মুহাম্মদ হামিদুল ইসলাম আজাদ
রমাদান মাস সিয়াম সাধনা ও তাকওয়ার মাস, কল্যাণ ও বরকতের মাস, রহমত ও মাগফিরাত এবং জাহান্নামের অগ্নি থেকে মুক্তি লাভের মাস, ইসলাম বিরোধী মতবাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে মুক্তি লাভের মাস। মহান আল্লাহ এ মাসটিকে বহু ফযীলত ও মর্যাদা দিয়ে অভিষিক্ত করেছেন।
✔রমাদান আল-কুরআনের মাসঃ মহান আল্লাহ একে কুরআন নাযিলের মর্যাদাপূর্ণ সময়রূপে চয়ন করেছেন। তিনি বলেন, “রমাদান মাস - এতে কুরআন নাযিল হয়েছে।” সূরা আল-বাকারাহ: ১৮৫
✔ এ মাসে জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত রাখা হয়ঃ জাহান্নামের দ্বারসমূহ রুদ্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তান ও দুষ্ট জিনদের শৃংখলিত করে রাখা হয়। নবী সাঃ বলেন, “রমাদ্বান মাস এলে জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত রাখা হয় জাহান্নামের দ্বারসমূহ রুদ্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানদের শৃংখলিত করা হয়। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮০০,৩১০৩ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৫৪৭)
✔ এ মাসে রয়েছে লাইলাতুল ক্বদেরর ন্যায় বরকতময় রজনীঃ মহান আল্লাহ বলেন,‘লাইলাতুল ক্বদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ রাত্রে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হন প্রত্যেক কাজে, তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিময় এ রজনী, ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত।”সূরা আল-ক্বদরঃ ৩-৫
✔ এ মাস দোআ কবুলের মাসঃ নবী সাঃ বলেন, “(রমাদানের) প্রতি দিন ও রাতে (জাহান্নাম থেকে) আল্লাহর কাছে বহু বান্দা মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। তাদের প্রত্যেক বান্দার দোআ কবুল হয়ে থাকে (যা সে রমাদান মাসে করে থাকে)।” (সহীহ সনদে ইমাম আহমদ কতৃক বর্ণিত, হাদীস নং ৭৪৫০)
ত্বাকওয়া অর্জনের এ মুবারক মাসে মুমিনদের উপর অর্পিত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, সৃষ্টি হয়েছে পুণ্য অর্জনের বিশাল সুযোগ এবং প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে মহান চরিত্র অর্জনের সুন্দর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। এ অর্পিত দায়িত্ব পালন এবং সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আজ সারা বিশ্বের মুসলিমদের উচিত চারিত্রিক অধ:পতন থেকে নিজেদের রক্ষা করা, নেতিয়ে পড়া চেতনাকে জাগ্রত করা এবং সকল প্রকার অনাহূত শক্তির বলয় থেকে মুক্ত হয়ে হক প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞাকে সুদৃঢ় করা, যাতে তারা রিসালাতের পবিত্র দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারে এবং কুরআন নাযিলের এ মাসে কুরআনের মর্ম অনুধাবন করতে পারে, তা থেকে হিদায়াত লাভ করতে পারে এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে একেই অনুসরণের একমাত্র মত ও পথ রূপে গ্রহণ করতে পারে।
পবিত্র রমাদান মাসে যেসব দায়িত্ব ও কাজ শরীয়ত কর্তৃক অর্পিত হয়েছে কিংবা যা পালনে শরীয়ত আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে ও যা বর্জন করতে নির্দেশ দিয়েছে, পবিত্র আল কুরআন ও সহীহ্ হাদীসের আলোকে সেগুলো নিচে আমরা আলোচনা করব ।
✔ যা করতে শরীয়ত নির্দেশ দিয়েছে এবং উদ্বুদ্ধ করেছে সেগুলো নিম্নরূপ:
✔ সিয়াম বা রোযা পালন করাঃ রমাদান মাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজই হল সিয়াম। আর সিয়াম হল ফজরের উদয়লগ্ন থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়্যাতসহ পানাহার ও যৌন মিলন থেকে বিরত থাকা । সিয়াম পালন তথা রোযা ফরয এবং এটি ইসলামের অন্যতম একটি রুকন। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমদের উপর রোযা ফরয করে দেয়া হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার - নির্দিষ্ট কয়েকদিন মাত্র ......।” সূরা আল-বাকারাহ: ১৮৩-১৮৪
অন্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন, “সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে, তারা যেন এ মাসে রোযা পালন করে ।” সূরা আল-বাকারাহ: ১৮৫
রোযার গুরুত্ব আরো প্রকটিত হয় সে সব ফযীলতের দ্বারা, যা দ্বারা একে বিশেষত্ব দান করা হয়েছে। সে সবের মধ্যে রয়েছেঃ
✔ রোযার পুরস্কার আল্লাহ স্বয়ং নিজে প্রদান করবেনঃ একটি হাদীসে কুদসীতে রাসূল সাঃ বলেন, আল্লাহ বলেন, “বনী আদমের সকল আমল তার জন্য, অবশ্য রোযার কথা আলাদা, কেননা রোযা আমার জন্য এবং আমিই এর পুরস্কার দিব ।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮০৫, ৫৫৮৩ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭৬০)
✔ রোযা রাখা গোনাহের কাফফারা স্বরূপ এবং ক্ষমালাভের কারণঃ রাসূল সাঃ বলেন, “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রমাদান মাসে রোযা রাখবে, তার পূর্বের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে ।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯১০ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৮১৭)
✔ রোযা জান্নাত লাভের পথঃ রাসূল সাঃ বলেন, “জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে যাকে বলা হয় ‘রাইয়ান’-কিয়ামতের দিন এ দরজা দিয়ে সায়িমগণ প্রবেশ করবে। অন্য কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না.....সায়িমগণ প্রবেশ করলে এ দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে আর কেউ সেখান দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৭৯৭ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭৬৬)
✔ সায়িমের জন্য রোযা শাফায়াত করবেঃ উত্তম সনদে ইমাম আহমাদ ও হাকেম বর্ণনা করেন যে, রাসূল সাঃ বলেছেন, “রোযা এবং কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য শাফায়াত করবে। রোযা বলবে, হে রব! আমি তাকে দিবসে পানাহার ও কামনা চারিতার্থ করা থেকে নিবৃত্ত রেখেছি। অতএব, তার ব্যাপারে আমাকে শাফায়াত করার অনুমতি দিন....।” (মুসনাদ, হাদীস নং ৬৬২৬, আল-মুস্তাদরাক, হাদীস নং ২০৩৬)
✔ সায়িমের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মিসকের সুগন্ধির চেয়েও উত্তমঃ রাসূল সাঃ বলেন, “যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ তার শপথ! সায়িমের মুখের গন্ধ কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে মিসকের চেয়েও সুগন্ধিময় ।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৯৪ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭৬২)
✔ রোযা ইহ-পরকালে সুখ-শান্তি লাভের উপায়ঃ রাসূল সাঃ বলেন, “সায়িমের জন্য দু’টো খুশীর সময় রয়েছে। একটি হলো ইফতারের সময় এবং অন্যটি স্বীয় প্রভু আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার সময়।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮০৫ ও সহীহ মুসলিম, হদীস নং ২৭৬৩)।
✔ রোযা জাহান্নামের অগ্নি থেকে মুক্তিলাভের ঢালঃ রাসূল সাঃ বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় একদিন রোযা রাখে, আল্লাহ তাকে জাহান্নাম থেকে সত্তর বৎসরের দূরত্বে নিয়ে যান।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৬৮৫ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭৬৭)
