অনেক ধার্মিক ও ইসলামপ্রেমিক মানুষ রাসূলুলাহ সাঃ ও তাঁর সাহাবীগণের অনুরূপ
আত্মিক অবস্থা অর্জনে একেবারেই আগ্রহী নন। অনেকেই মোটামুটি দ্বীনের মৌলিক
বিধিবিধান পালন করলেও সর্বদা বেশি বেশি নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য
অর্জনে অবহেলা করেন। আমাদের হৃদয়ের কাঠিন্য দূরকরার চেষ্টাও আমরা করি না।
সাধারণত আমরা আমাদের কর্মে সন্তুষ্ট। আমরা আমাদেরকে ভালো মনে করি, অন্যান্য মানুষদের চেয়ে আল্লাহর পথে বেশি অগ্রসর মনে করি। আল্লাহ যদি কাউকে কিছু নেক আমল করার তাওফীক দান করেন তাহলে তার জন্য আল্লাহর শুকরিয়া ও স্থায়িত্বের দোয়া না করে উক্ত আমলকে নিজের কৃতিত্ব মনে করে নিজের উপর খুশি ও সন্তুষ্ট হই এবং নিজেকে অন্যান্য দ্বীনদার মানুষের চেয়ে উত্তম মনে করে অহংকারে নিপতিত হই।
রাসূলুলাহ সাঃ ও তাঁর সাহাবীগণ যেখানে অবিরত অঝোরে কেঁদেছেন সেখানে আমরা দুই একবারও কাঁদার কথা চিন্তা করি না। করবই বা কেন? আমরা তো মনে করি যে, আমাদের জন্য জান্নাত নিশ্চিত। আমরা হয়ত ভাবি, আমাদের তো কোনো গোনাহ নেই, যত গোনাহ তো অন্য মানুষেরা করেন। এজন্য আমরা দু’জন ধার্মিক মানুষ একত্রিত হলে নিজেদের গোনাহের কথা স্মরণ করি না, বরং অন্য মানুষদের গোনাহের সমালোচনা করি। আমরা হয়ত মনে করি, আমাদের এত নেক আমল কবুল না করে আল্লাহর কি উপায় আছে ! আল্লাহ ক্ষমা করেন। সাহাবীগণের হৃদয়ের অবস্থা দেখুন। তাবেয়ী সাঈদ ইবনু হাইয়ান বলেন:
আব্দুলাহ ইবনু উমর ও আব্দুলাহ ইবনু আমর (রা.) আনহুম দু’জনে একত্রিত হন। পরে আব্দুলাহ ইবনু উমর (রা.) কাঁদতে কাঁদতে আসেন। সমবেত মানুষেরা প্রশ্ন করেন : আপনি কাঁদছেন কেন? তিনি বলেন : ইনি (আব্দুলাহ ইবনু আমর) আমাকে বললেন যে, তিনি রাসূলুলাহ সাঃ -কে বলতে শুনেছেন : “যদি কোনো মানুষের মনে শরিষার দানা পরিমাণ অহংকার থাকে তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।” (এ কথা শুনে আমি জাহান্নামের ভয়ে কাঁদছি।) (মুসনাদে আহমদ ৬২৪০)
এই ছিল সাহাবীগণের হৃদয়ের অবস্থা। যারা সকলেই জান্নাতের নিশ্চিত সুসংবাদ কুরআনের ওহীর মাধ্যমে পেয়েছেন, তাঁরাও গোনাহের ভয়ে, শাস্তির ভয়ে, ইবাদত কবুল না হওয়ার ভয়ে কেঁদেছেন। আমাদের অবস্থা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। আত্মশুদ্ধি, আল্লাহর প্রেম ও ভয়ে ক্রন্দন ইত্যাদি আমাদের জীবনে অনুপস্থিত। এমনকি যাঁরা আত্মশুদ্ধির নামে কিছু যিকির ওযীফা, পীরমুরিদী, আনুষ্ঠানিক ক্রন্দন ইত্যাদি পালন করছি তাঁরাও আত্মশুদ্ধির নামে দলাদলি, বিদ্বেষ ও অহংকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছি। অথচ আত্মশুদ্ধির মূল হলো এগুলি থেকে হৃদয়গুলিকে পবিত্র করা। অহঙ্কার সকল ক্ষেত্রেই ধ্বংসাত্মক। তবে তা যদি আত্মশুদ্ধি, ধর্মপালন, দ্বীনের দাওয়াত, দ্বীন প্রতিষ্ঠা বা আল্লাহর ইবাদত কেন্দ্রিক হয় তাহলে তা আরো বেশি ক্ষতিকারক। নিজেকে ভালো দ্বীনদার মনে করা শয়তানের অন্যতম চক্রান্ত। সাথে সাথে যদি নিজেকে অন্য কোনো মুসলমানের চেয়ে বেশি দ্বীনদার মনে করা হয় তাহলে ধ্বংসের ষোলকলা পূর্ণ হয়।
পাঠক হয়ত প্রশ্ন করবেন, ধর্ম পালনে তো কম-বেশি আছেই। আমি দাড়ি রেখেছি, আরেকজন রাখেনি। আমি যিকির করি অথচ সে করে না। আমি বিদ‘আত মক্তু , অথচ অমুক বিদ‘আতে জড়িত। আমি সুন্নাত পালন করি কিন্তু অমুক করে না। আমি ইসলামের দাওয়াত, প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখেছি অথচ আমার আরেক ভাই শুধুমাত্র নামায রোযা পালন করেই আরামে সংসার করছেন। এখন কি আমি ভাবব যে, আমি ও সে সমান বা আমি তার চেয়ে খারাপ ? তাহলে আমার এত কষ্টের প্রয়োজন কি ?
