কবি মতিউর রহমান মল্লিক বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট কবি। উত্তর সত্তর যে ক’জন কবি স্বকীয় প্রতিভায় প্রোজ্জ্বল-কবি মল্লিক তাদের অন্যতম। কাব্য মূল্যায়ন মূলত : কাব্যভাষা, কাব্য লক্ষ্য ও কাব্য সৌন্দর্য্যরে ওপর অনেকটা নির্ভর করে। এক্ষেত্রে কাব্যগ্রন্থ সংখ্যা বা কবিতা সংখ্যা প্রধান নয়।
কবির প্রকাশিত কবিতা এবং গ্রন্থিত কবিতার কাব্যমানের ওপর কবির মর্যাদা নির্মিত হয়।
অনেক কবিতা লিখেছেন তিনি কিন্তু তার খানিকটা প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রকাশমানতা নির্ভর করেছে তার প্রকাশ হওয়ার মানসিকতার ওপর। তিনি অত্যন্ত লাজুক এবং প্রচার-প্রকাশ অপ্রিয় কবি ছিলেন। আড়ালে-অন্তড়ালে নিভৃতে নিজেকে সেঁধিয়ে রাখতে পছন্দ করতেন। এ স্বভাবচারিতা তাকে জীবনানন্দ দাস এবং ফররুখের মতো করেছে। ফলে আমরা তার প্রকাশিত গ্রন্থ তেমন বিপুলাকারে পাই না।
কবির প্রকাশিত কবিতা এবং গ্রন্থিত কবিতার কাব্যমানের ওপর কবির মর্যাদা নির্মিত হয়।
অনেক কবিতা লিখেছেন তিনি কিন্তু তার খানিকটা প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রকাশমানতা নির্ভর করেছে তার প্রকাশ হওয়ার মানসিকতার ওপর। তিনি অত্যন্ত লাজুক এবং প্রচার-প্রকাশ অপ্রিয় কবি ছিলেন। আড়ালে-অন্তড়ালে নিভৃতে নিজেকে সেঁধিয়ে রাখতে পছন্দ করতেন। এ স্বভাবচারিতা তাকে জীবনানন্দ দাস এবং ফররুখের মতো করেছে। ফলে আমরা তার প্রকাশিত গ্রন্থ তেমন বিপুলাকারে পাই না।
পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত (অমুদ্রিত) কবিতার সংখা হবে প্রচুর।
তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের তালিকা
(১) আবর্তিত তৃণলতা : মোনালিসা প্রকাশন। (২) অনবরত বৃক্ষের গান : মোনালিসা প্রকাশন। (৩) তোমার ভাষায় তিèছোরা : বাংলা সাহিত্য পরিষদ। (৪) চিত্রল প্রজাপতি : প্রফেসর’স পাবলিকেশন্স। (৫) নীষন্ন পাখির নীড়ে : আত্ম প্রকাশন। (৬) রঙিন মেঘের পালকি : জ্ঞান বিতরণী।
প্রকাশিতব্য কাব্যগ্রন্থ :
(১) একক আকাশ : অনেক নক্ষত্র। (২) কোলিল জ্যোতি। (৩) নন্দিত নদী।
এছাড়াও তার অনেক কবিতা ও ছড়া বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। অপ্রকাশিত কবিতাও রয়েছে প্রচুর।
এমুহূর্তে তার চারটি কবিতা যথা-জঙ্গলের মতো অসভ্য, স্রোতধারা, লাশখেকো ও এতো যে হিংসা প্রসঙ্গে কিছু আলোকপাত করার প্রয়াস পাবো।