ইমাম আহমাদ বিশুদ্ধ সনদে বর্ণনা করেন-রাসূল সাঃ বলেন, “রোযা ঢাল স্বরূপ-যদ্বারা বান্দা নিজেকে আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষা করতে পারে, যেভাবে তোমাদের কেউ একজন যুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করে।” (মুসনাদ, হাদীস নং ১৭৯০৯)
রোযার আরো ফযীলতের মধ্যে রয়েছে - এতে ইচ্ছা ও সংকল্পে দৃঢ়তা সৃষ্টি হয়, চারিত্রিক মহত্ব অর্জিত হয়, শারীরিক ও মানসিক প্রশান্তি লাভ করা যায় এবং সর্বোপরি তা মুসলিম উম্মাহ একতাবদ্ধ হওয়ার এক বাস্তব নিদর্শন ।
সিয়ামের সাথে সংশ্লিষ্ট আমলসমূহঃ
✔ রোযার নিয়্যাতঃ রাতেই রোযার নিয়্যাত করতে হবে। সুনান আন-নাসাঈ গ্রন্থে বিশুদ্ধ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাঃ বলেন, “যে ব্যক্তি ফজর উদয়ের পূর্বে, রাতেই রোযার নিয়্যাত করে না, তার রোযা হবে না।” (সুনান আন-নাসাঈ, হাদীস নং ২৩৩২)
আরবীতে নিয়্যাত মুখে উচ্চারণ করে পড়তে হবে না। বরং মনে মনে সংকল্প করলেই হবে।
✔ দেরী করে সেহেরী খাওয়াঃ সেহেরী খাওয়া একটি বরকতময় বৈশিষ্ট্য যা আল্লাহ এ উম্মাতকে দান করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেন,‘আমাদের রোযা ও আহলে কিতাবের রোযার মধ্যে পার্থক্য হলো সেহেরী খাওয়া।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৬০৪)
সেহেরী বরকতময় হওয়ার প্রমাণ নবী সাঃ এর বাণী, “তোমরা সেহেরী খাও, কেননা সেহেরীতে রয়েছে বরকত।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮২৩ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৬০৩)
দেরী করে সেহেরী খাওয়ার দলীল হল, আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু যায়েদ বিন সাবেত রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, “আমরা নবী সা:-এর সাথে সেহেরী খেয়েছি। অত:পর তিনি সালাতে দাঁড়ালেন।” আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু তখন জিজ্ঞাসা করলেন, আযান ও সেহেরীর মধ্যে কতটুকু সময়ের পার্থক্য ছিল? যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, “পঞ্চাশটি আয়াত পরিমাণ ।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮২১ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৬০৬)
✔ তাড়াতাড়ি ইফতার করাঃ সূর্য অস্ত যাওয়া নিশ্চিত হলে তাড়াতাড়ি ইফতার করা সায়িমের জন্য মুস্তাহাব। রাসূল সা:-বলেন, “মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত কল্যাণের উপর থাকবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা অনতিবিলম্বে ইফতার করবে।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৮৫৬ ও সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৬০৮)
✔ কি দিয়ে ইফতার করবেঃ আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী সা:-‘রুতাব’ (শুকনা নয় এমন) খেজুর দিয়ে সালাতের আগে ইফতার করতেন, রুতাব পাওয়া না গেলে শুকনা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। তাও পাওয়া না গেলে তিনি কয়েক ঢোক পানি পানে ইফতার করতেন।” (উত্তম সনদে ইমাম আহমাদ, হাদীস নং ১২৬৭৬ ও আবু দাউদ, হাদীস নং ২৩৫৬)
✔ সায়িমকে ইফতার করানোঃ সহীহ সনদে তিরমিযী ও আহমাদ বর্ণনা করেন যে, নবী সা:- বলেন, “যে ব্যক্তি কোন সায়িমকে ইফতার করায়, সে উক্ত সায়িমের সাওয়াবের কোনরূপ ঘাটিত না করেই তার সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করবে।” (সুনান তিরমিযী, হাদীস নং ৮০৭ ও মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ১৭০৩৩)
লেখকঃ মুহাম্মদ হামিদুল ইসলাম আজাদ
চেয়ারম্যানঃ বাংলাদেশ ইসলামিক রির্চাস সেন্টার
মোবাইলঃ ০১৭৪২৩৪৪১০৭