দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করা ও দারিদ্রতার মাহাত্ম্য



রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে- 
 
 

আল্লাহ তাআলা বলেন,
“বস্তুতঃ পার্থিব জীবনের দৃষ্টান্ত তো বৃষ্টির মত, যা আমি আসমান হতে বর্ষণ করি। অতঃপর তার দ্বারা উৎপন্ন হয় ভূপৃষ্টের উদ্ভিদগুলো অতিশয় ঘন হয়, যা থেকে মানুষ ও পশুরা ভক্ষণ করে। অতঃপর যখন ভূমি তার শোভা ধারণ করে ও নয়নাভিরাম হয়ে ওঠে এবং তার মালিকরা মনে করে যে, তারা এখন তার পুর্ন অধিকারী, তখন দিনে অথবা রাতে তার উপর আমার (আযাবের) আদেশ এসে পড়ে, সুতরাং আমি তা এমনভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেই, যেন গতকাল তার অস্তিত্বই ছিল না। এরুপেই আয়াতগুলোকে আমি চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য বিশদরূপে বর্ণনা করে থাকি”।(সূরা ইউনুস ২৪)
তিনি আরও বলেন,
“তাদের কাছে পেশ কর উপমা পার্থিব জীবনের; এটা পানির ন্যায় যা আমি বর্ষণ করি আকাশ হতে, যার দ্বারা ভূমির উদ্ভিদ ঘন সন্নিবিস্ট হয়ে উদগত হয়। তারপর তা বিশুষ্ক হয়ে এমন চূর্ন-বিচূর্ন হয় যে, বাতাস ওকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। আর আল্লাহ সর্ব বিষয়ে শক্তিমান। ধনঐশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি পার্থিব জীবনের শোভা। আর সৎকার্য, যার ফল স্থায়ী, ওটা তোমার প্রতিপালকের নিকট পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য শ্রেষ্ঠ এবং আশা প্রাপ্তির ব্যাপারেও উৎকৃষ্ট।” (সূরা কাহফ ৪৫-৪৬ )
 আরো অন্য জায়গায় তিনি বলেছেন,
 “তোমার জেনে রাখো যে, পার্থিব জীবন তো ক্রীড়া-কৌতুক, জাঁকজমক, পারষ্পরিক অহংকার প্রকাশ, ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি প্রাচুর্য লাভের প্রতিযোগিতা ব্যতীত আর কিছুই নয়। এর উপমা বৃষ্টি; যার দ্বারা উৎপন্ন ফসল কৃষকদেরকে চমৎকৃত করে, তারপর তা শুকিয়ে যায়, ফলে তুমি তা পীতবর্ন দেখতে পাও, অবশেষে তা টুকরো-টুকরো (খড়-কুটায়) পরিণত হয় এবং পরকালে রয়েছে কঠিন শাস্তি এবং আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। আর পার্থিব জীবন ছলনাময় ভোগ ব্যতীত কিছুই নয়।” (সূরা হাদীদ ২০ আয়াত)
অন্যএ আল্লাহ তাআলা বলেন,
 “নারী, সন্তান-সন্ততি, জমাকৃত সোনা-রূপার ভাণ্ডার, পছন্দসই (চিহ্নত) ঘোরা, চতুষ্পদ জন্তু ও ক্ষেত-খামারের প্রতি আসক্তি মানুষের নিকট লোভনীয় করা হয়েছে। এ সব ইহজীবনের ভোগ্য বস্ত। আর আল্লাহর নিকতেই উওম আশ্রয়স্থল রয়েছে”। (আলে ইমরান ১৪)
তিনি আরো বলেন,
” হে মানুষ! আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য; সুতরাং পার্থিব জীবন যেন কিছুতেই তোমাদেরকে প্রতারিত না করে এবং কোন প্রবঞ্চক যেন কিছুতেই আল্লাহ সম্পর্কে প্রবঞ্চিত না করে”। (সূরা ফাত্বির ৫ আয়াত)
আল্লাহ তাআলা অন্য জায়গায় বলেন, 
  “প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে। যতক্ষণ না তোমরা (মরে) কবরে উপস্থিত হও। কখনও নয়, তোমরা শীঘ্রই জানতে পারবে। আবার বলি, কখনও নয়, তোমরা শীঘ্রই জানতে পারবে। সত্যিই, তোমরা নিশ্চিত জ্ঞান থাকলে অবশ্যই তোমরা জানতে (ঐ প্রতিযোগিতার পরিণাম)” (সূরা তাকাসুর ১-৫ আয়াত)
