যৌতুক: এক অভিশপ্ত সামাজিক ব্যাধি, বহু কবীরা গুনাহর সমষ্টি !
আমাদের
সমাজে যৌতুক গ্রহণের অপর কারণটি হচ্ছে, আল্লাহর প্রতি ভয়হীনতা এবং
শরীয়তের বিধানের প্রতি অবজ্ঞা ও উদাসীনতা। নারীর মর্যাদা দান ও নারীর
আর্থিক অধিকার সুরক্ষায় ইসলাম যে বিধিবিধান দিয়েছে তার প্রতি সাধারণ
পর্যায়ের সম্মানবোধ থাকলে কোনো বরের পরিবারের পক্ষেই যৌতুক গ্রহণের কোনো
উদ্যোগ থাকার কথা ছিল না। অথচ যৌতুক গ্রহণের সঙ্গে এ সম্মানবোধের কোনো
সম্পর্ক নেই। বিশেষত যৌতুকের নামে ‘দেনা-পাওনা’ ধার্য করা এবং তা উসূল করার
নির্মম পর্যায়গুলোতে ন্যূনতম স্তরের মানুষির কোনো আলামত দৃশ্যত থাকে না।
এটা শরীয়তের বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। তাই
অন্তরে আল্লাহর ভয় থাকলে এটা সম্ভব হওয়ার কথা নয়।
মূলতঃ
এ কারনেই মুসলিম-সমাজে যখন অজ্ঞতা ও বিজাতির সংশ্রব একত্র হয়েছে তখন
ভিন্ন সমাজের রোগ-ব্যধি ও রীতি-রেওয়াজে আক্রান্ত হওয়া আশ্চর্যের কিছু
নয়। সকল অন্যায় ও প্রান্তিকতা এবং শোষণ ও নির্যাতনমূলক রীতি-নীতি থেকে
সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র আদর্শ ইসলামকে পেয়েও যারা সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করে
না এবং বিজাতির অন্ধ অনুকরণের মোহ কাটাতে পারে না, শুধু আদম-শুমারির
মুসলমানিত্ব কি পারবে ঐ সকল মরণ-ব্যাধি থেকে তাদেরকে রক্ষা করতে?
যৌতুক প্রথার প্রচলন কীভাবে শুরু হয়?
যৌতুক
প্রথার উৎপত্তি হিসাবে ‘কন্যাদান’ অথবা ‘স্ত্রীদান’ নামক বৈদিক যুগের একটি
ধর্মীয় রীতিকে গণ্য করা হয়। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অনুযায়ী পিতার সম্পত্তিতে
কন্যার কোন অধিকার নেই। বিয়ের পর থেকে কন্যার দায়-দায়িত্ব আর পিতার থাকে
না, যা কন্যার স্বামীর উপরে বর্তায়। এজন্য বিয়ের সময় পিতা কন্যাদান রীতির
মাধ্যমে কন্যার স্বামীকে খুশী হয়ে কিছু উপহার বা দক্ষিনা দেন (সামর্থ
অনুযায়ী)। আবার পিতার দক্ষিনা ছাড়া কন্যাদান তথা বিবাহ ধর্মীয়ভাবে
অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বৈদিক সময়ের সামর্থ্যানুযায়ী দক্ষিনাই কালাতিক্রমে
বর্তমানে বাধ্যতামূলক ও সাধ্যাতিরিক্ত যৌতুকে বিবর্তিত হয়েছে [Dowry System
in India.]। শুরুর দিকে কন্যাদান উচ্চবর্ণের হিন্দু তথা ব্রাহ্মণ সমাজেই
সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে নিম্নতর বর্ণের হিন্দুরাও তা অনুসরণ করা শুরু করে।
প্রসংগত হিন্দু ধর্মে বিয়ে হয় চিরজীবনের জন্য। এজন্য ধর্মীয়ভাবে
বিবাহবিচ্ছেদ ও পুনঃবিবাহের প্রচলন নেই। বিবিসি’র রিপোর্টে দেখা যায় ভারতে
প্রায় ৪০ মিলিয়ন বিধবা মানবেতর জীবনযাপন করে। অনেক গবেষকের মতে যৌতুক
প্রথার সাথে এই বিষয়টিও ওতপ্রোতভাবে জড়িত [Vijayendra Rao, The Economics
of Dowries in India. Development Research Group, World Bank Forthcoming
in in Oxford Companion to Economics (Kaushik Basu, editor), Oxford
University Press, 2006.]।
বাংলাদেশে কখন ও কীভাবে যৌতুক প্রথার প্রচলন শুরু হয়?
