ড.
আহমদ আল রাইসুনী – সমসাময়িক ইসলামী স্কলারদের মাঝে প্রথম সারির একজন। তাঁর
জন্ম ১৯৫৩ সালে, মরক্কোতে। বর্তমানে তিনি মুসলিম স্কলারদের আন্তর্জাতিক
সংগঠন International Union of Muslim Scholars-এর সহ-সভাপতি। ‘শূরা: মতামত
গ্রহণের কোরআনিক নীতি’ তাঁর লেখা বিখ্যাত ও বহুল আলোচিত বইগুলোর একটি। আল
জাজিরাসহ পৃথিবীর বিখ্যাত অনেক মিডিয়ায় তিনি ইসলামী রাষ্ট্র, মাকাসিদে
শরীয়াহ, গণতন্ত্র, শূরা ইত্যাদি নিয়ে অসংখ্য বক্তব্য ও সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।
২০০৭ সালের ১২ আগস্ট আল জাজিরা অ্যারাবিকের ‘শরীয়াহ ও জীবন’ অনুষ্ঠানে শূরা ও গণতন্ত্র নিয়ে তিনি একটি সাক্ষাৎকার দেন।
অনুষ্ঠানটির উপস্থাপক ছিলেন উসমান উসমান। সেখান থেকে প্রাসঙ্গিক একটি ছোট
অংশ অনুবাদ করলাম। ইউটিউব ভিডিওতে সাবটাইটেলও যোগ করে দিয়েছি।
আল জাজিরা: শূরা এবং গণতন্ত্রের মাঝে আসলে পার্থক্য কী?
আহমদ রাইসুনী:
প্রথমে সংক্ষেপে বলি, এরপর ব্যাখ্যা করব। গণতন্ত্র শূরারই একটি অংশ। এটি
এমন এক টুল বা পদ্ধতি, যা দিয়ে রাজনীতিকে সংগঠিত ও সুশৃঙ্খল করা হয়।
কিন্তু শূরা হলো আকীদা, বিশ্বাস, চরিত্র, আচার-ব্যবহার, সংস্কৃতি – এক কথায় সবকিছুই। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। কোরআনের অনেক আয়াতে ‘শূরা’ শব্দটি পরিবার, দাম্পত্য জীবন এবং সন্তান লালন-পালন প্রসঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, সন্তানের দুধ ছাড়ানোর ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন–
কিন্তু শূরা হলো আকীদা, বিশ্বাস, চরিত্র, আচার-ব্যবহার, সংস্কৃতি – এক কথায় সবকিছুই। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। কোরআনের অনেক আয়াতে ‘শূরা’ শব্দটি পরিবার, দাম্পত্য জীবন এবং সন্তান লালন-পালন প্রসঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, সন্তানের দুধ ছাড়ানোর ব্যাপারে আল্লাহ বলেছেন–
“পিতামাতা যদি ইচ্ছা করে, তাহলে দু’বছরের মধ্যেই পারস্পরিক পরামর্শের মাধ্যমে সন্তানের দুধ ছাড়িয়ে দিতে পারে।” (সূরা বাকারা: ২৩৩)
অর্থাৎ,
এখনই শিশুকে দুধ ছাড়াবে, নাকি আরো দুই মাস চালিয়ে যাবে– এক্ষেত্রেও
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শূরা অর্থাৎ পরামর্শ করা ও সম্মতি নেয়া ওয়াজিব। যে
কোনো একজন কাজটা করে ফেললে হবে না, স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই সিদ্ধান্তে
পৌঁছাতে হবে। পরিবারে স্বামী-স্ত্রী পরামর্শ করার ব্যাপারে অন্য একটি আয়াতে
আল্লাহ বলেছেন,
“তোমরা নিজেদের মাঝে ভালোভাবে পরামর্শ করবে।” (সূরা তালাক: ৬)
এই আয়াতে ‘আল-ই’তিমার’ (الإئتِمار)
শব্দের অর্থ পরস্পর পরামর্শ করা এবং আলাপ-আলোচনা করা। পরিবারের এই
ব্যাপারটা গণতন্ত্রের বিষয় নয়, এটি শূরার বিষয়। একজন মানুষের ব্যক্তি জীবনে
গণতন্ত্র দ্বারা তেমন কিছু যায় আসে না, কিন্তু শূরা বা পরামর্শের প্রয়োজন
রয়েছে। কোথাও ভ্রমণে বের হওয়া, কোনো পেশা পছন্দ করা, কিংবা বিয়ের আগে
আপনাকে পরামর্শ গ্রহণ করতে হয়।
একটি বিষয়
হলো পরামর্শ চাওয়া ও আরেকটি হলো সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। দুটি বিষয়ই
পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। তাই শূরার পরিধি বেশ প্রশস্ত। মানুষের দৈনন্দিন
আচার-আচরণ, ইবাদত – এই সবকিছুই শূরার অন্তর্ভুক্ত। রাজনীতির ক্ষেত্রে শূরা
শব্দটির অর্থ হলো গণতন্ত্রকে সুশৃঙ্খল বা সংগঠিত করা। শূরার ক্ষেত্রে
পারস্পরিক পরামর্শ গ্রহণ করাটাই আসল ব্যাপার। কিন্তু গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে
পারস্পরিক পরামর্শ করাটা মূল বিষয় নয়, ফলাফল বা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোই মুখ্য
ব্যাপার। এ কারণেই মানুষ সংসদে একত্রিত হয়। সেখানে মুখ্য বিষয় হলো সকলে
মিলে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো। শূরার ক্ষেত্রে মুক্তচিন্তা ও খোলা মনে
পারস্পরিক পরামর্শ করা খুব প্রয়োজন। এখানে ফলাফল তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। যদি
পারস্পরিক পরামর্শের বিষয়টা শুদ্ধ ও সুন্দর হয়ে থাকে, তাহলে একটা শুদ্ধ ও
সুন্দর সিদ্ধান্ত আসবেই।
এখন
গণতন্ত্রের মাঝে যদি সামাজিক কর্মকাণ্ড, নৈতিকতা ও ভালো আচার-ব্যবহার
ইত্যাদি থাকে, তাহলে সেই গণতন্ত্র উদার ও ভালো। গণতন্ত্রের ব্যাপারে
আমাদেরকে স্বীকার করতে হবে– এখানে সাধারণত যেসব মেকানিজম, মডেল ও পদ্ধতি
রয়েছে, তা সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্রের জন্যে একটা বড় ভারসাম্য তৈরি করে।
কিন্তু শূরার ক্ষেত্রে এমন নির্দিষ্ট কোনো মডেল বা পদ্ধতি নেই।
আল জাজিরা: উস্তাদ, কেউ কেউ বলেন, ‘গণতন্ত্র হলো কুফরি পদ্ধতি, এটি জায়েজ নেই।’ এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?
আহমদ রাইসুনী:
কুফর বলতে কী বুঝায়, আমরা সবাই তা জানি। আল্লাহকে অস্বীকার করা, কোরআনকে
অস্বীকার করা, রাসূলকে (সা) অস্বীকার করা– এসব হলো কুফর। অথচ গণতন্ত্র বলে–
এসো, তোমাদের নিজেদের জন্যে নির্বাচন করো, তোমরা ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে
ভাগাভাগি করে নাও। এটা কীভাবে কুফর হয়, তা আমার বুঝে আসে না। মুসলমানরাও তো
অতীতে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। কারণ, ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নিলে সেটা
সামনের দিকে অগ্রসর হয়। ক্ষমতা সমাজের অনেক ব্যক্তির হাতে থাকা যেমন সম্ভব,
তেমনি একক কোনো ব্যক্তির হাতে থাকাও সম্ভব।
যখন কোনো
একটি কাজ বা দায়িত্ব বড় কিংবা জটিল হয়ে যায়, তখন তা ভাগাভাগি করে নিতে হয়।
সবকিছুতেই তো ভাগাভাগি করার ব্যাপারটা আছে। এমনকি, বিল্ডিং বা জ্ঞানের
ক্ষেত্রেও। জ্ঞান যত বাড়ছে ততই তা ভাগ, ভাগ হয়ে যাচ্ছে। আবার, একই পরিবারের
প্রত্যেক সন্তানের জন্যে আলাদা আলাদা কক্ষ বা বাড়ি নির্ধারণ করে দেয়া হয়।
গণতন্ত্রের এই ব্যাপারটা হলো একটি সাংগঠনিক পদ্ধতিগত ব্যাপার মাত্র।
তাই আমি
বলি, ধর্মের সাথে গণতন্ত্র সম্পর্কিত নয়। আবার, এটি ধর্মের বিপরীতও নয়।
গণতন্ত্র হচ্ছে এক বা একাধিক সামাজিক অভিজ্ঞতা, যা রাজনীতি ও সাধারণ
বিষয়াদির সাথে সম্পর্কিত। ফলে আমরা অনেক মানুষকে দেখি, যারা কাফের হলেও
গণতন্ত্রপন্থী নয়। আবার অনেকে গণতন্ত্রপন্থী হওয়া সত্ত্বেও নামাজ পড়েন এবং
জাকাত দেন। এটা হলো একটা পদ্ধতিগত ব্যাপার ও একটা পরিভাষা মাত্র। এর বেশি
কিছু নয়।
কিছু
মানুষ বলে– গণতন্ত্রের উৎপত্তি হয়েছে গ্রীসে, আর তারা হলো মুশরিক বা
পৌত্তলিক। পরবর্তীতে এই গণতন্ত্র বিস্তৃত হয়ে পশ্চিমে গিয়েছে, আর তারা হলো
সেক্যুলার। জনাব, গণতন্ত্রকে পৌত্তলিকতা বা এ জাতীয় কিছুর সাথে মিলিয়ে
ফেলতে আপনাকে কে বলল! পৌত্তলিকতা আলাদা একটি বিষয়। একে তার জায়গায় আলাদাই
রাখুন।
পৌত্তলিকতা
এবং সেক্যুলারিজম থেকে গণতন্ত্রের উৎপত্তি হয়নি। এর পক্ষে যুক্তি হলো,
গণতন্ত্র কোথাও আছে সেক্যুলারিজমের সাথে, কোথাও আছে খ্রিস্টবাদের সাথে,
আবার কোথাও আছে পৌত্তলিকতার সাথে। তাই গণতন্ত্র যদি সেক্যুলার, পৌত্তলিক বা
খ্রিস্টীয় কোনো যুগের সাথে মিলে যায়, তাহলে তা একান্তই কাকতলীয় ব্যাপার
এবং তা কেবলই ইতিহাসের একটি আলোচ্য বিষয়। এর বেশি কিছু নয়।