দারসূল কুরআন



দারসূল কুরআন
  মুহাম্মদ হামিদুল ইসলাম আজাদ

اعْلَمُوا أَنَّمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا لَعِبٌ وَلَهْوٌ وَزِينَةٌ وَتَفَاخُرٌ بَيْنَكُمْ وَتَكَاثُرٌ فِي الْأَمْوَالِ وَالْأَوْلَادِ ۖ كَمَثَلِ غَيْثٍ أَعْجَبَ الْكُفَّارَ نَبَاتُهُ ثُمَّ يَهِيجُ فَتَرَاهُ مُصْفَرًّا ثُمَّ يَكُونُ حُطَامًا ۖ وَفِي الْآخِرَةِ عَذَابٌ شَدِيدٌ وَمَغْفِرَةٌ مِّنَ اللَّهِ وَرِضْوَانٌ ۚ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ
২০. ভালভাবে জেনে রাখো দুনিয়ার জীবন, একটা খেলা, হাসি তামাসা, বাহ্যিক চাকচিক্য, তোমাদের পারস্পরিক গৌরব অহংকার এবং সন্তান সন্তুতি অর্থ-সম্পদে পরস্পরকে অতিক্রম করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয় ৷ এর উপমা হচ্ছে, বৃষ্টি হয়ে গেল এবং তার ফলে উৎপন্ন উদ্ভিদরাজি দেখে কৃষক আনন্দে উৎফূল্ল হয়ে উঠলো ৷ তারপর সে ফসল পেকে যায় এবং তোমরা দেখতে পাও যে, তা হলদে বর্ণ ধারণ করে এবং পরে তা ভূষিতে পরিণত হয়৷ পক্ষান্তরে আখেরাত এমন স্থান যেখানে রয়েছে কঠিন আযাব, আল্লাহর ক্ষমা সন্তুষ্টি৷ পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ ছাড়া আর কিছুই নয় ৷
سَابِقُوا إِلَىٰ مَغْفِرَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أُعِدَّتْ لِلَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ ۚ ذَٰلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَن يَشَاءُ ۚ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ
২১. দৌড়াও এবং একে অপরের চেয়ে অগ্রগামী হওয়ার চেষ্টা করো, তোমার রবের মাগফিরাতের দিকে এবং সে জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি আসমান যমীনের মত ৷ তা প্রস্তুত রাখা হয়েছে সে লোকদের জন্য যারা আল্লাহ তাঁর রসূলদের প্রতি ঈমান এনেছে ৷ এটা আল্লাহর অনুগ্রহ যাকে ইচ্ছা তিনি তা দান করেন ৷ আল্লাহ বড়ই অনুগ্রহশীল ৷
مَا أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي أَنفُسِكُمْ إِلَّا فِي كِتَابٍ مِّن قَبْلِ أَن نَّبْرَأَهَا ۚ إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ
২২. পৃথিবীতে এবং তোমাদের নিজেদের ওপর যেসব মুসিবত আসে তার একটিও এমন নয় যে, তাকে আমি সৃষ্টি করার পূর্বে একটি গ্রন্থে (কিতাব অর্থ ভাগ্য লিপি) লিখে রাখিনি ৷ এমনটি করা আল্লাহর জন্য খুবই সহজ কাজ ৷

لِّكَيْلَا تَأْسَوْا عَلَىٰ مَا فَاتَكُمْ وَلَا تَفْرَحُوا بِمَا آتَاكُمْ ۗ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ
২৩. ( সবই এজন্য) যাতে যে ক্ষতিই তোমাদের হয়ে থাকুক তাতে তোমরা মনক্ষুন্ন না হও ৷ আর আল্লাহ তোমাদের যা দান করেছেন সেজন্য গর্বিত না হও ৷ যারা নিজেরা নিজেদের বড় মনে করে এবং অহংকার করে, আল্লাহ পছন্দ করেন না উদ্ধত ও অহংকারীদেরকে ।

الَّذِينَ يَبْخَلُونَ وَيَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبُخْلِ ۗ وَمَن يَتَوَلَّ فَإِنَّ اللَّهَ هُوَ الْغَنِيُّ الْحَمِيدُ
২৪. নিজেরাও কৃপণতা করে এবং মানুষকেও কৃপণতা করতে উৎসাহ দেয় আল্লাহ তাদের পছন্দ করেন না ৷ এরপর যদি কেউ মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে আল্লাহ অভাবশূন্য অতি প্রশংসিত ৷
لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ ۖ وَأَنزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيهِ بَأْسٌ شَدِيدٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ مَن يَنصُرُهُ وَرُسُلَهُ بِالْغَيْبِ ۚ إِنَّ اللَّهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ
২৫. আমি আমার রসূলদের সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ এবং হিদায়াত দিয়ে পাঠিয়েছি ৷ তাদের সাথে কিতাব মিযান নাযিল করেছি যাতে মানুষ ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে ৷ আর লোহা নাযিল করেছি যার মধ্যে বিরাট শক্তি এবং মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ রয়েছে ৷ এটা করা হয়েছে এজন্য যে, আল্লাহ জেনে নিতে চান কে তাঁকে না দেখেই তাঁকে তাঁর রসূলদেরকে সাহায্য করে ৷ নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ অত্যন্ত শক্তিধর মহাপরাক্রমশালী । (সূরা হাদীদঃ ২০-২৫)
নামকরণঃ আলোচ্য সূরার ২৫ নম্বার আয়াতের (الْحَدِيدَ) বাক্যাংশ থেকে নাম গৃহীত হয়েছে ।