মুসলিম
আইন অনুযায়ী পাত্রীকে মোহরানা পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু বর্তমানে উল্টো
পাত্রী পক্ষকে যৌতুক দিতে বাধ্য করা হচ্ছে! ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে
যৌতুক নামক প্রথা অপরিচিত ছিল। সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৯৪৫-১৯৬০
সালে যৌতুকের হার ছিল ৩%। ১৯৮০ সালে আইনগতভাবে যৌতুক নিষিদ্ধ করা হয়।
কিন্তু তারপর থেকে যৌতুকের হার অনেকাংশে বেড়েছে, যা ২০০৩ সালে ছিল ৭৬%
[Siwan Anderson (2007). The Economics of Dowry and Brideprice. Journal
of Economic Perspectives—Volume 21, Pages 151–174]। সাম্প্রতিক (২০০৮)
ব্র্যাক ও আমেরিকার পপুলেশন কাউন্সিলের সমীক্ষা অনুযারী বাংলাদেশের বিভিন্ন
এলাকা ভেদে যৌতুকের হার হচ্ছে ২০% থেকে ৮০% [Reforming marriage practices
in Bangladesh, prepared by Sajeda Amin Brief no. 31 January 2008]।
বাংলাদেশে যৌতুক প্রথা প্রচলনের মূল কারণ
১।
সমাজ বিজ্ঞানীর মতে হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব বাংলাদেশে যৌতুক প্রথা
প্রতিষ্ঠিত করতে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে [Rozario Santi, 2004. Purity and
Communal Boundaries: Women and Social Change in a Bangladeshi Village,
(Dhaka: The University Press Limited]।
২।
সম্প্রতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা অনুযায়ী আমাদের দেশে যৌতুক
প্রথা প্রতিষ্ঠার পেছনে মুসলিম বিবাহ সংক্রান্ত আইন-কানুন পরিবর্তন
(দ্বিতীয় বিবাহে অত্যন্ত কঠোরতা ও বিবাহ-বিচ্ছেদ আইনত ঝামেলাপূর্ণ) ও
বাকীতে মোহরানা দেওয়ার প্রবণতাকেও দায়ী করা হয়েছে [Attila Ambrus, Erica
Field, Maxio Torero. 2010. Muslim family law, prenuptial agreements and
the emergence of dowry in Bangladesh. The Quarterly Journal of
Economics, 125 (3): 1349-1397]।
৩।
কন্যার বৈবাহিক জীবনের নিশ্চয়তার লক্ষ্যে ‘সিকিউরিটি মানি’ (Security
money) হিসেবে যৌতুক দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। অন্যদিকে পাত্ররাও মোহরানা
বাকীতে পরিশোধ করতে চায়। এজন্য কন্যার গার্ডিয়ানরাও বড় অংকের মোহরানা ধার্য
করে যা বেশীর ভাগ পাত্রই পরিশোধ করার সমর্থ রাখে না। কিন্তু আইন অনুযায়ী
বিবাহ বিচ্ছেদ হলে ঐ মোহরানা আদায় করা হয়। যার ফলে এতে বিবাহ বিচ্ছেদের
সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে যায় [Hanne Cecilie Geirbo, Nuzhat Imam. The
Motivations Behind Giving and Taking Dowry Research Monograph Series No.
28 BRAC, July 2006]।
৪। যৌতুক গ্রহণে
মানুষের লোভ অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে তরুন সমাজের বেশীর ভাগ
যৌতুককে খারাপ দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে। কিন্তু দূর্মূল্যের বাজারে ফাও
(বিনা পরিশ্রমে) পেতে সবারই প্রচণ্ড আকাংখা থাকে। এজন্য সাধারণত
পাত্রপক্ষকে ঘর সাজানোর উপকরণ (যেমন ফ্রীজ, টেলিভিশন, ফার্নিচার, মোটর
সাইকেল) সংগ্রহে উদগ্রীব দেখা যায়।
যারা যৌতুক নেন না, তারাও কি যৌতুক থেকে মুক্ত?
