলেন: “ওসীলা: অর্থ
আগ্রহের সাথে কোনো কিছুর নিকটবর্তী হওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: মহান আল্লাহ
বলেছেন: ‘তোমরা তাঁর দিকে ওসীলা সন্ধান কর’। আল্লাহর দিকে ওসীলার হাকীকাত
হলো ইলম ও ইবাদতের মাধ্যমে এবং শরীয়তের মর্যাদাময় বিধিবিধান পালনের মাধ্যমে
সর্বাত্মক চেষ্টার মাধ্যমে আল্লাহর রাস্তায় প্রতিষ্ঠিত থাকা। এ হলো নেক
আমল বা নৈকট্য।”
আমরা ইতোপূর্বে তৃতীয় অধ্যায়ে রাসূলুল্লাহ সা.-এর মর্যাদা বিষয়ক আলোচনায়
দেখেছি যে, মহান আল্লাহ তাঁকে ‘ওসীলা’ প্রদান করবেন। স্বভাবতই এখানে ওসীলা
অর্থ উপকরণ বা মধ্যস্থতাকারী নয়, বরং ওসীলা অর্থ নৈকট্য। মহান আল্লাহ তাঁকে
সর্বোচ্চ নৈকট্য ও নিকটতম মর্তবা প্রদান করবেন।
মহান আল্লাহ বলেন:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَابْتَغُوا إِلَيْهِ
الْوَسِيلَةَ وَجَاهِدُوا فِي سَبِيلِهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
“হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তাঁর নৈকট্য সন্ধান কর এবং তাঁর পথে সংগ্রাম কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।”
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনু জারীর আত-তাবারী (৩১০ হি) বলেন:
وابتغوا إليه الوسيلة يقول واطلبوا القربة إليه ومعناه بما يرضيه والوسيلة
هي الفعلية من قول القائل توسلت إلى فلان بكذا بمعنى تقربت إليه
“তাঁর দিকে ওসীলা সন্ধান কর। এর অর্থ: তাঁর দিকে নৈকট্য সন্ধান কর,অর্থাৎ
যে কর্ম করলে তিনি সন্তুষ্ট হন তা করে। ওসীলা শব্দটি ‘তাওয়াস্সালতু’ কথা
থেকে ‘ফায়ীলাহ’ ওযনে গৃহীত ইসম। বলা হয় ‘তাওয়াস্সালতু ইলা ফুলান বি-কাযা,
অর্থাৎ আমি অমুক কাজ করে অমুকে নিকটবর্তী হয়েছি।”
এরপর ইমাম তাবারী বিভিন্ন জাহিলী কবির কবিতা উদ্ধৃৃৃত করে প্রমাণ করেন যে,
ওসীলা শব্দটির অর্থ নৈকট্য। অতঃপর তিনি সাহাবী ও তাবিয়ীগণ থেকে এ আয়াতের
ব্যাখ্যায় তাদের মতামত সনদ সহ উদ্ধৃত করেন। সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস
(রা), তাবিয়ী আবূ ওয়ায়িল, আতা ইবনু আবি রাবাহ, কাতাদাহ ইবনু দি‘আমাহ,
মুজাহিদ ইবনু জাবর, হাসান বাসরী, আব্দুল্লাহ ইবনু কাসীর, সুদ্দী আল-কাবীর,
ইবনু যাইদ, প্রমুখ মুফাস্সির থেকে তিনি উদ্ধৃৃৃত করেছেন যে, সকলেই বলেছেন
‘তাঁর ওসীলা সন্ধান কর’ অর্থ তাঁর নৈকট্য সন্ধান কর, অর্থাৎ তাঁর আনুগত্য ও
রেযামন্দিমূলক নেককর্ম করে তাঁর নৈকট্য ও মহব্বত লাভে সচেষ্ট হও।
দু‘আর মধ্যে ওসীলা
মহান আল্লাহর কাছে দু‘আর সময় কোনো কিছুর ‘দোহাই’ দেওয়াকে ‘ওসীলা’ বলে
আখ্যায়িত করা হয়। দু‘আর মধ্যে ‘বা’ (الباء) অব্যয়টি ব্যবহার করে দু‘আ চাওয়া
বিভিন্ন হাদীসে রয়েছে। এ অব্যয়টির অর্থ দ্বারা, সাহায্যে বা কারণে। যেমন
হাদীসে বর্ণিত বিভিন্ন দু‘আয় বলা হয়েছে: হে আল্লাহ, আপনার মহান নামগুলির
দ্বারা বা কারণে আমার দু‘আ কবুল করুন। আমি আপনার নামগুলি দ্বারা আপনার কাছে
দু‘আ করছি। আমার অমুক কর্মের দ্বারা বা কারণে আমার দু‘আ কবুল করুন…
ইত্যাদি। তবে এ অর্থে “হে আল্লাহ, অমুকের ওসীলায় (بوسيلة) কথাটি কোনো
হাদীসে ব্যবহৃত হয় নি। এ অর্থে আরবীতে ‘বিহাক্কি’ (بِحق) অর্থাৎ “অমুক কর্ম
বা ব্যক্তির অধিকারের কারণে বা দ্বারা’ এবং ‘বিহুরমাতি’ অর্থাৎ “অমুকের
সম্মানে’ কথাও ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলায় অনুবাদ হিসেবে এক্ষেত্রে ‘ওসীলা’
শব্দটির ব্যবহার ব্যাপক।
বিষয়টি আর একটু সহজভাবে বুঝার জন্য আমরা ওসীলাকে কয়েকভাবে ভাগ করে নিতে পারি।
(১) মহান আল্লাহর পবিত্র নাম ও গুণাবলির দোহাই দেওয়া।
(২ ) নিজের কোনো ভাল কর্মের দোহাই দেওয়া।
(৩) কারো দুআর দোহাই দেওয়া।
(৪) কারো ব্যক্তিগত মর্যাদা বা অধিকারের দোহাই দেওয়া।
প্রথমত: মহান আল্লাহর পবিত্র নাম ও গুণাবলির দোহাই দেওয়া।
যেমন বলা যে, হে আল্লাহ, আপনার রহমান নামের গুণে, বা গাফ্ফার নামের ওসীলায়
আমার দু‘আ কবুল করুন। এরূপ দোহাই দেওয়া কুরআন- হাদীসের নির্দেশ এবং দু‘আ
কবুল হওয়ার কারণ।
দিত্বীয়তঃ নিজের কোনো ভাল কর্মের দোহাই বা ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দু‘আ করা।
নিজের কোনো ভাল কর্মের দোহাই বা ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দু‘আ করলে কবুল হয়
বলে হাদীস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে। একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
অতীত যুগের তিনজন মানুষ বিজন পথে চলতে চলতে বৃষ্টির কারণে এক পাহাড়ের গুহায়
আশ্রয় গ্রহণ করে। প্রবল বর্ষণে একটি বিশাল পাথর গড়িয়ে পড়ে তাদের গুহার মুখ
একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে গুহাটি তাদের জীবন্ত কবরে পরিণত হয়। এ ভয়ানক
বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য তারা দু‘আ করতে মনস্থ করেন। এবং আল্লাহ তাদের
দোয়া কবুল করেন এবং পাথরটি সরে যায়।
অনুরূপভাবে নিজের ঈমান, মহব্বত ইত্যাদির ওসীলা দিয়ে দু‘আ চাওয়াও এ প্রকারের
ওসীলার অন্তর্ভক্ত । বুরাইদাহ আসলামী (রা) বলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ
(সা.)-এর সাথে মসজিদে প্রবেশ করে দেখেন এক ব্যক্তি সালাতরত অবস্থায় দু‘আ
করছে “হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করছি, এ ওসীলায় (এদ্বারা) যে,
আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি, আপনিই আল্লাহ, আপনি ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই। আপনিই