প্রিয় পাঠক, বিষয়টি ভুল খাতে চলে গেছে। প্রথমত, আমি যা কিছু করেছি সবই আল্লাহর দয়া, রহমত ও তাওফীক হিসাবে তাঁর দরবারে শুকরিয়া জানাতে হবে এবং এই নেয়ামতের স্থায়িত্বের জন্য সকাতরে দোয়া করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, যে ভাই এ সকল নেয়ামত পাননি তার জন্য আন্তরিকতার সাথে দোয়া করতে হবে, যেন আল্লাহ তাকেও এ সকল নেয়ামত প্রদান করেন এবং আমরা একত্রে আল্লাহর জান্নাতে ও রহমতের মধ্যে থাকতে পারি।
তৃতীয়ত, আমাকে খুব বেশি করে বুঝতে হবে যে, আমি যা কিছু করছি তা আমার প্রতি আল্লাহর নেয়ামতের তুলনায় খুবই কম। আমি কখনোই আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করতে পারিনি। কাজেই, আমার তৃপ্ত হওয়ার মতো কিছুই নেই।
চতুর্থত, আমাকে বার বার সজাগ হতে হবে যে, আমি জানি না আমার ইবাদত আল্লাহর দরবারে গ্রহণ হচ্ছে কি-না ? হয়ত আমার এ সকল ইবাদত বিভিন্ন ভুল ও অন্যায়ের কারণে কবুল হচ্ছে না, অথচ যাকে আমি আমার চেয়ে ছোট ভাবছি তার অল্প আমলই আল্লাহ কবুল করে নিয়েছেন, কাজেই কী-ভাবে আমি নিজেকে বড় ভাবব ?
পঞ্চমত, আমি জানি না, আমার কী পরিণতি ও তার কী পরিণতি ? হয়ত মৃত্যুর আগে সে আমার চেয়ে ভালো কাজ করে আমার চেয়ে অনেক বেশি মর্যাদা নিয়ে আল্লাহ দরবারে হাজিরা দেবে।
কেয়ামতের হিসাবনিকাশ শেষে জান্নাতে প্রবেশের আগে কখনো কোনো মুমিন নিশ্চিত হতে পারে না, নিজেকে অন্য কারো চেয়ে উত্তম বা বেশি ধার্মিক ভাবা তো দূরের কথা ! সাহাবী, তাবেয়ীগণ ও পূর্ববর্তী যুগের শ্রেষ্ঠতম বুজুর্গ ও নেককার মানুষেরা নিজেদেরেকে জীবজানোয়ারের চেয়ে উত্তম ভাবতে পারতেন না। তাঁরা বলতেন, কেয়ামতের বিচার পার হওয়ার পরেই বুঝতে পারব, আমি জানোয়ারের চেয়ে অধম না কি তাদের চেয়ে উত্তম।
আরেকটি বিষয় আমাদেরকে সমস্যায় ফেলে দেয়। আমরা জানি যে, শিরক, কুফর, বিদ‘আত, হারাম, পাপ ইত্যাদিকে ঘৃণা করা ও যারা এগুলিতে লিপ্ত বা এগুলির প্রচার প্রসারে লিপ্ত তাদেরকে ঘৃণা করা আমাদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ঈমানী দায়িত্ব। আমরা পাপকে ঘৃণা করার ও হৃদয়কে হিংসামুক্ত রাখার মধ্যে কিভাবে সমন্বয় সাধন করব? এই বিষয়টিকে শয়তান অন্যতম ফাঁদ হিসাবে ব্যবহার করে, যা দিয়ে সে অগণিত ধার্মিক মুসলিমকে হিংসা, হানাহানি, আত্মতৃপ্তি ও অহংকারের মতো জঘন্যতম কবীরা গোনাহের মধ্যে নিপতিত করছে। এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় আমাদের মনে রাখা উচিত,
প্রথমত, পাপ অন্যায়, জুলুম অত্যাচার, শিরক, কুফর, বিদ‘আত বা নিফাককে অপছন্দ ও ঘৃণা করতে হবে ; এবং তা করতে হবে রাসূলুলাহ সাঃ-এর অনুসরণে ও তাঁর প্রদত্ত গুরুত্ব অনুসারে। তিনি যে পাপকে যতটুকু ঘৃণা করেছেন, নিন্দা করেছেন বা যতটুকু গুরুত্ব দিয়েছেন ততটুকু গুরুত্ব দিতে হবে। তাঁর পদ্ধতি বা সু্ন্নাতের বাইরে মনগড়াভাবে ঘৃণা করলে তা হবে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ইসলামের নামে নিজের ব্যক্তি আক্রোশ বা অহংকারকে প্রতিষ্ঠা করা ও শয়তানের আনুগত্য করা।