তিনি আরও বলেন,
 “এ পার্থিব জীবন তো খেল-তামাশা ছাড়া কিছুই নয়। আর পরলৌকিক জীবনই তো প্রকৃত জীবন; যদি ওরা জানত”। (সূরা আনকাবূত ৬৪ আয়াত)
এ মর্মে প্রচুর আয়াত ও হাদীস রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি হাদীস বর্ণনা করা হল-
১) আমর ইবনে আউফ আনসারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একবার আবূ উবাইদাহ ইবনে জারাহকে জিযিয়া (ট্যাক্স) আদায় করার জন্য বাহরাইন পাঠালেন। তারপর তিনি বাহরাইন থেকে (প্রচুর) মাল নিয়ে এলেন। আনসারগন তাঁর আগমনের সংবাদ শুনে ফজরের নামাযে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে শরীক হলেন। যখন তিনি নামায পড়ে (নিজ বাড়ি) ফিরে যেতে লাগলেন, তখন তারা তাঁর সামনে এলেন।  রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদেরকে দেখে হেসে বললেন, “আমার মনে হয়, তোমরা আবূ উবাইদাহ বাহরাইন থেকে কিছু (মাল) নিয়ে এসেছে, তা শুনেছ।”  তারা বলল, ‘জী হ্যাঁ ।’ তিনি বললেন, “সুসংবাদ গ্রহণ কর এবং তোমরা সেই আশা রাখ, যা তোমাদেরকে আনন্দিত করবে। তবে আল্লাহর কসম! তোমাদের উপর দারিদ্র্য আসবে আমি এ আশংকা করছি না.বরং আশংকা করছি যে, তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতের ন্যায় তোমাদেরও পার্থিব জীবনে প্রশস্তুতা আসবে। আর তাতে তোমরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, যেমন তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছিল।।” (সহীহুল বুখারী ৩১৫৮,৪০১৫, মুসলিম ২৯৬১)
২) আবূ সাইদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মিম্বরে বসলেন এবং আমরা তাঁর আশেপাশে বসলাম। তারপর তিনি বললেন, “আমি তোমদের উপর যার আশঙ্কা করছি তা হল এই যে, তোমাদের উপর শোভা ও সৌন্দর্য (এর দরজা) খুলে দেওয়া হবে।” (সহীহুল বুখারী ১৪৬৫,৯২২, মুসলিম ১০৫২)
৩) উক্ত রাবী (রাঃ) থেকেই বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “দুনিয়া হচ্ছে সুমিষ্ট ও সবুজ শ্যামল এবং আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে তাতে প্রতিনিধি করেছেন। তারপর তিনি দেখবেন যে, তোমরা কিভাবে কাজ কর। অতএব তোমরা দুনিয়ার ব্যাপারে সাবধান হও ও নারীজাতির ব্যাপারে।” (মুসলিম ২৭৪২, তিরমিযী ২১৯১)
৪) আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেন, “হে আল্লাহ! আখেরাতের জীবনই প্রকৃত জীবন।” (সহীহুল বুখারী ২৮৩৪,২৮৩৫ মুসলিম ১৮০৫)
৫) উক্ত রাবী থেকেই বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেন, “তিনটি জিনিস মৃত ব্যক্তির অনুসরণ করে (সঙ্গে যায়)  দাফনের পর দুটি ফিরে আসে, আর একটি তার সাথেই থেকে যায়। সে তিনটি হল, (এক) তার পরিবারবর্গ, (দুই) তার মাল, (তিন) তার আমল। দাফনের পর তার পরিবারবর্গ ও মাল ফিরে আসে। আর তার আমল তার সাথেই থেকে যায়।” (সহীহুল বুখারী ৬৫১৪, মুসলিম ২৯৬০)
৬) উক্ত রাবী থেকেই বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেন, “কিয়ামতের দিন জাহান্নামীদের মধ্যে হতে এমন এক ব্যক্তি নিয়ে আসা হবে, যে দুনিয়ায় সবচেয়ে সুখী ও বিলাসী ছিল। তারপর তাকে জাহান্নামে একবার (মাএ) চুবানো হবে, তারপর তাকে বলা হবে, ‘হে আদম সন্তান! তুমি কি কখনো ভাল জিনিস দেখেছ? তোমার নিকটে কি কখনো সুখ-সামগ্রী এসেছে?’ সে বলবে, ‘না। আল্লাহর কসম! হে প্রভু!’ আর জান্নাতীদের মধ্যে হতে এমন এক ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হবে, যে দুনিয়ায় সবচেয়ে দুখী ও অভাবী ছিল। তাকে জান্নাতে (মাএ একবার) চুবানোর পর বলা হবে, ‘হে আদম সন্তান! তুমি কি দুনিয়ায়তে কখনো কষ্ট দেখছ? তোমার উপরে কি কখনো বিপদ গেছে?’ সে বলবে, ‘না। আল্লাহর কসম! আমার উপর কোনদিন কষ্ট আসেনি এবং আমি কখনো কোন বিপদও দেখিনি।” (মুসলিম ২৮০৭, আহমাদ ১২৬৯৯,১৩২৪৮)
৭) মুস্তাওরিদ ইবনে শাদ্দাদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “আখিরাতের মুকাবেলায় দুনিয়ার দৃষ্টান্ত ঐরূপ, যেমন তোমাদের কেউ সমুদ্রে আঙ্গুল ডুবায় এবং ( তা বের করে ) দেখে যে,  আঙ্গুলটি সমুদ্রে কতটুকু পানি নিয়ে ফিরেছে।” (মুসলিম ২৮৫৮,  আহমাদ ১৭৫৪৭,১৭৫৪৮)
৮) জাবের (রাঃ) হতে বর্ণিত,একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বাজারের পাশ দিয়ে গেলেন। এমন অবস্থায় যে, তাঁর দুই পাশে লোকজন ছিল। তারপর তিনি ছোট কানবিশিষ্ট একটি মৃত ছাগল ছানার পাশ দিয়ে গেলেন। তিনি তার কান ধরে বললেন, “তোমাদের কেউ কি এক দিরহামের পরিবর্তে এটাকে নেওয়া পছন্দ করবে?” তারা বললেন, ‘আমরা কোন জিনিসের বিনিময়ে এটা নেওয়া পছন্দ করব না এবং আমারা এটা নিয়ে করবই বা কি?’ তিনি বললেন, “তোমরা কি পছন্দ কর যে, (বিনামুল্যে) এটা তোমাদের হোক?” তারা বললেন, ‘আল্লাহর কাসম! যদি এটা জীবিত থাকত তবুও সে ছোট কানের কারনে দোষযুক্ত ছিল। এখন সে মৃত (সেহেতু একে কে নেবে)?’ তিনি বললেন, “আল্লাহর কসম! তোমাদের নিকট এই  মৃত ছাগল ছানাটা যতটা  নিকৃষ্ট, দুনিয়া আল্লাহর নিকট তার চেয়ে বেশি নিকৃষ্ট।” (মুসলিম ২৯৫৭, আবূ দাউদ ১৮৬, আহমাদ ১৪৫১৩)
৯) আবূ যার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি (একবার) নবী (সাঃ) –এর সাথে মদীনার কালো পাথুরে যমীনে হাঁটছিলাম। উহুদ পাহাড় আমাদের সামনে পড়ল। তিনি বললেন, “হে আবূ যার! এতে আমি খুশী নই যে, আমার নিকট এই উহুদ পাহাড় সমান স্বর্ণ থাকবে, এ অবস্থায় তিনদিন অতিবাহিত হবে অথচ তার মধ্যে থেকে একটি দীনারও আমার কাছে অবশিষ্ট থাকবে। অবশ্য টা থাকবে যা আমি ঋণ আদায়ের জন্য বাকী রাখব অথবা আল্লাহর বান্দাদের মাঝে এইভাবে এইভাবে এইভাবে ডানে, বামে ও পিছনে খরচ করব।”
তারপর (কিছু আগে) চলে তিনি বললেন, “প্রাচুর্যের অধিকারীরাই কিয়ামতের দিন নিঃস্ব হবে। অবশ্য সে নয় যে সম্পদকে (ফোয়ারার মত) এইভাবে এইভাবে এইভাবে ডানে, বামে ও পিছনে খরচ করে। কিন্ত এরকম লোকের সংখ্যা খুবই কম।”