মতিউর রহমান মল্লিক ছিলেন আদর্শবাদী, বিশ্বাসী ও দেশপ্রেমিক কবি। তার বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থে এসব বিষয় তীর্যকভাবে ফুটে উঠেছে। একজন কবি সমাজ, রাষ্ট্র, নিরপেক্ষ নয়-নয় ধর্মনিরপেক্ষও। প্রত্যেক বস্তু-বস্তুকণার নিজস্ব গুণাবলী এবং তার চর্চা রয়েছে-এটাই ঐ বস্তুর বা কণার ধর্ম। ধর্মহীন বা ধর্মনিরপেক্ষ কোনো বস্তুকণা বা প্রাণীর অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। বস্তুর ইলেকট্রোন, প্রোটন কণা বা ধণাত্মক ও ঋণাত্মক অংশ রয়েছে। একমাত্র ‘পজিট্রন’ যা মুহূর্তে নিরপেক্ষ রইলেও পর মুহূর্তে হয় ধনাত্মক নয় ঋণাত্মক কণায় পরিণত হয়। কোনো মানুষ তার ধর্ম, গুণাবলী এবং বিশ্বাস থেকে নিরপেক্ষ, নিষ্ঠায় থাকতে পারে না। এটা এক ধরনের অসততা যে যা বিশ্বাস করবে-তাই করবে, এটাই স্বাভাবিক। সে যে ধর্মে বিশ্বাস করবে-তাকে সে শ্রদ্ধা করবে-তাকে সে উচ্চকিত করে তুলবে এটাই সততা-এটাই স্বাভাবিকতা। তবে এক্ষেত্রে অন্য ধর্মের বা অন্য কর্মচারীর প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করা অগণতান্ত্রিক এবং অন্যায়। পরমত পরধর্মকে বিশ্বাস না করলে-তাকে ঘৃণা বা কটাক্ষ করা যাবে না। অন্য মতের প্রতি খড়গহস্ত হওয়া যাবে না। কিন্তু আধুনিক সময়ে-এই গণতান্ত্রিক বিশ্বেও মানুষ একে অপরকে ঘৃণা করছে। পর ধর্মকে ঘৃণা করছে, আঘাত করছে। আঘাত প্রাপ্তদের উচিত হবে প্রত্যাঘাত করা-প্রতিবাদ করা প্রতিবিধান করা। ইসলাম মানবতার ধর্ম-বিশ্বসৃষ্টির ধর্ম। এই ধর্ম কেবল মুসলমানের নয় সকলের। ইসলামকে কেউ আঘাত করলে-এর নবীকে কেউ কটাক্ষ করলে-এর অনুসারীরা অবশ্যই তার প্রতিবাদ করবে। এক্ষেত্রে একজন বড় কবি বা সত্য সুন্দরের কবি অবশ্যই কাব্যভাষার মাধ্যমে ধর্ম কটাক্ষকারীদের প্রতিবাদ করবে-এটাই স্বাভাবিক।
মার্কিন সেনারা বা ডাচ চিত্রকররা যখন কোরআনকে কটাক্ষ করেন-অবমাননা করেন তখন তারা মূলত: সভ্য ভদ্র মানুষ থাকেন না। তারা সুন্দরের প্রতিপক্ষে প্রকৃতির প্রতিপক্ষে চলে যায় এমন সুন্দর কাব্যভাষা নির্মাণ কেেছন তিনি।
উদ্বৃতি :
আকাশের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো উদ্ধত ছাড়া
বাতাসকে অস্বীকার করার মতো কোনো বেয়াদব ছাড়া
নক্ষত্র-মেঘমালা-নদীনালা
এবং তরঙ্গের কোন চিহ্নিত শত্রুরা ছাড়া
বস্তুত বৃক্ষ-বিহঙ্গ-প্রাণীকূল
এবং মায়াময় মৃত্তিকার প্রকাশ্য দুশমনরা ছাড়া
অর্থাৎ মানুষের যাবতীয় উজ্জ্বল উদযাপনের হত্যাকারীরা ছাড়া
মানবতার নানাবিধ উপঢৌকনের অনবরত হন্তারকরা ছাড়া
স্বাধীনতা-স্বাধিকার
ইতিহাস-ঐতিহ্য
শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি
এবং গণতন্ত্রের নিয়মিত খুনিরা ছাড়া
অর্থাৎ ফুলের বিরুদ্ধে
ফলের বিরুদ্ধে
নারীর বিরুদ্ধে
শিশুর বিরুদ্ধে
জমিনের বিরুদ্ধে
ফসলের বিরুদ্ধে
প্রভাতের বিরুদ্ধে
এবং যাবতীয় আলোর বিরুদ্ধে অবস্থানকারীরা ছাড়া
কোরআনের অবমাননা করার মতো কোনো হিংস্র হতে পারে না
হতে পারে না জংগলের মতো অসভ্য।
(জংগলের মতো অসভ্য)
কবি এখানে ধর্ম বিদ্বেষী অর্থাৎ ইসলাম বিরোধীদের অত্যন্ত শ্লীল ভাষায় শিল্পসম্মতভাবে প্রত্যাঘাত করেছেন। ধর্মবিদ্বেষীরা, প্রকৃতি, ফুল, ফল, নারী শিশুদের বিরুদ্ধে তারা হিংস্র এবং জংগলের মতো অসভ্য পরিমিতি বোধহীন। চমৎকার সভ্য এবং বড় কবির আচরণ এই কবির।
একজন কবি মানবতাবাদী, মানবদরদী, দেশদরদী। এ কারণেই যখন দেশ-দেশের মানুষ ও ভূ-খণ্ড পরদেশি বা প্রতিবেশীর দ্বারা আক্রান্ত হয়-তখন কবি এর প্রতিবাদ না করে পারেন না। তিনি দেশদ্রোহী, স্বাধীনতা বিরোধী, দেশ আক্রমণকারী সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন-লেখেন অমর কবিতা।
পৃৃথিবীর সব ভাষার-সব দেশের কবিরাই তার দেশ ও ভাষা আক্রান্ত হলে তার প্রতিবাদ করেন। এক্ষেত্রে মল্লিক ব্যতিক্রম নন। আমাদের দেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত কর্তৃক সাহায্যপ্রাপ্ত হয়েছিল। ভারত সরকার আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছিল। তারা আমাদের অস্ত্র, খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে এমনকি সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করে সাহায্য করেছে। এ জন্য আমারা কৃতজ্ঞ। কিন্তু স্বাধীনতার পরপরই তারা আমাদের অবজ্ঞা করছে। আমাদের সীমান্তে তারা প্রতিদিন পাখি মারার মত আমাদের মানুষদের গুলি করে হত্যা করছে। এর দায় সে দেশের সরকার প্রধানরা এড়াতে পারেন না। তাই এই অধিকার, এই নির্মম হত্যাযজ্ঞের কঠোর প্রতিবাদ করা উচিত। আমাদের দেশের অনেক কবিই এর প্রতিবাদ করছেন-আবার অনেক কবিই একে এড়িয়ে যাচ্ছেন-এর প্রতিবাদ করছেন না। এমনকি কোনো ইতর শ্রেণীর লেখকরা এই সাম্রাজ্যবাদীদের পদলেহন করছেন -চটে উপবেশনের স্বপ্নে বিভোর হচ্ছেন। মল্লিক খাটি দেশপ্রেমিক কবি-তাই তিনি সাম্রাজ্যবাদী ভারতীয় সরকার প্রধানকে উদ্দেশ্য করে বলছেন-
‘মনমোহনরা ভেবেছো কি? ভেবেছো কি আজ?
অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে সাজিয়ে রণ সাজ।
দেশটা আবার করবে দখল দাপট দেখায়ে?
মাছ না পেয়ে ছিপে দাঁতাল কামড় হাঁকায়ে?’
(লাশ খেকো)
রাজনৈতিক কবিতা খুব কম লিখেছেন তিনি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ক্ষমতার পালাবদল-ভালোমন্দের মিশেল-পার্শ্বপরিবর্তন, দিবারাত্রির ক্রমাবর্তন-এসবই সময়ে সময়ে ঘটে থাকে। এ জন্য বৈরী সময়ে-বিরুদ্ধ বাতাসে হতাশ না হয়ে আশান্বিত হওয়া দরকার। কবিদের কাজ হলো স্বপ্নদেখা-ভালো স্বপ্ন দেখানো এবং আশাবাদ ব্যক্ত করা। ‘স্রোতধারা’
কবির একটি রাজনৈতিক কবিতা-তবে এতে উগ্র রাজনৈতিক আক্রমণাত্মক ভাষা নেই- নেই সরাসরি কোনো বক্তব্য-রূপকের মাধ্যমে তিনি তার সমাজ ও জাতিকে নতুন আশায় উদ্দিপ্ত করেছেন।
উদ্ধৃতি
এই দুর্ভয় রইবে না
এই দুর্লয় মহাক্ষয় যাবে চলে
এই দুর্ভোগ ঠেলে ঠেলে জানি
হাসবে নতুন ভোর-নতুন ভ্রমর নিয়ে ফুলে ফুলে।
মেঘনা যমুনা দেবে নতুন নতুন স্রোতধারা
দোয়েল পাপিয়া পিউ জাগাবে আবার নব-সাড়া
সুরমা রূপসা সাগরে-নতুন নতুন গান দুলে দুলে।
‘এতো যে হিংসা’ কবির আর একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রন্থিক কবিতা। পরচর্চা, গীবত, চোগলখুরী, মিথ্যা অপবাদ’ প্রভৃতি মানবমন, সমাজ ও রাষ্ট্রকে দুর্বল ও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। একজন কবি যিনি মানবতাবাদী, যিনি মানুষের বন্ধু, সৃষ্টির বন্ধু তিনি অবশ্যই এসব খারাপ গুণের ঘৃণা করবেন। তিনি সুন্দরের চর্চার দিকে শ্লীল সভ্যতার দিকে অনাবিল সৌন্দর্যের দিকে আহ্বান করবেন। তিনি অসত্য, পরশ্রীকাতরতা, স্বার্থপরতা, সন্দেহ প্রবণতার বিরুদ্ধে তার অবস্থানকে সুস্পষ্ট করেছেন।
উদ্ধৃতি
এতো যে হিংসা এতো বিদ্বেষ
এতো পরশ্রী কাতরতা,
দিকে দিকে এতো স্বার্থপরতা
এতো সন্দেহ প্রবণতা;
নাকি এইসব প্রলয় ধ্বংস
ঘটবার ঠিক পূর্ব অংশ
বিবেকহীন বিবেচনাহীন
ঘৃণ্য প্রগলভতা।
পরচর্চার বন্যায় দেশ
ভেসে যায় রাতদিন,
সৎ-চরিত্র হননের কাজ
চলেছে বিরামহীন;
অন্যকে খুব ছোট করবার
নিজের অহং তুলে ধরবার
চৌদিকে এতো কি যে ভয়ানক
মত্ত উন্মদতা।
মতিউর রহমান মল্লিক একজন অন্তরালপ্রিয় কবি। তার অনেক কবিতা, ছড়া ও গান এখনও লোকচুর অগোচরে রয়েছে। তার কাব্যভাষা, কাব্যমান নিয়ে এখনও পূর্ণাঙ্গ কথা বলার সময় আসেনি। যত সময় যাবে-তত তার অপ্রকাশ্য লেখা প্রকাশিত হবে-তাকে চেনা তাকে মূল্যায়ন করা ততো সংগত হবে, ততো সহজ ও সুন্দর হবে।
মতিউর রহমান মল্লিক মূলত নির্বাচিত শব্দগুচ্ছের কবি। শব্দই তার কবিতার সৌন্দর্য। শব্দ বিন্যাস রীতিই তাকে এবং তার কাব্যভাষাকে সুন্দর ও অন্য অনেকের চেয়ে পৃথক করেছে।
লেখক : কবি