-ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর
ভূমিকা :
পৃথিবীর ইতিহাসে প্রবহমান পাপ সমূহের
মধ্যে শিরক সর্বাপেক্ষা বড় পাপ হিসাবে স্বীকৃত। শিরকের চেয়ে জঘন্য কোন পাপ নেই। অন্যান্য পাপ মহান আল্লাহ সহজেই মাফ করে দেন। কিন্তু শিরকের পাপ সহজে মাফ করেন না। শিরকের অপরাধের জন্য বিনয়-নম্রতার সাথে তওবা করতে হয়। শিরককে কাবীরা গুনাহ সমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় কাবীরা গুনাহ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আব্দুর রহমান ইবনু আবুবকর তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তার পিতা বলেন, একদা আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট ছিলাম। তিনি বললেন, আমি তোমাদের সবচেয়ে বড় তিনটি পাপের কথা বলব কী? ছাহাবীগণ বললেন, হ্যাঁ হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সাথে শিরক করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করা’।[1] শিরক এক অমার্জনীয় অপরাধ। আনাস (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে আদম সন্তান! তুমি যদি আমার নিকট যমীন ভর্তি পাপ নিয়ে আস, আর শিরক মুক্ত অবস্থায় আমার সাথে সাক্ষাৎ কর। তাহলে আমি ঐ যমীন ভর্তি পাপ ক্ষমা করে দিব’।[2] তাই বুঝা যায়, শিরকের মত জঘন্য পাপ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। যার কারণে প্রত্যেক নবী ও রাসূলগণ শিরকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে গেছেন। কোন নবী ও রাসূলকে শিরকের সাথে আপোস করতে দেখা যায়নি। তাঁরা প্রত্যেকে ছিলেন শিরকের সাথে আপোসহীন।
শিরকের শাব্দিক পরিচিতি :
ইবনু মানযুর
বলেছেন, ‘আশ-শিরকাতু’ ও ‘আশ-শারকাতু’ الشركة و الشركة সমার্থবোধক দু’টি শব্দ। যার অর্থ হল, দু’শরীকের সংমিশ্রণ। তিনি আরো বলেন, ‘ইশতারাকানা’ إشتركنا ‘আমরা শরীক হলাম’ শব্দের অর্থ হল, ‘তাশারাকানা’ تشاركنا
‘আমরা পরস্পর শরীক হলাম’। দু’জন শরীক হল আর পরস্পর শরীক হল বা একে অপরের সাথে শরীক হল কিংবা শরীক হওয়া এ সকল শব্দের অর্থ হল, ‘আল-মুশারিক’ المشارك বা অংশীদার। ‘আশ-শিরকু’ الشرك শব্দটিও শরীক করা ও শরীক হওয়ার মতই। এর বহুবচন হল ‘ইশরাক’ ও শুরাকা-উ’ إشرك و شركاء ‘সকল শরীকান বা অংশীদার’।[3]
আল-মুনজিদ
নামক অভিধানে বলা হয়েছে, أشرك في أمره অর্থাৎ ‘তার কাজে সে (অপর কাউকে) শরীক করে নিয়েছে’। أشرك با الله অর্থাৎ ‘আল্লাহর সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করেছে’। আর যে তা করল সে মুশরিক হয়ে গেল।[4]
শেখ যাকারিয়া
বলেন, শিরক শব্দমূলটি সংমিশ্রণ ও একত্রিকরণের অর্থ প্রকাশ করে। কোন বস্ত্তর অংশ বিশেষ যখন একজনের হবে, তখন এর অবশিষ্ট অংশ অপর এক বা একাধিক জনের হবে।[5] যেমন আল্লাহ বলেন, أَمْ لَهُمْ
شِرْكٌ فِي السَّمَاوَاتِ ‘তবে কি আকাশমন্ডলীতে তাদের অংশীদারিত্ব রয়েছে’ (আহক্বাফ ৪৬/৪)।
উপরোক্ত বর্ণনার আলোকে প্রমাণিত হয় যে,
‘শিরক’ শব্দটি মূলগতভাবেই মিশ্রণ ও মিলনের অর্থ প্রকাশ করে এবং এ মৌলিক অর্থটি এর সকল রূপান্তরিত শব্দের মধ্যে নিহিত থাকে। আর দুই বা ততোধিক ব্যক্তির মধ্যকার অংশীদারিত্ব যেমন ইন্দ্রিয় অনুভূত বস্ত্তসমূহের মধ্যে হতে পারে, তেমনি তা কোন অর্থগত বা গুণগত বস্ত্ততেও হতে পারে।[6]
শিরকের পারিভাষিক পরিচিতি :
ড. ইবরাহীম
বরীকান শিরকের পারিভাষিক অর্থ বর্ণনায় বলেন, গায়রুল্লাহকে আল্লাহর বৈশিষ্ট্যের সমকক্ষ করা। সমকক্ষ বলতে এখানে মুক্ত শরীকানা বুঝানো হয়ে থাকে, শরীকানায় আল্লাহর অংশ গায়রুল্লাহ-এর অংশের সমান হতে পারে অথবা আল্লাহর অংশ গায়রুল্লাহ-এর অংশের চেয়ে অধিকও হতে পারে।[7]
তিনি শিরকের
আরেকটি অর্থ নিয়েছেন যে, আল্লাহর পাশাপাশি গায়রুল্লাহকে উপাস্য ও মান্যবর হিসাবে গ্রহণ করা। কুরআন, সুন্নাহ ও অগ্রবর্তী মনীষীগণের কথায় শিরক শব্দটি যখন সাধারণভাবে ব্যবহৃত হয়, তখন এর দ্বারা শিরকের দ্বিতীয় অর্থই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে।[8]
মূলতঃ শিরক হচ্ছে
সৃষ্টি ও স্রষ্টার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়া বা সৃষ্টিকে স্রষ্টার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ করা। অর্থাৎ স্রষ্টা হওয়ার জন্য যে সব গুণাবলী দরকার, সেগুলোর ক্ষেত্রে কোন লোক সৃষ্টিকে স্রষ্টার সাথে তুলনা বা সাদৃশ্যপূর্ণ
করলে, সে মুশরিক হয়ে যাবে।[9]
আল্লাহর সাথে শিরক
করার অর্থ হল- বান্দা কোন ব্যক্তিকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করে, তার নিকট প্রার্থনা করে, কোন কিছু আশা করে, তাকে ভয় করে, তার উপর ভরসা করে, তার নিকট সুপারিশ চাওয়া, তার নিকট বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য ফরিয়াদ করা, কিংবা তার নিকট এমন বিষয়ে সাহায্য প্রার্থনা করা, যার সমাধান আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ দিতে পারে না, অথবা তার নিকট মিমাংসা চাওয়া, কিংবা আল্লাহর অবাধ্যতা করে তার আনুগত্য করা, অথবা তার কাছ থেকে শরী‘আতের বিধান গ্রহণ করা কিংবা তার জন্য (বা তার নামে) যবহ করা, অথবা তার নামে মানত করা, অথবা তাকে এতটুকু ভালবাসা যতটুকু আল্লাহকে ভালবাসা উচিৎ।
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা
যে সকল কথা, কাজ ও বিশ্বাসকে ওয়াজিব বা মুস্তাহাবরূপে নির্ধারণ করেছেন, সেগুলোর সব কিংবা কোন একটি গায়রুল্লাহ তথা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উদেশ্যে করাই হল শিরক।
শিরকের প্রকারভেদ :
প্রকৃতপক্ষে শিরক তিন
ভাগে বিভক্ত। (ক) শিরকে আকবার বা বড় শিরক (খ) শিরকে আছগার বা ছোট শিরক (গ) শিরকে খাফী বা গোপন শিরক।
শিরকে আকবার বা বড় শিরক :
বিশ্বাস জাতীয় বিষয়াদী ও উপাসনার
ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার সাথে কাউকে শরীক বা সমান করাই মূলতঃ শিরকে আকবার।
আবার কেউ
সংজ্ঞা প্রদান প্রসঙ্গে বলেন, শিরকে আকবার হচেছ, আল্লাহর সাথে কাউকে শিরক করা। যেমন অন্যকে আহবান করা, অন্যের নিকট কিছু কামনা করা, অন্যকে ভয় করা, অন্যকে আল্লাহর ন্যায় ভালবাসা, অন্যের জন্য পশু উৎসর্গ বা মানত করা।
কেউ কেউ
বলেন, আল্লাহর সাথে গায়রুল্লাহকে আহবান করাই হচ্ছে শিরকে আকবার।[10]
আবার কেউ
বলেন, আল্লাহর উপাসনা সমূহের কোন উপাসনা গায়রুল্লাহ-এর উদ্দেশ্যে করাকে শিরকে আকবার বলা হয়।[11]
আল্লাহ তা‘আলার
নামাবলী ও গুণাবলীর যে বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যে বৈশিষ্টগুণে তিনি আমাদের একক রব ও উপাস্য, আমাদের রাসূল (ছাঃ) বা কোন অলি-দরবেশ, জিন-পরী বা গ্রহ-তারা, গাছ-পালা ও পাথর ইত্যাদিকে সে সব বৈশিষ্ট্যের কোন না কোন বৈশিষ্ট্যের সমান বা আংশিক অধিকারী বলে মনে করা এবং নবী, অলি, গাছ-পালা ও পাথর ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও অন্তর দ্বারা উপাসনামূলক কোন কর্ম করাকে শিরকে আকবার বলা হয়।
এরূপ শিরককারীর
পরিণতি হল চিরস্থায়ী জাহান্নাম। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ
حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ
مِنْ أَنْصَارٍ ‘যে আল্লাহর সাথে অন্য কাইকে শরীক করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন এবং তার আবসস্থল হবে জাহান্নাম’ (মায়েদা ৫/৭২)।
শিরকে আছগার বা ছোট শিরক :
শিরকে আকবার নয় এমন
যে সব কর্মকে শরী‘আতে সুস্পষ্ট প্রমাণ দ্বারা শিরক বলে নাম করণ করা হয়েছে, সেগুলোই হচ্ছে শিরকে আছগার। যেমন কেউ বলল, ‘আল্লাহ আর আপনি যা চান’। ‘আল্লাহ আর আপনি যদি উপস্থিত না থাকতেন, তাহলে আমার মহা বিপদ হয়ে যেত’। অনুরূপভাবে আল্লাহ ব্যতীত অপর কারো নামে শপথ করা ইত্যাদি।[12]
ড. ইবরাহীম
বরীকান শিরকের সংজ্ঞায় বলেন, ‘আমলের ক্ষেত্রে গায়রুল্লাহকে আল্লাহ তা‘আলার সমান মনে করাকে শিরকে আছগার বলা হয়’। যেমন কোন কাজে ও কথায় লোক দেখানোর ভাব করা।[13]
ইমাম ইবনুল
ক্বইয়িম শিরকে আছগারের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘উপাসনায় লোক দেখানোর ভাব করা, মানুষের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোন কাজ করা, আমি আল্লাহ ও আপনার উপর ভরসা করেছি এমনটি বলা, আল্লাহ ও আপনি না হলে এমনটি হত। এ সব উদাহরণ প্রদানের পর তিনি বলেন, শিরকে আছগার কখনো কর্তা ব্যক্তির মানসিক অবস্থা ও উদ্দেশ্যের পরিপ্রেক্ষিতে শিরকে আকবারেও রূপান্তরিত হতে পারে’।[14]
আবার কারো
কারো মতে, শিরকে আছগার হল- ‘এমন সব কথা বা কাজ, যা বাহ্যিকভাবে গায়রুল্লাহকে আল্লাহ তা‘আলার সাথে সমান করে নেয়া হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়, যদিও এই সমকক্ষ বানানোটা কর্তা ব্যক্তির উদ্দেশ্য নয়’।[15]
নিম্নোক্ত উদাহরণ গুলোতে শিরকে আছগারের পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায়। যেমনভাবে
মানুষেরা বলে থাকে, আল্লাহ আর এই পোষা কুকুরটি না হলে আজ রাতে আমার বাড়ীতে চুরি হয়ে যেত। আল্লাহ এবং আপনি না হলে আজকে মহা অঘটন ঘটে যেত। আমি মাটি হাতে নিয়ে বা মায়ের নাম নিয়ে বা সন্তানের মাথায় হাত রেখে বা চোখের বা দানা ছুঁয়ে শপথ করে বলছি। আমি আল্লহর অনুগ্রহে এবং আপনাদের দো‘আয় ভাল আছি ইত্যাদি ধরনের কথা বলা। (চলবে)
[1]. ছহীহ বুখারী হা/২৬৬৪, ১/৩৬২ পৃঃ; ছহীহ মুসলিম হা/২৫৫, ১/৬৪ পৃঃ।
[2]. তিরমিযী হা/৩৫৪০; মিশকাত হা/২৩৩৬, সনদ ছহীহ।
[3]. ইবনু মানজুর, লিসানুল আরব, الشرك শব্দমূল (১৮০৫ হিঃ), ১০/৪৪৮-৪৫০ পৃঃ।
[4]. অধ্যাপক আনতুয়ান, আল-মুনজিদ (বৈরুত : দারুল মাশারিক, ২১ তম সংস্করণ, ১৯৭২ খ্রিঃ), পৃঃ ৩৮৪।
[5]. ড. মুহাম্মাদ মুযযাম্মিল আলী, শিরক কী ও কেন? (সিলেট : এডুকেশন সেন্টার, ১ম প্রকাশ জুলাই-২০০৭ ইং), পৃঃ ২৯।
[6]. শিরক কী ও কেন? পৃঃ ৩০।
[7]. ড. ইব্রাহীম বরীকান, আল-মাদখালু লিদেরাসাতিল ‘আক্বীদাতিল ইসলামিয়্যাহ ‘আলা মাযহাবি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আহ (আল-খুবাব : দারুস সুন্নাহ লিন নসরি ওয়াত তাওযী, ১৯৯২ ইং), পৃঃ ১২৫।
[8]. আল-মাদখালু লিদেরাসাতিল ‘আক্বীদাতিল ইসলামিয়্যাহ ‘আলা মাযহাবি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আহ, পৃঃ ১২৬।
[9]. মূল : আলী বিন নুফায়ী আল-উলাইয়ানী, অনুবাদ : ইঞ্জিনিয়ার মুহাম্মাদ মুজিবুর রহমান, আক্বীদার মানদন্ডে তা’বিয (ঢাকা : ইসলামী ঐতিহ্য সংরক্ষণ সংস্থা, প্রকাশকাল : রামাযান ১৪১৭ হিঃ, ১৯৯৭ ঈসায়ী), পৃঃ ২৫।
[10]. শিরক কী ও কেন?, পৃঃ ৫৮।
[11]. আব্দুল আযীয আল-মুহাম্মাদ আস-সালাম, আল-আসইলাতু ওয়াল আজইবাতিল উছূলিয়্যাতি ‘আলাল ‘আক্বীদাতিল ওয়া-সিতিয়্যাতি লি ইবনে তাইমিয়্যাহ (২১তম সংস্করণ, ১৯৮৩ খ্রিঃ), পৃঃ ৫৮।
[12]. ‘আক্বীদাতিল ওয়াসিতিয়্যা, লে ইবনে তাইমিয়্যাহ পৃঃ ১৭০।
[13]. ড. ইব্রাহীম বরীকান, প্রাগুক্ত পৃঃ ১২৬।
[14]. আশ-শায়খ সুলাইমান ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু মুনী, তাইসীরুল ‘আযীযিল হামীদ ফী শরহে কিতাবিত তাওহীদ (বৈরুত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১ম সংস্করণ, ১৪০২ হিঃ), পৃঃ ৪৫।
[15]. শিরক কী ও কেন? পৃঃ ৬২।