তারপর তিনি আমাকে বললেন, “তুমি এখানে বসে থাক, যতক্ষণ না আমি তোমাদের কাছে (ফিরে) আসছি।” এরপর তিনি রাতের অন্ধকারে চলতে লাগলেন, এমনকি শেষ পর্যন্ত তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। হঠাৎ, আমি এক জোর শব্দ শুনলাম। আমি ভয় পেলাম যে কোন শত্রু হয়তো নবী (সাঃ)-এর সামনে পড়েছে। সুতরাং আমি তাঁর নিকট যাওয়ার ইছা করলাম, কিন্ত তাঁর কথা আমার স্মরণ হল, “তুমি এখানে বসে থাক, যতক্ষণ না আমি তোমাদের কাছে (ফিরে) আসছি।” সুতরাং আমি তাঁর ফিরে না আসা পর্যন্ত বসে থাকলাম। (তিনি ফিরে এলে) “আমি বললাম,আমি এক জোর শব্দ শুনলাম, যাতে আমি ভয় পেলাম ।” সুতরাং যা শুনলাম আমি তা তাঁর কাছে উল্লেখ করলাম।
তিনি বললেন, “তুমি শব্দ শুনেছিলে?” আমি বললাম, “জী হ্যাঁ” , তিনি বললেন, “তিনি জিবরাঈল ছিলেন। তিনি আমার কাছে এসে বললেন, “আপনার উম্মাতের মধ্যে যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করে মরবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” আমি বললাম, “যদিও সে ব্যভিচার করে ও চুরি করে তবুও কি?” তিনি বললেন, “যদিও সে ব্যভিচার করে ও চুরি করে।” (সহীহুল বুখারী ৬২৬৮,১২৩৭,২৩৮৮,৩২২২, মুসলিম ৯৪)
১০) আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকেই বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যদি আমার নিকট উহুদ পাহাড় সমান সোনা থাকত, তাহলে আমি এতে আনন্দিত হতাম যে, ঋণ পরিশোধের পরিমাণ মত বাকী রেখে অবশিষ্ট সবটাই তিন দিন অতিবাহিত না হতেই আল্লাহর পথে খরচ করে ফেলি।” (সহীহুল বুখারী ২৩৮৯,৬৪৪৫,৭২২৮, মুসলিম ৯৯১)
১১) উক্ত সাহাবী (সাঃ) থেকেই বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেন, “(দুনিয়ার ধন-দৌলত ইত্যাদির দিক দিয়ে) তোমারা মধ্যে যে নীচে তোমরা তার দিকে তাকাও এবং যে তোমাদের উপরে তার দিকে তাকায়ো না। যেহেতু সেটাই হবে উৎকৃষ্ট পন্থা যে, তোমাদের প্রতি যে আল্লাহর নিয়ামত রয়েছে তা তুচ্ছ মনে করবে না।” (সহীহুল বুখারী ৬৪৯০,মুসলিম ২৯৬৩)
১২) বুখারীর বর্ণনায় আছে, “তোমাদের কেউ যখন এমন ব্যক্তির দিকে তাকায়, যাকে সম্পদে ও দৈহিক গঠনে তার থেকে বেশি শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে, তখন সে যেন এমন ব্যক্তির দিকে তাকায়, যে এ বিষয়ে তার চেয়ে নিম্নস্তরের।”
১৩) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেন, “ধ্বংস হোক দীনারের গোলাম, দিরহামের গোলাম ও উওম পোশাকের গোলাম (দুনিয়াদার)! যদি তাকে দেওয়া হয়, তাহলে সে সন্তুষ্ট হয়। আর না দেওয়া হলে অসন্তুষ্ট হয়। (সহীহুল বুখারী ২৮৮৭, ৭৪৩৫, তিরমিযী ২৫৭৫)
১৪) উক্ত সাহাবী (রাঃ) থেকেই বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘সওরজন (আহলে সুফফাকে) এই অবস্থায় দেখেছি, তাদের কারো কাছে (গা ঢাকার) জন্য চাদর ছিল না, কারো কাছে লুঙ্গী ছিল এবং কারো কাছে চাদর, (এক সঙ্গে দুটি বস্ত্রই কারো কাছে ছিল না) তারা তা গর্দানে বেঁধে নিতেন। তারপর সেই বস্ত্র কারো পায়ের অর্ধগোছা পর্যন্ত হত এবং কারো পায়ের গাঁট পর্যন্ত। সুতরাং তাঁরা তা হাত দিয়ে জমা করে ধরে রাখতেন, যেন লজ্জাস্থান দেখা না যায়!’ (সহীহুল বুখারী ৪৪২)
