ড. শমশের আলী
১. সূচনা : মানবজাতির ইতিহাসের বর্তমান সময়ের চেয়ে এর আগে কখনো এমন
জোরালোভাবে শান্তি ও একতার প্রয়োজনীয়তা অনুভ’ত হয়নি। বিশ্বে আগে থেকেই
বিরাজমান সহিংসতা, সন্ত্রাস ও ঘৃণার মতো সমস্যায় নিউইয়র্কের ৯/১১, ২০০৪
সালের ১১ মার্চ মাদ্রিদের বোমা বিস্ফোরণ এবং সাম্প্রতিককালে লন্ডনে ৭/৭
বোমা হামলা আরো মাত্রা যোগ করেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এসব ঘটনায় নিন্দা
প্রকাশ করেছে এবং এসব সন্ত্রাসী তৎপরতাও ঐক্যবদ্ধভাবে পৌছেছেন। বাংলাদেশের
সরকার এবং বাংলাদেশী জনগণও বিভিন্ন স্থাপনা ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর
পরিচালিত এ কাপুরুষোচিত হামলার বিরুদ্ধে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিন্দা
জানিয়েছেন। বাংলাদেশী জনগণের উদ্বেগ হলো, এ ধরনের গর্হিত দুষ্কর্মের
পটভ’মিতে ইসলামী বিশ্বের কিছু গৎবাঁধা বুলির ‘প্রতিক’ হয়ে ওঠা।
বাংলাদেশী জনগণ সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে তাদের সংহতি প্রকাশ করেছে। দেড়শ’ কোটি মুসলমান এক বৈচিত্র্যপূর্ণ সম্প্রদায়। যদিও অল্পসংখ্যক মুসলিম সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারে। কিন্তু বড় সত্য হচ্ছে, সামগ্রিকভাবে মুসলমানরা ধার্মিক এবং শান্তিপ্রিয়। আর মুসলমানরা শুধুই মধ্যপ্রাচ্যে নয়, তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিশ্বময়। তাহলে কেন গুটিকয়েক সহিংস মুসলমানের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ শান্তিপ্রিয় মুসলমানরা দুর্ভাগ্যের শিকার হবেন? এসব সন্ত্রাসীর জীবনধারায় আদৌ ইসলামী আদর্শের কোন প্রতিফলন রয়েছে কি না তা বিবেচনায় নিতে হবে। ইসলামের অনুসারী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপনের মাধ্যমেই ধর্ম অনুশীলন করেন। তাদের জীবনধারায় চরমপন্থার কোন ঠাঁই নেই। সে কারণেই বিশ্বের সব অঞ্চল ও সব ধরনের মানুষের সহযোগিতায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ধারনাটি সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। এটা স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা প্রয়োজন, ইসলামসহ বিশ্বের কোন ধর্মই কিন্তু কোন ধরনের সমস্যার সমাধানে হিংসার পথ বেছে নেয়ার ব্যাপারে ছাড়পত্র দেয়নি। ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ এবং হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর বাণীতে বহুস্থানে সহিংসতার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে। এমনি অন্য ধর্মের অনুসারীদের বিরুদ্ধে অবজ্ঞাসুচক কোন শব্দ উচ্চারণও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মোটকথা, সহিংস পন্থা অবলম্বনের পক্ষে যুক্তি দানের কোন সুযোগ ইসলামে নেই। আমাদের যে কোন অহিংস পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে সন্ত্রাস প্রতিহত করতে হবে। বর্তমানে বৈশ্বিক সমস্যা মানবজাতিকে দু’টি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
প্রথমত. বিশ্বশান্তির জন্য বিঘœসৃষ্টিকারী ইস্যু চিহিতকরণ এবং তা সমাধানের সুষ্ঠু উপায় উদ্ভাবন।
দ্বিতীয়ত. সব কাজ ও কথার মাধ্যমে এটা স্পষ্ট করা যে, লক্ষ্য অর্জনের জন্যে ধর্ম কখনো সহিংসতার সমর্থন দেয় না।
২-ক. প্রথম চ্যালেঞ্জ
যদিও প্রথম চ্যালেঞ্জ সর্বজনীন এবং তা মোকাবিলায় বিশ্বের দায়িত্বশীল নাগরিকদের রুখে দাঁড়াতে হবে। বিশ্বের পরাক্রমশালী জাতিগুলোর কাছে রয়েছে বৃহত্তর সম্পদ ও ক্ষমতা। এটা কাজে লাগিয়ে তারা বকেয়া রাজনৈতিক সংঘাত সমাধান করতে পারেন। মনে রাখতে হবে, সমস্যা জিইয়ে রাখা হলে সন্ত্রাসীরা কিছু মহলের সহানুভ’তি আদায় করার সুযোগ নিতে পারে। যদিও এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি ধর্মের কোন সমর্থন নেই। সব ধরনের প্রভাব ও ক্ষমতা খাটিয়ে সংঘাতের অবসানের জন্য রাষ্ট্র, এনজিও, বহুজাতিক কোম্পানী এবং ব্যক্তির দায়িত্ব রয়েছে। মুসলিম জনসংখ্যার দৃশ্যত জঙ্গি মনোভাব বোঝাতে প্রায়শ একটি কথা ব্যবহার করা হয়। আর তা হল ‘মৌলবাদ’। বিপুলসংখ্যক ধার্মিক মুসলিমদের উপহাস করতে এ কথাটি প্রয়োগের প্রচলন রয়েছে। অথচ এ ধার্মিক মুসলিমরা ধর্মকে বিভক্তির চেয়ে মানবজাতির ঐক্যের হাতিয়ার হিসেবে পণ্য করে থাকেন। তারা বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করেন, তাদের নির্দয়ভাবে ‘মৌলবাদী’ আখ্যা দেয়া হয়ে থাকে। সন্ত্রাসীরা কখনো মৌলবাদী হতে পারে না। কারণ আঁকড়ে ধরার জন্য তাদের কোন মৌলিক মূল্যবোধ নেই। অন্যদিকে দেড়শ’ কোটি মুসলমানের উল্লেখযোগ্য অংশই ধার্মিক। কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে তারা উপার্জন করে থাকেন এবং এই পৃথিবীতে প্রাপ্তির জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে কৃতজ্ঞ থাকেন। আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাতে তারা কখনো বিস্মৃত হন না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ খোদাভীরু এবং কোন অন্যায় কাজে লিপ্ত হওয়ার আগে তারা দু’বার ভাবেন। বিশ্বের অন্যান্য অংশের ধার্মিক মুসলমানদের সঙ্গে এ মুসলমানরা নিশ্চিতভাবেই মৌলিক ধর্মীয় মূল্যবোধ আঁকড়ে থাকেন। এবং যেমনটা প্রজন্মের পর প্রজন্ম তারা তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে রপ্ত করেছেন। এই ধার্মিক জনগোষ্ঠী প্রকৃত মৌলবাদী বটে; কিন্তু তারা সন্ত্রাসী নয়। তাদের ধর্মানুরাগ তাদের জীবন ব্যবস্থায় এবং বিশ্বাসে প্রতিনিয়ত প্রতিফলিত। বাংলাদেশ সফরকারী পশ্চিমা সাংবাদিকরা লক্ষ্য করেছেন যে, বন্যা ও সাইক্লোনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ সাধারণ মানুষ দুর্যোগের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে কী অদম্য সাহসে ভর করে থাকেন। নিজেদের পায়ে পুনরায় দাঁড়াতে তারা কখনোই হাল ছেড়ে দেন না। নব-উদ্যমে আবার তারা নেমে পড়েন জীবন সংগ্রামে। জনগণের এই জীবন ব্যবস্থার এভাবে বদলে যাওয়ার নেপথ্যে থাকে অঙ্গীকার, চারিত্রিক দৃঢ়তা, সৃষ্টিকর্তার প্রতি অবিচল আস্থা এবং মূল্যবোধের প্রতি বিশ্বাস।
পাশ্চাত্যের নাগরিক এবং আমাদের বুঝতে হবে ইসলাম শান্তি ও প্রগতির প্রবক্তা। মুসলিম বিশ্বের উল্লেখযোগ্য অংশ আজ কেন শিক্ষা-দীক্ষা ও সমৃদ্ধিতে অনগ্রসর, তা বিবেচনায় নিতে হবে এবং এই সত্য মুছে ফেলা উচিত নয়, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত গবেষণা আধুনিক বিশ্বের বস্তুগত অগ্রগতি নিশ্চিত করেছে, তাকে কিন্তু কোরআন ও হাদীস দারুণভাবে উৎসাহিত করেছে। পবিত্র কোরআনে প্রায় ৭৫০টি আয়াত রয়েছে, যা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে আমাদের চারপাশের জগতের বৈজ্ঞানিক সত্যকে তুলে ধরেছে। আল-কোরআনের ১০:১০১ আয়াতে হযরত মুহাম্মদকে (স.) বলা হয়েছে, ‘(হে নবী) তুমি বল, তোমরা দেখ, আসমানসমূহ ও জমিনের কি কি জিনিস রয়েছে।’ এই আয়াতের মাধ্যমে কার্যত বিজ্ঞানের সত্য অন্বেষণের সব এজেন্ডা প্রতিফলিত হয়েছে এবং এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, এই আয়াত দ্বারা উৎসাহিত হয়েই আদিপর্বের মুসলমানরা বিজ্ঞান, কলা ও সংস্কৃতিতে অগ্রসর হয়ে সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় এক নতুন সভ্যতার। গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, প্রযুক্তি এবং আরো নানা বিষয়ে তারা বিরাট অগ্রগতি নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়। এ প্রসঙ্গে আমি ‘ইসলাম ঃ বিশ্বাসের ঐতিহ্য’ শীর্ষক একটি প্রামান্যচিত্রের কথা উল্লেখ না করে পারছি না। ৯/১১-এর দুর্ঘটনার পর নির্মিত এ চিত্রটির মাধ্যমে হার্ভার্ডের কয়েকজনসহ পশ্চিমা প-িতরা দেখিয়েছেন, যখন পাশ্চাত্যের প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যাপ্ত গ্রন্থাগার ছিল না, তখন মুসলমানদের বাড়ীতেও ছিল সমৃদ্ধ পাঠাগার। এটা সত্যি বড় দুঃখজনক, যে মুসলমানরা আধুনিক যুগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপন করেছেন, তারাই আজ জ্ঞানের দিক থেকে পিছিয়ে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কিন্তু জ্ঞান-বিভক্তি এবং এর পরিণামস্বরূপ সমৃদ্ধি-বিভক্তি ব্যতিরেখেই সহাবস্থানে সক্ষম। পাশ্চাত্যের নেতারা মুসলমানদের সঙ্গে তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান ভাগাভাগি করতে পারেন এবং বঞ্চনার পরিবর্তে তাদের দিতে পারেন সহযোগিতা ও ন্যায়পরায়ণতার বোধ। এ ধরনের সহযোগিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হলেই পাশ্চাত্যের সঙ্গে ইসলামের চমৎকার নৈকট্য গড়ে উঠতে পারে। আর সেক্ষেত্রে সন্ত্রাসী নির্মূলে বহুদূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। সন্ত্রাসীরা তখন আর দারিদ্র্য এবং অধিকার হরণের শিকার হওয়া জনগণের কাছ থেকে কোন সমর্থন পাবে না। আর সে কারণেই মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বা সহ¯্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আলোকে উন্নয়নের একটি রোডম্যাপ তৈরী সময়ের দাবী।
