ইসরা ও মি’রাজ এর শিক্ষা ! (১ম পর্ব)

ইসরা ও মি’রাজ এর শিক্ষা ! (১ম পর্ব) 
মুহাম্মদ হামিদুল ইসলাম আজাদ
পৃথিবীর ইতিহাসে যত নবী-রাসূল এসেছেন সকলের জীবনেই কোন না কোন বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে, তন্মধ্যে সর্বশেষ নবী সাঈয়েদুল মুরসালিন, খাতামুন্নাবিয়ীন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাঃ এর জীবনে মিরাজ হচ্ছে বিশেষ একটি অলৌকিক ঘটনা। এই মিরাজের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তার সৃষ্টি জগতের সকল ক্ষেত্রে সকল স্থানে অনাবিল শান্তির অত্যাধুনিক কয়েকটি নিয়ম-নীতি, বিধি-নিষেধ আরোপ করেছেন যার বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশ্ববাসী সেই শান্তির সুফল পেতে পারেন।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মারামারি, কাটাকাটি, জুলুম-নির্যাতন, অন্যায়-অবিচার ইত্যাদি অপকর্ম চলছে তা হতে সমাজকে রক্ষা করতে হলে মিরাজের শিক্ষাগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন দরকার। তবেই সমাজের সর্বত্র বয়ে আসবে অবিরাম শান্তি। আসুন আমরা মিরাজের শিক্ষাগুলো যথাযথভাবে জেনে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করি। মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয়তম রাসূল কে যত মুজিযা দিয়েছেন সেগুলির অন্যতম এক মুজিযা হলো ইসরা ও মি’রাজ।


ইসরা ও মি’রাজ এর পরিচিতিঃ

اَسْرَى ক্রিয়াটি  اِسْرَاءٌ মূলধাতু হতে উৎপন্ন। اِسْرَاءٌ বা “ইসরা” শব্দের অর্থ হল, রাতে নিয়ে যাওয়া, “নৈশ-ভ্রমন” বা “রাত্রিকালে ভ্রমণ করানো, রাত্রিকালীন ভ্রমণ।” মহান আল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাঃ কে এক রাত্রিতে মক্কা মুআজ্জামা থেকে ফিলিস্তিনের ‘আল-মাসজিদুল আকসা’ পর্যন্ত নিয়ে যান। এরপর সেখান থেকে ঊর্ধ্বে ৭ আসমান ভেদ করে তাঁর ক্সনকট্যে নিয়ে যান। মক্কা শরীফ থেকে আল-মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণকে “ইসরা” এবং সেখান থেকে ঊর্ধ্বে গমনকে মি’রাজ বলা হয়।
আর  مِعْرَاجٌ বা “মি’রাজ” আরবী শব্দ, অর্থ সিঁড়ি, “ঊর্ধ্বারোহণ” বা “উর্ধক্ষারোহণের যন্ত্র”। শারঈ অর্থে বায়তুল মুক্বাদ্দাস থেকে যে অলৌকিক সিঁড়ির মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে সপ্ত আসমানের উপরে আরশের নিকটে আল্লাহর সান্নিধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়, সেই সিঁড়িকে ‘মি‘রাজ’ বলা হয়। ‘মি’রাজ’ শব্দটাই বেশী প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।
পারিভাষিক অর্থে হিজরতের পূর্বে একটি বিশেষ রাতের শেষ প্রহরে বায়তুল্লাহ হ’তে বায়তুল মুক্বাদ্দাস পর্যন্ত ‘বোরাক্বে’১ ভ্রমণ, অতঃপর সেখান থেকে অলৌকিক সিঁড়ির মাধ্যমে সপ্ত আসমান পেরিয়ে আরশে আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন ও পুনরায় বায়তুল মুক্বাদ্দাস হয়ে বোরাক্বে আরোহন করে প্রভাতের আগেই মক্কায় নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তনের ঘটনাকে ‘মি‘রাজ’ বলা হয়।
সূরা বানী ইসরাঈলের ১ম আয়াতে উল্লিখিত ‘ইসরা’ বা রাত্রিকালীন ভ্রমণ বলতে মি‘রাজের রাত্রিতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আক্বছা পর্যন্ত সফরকে বুঝানো হয়। অর্থাৎ ‘ইসরা’ হ’ল যমীন থেকে যমীনে ভ্রমণ। অনেকটা বিমান বনদরের ‘রানওয়ে’র মত। প্রথমে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে দ্রুত ছুটে চলা, অতঃপর ধীরে ধীরে ঊর্ধ্বে ওঠা। আর যমীন হ’তে ঊর্ধ্বলোকে ভ্রমণকে মি‘রাজ বলা হয়। কুরআন মাজীদের সূরা বানী ইসরাঈলের ১ম আয়াতে ‘ইসরা’ এবং সূরা নাজমের ১৩ থেকে ১৯ আয়াত পর্যন্ত ‘মিরাজে’র ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া ২৬-এর অধিক ছাহাবী কর্তৃক বুখারী, মুসলিমসহ প্রায় সকল হাদীছ গ্রন্থে মুতাওয়াতির পর্যায়ে মি‘রাজের ঘটনাবলী বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং মি‘রাজ অকাট্যভাবে প্রমাণিত একটি সত্য ঘটনা। যাতে সন্দেহ পোষণের কোন অবকাশ নেই।

ইসরা ও মি’রাজ সংঘটিত হওয়ার সময় কাল ও তারিখঃ

মি‘রাজ সংঘটিত হওয়ার সঠিক তারিখ বা দিনক্ষণ সম্পর্কে মুহাদ্দিছীন ও ওলামায়ে কেরামের মাঝে মত পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। হাদীস ও সীরাত বিষয়ক গ্রন্থে প্রায় ৪০ জন সাহাবী সহীহ বা যয়ীফ সনদে মিরাজের ঘটনার বিভিন্ন দিক ছোট বা বড় আকারে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কোনো হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাঃ থেকে মি’রাজের তারিখ সম্পর্কে একটি কথাও বর্ণিত হয়নি। সাহাবী-তাবিয়ীগণও তারিখ বিষয়ে তেমন কিছু বলেন নি। এসকল হাদীসের শিক্ষা গ্রহণই তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল। দিবস পালন তো দূরের কথা তারিখ জানার বিষয়ে তাদের আগ্রহ ছিল অতি সামান্য। ফলে তারিখের বিষয়ে পরবর্তী যুগের মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। মি’রাজ একবার না একাধিকবার সংঘঠিত হয়েছে, কোন্ বৎসর হয়েছে, কোন্ মাসে হয়েছে, কোন্ তারিখে হয়েছে ইত্যাদি বিষয়ে অনেক মতবিরোধ রয়েছে এবং প্রায় ২০টি মত রয়েছে। ফাতহুল বারী, উমদাতুল কারী, আল-মাওয়াহিবুল্লাদুনিয়্যাহ, শারূহুল মাওয়াহিব, তারিখে ইবন কাসীর, সীরাহ শামিয়্যাহ ইত্যাদি হাদীসের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ও সীরাতুন্নাবী বিষয়ক যে কোনো মৌলিক আরবী গ্রন্থে আপনারা এ সকল মত দেখতে পারবেন। 
কোনো কোনো আলিমের মতে যুলকাদ মাসে, কারো মতে রজব মাসের এক তারিখে, বা রজব মাসের প্রথম শুক্রবারে এবং কারো মতে রজব মাসের ২৭ তারিখে মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল। তবে অধিকাংশ আলিমই বলেছেন যে, রবিউল আউয়াল মাসে মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল। তাবিয়ীদের মধ্যে ইমাম যুহরী ও উরওয়া ইবনুয যুবাইর থেকে এ মত বর্ণিত। ইবনু আবী শাইবা সংকলিত এক মুরসাল হাদীসে জাবির রাঃ ও ইবনু আব্বাস রাঃ বলেন, রাসূলুল্লাহ সাঃ রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার জন্মগ্রহণ করেন, এদিনেই তিনি নুবুওয়াত লাভ করেন, এ দিনেই তিনি মি’রাজে গমন করেন, এদিনেই তিনি হিজরত করেন এবং এদিনেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।২
আর-রাহীকুল মাখতূম-এর লেখক ছফীউর রহমান মুবারকপুরী রহঃ এ বিষয়ে ৬টি মতামত উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, মি’রাজের এ বিশ্ববিশ্রুত অলৌকিক ঘটনাটি কোন্ সময় সংঘটিত হয়েছিল সে ব্যাপারে জীবনচরিতকারগণের মধ্যে যে মতভেদ লক্ষ্য করা যায় তা নিম্নে লিপিবদ্ধ করা হল,
১. রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে যে নবুওয়াত প্রদান করা হয়েছিল সে বছর মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল (এটা তাবারীর কথা)।
২. নবুওয়াতের পাঁচ বছর পর মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল (ইমাম নাবাবী এবং ইমাম কুরতুবী এ মত অধিক গ্রহণযোগ্য বলে স্থির করেছেন)।
৩. দশম নবুওয়াত বর্ষের ২৭শে রজব তারীখে মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল। (আল্লামা মানসুরপুরী এ মত গ্রহণ করেছেন)।
৪. হিজরতের ষোল মাস পূর্বে, অর্থাৎ নবুওয়াত দ্বাদশ বর্ষের রমযান মাসে মি’রাজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
৫. হিজরতের এক বছর দু’মাস পূর্বে অর্থাৎ নবুওয়াত ত্রয়োদশ বর্ষের মুহারম মাসে মি’রাজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
৬. হিজরতের এক বছর পূর্বে অর্থাৎ নবুওয়াত ত্রয়োদশ বর্ষের রবিউল আওয়াল মাসে মি’রাজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
এর মধ্যে প্রথম তিনটি মত এ জন্য সহীহুল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে না যে, উম্মুল মু’মিনীন খাদীজাহ (রাঃ)-এর মৃত্যু হয়েছিল পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ হওয়ার পূর্বে। অধিকন্তু, এ ব্যাপারে সকলেই এক মত যে, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ হয়েছে মি’রাজের রাত্রিতে। কাজেই, এ থেকে এটা পরিস্কার বুঝা যায় যে, খাদীজাহ (রাঃ)-এর মৃত্যু হয়েছিল মি’রাজের পূর্বে। তাছাড়া, এটাও সর্বজনবিদিত ব্যাপার যে, তাঁর মৃত্যু হয়েছিল দশম নবুওয়াত বর্ষের রমাযান মাসে। এ প্রেক্ষিতে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, মি’রাজের ঘটনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাঁর মৃত্যুর পরে, পূর্বে নয়।
অবশিষ্ট থাকে শেষের তিনটি মত। এ তিনটির কোনটিকেই কোনটির উপর অগ্রাধিকার দানের প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে সূরাহ ‘ইসরার’ বর্ণনাভঙ্গি থেকে অনুমান করা যায় যে, এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মক্কা জীবনের শেষ সময়ে।৩
ফাতহুল কাদীর গ্রন্থকার বলেন, মি’রাজের সময়কাল নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে সকলে একমত যে, তা হিজরতের পূর্বে সংঘটিত হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, এক বছর পূর্বে। আবার কেউ বলেছেন, কয়েক বছর পূর্বে এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। অনুরূপ মাস ও তার তারীখের ব্যাপারেও মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, রবিউল আওয়াল মাসের ১৭ অথবা ২৭ তারীখে হয়েছে। কেউ বলেছেন, রজব মাসের ২৭ তারীখ এবং কেউ অন্য মাস ও অন্য তারীখের কথাও উল্লেখ করেছেন।৪
কারো মতে ৬২০ বা ৬২১ খৃষ্টাব্দে নবুওয়াতের দশম বছরের রজব মাসের ২৭ তারিখ রাতে মি‘রাজ সংঘটিত হয়েছে। হাফেয ইবনু কাছীর রহঃ খ্যাতনামা জ্যেষ্ঠ তাবেঈ ইবনু শিহাব যুহরীর বরাতে বলেন, হিজরতের এক বছর পূর্বে মি‘রাজ সংঘটিত হয়েছিল।৫ অতএব নির্দিষ্টভাবে ২৭শে রজব দিবাগত রাতে মি‘রাজ হয়েছিল বলে যে কথা পাক-ভারত উপমহাদেশে প্রচলিত আছে তা নিতান্তই দলীল বিহীন।৬
অন্যান্য ধর্মের লোকের ন্যায় মুসলমানরাও যাতে ধর্মের নামে অহেতুক আনুষ্ঠানিকতায় বন্দী না হয়ে পড়ে সে কারণে রাসূলুল্লাহ সাঃ এর জন্ম দিন, লাইলাতুল ক্বদর ইত্যাদির ন্যায় লাইলাতুল মি‘রাজের দিন-তারিখকেও ভুলিয়ে দেওয়ার মধ্যে মহান আল্লাহর পূর্ণ কৌশল নিহিত আছে বলে অনুমিত হয়।

চলবে ইনশা-আল্লাহ

উৎসঃ

১. بُرَاقٌ আরবী শব্দ যা بَرْقٌ   মূল ধাতু হ’তে নির্গত। এর অর্থ বিদ্যুৎ। এটি বিদ্যুতের মত আশ্চর্যজনক দ্রুতগতিসম্পন্ন ডানাওয়ালা অশ্ব  বিশেষ। খচ্চরের চেয়ে ছোট ও গাধার চেয়ে একটু বড়। কর্ণদ্বয় অতি চিকন এবং গায়ের রং ধবধবে সাদা।
২.  মুহাম্মাদ ইবনু ইউসূফ শামী,  সুবুলুল হুদা  (সীরাহ শামিয়্যাহ) ৩/৬৪-৬৬। আরো দেখুন ইবনু কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/৪৭০-৪৮০; কাসতালানী, আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যাহ ২/৩৩৯-৩৯৮; খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, হাদীসের নামে জালিয়াতি,. পৃ. ৪০৯।
৩. বিস্তারিত তথ্য জানতে হলে দেখুন যা’দুল মা’আদ ২য় খন্ড ৪৯ পৃঃ মুকতাসারুস সীরাহ শাইখ আবদুল্লাহ পৃঃ ১৪৮-১৪৯। রহমাতুল্লিল আলামীন ১ম খন্ড ৭৬ পৃঃ।
৪. ফাতহুল কাদীর
৫. শিহাবুদ্দীন সুন্নী, মাহে রজব-হুরমত মাস।

বাংলাদেশ ইসলামী দাওয়াহ সেন্টার