নাযিলের সময়-কালঃ সর্ব সম্মাত মতে এটি মদীনায় অবতীর্ণ সূরা। সূরার বিষয়বস্তু নিয়ে চিন্তা ভাবনা করলে মনে হয় সম্ভবত উহুদ যুদ্ধ হুদায়বিয়ার সন্ধির মধ্যবর্তী কোন এক সময় সূরা নাযিল হয়েছে। এটা সে সময়ের কথা যখন কাফেররা চারদিক থেকে ক্ষুদ্র ইসলামী রাষ্ট্রটিকে তাদের আক্রমণের লক্ষস্থল বানিয়েছিল এবং ঈমানদারদের ক্ষুদ্র একটি দল অত্যন্ত সহায় সম্বলহীন অবস্থায় সমগ্র আরবের শক্তির মোকাবিলা করে যাচ্ছিলেন। পরিস্থিতিতে ইসলাম তার অনুসারীদের কাছে শুধু জীবনের কুরবানীই চাচ্ছিলো না বরং সম্পদের কুরবানীর প্রয়োজনীয়তাও একান্তভাবে উপলব্ধি করেছিলো। ধরনের কুরবানী পেশ করার জন্য সূরায় অত্যন্ত জোরালো আবেদন জানানো হয়েছে । সূরার ১০ আয়াত অনুমানকে আরো জোরালো করছে । আয়াতে আল্লাহ তাআলা ঈমানদারদের দলকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, যারা বিজয়ের পরে নিজেদের অর্থ সম্পদ খরচ করবে এবং আল্লাহর পথে লড়াই করবে তারা কখনো সব লোকদের সমমর্যাদা সম্পন্ন হতে পারবে না যারা বিজয় লাভেরপূর্বের জান মালের কুরবানী পেশ করবে । ইবনে মারদুইয়া কর্তৃক উদ্ধৃত হযরত আনাস (রা) বর্ণিত হাদীস একথাই সমর্থন করে । তিনি আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসংগে বলেনঃ কুরআন নাযিলের শুরু থেকে ১৭ বছর পর ঈমানদারের আলোড়নকারী আয়াতটি নাযিল হয় । হিসেব অনুসারে এর নাযিল হওয়ার সময় ৪র্থ পঞ্চম হিজরী সনের মধ্যবর্তী সময়ই সূরার নাযিল হওয়র সময়-কাল বলে নির্ধারিত হয়
সূরার বিষয়বস্তু মূল বক্তব্যঃ সূরার আলোচ্য বিষয় হচ্ছে আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করার উপদেশ দান । যখন আরব জাহেলিয়াতের সাথে ইসলামের সিদ্ধান্তের সংগ্রাম চলছিলো, ইসলামের ইতিহাসের সে সংকটকালে মুসলমানদেরকে বিশেষভাবে আর্থিক কুরবানীর জন্য প্রস্তুত করা এবং ঈমান যে শুধু মৌখিক স্বীকৃতি বাহ্যিক কিছু কাজকর্মের নাম নয় বরং আল্লাহ তার রসূলের জন্য একনিষ্ঠ হওয়াই তার মূল চেতনা প্রেরণা, একথা তাদের মনে বদ্ধমূল করে দেয়ার উদ্দেশ্যেই সূরা নাযিল করা হয়েছিল । যে ব্যক্তির মধ্যে চেতনা প্রেরণা অনুপস্থিত এবং আল্লাহ তার দীনের মোকাবিলায় নিজের প্রাণ, সম্পদ স্বার্থকে অধিকতর ভালবাসে তার ঈমানের দাবী অন্তসর শুন্য । আল্লাহর কাছে ধরনের ঈমানের কোন মূল্য মর্যাদা নেই । উদ্দেশ্যে সর্ব প্রথম আল্লাহ তাআলার গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে যাতে শ্রোতারা ভালভাবে উপলবদ্ধি করতে পারে যে, কোন মহান সত্তার পক্ষ থেকে তাঁকে সম্বোধন করা হচ্ছে । তারপর নিম্নের বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাব পেশ করা হয়েছে ।
দুনিয়ার জীবন মাত্র কয়েক দিনের চাকচিক্য এবং ধোয়ার উপকরণ । এখানকার খেল তামাসা, এখানকার আনন্দ আকর্ষণ এখানকার সৌন্দর্য সাজ-সজ্জা, এখাকার শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে গর্ব অহংকার এবং এখাকার ধন সম্পদ ঐশ্বর্যের ব্যপারে একে অপরকে অতিক্রম করার চেষ্টা সাধনা সব কিছুই অস্থায়ী । এর উপমা দেয়া যায় সেই শস্য ক্ষেত্রের সাথে যা প্রথম পর্যায়ে সবুজ সতেজ হয়ে ওঠে । তারপর বিবর্ণ হয়ে তামাটে বর্ণ ধারণ করে এবংসর্বশেষ ভূষিতে পরিণত হয় । প্রকৃতপক্ষে আখেরাতের জীবন হচ্ছে স্থায়ী জীবন যেখানে সব কাজের বড় বড় ফলাফল পাওয়া যাবে । তোমাদের যদি প্রতিযোগিতামূলকভাবে কিছু করতে হয় তাহলে জান্নাতের দিকে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার জন্য চেষ্টা করো। পৃথিবীতে আরাম -আয়েশ বিপদ আপদ যাই আসে তা আল্লাহ তাআলার পর্ব লিখিত সিদ্ধান্ত অনুসারেই আসে। একজন ঈমানদারের ভূমিকা হওয়া উচিত বিপদ আপদ আসলে সাহস না হারানো এবং আরাম আয়েশ সুখ-শান্তি আসলে গর্ব প্রকাশ না করা একজন মুনাফিক বা কাফেরের আচরণ হচ্ছে আল্লাহ যদি তাকে নিয়ামত দান করেন তাহলে সে গর্বে মেতে উঠে, অহংকার প্রকাশ করতে থাকে এবং নিয়ামত দাতা আল্লাহর কাজে ব্যায় করতে নিজেও সংকীর্ণতার পরিচয় দেয় এবং অন্যদেরকেও কার্পণ্য করতে পরামর্শ দেয় ।
আল্লাহ সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ, কিতাব এবং ন্যায় বিচারের ভারসাম্যপূর্ণ মানদণ্ড সহকারে তাঁর রসূল পাঠিয়েছেন, যাতে মানুষ ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে আর তার সাথে লোহাও নাযিল করছেন যাতে ন্যায় সত্য প্রতিষ্ঠা এবং বাতিলের মাথা অবনত করার জন্য শক্তি ব্যবহার করা যায় । এভাবে এভাবে আল্লাহ দেখতে চান মানুষের মধ্যে এমন লোক কারা যারা তাঁর দীনের সহায়তা সাহায্যের জন্য প্রস্তুত হয় এবং সেজন্য প্রাণপণে চেষ্টা করে । তোমাদের নিজেদের উন্নতি মর্যাদার জন্য আল্লাহ এই সুযোগসমূহ সৃষ্টি করেছেন । অন্যথায় আল্লাহ তাঁর কাজের জন্য কারো মুখাপেক্ষী নন ।
আল্লাহর পক্ষ থেকে ইতিপূর্বেও একের পর এক নবী রসূলগণ এসেছেন। তাদের আহবানে কিছু লোক সঠিক পথে ফিরে এসেছে । কিন্তু অধিকাংশ লোকই পাপাচারী রয়ে গিয়েছে । তারপর ঈসা আলাইহিস সালাম এসেছেন । তাঁর শিক্ষায় মানুষের মধ্যে বহু নৈতিক গুণাবলী সৃষ্টি হয়েছে । কিন্তু তাঁরউম্মাতবৈরাগ্যবাদের বিদআত অবলম্বন করে ।
