পরস্পর বিরোধী হাদীসের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতি ও আমাদের করণীয় !

পরস্পর বিরোধী হাদীসের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতি ও আমাদের
করণীয় !

মুহাম্মদ হামিদুল ইসলাম আজাদ

আসল কথা তো এটাই যে, সব হাদীসের ওপরই আমল করা হবে। হ্যাঁ, যদি পরস্পর বিরোধী হয়ে দাঁড়াবার কারণে উভয় হাদীসের ওপর আমল করা দুঃসাধ্য হয় তাহলে ভিন্ন কথা। মূলত হাদীসে কোনো মতভেদ নেই। শুধু আমলের দৃষ্টিতে মতভেদ পরিদৃষ্ট হয়। যদি দুটো পরস্পর বিরোধী হাদীস সামনে আসে, যদি উভয় হাদীসেই হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাজ বর্ণিত হয়, যদি এক সাহাবী বলেন যে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কাজ করেছেন এবং অপর সাহাবী বলেন যে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য কাজ করেছেন, তা হলে দুটোর ভেতরে কোনো বিরোধ নেই। সেক্ষেত্রে দুটো কাজই মোবাহ হবে। অবশ্য যদি সে কাজ দুটো ইবাদত না হয়ে অভ্যেসগত হয়। অন্যথায় একটি হবে মুস্তাহাব এবং অপরটি হবে জায়েয। তবে যদি একটিতে ইবাদতের লক্ষণ সুস্পষ্ট হয় এবং অপরটিতে না হয় কিংবা দুটো কাজই ওয়াজিব বা মুস্তাহাব হয়, তখন দুটোর একটি অপরটির জন্যে যথেষ্ট হবে। অবশ্য দুটোই যদি ইবাদত হয়।


সাহাবী হাফেজগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে এভাবেই ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। যেমন বিতরের নামায এগারো রাকআত, নয় রাকআত, সাত রাকআত ইত্যাদির বর্ণনা। তেমনি তাহাজ্জুদ নামাযে জোরে কিংবা আস্তে পড়া। এ পদ্ধতিতেই রাফিয়্যাদাইনের ব্যাপারটি ফয়সালা করা হবে। মানে, হাত কান পর্যন্ত উঠানো হোক কিংবা কাঁধ পর্যন্ত।

হযরত উমর (রাঃ), ইবনে মাসউদ (রাঃ) ও ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর তাশাহহুদের ব্যাপারটি মীমাংসা এভাবেই করা চাই। এ পদ্ধতিতেই বিতরের নামায কি তিন রাকআত, না এক রাকআত ভিন্ন নামায যে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া চাই। এভঅবেই নামায শুরুর দোআ, সকাল সন্ধ্যার দোআ এবং সব রকমের কার্যকারণ ও কর্মসূচী নির্ধারণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

অথবা যদি সে কাজ দুটো কোনো কষ্টকর ব্যবস্থা থেকে পরিত্রাণ দাতা হয়। হয়ত পূর্বে সে কাজ অপরিহার্য করার কোনো কারণ ছিল। যেমন কাফফারা সম্পর্কিত ব্যাপারসমূহ।একটি বর্ণনামতে যুদ্ধের বিনিময় সম্পর্কিত ব্যাপার। অথবা সেক্ষেত্রে কোনো সুপ্ত কারণ ছিল যা এক সময় একটি কাজকে ওয়াজিব করেছে এবং অন্য সময় অপর কাজটি মুস্তাহাব করেছে। অথবা একটি কাজ এক সময় ওয়াজিব করেছে এবং অন্য সময়ে বর্জন করার অবকাশ দিয়েছে। তখন অপরিহার্য হবে সে কারণ অনুসন্ধান করা।

