আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর আনুগত্য করার আদেশ দিয়েছেন। একজন মুসলমানের মূল কাজ হচ্ছে আল্লাহর আদেশ মেনে চলা এবং নিষেধ থেকে বিরত থাকা; চাই সেই আদেশ-নিষেধের হিকমত (অন্তর্নিহিত তত্ত্ব ও কারণ) প্রকাশিত হোক বা না হোক। হিকমত প্রকাশ না হওয়া বা নাজানার অজুহাতে কোন মুসলমানের জন্য শরিয়তের কোন বিধানকে অবজ্ঞা করা জায়েয নয়।
পবিত্র কুর’আনে ইরশাদ হয়েছেঃ
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْراً أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلالاً مُبِيناً ) الأحزاب/36
অর্থাৎ, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যখন কোন বিষয়ে ফায়সালা করেন তখন কোন মুমিন নর-নারীর জন্য তাতে নিজস্ব ইচ্ছাধিকার (প্রয়োগের) সুযোগ নেই। আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হল সে পরিষ্কার পথভ্রষ্টতার শিকার হল”।(সূরা আহযাবঃ৩৬)
পবিত্র কুর’আনে শূকরের মাংশ স্পষ্টভাবে হারাম করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছেঃ
( إِنَّمَا حَرَّمَ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةَ وَالدَّمَ وَلَحْمَ الْخِنْزِيرِ )
অর্থাৎ, তিনি তোমাদের জন্য মৃতপ্রাণী,রক্ত ও শূকরের মাংশ হারাম করেছেন”(সূরা বাকারাঃ১৭৩)।
তাই কোন মুসলমানের জন্য কোন অবস্থাতেই শূকরের মাংশ গ্রহন করা বৈধ নয়।(তবে খাদ্যাভাবে মরনাপন্ন অবস্থায় জীবন বাচানোর স্বার্থে সামান্য গ্রহনের অনুমতি রয়েছে)।
কুর’আনে শূকর হারাম হওয়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে এটি “রিজ্স”( فَإِنَّهُ رِجْس )। মানুষের সুস্থ বিবেক ও শরিয়ত কর্তৃ্ক নিন্দনীয় যে কোন জিনিসকে আরবীতে “রিজস” বলা হয়। শূকরের মাংশ হারাম হওয়ার কারণ হিসেবে এটিই যথেষ্ট। এছাড়াও খাদ্য-পানীয়জাতীয় বস্তু হালাল বা হারাম হওয়ার জন্য যে সাধারণ মূলনীতি ঘোষণা করা হয়েছে তার আলোকেও শূকরের মাংশ হারামের আওতায় পড়ে। ইরশাদ হয়েছেঃ
( وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ )
অর্থাৎ, তিনি (আল্লাহ) তাদের জন্য উত্তম জিনিস হালাল করেছেন আর খাবাইস (নিকৃষ্ট জিনিস) হারাম করেছেন”,(সূরা আ’রাফঃ ১৫৭)।
এখানে ”খাবাইস” দ্বারা ওই সমস্ত জিনিস উদ্দেশ্য করা হয়েছে যা মানুষের শারিরিক,মানসিক,চারিত্রিক বা আর্থিক ক্ষতিসাধন করে। সুতরাং যে জিনিসই মানুষের জন্য কোন ক্ষতিকর ফল বয়ে আনে তাই “খাবাইস”র অন্তর্ভুক্ত হবে।
মুসলমান হিসাবে আমরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি যে ইসলামী শরিয়তের কোন বিধানই ‘হিকমত’ থেকে খালি নয়।(তবে তা মানুষের ক্ষুদ্র আকলে বুঝে আসুক বা না আসুক সেটা ভিন্ন প্রসংগ)। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমত এইযে, ১৪০০ বছর আগে আরবের মরূভূমি থেকে আল্লাহর নবী মানুষের জীবনসংশ্লিষ্ট যে সকল বিধান প্রচার করেছেন তার অধিকাংশের সত্যতা আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে। শূকরের মাংশ মানুষের জন্য কী ধরণের ক্ষতিকর তার কিছু বিবিরণ নিম্নে উল্লেখ করছি।
অমুসলিম গবেষক ও চিকিৎসকদের মতামতঃ
১= প্রাচীন চীনের স্বনামধন্য চিকিৎসক চাং চি মাও (যিনি ততকালীন রাজপরিবারের সন্তান ছিলেন এবং তাকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন) তাঁর বইয়ে লিখেনঃ ” শূকরের মাংশ সুস্থতা লাভের পর মানুষের শরিরে পূনরায় রোগের প্রত্যাবর্তনে সাহায্য করে। এছাড়াও Asthma (হাপানি রোগ) ও বন্ধ্যত্ব সৃষ্টি করে”।
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান তাঁর এ বক্তব্যের অকাট্যভাবে সমর্থন দিয়েছে।
২= চীনের রাজপরিবারের আরেকজন চিকিৎসক লি সুন চাং (যিনি তাঁর গোটা জীবন চিকিতসাবিষয়ক গবেষণায় ব্যয় করেছেন এবং ৫০খন্ডে এর উপর কালজয়ী গ্রন্থ রচনা করেছেন যা চীনে সমধিক প্রসিদ্ধ গ্রন্থ) তিনি বলেনঃ ” শূকরের মাংশের গন্ধ অরূচিকর। এটি রান্নার সময় এক ধরণের ঘন পদার্থ বের হয় যা মানুষের শরিরে বিষাক্ত ক্রিয়া সৃষ্টি করে”।
