শাহমুন নাকীব ফারাবী
সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তচিন্তার নামে রাসূল (সঃ) এর সম্পর্কে কূৎসা
রটানোর চেষ্ঠা করা হচ্ছে। আর মুক্তচিন্তার নামে এই অসুস্থ কর্মকান্ড উপমহাদেশের
অন্যান্য যেকোন দেশের চেয়ে বাংলাদেশে খুব বেশি হচ্ছে। কিন্তু তথাকথিত এই
মুক্তচিন্তকরা যাদেরকে তাদের গুরু মনে করে সেই ইউরোপীয় লেখকরাও রাসূল (সঃ) কে নিয়ে
বিভিন্ন সময়ে বই লিখেছে। ২০০০ সালে দামেস্কের ‘আল মুকতাবি’
নামক
পত্রিকা একটি জরিপ করে। এবং সেই জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, মুহাম্মাদ (সঃ)
সম্পর্কে ইউরোপের বিভিন্ন ভাষায় এখন পর্যন্ত প্রায় ১৩০০ টি বই প্রকাশিত হয়েছে। আর
তার মধ্যে অধিকাংশগুলোতেই রাসূল (সঃ) কে বিতর্কিত ভাবে উপস্থাপনের চেষ্ঠা করা
হয়েছে। কিন্তু তারপরও সেই সব বই এ লেখকরা সত্য প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছেন।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিষয়ক অধ্যাপক ডি.এস.মারগোলিয়াথ ১৯০৫
সালে রাসূল (সঃ) এর জীবনী নিয়ে “ হিরোজ অব দি নেশান্স” নামে একটি বই
লিখেন। রাসূল (সঃ) এর জীবনী নিয়ে এর চেয়ে বিষাক্ত কিতাব আর একটিও লেখা হয় নি। এ
বইয়ে লেখক প্রত্যেকটি বিষয়ে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দিয়ে রাসূল (সঃ) এর চরিত্রকে
কলুষিত করবার চেষ্ঠা করেন। কিন্তু তারপরও বইটির ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন,
[b]“মুহাম্মাদ
(সঃ) এর জীবনীকারদের দির্ঘ সিলসিলা শেষ
হওয়া অসম্ভব। কিন্তু তাঁদের মধ্যে স্থান লাভ করা একটি বিরাট সম্মানের বিষয়।”
[/b]
১৮৭০ সালে জন ডেভিনপোর্ট ‘এ্যাপলজি ফর মুহাম্মাদ এন্ড দি কুরআন’
বইটি
লিখেন। তিনি বইটির ভূমিকায় লিখেছেন,[b]“এতে কোন সন্দেহ নেই যে, সকল আইন প্রণেতা
ও বিজয়ীগণের মধ্যে একজনও এমন নেই, যার জীবনবৃত্তান্ত মুহাম্মাদ (সঃ) এর জীবন
বৃত্তান্তের চাইতে অধিক বিস্তারিত ও সত্য”।[/b]
১৮৭৪ সালে অক্সফোর্ড ট্রিনিটি কলেজের ফেলো রেভারেন্ড বসওয়ার্থ স্মিথ ‘রয়াল
ইনষ্টিটিউশান অব গ্রেট বৃটেন’-এ ‘মুহাম্মাদ (সঃ)’ ও ‘মোহামেডিনিজম’
সম্পর্কে
একটি বক্তৃতা প্রদান করেন। যা পরবর্তিতে পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়। এতে রেভারেন্ড
সাহেব বলেছেন, [b]“ধর্ম সম্পর্কে সাধারণত যা
কিছু সত্য, দুর্ভাগ্যবশত এ তিনটি ধর্ম ও এদের প্রবর্তকদের সম্পর্কেও তা সত্য।
আমরা ধর্মের প্রাথমিকময়কার কর্মীবৃন্দের সম্পর্কে খুব কম জানি এবং তাদের শ্রমের
সঙে পরবর্তিকালে নিজেদের শ্রম মিলিয়েছেন তাদের সম্পর্কে সম্ভবত আমরা অনেক বেশি
জানি।
আমরা যরথুষ্ট্র ও কনফুসিয়ান সম্পর্কে সুলান ওসক্রেটিসের চাইতে অনেক
কম জানি। মূসা (আঃ) ও গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কে
অনেক কম জানি,যা অ্যামব্রেস ও জুলিয়াস সিজার সম্পর্কে জানি। আমরা আসলে ঈসা মসীহর
জীবনের একটি অংশের আংশিক জ্ঞান রাখি। যে ত্রিশটি বছর তিন বছরের জন্য পথ পরিষ্কার
করল তাকে আবরণমুক্ত করবে কে? যা কিছু আমরা জানি তা হচ্ছে এই যে, তিনি দুনিয়ার এক
তৃতীয়াংশকে জীবিত করেছেন এবং সম্ভবত আরও অনেক বেশি অংশকে জীবিত করবেন। একটি আদর্শ
জীবন যা অনেক দূরের আবার অনেক নিকটের। যা সম্ভব আবার অসম্ভবও তার কত বিরাট অংশ
সম্পর্কে আমরা এখনও বিরাট অজ্ঞ। আমরা ঈসা (আঃ) এর মাতা,তাঁর সংসার জীবন,তাঁর প্রাথমিক
বন্ধুবান্ধব,তাঁদের সাথে তাঁর সম্পর্ক,তাঁর আধ্যাত্নিক মিশনের পর্যায়ে ক্রমিক
অভ্যুদয় অথবা তাঁর আকর্ষিক বিকাশ সম্পর্কে
কি বা জানি! এগুলি সম্পর্কে আমাদের
প্রত্যেকের মনে কত প্রশ্নই না জাগে। এগুলো চিরকার প্রশ্নই থেকে যাবে। কিন্তু
ইসলামের প্রত্যেকটি বস্তু বৈশিষ্ঠ্যমন্ডিত। এখানে কোন অস্পষ্টতা ও রহস্য নেই।
আমাদের নিকট ইতিহাস আছে। আমরা মুহাম্মাদ (সঃ) সম্পর্কে এতো বেশি জানি, যেমন জানি মিলটন
ও লুথার সম্পর্কে । পৗরাণিকতা ও কাল্পনিক গল্প ও স্বাভাবিক ঘটনাবলি প্রাথমিক যুগের
আরব লেখগণের রচনামুক্ত। অথবা কোথাও এগুলির অস্তিত্ব কিছু থাকেও তাহলে অতি সহজেই
ঐতিহাসিক ঘটনাবলি থেকে সেগুলিকে পৃথক করা যায়। এখানে কেউ নিজকে অথবা অন্যকে
প্রতারণা করতে পারে না। এখানে সমগ্র পরিস্থিতি স্বচ্ছ দিবালোকে ভাস্বর। প্রত্যেকটি
বস্তুর উপর সে আলো পড়ছে এবং তা প্রত্যেকের নিকট পৌছাতে পারে। আসলে ব্যক্তি জীবনের
গভীরতম অঞ্চল চিরকাল আমাদের নাগালের বাহিরে থাকবে। কিন্তু আমরা মুহাম্মদ (সঃ) এর
বাহ্যিক জীবনের প্রত্যেকটি বিষয় সম্পর্কে অবগত। তাঁর যৌবন,তাঁর নবুয়্যতের
প্রকাশ,মানুষের
সাথে তাঁর সম্পর্ক,তাঁর অভ্যাস, তাঁর প্রাথমিক চিন্তাধারা ও এর ক্রমিক উন্নতি,তাঁর ওপর মাহন
ওহীর পর্যায় ক্রমিক অবতরন,তাঁর ভিতরের জীবনের জন্য তাঁর মিশন হবার পরবর্তিকালের
একটি কিতাব আল কুরআন আমাদের নিকট আছে। এই কিতাবটি নিজেদের মৌলিকত্বের ব্যাপারে,
সংরক্ষিত
থাকার ও অবিন্যাস্ত বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে অদ্বিতীয়। এই কিতাবের মধ্যে আলোচিত
বিষয়বস্তুর সত্যতার প্রশ্নে কখনো কোন ব্যক্তি যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ পোষণ করতে পারে
নি। যদি এমন কোন কিতাব আমাদের নিকট থাকে,যার মধ্যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির
স্বত্বা রূপ লাভ করেছে। তাহলে সেটি হচ্ছে এই আল কুরআন যা,সাধারণ
কৃত্রিমতা মুক্ত, অবিন্যস্ত, বৈপরিত্যসম্পন্ন, ক্লান্তিকর
অথচ বিরাট ও মহৎ চিন্তায় পরিপূর্ণ । এর
মধ্যে আবদ্ধ আধ্যাত্নিকতায় পরিপূর্ণ একটি
চিন্তাশীল মগজ আল্লাহ প্রেমের নেশায় বিভোর। কিন্তু তার সাথে মানবিক দুর্বলতারও যোগ
আছে। এ দুর্বলতা থেকে মুক্ত হবার দাবী তিনি কখনো করেন নি এবং এটি হচ্ছে মুহাম্মাদ
(সঃ) এর সর্বশেষ শ্রেষ্ঠত্ব যে, তিনি তা থেকে মুক্ত হবার দাবী করেন নি।”[/b]
ভল্টেয়ার বলেছিলেন,'No man in hero to his valet' অর্থা
ৎ “কোন ব্যক্তি নিজের ঘরে হিরো হতে পারে না।” কিন্তু বসওয়ার্থ
স্মিথের মতে,“ এই নীতিটি কমপক্ষে ইসলামের নবীর পক্ষে সত্য নয়”।
এই বিষয়টি গীবন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, [b]“প্রথম যুগের কোন
নবীর সত্যতায় এমন কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন নি,যেমন মুহাম্মাদ
(সঃ) উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।সর্ব প্রথম তিনি এমনসব লোকের সম্মুখে নিজেকে নবী হিসেবে
পেশ করেছিলেন,যারা মানুষ হিসেবে তাঁর যাবতীয় দুর্বলতা সম্পর্কে অবগত ছিল। যারা তাঁকে সবচাইতে বেশি জানতেন,
তাঁর
স্ত্রী,গোলাম,তাঁর চাচাতো ভাই,তার সবচাইতে
পুরাতন বন্ধু-যাঁর সম্পর্কে মুহাম্মাদ
(সঃ) নিজেই বলেছেন যেেএকমাত্র সেই বন্ধুই কখনো পৃষ্ঠপ্রদর্শণ করেনি এবং কখনো
শঙ্কিত হয় নি। এসব লোকই সর্ব প্রথম তাঁর অনুসারী হয়েছেন। এক্ষেত্রে সাধারণত নবীদের
ভাগ্যে যা ঘটে থাকে,মুহাম্মাদ (সঃ) এর ব্যাপারে ঘটেছে ঠিক তার বিপরীত। যারা তাঁকে জানত
না,তারা
ছাড়া অন্যদের নিকট তিনি অখ্যাত ছিলেন না।” [/b]
বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ক্যাডফ্রে হেগেন্স ‘এ্যাপলজি ফর
মুহাম্মাদ’-এ লিখেছেন, [b]“ খৃষ্টানরা যদি একথা মনে রাখে,তাহলে খুব ভালই
হবে যে, মুহাম্মাদ
(সঃ) এর নবুয়্যাত তাঁর অনুসারীদের মনে এমন নেশার সৃষ্টি করেছিল, যা যীশুর প্রথম
যুগের অনুসারীদের মধ্যে সন্ধান করা অর্থহীন। যীশুকে যখন শূলদন্ডের উপর চড়ানো হলো,
তখন
তাঁর অনুগামীরা পলায়ন করল। তাদের ধর্মীয় নেশা কেটে গিয়েছিল এবং নিজেদের শ্রদ্ধেয়
নেতাকে মৃত্যুর কবলে শৃঙ্খলিত রেখে তারা সরে পড়ল। অপরদিকে মুহাম্মাদ (সঃ) এর
অনুসারীরা তাদের মজলুম পয়গম্বরের চতুর্দিকে সমবেত হলো, তারা নিরাপত্তার
জন্যে নিজেদের জানমাল বিপদের মুখে নিক্ষেপ করে তাঁতে শুত্রুর ওপর বিজয়ী করল”।[/b]
ইউরোপীয় লেখকরা অকপটে সত্যকে স্বীকার করতে পারে কিন্তু আমাদের দেশের
তথাকথিত মুক্তমনারা সত্য জেনেও সত্যকে স্বীকার করতে চায় না। তাদের ভয় একটাই,
সত্যকে
স্বীকার করে নিলে যদি ইউরোপের ভিসা না মিলে(!)