পাশ্চাত্যের বহু দেশ উল্লেখ করেছে, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে, ইসলামের বিরুদ্ধে নয়। ইসলামী বিশ্বকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সব সংঘাতের অবসানে এগিয়ে আসতে হবে এবং তাকে কথা ও কাজের মাধ্যমে তার সত্যিকারের প্রমাণও রাখতে হবে।
২-খ. ন্যায়পরায়ণতা এবং শান্তির পথে বাধা হিসেবে দ্বৈতনীতি পরিহার। যদি পরিবার থেকে শুরু করে সামাজিক, জাতীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক স্তরে শান্তি অর্জন করতে হয়, মানবজাতির সর্বস্তরের বিরোধ নিষ্পত্তিতে ন্যায়পরায়ণতা ও ন্যায্যতার নীতি অনুসরণ নিশ্চিত করা। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের রাজনৈতিক পর্যায়ে আমরা যে দ্বৈতনীতি দেখতে পাই, তা যে কোন মূল্যে পরিহার করতে হবে। কারণ দ্বৈতনীতির অনুসরণে নিরীহ লোকদের অনুভূতি আহত হতে পারে। এটা লক্ষ্যণীয় যে, পবিত্র কোরআন ও হাদিসে ন্যায়পরায়ণতা ও বিধি অনুসরণে বারবার গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ( যেমন আয়াত ৫ৎ৪৫, ৪৯:৯, ৬০:৮ যেখানে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন, যারা বিচারের ক্ষেত্রে বজায় রাখেন ন্যায়পরায়ণতা)।’ আবার ক্ষল্য করুন, ১১:৮৫ আয়াত। ‘হে আমার জাতি, তোমরা মাপ ও ওজনের কাজকে ইনসাফের সঙ্গে আঞ্জাম দেবে, মানুষকে কখনো তাদের প্রাপ্য বস্তু কম দেবে না, মাপের তারতম্য করে, জমিনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করো না।’
৩. দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ
ইসলামের অনুসারীদের জন্য দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটি আরো বেশী প্রাসঙ্গিক। এর সহজ কারণ হলো, শান্তির পথে বিঘœ সৃষ্টিকারী হিসেবে আজ মুসলমানরাই বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমের শিরোনামে পরিণত হয়েছে। সুতরাং ইসলামের প্রত্যেক অনুসারীর ইহজাগতিক কর্তব্য হচ্ছে, এই ধারণা স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ করে দেয়া যে, ইসলাম ধর্ম এই ধরিত্রীর বুকে সত্যিই বইয়ে দিতে চায় এক সুশীতল ঝরনা ধারার প্র¯্রবণ। এটা কিভাবে বাস্তবে রূপদান করা সম্ভব, সেদিকে আলোকপাত করাই এই নিবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য। সত্যি বলতে কি, বিশ্বের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ ইসলামের সত্যিকারের আদর্শ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে তুলে ধরার জন্য এক অপূর্ব সুযোগ এনে দিয়েছে। এটা কাজে লাগিয়ে মুসলমানদের উচিত হবে একটি বহু জাতিগতভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় ইসলাম কি করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ঝা-া উর্ধ্বে তুলে ধরতে সক্ষম, বিশ্ববাসীল মনোযোগ সেদিকে আকর্ষণ করা। ইসলামের এ অবস্থান যদি বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা তাদের ব্যক্তিগত সদাচরণ এবং অমুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়, তাহলে ইসলামের বড় উপকার হবে। সেক্ষেত্রে কারো পক্ষেই এটা আর বিশ্বাস করার কোন যুক্তি থাকবে না, যে কোন পরিস্থিতিতে শান্তি বিঘিœত করার প্রতি ইসলামের কোনো অনুমোদন রয়েছে। কিন্তু কিভাবে আমরা ইসলামের এই সৌম্যরূপকে জগৎ সভায় বিকশিত করতে পারি? এই প্রশ্নের জবাব পেতে হলে আমাদের নিজেদের প্রতি এই প্রশ্ন রাখতে হবে যে, শান্তি সুরক্ষায় পবিত্র কোরআনে যেভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান কি তা উপলব্দি করতে পেরেছেন? সম্ভবত এর জবাব কিন্তু নেতিবাচকই হবে। ইসলাম ধর্মের অনুসরণকে সাধারণত অযৌক্তিকভাবে কতিপয় আচার-অনুষ্ঠান অনুসরণের সঙ্গে তুলনা করা হয়। আচার-অনুষ্ঠান নিশ্চয় খুব গুরুত্বপূর্ণ যা মানুষকে ভ্রান্ত চিন্তা ও কর্ম থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে ভ’মিকা রাখে। কিন্তু সমানভাবে, অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ না হলেও পবিত্র কোরআন ও হাদিসের সারবত্তা সম্পর্কে মুসলমানদের সম্যক উপলব্দি থাকতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত, মুসলমানরা এ সারবত্তা উপেক্ষা করে শুধু ধর্মের বাহ্যিক দিকটিই অনুসরণ করে। সুতরাং শান্তি এবং সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কিত কোরআনের শিক্ষাকে অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সর্বাগ্রে মুসলমানদের নিজেদেরই তা রপ্ত করতে হবে। সুতরাং ইসলামী প-িতদের বিরাট দায়িত্ব রয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমের, (সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট ইত্যাদি) মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ অপনোদনে যথোপযুক্ত প্রচার চালানো। বিশ্বশান্তির কথা বলতে গেলে, কোরআনে বর্ণিত শান্তির বিভিন্ন পর্যায় সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা জরুরী।
এতে ব্যক্তির নিজের যেমন, তেমনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শান্তি, সমাজের সদস্যদের সঙ্গে শান্তি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে শান্তি এবং অবশিষ্ট বিশ্বের সঙ্গে শান্তির ধারণা অন্তভর্’ক্ত এবং সাধারণভাবে মানবজাতিকে এমন কিছুতে অংশ না নিতে বলা হয়েছে, যা ‘ফিতনা ও ফ্যাসাদ’ সৃষ্টি এবং বিশ্বের সামগ্রিক শান্তি ও সংহতিকে বিনষ্ট করে। পবিত্র কোরআনে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালাকে স্বরণের মধ্য দিয়ে আতœার শান্তি গঠিত। যদিও কথাটির প্রকৃতি দর্শনগত মনে হতে পারে। কিন্তু এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জীবনযাপনের জন্যে দর্শনের প্রয়োজন রয়েছে এবং বিশেষ করে এমনটা তো দরকারই, যা নিশ্চিত করে শান্তি। আমরা যদি শান্তিপূর্ণ জাতিসমূহের একটি বিশ্ব সম্প্রদায় অর্জনের কথা বলি, তাহলে অধিকতর নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, এটা উপলব্দিতে নিতে হবে যে, একটি বহু জাতিগত সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা প্রধানত নির্ভর করছে সহিষ্ণুতার ওপর। এবঙ এই সহিষ্ণুতাই কিন্তু ইসলামের অন্যতম শক্তিশালী স্তম্ভ। সুতরাং সহিষ্ণুতা কথাটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দারুণভাবে অপরিহার্য্য।
৩. ইসলামের সহিষ্ণুতা
ইসলামের সহিষ্ণুতার গুরুত্ব উপলব্দির জন্যে কেউ একজন নি¤েœাক্ত বিষয়গুলোকে ব্যাপকভিত্তিক ক্ষেত্র হিসেবে চিহিত করতে পারেন ঃ
৩. ক. ধারণাসমূহের সহিষ্ণুতা;
৩. খ. অন্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা;
৩. গ. রাজনীতিতে সহিষ্ণুতা;
৩. ঘ. ঘরোয়া ও সামাজিক জীবনে সহিষ্ণুতা
এখন আমরা পর্যায়ক্রমে এসব বিষয়ের ওপর আলোকপাত করব।
৩. ক. ধারণাসমূহের সহিষ্ণুতা
বিজ্ঞান আজ যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, তা হয়তো সম্ভব হতো না, যদি না বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলোর মধ্যে সহিষ্ণুতার ঘাটতি থাকত। ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে যে, বহু ক্ষেত্রে এ সহিষ্ণুতা না দেখা গেলেও ইসলামের অনুসারীরা কিন্তু নতুন বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলো গ্রহণে কখনো দ্বিধান্বিত থাকেননি। বৈজ্ঞানিক মতবাদ প্রচার করতে গিয়ে গ্যালিলিওর ক্ষেত্রে আমরা যে ধর্ম বিচার-সভা প্রত্যক্ষ করেছি, তেমনি নজির কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে নেই। গ্যালিলিও কিন্তু যথাযথই দিকনির্দেশ করেন যে, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। অথচ গ্যালিলিওকে এই ধারণা প্রচারের জন্য কি খেসারতটাই না দিতে হয়েছে। সমগ্র মানবজাতির জন্যে এটা ছিল এক লজ্জার। যেদিন গ্যালিলিওকে চার্চের সামনে নতজানু হয়ে এ মর্মে অনুশোচনা করতে হয়েছিল যে, তিনি যা বলেছেন তা ঠিক নয়। কিন্তু মানবজাতি আজো জানেন, গ্যালিলিওই ছিলেন সঠিক।
মুসলমানদের ক্ষেত্রে সহিষ্ণুতার ভিত্তি হচ্ছে কোরআনের আয়াত; যেখানে তাদের প্রকৃতি নিয়ে ভাবতে বলা হয়েছে। সমগ্র বিজ্ঞান কিন্তু জিজ্ঞাসার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এবং এটা হলো সেই জিজ্ঞাসা, যা পবিত্র কোরআনে বারবার উৎসাহিত করেছে। ১০:১০১ আয়াতে ঘোষণা হচ্ছে, ‘.....পর্যবেক্ষণ কর সব কিছুই, স্বর্গ ও পৃথিবীর মধ্যে যা কিছু অবস্থিত।’ এই যে এখানে বেহেশত ও পৃথিবীর মধ্যকার সবকিছুই। পর্যবেক্ষণ করতে বলা হলো, তার মূল সুর কিন্তু বিজ্ঞানের মাধ্যমে সত্যের অন্বেষায় নিহিত। এতে তাই বিস্ময়ের কিছু নেই যে, পবিত্র কোরআনে এবং বিজ্ঞান যে বিন্দুতে এসে মিলিত হয়েছে তা হচ্ছে সত্য। এই সত্য পরিব্যাপ্ত রয়েছ, ক্ষুদ্রের মধ্যে ক্ষুদ্রতম থেকে বৃহত্তের মধ্যে বৃহত্তমে। এবং এটাই বৈজ্ঞানিক জিজ্ঞাসা ও গবেষণা, যার মাধ্যমে মানুষ সত্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে পারে, আর সে সত্য কিন্তু প্রতিফলিত প্রকৃতির আইনে। এও সত্য যে, আজ আমরা যাকে বিজ্ঞান বলে জানি, তা আসলে মানবজাতির অংশীদারিত্বভিত্তিক ঐতিহ্যবাহী সম্পদ। এটা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে বিশ্বের বহু ভুখ-ের, সংস্কৃতির ও ধর্মের অনুসারী নারী-পুরুষের বিরামহীন প্রচেষ্টার ফলে। আসলে বিজ্ঞানই হচ্ছে মানবজাতির একমাত্র অভিন্ন সম্পদ। এ সম্পদ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ইসলামের শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু অবিস্মরণীয়। এ প্রসঙ্গে খলিফা আল মনসুরের ভূমিকা প্রণিধানযোগ্য। রাজধানী হিসেবে বাগদাদের প্রতিষ্ঠালগ্নকে স্মরণীয় রাখতে তিনি আহবান করেন এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন। বাগদাদ পরবর্তী সময়ে মানব সভ্যতার অন্যতম মহান কেন্দ্রের মর্যাদা লাভ করে। ওই সম্মেলনের প্রতিপাদ্য ছিল পৃথিবীর পরিধির মাপ নির্ধারণ করা। এটা কিন্তু এমন ছিল না যে, ওই সময়ে পৃথিবীর পরিধি সম্পর্কে মানুষের কোনো ধারণাই ছিল না। কিন্তু আল মনসুর নিখুঁত মাপ নিরূপণে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তারই প্রচেষ্টায় ওই সময়ের বিশ্বে যেখানে যত নামজাদা প-িত ছিলেন, তাদের সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ভারতের কঙ্কা ছিলেন তাদের অন্যতম। সেই সম্মেলন থেকেই কিন্তু বায়তুল হিকমাত বা জ্ঞানের আবাস সৃষ্টির ধারণা উত্থিত হয়। মজার বিষয় হচ্ছে, পৃথিবীর পরিধির প্রকৃত মাপের চেয়ে সেই সময়ের নিরূপিত মাপের মধ্যে ব্যবধান ছিল শুধুই ১০ শতাংশের। খলিফা মনসুরের এই যে মাপ সম্পর্কে যথার্থতা নিরুপণের প্রয়াস, তাকে কিন্তু এক চমৎকার দৃষ্টান্ত হিসেবেই দেখতে হবে। আর দৃষ্টান্ত হচ্ছে বহু সংস্কৃতি থেকে আসা প-িতদের সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষ অর্জন। এটা একই সঙ্গে সত্যের অনসন্ধানে জ্ঞানের অংশীদারিত্বের প্রয়োজনীয়তারও এক প্রতীকী নির্দেশক। সুতরাং মুসলিম বিজ্ঞানী ও শাসকরা এভাবেই জ্ঞানের প্রাসাদ নির্মাণে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছেন। এর মূল ভিত্তি হচ্ছে বহু লোকের বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলোকে ধারণ করার সহিষ্ণুতায় স্বীকৃতি। এসব সত্য ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং আজ তা অমুসলিমদের পাশাপাশি তরুণ মুসলিম প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। তরুণ প্রজন্ম দুর্ভাগ্যবশত তাদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে উদগ্রীব নয়।
বিজ্ঞান হচ্ছে একমাত্র ক্ষেত্র যেখানে ইসলাম প্রমাণ করতে পারে যে, তার ধর্ম আধুনিক এবং প্রগতিশীল। সামাজিক খাতের দিকে তাকান। ইসলাম তার উত্থানের গোড়া থেকেই সামাজি ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কে শিক্ষা দিয়েছে। নারী ও পুরুষের অধিকার সমুন্নত রেখেছে। আজ আমরা মেয়ে শিশুর অধিকার নিয়ে কথা বলছি; কিন্তু ইসলাম মেয়ে শিশুকে জীবন্ত কবর দেয়ার মতো অভিশপ্ত প্রথার বিলোপ ঘটিয়েছে। কঠোর হস্তে। খ্রিস্টান বিশ্বের যেমন রয়েছে জোয়ান অব আর্ক, তেমনি মুসলমানদের রয়েছে দুঃসাহসী রাজিয়া সুলতানা।
ব্যাংকিংয়ের দিকে একটু নজর দেয়া যাক। বিশ্বের বহু দেশে ইসলামী ব্যাংকিং বিস্তৃত রয়েছে। এর মধ্যে বিশ্বের সম্পদশালী দেশও রয়েছে। কিন্তু এই ব্যাংকিং উন্নত ব্যবসা পরিবেশের প্রতি হুমকি হিসেবে গণ্য হয়নি। পবিত্র কোরআন রিবা বা সুদ হারাম করেছে। অথচ এর ফলে ব্যাংকিং ও ব্যবসা কিন্তু পঙ্গু হতে বসেনি। বিপরীতক্রমে বরং বলা চলে গলাকাটা সুদের লেনদেন অথবা এক ধরনের প্রতারণানির্ভর লেনদেনের বিরুদ্ধে এটা এক রক্ষাকবচ। ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা ব্যাংক ও গ্রাহকদের মধ্যে এক সুষ্ঠু যৌথ ব্যবসায় উদ্যোগ। অর্থনীতি, সামাজিক উন্নয়ন, বিজ্ঞান প্রযুক্তি, ইতিহাস-এ রকম সবক্ষেত্রেই অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে, ইসলাম যেখানে নতুন ধারণা, নীতি ও পদ্ধতি উদ্ভাবনে অগ্রণী ভ’মিকা রেখছে। আজকের বিশ্ব সমাজ যদি এই সম্পর্কে অবহিত না হয়, তাহলে তা আমাদের গলদ। মুসলিম হিসেবে আমাদের অবশ্যই আমাদের ধর্মের সত্যিকারের সুমহান রূপ উন্মোচিত করতে হবে। এ ধর্ম যে আদৌ অন্ধকার যুগের মতবাদ নয়, এ যে এক প্রগতিশীল আধুনিক বিশ্বাস তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
৩. খ. অন্যান্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা
অন্যান্য ধর্মের প্রদি ইসলামের যে সহিষ্ণুতা, তার মূল ভিত্তিও কিন্তু পবিত্র কোরআন। অথচ অনেকেই একটা উল্টো ধারণা পোষণ করেন যে, ইসলামের প্রসার ঘটেছে শক্তি প্রয়োগে। পবিত্র কোরআন সুনির্দিষ্টভাবে ঘোষণা করেছে, ‘আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে কোনো জোর জবরদস্তি নেই। কারণ সত্য এখানে মিথ্যা থেকে দিবালোকের মতই স্পষ্ট। (২ঃ২৫৬)। ৬:১০৭ আয়াতেও এটা বলা হয়েছে ঃ ‘আমি তোমাকে তাদের ওপর পাহারাদার নিযুক্ত করে পাঠাইনি। তুমি তো তাদের ওপর কোনো অভিভাবক নও’। ৮৮:২১-২৬ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমাকে তো এদের ওপর বলপ্রয়োগকারী করে পাঠানো হয়নি’। আবার ১০:৯৯ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে নবী, তোমার মালিক চাইলে এ জমিনে যত মানুষ আছে, তারা সবাই ঈমান আনত (কিন্তু তিনি তা চাননি, তাছাড়) তুমি কি জোড়-জবরদস্তি করে চাইবে যে, তারা সবাই মোমিন হয়ে যাক। ইসলামে সহিষ্ণুতা এবং সহাবস্থান সম্পর্কে সর্বোচ্চ আরজি জানানো মূর্ত হয়েছে ১৮:১৯ আয়াতে। সুতরাং যার ইচ্ছা সে ঈমান আনুক, আর যার ইচ্ছা সে অস্বীকার করুক’।
ইসলাম ধর্ম তার অনুসারীদের অন্য ধর্মের দেব-দেবীদের অসম্মান করাকে নিষিদ্ধ করেছে। পবিত্র কোরআন ৬:১০৮ আয়াতে ঘোষণা দিচ্ছে, ‘তারা আল্লাহ তায়ালার বদলে যাদের ডাকে, তাদের তোমরা কখনো গালিগালাজ করো না, নইলে বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে, না জেনে আল্লাহ তায়ালাকেও তারা গালি দেবে। আমি প্রত্যেক জাতির কাছে তাদের নিজ কার্যকলাপকে সুশোভন করে রেখেছি। অতঃপর সবাইকে তাদের মালিকের কাছ ফিরে যেতে হবে। অতপর তিনি তাদের বলে দেবেন, তারা দুনিয়ার জীবনে কী করে এসেছে’। অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের সঙ্গে সহাবস্থানের তাগিদ দিয়ে একজন মুসলমানকে পবিত্র কোরআন কর্তব্যও নির্ধারণ করে দিয়েছে। পবিত্র কোরআনের ভাষায়, লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিইয়া দ্বীন। এর অর্থ হচ্ছে ‘তোমাদের পথ তোমাদের জন্য আমার পথ আমার জন্য’।
যদি তরুণ প্রজন্ম শান্তিকামী হিসেবে আদর্শস্থানীয় কয়েকজনকে অনুসরণ করে, তাহলে তা শান্তি অর্জনের পথ কুসুমাস্তীর্ণ করতে পারে। এ প্রসঙ্গে জর্জ বার্নার্ডশ’য়ের একটি উক্তি উল্লেখযোগ্য ঃ ‘আমি সর্বদাই মুহাম্মদের ধর্মের প্রতি উঁচু শ্রদ্ধা পোষণ করি। কারণ এ ধর্মের রয়েছে এক আশ্চর্য জীবনীশক্তি। এটাই একমাত্র ধর্ম, যা পরিবর্তনশীল বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে হওয়ার ক্ষমতা রাখে বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। এ ধর্ম প্রত্যেক যুগেই প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখার দাবীদার। আমি তাকে আতœস্থ করেছি এবং বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, তিনি খ্রিস্টবিরোধী দলের কেউ নন। বরং তাকে অবশ্যই বলা উচিত মানবতার রক্ষাকর্তা। আমি বিশ্বাস করি, তার মতো একজন ব্যক্তি যদি আধুনিক বিশ্বের স্বৈরশাসক হতেন, তাহলে তিনি এমন উপায়ে সমস্যার সমাধান করতেন, যার ফলে বহু প্রত্যাশিত শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত হতো। আমি মুহাম্মদের বিশ্বাস সম্পর্কে এই ভবিষ্যদ্বাণী করছি যে, এটা আগামী দিনের ইউরোপের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে; আজকের ইউরোপে যেমন এটা কিন্তু পেতে শুরু করেছে।’
ইসলামে সহিষ্ণুতার দৃষ্টান্ত হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছ থেকে সবচেয়ে ভালোভাবে আহরণ করা সম্ভব। সত্য প্রচার করতে গিয়ে তিনি বহুবার বহু উপায়ে পদ্ধতিগত নিগ্রহ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কিন্তু তাই বলে কখনো যুদ্ধ ঘোষণা করেননি। বরং তিনি তার প্রিয় আবাসভ’মি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেছেন। ইসলামে প্রথম হামলা বা ফাষ্ট এটাকের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, ইসলামে আতœরক্ষার অধিকার দেওয়া হয়নি। অন্যায়ভাবে আক্রান্ত হলে যে কেউ সর্বদাই তা রুখে দাঁড়াতে পারেন। পবিত্র কোরআনের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেই লড়াই চালাতে পারেন। এসব কিছুই একটি বিষয় নিশ্চিত করছে যে, ইসলামে সহিংসতার কোনো সুযোগ নেই। পবিত্র কোরআনের ৫:৩২ আয়াতেও আমরা তার সুস্পষ্ট উল্লেখ দেখতে পাই। ‘....কোনো মানুষকে হত্যা করার কিংবা পৃথিবীতে ধ্বংসাতœক কাজ করার শান্তির বিধান ছাড়া অন্য কোনো কারণে কেউ যদি কাউকে হত্যা করে , সে যেন গোটা মানবজাতিকে হত্যা করল। আবার এমনিভাবে যদি একজনের প্রাণ রক্ষা করে, সে যেন গোটা মানবজাতিকেই বাঁচিয়ে দিল। এদের কাছে আমার রাসূলরা সুস্পষ্ট আইন নিয়ে এসেছিলেন, তারপরও এদের অনেকেই এ জমিনের বুকে সীমা লঙ্ঘনকারী হিসেবে থেকে গেল।’ শান্তির অন্বেষণ তাই আমাদের লক্ষ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়া উচিত। আর এই লক্ষ্য হচ্ছে উল্লিখিত আয়াত এবং ৮:৬১ আয়াতে বর্ণিত সর্বজনীন আদর্শ প্রতিষ্ঠা। ৮:৬১ এর ঘোষণা হচ্ছে-‘তারা যদি সন্ধির প্রতি আগ্রহ দেখায়, তাহলে তুমিও সন্ধির দিকে ঝুঁকে যাবে’। সপ্তদশ শতাব্দীর মরমি কবি জন ডান তার লেখনীর মাধ্যমে একই প্রতিধ্বনি তুলেছেন ঃ ‘কোনো মানুষই তার নিজের জন্যে কোনো একটি দ্বীনের সমগ্র দাবী করতে পারে না; প্রত্যেক মানুষ মহাদেশের একটি অংশমাত্র, মূলের একটি খ-; কোনো মাটির ঢেলা, কোনো উদগ্রভ’মি কিংবা কারো জমিদারী সমুদ্রে বিলীন হয়ে গেলে তা কিন্তু মহাদেশ হিসেবে ইউরোপের ক্ষতি। যে কারো মৃত্যু আমাকে ক্ষয় করে। কারণ মানবজাতির সঙ্গে আমার অস্তিত্ব অবিচ্ছেদ্য। আর সে কারণেই কারো মৃত্যুতে যখন বাজতে থাকে গির্জার ঘণ্টা, তখন যেন তোমরা জিজ্ঞেস করো না, এটা কার মৃত্যুতে, এটা তো তোমারই জন্যে।’ এটা দুঃখজনক যে, ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্ররা এই উক্তি সযতেœ স্মরণ রাখে। কিন্তু অভিন্ন বার্তাবাহী কোরআনের উল্লিখিত আয়াতের দিকে তাদের নজর পড়ে না।
সহিষ্ণুতার অনুশীলন এবং শান্তি অর্জনের কতা পুনরায় উল্লেখ করতে হলে আমাদের অবশ্যই পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান মদিনা সনদের কথা স্মরণে রাখতে হবে। পবিত্র নবী বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রয়োজনীয়তার নিরিখেই মদিনা সনদ প্রণয়ন করেন। সুতরাং এত কোনো বিস্ময়ের কিছু নেই যে, মদিনা সনদের একটি বিধান অত্যন্ত প্রজ্ঞার সঙ্গে এই মর্মে সংযোজিত হয় যে, সব ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে নিজেদের ধর্ম-কর্ম পালন করতে পারবেন। এবং কাউকে কোনো ধর্মে হস্তক্ষেপ করার অজুহাত বরদাশত করা হবে না। একটি বহু জাতিগত সমাজ ব্যবস্থায় আমরা যখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্যে লড়াই করছি বিশ্বময়, তখন আমরা লক্ষ্য করব, এই উদ্দেশ্য অর্জনে মদিনা সনদে বর্ণিত বিধানের মতো এমন অনন্য রক্ষাকবচ আর নেই। আমাদের নবীজী তাঁর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে পুনঃ পুনঃ দেখিয়েছেন যে, সহিষ্ণুতা এবং ক্ষমা জনগণের হৃদয় জয় করার জন্যে মোক্ষম অস্ত্র। একটি দৃষ্টান্তে বিষয়টি খুবই স্পষ্ট হবে। মক্কার যকন পতন ঘটে তখন আবু জাহেল, যিনি ইসলামের ঘোরতর বিরোধী হিসেবে চিহিত, তার ছেলে ইকরামা আবিসিনিয়ায় পালিয়ে যেতে মনস্থির করলেন। কারণ, তার আশঙ্কা ছিল, মুসলমানরা তাকে ধরতে পারলে হত্যা করবে। এমন পটভ’মিতে ইকরামার কন্যা নবীজীর কাছে এসে জানতে চাইলেন, ইকরামা মক্কায় থেকে যেতে এবং তার নিজের ধর্মবিশ্বাস পালন করে যেতে পারবে কিনা? এহনবী ইতিবাচক জবাব দিয়ে বলেছেন, ‘ধর্মবিশ্বাস হচ্ছে বিবেকের বিষয় এবং বিবেক স্বাধীন’। একথা শুনে ইকরামার স্ত্রী তার স্বামীর কাছে গেলেন এবং তাকে মহানবীর কাছে জবরদস্তি ধরে নিয়ে এলেন। একটু আগে স্ত্রীর মুখ থেকে শোনা কথাই নবীজীর কাছ থেকে জানতে পেরে ইকরামা তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়লেন এবং নবীজীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। বললেন, তিনি ইসলামের একজন খাদেম হিসেবে সেবা করতে চান। এই ইকরামাই কিন্তু ইন্তেকালের আগে জেনারেলের পদমর্যাদায় উন্নীত হন। এ ধরনের দৃষ্টান্তই ইসলামের বাস্তবতা। শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় এমন নজিরই পথনির্দেশক হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত।
আমরা যদি আজকের বাংলাদেশের সমাজের তৃণমূল পর্যায়ে, উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব অথবা পশ্চিমের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামীণ জনপদে নজর দিই, তাহলে প্রত্যক্ষ করতে পারি, মদিনা সনদের মুর্ত প্রকাশ। আমরা খুব সহজেই এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা দিতে পারি। কারণ, মুসলমান ও হিন্দু সম্পূর্ণ একতায় পাশাপাশি বসবাস করছেন। খ্রিস্টানদের রয়েছে চার্চ। বৌদ্ধরাও নিশ্চিন্তে অনুসরণ করছে তাদের ধর্মবিশ্বাস। শিশুরা একত্রে খেলছে। সত্য বটে, মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু একটি বহু জাতিগত সমাজ এমনই একটি ‘মেল্টিং পট’, যেখানে বিভিন্নমুখী পার্থক্য, সহিষ্ণুতা ও সম্প্রীতির বড় কড়াইয়ে বিলীন হয়ে যায়।
৩. গ. রাজনীতিতে সহিষ্ণুতা
একটি বহু জাতিগত সমাজে বিভিন্ন ইস্যুতে সর্বদাই মতামতের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যপূর্ণতা লক্ষ্য করা যায়। ইসলামে পরস্পরের মতের প্রতি সহনশীলতার সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এবং একে অপরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন ইস্যুর নিস্পত্তির কথা বলা হয়েছে। গণতন্ত্রের ভিত্তি বর্ণিত হয়েছে ৪২:৩৮ আয়াতে ‘....যাদের কাজকর্মগুলো পারস্পরিক পরামর্শেই সম্পন্ন হয়....।’ হযরত যখন মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেন, তখন এমনকি বন্দী ইস্যুও বিবেচনা করা হলো। কেউ একজন প্রশ্ন রাখতে পারেন, ইসলাম যদি সত্যিই রাজনৈতিক সহিষ্ণুতায় সমর্থন দেয়, তাহলে কেন বন্দীদের কর দিতে হবে? এর জবাব হলো, বন্দীদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা দিতে বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন পড়ে। বন্দীদের কোনো যাকাত দিতে হয় না। অন্যান্য বিষয়েও তাদের অধিকার সমান। যাকাতের পরিবর্তে তারা আর্থিক অনুদান দিয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে এটা উল্লেখযোগ্য যে, অমুসলিম কিন্তু মুসলমানদের হাতেই অধিকতর নিরাপদ; কারন মুসলমানরা অমুসলিমের জীবন ও সম্পত্তি স্পর্শ করতে পারে না। অবশ্যই একটি বহু জাতিগত সমাজ ব্যবস্থায় বিভিন্নমুখী রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতামতের প্রেক্ষাপটে ইসলামের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান অবশ্যই এক মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ।
(রাজনীতি ও সহিষ্ণুতার জন্য ইসলাম সংক্রান্ত ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অধিকতর প্রাসঙ্গিক অথচ ভিন্নতর রেফারেন্স দেওয়া কি সম্ভব?)
