তাফসীর রচনাপদ্ধতি

মূল: ইবনে তাইমিয়্যাহ

যদি প্রশ্ন করা হয় তাফসীর রচনার সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা কোনটি, তাহলে বলা যায় কুরআন দ্বারা (এক অংশ দ্বারা) কুরআনকে (অন্য অংশের) ব্যাখ্যা করা। কারণ কুরআনে একস্থানে যা পরোক্ষভাবে উল্লেখিত হয়, অন্য স্থানে হয়ত তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় এবং এক স্থানে যা সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপন করা হয় অন্য স্থানে তার বিস্তারিত দিক নির্দেশনা পাওয়া যায়। কিন্তু কুরআনের অন্য অংশের দ্বারা সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা পাওয়া না গেলে, আমাদের উচিত সুন্নাহর অনুবর্তী হওয়া। কারণ, সুন্নাহ হচ্ছে কুরআনের ব্যাখ্যাস্বরূপ। ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে ইদ্রিস আশ শাফিঈ বলেছেন: “রাসূল (সা.) যা কিছুই বলেছেন তার সবটুকুই ছিল কুরআনভিত্তিক।”


আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, “নিশ্চয়ই আমি আপনার প্রতি সত্য কিতাব অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি মানুষের মধ্যে ফয়সালা করেন, যা আল্লাহ আপনাকে হৃদয়ঙ্গম করান। আপনি বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষ হতে বিতর্ককারী হবেন না”। (সূরা নিসা ১০৫)
“তাদেরকে প্রেরণ করেছিলাম নির্দেশাবলী ও অবতীর্ণ গ্রন্থসমূহ এবং আপনার কাছে আমি স্মরণিকা অবতীর্ণ করেছি, যাতে আপনি লোকদের সামনে ঐসব বিষয় বিবৃত করেন, যেগুলো তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে, যাতে তারা চিন্তাভাবনা করে।” (আন নাহল ৪৪)
“আমি আপনার প্রতি এ জন্যেই গ্রন্থ নাযিল করেছি, যাতে আপনি সরল পথ প্রদর্শনের জন্যে তাদেরকে পরিষ্কার বর্ণনা করে দেন, যে বিষয়ে তারা মতবিরোধ করছে এবং ঈমানদারকে ক্ষমা করার জন্য” (আন নাহল ৪৬)
তাই নবী (সা.) বলেছেন, “জেনে রাখ যে আমাকে কুরআন এবং তৎসদৃশ বিষয় দেয়া হয়েছে” (আহমদ, মুসনাদ খণ্ড চার ১৩১, আবু দাউদ, সুনান সুন্নাহ ৫)
‘তৎসদৃশ’ এখানে সুন্নাহকে ইঙ্গিত করে। আসলে কুরআনের মত সুন্নাহও অহীভিত্তিক, তবে কুরআনের ন্যায় তা তাঁর নিকট পাঠ (তিলাওয়াত) করা হয়নি। ইমাম আশ শাফিঈ সহ বেশ কিছু আলেম এর পক্ষে যথেষ্ট যুক্তির অবতারণা করেছেন, কিন্তু এখানে তা উল্লেখ করা সম্ভব নয়। (বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন আল শাফিঈ আল রিসালাহ)।
কুরআন বুঝতে হলে সর্বপ্রথম কুরআনের ভিতরে ব্যাখ্যা অন্বেষণ করতে হবে। তাতে যদি ইঙ্গিত পাওয়া না যায়, তবে সুন্নাহ’র প্রতি নজর দিতে হবে। রাসূল (সা.) যখন মু’আয (রা.) কে ইয়েমেনে পাঠান তখন জিজ্ঞেস করেছিলেন “তুমি কিভাবে তোমার নিকট আনীত বিষয়ের মীমাংসা করবে?” তিনি বললেন “আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী ফয়সালা করব”। রাসূল (সা.) জিজ্ঞেস করলেন “সেখানে তুমি কিছু না পেলে কি করবে?” তিনি উত্তর দিলেন, “আমি রাসূল (সা.)-এঁর সুন্নাহ’র অনুসরণ করব”। রাসূল (সা.) পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, “যদি তুমি সেখানেও ফয়সালা না পাও তখন কি করবে?” তিনি উত্তর দিলেন “আমি নিজ বিচার-বুদ্ধি অনুযায়ী ফয়সালা করব।” একথা শুনে রাসুল (সা.) মু’আয (রা.)-এর ঘাড়ে মৃদু আঘাত পূর্বক বাহবা জানালেন। বললেন, “আল্লাহর জন্যই সমস্ত প্রশংসা যিনি তাঁর রাসূলের প্রতিনিধিকে সেই পথে পরিচালিত করেছেন, যাতে তাঁর রাসূল সন্তুষ্ট হন।” এ হাদীসখানি মুসনাদে উল্লেখিত হয়েছে এবং সুনান হাদীস সংকলনে সংকলিত হয়েছে। (আহমদ, মুসনাদ আল দারিমী, সুনান, মুকাদ্দিমাহ্ ৩০; আল তিরমিযী, সুনান, আহ্কাম, ৩; আবু দাউদ, সুনান, আযিয়া ১১)
যখন কুরআন এবং সুন্নাহ থেকে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে না, তখন সাহাবীদের বক্তব্য খেয়াল করতে হবে। কারণ তাঁরা কুরআন অধিক ভালভাবে অনুধাবন করেছেন; তাদের সমসাময়িক কালেই কুরআন নাযিল হয়েছে এবং যে অবস্থার প্রেক্ষিতে কুরআন নাযিল হয়েছে, তাঁরা সেই অবস্থা বা ঘটনার প্রত্যদর্শী এবং এ ব্যাপারে তাঁরা ছিলেন পূর্ণ ওয়াকিবহাল। বিশেষ করে চার খলিফা এবং আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা.)। ইমাম আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে জারীর আত তাবারী বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা.) হতে মাসরুক; মাসরুক হতে আবু দুহা; আবু দুহা হতে আল আ’মাশ; আল আ’মাশ হতে জাবীর ইবনে নুহ; জাবীর ইবনে নুহ থেকে আবু কুরাইব বলেছেন যে, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা.) বলেন, “সেই একক সত্তার শপথ যিনি ভিন্ন আর কোন উপাস্য নেই, কুরআনে এমন কোন আয়াত নেই যা কোন ব্যক্তির সম্পর্কে এবং কোন স্থানে নাযিল হয়েছে সে বিষয়ে আমি না জানি। আমি যদি জানতাম যে, কেউ আমার চেয়ে কুরআন সম্পর্কে অধিক জ্ঞান রাখে এবং তার সাথে আমার সাক্ষাৎ করা সম্ভবপর তাহলে আমি অবশ্যই তার সাথে সাক্ষাৎ করতাম।” (ইবনে আল আছীর, জামী আল উসুল ফি আহাদীস আর রাসূল, ১৩৯২/১৯৭২, খণ্ড ৯, পৃ. ৪৮) আল আ’মাশ আবু ওয়ায়েলের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন যে আব্দুল্লাহ ইবন মাসুদ বলেন, “যখন আমাদের কেউ কুরআনের দশটি আয়াত শিখত, সে পরবর্তীতে ততক্ষণ অগ্রসর হতনা, যতক্ষণ না সে ঐ আয়াত সমূহের অর্থ এবং বাস্তবজীবনে কিভাবে তার অনুশীলন করতে হবে তা জেনে নিত ।”
আরেকজন বিশিষ্ট আলেম হচ্ছেন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.), যিনি রাসূলের(সা.) চাচাতো ভাই এবং কুরআনের ব্যাখ্যাকারক। তিনি রাসূলের দোয়ায় এই বিশেষ গুণাবলী অর্জন করেছিলেন, “হে আল্লাহ, তাঁকে (ইবনে আব্বাস) ইসলামের জ্ঞান এবং কুরআনের তাৎপর্য শিক্ষা দাও।” (আহমদ, মুসনাদ, খণ্ড ১ : ২৬৬, ৩১৪, ৩২৮, ৩৩৫)
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা.) হতে মাসরুক, মাসরুক হতে মুসলিম ইবনে সাবি ইবনে দুহা, মুসলিম হতে আল আ’মাশ আল আ’মাশ হতে সুফিয়ান, সুফিয়ান হতে ওয়াকি, ওয়াকি হতে মুহাম্মদ ইবনে বাশশার, আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা.) এর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন: “ইবনে আব্বাস কুরআনের কি অসাধারণ ব্যাখ্যাকারক!”
ইবনে জারীর-ও একই রকম হাদীস ভিন্ন শব্দ মালায় এবং ইয়াহইয়া ইবনে দাউদ, ইসহাক আল আযরাফ, সুফিয়ান, আল আ’মাশ, মুসলিম ইবনে সাবি আবি দুহা, আল মাসরুক পরম্পরায় তুলে ধরেন:“ইবনে আব্বাস কি অসাধারণ কুরআনের ব্যাখ্যা কারক!”

ইবনে জারীর একই ধরনের বক্তব্য বুন্দার, জাফর ইবন আওন, আল আ’মাশ পরম্পরায় উল্লেখ করেন। তার এ বক্তব্যগুলোও ইবনে মাসুদের (রা.) উদ্ধৃতি যা ইবনে আব্বাস (রা.) প্রসঙ্গে বলা হয়েছিল। ইবনে মাসুদ (রা.) সম্ভবত ৩৩ হিজরী সনে ইন্তেকাল করেন; ইবনে আব্বাস (রা.) তাঁর মৃত্যুর পর ৩৬ বছর জীবিত ছিলেন এবং ইসলামী জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধি দান করেন।
আবু ওয়াইল হতে আল আ’মাশ বলেন যে আলী (রা.) ইবনে আব্বাস (রা.) কে হজব্রত পালনকারীদের আমীর নিযুক্ত করেন। তিনি এমনভাবে সূরা বাকারাহ হতে (অন্য বর্ণনা মতে সূরাত আন নূর হতে) ধর্মোপদেশ দান করলেন যে, যদি রোমান, তুর্কী বা দালামাইটগণ তা শুনতে পেতেন তবে তারা ইসলাম গ্রহণ করতেন। সেজন্যই আবদেল রহমান সুদ্দী রচিত তাফসীরে উদ্ধৃত অধিকাংশ ব্যাখ্যা এই দুই বিখ্যাত আলেম ইবন মাসুদ (রা.), ইবন আব্বাস (রা.)-এর ব্যাখ্যা থেকে সংকলিত।

লিখেছেন শায়খ এনামুল হক