এই ক্ষেত্রে বর্তমানে অধিকাংশ ধার্মিক মানুষ কঠিন ভুলের মধ্যে নিপতিত হন। কুরআন ও সুন্নাহে বর্ণিত কঠিন পাপগুলিকে আমরা ঘৃণা করি না বা বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করি না, কিন্তু যেগুলি কোনো পাপ নয় বা কম ভয়ঙ্কর পাপ সেগুলি নিয়ে প্রচণ্ড হানাহানি ও হিংসা বিদ্বেষে নিপতিত হই। একুট চিন্তা করলেই দেখতে পাবেন যে, আমাদের সমাজের ধার্মিক মুসলিমদের দলাদলি, হানাহানি, গীবতনিন্দা ও অহঙ্কারের ভিত্তি হলো নফল ইবাদত। আমরা কুফর, শিরক, হারাম উপার্জন, মানুষের ক্ষতি, সৃষ্টির অধিকার নষ্ট, ফরয ইবাদত ত্যাগ ইত্যাদি বিষয়ে তেমন কোনো আলোচনা, আপত্তি, বিরোধিতা বা ঘৃণা করি না। অথচ সু্ন্নাত নফল নিয়ে কীও ভয়ঙ্কর হিংসা ঘৃণার সয়লাব। ফরয সালাত যে মোটেও পড়ে না, তার বিষয়ে আমরা বেশি চিন্তা করি না, কিন্তু যে সুন্নাত সালাত আদায় করল না, বা সালাতের মধ্যে টুপি বা পাগড়ি পরল না, অথবা সালাতের শেষে মুনাজাত করল বা করল না, অথবা সালাতের মধ্যে হাত উঠালো বা উঠালো না ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আমরা হানাহানি ও অহঙ্কারে লিপ্ত রয়েছি।
দ্বিতীয়ত, এই ঘৃণা একান্তই আদর্শিক ও ঈমানী। ব্যক্তিগত জেদাজেদি, আক্রোশ বা শত্রুতার পর্যায়ে যাবে না। আমি পাপটিকে ঘৃণা করি। পাপে লিপ্ত মানুষটিকে আমি খারাপে লিপ্ত বলে জানি। তিনি যখন তা পরিত্যাগ করবেন তখন তিনি আমার প্রিয়জন হবেন। আমি তার জন্য দোয়া করি যে, আল্লাহ তাকে পাপ পরিত্যাগের তাওফীক দিন।
তৃতীয়ত, ঘৃণা ও বিরোধিতার অর্থ হিংসা নয়। ভালবাসার সাথে এই ঘৃণা একত্রিত থাকে। মা তার মলমূত্র জড়ানো শিশুকে দেখে নাক শিটকায় ও তাকে ঘৃণা করে। আপন ভাই তার অপরাধে লিপ্ত ভাইকে ঘৃণা করে। কিন্তু এই ঘৃণার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে থাকে ভালবাসা। মূলত ব্যক্তি শিশু বা ব্যক্তি ভাইকে ঘিরে থাকে তার সীমাহীন ভালবাসা, আর তার গায়ে জড়ানো ময়লা বা অপরাধকে ঘিরে থাকে ঘৃণা। সাথে থাকে তাকে ঘৃণিত বিষয় থেকে মুক্ত করার আকুতি।
চতুর্থত, ঘৃণা ও অহংকার এক নয়। আমি পাপকে ঘৃণা করি। পাপীকে অন্যায়কারী মনে করি। পাপের প্রসারে লিপ্ত ব্যক্তিকে ঘৃণা করি। কিন্তু এগুলির অর্থ এই নয় যে, আমি আমার নিজেকে ব্যক্তিগতভাবে অমুক পাপীর চেয়ে উন্নত, মুত্তাকী বা ভালো মনে করি। নিজেকে কারো চেয়ে ভালো মনে করা তো দূরের কথা নিজের কাজে তৃপ্ত হওয়াও কঠিন কবীরা গোনাহ ও ধ্বংসের কারণ। আমি জানি না যে, আমার ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হচ্ছে কি-না, আমি জানি না আমার পরিণতি কী আর উক্ত পাপীর পরিণতি কী, কিভাবে আমি নিজেকে অন্যের চেয়ে ভালো মনে করব?
