ইসলামী জীবন-ব্যবস্থায় হাদীসের গুরুত্বের বিষয়টি আলোচনা বাহ্যত নিষ্প্রয়োজনীয়। কুরআন কারীমের অনেক নির্দেশ, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর
অগণিত নির্দেশ ও সাহাবীগণের কর্ম-পদ্ধতি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে যে,
‘হাদীস’ ইসলামী জীবন-ব্যবস্থার দ্বিতীয় উৎস ও ভিত্তি। বস্ত্তত মুসলিম
উম্মাহর সকল যুগের সকল মানুষ এ বিষয়ে একমত। সাহাবীগণের যুগ থেকে শুরু করে
সকল যুগে হাদীস শিক্ষা, সংকলন, ব্যাখ্যা এবং হাদীসের আলোকে মানব জীবন
পরিচালিত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এভাবে গড়ে উঠেছে হাদীস বিষয়ক
সুবিশাল জ্ঞান-ভান্ডার।
তবে কতিপয় ইহূদী-খৃস্টান ‘প্রাচ্যবিদ’
পন্ডিত ও মুসলিম উম্মাহর কোনো কোনো ‘পন্ডিত’ বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন ভাবে
হাদীসের গুরুত্ব অস্বীকার করতে চেষ্টা করেছেন। তাঁদের বক্তব্যের পক্ষে
উপস্থাপিত ‘দলীল’-সমূহকে আমরা চার ভাগে ভাগ করতে পারি:
(১) কুরআন কারীমের কিছু আয়াতের আলোকে দাবি করা যে, ‘কুরআনেই সব কিছুর বর্ণনা’ রয়েছে, কাজেই ‘হাদীস’ নিষ্প্রয়োজনীয়।
(২) হাদীসের বর্ণনা ও
সংকলন বিষয়ক কিছু আপত্তি উত্থাপন করে দাবি করা যে, হাদীসের মধ্যে অনেক
জালিয়াতি প্রবেশ করেছে, কাজেই তাঁর উপর নির্ভর করা যায় না।
(৩) কিছু হাদীস উল্লেখ করে হাদীসের মধ্যে বিজ্ঞান বা জ্ঞান বিরোধী কথাবার্তা বা বৈপরীত্য আছে বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করা।
(৪) কিছু হাদীস থেকে তাঁরা প্রমাণ (!) পেশ করেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণ হাদীসের উপর গুরুত্ব প্রদান করতে নিষেধ করেছেন।
এ বিষয়ক বিস্তারিত আলোচনা আমাদের গ্রন্থের
পরিসরে সম্ভব নয়। তবে আমরা আমাদের এ গ্রন্থে হাদীসের জালিয়াতি ও সহীহ
হাদীস থেকে জাল হাদীসকে পৃথক করার বিষয়ে আলোচনা করছি। আমাদের সকল আলোচনা
এবং সাহাবীগণের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহর সকল শ্রমের মূল
ভিত্তিটিই হলো এটা যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীসের অনুসরণ ছাড়া কুরআন পালন, ইসলাম পালন বা মুসলমান হওয়া যায় না। আমাদের জীবন চলার অন্যতম পাথেয় হাদীসে রাসূল (ﷺ)। তবে আমাদের অবশ্যই বিশুদ্ধ ও প্রমাণিত হাদীসের উপর নির্ভর করতে হবে।
হাদীস বাদ দিলে আর কোনোভাবেই কুরআন মানা
বা ইসলাম পালন করা যায় না। হাদীসের বিরুদ্ধে এ সকল মানুষের উত্থাপিত
যুক্তিগুলোর মধ্যে প্রথম যুক্তিটি আমরা আলোচনা করতে পারি। আমরা দেখতে পাব
যে, কুরআন মানতে হলে হাদীস মানা আবশ্যক। নিম্নের বিষয়গুলো লক্ষ্য করুন:
(১) ‘ওহী’র মাধ্যমে যে
নির্দেশনা মানব জাতি লাভ করে তার বাস্তব প্রয়োগ ও পালনের সর্বোচ্চ আদর্শ হন
‘ওহী-প্রাপ্ত নবীগণ’ ও তাঁদের সাহচর্য প্রাপ্ত শিষ্য বা সঙ্গীগণ। তাঁদের
জীবনাদর্শই মূলত অন্যদের জন্য ‘ওহী’র অনুসরণ ও পালনের একমাত্র চালিকা
শক্তি। এ জন্য সকল সম্প্রদায়ের মানুষেরা ধর্ম-প্রচারক ও তাঁর শিষ্য,
প্রেরিত বা সহচরদের জীবন, কর্ম ও আদর্শকে ‘ধর্ম’ পালনের মূল উৎসরূপে
সংরক্ষণ ও শিক্ষা দান করেন। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর
জীবন, কর্ম, ত্যাগ, ধৈর্য, মানবপ্রেম, আল্লাহর ভয়, সত্যের পথে
আপোষহীনতা... ইত্যাদি ‘হাদীস’ ছাড়া জানা সম্ভব নয়। একজন মুসলমানকে হাদীস
থেকে বিচ্ছিন্ন করার অর্থই হলো তাঁকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাস্তব জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা। এতে অতি সহজেই তাঁকে কুরআন থেকে এবং ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা সম্ভব হয়।
(২) হাদীসের উপর নির্ভর না করলে ‘কুরআন’-এর পরিচয় লাভ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর
জীবন, পরিচয়, বিশ্বস্ততা, সততা, নবুয়ত ইত্যাদি কোনো তথ্যই হাদীসের মাধ্যমে
ছাড়া জানা সম্ভব নয়। তিনি কিভাবে কুরআন লাভ করলেন, শিক্ষা দিলেন, সংকলন
করলেন... ইত্যাদি কোনো কিছুই হাদীসের তথ্যাদি ছাড়া জানা সম্ভব নয়।
(৩) হাদীসের উপর নির্ভর
না করলে ‘কুরআন’ মানাও সম্ভব নয়। কুরআন কারীমে ‘সকল কিছুর’ বর্ণনা রয়েছে।
কিন্তু তা সবই শুধুমাত্র ‘মূলনীতি’ বা ‘প্রাথমিক নির্দেশনা’ রূপে। কুরআন
কারীমের অধিকাংশ নির্দেশই ‘প্রাথমিক নির্দেশ’, ব্যাখ্যা ছাড়া যেগুলো পালন
করা অসম্ভব। ইসলামের সর্বোচ্চ ও সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম ‘সালাত’ বা নামায। কুরআন
কারীমে শতাধিক স্থানে সালাতের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, কিন্তু সালাতের পদ্ধতি
ব্যাখ্যা করা হয় নি। বিভিন্ন স্থানে রুকু করার ও সাজদা করার নির্দেশ দেয়া
হয়েছে। বলা হয়েছে ‘যেভাবে তোমাদেরকে সালাত শিখিয়েছি সেভাবে সালাত আদায় কর’।
কিন্তু কুরআন কারীমে কোথাও সালাতের এ পদ্ধতিটি শেখানো হয় নি। ‘সালাত’ বা
‘নামায’ কী, কখন তা আদায় করতে হবে, কখন কত রাক‘আত আদায় করতে হবে, প্রত্যেক
রাক‘আত কী পদ্ধতিতে আদায় করতে হবে, প্রত্যেক রাক‘আতে কুরআন পাঠ কিভাবে হবে,
রুকু কয়টি হবে, সাজদা কয়টি হবে, কিভাবে রুকু ও সাজদা আদায় করতে হবে....
ইত্যাদি কোনো কিছুই কুরআনে শিক্ষা দেয়া হয় নি। কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ
নির্দেশকে আমরা কোনোভাবেই হাদীসের উপর নির্ভর না করে আদায় করতে পারছি না।
এভাবে কুরআন কারীমের অধিকাংশ নির্দেশই হাদীসের ব্যাখ্যা ছাড়া পালন করা
সম্ভব নয়।
(৪) কুরআন কারীমে কিছু
নির্দেশ বাহ্যত পরস্পর বিরোধী। যেমন কোথাও মদ, জুয়া ইত্যাদিকে বৈধ বলে
উল্লেখ করা হয়েছে, কোথাও তা অবৈধ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কোথাও কাফির ও
অবিশ্বাসীদের সাথে যুদ্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং কোথাও সকল প্রকার
বিরোধিতা ও যুদ্ধ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হাদীসের নির্দেশনা
ছাড়া এ সকল নির্দেশের কোনটি আগে, কোন্টি পরে এবং কিভাবে সেগুলো পালন করতে
হবে তা জানা যায় না। এজন্য হাদীস বাদ দিলে এ সকল আয়াতের ইচ্ছামত ও মনগড়া
ব্যাখ্যা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা খুবই সহজ হয়ে যায়।
মূলত এজন্যই ইহূদী, খৃস্টান, কাদিয়ানী,
বাহাঈ প্রমুখ সম্প্রদায় হাদীসের বিরুদ্ধে ঢালাও অপপ্রচার চালান। তাঁদের
উদ্দেশ্য মুসলিম উম্মাহকে কুরআন ও ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া। তাঁরাও
জানেন যে, হাদীসের সাহায্য ছাড়া কোনোভবেই কুরআন মানা যায় না। শুধুমাত্র
সরলপ্রাণ মুসলিমকে ধোঁকা দেয়ার জন্যই তারা মূলত ‘কুরআনের’ নাম নেন।
(৫) আমরা দেখেছি যে, আল্লাহ তাঁর রাসূল (ﷺ)-কে
দুটি বিষয় প্রদান করেছেন: ‘কিতাব’ (পুস্তক) ও ‘হিকমাহ’ (প্রজ্ঞা)।
স্বভাবতই কুরআনও প্রজ্ঞা ও হিকমাহ। তবে বারংবার পৃথকভাবে উল্লেখ করা থেকে
আমরা জানতে পারি যে, কুরআনের অতিরিক্ত ‘প্রজ্ঞা’ বা জ্ঞান আল্লাহ তাঁর
প্রিয় রাসূলকে (ﷺ) প্রদান
করেছিলেন এবং তিনি কুরআন ছাড়াও অতিরিক্ত অনেক শিক্ষা মানব জাতিকে প্রদান
করেছেন এ ‘প্রজ্ঞা’ থেকে। আমরা জানি যে, কুরআনের অতিরিক্ত যে শিক্ষা তিনি
প্রদান করেছিলেন তাই ‘হাদীস’-রূপে সংকলিত। ‘হাদীস’ ছাড়া তাঁর ‘প্রজ্ঞা’
জানার ও মানার আর কোনো উপায় নেই। কাজেই কুরআনের নির্দেশ অনুসারেই আমাদেরকে
কুরআন ও হাদীসের অনুসরণে জীবন পরিচালিত করতে হবে।
(৬) কুরআনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আনুগত্য করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আনুগত্য ছাড়াও তাঁকে ‘অনুসরণ’ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمْ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ
‘‘বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে
আমাকে অনুসরণ কর, এতে আল্লাহ তোমাদিগকে ভালবাসবেন এবং তোমাদিগকে তোমাদের
পাপ মার্জনা করবেন।’’[1]
আমরা জানি যে, আনুগত্য অর্থ আদেশ-নিষেধ
পালন করা। আর কারো অনুসরণের অর্থ অবিকল তাঁর কর্মের মত কর্ম করা। হাদীসের
উপর নির্ভর না করলে কোনোভাবেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনুসরণ করা সম্ভব নয়। কুরআন কারীমে আদেশ নিষেধ উল্লেখ করা হলেও কোথাও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর
কর্ম ও জীবনরীতি আলোচিত হয় নি। এজন্য কুরআন দেখে রাসূলুল্লাহর ‘অনুসরণ’
করা কোনো মতেই সম্ভব নয়। কাজেই ‘কুরআনের নির্দেশ অনুসারে আল্লাহর প্রেম ও
ক্ষমা লাভ করতে হলে অবশ্যই হাদীসের বর্ণনা অনুসারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনুসরণ করতে হবে।
(৭) মহান আল্লাহ -সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা- বলেন,
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ
‘‘নিশ্চয় তোমাদের জন্যে রাসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে...।’’[2]
ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সমাজ জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন ইত্যাদি ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাস্তব জীবনরীতি কুরআনে উল্লেখ করা হয় নি। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, কুরআনের নির্দেশে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আদর্শ অনুসরণ করতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই হাদীসের উপর নির্ভর করতে হবে।
(৮) অন্যত্র মহান আল্লাহ-জাল্লা শানুহু- বলেন:
مَا آَتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا
‘‘রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক।’’[3]
আমরা জানি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)
তাঁর সুদীর্ঘ নবুওয়তি জীবনে অনেক অনেক শিক্ষা প্রদান করেছেন তাঁর
সাহাবীগণকে। জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে খুটিনাটি অনেক দিকনির্দেশনা তিনি প্রদান
করেছেন। এ সকল শিক্ষা ও নির্দেশনাও ‘রাসূল তোমাদেরকে যা দিয়েছেন’-এর
অন্তর্ভুক্ত। কাজেই ‘রাসূল যা দিয়েছেন’ সবকিছু গ্রহণ করতে হলে অবশ্যই
আমাদেরকে কুরআনের পাশাপাশি হাদীসের উপর নির্ভর করতে হবে।
হাদীস সংকলন, লিখন, বর্ণনা ও জালিয়াতি
বিষয়ক তাঁদের অন্যান্য আপত্তির বিষয় আমরা এ পুস্তকের অন্যান্য আলোচনা থেকে
জানতে পারব। তবে এখানে আমরা বুঝতে পারছি যে, কুরআনের নির্দেশনা অনুসারেই
আমাদেরকে হাদীসের আলোকে জীবন গঠন করতে হবে, হাদীসের আলোকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হুবহু অনুকরণ করতে হবে, হাদীসের আলোকে রাসূলের (ﷺ)
আদর্শে জীবন গড়তে হবে এবং হাদীসের ভিত্তিতেই আমাদেরকে কুরআনের নির্দেশাবলি
পালন করতে হবে। আমরা আরো দেখছি যে, হাদীস ছাড়া কোনো অবস্থাতেই কুরআন পালন
বা ইসলামী জীবন গঠন সম্ভব নয়।
হাদীসের গুরুত্বের বিষয়ে মুসলিম উম্মাহ
মূলত একমত। আর এজন্যই হাদীসের নামে জালিয়াতি ও মিথ্যা প্রতিরোধের সর্বোত্তম
নিরীক্ষা ও বিচার পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন তাঁরা। তাঁদের নিরীক্ষা ও বিচার
পদ্ধতির আলোচনার আগে আমরা মিথ্যার পরিচয় ও ওহীর নামে মিথ্যার বিধান আলোচনা
করব। মহান আল্লাহর কাছে তাওফীক প্রার্থনা করছি।