শিক্ষিত
মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারে তথাকথিত যৌতুক প্রথা সাধারণত পরিলক্ষিত হয়
না। কিন্তু অন্যভাবে কন্যার পরিবারকে চাপের মধ্যে রাখা হয়, যেটা যৌতুকের
অন্তর্ভূক্ত। ইসলামিক ভাবধারা মতে কন্যার পরিবারকে বিয়ের সামাজিক অনুষ্ঠান
পালনে নিরুৎসাহি করা হয়েছে। তবে পাত্র পক্ষকে সামর্থানুযায়ী বউভাত (ওলিমা)
করতে উৎসাহি করা হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় সামাজিক ও বরপক্ষের চাপে
কন্যাপক্ষকে রীতিমতো ঘটা করে বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করতে হয়। বর্তমানে
বিয়েতে আবার আমদানী করা হয়েছে ভিনদেশী নতুন নতুন অনুষ্ঠান (যেমন গায়ে
হলুদ)। যার ফলে অনেক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবার মেয়ে বিয়ে দেওয়ার সময়
দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয়। অন্যদিকে পাত্রকে সমাজের মুখ রক্ষা করতে গিয়ে
সামর্থের অধিক খরচ করতে বাধ্য করা হয়। আর এর প্রভাব পড়ে নব-দম্পতির
পারিবারিক জীবনে। অভাব-অনটন দিয়ে শুরু হয় নতুন পরিবারের যাত্রা। ইসলামের
দৃষ্টিকোণ থেকে ঐ বিয়েকে উত্তম ও কল্যাণকর বিয়ে বলা হয় যেখানে খরচ ও
জাঁকজমক কম হয়।
মোহরানা নিয়ে অত্যন্ত বিদ্বেষপূর্ণ অপপ্রচার
মুসলিম
সমাজে মোহরানা দেয়ার নিয়ম থাকলেও এই প্রথার কারণে কোন প্রকার হত্যা কিংবা
নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনা ঘটে না। যেখানে যৌতুক প্রথার কারণে প্রতি বছর হাজার
হাজার নারী বলির শিকার সহ লক্ষ লক্ষ নারী বিভিন্নভাবে নির্যাতন-নিপীড়নের
শিকার হচ্ছে, সেখানে ইসলাম-বিদ্বেষী একটি চক্র যৌতুক প্রথার ভয়াবহতাকে চেপে
যেয়ে মুসলিম সমাজে মোহরানার উপর ভিত্তি করে স্ত্রীকে “বেশ্যা” কিংবা
“স্বামীর যৌনদাসী” হিসেবে প্রচার চালাচ্ছে।
যৌতুক : এক অভিশপ্ত সামাজিক ব্যধি, বহু কবীরা গুনাহর সমষ্টি
মূল
প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটি কথা। তা এই যে, جهاز আরবীতে একটি শব্দ আছে,
جهاز যার উর্দু তরজমা করা হয় জাহীয। কেউ কেউ অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই এই
শব্দের তরজমা করেন যৌতুক। যা সঠিক নয়।
জাহায
বা জাহীয হচ্ছে, কন্যাকে দেওয়া পিতার উপহার। স্বামী বা শ্বশুরালয়ের কেউ
এর মালিক নয়, এর মালিক কন্যা নিজে। পিতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কন্যাকে তা
দিয়ে থাকে। এতে স্বামী ও শ্বশুরালয়ের দাবি ও চাপাচাপি তো দূরের কথা,
কন্যার পক্ষ থেকেও কোনো দাবি থাকে না। এটা নামধামের জন্য দেওয়া হয় না।
যৎসামান্য উপহার পিতা নিজের সামর্থ্য অনুসারে কন্যাকে দিয়ে থাকেন।
এই
উপহারও বিয়ের সময় দেওয়া সুন্নত, মুস্তাহাব নয়; নিছক মোবাহ, যদি না
কোনো সামাজিক চাপ কিংবা প্রথাগত বাধ্য-বাধকতা থাকে। অন্যথায় তা সম্পূর্ণ
নাজায়েয ও হারাম হয়ে যায়। হাদীস শরীফে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছেন-
ألا ولا يحل لامرئ من مال أخيه شيء إلا بطيب نفس منه
সাবধান!
কারো জন্য তার ভাইয়ের কিছুমাত্র সম্পদও বৈধ নয়, যদি তার স্বতঃস্ফূর্ত
সম্মতি না থাকে।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৫৪৮৮; সুনানে দারাকুতনী, হাদীস :
২৮৮৩; শুআবুল ঈমান বায়হাকী, হাদীস : ৫৪৯২
অর্থাৎ
কেউ কিছু দিলেই তা ভোগ করা হালাল হয় না, যে পর্যন্ত না খুশি মনে দেয়।