অথবা কাজ দুটোর একটি অপরিত্যাজ্য ও অপরটি বর্জনের অবকাশ রয়েছে। শর্ত হচ্ছে, প্রথমটিতে দৃঢ়তার লক্ষণ থাকবে ও দ্বিতীয়টিতে কষ্টকর দিকটি বিবেচিত হবে। তবে যদি তার ভেতর একটিতে কাজের বর্ণনা ও দ্বিতীয় হাদীসে কাজের বর্জন আসে, সেক্ষেত্রে যদি কাজটির সুস্পষ্টতঃ ওয়াজিব বা হারাম হওয়ার প্রমাণ না মিলে কিংবা অপর বর্ণনাটিতে সুস্পষ্ট বর্জন না বুঝায়, তখন তাতে কয়েকটি কারণ হতে পারে। যদি একটি বর্ণনায় সুস্পষ্ট ওয়াজিব বা হারামের ব্যাপার থাকে তা হলে উভয় হাদীসই এই অর্থে ব্যবহৃত হবে যে, ব্যাপারটি হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্যে নির্দিষ্ট।

অথবা দুটোকেই মানসুখ করা হবে। তখন উভয়ের লক্ষণাদি অনুসন্ধান করে দেখা হবে। যদি দুটোই বক্তব্যমূলক হাদীস হয়, এবং একটির অর্থ সুস্পষ্ট হয় ও দ্বিতীয়টি ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করলে একই অর্থ দাঁড়ায় আর ব্যাখ্যাও কাছাকাছি হয়, তা হলে সুস্পষ্ট অর্থবোধক হাদীসের ওপরই আমল হবে। তখন স্পষ্ট হাদীসটি অস্পষ্ট হাদীসের ব্যাখ্যা বলে গ্রহণ করা হবে। পক্ষান্তরে ব্যাখ্যা যদি দূরের হয় তাহলে ব্যাখ্যার অর্থ তখনই গ্রহণযোগ্য হবে যখন তার সপক্ষে বড় কোনো নিদর্শন মিলবে কিংবা কোনো ফকীহ সাহাবী থেকে তা বর্ণিত হবে। যেমন দোয়া কবুলের সময় সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ)-এর এ বক্তব্য যে, সেটা হলো সূর্যাস্তের প্রাক্কালে। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) সে ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে, যে, সে সময়ে নামায বৈধ নয়। অথচ হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ‘এক মুসলমান নামাযে রত অবস্থায় যে প্রার্থনা জানাবে তা পাবে’। জবাবে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) বলেনঃ নামাযের জন্যে অপেক্ষমাণ ব্যক্তিও নামাযরত ব্যক্তির সমান।

এটা তো হলো দূরের ব্যাখ্যার ব্যাপার। এ ব্যাখ্যা শুধু তখনই গ্রহণযোগ্য হবে যখন কোন ফকীহ সাহাবীর থেকে তা পাওয়া যাবে। দূরের ব্যাখ্যা সেটাই যা সুস্থ বিবেকের সামনে পেশ করলে তার সংগতিহীনতা ও প্রমাণহীনতার জন্যে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয় না। তারপর যদি তা প্রকাশ্য ইঙ্গিত, সুস্পষ্ট তাৎপর্য কিংবা সুস্পষ্ট বক্তব্যের পরিপন্থী হয় তা হলে আদৌ বৈধ নয়।

কাছাকাছি ব্যাখ্যার অন্যতম হলো ‘কসরে আম’ বা সীমিত সাধারণ হুকুম। এ ধরনের নির্দেশে কিছু সংখ্যক লোককে শামিল করার রীতি থাকে এবং তা থেকে এমন স্থানে সাধঅরণ অর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করা হয় যেখানে স্বভাবতই ভুল বুঝাবুঝির অবকাশ থাকে। যেমন প্রশংসাকীর্তন কিংবা নিন্দাগাথা রচনা। সাধারণ অর্থবোধক শব্দের অন্যতম হলো সেই শব্দ যা নির্দেশের মূল উদ্দেশ্য সাধনের পর যার জন্যে তা প্রযুক্ত হয় সে কাজে লাগানো হয়। সেটাকে সংশয়পূর্ণ বাক্যের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। যেমন হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “যে জমিনে বৃষ্টির পানি ফসল দেয় তার ওশর (দশমাংশ) হবে”। অন্যত্র তিনি বলেনঃ পাঁচ ওয়াসাকের কম হলে যাকাত নেই।