পঞ্চমত, সবচেয়ে বড় কথা হলো, মুমিনকে নিজের গোনাহের চিন্তায় ও আল্লাহর যিকিরে ব্যস্ত থাকতে হবে। অন্যের কথা চিন্তা করা থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকতে হবে। আমরা অধিকাংশ সময় অন্যের শিরক, কুফর, বিদ‘আত, পাপ, অন্যায় ইত্যাদির চিন্তায় ব্যস্ত থাকি। মনে হয় আমাদের বেলায়াত, কামালাত, জান্নাত, নাজাত সবকিছু নিশ্চিত। এখন শুধু দুনিয়ার মানুষের সমালোচনা করাই আমার একমাত্র কাজ। বাঁচতে হলে এগুলি পরিহার করতে হবে। প্রয়োজন ছাড়া পাপ বা পাপীর চিন্তায় নিজের হৃদয়কে ব্যস্ত রাখা খুবই অন্যায়। এ চিন্তা আমাদের কঠিন ও আখেরাত বিধ্বংসী পাপের মধ্যে ফেলে দেয়। তা হলো আত্মতৃপ্তি ও অহঙ্কার। যখনই আমি পাপীর চিন্তা করি তখনই আমার মনে তৃপ্তি চলে আসে, আমি তো তার চেয়ে ভালো আছি। তখন নিজের পাপ ছোট মনে হয় ও নিজের কর্মে তৃপ্তি লাগে। আর এ হলো ধ্বংসের অন্যতম পথ।
হিংসামুক্ত পবিত্র হৃদয় অর্জন করাই হলো রাসূলুলাহ সাঃ -এর অন্যতম সুন্নাত। এই সুন্নাতকে প্রতিপালন ও জীবনদানের নির্দেশ তিনি বিশেষভাবে দিয়েছেন। আনাস ইবনু মালিক (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূলুলাহ সাঃ-কে বলতে শুনেছি : “বেটা, যদি সম্ভব হয় তাহলে এভাবে জীবনযাপন করবে যে, সকালে সন্ধ্যায় (কখনো) তোমার অন্তরে কারো জন্য কোনো ধোঁকা, বিদ্বেষ বা অমঙ্গল কামনা থাকবে না। অতঃপর তিনি বলেন : বেটা, এটা আমার সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। আর যে আমার সুন্নাতকে জীবিত করবে সে আমাকেই ভালবাসবে। আর যে আমাকে ভালবাসবে, সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে।”
হিংসা ও অহংকারমক্তু হৃদয় হলো জান্নাতের অন্যতম চাবিকাঠি। অন্য হাদীসে আনাস ইবনু মালিক (রা.) বলেন : “একদিন আমরা রাসূলুলাহ সাঃ এর কাছে বসে ছিলাম, এমতাবস্থায় তিনি বললেন : এখন তোমাদের এখানে একজন জান্নাতী মানুষ প্রবেশ করবেন। তখন একজন আনসারী মানুষ প্রবেশ করলেন, যাঁর দাড়ি থেকে ওযুর পানি পড়ছিল এবং তাঁর বাম হাতে তাঁর জুতাজুড়া ছিল। পরের দিনও রাসূলুলাহ সাঃ একই কথা বললেন এবং একই ব্যক্তি প্রবেশ করল। তৃতীয় দিনেও রাসূলুলাহ সাঃ প্রথম দিনের মতোই আবারো বললেন এবং আবারো একই ব্যক্তি প্রবেশ করল। তৃতীয় দিনে রাসূলুলাহ সাঃ মজলিস ভেঙ্গে চলে গেলে আব্দুলাহ ইবনু উমর উক্ত আনসারী ব্যক্তির পিছে পিছে যেয়ে বলেন, আমি আমার পিতার সাথে মন কষাকষি করেছি এবং তিন রাত বাড়িতে যাব-না বলে কসম করেছি। সম্ভব হলে এই কয় রাত আপনার কাছে থাকতে দিবেন কি ? তিনি রাজি হন। (আব্দুলাহর ইচ্ছা হলো তিন রাত তাঁর কাছে থেকে তাঁর ব্যক্তিগত ইবাদত জেনে সেই মতো আমল করা, যেন তিনিও জান্নাতী হতে পারেন)। তিনি তিন রাত তাঁর সাথে থাকেন, কিন্তু তাঁকে রাত্রে উঠে তাহাজ্জুদ আদায় করতে বা বিশেষ কোনো নফল ইবাদত পালন করতে দেখেন না। তবে তিন দিনের মধ্যে তাঁকে শুধুমাত্র ভালো কথা ছাড়া কারো বিরুদ্ধে কোনো খারাপ কথা বলতে শোনেননি। আব্দুলাহ বলেন, আমার কাছে তাঁর আমল খুবই নগণ্য মনে হতে লাগল। আমি বললাম : দেখুন, আমার সাথে আমার পিতার কোনো মনোমালিন্য হয়নি। তবে আমি পরপর তিনি দিন রাসূলুলাহ সাঃ-কে বলতে শুনলাম এখন একজন জান্নাতী মানুষ আসবেন এবং তিন বারই আপনি আসলেন। এজন্য আমি আপনার আমল দেখে সেইমতো আমল করার উদ্দেশ্যে আপনার কাছে তিন রাত্র কাটিয়েছি, কিন্তু আমি আপনাকে বিশেষ কোনো আমল করতে দেখলাম না! তাহলে কী কর্মের ফলে আপনাকে রাসূলুলাহ সাঃ জান্নাতী বললেন ? তিনি বললেন : তুমি যা দেখেছ এর বেশি কোনো আমল আমার নেই, তবে আমি আমার অন্তরের মধ্যে কোনো মুসলমানের জন্য কোনো অমঙ্গল ইচ্ছা রাখি না এবং আমি কোনো কিছুর জন্য কাউকে হিংসা করি না। তখন আব্দুলাহ বলেন : এই কর্মের জন্যই আপনি এই মর্যাদায় পৌঁছাতে পেরেছেন।” (মুসনাদে আহমদঃ ৩/১৬৬) উৎসঃ (এহইয়াউস সুনান: ৫০৮-৫১৩)
সাধারণত আমরা আমাদের কর্মে সন্তুষ্ট। আমরা আমাদেরকে ভালো মনে করি, অন্যান্য মানুষদের চেয়ে আল্লাহর পথে বেশি অগ্রসর মনে করি। আল্লাহ যদি কাউকে কিছু নেক আমল করার তাওফীক দান করেন তাহলে তার জন্য আল্লাহর শুকরিয়া ও স্থায়িত্বের দোয়া না করে উক্ত আমলকে নিজের কৃতিত্ব মনে করে নিজের উপর খুশি ও সন্তুষ্ট হই এবং নিজেকে অন্যান্য দ্বীনদার মানুষের চেয়ে উত্তম মনে করে অহংকারে নিপতিত হই।
রাসূলুলাহ সাঃ ও তাঁর সাহাবীগণ যেখানে অবিরত অঝোরে কেঁদেছেন সেখানে আমরা দুই একবারও কাঁদার কথা চিন্তা করি না। করবই বা কেন? আমরা তো মনে করি যে, আমাদের জন্য জান্নাত নিশ্চিত। আমরা হয়ত ভাবি, আমাদের তো কোনো গোনাহ নেই, যত গোনাহ তো অন্য মানুষেরা করেন। এজন্য আমরা দু’জন ধার্মিক মানুষ একত্রিত হলে নিজেদের গোনাহের কথা স্মরণ করি না, বরং অন্য মানুষদের গোনাহের সমালোচনা করি। আমরা হয়ত মনে করি, আমাদের এত নেক আমল কবুল না করে আল্লাহর কি উপায় আছে ! আল্লাহ ক্ষমা করেন। সাহাবীগণের হৃদয়ের অবস্থা দেখুন। তাবেয়ী সাঈদ ইবনু হাইয়ান বলেন:
আব্দুলাহ ইবনু উমর ও আব্দুলাহ ইবনু আমর (রা.) আনহুম দু’জনে একত্রিত হন। পরে আব্দুলাহ ইবনু উমর (রা.) কাঁদতে কাঁদতে আসেন। সমবেত মানুষেরা প্রশ্ন করেন : আপনি কাঁদছেন কেন? তিনি বলেন : ইনি (আব্দুলাহ ইবনু আমর) আমাকে বললেন যে, তিনি রাসূলুলাহ সাঃ -কে বলতে শুনেছেন : “যদি কোনো মানুষের মনে শরিষার দানা পরিমাণ অহংকার থাকে তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।” (এ কথা শুনে আমি জাহান্নামের ভয়ে কাঁদছি।) (মুসনাদে আহমদ ৬২৪০)
এই ছিল সাহাবীগণের হৃদয়ের অবস্থা। যারা সকলেই জান্নাতের নিশ্চিত সুসংবাদ কুরআনের ওহীর মাধ্যমে পেয়েছেন, তাঁরাও গোনাহের ভয়ে, শাস্তির ভয়ে, ইবাদত কবুল না হওয়ার ভয়ে কেঁদেছেন। আমাদের অবস্থা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। আত্মশুদ্ধি, আল্লাহর প্রেম ও ভয়ে ক্রন্দন ইত্যাদি আমাদের জীবনে অনুপস্থিত। এমনকি যাঁরা আত্মশুদ্ধির নামে কিছু যিকির ওযীফা, পীরমুরিদী, আনুষ্ঠানিক ক্রন্দন ইত্যাদি পালন করছি তাঁরাও আত্মশুদ্ধির নামে দলাদলি, বিদ্বেষ ও অহংকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছি। অথচ আত্মশুদ্ধির মূল হলো এগুলি থেকে হৃদয়গুলিকে পবিত্র করা। অহঙ্কার সকল ক্ষেত্রেই ধ্বংসাত্মক। তবে তা যদি আত্মশুদ্ধি, ধর্মপালন, দ্বীনের দাওয়াত, দ্বীন প্রতিষ্ঠা বা আল্লাহর ইবাদত কেন্দ্রিক হয় তাহলে তা আরো বেশি ক্ষতিকারক। নিজেকে ভালো দ্বীনদার মনে করা শয়তানের অন্যতম চক্রান্ত। সাথে সাথে যদি নিজেকে অন্য কোনো মুসলমানের চেয়ে বেশি দ্বীনদার মনে করা হয় তাহলে ধ্বংসের ষোলকলা পূর্ণ হয়।
পাঠক হয়ত প্রশ্ন করবেন, ধর্ম পালনে তো কম-বেশি আছেই। আমি দাড়ি রেখেছি, আরেকজন রাখেনি। আমি যিকির করি অথচ সে করে না। আমি বিদ‘আত মক্তু , অথচ অমুক বিদ‘আতে জড়িত। আমি সুন্নাত পালন করি কিন্তু অমুক করে না। আমি ইসলামের দাওয়াত, প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখেছি অথচ আমার আরেক ভাই শুধুমাত্র নামায রোযা পালন করেই আরামে সংসার করছেন। এখন কি আমি ভাবব যে, আমি ও সে সমান বা আমি তার চেয়ে খারাপ ? তাহলে আমার এত কষ্টের প্রয়োজন কি ?
প্রিয় পাঠক, বিষয়টি ভুল খাতে চলে গেছে। প্রথমত, আমি যা কিছু করেছি সবই আল্লাহর দয়া, রহমত ও তাওফীক হিসাবে তাঁর দরবারে শুকরিয়া জানাতে হবে এবং এই নেয়ামতের স্থায়িত্বের জন্য সকাতরে দোয়া করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, যে ভাই এ সকল নেয়ামত পাননি তার জন্য আন্তরিকতার সাথে দোয়া করতে হবে, যেন আল্লাহ তাকেও এ সকল নেয়ামত প্রদান করেন এবং আমরা একত্রে আল্লাহর জান্নাতে ও রহমতের মধ্যে থাকতে পারি।
তৃতীয়ত, আমাকে খুব বেশি করে বুঝতে হবে যে, আমি যা কিছু করছি তা আমার প্রতি আল্লাহর নেয়ামতের তুলনায় খুবই কম। আমি কখনোই আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করতে পারিনি। কাজেই, আমার তৃপ্ত হওয়ার মতো কিছুই নেই।
চতুর্থত, আমাকে বার বার সজাগ হতে হবে যে, আমি জানি না আমার ইবাদত আল্লাহর দরবারে গ্রহণ হচ্ছে কি-না ? হয়ত আমার এ সকল ইবাদত বিভিন্ন ভুল ও অন্যায়ের কারণে কবুল হচ্ছে না, অথচ যাকে আমি আমার চেয়ে ছোট ভাবছি তার অল্প আমলই আল্লাহ কবুল করে নিয়েছেন, কাজেই কী-ভাবে আমি নিজেকে বড় ভাবব ?
পঞ্চমত, আমি জানি না, আমার কী পরিণতি ও তার কী পরিণতি ? হয়ত মৃত্যুর আগে সে আমার চেয়ে ভালো কাজ করে আমার চেয়ে অনেক বেশি মর্যাদা নিয়ে আল্লাহ দরবারে হাজিরা দেবে।
কেয়ামতের হিসাবনিকাশ শেষে জান্নাতে প্রবেশের আগে কখনো কোনো মুমিন নিশ্চিত হতে পারে না, নিজেকে অন্য কারো চেয়ে উত্তম বা বেশি ধার্মিক ভাবা তো দূরের কথা ! সাহাবী, তাবেয়ীগণ ও পূর্ববর্তী যুগের শ্রেষ্ঠতম বুজুর্গ ও নেককার মানুষেরা নিজেদেরেকে জীবজানোয়ারের চেয়ে উত্তম ভাবতে পারতেন না। তাঁরা বলতেন, কেয়ামতের বিচার পার হওয়ার পরেই বুঝতে পারব, আমি জানোয়ারের চেয়ে অধম না কি তাদের চেয়ে উত্তম।
আরেকটি বিষয় আমাদেরকে সমস্যায় ফেলে দেয়। আমরা জানি যে, শিরক, কুফর, বিদ‘আত, হারাম, পাপ ইত্যাদিকে ঘৃণা করা ও যারা এগুলিতে লিপ্ত বা এগুলির প্রচার প্রসারে লিপ্ত তাদেরকে ঘৃণা করা আমাদের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ঈমানী দায়িত্ব। আমরা পাপকে ঘৃণা করার ও হৃদয়কে হিংসামুক্ত রাখার মধ্যে কিভাবে সমন্বয় সাধন করব? এই বিষয়টিকে শয়তান অন্যতম ফাঁদ হিসাবে ব্যবহার করে, যা দিয়ে সে অগণিত ধার্মিক মুসলিমকে হিংসা, হানাহানি, আত্মতৃপ্তি ও অহংকারের মতো জঘন্যতম কবীরা গোনাহের মধ্যে নিপতিত করছে। এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় আমাদের মনে রাখা উচিত,
প্রথমত, পাপ অন্যায়, জুলুম অত্যাচার, শিরক, কুফর, বিদ‘আত বা নিফাককে অপছন্দ ও ঘৃণা করতে হবে ; এবং তা করতে হবে রাসূলুলাহ সাঃ-এর অনুসরণে ও তাঁর প্রদত্ত গুরুত্ব অনুসারে। তিনি যে পাপকে যতটুকু ঘৃণা করেছেন, নিন্দা করেছেন বা যতটুকু গুরুত্ব দিয়েছেন ততটুকু গুরুত্ব দিতে হবে। তাঁর পদ্ধতি বা সু্ন্নাতের বাইরে মনগড়াভাবে ঘৃণা করলে তা হবে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ইসলামের নামে নিজের ব্যক্তি আক্রোশ বা অহংকারকে প্রতিষ্ঠা করা ও শয়তানের আনুগত্য করা।
এই ক্ষেত্রে বর্তমানে অধিকাংশ ধার্মিক মানুষ কঠিন ভুলের মধ্যে নিপতিত হন। কুরআন ও সুন্নাহে বর্ণিত কঠিন পাপগুলিকে আমরা ঘৃণা করি না বা বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করি না, কিন্তু যেগুলি কোনো পাপ নয় বা কম ভয়ঙ্কর পাপ সেগুলি নিয়ে প্রচণ্ড হানাহানি ও হিংসা বিদ্বেষে নিপতিত হই। একুট চিন্তা করলেই দেখতে পাবেন যে, আমাদের সমাজের ধার্মিক মুসলিমদের দলাদলি, হানাহানি, গীবতনিন্দা ও অহঙ্কারের ভিত্তি হলো নফল ইবাদত। আমরা কুফর, শিরক, হারাম উপার্জন, মানুষের ক্ষতি, সৃষ্টির অধিকার নষ্ট, ফরয ইবাদত ত্যাগ ইত্যাদি বিষয়ে তেমন কোনো আলোচনা, আপত্তি, বিরোধিতা বা ঘৃণা করি না। অথচ সু্ন্নাত নফল নিয়ে কীও ভয়ঙ্কর হিংসা ঘৃণার সয়লাব। ফরয সালাত যে মোটেও পড়ে না, তার বিষয়ে আমরা বেশি চিন্তা করি না, কিন্তু যে সুন্নাত সালাত আদায় করল না, বা সালাতের মধ্যে টুপি বা পাগড়ি পরল না, অথবা সালাতের শেষে মুনাজাত করল বা করল না, অথবা সালাতের মধ্যে হাত উঠালো বা উঠালো না ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আমরা হানাহানি ও অহঙ্কারে লিপ্ত রয়েছি।
দ্বিতীয়ত, এই ঘৃণা একান্তই আদর্শিক ও ঈমানী। ব্যক্তিগত জেদাজেদি, আক্রোশ বা শত্রুতার পর্যায়ে যাবে না। আমি পাপটিকে ঘৃণা করি। পাপে লিপ্ত মানুষটিকে আমি খারাপে লিপ্ত বলে জানি। তিনি যখন তা পরিত্যাগ করবেন তখন তিনি আমার প্রিয়জন হবেন। আমি তার জন্য দোয়া করি যে, আল্লাহ তাকে পাপ পরিত্যাগের তাওফীক দিন।
তৃতীয়ত, ঘৃণা ও বিরোধিতার অর্থ হিংসা নয়। ভালবাসার সাথে এই ঘৃণা একত্রিত থাকে। মা তার মলমূত্র জড়ানো শিশুকে দেখে নাক শিটকায় ও তাকে ঘৃণা করে। আপন ভাই তার অপরাধে লিপ্ত ভাইকে ঘৃণা করে। কিন্তু এই ঘৃণার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে থাকে ভালবাসা। মূলত ব্যক্তি শিশু বা ব্যক্তি ভাইকে ঘিরে থাকে তার সীমাহীন ভালবাসা, আর তার গায়ে জড়ানো ময়লা বা অপরাধকে ঘিরে থাকে ঘৃণা। সাথে থাকে তাকে ঘৃণিত বিষয় থেকে মুক্ত করার আকুতি।
চতুর্থত, ঘৃণা ও অহংকার এক নয়। আমি পাপকে ঘৃণা করি। পাপীকে অন্যায়কারী মনে করি। পাপের প্রসারে লিপ্ত ব্যক্তিকে ঘৃণা করি। কিন্তু এগুলির অর্থ এই নয় যে, আমি আমার নিজেকে ব্যক্তিগতভাবে অমুক পাপীর চেয়ে উন্নত, মুত্তাকী বা ভালো মনে করি। নিজেকে কারো চেয়ে ভালো মনে করা তো দূরের কথা নিজের কাজে তৃপ্ত হওয়াও কঠিন কবীরা গোনাহ ও ধ্বংসের কারণ। আমি জানি না যে, আমার ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হচ্ছে কি-না, আমি জানি না আমার পরিণতি কী আর উক্ত পাপীর পরিণতি কী, কিভাবে আমি নিজেকে অন্যের চেয়ে ভালো মনে করব?