৪. ঘ. ঘরোয়া ও সামাজিক জীবনে সহিষ্ণুতা
সহিষ্ণুতা প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তিগত জীবন থেকেই জীবনের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের ৪২:৩৭ আয়াত উল্লেখযোগ্য। যেখানে বলা হয়েছে, ‘যারা বড় বড় গুনাহ ও অশ্লীল কার্যকলাপ থেকে বেঁচে থাকে, যখন রাগান্বিত হয় তখন তারা (অন্যদের ভুল) ক্ষমা করে দেয়।’
সুতরাং আমরা লক্ষ্য করি, ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে ইসলাম বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছে। মজার বিষয় হলো, এমনকি লড়াইয়ের ময়দানেও ব্যক্তিগত ক্ষোভ কোনো যুদ্ধের কারণ হওয়া উচিত নয়। যুদ্ধের জন্য অবশ্যই একটি প্রকৃত কারণ থাকতে হবে। এ প্রসঙ্গে হযরত আলী (রা.)-এর একটি কাহিনী স্মরণযোগ্য। তিনি এক লড়াইয়ের ময়দানে কারো বুকের ওপরে চড়ে বসেন। ভ’পাতিত লোকটি হযরত আলী (রা.)-এর মুখে থুতু ছিটিয়ে দেন। এতে হযরত আলী (রা.) খুবই ক্রোদ্ধ ও অসন্তুষ্ট হলেন। তবে যার বিরুদ্ধে তিনি লড়াইয়ে ছিলেন তিনি হঠাৎ শান্ত হলেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী তাঁকে জিজ্ঞেস করল, কেন তিনি তাকে হত্যা করেননি? আলী উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন, ‘আমি তোমাকে এখন হত্যা করতে পারি না। কারণ এখন আমি তোমার প্রতি ক্রুদ্ধ’। যদি সত্যিই এমন দৃষ্টান্ত ঘরোয়া ও সামাজিক জীবনে অনুসরণ করা হয়, তাহলে সমাজে প্রকৃত শান্তি আসবে। সমাজের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে আলোচনাকালে এবং এমনকি ধর্মকথা বলার মুহুর্তেও এ উপদেশ বহাল থাকে যে, পরস্পরের সঙ্গে তারা যেন বিরোধে জড়িয়ে না পড়েন। কিন্তু ১৬:১২৫ আয়াতে বর্ণিত রয়েছে এক সুবিবেচনাপূর্ণ আহ
বাংলাদেশী জনগণ সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে তাদের সংহতি প্রকাশ করেছে। দেড়শ’ কোটি মুসলমান এক বৈচিত্র্যপূর্ণ সম্প্রদায়। যদিও অল্পসংখ্যক মুসলিম সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে পারে। কিন্তু বড় সত্য হচ্ছে, সামগ্রিকভাবে মুসলমানরা ধার্মিক এবং শান্তিপ্রিয়। আর মুসলমানরা শুধুই মধ্যপ্রাচ্যে নয়, তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিশ্বময়। তাহলে কেন গুটিকয়েক সহিংস মুসলমানের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ শান্তিপ্রিয় মুসলমানরা দুর্ভাগ্যের শিকার হবেন? এসব সন্ত্রাসীর জীবনধারায় আদৌ ইসলামী আদর্শের কোন প্রতিফলন রয়েছে কি না তা বিবেচনায় নিতে হবে। ইসলামের অনুসারী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপনের মাধ্যমেই ধর্ম অনুশীলন করেন। তাদের জীবনধারায় চরমপন্থার কোন ঠাঁই নেই। সে কারণেই বিশ্বের সব অঞ্চল ও সব ধরনের মানুষের সহযোগিতায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ধারনাটি সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। এটা স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা প্রয়োজন, ইসলামসহ বিশ্বের কোন ধর্মই কিন্তু কোন ধরনের সমস্যার সমাধানে হিংসার পথ বেছে নেয়ার ব্যাপারে ছাড়পত্র দেয়নি। ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ এবং হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর বাণীতে বহুস্থানে সহিংসতার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে। এমনি অন্য ধর্মের অনুসারীদের বিরুদ্ধে অবজ্ঞাসুচক কোন শব্দ উচ্চারণও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মোটকথা, সহিংস পন্থা অবলম্বনের পক্ষে যুক্তি দানের কোন সুযোগ ইসলামে নেই। আমাদের যে কোন অহিংস পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে সন্ত্রাস প্রতিহত করতে হবে। বর্তমানে বৈশ্বিক সমস্যা মানবজাতিকে দু’টি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
প্রথমত. বিশ্বশান্তির জন্য বিঘœসৃষ্টিকারী ইস্যু চিহিতকরণ এবং তা সমাধানের সুষ্ঠু উপায় উদ্ভাবন।
দ্বিতীয়ত. সব কাজ ও কথার মাধ্যমে এটা স্পষ্ট করা যে, লক্ষ্য অর্জনের জন্যে ধর্ম কখনো সহিংসতার সমর্থন দেয় না।
২-ক. প্রথম চ্যালেঞ্জ
যদিও প্রথম চ্যালেঞ্জ সর্বজনীন এবং তা মোকাবিলায় বিশ্বের দায়িত্বশীল নাগরিকদের রুখে দাঁড়াতে হবে। বিশ্বের পরাক্রমশালী জাতিগুলোর কাছে রয়েছে বৃহত্তর সম্পদ ও ক্ষমতা। এটা কাজে লাগিয়ে তারা বকেয়া রাজনৈতিক সংঘাত সমাধান করতে পারেন। মনে রাখতে হবে, সমস্যা জিইয়ে রাখা হলে সন্ত্রাসীরা কিছু মহলের সহানুভ’তি আদায় করার সুযোগ নিতে পারে। যদিও এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি ধর্মের কোন সমর্থন নেই। সব ধরনের প্রভাব ও ক্ষমতা খাটিয়ে সংঘাতের অবসানের জন্য রাষ্ট্র, এনজিও, বহুজাতিক কোম্পানী এবং ব্যক্তির দায়িত্ব রয়েছে। মুসলিম জনসংখ্যার দৃশ্যত জঙ্গি মনোভাব বোঝাতে প্রায়শ একটি কথা ব্যবহার করা হয়। আর তা হল ‘মৌলবাদ’। বিপুলসংখ্যক ধার্মিক মুসলিমদের উপহাস করতে এ কথাটি প্রয়োগের প্রচলন রয়েছে। অথচ এ ধার্মিক মুসলিমরা ধর্মকে বিভক্তির চেয়ে মানবজাতির ঐক্যের হাতিয়ার হিসেবে পণ্য করে থাকেন। তারা বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করেন, তাদের নির্দয়ভাবে ‘মৌলবাদী’ আখ্যা দেয়া হয়ে থাকে। সন্ত্রাসীরা কখনো মৌলবাদী হতে পারে না। কারণ আঁকড়ে ধরার জন্য তাদের কোন মৌলিক মূল্যবোধ নেই। অন্যদিকে দেড়শ’ কোটি মুসলমানের উল্লেখযোগ্য অংশই ধার্মিক। কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে তারা উপার্জন করে থাকেন এবং এই পৃথিবীতে প্রাপ্তির জন্য মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে কৃতজ্ঞ থাকেন। আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাতে তারা কখনো বিস্মৃত হন না। দৃষ্টান্তস্বরূপ, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ খোদাভীরু এবং কোন অন্যায় কাজে লিপ্ত হওয়ার আগে তারা দু’বার ভাবেন। বিশ্বের অন্যান্য অংশের ধার্মিক মুসলমানদের সঙ্গে এ মুসলমানরা নিশ্চিতভাবেই মৌলিক ধর্মীয় মূল্যবোধ আঁকড়ে থাকেন। এবং যেমনটা প্রজন্মের পর প্রজন্ম তারা তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে রপ্ত করেছেন। এই ধার্মিক জনগোষ্ঠী প্রকৃত মৌলবাদী বটে; কিন্তু তারা সন্ত্রাসী নয়। তাদের ধর্মানুরাগ তাদের জীবন ব্যবস্থায় এবং বিশ্বাসে প্রতিনিয়ত প্রতিফলিত। বাংলাদেশ সফরকারী পশ্চিমা সাংবাদিকরা লক্ষ্য করেছেন যে, বন্যা ও সাইক্লোনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ সাধারণ মানুষ দুর্যোগের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে কী অদম্য সাহসে ভর করে থাকেন। নিজেদের পায়ে পুনরায় দাঁড়াতে তারা কখনোই হাল ছেড়ে দেন না। নব-উদ্যমে আবার তারা নেমে পড়েন জীবন সংগ্রামে। জনগণের এই জীবন ব্যবস্থার এভাবে বদলে যাওয়ার নেপথ্যে থাকে অঙ্গীকার, চারিত্রিক দৃঢ়তা, সৃষ্টিকর্তার প্রতি অবিচল আস্থা এবং মূল্যবোধের প্রতি বিশ্বাস।
পাশ্চাত্যের নাগরিক এবং আমাদের বুঝতে হবে ইসলাম শান্তি ও প্রগতির প্রবক্তা। মুসলিম বিশ্বের উল্লেখযোগ্য অংশ আজ কেন শিক্ষা-দীক্ষা ও সমৃদ্ধিতে অনগ্রসর, তা বিবেচনায় নিতে হবে এবং এই সত্য মুছে ফেলা উচিত নয়, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত গবেষণা আধুনিক বিশ্বের বস্তুগত অগ্রগতি নিশ্চিত করেছে, তাকে কিন্তু কোরআন ও হাদীস দারুণভাবে উৎসাহিত করেছে। পবিত্র কোরআনে প্রায় ৭৫০টি আয়াত রয়েছে, যা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে আমাদের চারপাশের জগতের বৈজ্ঞানিক সত্যকে তুলে ধরেছে। আল-কোরআনের ১০:১০১ আয়াতে হযরত মুহাম্মদকে (স.) বলা হয়েছে, ‘(হে নবী) তুমি বল, তোমরা দেখ, আসমানসমূহ ও জমিনের কি কি জিনিস রয়েছে।’ এই আয়াতের মাধ্যমে কার্যত বিজ্ঞানের সত্য অন্বেষণের সব এজেন্ডা প্রতিফলিত হয়েছে এবং এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, এই আয়াত দ্বারা উৎসাহিত হয়েই আদিপর্বের মুসলমানরা বিজ্ঞান, কলা ও সংস্কৃতিতে অগ্রসর হয়ে সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় এক নতুন সভ্যতার। গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, প্রযুক্তি এবং আরো নানা বিষয়ে তারা বিরাট অগ্রগতি নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়। এ প্রসঙ্গে আমি ‘ইসলাম ঃ বিশ্বাসের ঐতিহ্য’ শীর্ষক একটি প্রামান্যচিত্রের কথা উল্লেখ না করে পারছি না। ৯/১১-এর দুর্ঘটনার পর নির্মিত এ চিত্রটির মাধ্যমে হার্ভার্ডের কয়েকজনসহ পশ্চিমা প-িতরা দেখিয়েছেন, যখন পাশ্চাত্যের প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যাপ্ত গ্রন্থাগার ছিল না, তখন মুসলমানদের বাড়ীতেও ছিল সমৃদ্ধ পাঠাগার। এটা সত্যি বড় দুঃখজনক, যে মুসলমানরা আধুনিক যুগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপন করেছেন, তারাই আজ জ্ঞানের দিক থেকে পিছিয়ে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কিন্তু জ্ঞান-বিভক্তি এবং এর পরিণামস্বরূপ সমৃদ্ধি-বিভক্তি ব্যতিরেখেই সহাবস্থানে সক্ষম। পাশ্চাত্যের নেতারা মুসলমানদের সঙ্গে তাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান ভাগাভাগি করতে পারেন এবং বঞ্চনার পরিবর্তে তাদের দিতে পারেন সহযোগিতা ও ন্যায়পরায়ণতার বোধ। এ ধরনের সহযোগিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হলেই পাশ্চাত্যের সঙ্গে ইসলামের চমৎকার নৈকট্য গড়ে উঠতে পারে। আর সেক্ষেত্রে সন্ত্রাসী নির্মূলে বহুদূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। সন্ত্রাসীরা তখন আর দারিদ্র্য এবং অধিকার হরণের শিকার হওয়া জনগণের কাছ থেকে কোন সমর্থন পাবে না। আর সে কারণেই মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বা সহ¯্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আলোকে উন্নয়নের একটি রোডম্যাপ তৈরী সময়ের দাবী।