১৫) উক্ত রাবী থেকেই বর্ণিত, তিনি বললেন, নবী (সাঃ) বলেছেন, “দুনিয়া মু’মিনের জন্য জেলখানা এবং কাফেরের জন্য জান্নাত।” (মুসলিম ২৯৫৬, তিরমিযী ২৩২৪)
১৬) ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) (একদিন) আমার দুই কাঁধ ধরে বললেন, “তুমি এ দুনিয়াতে একজন মুসাফির অথবা পথচারীর মত থাক।” আর ইবনে উমার (রাঃ) বলতেন, ‘তুমি সন্ধ্যায় উপনীত হলে আর ভোরের অপেক্ষা করো না এবং ভোরে উপনীত হলে সন্ধ্যার অপেক্ষা করো না। তোমার সুস্থতার অবস্থায় তোমার পীড়িত অবস্থার জন্য কিছু সঞ্চয় কর এবং জীবিত অবস্থায় তোমার মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ কর।” (সহীহুল বুখারী ৬৪১৬, তিরমিযী ২৩৩৩)
*এই হাদিসটির ব্যাখ্যায় উলামাগন বলেন, দুনিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ো না এবং তাকে নিজের আসল ঠিকানা বানিয়ে নিও না । মনে মনে এ ধরনা করো না যে, তুমি তাতে দীর্ঘজীবী হবে। তুমি তার প্রতি যত্নবান হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করো না। তার সাথে তোমরা সম্পর্ক হবে ততটুক, যতটুক একজন প্রবাসী তার প্রবাসের সাথে রেখে থাকে। তাতে সেই বিষয়-বস্ত নিয়ে বিভোল হয়ে যেও না, যে বিষয়-বস্ত নিয়ে সেই প্রবাসের ব্যক্তি হয় না, যে স্বদেশে নিজের পরিবারের নিকট ফিরে যেতে চায়। আর আল্লাহই তওফীক দাতা।
১৭) আবুল আব্বাস সাহল ইবনে সা’দ (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি নবী (সাঃ) –এর কাছে এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! আপনি আমাকে এমন কর্ম বলে দিন, আমি তা করলে যেন আল্লাহ আমাকে ভালবাসেন এবং লোকেরাও আমাকে ভালবাসে।’ তিনি বললেন, “দুনিয়ার প্রতি বিতৃষ্ণা আনো, তাহলে আল্লাহ তোমাকে ভালবাসবেন। আর লোকদের ধন-সম্পদের প্রতি বিতৃষ্ণা আনো, তাহলে লোকেরা তোমাকে ভালবাসবে।” (ইবনু মাজাহ ৪১০২)
১৮) নু’মান ইবনে বাশীর (রাঃ) বলেন, উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) (পূর্বেকার তুলনায় বর্তমানে) লোকেরা যে দুনিয়ার (ধন-সম্পদ) অধিক জমা করে ফেলেছে সে কথা উল্লেখ করে বললেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) –কে দেখেছি, তিনি সারা দিন ক্ষুধায় থাকর ফলে পেটের উপর ঝুঁকে থাকতেন (যেন ক্ষুধার জ্বালা কম অনুভব হয়)  তিনি পেট ভরার জন্য নিকৃষ্ট মানের খুরমাও পেতেন না।’ (মুসলিম ২৯৭৭,২৯৭৮, তিরমিযী ২৩৭২)
১৯) আয়েশা (রাঃ) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এই অবস্থায় ইন্তেকাল করলেন যে, তখন একটা প্রানীর খেয়ে বাঁচার মত কিছু খাদ্য আমার ছিল না। তবে আমার তাকের মধ্যে যৎসামান্য যব ছিল। এ থেকে বেশ কিছুদিন আমি খেলাম। কিন্ত যখন একদিন মেপে নিলাম, সেদিনই তা শেষ হয়ে গেল।” (সহীহুল বুখারী ৩০৯৭, তিরমিযী ২৪৬৭)
২০) উম্মুল মু’মিনীন জুয়াইরিয়্যাহ বিন্তে হারেসের ভাই আমর ইবনে হারেস (রাঃ) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর মূত্যুর সময় কোন দীনার, দিরহাম, ক্রেতদাসী এবং কোন জিনিসই ছেড়ে যাননি। তবে তিনি ঐ সাদা খচ্চরটি ছেড়ে গেছেন, যার উপর তিনি সওয়ার হতেন এবং তাঁর হাতিয়ার ও কিছু জমি; যা তিনি মুসাফিরদের জন্য সাদকাহ করে গেছেন।’ (সহীহুল বুখারী ৪৪৬১,২৭৩৯,২৮৭৩)
২১) খাব্বার ইবনে আরাও (রাঃ) বলেন, ‘আমরা আল্লাহর চেহেরা (সন্তোষটি) লাভের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে (মদীনা) হিজরত করলাম। যার সওয়াব আল্লাহর নিকট আমাদের প্রাপ্য। এরপর আমাদের কেউ এ সওয়াব দুনিয়াতে ভোগ করার পূর্বেই বিদায় নিলেন। এর মধ্যে মুসআব ইবনে উমাইর (রাঃ) তিনি উহুদ যুদ্ধে শহীদ হলেন এবং শুধুমাএ একখানা পশমের রঙিন চাদর রেখে গেলেন। আমরা (কাফনের জন্য) তা দিয়ে তাঁর মাথা ঢাকলে তাঁর পা বেরিয়ে গেল। আর পা ঢাকলে তাঁর মাথা বেরিয়ে গেল। তাই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদেরকে নির্দেশ দিলেন যে, “তা দিয়ে তাঁর মাথা ঢেকে দাও এবং পায়ের উপর ‘ইযখির’ ঘাস বিছিয়ে দাও।” আর আমাদের মধ্যে এমনও লোক রয়েছেন, যাঁদের ফল পেকে গেছে। আর তাঁরা তা সংগ্রহ করছেন।’ (সহীহুল বুখারী ১২৭৬, ৩৮৯৭,৩৯১৪,৪০৪৭)
২২) সাহল ইবনে সা’দ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যদি আল্লাহর নিকট মাছির ডানার সমান দুনিয়া (মূল্য বা ওজন) থাকত, তাহলে তিনি কোন কাফেরকে তাঁর (দুনিয়ার) এক ঢোক পানিও পান করাতেন না।” (তিরমিযী ২৩২০, ইবনে মাজাহ ৪১১০)
২৩) আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) –কে বলতে শুনেছি, “শোনো ! নিঃসন্দেহে দুনিয়া অভিশপ্ত। অভিশপ্ত তাঁর মধ্যে যা কিছু আছে (সবই)  তবে আল্লাহর যিকর এবং তাঁর সাথে সম্পৃক্ত জিনিস, আলেম ও তালেবে-ইলম নয়।” (তিরমিযী ২৩২২, ইবনে মাজাহ ৪১১২)
২৪) আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “তোমরা জমি-জায়গা, বারি-বাগান ও শিল্প-ব্যবসায়ে বিভোর হয়ে পড়ো না। কেননা, (তাহলে) তোমরা দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়বে।” (তিরমিযী ২৩২৮, আহমাদ ৩৫৬৯,৪০৩৮,৪২২২)
২৫) আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একদিন আমাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। এমন অবস্থায় যে, আমরা আমাদের একটি কুঁড়েঘর সংস্কার করছিলাম। তিনি বললেন, “এটা কী?” আমরা বললাম, ‘কুঁড়ে ঘরটি দুর্বল হয়ে ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছিল, তাই আমরা তা মেরামত করছি।’ তিনি বললেন, “আমি ব্যাপারটিকে (মৃত্যুকে) এর চাইতেও নিকটবর্তী ভাবছি।” (তিরমিযী ২৩৩৫, আহমাদ ৬৪৬৬)
২৬) কা’ব ইবনে ইয়ায (রাঃ) বলেন, আমি আল্লাহর রসূল (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি; “প্রত্যেক উম্মাতের জন্য ফিতনা রয়েছে এবং আমরা উম্মাতের ফিতনা হচ্ছে মাল।” (তিরমিযী ২৩৩৬, আহমাদ ১৭০৭)
২৭) আব্দুল্লাহ ইবনে শিখখীর (রাঃ) বলেন, আমি নবী (সাঃ) –এর নিকট এলাম, এমন অবস্থায় যে, তিনি ‘আলহাকুমুত তাকাসুর’ অর্থাৎ, প্রাচুর্য্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে। (সূরা তাকাসুর) পড়ছিলেন।
তিনি বললেন, “আদম সন্তান বলে, ‘আমার মাল, আমার মাল।’ অথচ হে আদম সন্তান! তোমার কি এ ছাড়া কোন মাল আছে, যা তুম খেয়ে শেষ করে দিয়েছ অথচ যা তুমি পরিধান করে পুরাতন করে দিয়েছ অথবা সাদকাহ করে (পরকালের জন্য) জমা রেখেছ।” (মুসলিম ২৯৫৮)