একটি ব্যাখ্যা এটাও যে, প্রত্যেক হাদীসকে বিশেষ এক উপযোগী অর্থে গ্রহণ করা হবে। একটি ব্যাখ্যা এই যে, দুটোকেই মাকরূহ পর্যায়ে রেখে সামগ্রিক বিবেচনায় বৈধতা বুঝানোর জন্যে ব্যবহৃত হবে। অবশ্য যদি তা সম্ভব হয়। তখন কড়াকড়ি করাকে সতর্কীকরণ হিসেবে বিবেচনা করা হবে, যদি পূর্বে কোনো অন্যায় ঘটে থাকে। তবে এ নির্দেশ- ‘তোমাদের জন্যে মৃত জীব হারাম করা হলো, কিংবা তোমাদের জন্যে তোমাদের মাতাকে হারাম করা হলো’ অর্থাৎ তাদের বিয়ে করা হারাম, এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বক্তব্য ‘নজর লাগা সত্য’ অর্থাৎ নজরের প্রভাব হওয়া প্রমাণিত সত্য কিংবা রাসূল সত্য অর্থাৎ রাসূলের প্রেরিত হওয়া সত্য, অথবা ‘আমার উম্মতের ভুল-চুক উপেক্ষিত হবে’ অর্থাৎ ভুল বশত কৃত পাপ মাফ করা হবে, কিংবা ওযূ ছাড়া নামায নেই বা ওলি ছাড়া বিয়ে নেই’ অথবা ‘সব আমলে ভিত্তি হলো নিয়ত’ অর্থাৎ নিয়ত ছাড়া আমলের সেই প্রভাব সৃষ্টি হয় না যা শরীয়াত নির্ধারণ করেছে, কিংবা ‘যখন নামাযে দাঁড়াও ধুয়ে নাও’ অর্থাৎ যদি তুমি ওযু করে না থাকো, করে নাও ইত্যাদি কোনো ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। কারণ আরবের লোক এর প্রতিটি শব্দের যথাযথ প্রয়োগ সম্পর্কে অবহিত। তাই তারা এর যথাযথ অর্থই গ্রহণ করে, মূলত এসব তাদের অহরহ ব্যবহারের ভাষা। ফলে এর প্রকাশ্য অর্থের বাইরে কোনো অর্থ তারা বুঝে না।

তবে যদি দুটো কাজই কোনো মাসআলার জবাব হয় কিংবা কোনো ঘটনার ফয়সালা হয়, তখন যদি তার ভেতরে পার্থক্য সৃষ্টিকারী কোনো কারণ পাওয়া যায় তাহলে তদনুসারেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। যেমন কোনো যুবক তাঁর কাছে রোযা রাখা অবস্থায় স্ত্রীকে চুম্বন দান সম্পর্কে জানতে চাইল তিনি তাকে নিষেধ করলেন। পক্ষান্তরে যখন এক বৃদ্ধ প্রশ্ন করল, তখন তিনি তাকে অনুমতি দিলেন।

যদি এক হাদীসে কোনো প্রয়োজনের দিকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় কিংবা প্রশ্নকারীর অনিহার কারণে নির্দেশ তামিল না করার ব্যাপারটি এড়িয়ে যাওয়া হয়, অথবা কেউ যদি ইচ্ছা করে সেটাকে কড়াকড়িভাবে পালন করে, অথচ অপর হাদীসে তা প্রমাণিত না হয়, তাহলে প্রথমটি রোখসত ও দ্বিতীয়টি আযীমাত হিসেবে গণ্য হবে।

