বৈধ ও অবৈধ গীবত ! ( ১ম পর্ব )


বৈধ ও অবৈধ গীবত !
মুহাম্মদ হামিদুল ইসলাম আজাদ
মানুষ সামাজিক জীবসমাজবদ্ধ জীবনযাপন ছাড়া একাকী জীবন যাপন করা মানুষের পক্ষে সহজ নয়, তেমনটি কেউ কামনাও করে না। আবার পরিচিত সমাজের বাইরেও মানুষের পক্ষে চলা খুবই কঠিনপৃথিবীর সমাজবদ্ধ কোনো মানুষই সামাজিক বিপর্যয় কামনা করতে পারেন না
মানুষ সব সময় সুখ ও শান্তি চায়শান্তি মানুষের একটি আরাধ্য বিষয়কিন্তু এই প্রত্যাশিত সুখ-শান্তি নির্ভর করে সমাজবদ্ধ মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপরউঁচু-নিচু, ধনী-দরিদ্র­ এসব পার্থক্যই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেনমানুষের পারস্পরিক পরিচয়ের জন্যই এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ সূরা হুজরাতে এরশাদ করেছেন,

يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّا خَلَقْنَاكُمْ مِنْ ذَكَرٍ وَأُنْثَى وَجَعَلْنَاكُمْ شُعُوبًا وَقَبَائِلَ لِتَعَارَفُوا إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ ﴿13﴾
হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে এক নারী ও এক পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছিযাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পারতোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ননিশ্চয় আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত। (সূরা হুজুরাত: ১৩)
সুতরাং মানব সমাজের এই পার্থক্য সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার নিমিত্তেইযেসব কারণে সমাজের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ বিনষ্ট হয়, সমাজ বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হয়, সামাজিক মূল্যবোধ বিনষ্ট হয়, পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হয়, তার মধ্যে অন্যতম কারণ হলো গীবত, যা মানুষকে নিকৃষ্টতম প্রাণীতে পরিণত করেতাই তো মহান আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষকে এই নিকৃষ্ট স্বভাব থেকে বিরত থাকার তাগিদ দিয়েছেন
ইসলাম ঐক্যবদ্ধ থাকার গুরুত্বারোপ করেছে । ঐক্য ভ্রাতৃত্ব বিনষ্টকারী সমুদয় কর্ম হতে বিরত থাকতে সকলকে তাগীদ দিয়েছে । সমাজে যেসব বিষয়ে ফাটল ধরাতে এবং ঐক্যের সুরম্য প্রাসাদকে ভেঙ্গে তছনছ করে দিতে সক্ষম এমন বিষয়গুলির অন্যতম হল বেশী ধারণা অনুমান করা, অন্যের দোষ অন্বেষন করা ও পরনিন্দা বা গীবত । এর মাধ্যমেই শয়তান পারিবারিক জীবনে, সমাজীক জীবনে ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ফাটল ধরিয়ে থাকে । আল্লাহ্তাআলা বলেনঃ وَيْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةٍ
ধবংশ এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যে (সামনা সামনি) লোকদের ধিক্কার দেয় এবং (পেছনে) নিন্দা করতে অভ্যস্ত সূরা হুমাযাহঃ ০১
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اجْتَنِبُوا كَثِيرًا مِّنَ الظَّنِّ إِنَّ بَعْضَ الظَّنِّ إِثْمٌ ۖ وَلَا تَجَسَّسُوا وَلَا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا ۚ أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَن يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۚ إِنَّ اللَّهَ تَوَّابٌ رَّحِيمٌ
হে ঈমানদাগণ, বেশী ধারণা অনুমান করা থেকে বিরত থাকো কারণ কোন কোন ধারণা অনুমান গোনাহ ৷ দোষ অন্বেষন করো না ৷ আর তোমাদের কেউ যেন কারো গীবত না করে ৷ এমন কেউ কি তোমাদের মধ্যে আছে, যে তার নিজের মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে ? দেখো, তা খেতে তোমাদের ঘৃণা হয় ৷ আল্লাহকে ভয় করো ৷ আল্লাহ অধিক পরিমাণে তাওবা কবুলকারী এবং দয়ালু । সূরা হুজুরাতঃ ১২
আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয় এমন তিনটি কাজ কে হরাম বলে ঘোষনা করেছেন । 
প্রথমঃ বেশী ধারণা অনুমান করা: একেবারেই ধারণা করতে নিষেধ করা হয়নি বরং খুব বেশী ধারণার ভিত্তিতে কাজ করতে এবং সব রকম ধারণার অনুসরণ থেকে মানা করা হয়েছে এর কারণ বলা হয়েছে এই যে, অনেক ধারণা গোনাহের পর্যায়ের পড়ে নির্দেশটি বুঝার জন্য আমাদের বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত ধারণা কত প্রকার এবং প্রত্যেক প্রকারের নৈতিক অবস্থা কি ৷
এক প্রকারের ধারণা হচ্ছে, যা নৈতিকতার দৃষ্টিতে অত্যন্ত পছন্দনীয় এবং দীনের দৃষ্টিতেও কাম্য প্রশংসিত যেমনঃ আল্লাহ, তার রসূল এবং ঈমানদারদের ব্যাপারে ভাল ধারণা পোষণ করা তাছাড়া যাদের সাথে ব্যক্তির মেলামেশা উঠাবসা আছে এবং যাদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষনের কোন যুক্তিসংগত কারণ নেই
আরেক প্রকার ধারণা আছে যা বাদ দিয়ে বাস্তব জীবনে চলার কোন উপায় নেই যেমন আদালতে বিচারকের সামনে যেসব সাক্ষ পেশ করা হয় তা যাঁচাই বাছাই করে নিশ্চিত প্রায় ধারণার ভিত্তিতে ফায়সালা করা ছাড়া আদালত চলতে পারে না কারণ, বিচারকের পক্ষে ঘটনা সম্পর্কে সরাসরি জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয় আর সাক্ষের ভিত্তিতে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা নিশ্চিত সত্য হয়না, বরং প্রায় নিশ্চিত ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয় যে ক্ষেত্রে কোন না কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরী হয়ে পড়ে, কিন্তু বাস্তব জ্ঞান লাভ বাস্তব হয় না সে ক্ষেত্রে ধারণার ওপর ভিত্তি করে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ছাড়া মানুষের জন্য আর কোন উপায় থাকে না
তৃতীয় এক প্রকারের ধারণা আছে যা মূলত খারাপ হলেও বৈধ প্রকৃতির প্রকারের ধারণা গোনাহের অন্তরভুক্ত হতে পারে না যেমনঃ কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠির চরিত্র কাজ-কর্মে কিংবা তার দৈনন্দিন আচার -আচরণ চালচলে এমন সুস্পষ্ট লক্ষণ ফুটে উঠে যার ভিত্তিতে সে আর ভাল ধারণার যোগ্য থাকে না বরং তার প্রতি খারাপ ধারণা পোষণের একাধিক যুক্তিসংগত কারণ বিদ্যমান এরূপ পরিস্থিতিতে শরীয়াত কখনো দাবী করে যে, সরলতা দেখিয়ে মানুষ তার প্রতি অবশ্যই ভাল ধারণা পোষণ করবে তবে বৈধ খারাপ ধারণা পোষনের চূড়ান্ত সীমা হচ্ছে তার সম্ভাব্য দুস্কৃতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে নিছক ধারণার ভিত্তিতে আরো অগ্রসর হয়ে তার বিরুদ্ধে কোন তৎপরতা চালানো ঠিক নয়
চতুর্থ আরেক প্রকারের ধারণা আছে যা মূলত গোনাহ, সেটি হচ্ছে, বিনা কারণে কারো অপরের প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করা কিংবা অন্যদের ব্যাপারে মতস্থির করার বেলায় সবসময় খারাপ ধারণার ওপর ভিত্তি করেই শুরু করা কিংবা এমন লোকেদের ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষণ করা যাদের বাহ্যিক অবস্থা তাদের সৎ শিষ্ট হওয়ার প্রমাণ দেয় অনুরূপভাবে কোন ব্যক্তি কোন কথা বা কাজে যদি ভাল মন্দের সমান সম্ভবনা থাকে কিন্তু খারাপ ধারণার বশবর্তী হয়ে আমরা যদি তা খারাপ হিসেবেই ধরে নেই তাহলে তা গোনাহের কাজ বলে গণ্য হবে যেমনঃ কোন সৎ ভদ্র লোক কোন মাহফিল থেকে উঠে যাওয়ার সময় নিজের জুতার পরিবর্তে অন্য কারো জুতা উঠিয়ে নেন আমরা যদি ধরে নেই যে, জুতা চুরি করার উদ্দেশ্যেই তিনি কাজ করেছেন অথচ কাজটি ভুল করেও হতে পারে কিন্তু ভাল সম্ভাবনার দিকটি বাদ দিয়ে খারাপ সম্ভাবনার দিকটি গ্রহণ করার কারণ খারাপ ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয়