পুত্র-কন্যাও এ বিধানের বাইরে নয়। সুতরাং পিতা যদি বাধ্য হয়ে নিজের
কন্যাকেও কোনো কিছু দেয় তবে তা গ্রহণ করা তার জন্যও বৈধ নয়। তাহলে স্বামী
বা শ্বশুরালয় থেকে যদি কন্যার উপহার দাবি করা হয় কিংবা কোনো তালিকা
দেওয়া হয় তাহলে তা কীভাবে বৈধ হবে? এ তো মোবাহ জাহিয নয়. সরাসরি যৌতুক।
কেউ
কেউ রোখসতির সময় কন্যাকে কিছু উপহার, কিছু ঘরকন্নার সামগ্রি দেওয়াকে
মাসনূন মনে করেন। এ প্রসঙ্গে সীরাতের একটি ঘটনা উল্লেখ করা হয় যে, রাসূলে
কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ কন্যা ফাতিমা রা.কে রোখসতির
সময় কিছু জিনিস দিয়েছিলেন। মুসনাদে আহমদ (হাদীস : ৬৪৩) ও সহীহ ইবনে
হিববানে (হাদীস : ৬৯৪৭) এ তিনটি বস্ত্তর কথা আছে। একটি ঝুলদার চাদর, একটি
পানির মশক ও একটি বালিশ, যাতে ইযখির ঘাসের ছোবড়া ভরা ছিল। মুসনাদে আহমদের
এক রেওয়ায়েতে (হাদীস : ৮৩৮) দুটি ঘড়া ও দুটি যাঁতার কথাও আছে। কিন্তু
উসূলে ফিকহের বিধান মতে শুধু এইটুকু ঘটনার দ্বারা কোনো আমল মাসনূন প্রমাণিত
হয় না, শুধু মোবাহ বা বৈধ প্রমাণিত হয়। ঐ কাজ মাসনূন হলে নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাতে উৎসাহিত করতেন এবং তাঁর অন্য
কন্যাদের বিয়েতেও এ ধরনের উপহার দিতেন। তেমনি উম্মুল মুমিনীনদেরকেও তাদের
পিত্রালয় থেকে উপহার দেওয়া হত। কিন্তু কোনো রেওয়ায়েতে এমন কোনো কিছুই
পাওয়া যায় না। শুধু উম্মে হাবীবা রা. সম্পর্কে পাওয়া যায়, তাঁর জন্য
হাবাশার বাদশা নাজাশী নিজের পক্ষ থেকে কিছু উপহার পাঠিয়েছিলেন। (সুনানে
নাসায়ী, হাদীস : ৩৩৫০; তবাকাতে ইবনে সাদ ৮/২৯৩)
ফাতেমা
(রা.) -এর ঘটনার আরেকটি দিকও রয়েছে, যা বিবেচনা করা দরকার। তা এই যে, নবী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন হযরত আলী রা.-এরও অভিভাবক। সুতরাং
সম্ভাবনা আছে যে, ঐ জিনিসগুলো তিনি পাঠিয়েছিলেন আলী রা.-এর পক্ষ থেকে।
কারণ বিয়ের সময় তাঁর ঘরে ঐ ধরনের কোনো আসবাবপত্র ছিল না। মুসনাদে আহমদ
(হাদীস : ৬০৩) সহ বিভিন্ন কিতাবে নির্ভরযোগ্য সনদে এই তথ্য রয়েছে। মাওলানা
মুহাম্মাদ মনযূর নুমানী রাহ. মাআরিফুল হাদীস (৩/৪৬০-৪৬১) এই ব্যাখ্যাই
করেছেন। কোনো কোনো রেওয়ায়েত থেকে বোঝা যায়, এই জিনিসগুলো দেওয়া হয়েছিল
তাঁর মোহরের টাকা থেকে, কিন্তু ঐসব রেওয়ায়েত সহীহ নয়।
মোটকথা,
রোখসতির সময় মেয়েকে কিছু উপহার দেওয়া বা ঘরকন্নার প্রয়োজনীয় সামগ্রী
প্রদান করাকে কোনো সাহাবী ও তাবেয়ী মাসনূন বা মুস্তাহাব বলেছেন, এমন তথ্য
আমার জানা নেই। ফিকহ-ফতোয়ার নির্ভরযোগ্য কিতাবের মোহর-অধ্যায়ের মাসায়েল
থেকে এর বৈধতাটুকুই প্রমাণিত হয়। সুতরাং, কন্যার বিয়ে বা রোখসতির সময়
পিতা নিজ সাধ্য অনুসারে তাকে যে গহনাগাটি বা সামানপত্র শুধু আল্লাহর
রেযামন্দির জন্য উপহার দেয় যাকে আরবীতে বলে জাহায, এবং উর্দূতে যার তরজমা
জাহীয শব্দ দ্বারা করা হয় একে মোবাহ বা মুস্তাহাব যাই বলুন না কেন প্রচলিত
যৌতুকের সাথে এর বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। এটা উর্দু ভাষার সীমাবদ্ধতা যে,
তাতে যৌতুকের জন্যও জাহীয শব্দ ব্যবহার করা হয়। আর মূল আরবীতে তো যৌতুকের
সমার্থক কোনো শব্দই নেই। কারণ সম্ভবত এই যে, ইসলামী যুগে তো দূরের কথা,
জাহেলী যুগেও আরব-সমাজে আর যা কিছুই ছিল, যৌতুকের অভিশাপ ছিল না। সম্প্রতি