যদি দুটো কাজই কোনো পরীক্ষা থেকে রোহই দান কিংবা কোনো পাপের শাস্তি দান অথবা কোনো কসম ভাঙ্গার কাফফারা হয় তো উভয়টিকে সঠিক বলে গ্রহণ করা হবে। তবে নাসেখ-মানসুখ হবার সম্ভাবনাও থেকে যাবে। এ পদ্ধতির ভিত্তিতেই হায়েজগ্রস্ত নারীর ব্যাপারে ফতোয়া দেয়া হয়েছে। কখনো প্রতি দু ওয়াক্ত নামাযে গোসলের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কখনো এ কথা বলা হয়েছে, স্বভাবত যতদিন হায়েজ থাকার কথা, ততদিনই হায়েজের দিন হিসেবে গণ্য হবে। কোথাও বলা হয়েছে বেশি রক্ত ঝরার দিনগুলোকে হায়েজের কাল ধরা হবে। এসব কারণে হয়েছে যে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হায়েজ গ্রস্তা নারীকে দুটো এখতিয়ারই দিয়েছেন। ইচ্ছে করলে সে অভ্যেসগত দিনগুলো পুরো অপেক্ষা করতে পারে অথবা রক্তের রঙ বিলুপ্ত হওয়াকে হায়েজের কাল বলে গণ্য করতে পারে। কারণ দুটোই হায়েজের কাল নির্ণয়ের মানদণ্ড হতে পারে।

তেমনি যে ব্যক্তি জিম্মায় রোযা রেখে মারা গেল, তার ব্যাপারে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এক বক্তব্যে তার তরফ থেকে রোযা রাখা ও অন্য ব্যক্তিকে খানা খাওয়াবার নির্দেশ রয়েছে। তেমনি যার নামাযে সন্দেহ থাকে তাকে তিনি দুটো পথ বাতলেছেন। ইচ্ছা হয় চিন্তাভাবনা করে রাকআতের সংখ্যা ঠিক করবে, অন্যথায় নিশ্চিত জানা রাকআত ধরে নামায পূর্ণ করবে। তেমনি তাঁর এক বক্তব্যে দেখা যায় বংশ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তিনি কখনো চেহারা ও আকৃতি অনুমান করে রায় দিয়েছেন, কখনো লটারির মাধ্যমে তা স্থির করেছেন।

যদি এসব বর্ণনায় নাসেখ-মানসুখ হবার সুস্পষ্ট দলীল থাকে তো সেটাই অনুসরণ করা হবে। এ ব্যাপারটি কখনো হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বক্তব্য ও বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়; যেমন, তিনি বললেনঃ আমি তোমাদের কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, কিন্তু এখন তা কর। কখনো তা এভাবে জানা যায় যে, হাদীস দুটোর সমন্বয় সাধন সম্ভব নয় এবং একটি আগের ও অপরটি পরের। পরবর্তী হাদীসের বিধান চালু হয়েছে ও প্রথমটির বিধান উহ্য হয়েছে। ফলে ফকীহ সাহাবীরা বুঝে নিয়েছেন যে, দ্বিতীয় হাদীস পয়লা হাদীসকে মানসুখ করেছে অথবা হাদীস দুটোয় মতভেদ থাকায় ফকীহ সাহাবীদের কেউ বলে দিলেন, একটি অপরটির নাসেখ। অবশ্য এ নসখ দৃশ্যত ঠিক হলেও চূড়ান্ত ধরা যাবে না। ফকীহরা তা বললেও যদি দেখা যায় যে, তাদের শায়েখদের আমল তার বিপরীত তা হলে তাদের বলাটাই যথেষ্ট হবে না।