একক, অমুখাপেক্ষী, যিনি জন্মদান করেননি ও জন্মগ্রহণ করেননি এবং তাঁর
সমতুল্য কেউ নেই।”
তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন :“যার হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ করে বলছি,
নিশ্চয় এই ব্যক্তি আল্লাহর কাছে তাঁর ইসমু আ’যম ধরে প্রার্থনা করেছে, যে
নাম ধরে ডাকলে তিনি সাড়া দেন এবং যে নাম ধরে চাইলে তিনি প্রদান করেন।”
তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৫১৫; আবূ দাউদ, হাকিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে
সহীহ বলেছেন।
এখানে আমরা দেখছি যে, ঈমান ও শাহাদতের ওসীলা দিয়ে দু‘আ চাওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন ভাবে এরূপ দু‘আ করা যায়, যেমন: “হে আল্লাহ, আমি গোনাহগার, আমি অমুক
কর্মটি আপনার সন্তুষ্টির জন্য করেছিলাম, সেই ওসীলায় আমার প্রার্থনা কবুল
করুন।
তৃতীয়ত: কারো দু‘আর দোহাই দেওয়া।
কারো দু‘আর ওসীলা দেওয়ার অর্থ এ কথা বলা যে, হে আল্লাহ, অমুক আমার জন্য
দু‘আ করেছেন, আপনি আমার বিষয়ে তাঁর দু‘আ কবুল করে আমার হাজত পূরণ করে দিন।
নেককার মুত্তাকী মুমিনদের নিকট দু‘আ চাওয়া সুন্নাত সম্মত রীতি। এবং হাদীস
দ্বারা প্রমাণীত। হাদীসে আনাস ইবনু মালিক (রা) বলেন:
إِنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ كَانَ إِذَا قَحَطُوا اسْتَسْقَى
بِالْعَبَّاسِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ فَقَالَ اللَّهُمَّ إِنَّا كُنَّا
نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّنك فَتَسْقِينَا وَإِنَّا نَتَوَسَّلُ
إِلَيْكَ بِعَمِّ نَبِيِّنَا فَاسْقِنَا قَالَ فَيُسْقَوْنَ
“উমার (রা) যখন অনাবৃষ্টিতে আক্রান্ত হতেন তখন আব্বাস ইবনু আব্দুল
মুত্তালিবকে (রা) দিয়ে বৃষ্টির দু‘আ করাতেন, অতঃপর বলতেন: হে আল্লাহ আমরা
আমাদের নবী (সা.)-এর ওসীলায় আপনার নিকট প্রার্থনা করতাম ফলে আপনি আমাদের
বৃষ্টি দান করতেন। এখন আমরা আপনার নিকট প্রার্থনা করছি আমাদের নবী (সা.)-এর
চাচার ওসীলায়, অতএব আপনি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করুন। আনাস (রা) বলেন, তখন
বৃষ্টিপাত হতো।” বুখারী, আস-সহীহ ১/৩৪২, ৩/১৩৬০।
আব্বাস (রা) নিম্নের বাক্যগুলি বলে দু‘আ করলে আল্লাহ বৃষ্টি দিতেন:
اللهم إنه لم ينزل بلاء إلا بذنب ولم يكشف إلا بتوبة وقد توجه القوم بي
إليك لمكانى من نبيك وهذه أيدينا إليك بالذنوب ونواصينا إليك بالتوبة
فاسقنا الغيث
“হে আল্লাহ, পাপের কারণ ছাড়া বালা-মুসিবত নাযিল হয় না এবং তাওবা ছাড়া তা
অপসারিত হয় না। আপনার নবীর সাথে আমার সম্পর্কের কারণে মানুষেরা আমার
মাধ্যমে আপনার দিকে মুখ ফিরিয়েছে। এ আমাদের পাপময় হাতগুলি আপনার দিকে