আরবরা একটি বিদেশি শব্দের অপভ্রংশ ‘দাওতা’ যৌতুকের জন্য ব্যবহার করে থাকে।
যৌতুক
শব্দের মূল প্রয়োগে কতটুকু ব্যাপকতা আছে তা আমার জানা নেই। তবে এখন তা
একটি পরিভাষা। বিয়ের সময় বা বিয়ের আগে-পরে যে কোনো সময় কনে বা
কনেপক্ষের নিকট থেকে বর বা বরপক্ষের লোকেরা যে সম্পদ বা সেবা গ্রহণ করে
কিংবা সামাজিক প্রথার কারণে তাদেরকে দেওয়া হয়, তদ্রূপ কনে বা কনেপক্ষের
লোকেরা মোহর ও ভরণ-পোষণের অধিক যা কিছু উসূল করে বা সামাজিক প্রথার কারণে
তাদেরকে দেওয়া হয় এই সবই যৌতুক। এটিই বর্তমান নিবন্ধের বিষয়বস্তু।
যৌতুকের কুফুল – একটি হারাম, অনেক হারামের সমষ্টি
যৌতুকের
লেনদেন এত জঘণ্য অপরাধ যে, তা শুধু হারাম বা কবীরা গুনাহ নয়, এমন
অনেকগুলো হারাম ও কবীরা গুনাহর সমষ্টি, যার কোনো একটিই যৌতুকের জঘণ্যতা ও
অবৈধতার জন্য যথেষ্ট ছিল।
১. মুশরিক-সমাজের রেওয়াজ
যৌতুকের
সবচেয়ে নগণ্য দিক হল, তা একটি হিন্দুয়ানি রসম বা পৌত্তলিক সমাজের প্রথা।
আর কোনো মুসলিম কোনো অবস্থাতেই কাফের ও মুশরিকদের রীতি-নীতি অনুসরণ করতে
পারে না।
২. জুলুম ও নির্যাতন
যৌতুক
শুধু জুলুম নয়, অনেক বড় জুলুম। আর তা শুধু ব্যক্তির উপর নয়, গোটা
পরিবার ও বংশের উপর জুলুম। যৌতুকের কারণে কনে ও তার অভিভাবকদের যে মানসিক
পীড়ন ও যন্ত্রণার শিকার হতে হয় তা তো ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। অথচ
কাউকে সামান্যতম কষ্ট দেওয়া ও জুলুম করাও হারাম ও কবীরা গুনাহ।
জালিমের
উপর আল্লাহর লা’নত ও অভিশাপ এবং জালিমের ঠিকানা জাহান্নাম। মজলুমের
ফরিয়াদ সরাসরি আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায় এবং যেকোনো মুহূর্তে আল্লাহ
জালিমের উপর আযাব ও গযব নাযিল করতে পারেন।
৩. পরস্ব হরণ
কুরআন মজীদে একাধিক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
لا تأكلوا اموالكم بينكم بالباطل
তোমরা বাতিল উপায়ে একে অন্যের সম্পদ গ্রাস করো না। – [সূরা বাকারা : ১৮৮; সূরা নিসা : ২৯]।
বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক ভাষণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন-
إن دماءكم وأموالكم وأعراضكم عليكم حرام كحرمة يومكم هذا في شهركم هذا في بلدكم هذا.
নিঃসন্দেহে
তোমাদের জান, মাল, ইজ্জত-আব্রু তোমাদের পরস্পরের জন্য এমনভাবে সংরক্ষিত,
যেমন হজ্বের দিবসটি হজ্বের মাস ও (হজ্বের শহর) মক্কায় সংরক্ষিত।
সুতরাং
কারো জান-মাল, ইজ্জত-আব্রুতে হস্তক্ষেপ করা হজ্বের সম্মানিত মাসে, হজ্বের
সম্মানিত দিবসে হারাম শরীফের উপর হামলার মতো অপরাধ। (সহীহ বুখারী, হাদীস :
১৭৩৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৬৭৯)
নিঃসন্দেহে
যৌতুক নেওয়া ‘আকল বিলবাতিল’ বা পরস্ব হরণের অন্তর্ভুক্ত। বিয়ে একটি
পবিত্র বন্ধন। এটি ব্যবসা বা অর্থোপার্জনের উপায় নয়। তেমনি বর-কনেও
ব্যবসার পণ্য নয়, যাদেরকে বিক্রি করে পয়সা কামানো হবে। যারা বিয়ের মতো
পবিত্র কাজকে ‘সোর্স অফ ইনকাম’ বানায় তারা আল্লাহর বিধানের অবজ্ঞাকারী।
কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা যে ‘আকল বিল বাতিল’ কে হারাম করেছেন তার অর্থই
হল, এমন কোনো পন্থায় সম্পদ উপার্জন, যাকে আল্লাহ উপার্জনের মাধ্যম
বানাননি। শরীয়তের দৃষ্টিতে এটি হজ্বের মহিমান্বিত মাসের মহিমান্বিত দিবসে
খানায়ে কাবার উপর হামলা করার মতো অপরাধ।
৪. ডাকাতি ও লুটতরাজ!
কে
না জানে, অন্যের সম্পদ লুট করা কবীরা গুনাহ! বড় কোনো সম্পদ নয়, যদি জোর
করে কেউ কারো একটি ছড়িও নিয়ে যায় সেটাও গছব ও লুণ্ঠন, যা সম্পূর্ণ
হারাম। লুণ্ঠিত বস্ত্ত অনতিবিলম্বে ফিরিয়ে দেওয়া ফরয। হাদীস শরীফে
ইয়াযীদ ইবনুস সায়েব রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেন-
لا يأخذن أحدكم متاع صاحبه لعبا جادا وإذا أخذ أحدكم عصا أخيه فليرددها عليه
অর্থাৎ
কেউ যেন তার ভাইয়ের জিনিস উঠিয়ে না নেয়; না ইচ্ছা করে, না ঠাট্টাচ্ছলে।
একটি ছড়িও যদি কেউ তুলে নেয় তা যেন অবশ্যই ফিরিয়ে দেওয়া হয়। (মুসনাদে
আহমদ, হাদীস : ১৭৯৪০; ১৭৯৪১; ১৭৯৪২; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৫০০৩; জামে
তিরমিযী, হাদীস : ২১৬০)
যৌতুক নেওয়া
কারো সামান্য জিনিস তুলে নেওয়ার মতো বিষয় নয়; বরং তা সরাসরি লুণ্ঠন ও
ডাকাতি। পার্থক্য শুধু এই যে, এখানে ছুরি-চাকুর বদলে বাক্যবান ও চাপের
অস্ত্র প্রয়োগ করা হয়, যা মজলুমের মন-মানসে অনেক বড় ও গভীর ক্ষত সৃষ্টি
করে। তো ডাকাতি ও লুটতরাজের যে গুনাহ যৌতুক নেওয়ার গুনাহও তার চেয়ে কোনো
অংশেই কম নয়।
৫. রিশওয়াত ও ঘুষ
আত্মসাৎ
ও অবৈধ উপার্জনের যতগুলো পন্থা আছে তন্মধ্যে নিকৃষ্টতম ও জঘণ্যতম একটি
পন্থা হল রিশওয়াত। এর বাংলা তরজমা করা হয় ‘ঘুষ’ বা ‘উৎকোচ’।
অনেকে
মনে করেন, অফিস-আদালতে নিজের বা অন্যের কোনো বৈধ পাওনা উসূল করার জন্য বা
সঠিক রায় পাওয়ার জন্য কর্মচারী-কর্মকর্তাদের চাপ, অশোভন আচরণের শিকার
হয়ে যে অর্থ দেওয়া হয় কিংবা অবৈধ সুবিধা হাসিলের জন্য যা খরচ করা হয় তা
হচ্ছে ঘুষ। অবশ্যই তা ঘুষ। তবে ঘুষ ও রিশওয়াত শুধু এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ
নয়। শরীয়তের দৃষ্টিতে রিশওয়াতের অর্থ আরো ব্যাপক। কারো কোনো হক বা
পাওনা, যা কোনো বিনিময় ছাড়াই তার পাওয়া উচিত, তা যদি বিনিময় ছাড়া না
দেওয়া হয় তাহলে ঐ বিনিময়টাই হল ঘুষ বা রিশওয়াত, যা হতে পারে অর্থ, সেবা
বা অন্য কোনো সম্পদ। এটা দেওয়া হারাম, নেওয়া হারাম এবং এই লেনদেনে
মধ্যস্থতা করাও হারাম। এটা এত বড় অপরাধ যে, এর সাথে যুক্ত সবার উপর
আল্লাহর লা’নত ও অভিশাপ। (আননিহায়া ফী গরীবিল হাদীস ওয়াল আছার, ইবনুল
আছীর (৬০৬ হি.) ২/২২৬; আলফাইক ফী গরীবিল হাদীস, যমখশরী (৫৩৮ হি.)
হাদীস শরীফে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لعنة الله على الراشي والمرتشي
অর্থাৎ
ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহীতা উভয়ের উপর আল্লাহর অভিশাপ। মুসনাদে আহমদ, হাদীস :
৬৭৭৮, ৬৯৮৪; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৫০৭৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস :
২৩১৩
অন্য হাদীসে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
لعن الله الراشي والمرتشي والرائش الذي يمشي بينهما
ঘুষদাতা
ও ঘুষগ্রহীতা ও ঘুষের লেনদেনে মধ্যস্থতাকারী সকলের উপর আল্লাহ অভিশাপ
করেছেন।-আলমুস্তাদরাক আলাস সহীহাইন, হাকীম আবু আবদিল্লাহ ৪/১০৩
বিয়ের
পয়গাম দিতে পারা নারী-পুরুষের বৈধ অধিকার। পয়গাম কবুল হলে বিবাহ-বন্ধনে
আবদ্ধ হতে পারাও নারী-পুরুষের বৈধ অধিকার। বিয়ের পর স্বামী তার স্ত্রীকে
পাওয়া এবং স্ত্রী তার স্বামীকে পাওয়া তাদের প্রত্যেকের ফরয হক ও
অপরিহার্য অধিকার। এরপর যতদিন বিবাহ-বন্ধন অটুট থাকে, একে অন্যের নিকট থেকে
শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করাও স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য অধিকার। তো এই
অধিকারগুলোর কোনো একটি পাওয়ার জন্য বা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য কোনোরূপ
অর্থব্যয়ের বাধ্যবাধকতা সম্পূর্ণ অবান্তর। সুতরাং এক্ষেত্রে কোনো