পাশ্চাত্যের বহু দেশ উল্লেখ করেছে, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে, ইসলামের বিরুদ্ধে নয়। ইসলামী বিশ্বকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সব সংঘাতের অবসানে এগিয়ে আসতে হবে এবং তাকে কথা ও কাজের মাধ্যমে তার সত্যিকারের প্রমাণও রাখতে হবে।
২-খ. ন্যায়পরায়ণতা এবং শান্তির পথে বাধা হিসেবে দ্বৈতনীতি পরিহার। যদি পরিবার থেকে শুরু করে সামাজিক, জাতীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক স্তরে শান্তি অর্জন করতে হয়, মানবজাতির সর্বস্তরের বিরোধ নিষ্পত্তিতে ন্যায়পরায়ণতা ও ন্যায্যতার নীতি অনুসরণ নিশ্চিত করা। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের রাজনৈতিক পর্যায়ে আমরা যে দ্বৈতনীতি দেখতে পাই, তা যে কোন মূল্যে পরিহার করতে হবে। কারণ দ্বৈতনীতির অনুসরণে নিরীহ লোকদের অনুভূতি আহত হতে পারে। এটা লক্ষ্যণীয় যে, পবিত্র কোরআন ও হাদিসে ন্যায়পরায়ণতা ও বিধি অনুসরণে বারবার গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ( যেমন আয়াত ৫ৎ৪৫, ৪৯:৯, ৬০:৮ যেখানে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন, যারা বিচারের ক্ষেত্রে বজায় রাখেন ন্যায়পরায়ণতা)।’ আবার ক্ষল্য করুন, ১১:৮৫ আয়াত। ‘হে আমার জাতি, তোমরা মাপ ও ওজনের কাজকে ইনসাফের সঙ্গে আঞ্জাম দেবে, মানুষকে কখনো তাদের প্রাপ্য বস্তু কম দেবে না, মাপের তারতম্য করে, জমিনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করো না।’
৩. দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ
ইসলামের অনুসারীদের জন্য দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটি আরো বেশী প্রাসঙ্গিক। এর সহজ কারণ হলো, শান্তির পথে বিঘœ সৃষ্টিকারী হিসেবে আজ মুসলমানরাই বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমের শিরোনামে পরিণত হয়েছে। সুতরাং ইসলামের প্রত্যেক অনুসারীর ইহজাগতিক কর্তব্য হচ্ছে, এই ধারণা স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ করে দেয়া যে, ইসলাম ধর্ম এই ধরিত্রীর বুকে সত্যিই বইয়ে দিতে চায় এক সুশীতল ঝরনা ধারার প্র¯্রবণ। এটা কিভাবে বাস্তবে রূপদান করা সম্ভব, সেদিকে আলোকপাত করাই এই নিবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য। সত্যি বলতে কি, বিশ্বের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ ইসলামের সত্যিকারের আদর্শ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে তুলে ধরার জন্য এক অপূর্ব সুযোগ এনে দিয়েছে। এটা কাজে লাগিয়ে মুসলমানদের উচিত হবে একটি বহু জাতিগতভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় ইসলাম কি করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ঝা-া উর্ধ্বে তুলে ধরতে সক্ষম, বিশ্ববাসীল মনোযোগ সেদিকে আকর্ষণ করা। ইসলামের এ অবস্থান যদি বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা তাদের ব্যক্তিগত সদাচরণ এবং অমুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়, তাহলে ইসলামের বড় উপকার হবে। সেক্ষেত্রে কারো পক্ষেই এটা আর বিশ্বাস করার কোন যুক্তি থাকবে না, যে কোন পরিস্থিতিতে শান্তি বিঘিœত করার প্রতি ইসলামের কোনো অনুমোদন রয়েছে। কিন্তু কিভাবে আমরা ইসলামের এই সৌম্যরূপকে জগৎ সভায় বিকশিত করতে পারি? এই প্রশ্নের জবাব পেতে হলে আমাদের নিজেদের প্রতি এই প্রশ্ন রাখতে হবে যে, শান্তি সুরক্ষায় পবিত্র কোরআনে যেভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান কি তা উপলব্দি করতে পেরেছেন? সম্ভবত এর জবাব কিন্তু নেতিবাচকই হবে। ইসলাম ধর্মের অনুসরণকে সাধারণত অযৌক্তিকভাবে কতিপয় আচার-অনুষ্ঠান অনুসরণের সঙ্গে তুলনা করা হয়। আচার-অনুষ্ঠান নিশ্চয় খুব গুরুত্বপূর্ণ যা মানুষকে ভ্রান্ত চিন্তা ও কর্ম থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে ভ’মিকা রাখে। কিন্তু সমানভাবে, অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ না হলেও পবিত্র কোরআন ও হাদিসের সারবত্তা সম্পর্কে মুসলমানদের সম্যক উপলব্দি থাকতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত, মুসলমানরা এ সারবত্তা উপেক্ষা করে শুধু ধর্মের বাহ্যিক দিকটিই অনুসরণ করে। সুতরাং শান্তি এবং সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কিত কোরআনের শিক্ষাকে অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সর্বাগ্রে মুসলমানদের নিজেদেরই তা রপ্ত করতে হবে। সুতরাং ইসলামী প-িতদের বিরাট দায়িত্ব রয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমের, (সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট ইত্যাদি) মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ অপনোদনে যথোপযুক্ত প্রচার চালানো। বিশ্বশান্তির কথা বলতে গেলে, কোরআনে বর্ণিত শান্তির বিভিন্ন পর্যায় সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা জরুরী।
এতে ব্যক্তির নিজের যেমন, তেমনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শান্তি, সমাজের সদস্যদের সঙ্গে শান্তি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে শান্তি এবং অবশিষ্ট বিশ্বের সঙ্গে শান্তির ধারণা অন্তভর্’ক্ত এবং সাধারণভাবে মানবজাতিকে এমন কিছুতে অংশ না নিতে বলা হয়েছে, যা ‘ফিতনা ও ফ্যাসাদ’ সৃষ্টি এবং বিশ্বের সামগ্রিক শান্তি ও সংহতিকে বিনষ্ট করে। পবিত্র কোরআনে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালাকে স্বরণের মধ্য দিয়ে আতœার শান্তি গঠিত। যদিও কথাটির প্রকৃতি দর্শনগত মনে হতে পারে। কিন্তু এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জীবনযাপনের জন্যে দর্শনের প্রয়োজন রয়েছে এবং বিশেষ করে এমনটা তো দরকারই, যা নিশ্চিত করে শান্তি। আমরা যদি শান্তিপূর্ণ জাতিসমূহের একটি বিশ্ব সম্প্রদায় অর্জনের কথা বলি, তাহলে অধিকতর নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, এটা উপলব্দিতে নিতে হবে যে, একটি বহু জাতিগত সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা প্রধানত নির্ভর করছে সহিষ্ণুতার ওপর। এবঙ এই সহিষ্ণুতাই কিন্তু ইসলামের অন্যতম শক্তিশালী স্তম্ভ। সুতরাং সহিষ্ণুতা কথাটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দারুণভাবে অপরিহার্য্য।
৩. ইসলামের সহিষ্ণুতা
ইসলামের সহিষ্ণুতার গুরুত্ব উপলব্দির জন্যে কেউ একজন নি¤েœাক্ত বিষয়গুলোকে ব্যাপকভিত্তিক ক্ষেত্র হিসেবে চিহিত করতে পারেন ঃ
৩. ক. ধারণাসমূহের সহিষ্ণুতা;
৩. খ. অন্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা;
৩. গ. রাজনীতিতে সহিষ্ণুতা;
৩. ঘ. ঘরোয়া ও সামাজিক জীবনে সহিষ্ণুতা
এখন আমরা পর্যায়ক্রমে এসব বিষয়ের ওপর আলোকপাত করব।
৩. ক. ধারণাসমূহের সহিষ্ণুতা
বিজ্ঞান আজ যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, তা হয়তো সম্ভব হতো না, যদি না বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলোর মধ্যে সহিষ্ণুতার ঘাটতি থাকত। ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে যে, বহু ক্ষেত্রে এ সহিষ্ণুতা না দেখা গেলেও ইসলামের অনুসারীরা কিন্তু নতুন বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলো গ্রহণে কখনো দ্বিধান্বিত থাকেননি। বৈজ্ঞানিক মতবাদ প্রচার করতে গিয়ে গ্যালিলিওর ক্ষেত্রে আমরা যে ধর্ম বিচার-সভা প্রত্যক্ষ করেছি, তেমনি নজির কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে নেই। গ্যালিলিও কিন্তু যথাযথই দিকনির্দেশ করেন যে, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। অথচ গ্যালিলিওকে এই ধারণা প্রচারের জন্য কি খেসারতটাই না দিতে হয়েছে। সমগ্র মানবজাতির জন্যে এটা ছিল এক লজ্জার। যেদিন গ্যালিলিওকে চার্চের সামনে নতজানু হয়ে এ মর্মে অনুশোচনা করতে হয়েছিল যে, তিনি যা বলেছেন তা ঠিক নয়। কিন্তু মানবজাতি আজো জানেন, গ্যালিলিওই ছিলেন সঠিক।
মুসলমানদের ক্ষেত্রে সহিষ্ণুতার ভিত্তি হচ্ছে কোরআনের আয়াত; যেখানে তাদের প্রকৃতি নিয়ে ভাবতে বলা হয়েছে। সমগ্র বিজ্ঞান কিন্তু জিজ্ঞাসার ওপর প্রতিষ্ঠিত। এবং এটা হলো সেই জিজ্ঞাসা, যা পবিত্র কোরআনে বারবার উৎসাহিত করেছে। ১০:১০১ আয়াতে ঘোষণা হচ্ছে, ‘.....পর্যবেক্ষণ কর সব কিছুই, স্বর্গ ও পৃথিবীর মধ্যে যা কিছু অবস্থিত।’ এই যে এখানে বেহেশত ও পৃথিবীর মধ্যকার সবকিছুই। পর্যবেক্ষণ করতে বলা হলো, তার মূল সুর কিন্তু বিজ্ঞানের মাধ্যমে সত্যের অন্বেষায় নিহিত। এতে তাই বিস্ময়ের কিছু নেই যে, পবিত্র কোরআনে এবং বিজ্ঞান যে বিন্দুতে এসে মিলিত হয়েছে তা হচ্ছে সত্য। এই সত্য পরিব্যাপ্ত রয়েছ, ক্ষুদ্রের মধ্যে ক্ষুদ্রতম থেকে বৃহত্তের মধ্যে বৃহত্তমে। এবং এটাই বৈজ্ঞানিক জিজ্ঞাসা ও গবেষণা, যার মাধ্যমে মানুষ সত্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে পারে, আর সে সত্য কিন্তু প্রতিফলিত প্রকৃতির আইনে। এও সত্য যে, আজ আমরা যাকে বিজ্ঞান বলে জানি, তা আসলে মানবজাতির অংশীদারিত্বভিত্তিক ঐতিহ্যবাহী সম্পদ। এটা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে বিশ্বের বহু ভুখ-ের, সংস্কৃতির ও ধর্মের অনুসারী নারী-পুরুষের বিরামহীন প্রচেষ্টার ফলে। আসলে বিজ্ঞানই হচ্ছে মানবজাতির একমাত্র অভিন্ন সম্পদ। এ সম্পদ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ইসলামের শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু অবিস্মরণীয়। এ প্রসঙ্গে খলিফা আল মনসুরের ভূমিকা প্রণিধানযোগ্য। রাজধানী হিসেবে বাগদাদের প্রতিষ্ঠালগ্নকে স্মরণীয় রাখতে তিনি আহবান করেন এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন। বাগদাদ পরবর্তী সময়ে মানব সভ্যতার অন্যতম মহান কেন্দ্রের মর্যাদা লাভ করে। ওই সম্মেলনের প্রতিপাদ্য ছিল পৃথিবীর পরিধির মাপ নির্ধারণ করা। এটা কিন্তু এমন ছিল না যে, ওই সময়ে পৃথিবীর পরিধি সম্পর্কে মানুষের কোনো ধারণাই ছিল না। কিন্তু আল মনসুর নিখুঁত মাপ নিরূপণে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তারই প্রচেষ্টায় ওই সময়ের বিশ্বে যেখানে যত নামজাদা প-িত ছিলেন, তাদের সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ভারতের কঙ্কা ছিলেন তাদের অন্যতম। সেই সম্মেলন থেকেই কিন্তু বায়তুল হিকমাত বা জ্ঞানের আবাস সৃষ্টির ধারণা উত্থিত হয়। মজার বিষয় হচ্ছে, পৃথিবীর পরিধির প্রকৃত মাপের চেয়ে সেই সময়ের নিরূপিত মাপের মধ্যে ব্যবধান ছিল শুধুই ১০ শতাংশের। খলিফা মনসুরের এই যে মাপ সম্পর্কে যথার্থতা নিরুপণের প্রয়াস, তাকে কিন্তু এক চমৎকার দৃষ্টান্ত হিসেবেই দেখতে হবে। আর দৃষ্টান্ত হচ্ছে বহু সংস্কৃতি থেকে আসা প-িতদের সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে বৈজ্ঞানিক উৎকর্ষ অর্জন। এটা একই সঙ্গে সত্যের অনসন্ধানে জ্ঞানের অংশীদারিত্বের প্রয়োজনীয়তারও এক প্রতীকী নির্দেশক। সুতরাং মুসলিম বিজ্ঞানী ও শাসকরা এভাবেই জ্ঞানের প্রাসাদ নির্মাণে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছেন। এর মূল ভিত্তি হচ্ছে বহু লোকের বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলোকে ধারণ করার সহিষ্ণুতায় স্বীকৃতি। এসব সত্য ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং আজ তা অমুসলিমদের পাশাপাশি তরুণ মুসলিম প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে। তরুণ প্রজন্ম দুর্ভাগ্যবশত তাদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে উদগ্রীব নয়।
বিজ্ঞান হচ্ছে একমাত্র ক্ষেত্র যেখানে ইসলাম প্রমাণ করতে পারে যে, তার ধর্ম আধুনিক এবং প্রগতিশীল। সামাজিক খাতের দিকে তাকান। ইসলাম তার উত্থানের গোড়া থেকেই সামাজি ন্যায়পরায়ণতা সম্পর্কে শিক্ষা দিয়েছে। নারী ও পুরুষের অধিকার সমুন্নত রেখেছে। আজ আমরা মেয়ে শিশুর অধিকার নিয়ে কথা বলছি; কিন্তু ইসলাম মেয়ে শিশুকে জীবন্ত কবর দেয়ার মতো অভিশপ্ত প্রথার বিলোপ ঘটিয়েছে। কঠোর হস্তে। খ্রিস্টান বিশ্বের যেমন রয়েছে জোয়ান অব আর্ক, তেমনি মুসলমানদের রয়েছে দুঃসাহসী রাজিয়া সুলতানা।
ব্যাংকিংয়ের দিকে একটু নজর দেয়া যাক। বিশ্বের বহু দেশে ইসলামী ব্যাংকিং বিস্তৃত রয়েছে। এর মধ্যে বিশ্বের সম্পদশালী দেশও রয়েছে। কিন্তু এই ব্যাংকিং উন্নত ব্যবসা পরিবেশের প্রতি হুমকি হিসেবে গণ্য হয়নি। পবিত্র কোরআন রিবা বা সুদ হারাম করেছে। অথচ এর ফলে ব্যাংকিং ও ব্যবসা কিন্তু পঙ্গু হতে বসেনি। বিপরীতক্রমে বরং বলা চলে গলাকাটা সুদের লেনদেন অথবা এক ধরনের প্রতারণানির্ভর লেনদেনের বিরুদ্ধে এটা এক রক্ষাকবচ। ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা ব্যাংক ও গ্রাহকদের মধ্যে এক সুষ্ঠু যৌথ ব্যবসায় উদ্যোগ। অর্থনীতি, সামাজিক উন্নয়ন, বিজ্ঞান প্রযুক্তি, ইতিহাস-এ রকম সবক্ষেত্রেই অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে, ইসলাম যেখানে নতুন ধারণা, নীতি ও পদ্ধতি উদ্ভাবনে অগ্রণী ভ’মিকা রেখছে। আজকের বিশ্ব সমাজ যদি এই সম্পর্কে অবহিত না হয়, তাহলে তা আমাদের গলদ। মুসলিম হিসেবে আমাদের অবশ্যই আমাদের ধর্মের সত্যিকারের সুমহান রূপ উন্মোচিত করতে হবে। এ ধর্ম যে আদৌ অন্ধকার যুগের মতবাদ নয়, এ যে এক প্রগতিশীল আধুনিক বিশ্বাস তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
৩. খ. অন্যান্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা
অন্যান্য ধর্মের প্রদি ইসলামের যে সহিষ্ণুতা, তার মূল ভিত্তিও কিন্তু পবিত্র কোরআন। অথচ অনেকেই একটা উল্টো ধারণা পোষণ করেন যে, ইসলামের প্রসার ঘটেছে শক্তি প্রয়োগে। পবিত্র কোরআন সুনির্দিষ্টভাবে ঘোষণা করেছে, ‘আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে কোনো জোর জবরদস্তি নেই। কারণ সত্য এখানে মিথ্যা থেকে দিবালোকের মতই স্পষ্ট। (২ঃ২৫৬)। ৬:১০৭ আয়াতেও এটা বলা হয়েছে ঃ ‘আমি তোমাকে তাদের ওপর পাহারাদার নিযুক্ত করে পাঠাইনি। তুমি তো তাদের ওপর কোনো অভিভাবক নও’। ৮৮:২১-২৬ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমাকে তো এদের ওপর বলপ্রয়োগকারী করে পাঠানো হয়নি’। আবার ১০:৯৯ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে নবী, তোমার মালিক চাইলে এ জমিনে যত মানুষ আছে, তারা সবাই ঈমান আনত (কিন্তু তিনি তা চাননি, তাছাড়) তুমি কি জোড়-জবরদস্তি করে চাইবে যে, তারা সবাই মোমিন হয়ে যাক। ইসলামে সহিষ্ণুতা এবং সহাবস্থান সম্পর্কে সর্বোচ্চ আরজি জানানো মূর্ত হয়েছে ১৮:১৯ আয়াতে। সুতরাং যার ইচ্ছা সে ঈমান আনুক, আর যার ইচ্ছা সে অস্বীকার করুক’।
ইসলাম ধর্ম তার অনুসারীদের অন্য ধর্মের দেব-দেবীদের অসম্মান করাকে নিষিদ্ধ করেছে। পবিত্র কোরআন ৬:১০৮ আয়াতে ঘোষণা দিচ্ছে, ‘তারা আল্লাহ তায়ালার বদলে যাদের ডাকে, তাদের তোমরা কখনো গালিগালাজ করো না, নইলে বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে, না জেনে আল্লাহ তায়ালাকেও তারা গালি দেবে। আমি প্রত্যেক জাতির কাছে তাদের নিজ কার্যকলাপকে সুশোভন করে রেখেছি। অতঃপর সবাইকে তাদের মালিকের কাছ ফিরে যেতে হবে। অতপর তিনি তাদের বলে দেবেন, তারা দুনিয়ার জীবনে কী করে এসেছে’। অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের সঙ্গে সহাবস্থানের তাগিদ দিয়ে একজন মুসলমানকে পবিত্র কোরআন কর্তব্যও নির্ধারণ করে দিয়েছে। পবিত্র কোরআনের ভাষায়, লাকুম দ্বীনুকুম ওয়ালিইয়া দ্বীন। এর অর্থ হচ্ছে ‘তোমাদের পথ তোমাদের জন্য আমার পথ আমার জন্য’।
যদি তরুণ প্রজন্ম শান্তিকামী হিসেবে আদর্শস্থানীয় কয়েকজনকে অনুসরণ করে, তাহলে তা শান্তি অর্জনের পথ কুসুমাস্তীর্ণ করতে পারে। এ প্রসঙ্গে জর্জ বার্নার্ডশ’য়ের একটি উক্তি উল্লেখযোগ্য ঃ ‘আমি সর্বদাই মুহাম্মদের ধর্মের প্রতি উঁচু শ্রদ্ধা পোষণ করি। কারণ এ ধর্মের রয়েছে এক আশ্চর্য জীবনীশক্তি। এটাই একমাত্র ধর্ম, যা পরিবর্তনশীল বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে হওয়ার ক্ষমতা রাখে বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। এ ধর্ম প্রত্যেক যুগেই প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখার দাবীদার। আমি তাকে আতœস্থ করেছি এবং বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, তিনি খ্রিস্টবিরোধী দলের কেউ নন। বরং তাকে অবশ্যই বলা উচিত মানবতার রক্ষাকর্তা। আমি বিশ্বাস করি, তার মতো একজন ব্যক্তি যদি আধুনিক বিশ্বের স্বৈরশাসক হতেন, তাহলে তিনি এমন উপায়ে সমস্যার সমাধান করতেন, যার ফলে বহু প্রত্যাশিত শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত হতো। আমি মুহাম্মদের বিশ্বাস সম্পর্কে এই ভবিষ্যদ্বাণী করছি যে, এটা আগামী দিনের ইউরোপের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে; আজকের ইউরোপে যেমন এটা কিন্তু পেতে শুরু করেছে।’
ইসলামে সহিষ্ণুতার দৃষ্টান্ত হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছ থেকে সবচেয়ে ভালোভাবে আহরণ করা সম্ভব। সত্য প্রচার করতে গিয়ে তিনি বহুবার বহু উপায়ে পদ্ধতিগত নিগ্রহ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কিন্তু তাই বলে কখনো যুদ্ধ ঘোষণা করেননি। বরং তিনি তার প্রিয় আবাসভ’মি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেছেন। ইসলামে প্রথম হামলা বা ফাষ্ট এটাকের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, ইসলামে আতœরক্ষার অধিকার দেওয়া হয়নি। অন্যায়ভাবে আক্রান্ত হলে যে কেউ সর্বদাই তা রুখে দাঁড়াতে পারেন। পবিত্র কোরআনের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেই লড়াই চালাতে পারেন। এসব কিছুই একটি বিষয় নিশ্চিত করছে যে, ইসলামে সহিংসতার কোনো সুযোগ নেই। পবিত্র কোরআনের ৫:৩২ আয়াতেও আমরা তার সুস্পষ্ট উল্লেখ দেখতে পাই। ‘....কোনো মানুষকে হত্যা করার কিংবা পৃথিবীতে ধ্বংসাতœক কাজ করার শান্তির বিধান ছাড়া অন্য কোনো কারণে কেউ যদি কাউকে হত্যা করে , সে যেন গোটা মানবজাতিকে হত্যা করল। আবার এমনিভাবে যদি একজনের প্রাণ রক্ষা করে, সে যেন গোটা মানবজাতিকেই বাঁচিয়ে দিল। এদের কাছে আমার রাসূলরা সুস্পষ্ট আইন নিয়ে এসেছিলেন, তারপরও এদের অনেকেই এ জমিনের বুকে সীমা লঙ্ঘনকারী হিসেবে থেকে গেল।’ শান্তির অন্বেষণ তাই আমাদের লক্ষ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়া উচিত। আর এই লক্ষ্য হচ্ছে উল্লিখিত আয়াত এবং ৮:৬১ আয়াতে বর্ণিত সর্বজনীন আদর্শ প্রতিষ্ঠা। ৮:৬১ এর ঘোষণা হচ্ছে-‘তারা যদি সন্ধির প্রতি আগ্রহ দেখায়, তাহলে তুমিও সন্ধির দিকে ঝুঁকে যাবে’। সপ্তদশ শতাব্দীর মরমি কবি জন ডান তার লেখনীর মাধ্যমে একই প্রতিধ্বনি তুলেছেন ঃ ‘কোনো মানুষই তার নিজের জন্যে কোনো একটি দ্বীনের সমগ্র দাবী করতে পারে না; প্রত্যেক মানুষ মহাদেশের একটি অংশমাত্র, মূলের একটি খ-; কোনো মাটির ঢেলা, কোনো উদগ্রভ’মি কিংবা কারো জমিদারী সমুদ্রে বিলীন হয়ে গেলে তা কিন্তু মহাদেশ হিসেবে ইউরোপের ক্ষতি। যে কারো মৃত্যু আমাকে ক্ষয় করে। কারণ মানবজাতির সঙ্গে আমার অস্তিত্ব অবিচ্ছেদ্য। আর সে কারণেই কারো মৃত্যুতে যখন বাজতে থাকে গির্জার ঘণ্টা, তখন যেন তোমরা জিজ্ঞেস করো না, এটা কার মৃত্যুতে, এটা তো তোমারই জন্যে।’ এটা দুঃখজনক যে, ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্ররা এই উক্তি সযতেœ স্মরণ রাখে। কিন্তু অভিন্ন বার্তাবাহী কোরআনের উল্লিখিত আয়াতের দিকে তাদের নজর পড়ে না।
সহিষ্ণুতার অনুশীলন এবং শান্তি অর্জনের কতা পুনরায় উল্লেখ করতে হলে আমাদের অবশ্যই পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান মদিনা সনদের কথা স্মরণে রাখতে হবে। পবিত্র নবী বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রয়োজনীয়তার নিরিখেই মদিনা সনদ প্রণয়ন করেন। সুতরাং এত কোনো বিস্ময়ের কিছু নেই যে, মদিনা সনদের একটি বিধান অত্যন্ত প্রজ্ঞার সঙ্গে এই মর্মে সংযোজিত হয় যে, সব ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে নিজেদের ধর্ম-কর্ম পালন করতে পারবেন। এবং কাউকে কোনো ধর্মে হস্তক্ষেপ করার অজুহাত বরদাশত করা হবে না। একটি বহু জাতিগত সমাজ ব্যবস্থায় আমরা যখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্যে লড়াই করছি বিশ্বময়, তখন আমরা লক্ষ্য করব, এই উদ্দেশ্য অর্জনে মদিনা সনদে বর্ণিত বিধানের মতো এমন অনন্য রক্ষাকবচ আর নেই। আমাদের নবীজী তাঁর জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে পুনঃ পুনঃ দেখিয়েছেন যে, সহিষ্ণুতা এবং ক্ষমা জনগণের হৃদয় জয় করার জন্যে মোক্ষম অস্ত্র। একটি দৃষ্টান্তে বিষয়টি খুবই স্পষ্ট হবে। মক্কার যকন পতন ঘটে তখন আবু জাহেল, যিনি ইসলামের ঘোরতর বিরোধী হিসেবে চিহিত, তার ছেলে ইকরামা আবিসিনিয়ায় পালিয়ে যেতে মনস্থির করলেন। কারণ, তার আশঙ্কা ছিল, মুসলমানরা তাকে ধরতে পারলে হত্যা করবে। এমন পটভ’মিতে ইকরামার কন্যা নবীজীর কাছে এসে জানতে চাইলেন, ইকরামা মক্কায় থেকে যেতে এবং তার নিজের ধর্মবিশ্বাস পালন করে যেতে পারবে কিনা? এহনবী ইতিবাচক জবাব দিয়ে বলেছেন, ‘ধর্মবিশ্বাস হচ্ছে বিবেকের বিষয় এবং বিবেক স্বাধীন’। একথা শুনে ইকরামার স্ত্রী তার স্বামীর কাছে গেলেন এবং তাকে মহানবীর কাছে জবরদস্তি ধরে নিয়ে এলেন। একটু আগে স্ত্রীর মুখ থেকে শোনা কথাই নবীজীর কাছ থেকে জানতে পেরে ইকরামা তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়লেন এবং নবীজীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। বললেন, তিনি ইসলামের একজন খাদেম হিসেবে সেবা করতে চান। এই ইকরামাই কিন্তু ইন্তেকালের আগে জেনারেলের পদমর্যাদায় উন্নীত হন। এ ধরনের দৃষ্টান্তই ইসলামের বাস্তবতা। শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় এমন নজিরই পথনির্দেশক হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত।
আমরা যদি আজকের বাংলাদেশের সমাজের তৃণমূল পর্যায়ে, উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব অথবা পশ্চিমের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামীণ জনপদে নজর দিই, তাহলে প্রত্যক্ষ করতে পারি, মদিনা সনদের মুর্ত প্রকাশ। আমরা খুব সহজেই এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা দিতে পারি। কারণ, মুসলমান ও হিন্দু সম্পূর্ণ একতায় পাশাপাশি বসবাস করছেন। খ্রিস্টানদের রয়েছে চার্চ। বৌদ্ধরাও নিশ্চিন্তে অনুসরণ করছে তাদের ধর্মবিশ্বাস। শিশুরা একত্রে খেলছে। সত্য বটে, মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু একটি বহু জাতিগত সমাজ এমনই একটি ‘মেল্টিং পট’, যেখানে বিভিন্নমুখী পার্থক্য, সহিষ্ণুতা ও সম্প্রীতির বড় কড়াইয়ে বিলীন হয়ে যায়।
৩. গ. রাজনীতিতে সহিষ্ণুতা
একটি বহু জাতিগত সমাজে বিভিন্ন ইস্যুতে সর্বদাই মতামতের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যপূর্ণতা লক্ষ্য করা যায়। ইসলামে পরস্পরের মতের প্রতি সহনশীলতার সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এবং একে অপরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন ইস্যুর নিস্পত্তির কথা বলা হয়েছে। গণতন্ত্রের ভিত্তি বর্ণিত হয়েছে ৪২:৩৮ আয়াতে ‘....যাদের কাজকর্মগুলো পারস্পরিক পরামর্শেই সম্পন্ন হয়....।’ হযরত যখন মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেন, তখন এমনকি বন্দী ইস্যুও বিবেচনা করা হলো। কেউ একজন প্রশ্ন রাখতে পারেন, ইসলাম যদি সত্যিই রাজনৈতিক সহিষ্ণুতায় সমর্থন দেয়, তাহলে কেন বন্দীদের কর দিতে হবে? এর জবাব হলো, বন্দীদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা দিতে বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন পড়ে। বন্দীদের কোনো যাকাত দিতে হয় না। অন্যান্য বিষয়েও তাদের অধিকার সমান। যাকাতের পরিবর্তে তারা আর্থিক অনুদান দিয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে এটা উল্লেখযোগ্য যে, অমুসলিম কিন্তু মুসলমানদের হাতেই অধিকতর নিরাপদ; কারন মুসলমানরা অমুসলিমের জীবন ও সম্পত্তি স্পর্শ করতে পারে না। অবশ্যই একটি বহু জাতিগত সমাজ ব্যবস্থায় বিভিন্নমুখী রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতামতের প্রেক্ষাপটে ইসলামের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান অবশ্যই এক মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ।
(রাজনীতি ও সহিষ্ণুতার জন্য ইসলাম সংক্রান্ত ব্যাপারে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অধিকতর প্রাসঙ্গিক অথচ ভিন্নতর রেফারেন্স দেওয়া কি সম্ভব?)
৪. ঘ. ঘরোয়া ও সামাজিক জীবনে সহিষ্ণুতা
সহিষ্ণুতা প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তিগত জীবন থেকেই জীবনের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনের ৪২:৩৭ আয়াত উল্লেখযোগ্য। যেখানে বলা হয়েছে, ‘যারা বড় বড় গুনাহ ও অশ্লীল কার্যকলাপ থেকে বেঁচে থাকে, যখন রাগান্বিত হয় তখন তারা (অন্যদের ভুল) ক্ষমা করে দেয়।’
সুতরাং আমরা লক্ষ্য করি, ক্রোধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে ইসলাম বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছে। মজার বিষয় হলো, এমনকি লড়াইয়ের ময়দানেও ব্যক্তিগত ক্ষোভ কোনো যুদ্ধের কারণ হওয়া উচিত নয়। যুদ্ধের জন্য অবশ্যই একটি প্রকৃত কারণ থাকতে হবে। এ প্রসঙ্গে হযরত আলী (রা.)-এর একটি কাহিনী স্মরণযোগ্য। তিনি এক লড়াইয়ের ময়দানে কারো বুকের ওপরে চড়ে বসেন। ভ’পাতিত লোকটি হযরত আলী (রা.)-এর মুখে থুতু ছিটিয়ে দেন। এতে হযরত আলী (রা.) খুবই ক্রোদ্ধ ও অসন্তুষ্ট হলেন। তবে যার বিরুদ্ধে তিনি লড়াইয়ে ছিলেন তিনি হঠাৎ শান্ত হলেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী তাঁকে জিজ্ঞেস করল, কেন তিনি তাকে হত্যা করেননি? আলী উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন, ‘আমি তোমাকে এখন হত্যা করতে পারি না। কারণ এখন আমি তোমার প্রতি ক্রুদ্ধ’। যদি সত্যিই এমন দৃষ্টান্ত ঘরোয়া ও সামাজিক জীবনে অনুসরণ করা হয়, তাহলে সমাজে প্রকৃত শান্তি আসবে। সমাজের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে আলোচনাকালে এবং এমনকি ধর্মকথা বলার মুহুর্তেও এ উপদেশ বহাল থাকে যে, পরস্পরের সঙ্গে তারা যেন বিরোধে জড়িয়ে না পড়েন। কিন্তু ১৬:১২৫ আয়াতে বর্ণিত রয়েছে এক সুবিবেচনাপূর্ণ আহ