২৮) আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন একটি লোক নবী (সাঃ) –কে বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! আল্লাহর কসম! আমি নিঃসন্দেহে আপনাকে ভালবাসি।’ তিনি বললেন, “তুমি যা বলছ, তা চিন্তা করে বল।” সে বলল, ‘আল্লাহর কসম! আমি নিঃসন্দেহে আপনাকে ভালবাসি।’ এরূপ সে তিনবার বলল। তিনি বললেন, “যদি তুমি আমাকে ভালবাসো, তাহলে দারিদ্রের জন্য বর্ম প্রস্তুত রাখো। কেননা, যে আমাকে ভালবাসবে স্রোত তার শেষ প্রান্তের দিকে যাওয়ার চাইতেও বেশি দ্রতগতিতে দারিদ্র তার নিকট আগমন করবে।” (তিরমিযী ২৩৫০)
২৯) কা’ব ইবনে মালেক (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “ছাগলের পালে দুটি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘকে ছেড়ে দিলে ছাগলের যতটা ক্ষতি করে, তার চেয়ে মানুষের সম্পদ ও সম্মানের প্রতি লভ-লালসা তার দ্বীনের বেশী ক্ষতিকারক।” (তিরমিযী ২৩৭৬, আহমাদ ১৫৩৫৭, ১৫৩৬৭)
৩০) আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একদিন চাটাই –এর উপর শুলেন। তারপর তিনি এই অবস্থায় উঠলেন যে, তাঁর পার্শ্বদেশে দাগ পড়ে গিয়েছিল। আমরা বললাম, ‘হে আল্লাহর রসূল! যদি (আপনার অনুমতি হয়, তাহলে) আমরা আপনার জন্য নরম গদি বানিয়ে দিই।’ তিনি বললেন, “দুনিয়ার সাথে আমার কি সম্পর্ক? আমি তো এ জগতে ঐ সওয়ারের মত যে ক্লান্ত হয়ে একটু বিশ্রামের জন্য গাছের ছায়ায় থামল। পুনরায় সে চলতে আরম্ভ করল এবং ঐ গাছটি ছেড়ে দিল।” (তিরমিযী ২৩৭৭, ইবনু মাজাহ ৪১১৬৯)
৩১) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “গরীব মুমিনরা ধনীদের পাঁচশত বছর পূর্বে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (তিরমিযী ২৩৫৩,২৩৫৪, ইবনু মাজাহ ৪১২২)
৩২) ইবনে আব্বাস (রাঃ) ও ইমরান ইবনে হুসাইন(রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেন, “আমি বেহেশ্তের মধ্যে তাকিয়ে দেখলাম, তার অধিকাংশই গরীব লোক। আর দোযখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তার অধিকাংশ অধিবাসীরাই মহিলা।” (সহীহুল বুখারী ৩২৪১,৫১৯৮,৬৪৪৯,৬৫৪৬, মুসলিম ২৭৩৮)
ইমাম বুখারী উক্ত হাদিসকে ইমরান ইবনে হুসাইন (রাঃ) থেকেও বর্ণনা করেছেন।
৩৩) উসামাহ ইবনে যায়েদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেন, “আমি জান্নাতের দুয়ারে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলাম, সেখানে অধিকাংশ নিঃস্ব লোক রয়েছে। আর ধনবানরা তখনো (হিসাবের জন্য) অবরুদ্ধ রয়েছে। অথচ দোযখীদেরকে দোযখের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়ে গেছে।” (সহীহুল বুখারী ৫১৯৬, ৬৫৪৭, মুসলিম ২৭৩৬)
৩৪) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, নবী (সাঃ) বলেছেন, “সবচেয়ে সত্য কথা কোন কবি বলেছেন, তা হল লাবীদ (কবীর) কথা, (তিনি বলেছেন,) ‘শোনো, আল্লাহ ছাড়া সব কিছুই বাতিল।” (সহীহুল বুখারী  ৩৮৪১, ৬১৪৭,৬৪৮৯ মুসলিম ২২৫৬)


 প্রবন্ধটি পড়া হলে, শেয়ার করতে ভুলবেন না