এখন আল্লাহ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামে পাঠিয়েছেন। যারা তাঁর প্রতি ঈমান আনবে এবং আল্লাহকে ভয় করে জীবন যাপন করবে আল্লাহ তাদেরকে তাঁর রহমতের দ্বিগুণ অংশ দেবেন এবং তাদেরকে এমননূরদান করবেন যার সাহায্যে তারা দুনিয়ার জীবনে পদে পদে বাঁকা পথসমূহের মধ্যে সোজা পথটি ষ্পষ্ট দেখে চলতে পারবে । আহলে কিতাব নিজেদেরকেও যদিও আল্লাহর রহমতের ঠিকাদার মনে করে থাকে। কিন্তু আল্লাহর রহমত তাঁর নিজেরই হাত আছে। যাকে ইচ্ছা তাকে এই রহমত অনুগ্রহ দান করার ইখতিয়ার তার আছে। হচ্ছে সূরায় সুবিন্যস্ত ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত বিষয়বস্তুর সার সংক্ষেপ
ব্যাখ্যা
২০ নাম্বার আয়াতঃ
اعْلَمُوا أَنَّمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا لَعِبٌ وَلَهْوٌ وَزِينَةٌ وَتَفَاخُرٌ بَيْنَكُمْ وَتَكَاثُرٌ فِي الْأَمْوَالِ وَالْأَوْلَادِ ۖ كَمَثَلِ غَيْثٍ أَعْجَبَ الْكُفَّارَ نَبَاتُهُ ثُمَّ يَهِيجُ فَتَرَاهُ مُصْفَرًّا ثُمَّ يَكُونُ حُطَامًا ۖ وَفِي الْآخِرَةِ عَذَابٌ شَدِيدٌ وَمَغْفِرَةٌ مِّنَ اللَّهِ وَرِضْوَانٌ ۚ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ
২০. ভালভাবে জেনে রাখো দুনিয়ার জীবন, একটা খেলা, হাসি তামাসা, বাহ্যিক চাকচিক্য, তোমাদের পারস্পরিক গৌরব অহংকার এবং সন্তান সন্তুতি অর্থ-সম্পদে পরস্পরকে অতিক্রম করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয় ৷ এর উপমা হচ্ছে, বৃষ্টি হয়ে গেল এবং তার ফলে উৎপন্ন উদ্ভিদরাজি দেখে কৃষক আনন্দে উৎফূল্ল হয়ে উঠলো ৷ তারপর সে ফসল পেকে যায় এবং তোমরা দেখতে পাও যে, তা হলদে বর্ণ ধারণ করে এবং পরে তা ভূষিতে পরিণত হয়৷ পক্ষান্তরে আখেরাত এমন স্থান যেখানে রয়েছে কঠিন আযাব, আল্লাহর ক্ষমা সন্তুষ্টি৷ পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ ছাড়া আর কিছুই নয় ৷
পৃথিবীর ধন, সম্পদ ও উপকরণের তুচ্ছতা সম্পর্কে সূরা আশ্-শুরা-র ৩৬ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলেন,
فَمَا أُوتِيتُم مِّن شَيْءٍ فَمَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ۖ وَمَا عِندَ اللَّهِ خَيْرٌ وَأَبْقَىٰ لِلَّذِينَ آمَنُوا وَعَلَىٰ رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ
যা- তোমাদের দেয়া হয়েছে তা কেবল দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের উপকরন মাত্র ৷ আর আল্লাহর কাছে যা আছে তা যেমন উত্তম তেমনি চিরস্থায়ী৷৫৬ তা সেই সব লোকের জন্য যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের রবের উপর নির্ভর করে ।
পৃথিবীর ধন, সম্পদ ও উপকরণের তুচ্ছতা সম্পর্কে সূরা আল কাহাফ এর ৪৫ ও ৪৬ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলেন,
وَاضْرِبْ لَهُم مَّثَلَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا كَمَاءٍ أَنزَلْنَاهُ مِنَ السَّمَاءِ فَاخْتَلَطَ بِهِ نَبَاتُ الْأَرْضِ فَأَصْبَحَ هَشِيمًا تَذْرُوهُ الرِّيَاحُ ۗ وَكَانَ اللَّهُ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ مُّقْتَدِرًا
আর হে নবী! দুনিয়ার জীবনের তাৎপর্য তাদেরকে উপমার মাধ্যমে বুঝাও যে, আজ আমি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করলাম, ফলে ভূ-পৃষ্ঠের উদ্ভিদ খুব ঘন হয়ে গেলো আবার কাল উদ্ভিদগুলোই শুকনো ভূষিতে পরিণত হলো, যাকে বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যায়৷ আল্লাহ সব জিনিসের ওপর শক্তিশালী ৷
অর্থাৎ তিনি জীবনও দান করেন আবার মৃত্যুও তিনি উত্থান ঘটান আবার পতনও ঘটান তাঁর নির্দেশে বসন্ত আসে এবং পাত ঝরা শীত মওসুমও তাঁর নির্দেশেই আসে আজ যদি তুমি সচ্ছল আয়েশ আরামের জীবন যাপন করে থাকো তাহলে অহংকারে মত্ত হয়ে থেকো না যে, অবস্থার পরিবর্তন নেই যে আল্লাহর হুকুমে তুমি এসব কিছু লাভ করেছো তাঁরই হুকুমে এসব কিছু তোমার কাছে থেকে ছিনিয়ে নেয়া যেতে পারে
الْمَالُ وَالْبَنُونَ زِينَةُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ۖ وَالْبَاقِيَاتُ الصَّالِحَاتُ خَيْرٌ عِندَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَخَيْرٌ أَمَلًا
ধন-সম্পদ সন্তান-সন্ততি দুনিয়ার জীবনের একটি সাময়িক সৌন্দর্য-শোভা মাত্র৷ আসলে তো স্থায়িত্ব লাভকারী সৎকাজগুলোই তোমার রবের কাছে ফলাফলের দিক দিয়ে উত্তম এবং এগুলোই উত্তম আশা-আকাঙ্ক্ষা সফল হবার মাধ্যম৷ 
পৃথিবীর ধন, সম্পদ ও উপকরণের তুচ্ছতা সম্পর্কে সূরা আলে ইমরানের এর ১৪ ও ১৫ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলেন,
زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِينَ وَالْقَنَاطِيرِ الْمُقَنطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالْأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ۗ ذَٰلِكَ مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا ۖ وَاللَّهُ عِندَهُ حُسْنُ الْمَآبِ
১৪. মানুষের জন্য নারী, সন্তান, সোনারুপার স্তূপ, সেরা ঘোড়া, গবাদী পশু কৃষি ক্ষেতের প্রতি আসক্তিকে বড়ই সুসজ্জিত সুশোভিত করা হয়েছে ৷ কিন্তু এগুলো দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের সামগ্রী মাত্র ৷ প্রকৃতপক্ষে উত্তম আবাস তো রয়েছে আল্লাহর কাছে ৷ 
.
قُلْ أَؤُنَبِّئُكُم بِخَيْرٍ مِّن ذَٰلِكُمْ ۚ لِلَّذِينَ اتَّقَوْا عِندَ رَبِّهِمْ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَأَزْوَاجٌ مُّطَهَّرَةٌ وَرِضْوَانٌ مِّنَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ بَصِيرٌ بِالْعِبَادِ
১৫. বলো, আমি কি তোমাদের জানিয়ে দেবো, ওগুলোর চাইতে ভালো জিনিস কি? যারা তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করে তাদের জন্য তাদের রবের কাছে রয়েছে বাগান, তার নিম্নদেশে ঝরণাধারা প্রবাহিত হয় ৷ সেখানে তারা চিরন্তন জীবন লাভ করবে ৷ পবিত্র স্ত্রীরা হবে তাদের সংগিনী১১ এবং তারা লাভ করবে আল্লাহর সন্তুষ্টি আল্লাহ তার বান্দাদের কর্মনীতির ওপর গভীর প্রখর দৃষ্টি রাখেন
আলোচ্য এ বিষয়টি পুরোপুরি বুঝার জন্য কুরআন মজীদের নিম্নবর্ণিত স্থানগুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবেঃ সূরা ইউনুস, আয়াত ২৪, ২৫ ইবরাহীম, ১৮, আন নূর, ৩৯ । এসব স্থানে মানুষের মনে যে বিষয়টি বদ্ধমুল করার চেষ্টা করা হয়েছে তা হচ্ছে পৃথিবীর জীবন প্রকৃত পক্ষে একটি ক্ষণস্থায়ী জীবন। এখানকার বসন্তকাল যেমন অস্থায়ী তেমনি শরতকালও অস্থায়ী । এখানে চিত্ত হরণের বহু উপকরণ আছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা এত নিকৃষ্ট এবং এত নগণ্য যে, নিজেদের নির্বুদ্ধিতার কারণে মানুষ ঐগুলোকে বড় বড় জিনিস বলে মনে করে এবং প্রতারিত হয়ে মনে করে ঐগুলো লাভ করতে পারাই যেন চরম জিনিস বলে মনে করে এবং প্রতারিত হয়ে মনে করে ঐগুলো লাভ করতে পারাই যেন চরম সফলতা অর্জন করা । অথচ যেসব বড় বড় স্বার্থ এবং আনন্দের উপকরণই এখানে লাভ করা সম্ভব তা নিতান্তই নগণ্য এবং কেবল কয়েক বছরের ধার করা জীবন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ তার অবস্থাও আবার এমন যে, ভাগ্যের একটি বিপর্যয় বিড়ম্বনা পৃথিবীতেই ওগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। পক্ষান্তরে আখেরাতের জীবন এক বিশাল স্থায়ী জীবন। সেখানকার কল্যাণও বিশাল স্থায়ী এবং ক্ষতিও বিশাল এবং স্থায়ী। সেখানে কেউ যদিআল্লাহর মাগফিরাত সন্তুষ্টি পেয়ে যায় তাহলে সে চিরদিনের জন্য এমন নিয়ামত লাভ করলো যার সামনে গোটা পৃথিবীর ধন-সম্পদ এবং রাজত্ব অতিশয় নগণ্য হীন । আর সেখানে যে আল্লাহর আযাবে গ্রেফতার হলো, সে যদি দুনিয়াতে এমন কিছুও পেয়ে যায় যা সে নিজে বড় মনে করতো । তবুও সে বুঝতে পারবে যে, সে ভয়ানক ক্ষতিকর কারবার করেছে
২১ নাম্বার আয়াতঃ
سَابِقُوا إِلَىٰ مَغْفِرَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أُعِدَّتْ لِلَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ ۚ ذَٰلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَن يَشَاءُ ۚ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ
দৌড়াও এবং একে অপরের চেয়ে অগ্রগামী হওয়ার চেষ্টা করো, তোমার রবের মাগফিরাতের দিকে এবং সে জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি আসমান যমীনের মত ৷ তা প্রস্তুত রাখা হয়েছে সে লোকদের জন্য যারা আল্লাহ তাঁর রসূলদের প্রতি ঈমান এনেছে ৷ এটা আল্লাহর অনুগ্রহ যাকে ইচ্ছা তিনি তা দান করেন ৷ আল্লাহ বড়ই অনুগ্রহশীল ৷  
২২. নাম্বার আয়াতাংশের ব্যাখ্যা:  سَابِقُوا إِلَىٰ
দৌড়াও এবং একে অপরের চেয়ে অগ্রগামী হওয়ার চেষ্টা করো,
মূল আয়াতে (سَابِقُوا) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে । শুধু দৌড়াও কথা দ্বারা এর সঠিক অর্থ প্রকাশ পায় না । (মুসাবিকাতুন) শব্দের অর্থ প্রতিযোগিতায় অন্যদের পেছনে ফেলে আগে চলে যাওয়ার চেষ্টা করা অর্থাৎ তোমরা পৃথিবীর ধন-সম্পদ, আনন্দ সুখ এবং কল্যাণসমূহ হস্তগত করার জন্য যে চেষ্টা করছো তা পরিত্যাগ করে জিনিসকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে নাও । এবং দিকে দৌড়িয়ে সফলতা লাভের চেষ্টা করো
আল্লাহ তায়ালা মাগফিরাত এবং জান্নাতকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে জীবন যাপনের তাকিদ দিয়ে সূরা আলে ইমরানের এর ১৩৩ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলেন,
وَسَارِعُوا إِلَىٰ مَغْفِرَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ
দৌড়ে চলো তোমাদের রবের ক্ষমার পথে এবং সেই পথে যা পৃথিবী আকাশের সমান প্রশস্ত জান্নাতের দিকে চলে গেছে, যা এমন সব আল্লাহভীরু লোকদের জন্য তৈরী করা হয়েছে,
২২. নাম্বার আয়াতাংশের ব্যাখ্যা:
مَغْفِرَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أُعِدَّتْ لِلَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ ۚ ذَٰلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَن يَشَاءُ ۚ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ
তোমার রবের মাগফিরাতের দিকে এবং সে জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি আসমান যমীনের মত ৷ তা প্রস্তুত রাখা হয়েছে সে লোকদের জন্য যারা আল্লাহ তাঁর রসূলদের প্রতি ঈমান এনেছে ৷ এটা আল্লাহর অনুগ্রহ যাকে ইচ্ছা তিনি তা দান করেন৷ আল্লাহ বড়ই অনুগ্রহশীল ৷
আয়াতাংশ দ্বারা জান্নাতের আয়তন বুঝাতে চাওয়া হয়নি, বরং তার বিস্তৃতির ধারণা দিতে চাওয়া হয়েছে । এখঅনে বলা হয়েছে, তার বিস্তৃতি আসমান যমীনের মত ব্যাপক
আর সূরা আলে ইমরানে বলা হয়েছেঃ "দৌড়াও তোমাদের রবের মাগফিরাত সেই জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি গোটা বিশ্ব -জাহান জুড়ে, যা মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে । (আয়াত ১৩৩)
দুটি আয়াত এক সাথে পড়লে মাথায় এমন একটা ধারণা জন্মে যে, একজন মানুষ জান্নাতে যে বাগান এবং প্রাসাদসমূহ লাভ করবে তার অবস্থান স্থল কেবল তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ । কিন্তু প্রকৃতপ্কষে গোটা বিশ্ব-জাহান হবে তার বিচরণ ক্ষেত্র । সে কোথাও সীমাবদ্ধ থাকবে না । সেখানে তার অবস্থা পৃথিবীর মত হবে না যে, চাঁদের মত সর্বাধিক নিকটবর্তী উপগ্রহ পর্যন্ত পৌছতেও তাকে বছরের পর বছর ধরে একের এক এক বহু কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে এবং সামান্য পথ ভ্রমণের কষ্ট দূর করার জন্য অজস্ত্র সম্পদ ব্যয় করতে হয়েছে । কিন্তু সেখানে গোটা বিশ্ব-জাহান তার জন্য উন্মুক্ত হবে, যা চাইবে নিজের জায়গায় বসে বসেই দেখতে পারবেএবং যেখানে ইচ্ছা বিনা বাধায় যেতে পারবে
জান্নাতে মুত্তাকীদের জন্য যেই সব নিয়ামত মওজুদ করে রাখা হয়েছে তার বর্ণনা সূরা মুহাম্মদ এর ১৫ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন,
مَّثَلُ الْجَنَّةِ الَّتِي وُعِدَ الْمُتَّقُونَ ۖ فِيهَا أَنْهَارٌ مِّن مَّاءٍ غَيْرِ آسِنٍ وَأَنْهَارٌ مِّن لَّبَنٍ لَّمْ يَتَغَيَّرْ طَعْمُهُ وَأَنْهَارٌ مِّنْ خَمْرٍ لَّذَّةٍ لِّلشَّارِبِينَ وَأَنْهَارٌ مِّنْ عَسَلٍ مُّصَفًّى ۖ وَلَهُمْ فِيهَا مِن كُلِّ الثَّمَرَاتِ وَمَغْفِرَةٌ مِّن رَّبِّهِمْ ۖ كَمَنْ هُوَ خَالِدٌ فِي النَّارِ وَسُقُوا مَاءً حَمِيمًا فَقَطَّعَ أَمْعَاءَهُمْ
মুত্তাকীদের জন্য যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তার অবস্থা এই যে, তার মধ্যে স্বচ্ছ নির্মল পানির নহর বইতে থাকবে ৷ এমন সব দুধের নহর বইতে থাকবে যার স্বাদে সামান্য কোন পরিবর্তন বা বিকৃতিও আসবে না,শরাবের এমন নহর বইতে থাকবে পানকারীদের জন্য যা হবে অতীব সুস্বাদু এবং বইতে থাকবে স্বচ্ছ মধুর নহর ৷ ছাড়াও তাদের জন্য সেখানে থাকবে সব রকমের ফল এবং তাদের রবের পক্ষ থেকে থাকবে ক্ষমা ৷ (যে ব্যক্তি জান্নাত লাভ করবে সেকি) ব্যক্তির মত হতে পারে যে চিরদিন জাহান্নামে থাকবে, যাদের এমন গরম পানি পান করানো হবে যা তাদের নাড়িভূঁড়ি ছিন্ন ভিন্ন করে দেবে
মারফূ' হাদীসে এর ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে এই যে, "তা পশুর বাঁট বা স্তন থেকে নির্গত দুধ হবে না " অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা দুধ ঝর্ণার আকারে মাটি থেকে বের করবেন এবং নদীর আকারে প্রবাহিত করবেন পশুর পালন বা বাট থেকে দোহন করে তারপর জান্নাতের নদীসমূহে ঢেলে প্রবাহিত করা হবে এমন নয় কুদরতী দুধের পরিচয়ে বলা হয়েছে, "তার স্বাদ, কোন পরিবর্তন আসবে না " অর্থাৎ পশুর পালন থেকে নির্গত দুধে যে এক ধরনের গন্ধ থাকে, তার লেশমাত্রও এতে থাকবে না
মারফূ' হাদীসে এর ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে এই যে, "পদদলন বা মাড়ানো দ্বারা শরাব নির্গত হবে না" অর্থাৎ সে শরাব দুনিয়ার সাধারণ মদের মত ফল পঁচিয়ে পায়ে মাড়িয়ে নির্গত করা হবে না বরং এটাও আল্লাহ তা'আলা ঝর্ণার আকারে সৃষ্টি করবেন এবং নদী -নালার আকারে প্রবাহিত করবেন এর পরিচয় দিতে গিয়ে আরো বলা হয়েছে, "তা হবে পানকারীদের জন্য অতীব সুস্বাদু "অর্থাৎ তা দুনিয়ার মদের মত তীব্র এবং গন্ধযুক্ত হবে না দুনিয়ার মদ তো এমন যে, যত বড় অভ্যস্ত মদখোরই তা পান করুক, মুখ বিকৃত না করে পান করতে পারে না
সূরা সাফ্ফাতে এর আরো পরিচয় দিয়ে বলা হয়েছে যে, তা পান করায় শরীরের কোন ক্ষতিও হবে না এবং বুদ্ধি বিভ্রমও ঘটবে না (আয়াত ৪৭) সূরা ওয়াকিআতে বলা হয়েছে যে, তার কারণে মাথাও ধরবে না কিংবা ব্যক্তির বিবেকও লুপ্ত হবে না (আয়াত ১৯) থেকে জানা গেল যে, তা মাদকতাপূর্ণ হবে না, বরং শুধু স্বাদ আনন্দই দান করবে
মারফু' হাদীসে এর ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে এই যে, তা মৌমাছির পেট থেকে নির্গত মধু হবে না অর্থাৎ মধুও ঝর্ণা থেকে নির্গত হবে এবং নদী-নালায় প্রবাহিত হবে সুতরাং তার মধ্যে মোম, মৌচাকের টুকরা এবং মৃত মৌমাছির পা মিশে থাকবে না। বরং তা হবে নিখাদ নির্ভেজাল মধু
জান্নাতের এসব নিয়ামতের উল্লেখের পর আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমার উল্লেখ করার দুটি অর্থ হতে পারে এক, এসব নিয়ামতের চেয়ে বড় নিয়ামত হচ্ছে এই যে, আল্লাহ তাদের ক্ষমা করে দেবেন দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, পৃথিবীতে তাদের দ্বারা যেসব ক্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছিল জান্নাতে তাদের সামনে কখনো তার উল্লেখ পর্যন্ত করা হবে না বরং যাতে তারা জান্নাতে লজ্জিত না হন সে জন্য আল্লাহ তাদের সব ত্রুটি-বিচ্যুতির ওপর চিরদিনের জন্য পর্দা টেনে দেবেন
২২ নাম্বার আয়াতঃ
مَا أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي أَنفُسِكُمْ إِلَّا فِي كِتَابٍ مِّن قَبْلِ أَن نَّبْرَأَهَا ۚ إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ
পৃথিবীতে এবং তোমাদের নিজেদের ওপর যেসব মুসিবত আসে তার একটিও এমন নয় যে, তাকে আমি সৃষ্টি করার পূর্বে একটি গ্রন্থে (কিতাব অর্থ ভাগ্য লিপি) লিখে রাখিনি ৷ এমনটি করা আল্লাহর জন্য খুবই সহজ কাজ ৷
'তাকে' কথাটি দ্বারা মুসিবতের প্রতিও ইংগিত করা হতে পারে, পৃথিবীর প্রতিও ইংগিত করা হতে পারে, নিজেদের কথাটির প্রতিও ইংগিত করা হতে পারে এবং বাক্যের ধারা অনসারে সৃষ্টিকূলের প্রতিও ইংগিত করা হতে পারে
অর্থাৎ নিজের সৃষ্টিকূলের মধ্যে প্রত্যেকের ভাগ্য আগেই লিখে দেয়া আল্লাহর জন্য কোন কঠিন কাজ নয়
২৩ নাম্বার আয়াতঃ
لِّكَيْلَا تَأْسَوْا عَلَىٰ مَا فَاتَكُمْ وَلَا تَفْرَحُوا بِمَا آتَاكُمْ ۗ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ
( সবই এজন্য) যাতে যে ক্ষতিই তোমাদের হয়ে থাকুক তাতে তোমরা মনক্ষুন্ন না হও ৷ আর আল্লাহ তোমাদের যা দান করেছেন সেজন্য গর্বিত না হও ৷ যারা নিজেরা নিজেদের বড় মনে করে এবং অহংকার করে, আল্লাহ পছন্দ করেন না উদ্ধত ও অহংকারীদেরকে ।
বর্ণনার এই ধারাবাহিকতার মধ্যে যে উদ্দেশ্যে কথাটি বলা হয়েছে তা বুঝার জন্য সূরা নাযিল হওয়ার সময় ঈমানদারগণ যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছিলেন তা সামনে রাখা দরকার। প্রতি মুহুর্তে শত্রুদের হামলার আশংকা একের পর এক যুদ্ধ বিগ্রহ, সর্বদা অবরোধ পরিস্থিতি, কাফেরদের অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে চরম দূরবস্থা, গোটা আরবের সর্বত্র ইসলাম গ্রহণকারীদের ওপর কাফেরদের জুলুম নির্যাতন পরিস্থিতির মধ্যে তখনকার মুসলামানদের সময় অতিবাহিত হচ্ছিলো। কাফেররা একে মুসলমানদের লঞ্ছিত অভিশপ্ত হওয়ার প্রমাণ মনে করতো। পরিস্থিতিকে মুনাফিকরা তাদের সন্দেহের সমর্থনে ব্যবহার করতো। আর একনিষ্ঠ মুমিনগণ যদিও অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছিলেন। তবুও বিপদ মসিবতের আধিক্য কোন কোন সময় তাদের জন্যও চরম ধৈর্য পরিক্ষার কারণ হয়ে দাঁড়াতো। কারণে মুসলমানদের সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বলা হচ্ছে, তোমাদের ওপর কোন বিপদই তোমাদের রবের অবগতির বাইরে নাযিল হয়নি। যা কিছু হচ্ছে তা সবই আল্লাহর পূর্ব পরিকল্পিত সিদ্ধান্ত মোতাবেক হচ্ছে-যা তাঁর দফতরে লিখিত আছে। তোমাদের প্রশিক্ষণের জন্যই এসব সঠিক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে তোমাদের অগ্রসর করানো হচ্ছে। আল্লাহ তা'আলা তোমাদের দিয়ে যে বিরাট কাজ আঞ্জাম দিতে চান তার জন্য প্রশিক্ষণ অত্যন্ত জরুরী। এসব পরীক্ষা ছাড়াই যদি তোমাদেরকে সফলতার স্বর্ণ দুয়ারে পৌছিয়ে দেয়া হয় তাহলে তোমাদের চরিত্রে এমন সব দুর্বলতা থেকে যাবে যার কারণে তোমরা না পারবে মর্যাদা ক্ষমতার গুরুপাক খাদ্য হজম করতে, না পারবে বাতিলের প্রলয়ংকারী তুফানের চরম আঘাত সহ্য করতে।
২৪ নাম্বার আয়াতঃ   الَّذِينَ يَبْخَلُونَ وَيَأْمُرُونَ النَّاسَ بِالْبُخْلِ ۗ وَمَن يَتَوَلَّ فَإِنَّ اللَّهَ هُوَ الْغَنِيُّ الْحَمِيدُ
নিজেরাও কৃপণতা করে এবং মানুষকেও কৃপণতা করতে উৎসাহ দেয় আল্লাহ তাদের পছন্দ করেন না ৷ এরপর যদি কেউ মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে আল্লাহ অভাবশূন্য অতি প্রশংসিত ৷
সে সময় মুসলিম সমাজের মুনাফিকদের যে চরিত্রের সবারই চোখে পড়ছিলে এখানে সেদিকে ইংগিত করা হয়েছে। ঈমানের বাহ্যিক স্বীকারোক্তি অনুসারে মুনাফিকও খাঁটি মুসলমানদের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না। কিন্তু নিষ্ঠা ঐকান্তিকতা না থাকার কারণে খাঁটি ঈমানদারদের যে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছিলো, তারা তাতে শামিল হয়নি। তাই তাদের অবস্থা ছিল এই যে, আরবের অতি সাধারণ একটা শহরে যে নাম মাত্র স্বচ্ছলতা পৌরহিত্য তারা লাভ করেছিলো তাতেই তারা যেন গর্বে স্ফীত হয়ে উঠেছিলো, এবং ফেটে পড়ার উপক্রম হয়েছিলো। তাদের মনের সংকীর্ণতা এমন পর্যায়ের ছিল যে, তারা যে আল্লাহর ওপর ঈমান আনার যে, রসূলের অনুসারী হওয়ার এবং যে দীন মানার দাবী করতো, তার জন্য নিজেরা একটি পয়সাও ব্যয় করবে কি, অন্য দাতাদেরও একথা বলে ব্যয় করা থেকে বিরত রাখতো, যে তোমরা নিজের অর্থ এভাবে অপচয় করছো কেন৷ স্পষ্ট কথা দুঃখ কষ্টের উত্তপ্ত কুণ্ডে যদি জ্বালানো না হতো, তাহলে এইকৃত্রিম পদার্থগুলো -যা আল্লাহর কেনা কাজে লাগার মত ছিল না-খাঁটিসোনা থেকে পৃথক করা যেতো না। আর তাকে আলাদা করা ছাড়া দুর্বল খাঁটি মুসলমানদের এই সংমিশ্রিত সমাবেশকে দুনিয়ার নেতৃত্বের গুরুত্বপূর্ণ মহান পদটি অর্পণ করা যেতো না, যার বহুবিধ মহতী কল্যাণ খিলাফতে রাশেদার যুগে দুনিয়া অবলোকন করেছিলো ।
উপদেশবাণী শোনার পরও যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহ তাঁর দীনের জন্য আন্তরিকতা, আনুগত্য এবং ত্যাগ কুরবানীর পন্থা অবলম্বন না করে এবং নিজের বক্রতা আঁকড়ে ধরে থাকতে চায় যা আল্লাহ অপছন্দ করেন-তাহলে আল্লাহর তাতে কেন পরোয়া নেই । তিনি অভাব শুন্য এসব লোকের কাছে তাঁর কোন প্রয়োজন আটকে নেই, আর তিনি অতিশয় প্রশংসিত, তাঁর কাছে উত্তম গুণাবলীর অধিকারী লোকেরাই গ্রহনযোগ্য হতে পার। দুষ্কর্মশীল লোকেরা তাঁর কৃপা দৃষ্টিলাভের উপযুক্ত হতে পারে না
২৫ নাম্বার আয়াতঃ
لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ ۖ وَأَنزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيهِ بَأْسٌ شَدِيدٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ مَن يَنصُرُهُ وَرُسُلَهُ بِالْغَيْبِ ۚ إِنَّ اللَّهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ
আমি আমার রসূলদের সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ এবং হিদায়াত দিয়ে পাঠিয়েছি ৷ তাদের সাথে কিতাব মিযান নাযিল করেছি যাতে মানুষ ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে ৷ আর লোহা নাযিল করেছি যার মধ্যে বিরাট শক্তি এবং মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ রয়েছে ৷ এটা করা হয়েছে এজন্য যে, আল্লাহ জেনে নিতে চান কে তাঁকে না দেখেই তাঁকে তাঁর রসূলদেরকে সাহায্য করে ৷ নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ অত্যন্ত শক্তিধর মহাপরাক্রমশালী ৷
২৫ নাম্বার আয়াতাংশের ব্যাখ্যা:
لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ
আমি আমার রসূলদের সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ এবং হিদায়াত দিয়ে পাঠিয়েছি ৷ তাদের সাথে কিতাব মিযান নাযিল করেছি যাতে মানুষ ইনসাফের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে ৷
সংক্ষিপ্ত আয়াতাংশে নবী-রসূলের মিশনের পুরা সার সংক্ষেপ বর্ণনা করা হয়েছে, যা ভালভাবে বুঝে নিতে হবে। এতে বলা হয়েছে, আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে পৃথিবীতে যত রসূল এসেছেন, তারা সবাই তিনটি বিষয় নিয়ে এসেছিলেনঃ
একঃ  অর্থাৎ স্পষ্ট নিদর্শনাবলী যা থেকে স্পষ্টরূপে প্রতিভাত হচ্ছিলো, যে তাঁরা সত্যিই আল্লাহর রসূল । তাঁরা নিজেরা রসূল সেজে বসেননি । তাঁরা যা সত্য বলে পেশ করেছেন তা সত্যিই সত্য আর যে জিনিসকে বাতিল বলে উল্লেখ করেন তা যে সত্যিই বাতিল তা প্রমাণ করার জন্য তাঁদের পেশকৃত উজ্জ্বল নিদর্শনসমূহই যথেষ্ট। সুস্পষ্ট হিদায়াতসমূহ, যাতে কোন সন্দেহ-সংশয় ছাড়া বলে দেয়া হয়েছিল-আকায়েদ, আখলাক, ইবাতদ-বন্দেগী এবং আদান -প্রদানে ক্ষেত্রে মানুষের জন্য সঠিক পথ কি- যা তারা অনুসরণ করবে এবং ভ্রান্ত পথসমূহ কি যা তারা বর্জন করবে
দুইঃ কিতাব, মানুষের শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সব দিক নির্দেশনা এতে বর্তমান যাতে মানুষ পথ নির্দেশনার জন্য তার স্বরণাপন্ন হতে পারে
তিনঃ মিযান, অর্থাৎ হক বাতিলের মানদণ্ড যা দাঁড়ি পাল্লার মতই সঠিকভাবে ওজন করে বলে দিবে চিন্তা ধ্যান -ধারণা, নৈতিকতা পারস্পরিক লেনদেনে প্রাচুর্য অপ্রতুলতার বিভিন্ন চরম পন্থার মধ্যে ইনসাফ ন্যায় বিচার কোনটি নবী রসূলদেরকে তিনটি জিনিস দিয়ে যে উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়েছে তা হচ্ছে পৃথিবীতে মানুষের আচরণ এবং মানব জীবনের বিধি-বিধান ব্যক্তিগতও সাময়িগ্রিকভাবেও যেন ন্যায় বিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। একদিকে প্রতিটি মানুষ তার আল্লাহর অধিকার, নিজের অধিকার এবং আল্লাহর সেসব বান্দাদের অধিকার সঠিকভাবে জানবে এবং ইনসাফের কথা আদায় করবে যার সাথে কোন না কোনভাবে তাকে জড়িত হতে হয়। অপর দিক সামাজিক জীবনের বিধি-বিধান এমন নীতিমালার ওপর নির্মাণ করতে হবে যাতে সমাজে কোন প্রকার জুলুম অবশিষ্ট না থাকে। সভ্যতা সংস্কৃতির প্রতিটি দিক ভারসাম্যহীনতা থেকে রক্ষা পায়, সমাজ জীবনের প্রতিটি বিভাগে সঠিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সমাজের সবাই যেন ইনসাফ মত যার অধিকার লাভ করে এবং নিজ নিজ দায়িত্ব কর্তব্য পালন করতে পারে। অন্য কথায় ব্যক্তিগত সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত ছিল নবী-রসূলদের প্রেরণের উদ্দেশ্য। তারা প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত জীবনেও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে উদগ্রীব হয়। তারা গোটা মানব সমাজেও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী ছিলেন যাতে ব্যক্তি এবং ব্যষ্টি উভয়েই পরস্পরের আত্মিক, নৈতিক বৈষয়িক উন্নতির পথে প্রতিবন্ধক সাংঘর্ষিক হওয়ার পরিবর্তে সহযোগী সাহায্যকারী হয় ।
২৫ নাম্বার আয়াতাংশের ব্যাখ্যা: وَأَنزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيهِ بَأْسٌ شَدِيدٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ
আর লোহা নাযিল করেছি যার মধ্যে বিরাট শক্তি এবং মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ রয়েছে ৷
লোহা নাযিল করার অর্থ মাটির অভ্যন্তরে লোহা সৃষ্টি করা । যেমন কুরআন মজীদের অন্য এক জায়াগায় বলা হয়েছে । তিনি তোমাদের জন্য গবাদী পশুর আটটি জোড়া নাযিল করেছেন । (আয যুমার ) পৃথিবীতে যা কিছু পাওয়া যায় তা যেহেতু আপনা থেকেই সৃষ্টি হয়নি, আল্লাহর নির্দেশে এখানে এসেছে। সুতরাং কুরআন মজীদে তা সৃষ্টি করাকে নাযিল করা বলে উল্লেখ করা হয়েছে ।
নবী-রসূলদের মিশন কি তা বর্ণনা করার পর পরই আমি লোহা নাযিল করেছি, তার মধ্য বিপুল শক্তি মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ রয়েছে। বলায় আপনা থেকেই বিষয়ে ইংগিত পাওয়া যায় যে, এখানে লোহা অর্থে রাজনৈতিক সামরিক শক্তিকে বুঝানো হয়েছে। বাক্যের প্রতিপাদ বিষয় হচ্ছে আল্লাহ তা'আলা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য শুধু একটা পরিকল্পনা পেশ করার উদ্দেশ্যে রসূলদের পাঠান নাই। কার্যত তা প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা চালানো সে উদ্দেশ্যে শক্তি সঞ্চয় করাও তাদের মিশনের অন্তরভুক্ত ছিল । যাতে প্রচেষ্টার ধ্বংস সাধনকারীদের শাস্তি দেয়া যায় এবং এর বিরুদ্ধে বাধা সৃষ্টিকারীদের শক্তি নির্মূল করা যায় ।
২৫ নাম্বার আয়াতাংশের ব্যাখ্যা: وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ مَن يَنصُرُهُ وَرُسُلَهُ بِالْغَيْبِ ۚ إِنَّ اللَّهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ
এটা করা হয়েছে এজন্য যে, আল্লাহ জেনে নিতে চান কে তাঁকে না দেখেই তাঁকে তাঁর রসূলদেরকে সাহায্য করে ৷ নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ অত্যন্ত শক্তিধর মহাপরাক্রমশালী ।
অর্থাৎ আল্লাহ দুর্বল, তিনি আপন শক্তিতে কাজ করতে সক্ষম নন, তাই তার সাহায্য প্রয়োজন, ব্যাপারটা তা নয় । তিনি মানুষকে পরীক্ষার জন্য কর্ম পন্থা গ্রহণ করেছেন। পরীক্ষার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েই মানুষ তার উন্নতি সফলতার পথে এগিয়ে যেতে পারে। আল্লাহ তা'আলার সব সময় ক্ষমতা আছে যে, যখন ইচ্ছা তিনি তাঁর একটি ইংগিতেই সমস্ত কাফেরদের পরাস্ত করে তাদের ওপর তার রসূলদের আধিপত্য দান করতে পারেন। কিন্তু তাতে রসূলদের ওপর ঈমান আনয়নকারীদের কি কৃতিত্ব থাকবে যে, তারা পুরস্কারের যোগ্য বলে বিবেচিত হবে ৷ তাই আল্লাহ তা'আলা কাজকে তাঁর বিজয়ী শক্তির সাহায্যে আঞ্জাম দেয়ার পরিবর্তে কর্মপন্থা গ্রহণ করেছেন যে, তাঁর রসূলদের 'বাইয়েনাত' স্পষ্ট নিদর্শনাদী, কিতাব মিযান দিয়ে মানুষের কাছে প্রেরণ করেছেন। তাদেরকে আদেশ দিয়েছেন যে, তারা যেন মানুষের সামনে ন্যায়নীতির বিধান পেশ করেন এবং জুলুম-নির্যাতন বে-ইনসাফী থেকে বিরত থাকার জন্য আহবান জানান। মানুষকে ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন যে, যার ইচ্ছা রসূলদের দাওয়াত কবুল করবে এবং যার ইচ্ছা প্রত্যাখ্যান করবে। যারা কবুল কারলো তাদের আহবান জানিয়েছেন;এসো এই ন্যায়বিচারপূর্ণ জীবন বিধান প্রতিষ্ঠা করতে আমার আমার রসূলদের সহযোগী হও এবং যারা জুলুম নির্যাতনমূলক বিধান টিকিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর, তাদের বিরুদ্ধে প্রাণপণ সংগ্রাম করো। আল্লাহ তা'আলা এভাবে দেখতে চান, মানুষের মধ্যে কারা ইনসাফ ন্যায় বিচারের বাণী প্রত্যাখান করে আর কারা ইনসাফ ন্যায়বিচারের মোকাবিলায় বে-ইনসাফী কায়েম রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। ইনসাফের বাণী গ্রহণ করার পর তার সাহায্য-সহযোগিতা সে উদ্দেশ্যে সংগ্রাম করা থেকে পালিয়ে বেড়ায় । আর কারা আল্লাহকে না দেখেও তাঁরই কারণে ন্যায় সত্যকে বিজয়ী করার জন্য প্রাণ-সম্পদও বাচিয়ে রাখছে। যার পরীক্ষায় সফল হবে, ভবিষ্যতে তাদের জন্যই বহুবিধ উন্নতির পথ খুলে যাবে ।
শিক্ষাঃ
১. দুনিয়ার জীবন, একটা খেলা, হাসি তামাসা, বাহ্যিক চাকচিক্য, আমাদের পারস্পরিক গৌরব অহংকার এবং সন্তান সন্তুতি অর্থ-সম্পদে পরস্পরকে অতিক্রম করার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয় ৷
২. দুনিয়ার জীবন আখিরাতের জবাদিহীতার অনুভূতি নিয়ে প্রতিটি কাজ পরিচালনা করা ।
৩. হারাম থেকে বেঁচে, হালালের গন্ডিতে থেকে, কারো কাছে হাত না পেতে জীবন যাপন করতে পারার মতো আর্থ সম্পদের মালিক হওয়া অভিপ্রেত । প্রয়োজন পূরণের মতো আর্থ সম্পদের মালিক হওয়া সত্তেও অবিরাম আর্থ সম্পদের পেছনে দৌড়ানো অভিপ্রেত নয় ।

বাংলাদেশ ইসলামী দাওয়াহ সেন্টোর
www.bidcenter.blogspot.com
মোবাইলঃ 01742344107