পঞ্চমত, সবচেয়ে বড় কথা হলো, মুমিনকে নিজের গোনাহের চিন্তায় ও আল্লাহর যিকিরে ব্যস্ত থাকতে হবে। অন্যের কথা চিন্তা করা থেকে যথাসম্ভব বিরত থাকতে হবে। আমরা অধিকাংশ সময় অন্যের শিরক, কুফর, বিদ‘আত, পাপ, অন্যায় ইত্যাদির চিন্তায় ব্যস্ত থাকি। মনে হয় আমাদের বেলায়াত, কামালাত, জান্নাত, নাজাত সবকিছু নিশ্চিত। এখন শুধু দুনিয়ার মানুষের সমালোচনা করাই আমার একমাত্র কাজ। বাঁচতে হলে এগুলি পরিহার করতে হবে। প্রয়োজন ছাড়া পাপ বা পাপীর চিন্তায় নিজের হৃদয়কে ব্যস্ত রাখা খুবই অন্যায়। এ চিন্তা আমাদের কঠিন ও আখেরাত বিধ্বংসী পাপের মধ্যে ফেলে দেয়। তা হলো আত্মতৃপ্তি ও অহঙ্কার। যখনই আমি পাপীর চিন্তা করি তখনই আমার মনে তৃপ্তি চলে আসে, আমি তো তার চেয়ে ভালো আছি। তখন নিজের পাপ ছোট মনে হয় ও নিজের কর্মে তৃপ্তি লাগে। আর এ হলো ধ্বংসের অন্যতম পথ।
হিংসামুক্ত পবিত্র হৃদয় অর্জন করাই হলো রাসূলুলাহ সাঃ -এর অন্যতম সুন্নাত। এই সুন্নাতকে প্রতিপালন ও জীবনদানের নির্দেশ তিনি বিশেষভাবে দিয়েছেন। আনাস ইবনু মালিক (রা.) বর্ণিত হাদীসে রাসূলুলাহ সাঃ-কে বলতে শুনেছি : “বেটা, যদি সম্ভব হয় তাহলে এভাবে জীবনযাপন করবে যে, সকালে সন্ধ্যায় (কখনো) তোমার অন্তরে কারো জন্য কোনো ধোঁকা, বিদ্বেষ বা অমঙ্গল কামনা থাকবে না। অতঃপর তিনি বলেন : বেটা, এটা আমার সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। আর যে আমার সুন্নাতকে জীবিত করবে সে আমাকেই ভালবাসবে। আর যে আমাকে ভালবাসবে, সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে।”
হিংসা ও অহংকারমক্তু হৃদয় হলো জান্নাতের অন্যতম চাবিকাঠি। অন্য হাদীসে আনাস ইবনু মালিক (রা.) বলেন : “একদিন আমরা রাসূলুলাহ সাঃ এর কাছে বসে ছিলাম, এমতাবস্থায় তিনি বললেন : এখন তোমাদের এখানে একজন জান্নাতী মানুষ প্রবেশ করবেন। তখন একজন আনসারী মানুষ প্রবেশ করলেন, যাঁর দাড়ি থেকে ওযুর পানি পড়ছিল এবং তাঁর বাম হাতে তাঁর জুতাজুড়া ছিল। পরের দিনও রাসূলুলাহ সাঃ একই কথা বললেন এবং একই ব্যক্তি প্রবেশ করল। তৃতীয় দিনেও রাসূলুলাহ সাঃ প্রথম দিনের মতোই আবারো বললেন এবং আবারো একই ব্যক্তি প্রবেশ করল। তৃতীয় দিনে রাসূলুলাহ সাঃ মজলিস ভেঙ্গে চলে গেলে আব্দুলাহ ইবনু উমর উক্ত আনসারী ব্যক্তির পিছে পিছে যেয়ে বলেন, আমি আমার পিতার সাথে মন কষাকষি করেছি এবং তিন রাত বাড়িতে যাব-না বলে কসম করেছি। সম্ভব হলে এই কয় রাত আপনার কাছে থাকতে দিবেন কি ? তিনি রাজি হন। (আব্দুলাহর ইচ্ছা হলো তিন রাত তাঁর কাছে থেকে তাঁর ব্যক্তিগত ইবাদত জেনে সেই মতো আমল করা, যেন তিনিও জান্নাতী হতে পারেন)। তিনি তিন রাত তাঁর সাথে থাকেন, কিন্তু তাঁকে রাত্রে উঠে তাহাজ্জুদ আদায় করতে বা বিশেষ কোনো নফল ইবাদত পালন করতে দেখেন না। তবে তিন দিনের মধ্যে তাঁকে শুধুমাত্র ভালো কথা ছাড়া কারো বিরুদ্ধে কোনো খারাপ কথা বলতে শোনেননি। আব্দুলাহ বলেন, আমার কাছে তাঁর আমল খুবই নগণ্য মনে হতে লাগল। আমি বললাম : দেখুন, আমার সাথে আমার পিতার কোনো মনোমালিন্য হয়নি। তবে আমি পরপর তিনি দিন রাসূলুলাহ সাঃ-কে বলতে শুনলাম এখন একজন জান্নাতী মানুষ আসবেন এবং তিন বারই আপনি আসলেন। এজন্য আমি আপনার আমল দেখে সেইমতো আমল করার উদ্দেশ্যে আপনার কাছে তিন রাত্র কাটিয়েছি, কিন্তু আমি আপনাকে বিশেষ কোনো আমল করতে দেখলাম না! তাহলে কী কর্মের ফলে আপনাকে রাসূলুলাহ সাঃ জান্নাতী বললেন ? তিনি বললেন : তুমি যা দেখেছ এর বেশি কোনো আমল আমার নেই, তবে আমি আমার অন্তরের মধ্যে কোনো মুসলমানের জন্য কোনো অমঙ্গল ইচ্ছা রাখি না এবং আমি কোনো কিছুর জন্য কাউকে হিংসা করি না। তখন আব্দুলাহ বলেন : এই কর্মের জন্যই আপনি এই মর্যাদায় পৌঁছাতে পেরেছেন।” (মুসনাদে আহমদঃ ৩/১৬৬) উৎসঃ (এহইয়াউস সুনান: ৫০৮-৫১৩)