অর্থ-সম্পদ দাবি করা হলে কিংবা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ চাপের মাধ্যমে কোনো
কিছু গ্রহণ করা হলে তা হবে সরাসরি ঘুষ ও রিশওয়াত, যার লেনদেন সম্পূর্ণ
হারাম এবং লেনদেনকারী ও মধ্যস্থতাকারী সবাই আল্লাহর লা’নত ও অভিশাপের
উপযুক্ত।
৬. লালসা হিংস্রতা ও চারিত্রিক হীনতা
এই
সব পাশবিক প্রবণতা থেকে নিজেকে মুক্ত করা প্রত্যেক নর-নারীর উপর ফরয।
পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে এইসব ঘৃণ্য প্রবণতা প্রকাশিত হওয়া চরম
দুর্ভাগ্যজনক। যে সমাজের লোকেরা এই সব দোষ ও দুর্বলতার সংশোধন করে না; বরং
কর্ম ও আচরণে পশুত্বের পরিচয় দিতে থাকে তাকে তো মনুষ্যসমাজ বলা যায় না।
একজন ইনসান, উপরন্তু সে যদি হয় মুমিন, তাহলে অন্যের ধন-সম্পদ ও
ইজ্জত-আব্রুর উপর কীভাবে হস্তক্ষেপ করে? কারো দুর্বলতা ও অসহায়ত্বের সুযোগ
সে কীভাবে নেয়? এ তো কমিনা ও কমবখত লোকের কাজ। যার মাঝে বিন্দুমাত্র
শরাফতও আছে তারও তো এই অপকর্মের হীনতা উপলব্ধি করা কঠিন নয়।
যৌতুক,
সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন এবং যত ধরনের দুর্নীতি এই সমাজে প্রচলিত তা সবই ঐ
পাশবিক চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। এখন প্রত্যেকের কর্তব্য, নিজেকে ও নিজের
অধীনস্ত সকলকে পশুত্বের হীনতা থেকে মনুষ্যত্বের মর্যাদায় উন্নিত করার
চেষ্টা করা। এটা এখন সময় ও সমাজের অপরিহার্য-দাবি। আর এর একমাত্র উপায়
হচ্ছে, আখিরাতের স্মরণ ও আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার অনুভূতিকে শক্তিশালী
করা। এজন্য দ্বীনী শিক্ষার বিস্তার, আখলাক-চরিত্রের সংশোধন এবং নেককার
বুযুর্গানে দ্বীনের জীবন ও আদর্শ চর্চার কোনো বিকল্প নেই।
৭. এক অপরাধ অসংখ্য অপরাধ
শরীয়তের
একটি সাধারণ নীতি এবং একটি স্বতঃসিদ্ধ কথা এই যে, কোনো কাজের দ্বারা যদি
হারামের দরজা খোলে তাহলে সেটাও হারাম হয়ে যায়। তাহলে যে কাজ নিজেও হারাম
এবং আরো অনেক হারামের জনক তা কত জঘণ্য ও ভয়াবহ হতে পারে? তো যৌতুক এমনই এক
অপরাধ, যা আরো বহু অপরাধের জন্ম দিয়ে থাকে।
যৌতুকের
দাবি পূরণের জন্য অনেক অভিভাবক সুদ-ঘুষের কারবার ও বিভিন্ন হারাম উপার্জনে
লিপ্ত হয়। এমনকি আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটে। আর স্ত্রীর উপর নির্যাতন-নিপীড়ন
এমনকি হত্যা ও আত্মহত্যাও সাধারণ বিষয়। তেমনি কনেপক্ষ শক্তিশালী হলে দুই
পরিবারে বিবাদ-বিসংবাদ, মামলা-মোকদ্দমা এমনকি খুন-জখম পর্যন্ত হতে থাকে।
দৈনিক পত্রিকার পাঠক এসব ঘটনায় রীতিমতো অভ্যস্ত!
যৌতুকের
সবচেয়ে ন্যূনতম ক্ষতিটি হল এর কারণে দাম্পত্য সম্পর্কের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ
হয়ে যায়। পরিবারে অশান্তির আগুন জ্বলতে থাকে। ঝগড়া-বিবাদ গালিগালাজ
এমনকি মারধর পর্যন্ত হয়। যার প্রত্যেকটিই এক একটি কবীরা গুনাহ এবং পরিবার ও
সমাজকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে টেনে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সন্তানমাত্রই
আল্লাহর রহমত, তবে কন্যা আল্লাহর বিশেষ রহমত কিন্তু যৌতুকের কারণে অনেক
পিতামাতা কন্যার প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন, যা চরম মূর্খতা ও
জাহিলিয়াত। আরো বেদনার বিষয় এই যে, ছেলের মা বোনেরাও নববধুর কাছে যৌতুক
দাবি করতে পিছপা হয় না। নারী হয়েও তারা নারীর যন্ত্রণা বোঝে না, তার
প্রতি সহমর্মী হয় না। অনেক ক্ষেত্রে তো জা-ননদ-শাশুড়িই হয়ে ওঠে নব বধুর
সবচেয়ে বড় দুশমন। তো যারা যৌতুক দাবি করে বা গ্রহণ করে তাদের উচিত রাসূলে
কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই বাণী স্মরণ রাখা-
لا يدخل الجنة لحم نبت من سحت النار أولى به
ঐ
দেহ বেহেশতে যাবে না, যা হারাম (গিযা) থেকে উৎপন্ন হয়েছে। দোযখের আগুনই
তার অধিক উপযোগী।-সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ১৭২৩, ৪৫১৪; মুসান্নাফে আবদুর
রাযযাক, হাদীস : ২০৭১৯
বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষা ও সামাজিক মূল্যবোধ যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ
বাংলাদেশের
সামাজিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষা ও সামাজিক মূল্যবোধ যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে
কার্যকরী বলে স্পষ্টত প্রতীয়মান। বিভিন্ন সংস্থা (সরকারী এবং এনজিও) যৌতুক
প্রথা নিরসনে মূলত নারীর শিক্ষা, প্রগতিশীলতা, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা এবং
স্বাধীনতা তথা আধুনিকায়নের উপর বিশেষভাবে জোর দিয়ে থাকে। সামাজিক
মূল্যবোধকে (যেমন মোহরানা) এ ক্ষেত্রে সাধারণত উপেক্ষা করা হয় বা তেমন
গুরুত্ব দেয়া হয় না, কেননা আমাদের দেশের যৌতুক-বিরোধী কর্মকাণ্ডে
পাশ্চাত্যের মডেলকে অনুসরণ করা হয়। মনে রাখা দরকার, এই ভাবধারা বা মডেল
অনুযায়ী পশ্চিমা সমাজ যেমন যৌতুক নামক সামাজিক ব্যাধি থেকে মুক্তি পেয়েছে,
তেমনি অন্য আরো নতুন নতুন সামাজিক অবক্ষয়েরও জন্ম দিয়েছে। নারীরাই মূলত এই
অবক্ষয়ের শিকার হচ্ছে। আর মেয়েদেরকে গড়ে তোলা হচ্ছে সেক্সুয়াল অবজেক্ট
হিসেবে।
মুসলিম সমাজের ‘একের অধিক বা
বহু বিবাহ’ নিয়ে যারা উপহাস-বিদ্রূপ করে থাকে তারাই কিনা অবাধ ও
বাছ-বিচারহীন যৌন ক্ষুধা মিটিয়ে থাকে। সেন্টার ফর ডিজীজ কন্ট্রোল (CDC)’র
সমীক্ষায় দেখায় যায় আমেরিকার একজন পুরুষ অন্তত কমপক্ষে ৭ জন নারীর
সজ্জাসংগী হয়। এদের প্রায় ৩০% রয়েছে ১৫ জনেরও বেশী সজ্জাসঙ্গিনী। ইউরোপে এই
হার আরো বেশী। যেমন অস্ট্রিয়াতে প্রত্যেকে পুরুষ কমপক্ষে ২৯ জন নারীকে ভোগ
করে। আর এই অবাধ মেলামেশাকে ‘প্রাকৃতিক’ বলে অভিহিত করে জাস্টিফাই করা হয়
ডারউইনিয়ান বিবর্তনবাদ তত্ত্ব দিয়ে! আর এসব কারণে লক্ষ লক্ষ গর্ভস্থশিশুকে
গর্ভপাতের মাধ্যমে হত্যা করা হয়। অন্যদিকে বিবাহ-বিচ্ছেদের হারও
আশংকাজনকভাবে বেশী। অবাধ যৌনাচার ও বিবাহ বিচ্ছেদের ফলে মিলিয়ন মিলিয়ন শিশু
বেড়ে উঠছে এক-কেন্দ্রিক পরিবারে (Single-parent)। বাবা অথবা মা’র
অনুপস্থিতিতে শিশুদের মানসিক বৃদ্ধি যে বাধাগ্রস্ত হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে
না। ২০০৬ সালের জরিপ অনুযায়ী আমেরিকার প্রায় ১৩ মিলিয়ন পরিবার
এক-কেন্দ্রিক বা Single-parent. আমাদের দেশে সামাজিক মূল্যবোধ জলাঞ্জলি
দিয়ে যৌতুক প্রথা নিরসন করা হলেও নারীরা যে তাদের প্রাপ্য সন্মান ও অধিকার
আদায় করতে পারবে – তার কি কোন নিশ্চয়তা আছে?
উপসংহার
যারা
এই কু-রসমের প্রতিরোধ করে না; বরং নিজেদেরকে অক্ষম মনে করে কিংবা যৌতুক
দিয়ে জামাতার মনোতুষ্টি কামনা করে তাদের মনে রাখা উচিত, কারো পাপ-দাবি
পূরণ করাও পাপ। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর
দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা তাদের দ্বিতীয়বার স্মরণ করা উচিত-ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহীতা
উভয়ের উপর আল্লাহর অভিশাপ। কবির ভাষায় তাই বলা যায় –
“যৌতুক প্রথা বন্ধ কর
ইসলামি আইন চালু কর
যৌতুক আর দিব না
ইসলাম ছাড়া বিয়ে মানব না।”
ইসলামি আইন চালু কর
যৌতুক আর দিব না
ইসলাম ছাড়া বিয়ে মানব না।”
সুতরাং,
এই অভিশপ্ত ব্যধি থেকে আল্লাহ আমাদের সমাজকে পবিত্র করুন, সকল কুফরী ও
শিরকী কর্মকান্ড থেকে আমাদেরকে রক্ষা করুন এবং একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টির
উদ্দেশ্যে এই সকল অপকর্মের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার তাওফীক
দান করুন।
লিখেছেনঃ সাজ্জাদ সালাদীন