৩= সাম্প্রতিক সময়ের প্রসিদ্ধ চিকিৎসক Sean John তাঁর ” মাংশ খাওয়ার সমস্যা” নামক বইয়ে লিখেনঃ” শূকরের মাংশ খাওয়ার দরুণ স্মৃতিশক্তি লোপ পায় এবং মাথার চুল ঝড়ে পড়ে”।
আধুনিক চিকিতসাবিজ্ঞানও এটা স্বীকার করে যে শূকরের মাংশ খাওয়া মাথায় টাক হওয়ার অন্যতম কারণ।
৪= Dr. Glen Shepherd ওয়াশিংটন পোস্ট ৩১মে ১৯৫২ তে the dangers of eating pork শিরোনামে এক নিবন্ধে বলেনঃ. “One in six people in USA and Canada have germs in their muscles – trichinosis 8 from eating pork infected with trichina worms. Many people so infected have no symptoms. Most of those, who do have, recover slowly. Some die; some are reduced to permanent invalids. All were careless pork caters”
“আমেরিকা ও কানাডায় প্রতি ছয়জনে একজন তাদের মাংশপেশিতে বিভিন্ন জিবাণুতে আক্রান্ত। শূকরের মাংশ খাওয়ার দরুণ (তাদের গায়ে) এক ধরণের কীট সংক্রামিত হয়। কিন্তু তাদের অধিকাংশই এই রোগের উপসর্গ ধরতে পারেনা। আক্রান্তদের কেউ কেউ খুব ধীরলয়ে সুস্থ হয়, কেউ মারা যায়, কেউ বা স্থায়ী কোন দুর্যোগের শিকার হয়। এ রোগে আক্রান্তদের সকলেই শূকরের মাংশভোগী”।
তিনি আরো বলেনঃ এদের কারোর মধ্যেই এ রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা থাকেনা। কেননা এন্টিবায়টিক,ভ্যাকসিন বা অন্য কোন ঔষধ এই প্রাণঘাতী কীটগুলোর উপর কোন ক্রিয়া সৃষ্টি করেনা। এই রোগ উপশমের একমাত্র পথ হল শূকরের মাংশ খাওয়া থেকে বিরত থাকা।
মাংশপেশিতে জন্ম নেয়া এই কীট সংখ্যায় হাজার হাজার বৃ্দ্ধি পায় এবং চল্লিশ বছর পর্যন্ত বাঁচে। এই রোগ সনাক্তকরণ খুব দুঃসাধ্য, কেননা এর উপসর্গ প্রায় ৫০টি রোগের উপসর্গের সদৃশ।
এই উক্তিগুলোর পাশাপাশি মেডিকেল-সাইন্সের বইয়ে শূকরের মাংশ থেকে উৎপন্ন বিভিন্ন রোগের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।
শূকরের প্রকৃতিঃ
শূকর সৃষ্টিগতভাবে অলস, অকর্ম ও যৌনকাতর একটি প্রাণী। সে সূর্যের আলো পছন্দ করেনা। তার মধ্যে দৃঢ়তা, লড়াই করার স্পৃহা এমনকি আত্মরক্ষার ইচ্ছাটুকুও নেই। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে এই অলসতা বাড়তে থাকে। মল-মূত্র-বিষ্ঠাসহ যাবতীয় নিকৃষ্ট বস্তু সে খায়। অসম্ভব নোংরা ও ময়লা জায়গায় থাকতে ভালবাসে। শূকরের অন্যতম খারাপ দিক হল সে বিকৃত যৌনমানসিকতাসম্পন্ন একটি প্রাণী। এছাড়া সকল প্রাণীকূলের মধ্যে শূকর হচ্ছে সর্বাধিক রোগজীবাণুবিশিষ্ট প্রাণী।
আমরা জানি যে খাদ্য মানুষের শারিরিক-মানসিক গঠনে প্রভাব ফেলে। সেদিক থেকে চিন্তা করলে দেখতে পাই যে শূকরের মধ্যে এমন কোন গুণ নেই যা মানুষের জন্য মঙ্গলজনক; বরং মানবসভ্যতার অধপতনের যে জোয়ার পশ্চিমা দেশগুলোতে বইছে এবং বিভিন্ন মরণব্যাধি হয়ে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে তার গোড়ায় আল্লাহর এই নিষিদ্ধ বস্তুর প্রভাব কম নয়।
উল্লেখ্য, স্বভাবতই অনেকের মনে প্রশ্ন জাগবে যে এত কিছুর পর তাহলে ক্ষতিকর এই প্রাণী (বা এজাতীয় প্রাণী )সৃষ্টির রহস্য কি? এর উত্তরে আমরা এটাই বলব যে এই ভূমন্ডল-নভোমন্ডল ও তাতে অবস্থিত সবকিছুর এক, অদ্বিতীয় স্রষ্টা হলেন আল্লাহ। { وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ فَقَدَّرَهُ تَقْدِيراً }الفرقان2 তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেককে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট দান করেছেন। তার এই সৃষ্টি-বৈচিত্রের নিগূঢ় রহস্য উদঘাটন মানুষের সাধারণ বিবেকের উর্ধ্বের বিষয়। তাই সেই তত্ত্ব বিশ্লেষণে কালক্ষেপন না করে এই মহান স্রষ্টার একনিষ্ঠ ইবাদতে মগ্ন হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
তথ্যসূত্রঃ حكمة وأسباب تحريم لحم الخنزير في العلم والدين. د/سليمان قوش
(দ্বীন ও বিজ্ঞানের আলোকে শূকরের মাংশ হারাম হওয়ার কারণঃ ডাঃ সুলাইমান কাওয়াশ)