নসখের পরিণতিতে এক হুকুমের বদলে অন্য হুকুম কায়েম হয়। মূলত একটি হুকুম বিলুপ্ত হয়। তা এ জন্যে যে, সে বিধানের কারণ শেষ হয়ে গেছে। অথবা মূল উদ্দেশ্যের জন্যে তারকারণ হওয়ায় সম্ভাবনা শেষে হয়েছে। কিংবা তার কারণ হবার পথে অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছে। অথবা আল্লাহর তরফের ওহী এসে তা রদ করেছে কিংবা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইজতেহাদে একটির ওপর অপরটির প্রাধান্য পেয়েছে। এটা তখনই হয় যখন পয়লা হুকুমটি ইজতেহাদের মাধ্যমে প্রদত্ত হয়। যেমন মিরাজের হাদীসে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ আমার বক্তব্যে কোনো রদবদল নেই।

যদি দুটো হাদীসের সমন্বয় সাধন কিংবা ব্যাখ্যার দ্বারাও দুটো রাখার কোনো সুযোগ না থাকে, এমনকি নসখ হওয়ারও কোনো প্রমাণ না থাকে, তখন বিরোধ থেকেই যায়। সেক্ষেত্রে যদি কোনোটিকে প্রাধান্য দেয়ার কারণ দেখা দেয় তো সেটাকে প্রধান্য দেবে। অন্যথায় দুটোকেই বাদ দেবে।

বিরোধের ক্ষেত্রে একটিকে প্রাধান্য দেবার কয়েকটি কারণ থাকে-

১। সনদের ভিত্তিতে অধিক বর্ণনাকারী থাকায় প্রাধান্য পায়। সেক্ষেত্রে বর্ণনাকারীকে ফকীহ হতে হয়, মুত্তাসিল ও মারফূ হাদীস হতে হয়। সে হাদীসের বর্ণনাকারীকে হাদীসের সাথে সংশ্লিষ্ট হতে হয়। হয় সে প্রশ্নকারী হবে অথবা হাদীস সংশ্লিষ্ট কাজের কর্তা হবে।

২। এ কারণেও প্রাধান্য পায় যে, কোনো একটি হাদীসের বক্তব্যে ব্যাখ্যা ও তাকীদ থাকে।

৩। বিধান ও তার কারণের সুস্পষ্টতার জন্যে প্রাধান্য পায়। বিধানটি শরীআতের অন্যান্য বিধানের সাথে সংগতি রাখে এবং তার কারণও এরূপ জোরালো যে, বিধানের সাথে তার সম্পর্ক সুস্পষ্টভাবে জানা যায়।

৪। কখনো বাইরের কোনো ব্যাপারের কারণেও প্রাধান্য পায়। অবশ্য অধিকাংশ আলেম যদি তা মেনে নেন।

হাদীসসমূহ বাতিল হওয়াটা নিছক কাল্পনিক ব্যাপার যা কখনো ঘটে না। কোনো সাহাবীর এ কথা বলা যে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ নির্দেশ দিয়েছেন যে, অমুক কাজ নিষেধ করেছেন, এটা করা সুন্নাত, এ কাজ যে করল সে আবুল কাসেম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাফরমানী করল, এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন, এ ব্যাপারে অবকাশ দিয়েছেন, আমাদের এ নির্দেশ দিয়েছেন, এ কাজ করতে আমাদের নিষেধ করেছেন, এ সবই হাদীস।

তা ছাড়া সাহাবীর এ কথা বলা যে, এটা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামম-এর নির্দেশ, এ থেকে বাহ্যত হাদীসটির মারফূ হওয়া জানা যায়। তবে এ সংশয়ও থেকে যায় যে সাহাবী কারণকে নির্দেশের ভিত্তি ধরে নিয়ে নিজে ইজতেহাদ করেছেন। অথবা নিজেই বিধান নির্ধারিত করেছেন যে, এটা ওয়াজিব, এটা মুস্তাহাব, এটা ব্যাপকার্থক এবং এটা বিশেষার্থক।

কোনো সাহাবী যখন বলেন হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কাজ করতেন, তার অর্থ সে কাজ তিনি কয়েকবার করেছেন। সাহাবী যখন বলেনঃ তিনি অন্য কাজ করতেন, তার অর্থ এ নয় যে, আগের কাজটি করেননি। তবে কোনো সাহাবীর এ বক্তব্য –“আমি তাঁর সাহচর্য ছিলাম এবং তাঁকে এটা নিষেধ করতে দেখিনি, এবং আমরা তাঁর যুগে একাজ করতাম’। বাহ্যত এটা কোনো বিধানের দলীল বটে, কিন্তু হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বক্তব্য নয়।

কখনো সূত্রে বিভিন্নতার কারণে হাদীসের শব্দে পার্থক্য দেখা দেয়। এ শাব্দিক পার্থক্য মূলত হাদীসটির বক্তব্য নিজের ভাষায় বর্ণনার কারণে ঘটে থাকে। তবে যদি কোনো হাদীস এমন হয় যে, নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের ভাষায় কোনো পার্থক্য না থাকে তাহলে বুঝা যাবে, সেটা হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভাষা। হয়ত শব্দ প্রয়োগে আগ-পিছ হতে পারে। অথবা ‘এবং’, ‘অতঃপর’ ইত্যকায় শব্দ যোগ হতে পারে। তবে যদি বর্ণনাকারীদের ভাষায় সংশয়যোগ্য মতভেদ দেখা দেয়, এবং তারা ফেকাহ জ্ঞান, মুখস্ত শক্তি ও বর্ণনাধিক্যে কাছাকাছি ও সমমর্যাদার হন, তখন বাহ্যিক ভাষাকে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বলা যাবে না। সেক্ষেত্রে হাদীসটি শুধু সেই অর্থেই ব্যবহৃত হবে যে অর্থে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে বর্ণনা করেছেন।

অধিকাংশ বর্ণনাকারীর পদ্ধতি এটাই ছিল যে, তারা বাড়তি শব্দ বা টিকা বাদ দিয়ে মূল বক্তব্যটির গুরুত্ব দিতেন। যদি বর্ণনাকারীদের মান সমান না হয়, তাহলে নির্ভরযোগ্য রাবীর বর্ণনা কিংবা বহুল বর্ণিত বর্ণনা গ্রহণ করা হবে। অথবা তার বর্ণনা গ্রহণ করা হবে যার সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে বেশি জানা রয়েছে।

যদি জানা যায় যে, কোনো নির্ভরযোগ্য বর্ণনায় কোনো বেশি কথা বর্ণিত হয়েছে, যেমনি হযরত আয়েশা (রাঃ) ‘দাঁড়ালেন’ না বলে ‘লাফিয়ে উঠলেন’ অথবা তিনি ‘হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গোসল করলেন’ না বলে ‘তিনি চামড়ার ওপর পানি বহালেন’ কথাটি বলেছেন। এরূপ ক্ষেত্রে তার বর্ণনাটিই গ্রহণ করা হবে। তবে যদি বর্ণনাকারীদের ভেতর চরম মতভেদ দেখা দেয় এবং কোনোটিকে প্রাধান্য দেবার কোনো সূত্র না পাওয়া যায়, তা হলে যে বিশেষ ক্ষেত্রে মতভেদ দেখা দেবে সেটা বাদ দেয়া হবে।

মুরছাল হাদীসের সাথে যদি কোনো লক্ষণ যোগ হয় যেমন কোনো সাহাবীর মাওকুফ হাদীসের সমর্থন পেয়ে তা শক্তি অর্জন করল, অথবা কোনো সাহাবীর জঈফ মুসনাদ হাদীস কিংবা অন্য কোনো সাহাবীর মুরছাল হাদীস দ্বারা শক্তি পায়, এবং উভয় হাদীসের বর্ণনাকারী ভিন্ন হয় অথবা অধিকাংশ হাদীস বিশারদের বক্তব্য, অনুমান ও ইঙ্গিত দ্বারা তা সমর্থিত হয়, কিংবা এটা জানা যায় যে, সংশ্লিষ্ট বর্ণনাকারী শুধু ন্যায়নিষ্ঠ ও নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর হাদীসই মুরছাল রূপে বর্ণনা করেন, তখন সে হাদীস দ্বারা প্রমাণ দেয়া বিশুদ্ধ হবে। অবশ্য হাদীসটি মুসনাদ হিসেবে কম মর্যাদা পাবে। তবে যদি উপরোক্ত আলোচনা অনুসারে মুরসাল হাদীস দ্বারা সমর্থিত না হয় তা হলে তা দিয়ে দলীল দেয়া যাবে না।

তেমনি দুর্বল মুখস্ত শক্তির বর্ণনাকারী যদি কোনো হাদীস বর্ণনা করেন, যদি তিনি অজ্ঞাত ও অভিযুক্ত ব্যক্তি না হন, তাহলে পছন্দনীয় কথা এটাই যে, হাদীসটি গ্রহণযোগ্য হবে। শর্ত এটাই যে, তার সমর্থনে কোনো লক্ষণ থাকতে হবে। যেমন তা কেয়াস সম্মত অথবা অধিকাংশ আলেম তা আমল করে থাকেন। যদি তা না হয় তা হলে গ্রহণযোগ্য হবে না।

যখন কোনো ছেকাহ রাবী এককভাবে কিছু বাড়তি বর্ণনা করেন এবং তা এরূপ বর্ণনা, যে ব্যাপারে অন্যান্য রাবী চুপ থাকতে পারেন, তা হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে। যেমন মুরসাল হাদীসের সনদ বর্ণনা করা কিংবা সনদের ভেতরে কোনো রাবীর বাড়তি বর্ণনা, অথবা হাদীসের উৎস বর্ণনা করা কিংবা বর্ণনা ও তার ভেতরে দীর্ঘ বক্তব্যের কারণ বর্ণনা করা, অথবা বাক্যের তাৎপর্যে পরিবর্তন না এনে স্বতন্ত্র কোনো বাক্যাংশ যোগ করা ইত্যাদি। তবে যদি সে ব্যাপারে অন্যান্য রাবী নীরব না থাকতে পারেন, যেমন তাৎপর্য পরিবর্তনকারী বাড়তি কথা অথবা এরূপ দুর্লভ বস্তুর উল্লেখ করা যা স্বভাবত বর্জনীয় নয়, তাহলে এরূপ বাড়তি বর্ণনা অগ্রাহ্য হবে।

যখন কোনো সাহাবী কোনো হাদীসকে কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন, আর সেক্ষেত্রে যদি ইজতেহাদের অবকাশ থাকে তাহলে সামগ্রিক বিবেচনায় এ প্রয়োগকে বাহ্যিক বলে ধরা হবে, যতক্ষণ না এর বিরুদ্ধে কোনো দলীল পাওয়া যায়। তবে যদি সেক্ষেত্রে ইজতেহাদের কোনো অবকাশ না থেকে থাকে, তা হলে এ প্রয়োগ জোরদার হবে। যেমন কোনো জ্ঞানী ও ভাষাবিদ অবস্থা ও বক্তব্যের লক্ষণ ও ইঙ্গিতের মাধ্যমে কোনো ব্যাপার বুঝে নেন।

সাহাবা ও তাবেঈনদের ভেতরকার মতভেদের সমাধান হলো এই যে, যদি তাতে সমন্বয় সম্ভব হয়, তা হলে সেটাই উত্তম এবং ওপরে আলোচিত পদ্ধতিগুলোর যে কোনো এক পদ্ধতিতে তা হতে হবে। তা না হলে এ প্রশ্নে দুই বা ততোধিক অভিমত রয়েছে। সেক্ষেত্রে দেখা চাই যে, কোনটি অপেক্ষাকৃত সঠিক বিবেচিত হতে পারে।

সাহাবাদের মজহাবগুলোর উৎস জানা এক গুপ্ত জ্ঞানের ব্যাপার। সেক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রয়াস চালালে কিছু না কিছু অংশ লাভ হবেই। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।