ইসলামে ধুমপানের বিধানঃ ও তার প্রতিকার
মুহা: আবদুল্লাহ আল কাফী
আজ পৃথিবীর মানুষ জাতি ধর্ম বর্ণ
নির্বিশেষে সকলে একমত যে ধুমপান স্বাস্থ, পরিবেশ, সমাজ ও দেশের জন্য
ক্ষতিকর। মানুষের এ ঐকমতই কিন্তু পরক্ষোভাবে ধুমপান যে হারাম তা প্রমাণ করে
দিচ্ছে।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ পাক এরশাদ
করেন, قُلْ أُحِلَّ لَكُمُ الطَّيِّبَاتُ “আপনি বলে দিন, পবিত্র বস্তু
তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে।” (সূরা মায়েদাঃ ৪) আল্লাহ্ আরো বলেন,
وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ “তিনি
তাদের জন্য পবিত্র বস্তু হালাল করেন এবং অপবিত্র বস্তু হারাম করেন।” (সূরা
আ’রাফঃ ১৫৭) তামাক, জর্দা, সিগারেট যে অপবিত্র বস্তু। তার স্বাদ-গন্ধ
প্রভৃতি অপসন্দনীয় তা করো কাছে গোপন নয়।
আল্লাহ্ আরো বলেন, وَلَا
تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ “তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে
ঠেলে দিও না।” (সূরা বাকারাঃ ১৯৫) তিনি আরো বলেন, وَلَا تَقْتُلُوا
أَنْفُسَكُمْ “তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না।” (সূরা নিসাঃ ২৯) ধুমপানের
মাধ্যমে মানুষের কিরূপ ক্ষতি হয় এবং কিভাবে তিলে তিলে নিজেকে ধ্বংসের পথে
ঠেলে দেয় তার কিছু বিবরণ নীচে পেশ করা হবে। ইনশাআল্লাহ্॥
রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “যে
বস্তু অধিক গ্রহণ করলে নেশা সৃষ্টি হয়, তার অল্পটাও হারাম।” (আহমাদ, আবু
দাউদ, তিরমিযী ছহীহ) বলার অপেক্ষা রাখে না ধুমপান এক প্রকারের নেশা।
নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন, “যে ব্যক্তি
কাঁচা পিঁয়াজ অথবা রসূন খাবে, সে যেন আমাদের থেকে আলাদা থাকে, আমাদের
মসজিদের নিকটবর্তী না হয় এবং বাড়ীতে বসে থাকে।” (মুসলিম) ধুমপানের দূর্গন্ধ
কি কাঁচা পিঁয়াজ বা রসূনের চাইতে অধিক প্রকট নয়?
রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন,
“নিজের ক্ষতি করা যাবে না এবং অন্য কারো ক্ষতিও করা যাবে না।” (ছহীহ ইবনে
মাজাহ্) ধুমপান মানেই নিজের ক্ষতি (আর্থিক, শারীরিক, ও ধর্মীয় ক্ষতি) এবং
মানুষকে কষ্ট দেয়া ও তাদের ক্ষতি করা।
যা নিজের ক্ষতি করে এবং মানুষের ক্ষতি করে তা কি হালাল হতে পারে?
ধুমপায়ীর কাছে আমাদের প্রশ্নঃ
আপনি যদি ধুমপানকে হালাল মনে করেন, তবে তা কেন মসজিদের মধ্যে
বসে পান করেন না? কেন মুরুব্বী ও সম্মানিত লোকদের সামনে পান করেন না? কেন
তা টয়লেট বা অপবিত্র স্থানে বসে পান করেন?
আপনি কি ধুমপানকে একটি নেয়ামত হিসেবে শুরু করার সময়
‘বিসমিল্লাহ্’ বলেন? আপনি কি একটি নেয়ামত লাভে ধন্য হয়েছেন তাই ধুমপান শেষ
করে ‘আল হামদুলিল্লাহ্’ বলেন? যেমনটি আপনি হালাল পানাহারের সময় করে থাকেন?
চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ধুমপানঃ
সিগারেট যেমন নিজেকে জ্বালায় তেমনি ধুমপায়ীকে ধীরে ধীরে জ্বালিয়ে শেষ করে দেয়।
ধুমপান শরীরের প্রত্যেক অঙ্গের ক্ষতি সাধন করে। ধুমপানের মাধ্যমে নিম্ন লিখিত রোগ সমূহ হয়ে থাকেঃ
- *মুখ ও ঠোঁটে ক্যান্সার (Cancer)
- *গলায় (স্বরযন্ত্রে) ক্যান্সার
- *ফুসফুসে ক্যান্সার (Lung Cancer)
- *সর্বদা শ্বাস কষ্ট
- *শিরা সমূহ শক্ত হয়ে যায় (Arteriosclerosis)
- *হৃৎপিন্ডে ও মগজে রক্ত জমে যায়
- *রক্ত চলাচলে অনিয়ম দেখা দেয়
- *খাদ্যনালী ও কণ্ঠনালীতে ক্যান্সার হয়
- *পেটে আলসার হয় মুত্রথলি ও অন্ডকোষ ফুলে যায়
- *বদ হজমী হয়
- *ধুমপায়ী গর্ভধারিণীদের অকাল গর্ভপাত ঘটে
- *যৌন শক্তিতে দুর্বলতা
- *দ্রুত বার্ধক্যে উপণিত হয়।
উভয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেইঃ
- ফরমালহাইড এসিডের মধ্যে যদি একটি ব্যাঙ ছেড়ে দেয়া হয় তবে তার রং কাল বর্ণ ধারণ করে এবং তার প্রতিটি অস্তি আলাদা আলাদ হয়ে যায়। ধুমপায়ীরও একই অবস্থা হয়। কেননা উক্ত এসিড সিগারেটের মধ্যেও পাওয়া যায়।
- পোঁকা-মাকড় ধ্বংসকারী মেডিসিনের (Insect Killer) মাধ্যমে পোঁকা মাকড় ধ্বংস হয়ে যায়। কেননা তার মধ্যে থাকে নিকোটিন। একই উপাদান (নিকোটিন) আছে সিগারেটের মধ্যে। তাহলে ধুমপায়ীর অবস্থা কি হতে পারে…?
- ইঁদুর মারার একটি প্যাকেটে প্রচুর পরিমাণে ধ্বংসকারী বিষ (Rat Poison) থাকে। অনুরূপ পরিমাণ বিষ পাওয়া যায় সিগারেটের একটি প্যাকেটে। তাহলে এতে ধুমপায়ীর কি ঘটতে পারে…?
৯ই সেপ্টেম্বর ২০০০ইং
বাংলাদেশের জাতীয় প্রেসক্লাবে তামাক বিরোধী সংগঠন জ্ঞআধুনিকঞ্চ আয়োজিত
তামাক নিয়ন্ত্রন বিষয়ক ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন (এফসিটিসি) সংক্রান্ত এক
সাংবাদিক সন্মেলনে এক তথ্য পেশ করা হয়। তাতে বলা হয় ধূমপান শীঘ্রই এক
প্রধান মরণ ফাঁদে পরিণত হবে। বর্তমানে ধূমপানজনিত রোগে প্রতি বছর ৪০ লাখ
লোক মারা যাচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে কমপক্ষে ১ কোটি লোক আক্রান্ত হবে এবং
প্রতি দিনই কমপক্ষে ১ লাখ তরুণ তামাকে আসক্ত হবে। এছাড়া ধূমপানে বিভিন্ন
দেশে যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় তাও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কোন কোন দেশে বছরে মোট
জাতীয় উৎপাদনের শতকরা ৭ থেকে ১২ ভাগ ক্ষতি হয় ধূমপানজনিত কারণে। (তথ্য,
মাসিক আত্ তাহরীক, অক্টোবর ২০০০ইং)
ধুমপান থেকে যখন বিরত থাকবেন তখন কি ঘটবে?
শেষ সিগারেটের ২০ মিনিটের মধ্যেঃ
১) রক্ত চাপ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে
২) হৃৎপিন্ডের ষ্পন্দন স্বাভাবিক হবে।
৩) দুই হাতের তালু এবং দু পায়ের তাপমাত্রা স্বাভাবিক অনুপাতের চেয়ে বৃদ্ধি পাবে।
৮ ঘন্টা পরঃ
১) রক্ত থেকে কার্বোন অক্সাইডের বিষ ক্রিয়া কমতে থাকবে।
২) রক্তে অক্সিজেনের অনুপাত বৃদ্ধি পেয়ে তা স্বাভাবিকতায় ফিরে আসবে।
২৪ ঘন্টা পরঃ
হার্ট এটাকের সম্ভাবনা ক্ষিণ হয়ে যাবে।
৪৮ ঘন্টা পরঃ
১) পেশী সমূহে নিকোটিনের প্রভাব কম হতে হতে তা স্বাভাবিক অবস্থা লাভ করবে।
২) ঘ্রাণ এবং স্বাদ গ্রহণের যন্ত্রদয়ের অবস্থার উন্নতি হতে থাকবে।
৭২ ঘন্টা পরঃ
১) রক্ত চলাচলে উন্নতি হবে।
২) শ্বাস-প্রশ্বাসে সহজতা আসবে।
দু সপ্তাহ থেকে দু মাস পরঃ
১) রক্ত চলাচলে স্বাভাবিক গতি ফিরে আসবে।
২) হাঁটার সময় অধিক ক্লান্তি অনুভব হবে না।
৩) ফুসফুসের কার্যক্রম উন্নতি হয়ে শতকরা ২০% এর উর্দ্ধে হবে।
৪) নিকোটিনের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ রূপে মুক্তি পাবে।
এক মাস থেকে ৯ মাস পরঃ
১) কফ-কাশি থেকে মুক্তি লাভ এবং কোন প্রকার ক্লান্তি অনুভব হবে না।
২) শরীরের শক্তি বৃদ্ধি পাবে।
৩) ধুমপানের কারণে ফুসফুসে যে বিন্দু বিন্দু পানির ধারা সৃষ্টি হয় তা নিঃশেষ হয়ে যাবে।
এক বছর পরঃ
১) হার্ট এ্যটাকের কারণে মৃত্যু সম্ভাবনা কম হয়ে যাবে এবং তা অধুমপায়ীদের গড় অনুপাতে পৌঁছবে।
২) ফুসফুস, মুখ, খাদ্যনালী, কন্ঠনালী এবং মুত্র থলিতে ক্যান্সারের গড় অনুপাত কম হয়ে যাবে এবং তা অধুমপায়ীদের গড় অনুপাতের অনুরূপ হবে।
অনিচ্ছাকৃতভাবে ধুমপানের অপকারিতাঃ
* অনিচ্ছাকৃত ধুমপান হলো- প্রজ্জোলিত সিগারেটের ধুঁয়া বা
ধুমপায়ীদের ধুমপানের সময় তাদের মুখ থেকে নির্গত ধুঁয়ার ঘ্রাণ অধুমপায়ীদের
নাকে প্রবেশ করা। একে বলা হয়ঃ ব্যবহৃত ধুমপান (Second Hand Smoking)।
* একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, এধরণের ধুঁয়ার প্রভাব অধুমপায়ীদের
ছথূ অধিক ক্ষতির কারণ ও বেশী ভয়ানক। কেননা সিগারেটে যে ফিলটার থাকে তার
মাধ্যম ছাড়াই এ ধোঁয়া অধুমপায়ীর নাকে প্রবেশ করে। এতে করে একই রোগ বা তার
চাইতে বেশী ক্ষতির সে সম্মুখীন হয় যা ধুমপায়ীদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে।
* অনিচ্ছাকৃত ধুমপানের ভয়াবহতা সম্পর্কে সর্ব প্রথম রিপোর্ট
বের হয় ১৯৫০ সালে। জনৈক ডাক্তার লক্ষ্য করেন যে, শ্বাসনালীর প্রদাহে
আক্রান্ত একজন শিশুকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়ার পরও তার কোন ফল পাওয়া যাচ্ছে
না। যখন এ শিশুর পারিবারিক বিবরণ সম্পর্কে খোঁজ নেয়া হল, তখন জানা গেল যে,
তার পিতা গৃহের মধ্যে খুব বেশী ধুমপান করে। আর সিগারেটের ধোঁয়া মিশ্রিত এ
বাতাস শিশুর নাকে প্রবেশ করে। একারণেই কোন চিকিৎসা তার উপকারে আসে না বরং
প্রতিদিন তার অবস্থা আরো অবনতির দিকেই যায়…। দেখা গেছে পিতা ধুমপান থেকে
বিরত থাকলেই শিশুর শ্বাস প্রদাহের কিছুটা লাঘব হয়। আবার যখন সে ধুমপান করে
তখন আবার তার অবনতি হয়।
* এই কারণে ইউরোপের অধিকাংশ দেশে ১৯৮০ সালের শুরু থেকেই
সাধারণ স্থান গুলোতে ধুমপায়ীদের জন্য আলাদা স্থান নির্ধারণ করা হয়। যেমন-
রেষ্টুরেন্ট, পার্ক, বিমান, বাস, ট্রেন ইত্যাদি।
* আর এ নিয়ম প্রবর্তনের একমাত্র কারণ ছিল অধুমপায়ীদেরকে
সিগারেটের ধোঁয়া থেকে হেফাযত করা। এবং এ শ্লোগানের বাস্তবায়ন করাঃ আমাদেরকে
নিরাপদ নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ দাও।
সিগারেট ত্যাগ করার ক্ষেত্রে জটিলতা ও তার প্রতিকারঃ
ধুমপায়ী যখন ধুমপান পরিত্যাগ করবে তখন সাধারণভাবে শারিরীক ও
মানষিক কিছুটা চাঞ্চল্য দেখা দিবে। আর এটা অনুভূত হবে শেষ সিগারেটটি পান
করার এক ঘন্টা বা দু ঘন্টা পরেই। আল্লাহ্র অনুগ্রহে এসকল জটিলতা পাঁচ
দিনের কম সময়ের মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে যাবে। নীচে সিগারেট পরিত্যাগের ক্ষেত্রে
বড় বড় জটিলতাগুলো চিহ্নিত করা হল এবং তা প্রতিকারের উপায় দেয়া হলঃ
জটিলতা ও প্রতিকার
- অধির আগ্রহ এবং সিগারেটের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করা
-মিষ্টি বা চুইঙ্গাম জাতীয় কিছু মুখে দিয়ে মুখটাকে ব্যস্ত রাখুন।
- মেজাজ বিগড়ে যাওয়ার অনুভব হবে
- ক্লান্তি ও অবসাদ এবং রুক্ষভাব ও কঠোরতা অনুভব হবে
- মুখ ও গলা শুকিয়ে যাবে
- কাশি হবে, অনিদ্রা দেখা দিবে
- মাথা ঘুরা অনুভব হবে
- বিকেলের দিকে অস্থিরতা অনুভব হবে
- ক্ষুধা-মন্দার ভাব হবে
- চঞ্চলতা অনুভব হবে
- গাড়ি চালানোর সময় অস্থিরতা অনুভব হবে
- কাজে মন বসবে না
- মল ত্যাগ করতে কষ্ট হবে
মানুষ অভ্যাসের দাস নয় বরং অভ্যাস মানুষের দাস। আপনি নিজের অভ্যাসকে যেভাবে গড়ে তুলবেন সে আপনার বাধ্য হবে।
তাই আসুন ভাই! আমরা নিজের প্রবৃত্তিকে দমন করে আল্লাহর গোলামে পরিণত হই।
মনের মধ্যে দৃঢ় সংকল্প করে শয়তানকে পারজিত করি। দুনিয়া-আখেরাতে ক্ষতি হবে
এমন সকল কাজ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করি।
আল্লাহ্ সবাইকে তাওফীক দিন।
লেখক: দাঈ, জুবাইল দাওয়া সেন্টার। সৌদী আরব।