বিশ্লেষণ থেকে একথা পরিস্কার হয়ে যায় যে, ধারণা করা যেমন নিষিদ্ধ বিষয় নয় বরং কোন কোন পরিস্থিতিতে তা পছন্দনীয়, কোন কোন পরিস্থিতিতে অপরিহার্য, কোন কোন পরিস্থিতিতে একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত জায়েয কিন্তু সীমার বাইরে নাজায়েয এবং কোন কোন পরিস্থিতিতে একেবারেই নাজায়েয তাই একথা বলা হয়নি যে, ধারণা বা খারাপ ধারণা করা থেকে একদম বিরত থাকো বরং বলা হয়েছে, অধিকমাত্রায় ধারণা করা থেকে বিরত থাকো তাছাড়া নির্দেশটির উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট করার জন্য আরো বলা হয়েছে , কোন কোন ধারণা গোনাহ সতর্কীকরণ দ্বারা আপনা থেকেই বুঝা যায় যে, যখনই কোন ব্যক্তি ধারণার ভিত্তিতে কোন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে কিংবা কোন পদক্ষেপ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তখন তার ভালভাবে যাচাই বাছাই করে দেখা দরকার, যে ধারণা সে পোষণ করেছে তা গোনাহের অন্তরভুক্ত নয় তো৷ আসলেই কি এরূপ ধারণা পোষনের দরকার আছে৷ এরূপ ধারণা পোষনের জন্য তার কাছে যুক্তিসংগত কারণ আছে কি৷ সে ধারণার ভিত্তিতে সে যে কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করেছে তা কি বৈধ৷ যেসব ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে এতটুকু সাবধানতা তারা অবশ্যই অবলম্বন করবে লাগামহীন ধারণা পোষণ কেবল তাদেরই কাজ যারা আল্লাহর ভয় থেকে মুক্ত এবং আখেরাতের জবাবদিহি সম্পর্কে উদাসীন
দ্বিতীয়ঃ মানুষের গোপন বিষয় তালাশ করাঃ অর্থাৎ মানুষের গোপন বিষয় তালাশ করো না একজন আরেকজনের দোষ খুঁজে বেড়িও না অন্যদের অবস্থা ব্যাপার স্যাপার অনুসন্ধান করে বেড়াবে না খারাপ ধারণা বশবর্তী হয়ে আচরণ করা হোক কিংবা অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য করা হোক অথবা শুধু নিজের কৌতুহল ঔৎসুক্য নিবারণের জন্য করা হোক শরীয়াতের দৃষ্টিতে সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধ অন্যদের যেসব বিষয় লোকচক্ষুর অন্তরালে আছে তা খোঁজাখুঁজি করা এবং কার কি দোষ-ক্রটি আছে কার কি কি দুর্বলতা গোপন আছে পর্দার অন্তরালে উকি দিয়ে তা জানার চেষ্টা করা কোন মু'মিনের কাজ নয় মানুষের ব্যক্তিগত চিঠিপত্র পড়া, দু'জনের কথোপকথন কান পেতে শোনা, প্রতিবেশীর ঘরে উঁকি দেয়া এবং বিভিন্ন পন্থায় অন্যদের পারিবারিক জীবন কিংব তাদের ব্যক্তিগত বিষয়াদি খোঁজ করে বেড়ানো একটি বড় অনৈতিক কাজ এর দ্বারা নানা রকম ফিতনা -ফাসাদ সৃষ্টি হয় কারণে একবার নবী সাঃ তার খোতবায় দোষ অন্বেষণকারীদের সম্পর্কে বলেছেনঃ "হে সেই সব লোকজন, যারা মুখে ঈমান এনেছো কিন্তু এখনো ঈমান তোমাদের অন্তরে প্রবেশ করেনি, তোমরা মুসলমানদের গোপনীয় বিষয় খুঁজে বেড়িও না যে ব্যক্তি মুসলমানদের দোষ-ত্রুটি তালাশ করে বেড়াবে আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটির অন্বেষণে লেগে যাবেন আর আল্লাহর যার ক্রুটি তালাশ করেন তাকে তার ঘরের মধ্যে লাঞ্ছিত করে ছাড়েন "(আবু দাউদ,)
হযরত মুয়াবিয়া (রা) বলেন, আমি নিজে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ "তুমি যদি মানুষের গোপনীয় বিষয় জানার জন্য পেছনে লেগো তাদের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টি করবে কিংবা অন্তত বিপর্যয়ের দ্বার প্রান্তে পৌছে দেবে " (আবু দাউদ)
অপর এক হাদীসে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "তোমাদের মনে করো সম্পর্কে সন্দেহ হলে, অন্বেষণ করো না "(আহকামুল কুরআন-জাস্সাস)
অপর একটি হাদীসে নবী সাঃ বলেছেনঃ "কেউ যদি কারো গোপন দোষ-ত্রুটি দেখে ফেলে এবং তা গোপন রাখে তাহলে সে যেন একজন জীবন্ত পূঁতে ফেলা মেয়ে সন্তানকে জীবন দান করলো " (আল জাস্সাস)
দোষ-ত্রুটি অনুসন্ধান না করার নির্দেশ শুধু ব্যক্তির জন্যই নয়, বরং ইসলামী সরকারের জন্যেও ইসলামী শরীয়াত নাহী আনিল মুনকারের ( মন্দ কাজের প্রতিরোধ) যে দায়িত্ব সরকারের ওপর ন্যস্ত করেছে তার দাবী নয় যে, সে একটি গোয়েন্দা চক্র কায়েম করে মানুষের গোপন দোষ-ক্রুটিসমূহ খুঁজে খুঁজে বের করবে এবং তাদেরকে শাস্তি প্রদান করবে বরং যেসব অসৎ প্রবণতা দোষ-ত্রুটি প্রকাশ হয়ে পড়বে কেবল তার বিরুদ্ধেই তার শক্তি প্রয়োগ করা উচিত গোপনীয় দোষ-ত্রুটি খারাপ চালচলন সংশোধনের উপায় গোয়েন্দাগিরি নয় বরং শিক্ষা, ওয়াজ-নসীহত, জনসাধারণের সামগ্রিক প্রশিক্ষণ এবং একটি পবিত্র সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করাই তার একমাত্র উপায় ক্ষেত্রে হযরত উমরের (রা) ঘটনা অতীব শিক্ষাপ্রদ একবার রাতের বেলা তিনি এক ব্যক্তির কণ্ঠ শুনতে পেলেন সে গান গাইতেছিল তাঁর সন্দেহ হলো তিনি প্রাচীরে উঠে দেখলেন সেখানে শরাব প্রস্তুত , তার সাথে এক নারীও তিনি চিৎকার করে বললেনঃ ওরে আল্লাহর দুশমন, তুই কি মনে করেছিস যে, তুই আল্লাহর নাফরমানী করবি আর তিনি তোর গোপনীয় বিষয় প্রকাশ করবেন না ৷ জবাবে সে বললোঃ আমীরুল মু'মেনীন , তাড়াহুড়ো করবেন না আমি যদি একটি গোনাহ করে থাকি তবে আপনি তিনটি গোনাহ করেছেন আল্লাহ দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়াতে নিষেধ করেছেন কিন্তু আপনি দোষ-ত্রুটি খুঁজেছেন আল্লাহ আদেশ দিয়েছেন, দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করো কিন্তু আপনি প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে ঘরে প্রবেশ করেছেন আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন, নিজের ঘর ছাড়া অনুমতি না নিয়ে অন্যের ঘরে প্রবেশ করো না কিন্তু আমার অনুমতি ছাড়াই আপনি আমার ঘরে পদার্পণ করেছেন" জবাব শুনে হযরত উমর (রা) নিজের ভুল স্বীকার করলেন এবং তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করলেন না তবে তিনি তার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিলেন যে, সে কল্যাণ সুকৃতির পথ অনুসরণ করবে (মাকারিমুল আখলাক -আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনে জা'ফর আলী খারায়েতী) থেকে প্রমানিত হয় যে, খুঁজে খুঁজে মানুষের গোপনীয় দোষ-ত্রুটি বের করা এবং তারপর তাদেরকে পাকড়াও করা শুধু ব্যক্তির জন্যই নয়, ইসলামী সরকারের জন্যও জায়েয নয় একটি হাদীসও একথা উল্লেখিত হয়েছে উক্ত হাদীসে নবী সাঃ বলেছেনঃ "শাসকরা যখন সন্দেহের বশে মানুষের দোষ অনুসন্ধান করতে শুরু করে তখন তাদের চরিত্র নষ্ট করে দেয় " (আবু দাউদ)
তবে কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে যদি খোঁজ-খবর নেয়া অনুসন্ধান করা একান্তই প্রয়োজন হয়ে পড়ে, তবে সেটা নির্দেশের আওতাভুক্ত নয় যেমনঃ কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আচার-আচরণে বিদ্রোহের কিছুটা লক্ষণ সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে ফলে তারা কোন অপরাধ সংঘটিত করতে যাচ্ছে বলে আশংকা সৃষ্টি হলে সরকার তাদের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালাতে পারে অথবা কোন ব্যক্তিকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া হয় বা তার সাথে ব্যবসায়িক লেনদেন করতে চায় তাহলে তার ব্যাপারে নিশ্চিত হবার জন্য সে তার সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে খোঁজ-খবর নিতে পারে
তৃতীয়ঃ গীবত করাঃ
গীবত কী?

গীবত শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে দোষারোপ করা, অনুপস্থিত থাকা, পরচর্চা করা, পরনিন্দা করা, কুৎসা রটনা করা, পিছে সমালোচনা করা ইত্যাদি।
পরিভাষায় গীবত বলা হয় তোমার কোনো ভাইয়ের পেছনে তার এমন দোষের কথা উল্লেখ করা যা সে গোপন রেখেছে অথবা যার উল্লেখ সে অপছন্দ করে(মুজামুল ওয়াসিত) গীবতের সবচেয়ে উত্তম ও বাস্তবসম্মত সংজ্ঞা দিয়েছেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা নিম্মোক্ত হাদিস থেকে পেতে পারি
সাহাবি আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, গীবত কাকে বলে, তোমরা জান কি? সাহাবিগণ বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -ই ভালো জানেনতিনি বললেন, তোমার কোনো ভাই (দীনি) সম্পর্কে এমন কথা বলা, যা সে অপছন্দ করে, তা-ই গীবতসাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমি যে দোষের কথা বলি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে তাহলেও কি গীবত হবে? উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি যে দোষের কথা বল, তা যদি তোমার ভাইয়ের থাকে তবে তুমি অবশ্যই তার গীবত করলে আর তুমি যা বলছ তা যদি তার মধ্যে না থাকে তবে তুমি তার ওপর মিথ্যা অপবাদ দিয়েছ। (মুসলিম) 
সুতরাং এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, কোনো ভাইয়ের এমন দোষের কথা বলা গীবত যা সে অপছন্দ করে
আল্লাহ তাআলা গীবত এর সংজ্ঞা দিতেগিয়ে বলেন, وَيْلٌ لِّكُلِّ هُمَزَةٍ لُّمَزَةٍ
ধবংশ এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যে (সামনা সামনি) লোকদের ধিক্কার দেয় এবং (পেছনে) নিন্দা করতে অভ্যস্ত সূরা হুমাযাহঃ ০১
"হুমাযাহ " "লুমাযাহ"  আরবী ভাষায় এই শব্দ দুটি অর্থের দিক দিয়ে অনেক বেশী কাছাকাছি অবস্থান করছে এমন কি কখনো শব্দ দুটি সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হয় । আবার কখনো দু 'য়ের পার্থক্য হয় কিন্তু সে পার্থক্যটা এমন পর্যায়ের যার ফলে একদল লোক "হুমাযাহ' যে অর্থ করে ,অণ্য একদল লোক "লুমাযা "রও সেই একই অর্থ করে আবার এর বিপরীত পক্ষে কিছু লোক "লুমাযাহ " যে অর্থ বর্ণনা করে অন্য কিছু লোকের কাছে "হুমাযাহ" অর্থ তাই এখানে যেহেতু দু'টি শব্দ এক সাথে এসেছে এবং "হুমাযাহ " "লুমাযাহ" শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তাই উভয় মিলে এখানে যে অর্থ দাঁড়ায় তা হচ্ছে : সে কাউকে লাঞ্ছিত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে । কারোর প্রতি তাচ্ছিল্য ভরে অংগুলি নির্দেশ করে । চোখের ইশারায় কাউকে ব্যঙ্গ করে কারো বংশের নিন্দা করে । কারো ব্যক্তি সত্তার বিরূপ সমালোচনা করে। কারো মুখের ওপর তার বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য করে । কারো পেছনে তার দোষ বলে বেড়ায় কোথাও চোখলখুরী করে এবং এর কথা ওর কানে লাগিয়ে বন্ধুদেরকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয় । কোথাও লোকদের নাম বিকৃত করে খারাপ নামে অভিহিত করে । কোথাও কথার খোঁচায় কাউকে আহত করে এবং কাউকে দোষারোপ করে এসব তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে পশ্চাতে সম্মুখে পরনিন্দাকারীর জন্য দুর্ভোগ । কুরআন হাদিসে এই আচরণ সম্পর্কে বিভিন্নভাবে সতর্ক করা হয়েছে
গীবত-এর সংজ্ঞাঃগীবতঅর্থ বিনা প্রয়োজনে কোন ব্যক্তির দোষ অপরের নিকটে উল্লেখ করা । ইবনুল আছীর বলেনঃগীবত হল কোন মানুষের এমন কিছু বিষয় যা তার অনুপস্থিতিতে উল্লেখ করা, যা সে অপছন্দ করে, যদিও তা তার মধ্যে বিদ্যমান থাকেএসব সংজ্ঞা মূলত হাদিস হতে নেয়া হয়েছে । রাসূলুল্লাহ্সাঃ গীবতের পরিচয় দিয়ে বলেনঃগীবত হল তোমার ভাইয়ের এমন আচরণ বর্ণনা করা, যা সে খারাপ জানে মুসলিম ১৮০৩
গীবতের সংজ্ঞা হচ্ছে, "কোন ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে তার সম্পর্কে কারো এমন কথা বলা যা শুনলে সে অপছন্দ করবে" খোদ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়অ সাল্লাম থেকে গীবতের সংজ্ঞা বর্ণিত হয়েছে মুসলমি, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী এবং আরো অনেক হাদীস বর্ণনাকারী হযরত আবু হুরাইরা থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন হাদীসে নবী সাঃ গীবতের যে সংজ্ঞা বর্ণনা করেছেন তা হচ্ছেঃ "গীবত হচ্ছে, তুমি এমনভাবে তোমার ভাইয়ের কথা বললে যা তার কাছে অপছন্দীয় প্রশ্ন করা হলো, আমি যা বলছি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে সত্যিই থেকে থাকে তাহলে আপনার মত কি৷ তিনি বললেনঃ তুমি যা বলছো তা যদি তার মধ্যে থাকে তাহলেই তো তুমি তার গীবত করলে আর তা যদি না থাকে তাহলে অপবাধ আরোপ করলে "
ইমাম মালেক (রহ:) তাঁর মুয়াত্তা গ্রন্থে হযরত মুত্তালিব ইবনে আবদুল্লাহ থেকে বিষয়ে আর একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন যার ভাষা নিম্নরূপঃ "এক ব্যক্তি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করলো, গীবত কাকে বলে ৷ তিনি বললেনঃ কারো সম্পর্কে তোমার এমন কথা বলা যা তার পছন্দ নয় সে বললোঃ হে আল্লাহর রসূল, যদি আমার কথা সত্য হয় ৷ তিনি জবাব দিলেনঃ তোমার কথা মিথ্যা হলে তো সেটা অপবাদ"
গীবত করার কারণঃ
মানুষ সব সময় নিজেকে বড় করে দেখে, এই আমিত্বের আরেক নাম আত্মপূজাএটা শুরু হয়ে গেলে আত্মপ্রীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেতখন তার আত্মত্যাগের মতো মহৎ বৈশিষ্ট্য দূরিভূত হতে থাকেফলে এ স্থানে দানা বাঁধে হিংসা-বিদ্বেষআবার হিংসা-বিদ্বেষ থেকেই অপরের প্রতি কুধারণার সৃষ্টি হবে, যা মানুষকে গীবত করতে বাধ্য করেসুতরাং আত্মপূজা, আত্মপ্রীতি, হিংসা-বিদ্বেষ, কুধারণাই মানুষকে গীবত করতে বাধ্য করে

চলবে ................ বৈধ ও অবৈধ গীবত !