প্রসারিত এবং আমাদের ললাটগুলি তাওবায় আপনার নিকট সমর্পিত, অতএব আপনি
আমাদেরকে বৃষ্টি দান করুন।” ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী, ২/৪৯৭।
এ হাদীসেও স্পষ্ট যে, আব্বাস (রা) বৃষ্টির জন্য দু‘আ করেছেন উমার (রা)
আব্বাসের (রা) দু‘আর ওসীলা দিয়ে দু‘আ করেছেন। তাঁর কথা থেকে বুঝা যায় যে,
যতদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) জীবিত ছিলেন, ততদিন খরা বা অনাবৃষ্টি হলে তাঁরা
রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে দু‘আ চাইতেন এবং সে দু‘আর ওসীলায় আল্লাহ তাদের
বৃষ্টি দান করতেন। তাঁর ওফাতের পরে যেহেতু আর তাঁর কাছে দু‘আ চাওয়া যাচ্ছে
না, সেহেতু তাঁর চাচা আব্বাসের (রা) কাছে দু‘আ চাচ্ছেন এবং দু‘আর ওসীলা
দিয়ে আল্লাহর কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা করছেন।
চতুর্থত: কোনো ব্যক্তি, তাঁর মর্যাদা বা অধিকারের দোহাই দেওয়া।
আল্লাহর কাছে দু‘আ করার ক্ষেত্রে ‘ওসীলা’ বা দোহাই দেওয়ার চতুর্ত পর্যায়
হলো, কোনো ব্যক্তির, বা তাঁর মর্যাদার বা তাঁর অধিকারের দোহাই দেওয়া। যেমন
জীবিত বা মৃত কোনো নবী-ওলীর নাম উল্লেখ করে বলা: হে আল্লাহ অমুকের ওসীলায়,
বা অমুকের মর্যাদার ওসীলায় বা অমুকের অধিকারের অসীলায় আমার দু‘আ কবুল করুন।
এরূপ দু‘আ করার বৈধতার বিষয়ে আলিমদের মধ্যে ব্যাপক মতভেদ রয়েছে। অনেক আলিম
এরূপ দু‘আ করা বৈধ বলেছেন। তাদের বর্ণনার সার-সংক্ষেপ যে, খলীফা হযরর
উসমান (রা)-এর সময়ে এক ব্যক্তি তাঁর দরবারে একটি প্রয়োজনে যায়। কিন্তু
খলীফা তার প্রতি দষ্টিৃপাত করেন না। লোকটি উসমান ইবনু হানীফের (রা) নিকট
গমন করে তাকে খলীফা উসমানের নিকট তার জন্য সুপারিশ করতে অনুরোধ করে। তখন
উসমান ইবনু হানীফ লোকটিকে একটি দোয়া শিখিয়ে দেন, যা রাসূল সাঃ এর এক অন্ধ
ছাহাবী অন্ধত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য রাসূল সাঃ এর কাছে দোয়া চাইলে তিনি
তাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন। লোকটি এভাবে দু‘আ করার পরে খলীফা উসমান (রা) তার
প্রয়োজন মিটিয়ে দেন। দোয়াটি নি¤œরূপঃ
أَنَّ رَجُلا ضَرِيرَ الْبَصَرِ أَتَى النَّبِيَّ فَقَالَ ادْعُ اللَّهَ
أَنْ يُعَافِيَنِي قَالَ إِنْ شِئْتَ دَعَوْتُ وَإِنْ شِئْتَ صَبَرْتَ
فَهُوَ خَيْرٌ لَكَ قَالَ فَادْعُهْ قَالَ فَأَمَرَهُ أَنْ يَتَوَضَّأَ
فَيُحْسِنَ وُضُوءَهُ (فيحسن ركعتين) وَيَدْعُوَ بِهَذَا الدُّعَاءِ:
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ وَأَتَوَجَّهُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّكَ
مُحَمَّدٍ نَبِيِّ الرَّحْمَةِ، (يا محمد) إِنِّي تَوَجَّهْتُ بِكَ إِلَى
رَبِّي فِي حَاجَتِي هَذِهِ لِتُقْضَى لِيَ (يا محمد إني أَتَوَجَّهُ بِكَ
إلى اللهِ أَنْ يَقْضِيَ حَاجَتِيْ) (فَيُجْلِيْ لِيْ عَنْ بَصَرِي)
اللَّهُمَّ فَشَفِّعْهُ فِيَّ (وشَفِّعْنِي فِيْهِ) (اللهم شَفِّعْهُ فِيَّ
وَشَفِّعْنِيْ فِيْ نَفْسِيْ)
“একজন অন্ধ ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট আগমনে করে বলে, আমার জন্য
দু‘আ করুন, যেন আল্লাহ আমাকে সুস্থতা দান করেন। তিনি বলেন: তুমি যদি চাও
আমি দু‘আ করব, আর যদি চাও তবে সবর কর, সেটাই তোমার জন্য উত্তম। লোকটি বলে:
আপনি দু‘আ করুন। তখন তিনি তাকে নির্দেশ দেন, সে যেন সুন্দর করে ওযূ করে
(অন্য বর্ণনায়: এবং দু রাকাত সালাত আদায় করে) এবং এই দু‘আ করে: “হে আল্লাহ,
আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করছি এবং আপনার দিকে মুখ ফিরাচ্ছি (মনোনিবেশ
করছি) আপনার নবী মুহাম্মাদের দ্বারা, যিনি রহমতের নবী, হে মুহাম্মাদ, আমি
মুখ ফিরাচ্ছি (মনোনিবেশ করছি) আপনার দ্বারা আমার প্রতিপালকের দিকে আমার এ
প্রয়োজনটির বিষয়ে, যেন তা মেটানো হয়। (অন্য বর্ণনায়: যেন তিনি তা মিটিয়ে
দেন, যেন তিনি আমার দৃষ্টি প্রদান করেন।) হে আল্লাহ আপনি আমার বিষয়ে তার
সুপারিশ কবুল করুন (অন্য বর্ণনায়: আমার বিষয়ে তাঁর সুপারিশ কবুল করুন এবং
তাঁর জন্য আমার সুপারিশ কবুল করুন। অন্য বর্ণনায়: আমার বিষয়ে তাঁর সুপারিশ
কবুল করুন এবং আমার বিষয়ে আমার নিজের সুপারিশও কবুল করুন।)” তিরমিযী,
আস-সুনান ৫/৫৬৯; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৭০০, ১/৭০৭; হাকিম ও অন্যান্য
মুহাদ্দিসণ হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
এ হাদীসে অন্ধ লোকটি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট দু‘আ চেয়েছে। তিনি দু‘আ
করেছেন এবং তাকে শিখিয়ে দিয়েছেন তাঁর দু‘আর ওসীলা দিয়ে মহান আল্লাহর কাছে
নিজে দু‘আ করতে। লোকটি সেভাবে দু‘আ করেছে।
এ থেকে বুঝা যায় যে, শুধু রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দু‘আর ওসীলাই নয়, উপরন্তু তাঁর ইন্তেকালের পরেও তাঁর ওসীলা দিয়ে দু‘আ চাওয়াও বৈধ।
তবে রাসূলুল্লাহ (সা.) ছাড়া অন্য কোনো ফিরিশতা, নবী, সাহাবী, তাবিয়ী বা
ওলী-আল্লাহর ওসীলা দিয়ে দু‘আ চাওয়ার কোনো কথা কোনো হাদীসে বা
সাহাবী-তাবিয়ীগণের বক্তব্যে পাওয়া যায় না।
কোনো কোনো আলিম কেবলমাত্র রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ব্যক্তিসত্তার ওসীলা দিয়ে
আল্লাহর কাছে দু‘আ করা জায়েয বলেছেন। অন্য কারো ওসীলা দিয়ে দু‘আ চাওয়া
নাজায়েয বলেছেন। তাঁদের মতে, কারো মৃত্যুর পরেও তাঁর ওসীলা দিয়ে দু‘আ করা
জায়েয বলার পরে রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বাদ দিয়ে অন্য কারো ওসীলা দিয়ে দু‘আ
করা তাঁর সাথে বেয়াদবী ছাড়া কিছুই নয়।
পক্ষান্তরে অন্য অনেক আলিম কোনো জীবিত বা মৃত ব্যক্তির, তাঁর মর্যাদার বা
তাঁর অধিকারের দোহাই দিয়ে আল্লাহর কাছে দু‘আ করা অবৈধ ও নাজায়েয বলে গণ্য
করেছেন। তাঁরা বলেন যে, এরূপ কোনো জীবিত বা মৃত কারো ব্যক্তিসত্তার ওসীলা
দিয়ে দু‘আ চাওয়ার কোনোরূপ নযির কোনো সহীহ ও প্রসিদ্ধ হাদীসে বা
সাহাবী-তাবিয়ীগণের মধ্যে পাওয়া যায় না। এছাড়া নবীগণ ও যাদের নাম মহান
আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে জানিয়েছেন তাঁরা ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির বিষয়ে
সুনিশ্চিতভাবে কখনোই বলা যায় না যে, উক্ত ব্যক্তি আল্লাহর প্রিয় বা আল্লাহর
কাছে তাঁর কোনো বিশেষ মর্যাদা বা অধিকার আছে। সর্বোপরি তাঁরা উপরে
উল্লেখিত উমার (রা) কর্তৃক আব্বাসের ওসীলা প্রদানকে দলীল হিসেবে পেশ করেন।
যদি কারো দু‘আর ওসীলা না দিয়ে তাঁর সত্তার ওসীলা দেওয়া জায়েয হত তবে উমার
(রা) ও সাহাবীগণ কখনোই রাসূলুল্লাহ -কে বাদ দিয়ে আব্বাস (রা)-এর দোয়ার
ওসীলা পেশ করতেন না।
শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবী তাঁর ‘আল-বালাগুল মুবীন’ গন্থে উমার
(রা)-এর হাদীসটি উদ্ধৃত করে বলেন: “এই ঘটনায় প্রতীয়মান হয় যে, মৃত
ব্যক্তিকে অসিলা করা শরীয়ত বিরোধী। যদি শরীয়ত সিদ্ধ হইত হযরত ওমর (রা)
হুযুর ((সা.))-কে অসিলা করিয়াই দোআ করিতেন। কারণ, মৃত বা জীবিত যে কোন
ব্যক্তির চেয়েই হুযুর ((সা.))-এর ফযীলত সীমাহীন-অনন্ত। তাহই হযরত ওমর (রা)
এই কথা বলেন নাই যে, হে আল্লাহ, ইতি পূর্বে তো আমরা তোমার নবীকে অসীলা
করিয়া দোআ করিতাম। কিন্তু এখন তিনি আমাদের মধ্যে বিদ্যমান নাই তাই আমরা
তাঁহার রুহু মোবারককে অসিলা করিয়া তোমার কাছে আরযী বেশ করিতেছি। তাই কোন
মৃত ব্যক্তিকে অসিলা করা মোটেই বৈধ নহে।” এবং জীবিত ব্যক্তির ব্যক্তি
স্বত্তার ওসীলা দিয়ে দোয়া করার কথাও কোরান হাদীসে কোথাও পাওয়া যায় না। বরং
জীবিত ব্যক্তির দোওয়ার ওসীলা দিয়ে দোয়া করার কথা একাধিক হাদীসে পাওয়া যায়।
ইমাম আবূ হানীফা (রাহ), ইমাম আবূ ইউসূফ (রাহ) ও ইমাম মুহাম্মাদ (রাহ) সকলেই
একমত যে কারো অধিকার বা মর্যাদার দোহাই দিয়ে আল্লাহর কাছে দু‘আ চাওয়া
মাকরূহ। আল্লামা ইবনু আবিল ইয্য হানাফী বলেন:
قَالَ أَبُو حَنِيفَةَ وَصَاحِبَاهُ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ : يُكْرَهُ
أَنْ يَقُولَ الدَّاعِي: أَسْأَلُكَ بِحَقِّ فُلانٍ، أَوْ بِحَقِّ
أَنْبِيَائِكَ وَرُسُلِكَ ، وَبِحَقِّ الْبَيْتِ الْحَرَامِ ،
وَالْمَشْعَرِ الْحَرَامِ ، وَنَحْوِ ذَلِكَ
“ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) ও তাঁর সঙ্গীদ্বয় বলেছেন: ‘আমি অমুকের অধিকার বা
আপনার নবী-রাসূলগণের অধিকার, বা বাইতুল হারামের অধিকার বা মাশ‘আরুল হারামের
অধিকারের দোহাই দিয়ে চাচ্ছি বা প্রার্থনা করছি’ বলে দু‘আ করা মাকরূহ।”
আল্লামা আলাউদ্দীন কাসানী (৫৮৭ হি) বলেন:
وَيُكْرَهُ لِلرَّجُلِ أَنْ يَقُولَ فِي دُعَائِهِ أَسْأَلُك بِحَقِّ
أَنْبِيَائِك وَرُسُلِك وَبِحَقِّ فُلانٍ لأنَّهُ لا حَقَّ لأحَدٍ عَلَى
اللَّهِ…
“‘আমি আপনার নবী-রাসূলগণের অধিকারের দোহাই দিয়ে চাচ্ছি এবং অমুকের অধিকারের
দোহাই দিয়ে চাচ্ছি বলে দু‘আ করা মাকরূহ; কারণ মহান আল্লাহর উপরে কারো কোনো
অধিকার নেই।
মুহতারাম ভাই, আপনার প্রশ্নের উত্তর প্রদানের পূর্বে বিষয়গুলো একটু
বিস্তারিত আলোচনা করলাম। আশা করছি আপনি আপনার প্রশ্রের উত্তর অনুধাবন করতে
পেরেছেন। উপরের আলোচনা থেকে দেখছি যে, আমাদের উচিত সর্বদা মহান আল্লাহর
পবিত্র নাম ও গুণাবলির ওসীলা দিয়ে দুআ করা। অনেক মাসনূন দুআয় এভাবে দুআ
করতে শেখানো হয়েছে। রাহে বেলায়াত বইটি পড়লে এরূপ অনেক দুআ শিখতে পারবেন।
উপরের আলোচনা্ থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে, জীবিত কোনো মানুষের ওসীলা দেওয়া
কয়েক প্রকার হতে পারে:
প্রথমত: জীবিত কোনো মানুষের দুআর ওসীলা দেওয়া্। যেমন আপনি কোনো ব্যক্তির
নিকট দুআ চেয়েছেন এবং তিনি দুআ করেছেন। আপনি মহান আল্লাহর কাছে বলবেন: হে
আল্লাহ, আপনার অমুক বান্দা আমার জন্য দুআ করেছেন। আপনি আমার বিষয়ে তার দুআ
কবুল করুন বা তার দুআর ওসীলায় আমার হাজত পূরণ করুন। এরূপ ওসীলা প্রদান বৈধ ও
সুন্নাহ সম্মত।
দ্বিতীয়ত: জীবিত কোনো মানুষের সাথে সংশ্লিষ্ট আপনার কোনো নেক আমলের ওসীলা
দেওয়। যেমন, হে আল্লাহ আমি অমুক ব্যক্তিকে আপনার জন্য ভালবাসি, অথবা আমি
আপনার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে অমুক ব্যক্তির অমুক কাজটি করেছি, আপনি সে
কর্মটির ওসীলায় আমার দুআ কবুল করুন। এরূপ ওসীলা প্রদান বৈধ ও সুন্নাত
সম্মত।
তৃতীয়ত: জীবতি কোনো ব্যক্তির ‘ব্যক্তিত্বের’, মর্যাদার বা অধিকারের ওসীলা
দেওয়া। যেমন বলা: হে আল্লাহ, অমুকের ওসীলায়, অমুকের অধিকারে অথবা অমুকের
মর্যাদার ওসীলায় আমার দুআ কবুল করুন। এরূপ ওসীলা দেওয়া সুন্নাহ বিরোধী ও
অবৈধ। মহান আল্লাহ আমাদেরকে সত্যকে জানার ও মানার তাওফীক প্রদান করুন।
আমীন।
জীবিত ব্যক্তির ওসীলা দিয়ে দোয়া করার বিধান
ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর
অধ্যাপক, আল-হাদীস বিভাগ,
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
চেয়ারম্যান, আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট