লর্ড উইলিয়াম রীজমোগ
লন্ডনের বোম হামলার পর লন্ডনবাসী খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন, তাদের
মধ্যে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর
চাপ পড়েছে। অমুসলিমদের চেয়ে বহুগুনে বেশী। বহু মানুষের কাছে আজ একটি বিষয়
বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে, প্রশ্নটি হলো কিভাবে একটি শান্তির ধর্ম এ রকম
ভীতিকর পরিস্থিতির কারণ হতে পারে। যখন কেউ কোরআন পড়ে, তখন এর কেন্দ্রীয়
অভিব্যক্তি অন্যান্য সাধারণ এবং এর মূল বিষয় হচ্ছে একজনই সৃষ্টিকর্তা, যিনি
বিশ্ব জাহানের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালা এবং মুহাম্মদ (স .) হচ্ছেন
আল্লাহর বাণীবাহক এবং সব মানুষের একমাত্র কাজ হচ্ছে আল্লাহর বিধানের অনুসরণ
করা, যেখানে নামায প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। কল্যাণ, ন্যায় ও দয়া -করুণার
কাজ করতে বলা হয়েছে।
উল্লেখ্য, এই বিষয়গুলো ইহুদীবাদ ও খৃষ্টবাদের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। একজন উত্তম ও ভালো মুসলিম যিনি কোরআনের প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্যসম্পন্ন তিনি ওই একনিষ্ঠ আনুগত্যসম্পন্ন তিনি ওই একনিষ্ঠ ইহুদীর মতো যিনি গভীরভাবে তাওরাত কিতাব অধ্যয়ন করেন এবং তা মেনে চলেন কিংবা একজন একনিষ্ঠ খৃস্টানের মতো যিনি গভীরভাবে বাইবেল অধ্যয়ন করেন।
কোরআন বারবার শুধু একথাই স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আল্লাহ মহান করুণাময় প্রভু। যিনি সবকিছু দেখেন এবং সমস্ত জ্ঞানের অধিকারী। ইসলাম কোন বোমাবাজি তত্ত্ব বা বোমা হামলার মতবাদ নয় বরং ইসলাম হচ্ছে দয়া ও করুণার মতবাদ।
তারপরও কী আশ্চর্য! আমরা একে ধর্মীয় সংঘাতের সাথে সম্পর্কিত করছি। মধ্যযুগের মতো আজ আমরা ইসলাম ও খৃস্টবাদের মধ্যে সংঘাতের পটভ’মির রচনা করছি। কিন্তু ইসলামের ও আধুনিক ইউরোপীয় সংস্কৃতি এবং উত্তর আমেরিকা এর মধ্যে জড়িয়ে যাচ্ছে সংঘাতের দিকে। এটা কি দুটি সংস্কৃতির মোড়কে উপস্থাপন করা হচ্ছে এখানে একটি ঐতিহাসিক বিষয়ের দিকে নজর দিতে চাই। ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষনার কথা সবাই জানেন। যে ঘোষণার কারণে ইসরাঈল সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের কারণে একটি মারাতœক অশান্তি এবং চিরস্থায়ী সমস্যার সৃষ্টি হয়। সে অশান্তি কি এখন আর তা প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই। এছাড়া তেলও অনুরূপ বিবাদ, অশান্তি ও সংঘাতের অন্যতম উপলক্ষ। কেননা বিশ্বের অর্থনীতি তেল সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। আর বিশ্বের তেলভান্ডারের অধিকাংশই মুসলিম দেশসমূহের আয়ত্বে। এটা শুধু আমার একার বক্তব্য নয়, বহু প্রতিবাদকারীর জোড় অভিযোগ হচ্ছে, আমেরিকা মুসলিম দেশসমূহের তেল ভান্ডারকে ছলে-বলে-কৌশলে নিজের আয়ত্বে নেয়া ও যথেচ্ছা ব্যবহারের জন্যে কক্ষিগত করতে চায়। সুতরাং আমেরিকা তার পররাষ্ট্র নীতিকে প্রতারণামূলক ও মিথ্যার ছদ্মবরণে ঢেলে সাজিয়েছে। আমেরিকা তার কর্মকান্ডকে এমনভাবে সাজিয়েছে, যাতে মধ্যপ্রাচ্যের তেল ভান্ডার দীর্ঘ মেয়াদে এমনকি সম্ভব হলে চিরস্থায়ীভাবে তাদের কব্জায় থাকে। তেলকে যেন মধ্যপ্রাচ্য রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার না করতে পারে সে জন্যে মৌলবাদী ধুয়া তুলে সন্ত্রাসের বিষয়টিকে সামনে আমেরিকা সামনে নিয়ে এসেছে।
রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে লন্ডনে বোম হামলার চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী হচ্ছে তেল অস্ত্র। আমেরিকা এ ক্ষেত্রে বিশ্বে তেল সরবরাহের ক্ষেত্রে তার দায় এড়াতে পারে না। কারণ চীন থেকে পেরু পর্যন্ত প্রতিটি দেশ তেলের ওপর শতভাগ নির্ভরশীল।
এই সংঘাতের উৎস আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। সাধারণ মানুষ কেন এতে জড়িয়ে পড়ছে সেটা গভীরভাবে উপলব্দি করা দরকার। ইসলাম এমন একটি গ্রন্থ আবর্তিত ধর্ম যার সাতে কোনো গ্রন্থের তুলনা করা যেতে পারেনা। কোরআন না পড়ে ইসলামকে পরিপূর্ণ উপলব্দি করা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। বাস্তব কথা হচ্ছে, ইসলামের মহান শিক্ষা হলো মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.), যীশু খ্রীস্ট অর্থাৎ ঈসা (আ.)-কে নবী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। খ্রীস্ট হিসেবে নয়।
বর্তমান পশ্চিমা জগতে আধুনিক সভ্যতা ও বহুবাদী সমাজ ব্যবস্থায় কোন একটি গ্রন্থই এককভাবে কোনো জাতির প্রতিনিধিত্ব করে না। একজন মুসলিম যদি পশ্চিমা দর্শন সম্পর্কে জানতে চায়, তবে তাকে বিশাল একটি লাইব্রেরী ঘাটতে হবে। তাকে মার্কিন সংবিধান থেকে শুরু করে কার্ল মার্কসের ডাস ক্যাপিটাল ও লেলিনের একনায়কতন্ত্র সম্পর্কে জানতে হবে। তাকে আরও পড়তে হবে নিউটন, ডারউইন এবং আইনস্টাইন; এছাড়া তলস্তয়, ডিকেন্স, হেমিংওয়ে সম্পর্কেও জানতে হবে। বেটোফোন, বিটেলসের মিউজিক শুনতে হবে। তারপরেও পশ্চিমা সংস্কৃতি, সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে না, যদি পশ্চিমা সমাজে বসবাস না করা হয়। সুতরাং পশ্চিমা দুনিয়ার মনোভাব ও সমাজ-সংস্কৃতি বুঝতে উপরোক্ত উপায়ের কোন বিকল্প নেই।
বৃটেনের মুসলিম সম্প্রদায়ের শীর্ষ নেতারা প্রধানমন্ত্রীর সাথে যথোপযুক্ত সময়ে একটি বৈঠক করেছেন এবং তাকে পুনরায় এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন যে, ইসলাম হচ্ছে কল্যাণময় শান্তির ধর্ম, সুতরাং একজন উত্তম ও ভালো মুসলিমের জন্যে কখনই সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীর পক্ষ সমর্থন করা সম্ভব নয়। মুসলিম নেতারা বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে ইসলামের সঠিক ও যথোপযুক্ত কাজটি করেছেন।
কেউ যদি নিজেকে উত্তম মানুষে পরিণত করতে চায় তবে তার অবশ্যই কোরআন পড়া উচিত। অবশ্য নানা ধরনের উদ্দেশ্যমূলক অনুবাদ বিশেষ করে ইংরেজী অনুবাদ যাচাই করে পড়তে না পারলে এবং আরবী ভাষা না শিখলে কোরআনের প্রকৃত অর্থ একজন স্বতন্ত্র পাঠকের কাছে বেশ দুর্বোধ্য থেকে যাওয়াই স্বাভাবিক। কোন কোন পাঠক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অনুবাদ পড়ে বিভ্রান্তিতে পড়েন। কিন্তু সত্যের অন্বেষায় একাগ্র ও একনিষ্ঠ পাঠকের কাছে কোরআন একটি আলোকবর্তিকা হিসেবেই এক সময় ধরা দেয়।
কোরআনের মূল সত্য অনুধাবন করতে হলে খুঁজে খুঁজে এর অন্তর্নিহিত অমীয় বাণীর মর্মার্থ অনুধাবন করতে হবে। কেননা যে কেউ তার স্বার্থ সিদ্ধিও জন্যে একে সহজেই ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে উপস্থাপন করতে পারে। সে ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি যেমন চরিত্রের, কুরআনকে স্বীয় স্বার্থের জন্যে তেমনিভাবে ব্যবহারের সে চেষ্টা চালায়। দুর্বল ও হীন চরিত্রের লোকেরা এই মহান গ্রন্থ আল কোরআনকে নিজেদের মতো করে দেখতে চায় এবং প্রয়োগও করতে চায়।
সুতরাং কোরআন কিংবা বাইবেলের ভুল ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অনুবাদ স্বভাবতই খারাপ হৃদয়ের ব্যক্তিদের দ্বারা হয়ে থাকে। এটা একেবারেই স্বাভাবিক কথা এবং সবাই সেটা জানেনও। সাধারণ একটি উদাহরণ থেকে এটা পরিষ্কার বোঝা যাবে। যেমন পবিত্র কোরআনে জিহাদের বিষয়ে যা বলেছে তার ভুল ব্যাখ্যা ও অনুবাদ যদি লক্ষ্য করি সেখানে দেখব্ োএকজন হীন স্বার্থবাদী অনুবাদক কিভাবে সেটা করেছেন।
সূরা বাকারার ১৯০ আয়াতে যেমন বল হয়েছে, “যারা তোমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় তাদের সাথে তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর। কিন্তু যুদ্ধ করতে গিয়ে তোমরা সীমালংঘন করো না। কেননা যারা বাড়াবাড়ি করে আল্লাহ তায়ালা তাদের পছন্দ করেন না। এই যালেমদের যেখানে পাও হত্যা কর। যেখান থেকে তোমাদের বের করেছিল সেখান থেকে ওদের বের করে দাও। কেননা অরাজকতা হত্যার চেয়েও মারাতœক জিনিস।”
এই আয়াতের ভুল অনুবাদ ও ব্যাখ্যার নানা রকম সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সত্যিকার সত্যান্বেষী ও পরিপক্ক ব্যাখ্যাকারী বা তাফসীরকারী কখনও তা করেন না। এ আয়াতের মূও ভিত্তি হচ্ছে “সীমালংঘন করো না”। বর্তমান সময়ের শত শত বছর পূর্বে যা শাশ্বত বাণী হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছে। এ বিষয়ে সত্যান্বেষী ও ব্যাখ্যাকারী বলেন, “যুদ্ধ অবশ্যই সীমারেখা মেনে করতে হবে, সীমালংঘনের বিষয়ে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ নারী, শিশু, বৃদ্ধ এবং যুদ্ধ করতে অক্ষম পুরুষদের উত্ত্যক্ত বা হত্যা করাকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধ করেছে।
এই আয়াতে কোরআন সন্ত্রাসবাদকে প্রত্যাখ্যান ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান ঘোষণা করেছে।
অন্যদিকে “যালেমদের যেখানে পাও হত্যা কর”। বাক্যটি যদি এখানে স্বতন্ত্রভাবে কেউ অনুবাদ করে তবে সেটা অবশ্যই উগ্রপন্থীদের সহায়ক অনুবাদ হব্ েএ ধরনের অসংখ্য বাক্য ইহুদীদের তাওরাত ও খৃস্টানদের নিউটেস্টামেন্টেও পাওয়া যাবে। কিন্তু কোন বাক্যের পূর্বাপর সম্পর্কহীন অনুবাদ যে গ্রহণযোগ্য নয় তা সবার জানা।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না এবং মুসলমানদের আরও স্মরণ রাখা উচিত যে, ৭ম শতাব্দীতে আরব ভ’মি প্রচন্ড রকম সন্ত্রাসী কার্যক্রমে পরিপূর্ণ ছিল রাসূল (স.) নিজেও সেই সন্ত্রাসের শিকার হয়েছিলেন। সুতরাং সেই পরিস্থিতি উপলব্দি না করে যদি কেউ কোরআনের অনুবাদ করতে যান, তবে এর মাধমে পবিত্র গ্রন্থের অবমাননা হতে বাধ্য এবং অবশ্যই তা ভুল অনুবাদ হবে। তারপরেও মুষ্টিমেয় কিছু উগ্রপন্থী মুসলিম একে গ্রহণ করেছে নব্য পরিস্থিতির বিপক্ষে ওষুধ হিসেবে। বর্তমানে যেখানে সন্ত্রাস দমনের নামে পশ্চিমা বিশ্ব যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, নিরীহ নারী-পুরুষ ও শিশুদের পাইকারী হারে হত্যা করছে, বৈষয়িক সম্পদ লুণ্ঠনের জন্যে লাখ লাখ নিরপরাধ মানুষকে পশ্চিমা বাহিনী হত্যা করছে; এরই প্রতিশোধ হিসেবে আমরা এই উগ্রপন্থী মুসলিমদের আতœঘাতি হামলা লক্ষ্য করছি।
লন্ডন হামলার পর বৃটিশ মুসলিম সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ বৃটিশ সম্প্রদায়ের দ্বারা প্রচন্ডরকম ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। এটাই কি আল-কায়েদার গুরুত্বপূর্ণ বিজয়? বাস্তব কথা হচ্ছে মুসলিম নেতাদেরকে বৃটেনে দুর্বল করে দিয়েছে, শেষ পর্যন্ত বৃটেনকে সম্প্রদায়গতভাবে দুর্বল করতে সক্ষম হয়েছে আল কায়েদা এবং বৃটিশ মুসলিমদের চরম সর্বনাশ ডেকে এনেছে। হঠাৎ করেই বৃটেনের জনগণ দেখতে পেয়েছে, তারা একটি ফাঁদে আটকে গেছে। যেখানে জাতিগত ও ধর্মীয় সম্প্রদায়গত যুদ্ধ চেপে বসতে যাচ্ছে। সুতরাং আমাদের জরুরী কাজ হচ্ছে আশঙ্কাজনক এই ধর্মীয় হানাহানির পথকে বন্ধ করা। আর সেটা একমাত্র সম্ভব কোরআনের মাধ্যমে। কোরআনই আমাদের সবাইকে এ অযাচিত বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে। ( লেখক লন্ডনের ডেইলি টাইমসের সাবেক সম্পাদক)
উল্লেখ্য, এই বিষয়গুলো ইহুদীবাদ ও খৃষ্টবাদের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। একজন উত্তম ও ভালো মুসলিম যিনি কোরআনের প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্যসম্পন্ন তিনি ওই একনিষ্ঠ আনুগত্যসম্পন্ন তিনি ওই একনিষ্ঠ ইহুদীর মতো যিনি গভীরভাবে তাওরাত কিতাব অধ্যয়ন করেন এবং তা মেনে চলেন কিংবা একজন একনিষ্ঠ খৃস্টানের মতো যিনি গভীরভাবে বাইবেল অধ্যয়ন করেন।
কোরআন বারবার শুধু একথাই স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আল্লাহ মহান করুণাময় প্রভু। যিনি সবকিছু দেখেন এবং সমস্ত জ্ঞানের অধিকারী। ইসলাম কোন বোমাবাজি তত্ত্ব বা বোমা হামলার মতবাদ নয় বরং ইসলাম হচ্ছে দয়া ও করুণার মতবাদ।
তারপরও কী আশ্চর্য! আমরা একে ধর্মীয় সংঘাতের সাথে সম্পর্কিত করছি। মধ্যযুগের মতো আজ আমরা ইসলাম ও খৃস্টবাদের মধ্যে সংঘাতের পটভ’মির রচনা করছি। কিন্তু ইসলামের ও আধুনিক ইউরোপীয় সংস্কৃতি এবং উত্তর আমেরিকা এর মধ্যে জড়িয়ে যাচ্ছে সংঘাতের দিকে। এটা কি দুটি সংস্কৃতির মোড়কে উপস্থাপন করা হচ্ছে এখানে একটি ঐতিহাসিক বিষয়ের দিকে নজর দিতে চাই। ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষনার কথা সবাই জানেন। যে ঘোষণার কারণে ইসরাঈল সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের কারণে একটি মারাতœক অশান্তি এবং চিরস্থায়ী সমস্যার সৃষ্টি হয়। সে অশান্তি কি এখন আর তা প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই। এছাড়া তেলও অনুরূপ বিবাদ, অশান্তি ও সংঘাতের অন্যতম উপলক্ষ। কেননা বিশ্বের অর্থনীতি তেল সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। আর বিশ্বের তেলভান্ডারের অধিকাংশই মুসলিম দেশসমূহের আয়ত্বে। এটা শুধু আমার একার বক্তব্য নয়, বহু প্রতিবাদকারীর জোড় অভিযোগ হচ্ছে, আমেরিকা মুসলিম দেশসমূহের তেল ভান্ডারকে ছলে-বলে-কৌশলে নিজের আয়ত্বে নেয়া ও যথেচ্ছা ব্যবহারের জন্যে কক্ষিগত করতে চায়। সুতরাং আমেরিকা তার পররাষ্ট্র নীতিকে প্রতারণামূলক ও মিথ্যার ছদ্মবরণে ঢেলে সাজিয়েছে। আমেরিকা তার কর্মকান্ডকে এমনভাবে সাজিয়েছে, যাতে মধ্যপ্রাচ্যের তেল ভান্ডার দীর্ঘ মেয়াদে এমনকি সম্ভব হলে চিরস্থায়ীভাবে তাদের কব্জায় থাকে। তেলকে যেন মধ্যপ্রাচ্য রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার না করতে পারে সে জন্যে মৌলবাদী ধুয়া তুলে সন্ত্রাসের বিষয়টিকে সামনে আমেরিকা সামনে নিয়ে এসেছে।
রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে লন্ডনে বোম হামলার চেয়ে অনেক বেশী শক্তিশালী হচ্ছে তেল অস্ত্র। আমেরিকা এ ক্ষেত্রে বিশ্বে তেল সরবরাহের ক্ষেত্রে তার দায় এড়াতে পারে না। কারণ চীন থেকে পেরু পর্যন্ত প্রতিটি দেশ তেলের ওপর শতভাগ নির্ভরশীল।
এই সংঘাতের উৎস আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। সাধারণ মানুষ কেন এতে জড়িয়ে পড়ছে সেটা গভীরভাবে উপলব্দি করা দরকার। ইসলাম এমন একটি গ্রন্থ আবর্তিত ধর্ম যার সাতে কোনো গ্রন্থের তুলনা করা যেতে পারেনা। কোরআন না পড়ে ইসলামকে পরিপূর্ণ উপলব্দি করা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। বাস্তব কথা হচ্ছে, ইসলামের মহান শিক্ষা হলো মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.), যীশু খ্রীস্ট অর্থাৎ ঈসা (আ.)-কে নবী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। খ্রীস্ট হিসেবে নয়।
বর্তমান পশ্চিমা জগতে আধুনিক সভ্যতা ও বহুবাদী সমাজ ব্যবস্থায় কোন একটি গ্রন্থই এককভাবে কোনো জাতির প্রতিনিধিত্ব করে না। একজন মুসলিম যদি পশ্চিমা দর্শন সম্পর্কে জানতে চায়, তবে তাকে বিশাল একটি লাইব্রেরী ঘাটতে হবে। তাকে মার্কিন সংবিধান থেকে শুরু করে কার্ল মার্কসের ডাস ক্যাপিটাল ও লেলিনের একনায়কতন্ত্র সম্পর্কে জানতে হবে। তাকে আরও পড়তে হবে নিউটন, ডারউইন এবং আইনস্টাইন; এছাড়া তলস্তয়, ডিকেন্স, হেমিংওয়ে সম্পর্কেও জানতে হবে। বেটোফোন, বিটেলসের মিউজিক শুনতে হবে। তারপরেও পশ্চিমা সংস্কৃতি, সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে না, যদি পশ্চিমা সমাজে বসবাস না করা হয়। সুতরাং পশ্চিমা দুনিয়ার মনোভাব ও সমাজ-সংস্কৃতি বুঝতে উপরোক্ত উপায়ের কোন বিকল্প নেই।
বৃটেনের মুসলিম সম্প্রদায়ের শীর্ষ নেতারা প্রধানমন্ত্রীর সাথে যথোপযুক্ত সময়ে একটি বৈঠক করেছেন এবং তাকে পুনরায় এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন যে, ইসলাম হচ্ছে কল্যাণময় শান্তির ধর্ম, সুতরাং একজন উত্তম ও ভালো মুসলিমের জন্যে কখনই সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীর পক্ষ সমর্থন করা সম্ভব নয়। মুসলিম নেতারা বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে ইসলামের সঠিক ও যথোপযুক্ত কাজটি করেছেন।
কেউ যদি নিজেকে উত্তম মানুষে পরিণত করতে চায় তবে তার অবশ্যই কোরআন পড়া উচিত। অবশ্য নানা ধরনের উদ্দেশ্যমূলক অনুবাদ বিশেষ করে ইংরেজী অনুবাদ যাচাই করে পড়তে না পারলে এবং আরবী ভাষা না শিখলে কোরআনের প্রকৃত অর্থ একজন স্বতন্ত্র পাঠকের কাছে বেশ দুর্বোধ্য থেকে যাওয়াই স্বাভাবিক। কোন কোন পাঠক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অনুবাদ পড়ে বিভ্রান্তিতে পড়েন। কিন্তু সত্যের অন্বেষায় একাগ্র ও একনিষ্ঠ পাঠকের কাছে কোরআন একটি আলোকবর্তিকা হিসেবেই এক সময় ধরা দেয়।
কোরআনের মূল সত্য অনুধাবন করতে হলে খুঁজে খুঁজে এর অন্তর্নিহিত অমীয় বাণীর মর্মার্থ অনুধাবন করতে হবে। কেননা যে কেউ তার স্বার্থ সিদ্ধিও জন্যে একে সহজেই ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে উপস্থাপন করতে পারে। সে ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি যেমন চরিত্রের, কুরআনকে স্বীয় স্বার্থের জন্যে তেমনিভাবে ব্যবহারের সে চেষ্টা চালায়। দুর্বল ও হীন চরিত্রের লোকেরা এই মহান গ্রন্থ আল কোরআনকে নিজেদের মতো করে দেখতে চায় এবং প্রয়োগও করতে চায়।
সুতরাং কোরআন কিংবা বাইবেলের ভুল ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অনুবাদ স্বভাবতই খারাপ হৃদয়ের ব্যক্তিদের দ্বারা হয়ে থাকে। এটা একেবারেই স্বাভাবিক কথা এবং সবাই সেটা জানেনও। সাধারণ একটি উদাহরণ থেকে এটা পরিষ্কার বোঝা যাবে। যেমন পবিত্র কোরআনে জিহাদের বিষয়ে যা বলেছে তার ভুল ব্যাখ্যা ও অনুবাদ যদি লক্ষ্য করি সেখানে দেখব্ োএকজন হীন স্বার্থবাদী অনুবাদক কিভাবে সেটা করেছেন।
সূরা বাকারার ১৯০ আয়াতে যেমন বল হয়েছে, “যারা তোমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় তাদের সাথে তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর। কিন্তু যুদ্ধ করতে গিয়ে তোমরা সীমালংঘন করো না। কেননা যারা বাড়াবাড়ি করে আল্লাহ তায়ালা তাদের পছন্দ করেন না। এই যালেমদের যেখানে পাও হত্যা কর। যেখান থেকে তোমাদের বের করেছিল সেখান থেকে ওদের বের করে দাও। কেননা অরাজকতা হত্যার চেয়েও মারাতœক জিনিস।”
এই আয়াতের ভুল অনুবাদ ও ব্যাখ্যার নানা রকম সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সত্যিকার সত্যান্বেষী ও পরিপক্ক ব্যাখ্যাকারী বা তাফসীরকারী কখনও তা করেন না। এ আয়াতের মূও ভিত্তি হচ্ছে “সীমালংঘন করো না”। বর্তমান সময়ের শত শত বছর পূর্বে যা শাশ্বত বাণী হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছে। এ বিষয়ে সত্যান্বেষী ও ব্যাখ্যাকারী বলেন, “যুদ্ধ অবশ্যই সীমারেখা মেনে করতে হবে, সীমালংঘনের বিষয়ে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ নারী, শিশু, বৃদ্ধ এবং যুদ্ধ করতে অক্ষম পুরুষদের উত্ত্যক্ত বা হত্যা করাকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধ করেছে।
এই আয়াতে কোরআন সন্ত্রাসবাদকে প্রত্যাখ্যান ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান ঘোষণা করেছে।
অন্যদিকে “যালেমদের যেখানে পাও হত্যা কর”। বাক্যটি যদি এখানে স্বতন্ত্রভাবে কেউ অনুবাদ করে তবে সেটা অবশ্যই উগ্রপন্থীদের সহায়ক অনুবাদ হব্ েএ ধরনের অসংখ্য বাক্য ইহুদীদের তাওরাত ও খৃস্টানদের নিউটেস্টামেন্টেও পাওয়া যাবে। কিন্তু কোন বাক্যের পূর্বাপর সম্পর্কহীন অনুবাদ যে গ্রহণযোগ্য নয় তা সবার জানা।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না এবং মুসলমানদের আরও স্মরণ রাখা উচিত যে, ৭ম শতাব্দীতে আরব ভ’মি প্রচন্ড রকম সন্ত্রাসী কার্যক্রমে পরিপূর্ণ ছিল রাসূল (স.) নিজেও সেই সন্ত্রাসের শিকার হয়েছিলেন। সুতরাং সেই পরিস্থিতি উপলব্দি না করে যদি কেউ কোরআনের অনুবাদ করতে যান, তবে এর মাধমে পবিত্র গ্রন্থের অবমাননা হতে বাধ্য এবং অবশ্যই তা ভুল অনুবাদ হবে। তারপরেও মুষ্টিমেয় কিছু উগ্রপন্থী মুসলিম একে গ্রহণ করেছে নব্য পরিস্থিতির বিপক্ষে ওষুধ হিসেবে। বর্তমানে যেখানে সন্ত্রাস দমনের নামে পশ্চিমা বিশ্ব যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, নিরীহ নারী-পুরুষ ও শিশুদের পাইকারী হারে হত্যা করছে, বৈষয়িক সম্পদ লুণ্ঠনের জন্যে লাখ লাখ নিরপরাধ মানুষকে পশ্চিমা বাহিনী হত্যা করছে; এরই প্রতিশোধ হিসেবে আমরা এই উগ্রপন্থী মুসলিমদের আতœঘাতি হামলা লক্ষ্য করছি।
লন্ডন হামলার পর বৃটিশ মুসলিম সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ বৃটিশ সম্প্রদায়ের দ্বারা প্রচন্ডরকম ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। এটাই কি আল-কায়েদার গুরুত্বপূর্ণ বিজয়? বাস্তব কথা হচ্ছে মুসলিম নেতাদেরকে বৃটেনে দুর্বল করে দিয়েছে, শেষ পর্যন্ত বৃটেনকে সম্প্রদায়গতভাবে দুর্বল করতে সক্ষম হয়েছে আল কায়েদা এবং বৃটিশ মুসলিমদের চরম সর্বনাশ ডেকে এনেছে। হঠাৎ করেই বৃটেনের জনগণ দেখতে পেয়েছে, তারা একটি ফাঁদে আটকে গেছে। যেখানে জাতিগত ও ধর্মীয় সম্প্রদায়গত যুদ্ধ চেপে বসতে যাচ্ছে। সুতরাং আমাদের জরুরী কাজ হচ্ছে আশঙ্কাজনক এই ধর্মীয় হানাহানির পথকে বন্ধ করা। আর সেটা একমাত্র সম্ভব কোরআনের মাধ্যমে। কোরআনই আমাদের সবাইকে এ অযাচিত বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে। ( লেখক লন্ডনের ডেইলি টাইমসের সাবেক সম্পাদক)