ফসলের যাকাত আদায় করার বিধাণ !

ফসলের যাকাত আদায় করার বিধাণ ! 
মূলঃ ড.আ.ছ.ম.তরীকুল ইসলাম
সম্পাদনাঃ মুহাম্মদ হামিদুল ইসলাম আযাদ
ইসলামের পক্ষ থেকে নির্ধারিত সম্পদের যাকাত ফারয। সম্পদের যাকাতের মত, ফসলের যাকাতও ফারয। আল-কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ইরশাদ করেছেন, وآتوا حقه يوم حصاده ‘ফসল কাটার দিন তাদের হক তাদেরকে দিয়ে দাও।’’১
এখানে আল্লাহর স্পষ্ট নির্দেশের কারণে ফসলের যাকাত ফারয । তাছাড়া এ প্রসঙ্গে ছাহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ سَالِمِ بْنِ عَبْدِ اللّهِ عَنْ أَبِيهِ رَضِيَ اللّهُ عَنْهُ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: فِيمَا سَقَتْ السَّمَاءُ وَالْعُيُونُ أَوْ كَانَ عَثَرِيًّا الْعُشْرُ وَمَا سُقِيَ بِالنَّضْحِ نِصْفُ الْعُشْرِ.
সালিম ইবন ‘আবদিল্লাহ রাদিআল্লাহু ‘আনহু তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘বৃষ্টি ও ঝর্ণার পানিতে অথবা প্রাকৃতিকভাবে সিক্ত মাটি হতে উৎপাদিত ফসলের এক দশমাংশ এবং সেচ দ্বারা উৎপাদিত শস্যের এক দশমাংশের অর্ধেক (যাকাত হিসেবে) দিতে হবে।’২
অন্যত্র আরো বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ قَالَ بعَثَنِي رَسُولُ اللّهِ صَلَّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى الْيَمَنِ وَأَمَرَنِي أَنْ آخُذَ مِمَّا سَقَتْ السَّمَاءُ وَمَا سُقِيَ بَعْلًا الْعُشْرَ وَمَا سُقِيَ بِالدَّوَالِي نِصْفَ الْعُشْرِ
মু‘আয ইবন জাবাল রাদিআল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে ইয়ামানে এ নির্দেশ দিয়ে প্রেরণ করেন যে, আমি যাতে বৃষ্টিতে সিক্ত হয়ে উৎপাদিত শস্যের এক-দশমাংশ এবং সেচ দ্বারা উৎপাদিত শস্যের এক-দশামাংশের অর্ধেক (যাকাত হিসাবে) গ্রহণ করি।’৩
আরো বর্ণিত হয়েছে-
أن أَبَا سَعِيدٍ الْخُدْرِيَّ يَقُولُ قَالَ رَسُولُ اللّهِ صَلَّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيْسَ فِيمَا دُونَ خَمْسَةِ أَوْسُقٍ صَدَقَةٌ.
‘নিশ্চয় আবূ সা‘ঈদ আল-খুদরী রাদি আল্লাহু ‘আনহু বলতেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, পাঁচ ওয়াসাকের কম হলে যাকাত নেই।’৪
আরো বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ رَضِيَ اللّهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللّهِ صَلَّى اللّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لَيْسَ فِيمَا دُونَ خَمْسَةِ أَوْسُقٍ مِنْ التَّمْرِ صَدَقَةٌ
‘আবূ সা‘ঈদ আল-খুদরী রাদি আল্লাহু ‘আনহু বলতেন, নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, পাঁচ ওয়াসাকের কম খেজু্র উৎপাদিত হলে তার যাকাত নেই।’৫ এক ওয়াসাক হচ্ছে, ১২৯ কিলোগ্রাম, সুতরাং ৫ ওয়াসাক হচ্ছে, ৬৪৫, কেজি বা পঁচিশ মণ পাঁচ কেজির সমান।৬
উল্লেখিত এ হাদীছসমূহ অনুধাবন করলে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, কোন মৌসুমে কেউ কম পক্ষে পঁচিশ মণ পাঁচ কেজি কোন ফসল উৎপাদন করলে, সেচ দ্বারা তা উৎপন্ন হলে, বিশ ভাগের একভাগ, আর সেচ দ্বারা উৎপন্ন না হয়ে এমনিতে উৎপন্ন হলে, তার দশভাগের একভাগ যাকাত হিসাবে দিয়ে দেয়া অপরিহার্য। এ যাকাত আদায় করাই হচ্ছে, উল্লিখিত ছাহীহ হাদীছগুলোর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করার একান্ত দাবী।
পক্ষান্তরে যে কোন বাহানায় এ যাকাত কেউ আদায় না করলে, তিনি হাদীছ পরিপালনে ব্যর্থ হয়েছেন বলে গণ্য হওয়াই স্বাভাবিক। উল্লেখ্য যে, অনেকে বিশেষ কোন আলিম সম্প্রদায় বা মাযহাবের অনুকরণ করে ফসলের এ যাকাত না দেয়ার যুক্তি হিসেবে, উক্ত জমির খাজনা দেন বলে কারণ উল্লেখ করে থাকেন। হাঁ, এটা যথার্থ যে, খারাজী জমির উৎপাদিত ফসলের যাকাত দিতে হয় না । তবে ইসলামের বিজ্ঞ ফকীহদের মতামত অনুযায়ী, আমাদের দেশে, আমরা আমাদের সরকারকে যে খাজনা দেই, তা ও খারাজ যে এক নয়, আমরা অনেকেই বুঝি না। খারাজী জমির গ্রহণ যোগ্য সংজ্ঞা বিবেচনা করলে দুই ধরণের জমিকে খারাজী জমি বলে চিহ্নিত করা যায়। বলা হয়েছে-
وهي أرض العجم التي فتحت عنوة فأبقيت بأيدي أصحابها وضرب عليها الخراج ، أو الأرض التي صالح أهلها عليها على خراج يؤدونه .
ক. সেটি ঐ ভূখন্ড, যা যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলিমদের দখলে আসলেও উক্ত জমির অমুসলিম মালিকরা, ইসলামী রাষ্ট্রের উক্ত জমি নিজেদের দখলে রাখে এবং বিনিময়ে উক্ত জমির জন্য নিজেদের পক্ষ হতে নির্ধারিত কর আদায় করে থাকে।
খ. যুদ্ধের মাধ্যমে তা মুসলিমদের দখলে না আসলেও ঐ জমির অমুসলিম মূল মালিকরা সন্ধির মাধ্যমে রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত কর আদায় করতে স্বতস্ফূর্ত ভাবে একমত হয়।৭
এ সংজ্ঞার আলোকে আমাদের দেশের ফসলী জমি যুদ্ধ করেও প্রাপ্ত নয় এবং বিশেষ কর দেয়ার শর্তে সন্ধির মাধ্যমেও প্রাপ্ত নয়। সুতরাং এ জমি কোন ভাবেই খারাজী জমি নয়। সেই জন্য একজন মুসলিমের ঈমানের অনিবার্য দাবীই হচ্ছে, উল্লেখিত এ ছাহীহ হাদীছগুলোর প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য দেখিয়ে ফসলের যাকাত দানের ক্ষেত্রে ছাহিবে নিছাব হলে তা যথাযথ আদায় করা। পরিতাপের বিষয় যে, এ সব হাদীস পরিপালনের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিতে থাকার কারণে, অসংখ্য মুসলিম তাদের ঈমানের এ অনিবার্য দাবী পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
[গবেষণা ও প্রচারেঃ] বাংলাদেশ ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার ও
বাংলাদেশ ইসলামী দাওয়াহ সেন্টার
উৎসঃ
১. সুরা আল- আন‘আম : ১৪১
২. ছাহীহ আল বুখারী ২খ. ৪৫০ পৃ; আত-তিরমিযী, আবূ হুরায়রা রাদিআল্লাহু ‘আনহু সূত্রে ৩ খ. ৩১ পৃ.; আহমাদ জাবির রাদিআল্লাহু ‘আনহু সূত্রে, ৩ খ. ৩৪১ পৃ
৩. ইবন মাজাহ, ১ খ. ৫৮১ পৃ.,আন-নাসাঈ, ৫ খ. ৪২ পৃ: ছাহীহ মুসলিম, ২ খ. ৬৭৩ পৃ.
৪. ছাহীহ মুসলিম, ২ খ. ৬৭৩ পৃ.
৫. ছাহীহ আল বুখারী ২ খ., ৫২৯ পৃ.
৬. ফাতওয়াইল আযহার ৯ খ. ২৪৬ পৃ.
৭. কিল‘আজী, মুহাম্মাদ রাওওয়াস, মু‘জামু লুগাতিল ফুকাহা, বায়রূত, ১৪০৫ হিঃ ১খ.৫৫পৃ: