মাযহাবের অন্ধানুকরণ করা চার মাযহাবেই নিষিদ্ধ !

মাযহাবের অন্ধানুকরণ করা চার মাযহাবেই নিষিদ্ধ !
মুহাম্মদ হামিদুল ইসলাম আযাদ
চার মাযহাবকে কেউ কেউ কঠোর ভাষায় গালি গালাজ করেন। এর ইমামদেরকেও শক্ত ভাষায় তিরস্কার করেন। কিন্তু এ সকল ইমাম ছাহীহ হাদীছকেই অনুসরণ করার চেষ্টা করেছেন। এমনকি তাঁদের মতের বিপরীতে ছাহীছ হাদীছ পাওয়া গেলে উক্ত ছাহীহ হাদীছের বক্তব্যই তাঁর মত বলে গণ্য হবে এবং এ বিষয়ে তাঁদের পূর্বের মত রহিত বলে বিবেচিত হবে বলেও, তাঁরা স্পষ্ট বক্তব্য রেখে গেছেন । দলিল ছাড়া মাযহাবের অন্ধানুকরণ করা চার মাযহাবেই নিষিদ্ধ বলে চার ইমাম বলেছেন । তাঁদের বক্তব্য নিম্নরূপ :

১. ইমাম আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন-
إذا صح الحديث فهو مذهبي.
‘যখন হাদীছ বিশুদ্ধ হবে, তখন তা আমার মাযহাব বলেই গণ্য হবে।’১ তিনি অন্যত্র বলেন-
لا يحل لأحد أن يأخذ بقولنا ما لم يعلم من أين أخذناه.
‘কারো জন্য এটা বৈধ হবে না যে, আমি আমার কথা কোন স্থান থেকে গ্রহণ করেছি, তা না জেনে গ্রহণ করা।’২
২. ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহ বলেন -
ليس أحد بعد النبي إلا ويؤخذ من قوله ويترك إلا النبي.
‘নবীর পরে এমন কেউ নেই, নবী ব্যতীত যার কথা গ্রহণ যোগ্য ও বর্জন যোগ্য নয়।’৩ অর্থাৎ নবী বাদে সবাই ভুল করে, আমি ও অন্যান্যরাও নিশ্চয় ভুল করতে পারি। তিনি আরো বলেন-
إنما أنا بشر أخطئ وأصيب فانظروا في رأيي فإن وافق الكتاب والسنة فخذوه وما لم يوافقهما فاتركوه.
‘নিশ্চয় আমি মানুষ, ভুলও করি, নির্ভুলও করি, সেজন্য আমার মত দেখুন, এর মধ্যে যা কিতাব ও সুন্নাহর সাথে মিলবে তা গ্রহণ করুন, আর যা মিলবে না তা বর্জন করুন।’৪
৩. ইমাম শাফিঈ রাহিমাহুল্লাহ বলেন -
إذا وجدتم في كتابي خلاف سنة رسول الله صلى الله عليه وسلم فقولوا بسنة رسول الله صلى الله عليه وسلم ودعوا قولي.
‘আমার গ্রন্থের মধ্যে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাতের বিপরীত কিছু দেখলে, আমারটি বর্জন করে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাতটি গ্রহণ করবেন।’৫ তিনি আরো বলেছেন-
"كل مسألة صحّ فيها الخبر عن رسول الله صلى الله عليه وسلم عند أهل النقل بخلاف ما قلت، فأنا راجع عنها في حياتي وبعد موتي."
‘প্রতিটি মাস‘আলাতে হাদীছ বিশারদদের থেকে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, যদি তা আমি যা বলেছি তার পরিপস্থী হয়, তাহলে আমার জীবদ্দশায় ও ওফাতের পরেও আমি উক্ত মত থেকে ফিরে এসেছি বলে গণ্য হবে।’৬
৪. ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ বলেন-
"لا تقلدني ولا تقلد مالكاً ولا الشافعي ولا الأوزاعي ولا الثوري، وخذ من حيث أخذوا."
‘আমাকে এবং মালিক, শাফিঈ, আল-আওযায়ী ও আছ-ছাওরী রাহিমাহুমুল্লাহ কাউকে অনুকরণ করো না, তারা যেখান থেকে গ্রহণ করেছে সেখান থেকে গ্রহণ কর।’৭
সুতরাং ইজতিহাদের ক্ষেত্রে বিশেষ দৃষ্টিভংগির কারণে অথবা হাদীছ তাঁদের নিকট না পৌঁছার কারণে একের থেকে অন্যের মত পৃথক হলেও, প্রত্যেক ইমামের মূল উদ্দেশ্য ছিল হাদীছ অনুসরণ করা ও হাদীছের আলোকে যাতে প্রত্যেক মুসলিম চলেন তার দিক নির্দেশনা দেয়া। সেজন্য ইসলামের বিজ্ঞ মনীষীগণ চার মাযহাবের ইমামদের সম্পর্কে সামান্য কোন খারাপ ধারণাও পোষণ করতেন না। এ প্রসংঙ্গে সাউদী আরবে দারুল ইফতার ফাতওয়া বিভাগের সুস্পষ্ট বক্তব্য খুবই গুরত্বপূর্ণ। সেখানে বলা হয়েছে-
لم يدع أحد من الأئمة الأربعة إلى مذهبه ولم يتعصب له، ولم يلزم الناس بالعمل به أو بمذهب معين، إنما كانوا يدعون إلى العمل بالكتاب والسنة -رحمهم الله- ويشرحون نصوص الدين، ويبينون قواعده، ... ويأمرون أن يضرب برأيهم عرض الحائط إذا خالف الحديث الصحيح."
‘চার মাযহাবের কোন ইমাম তাঁর মাযহাবের দিকে কাউকে আহবান জানাতেন না এবং নিজের মাযহাব নিয়ে গোঁড়ামিও করতেন না। বরং তাঁরা কিতাব ও সুন্নাহ এর আলোকে কাজ করার দিকে আহবান জানাতেন। দীনের ভাষ্যাদি ব্যাখ্যা করতেন, এর নিয়ম পদ্ধতি ব্যাখ্যা করতেন।...কোন ছাহীহ হাদীছের বিরুদ্ধে তাঁদের মত পাওয়া গেলে তাঁদের মতকে দেয়ালে ছুঁড়ে ফেলার নির্দেশ দিতেন।’৮
একথা দ্বারা স্পষ্টত প্রমাণিত হয় যে, চার মাযহাবের ইমামদের বিশুদ্ধ হাদীছের পক্ষ অবলম্বন করার কারণে ছালাফে ছালিহীন ও ইসলামের বিজ্ঞ পন্ডিতগণ তাঁদেরকে কখনো খারাপ দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করতেন না। ইসলামী জ্ঞান গবেষণার জগতে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। আমাদের সকলের কাছে তাঁরা বিশেষ সম্মান পাওয়ার যোগ্য। তাঁদের সুদৃঢ় বক্তব্য অনুযায়ী তাঁদের মতের বিপরীতে কোন হাদীছ পাওয়া গেলেও উক্ত হাদীছ অনুসরণ করাই হবে মুসলিম হিসাবে আমাদের অনিবার্য কর্তব্য।
৫. ইবনু তায়মিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন-
والسنة هي العيار على العمل وليس العمل عيارا على السنة.
‘সুন্নাহর মাপকাঠিতে আমল হতে হবে, আমলের মাপকাঠিতে সুন্নাহকে বিচার করা যাবে না।’৯
অর্থাৎ আমলের সঠিকতা যাচাই এর জন্য সুন্নাহকে মাপকাঠি ধরে নিতে হবে। কারো আমলকে হাদীছের মানের মনে করে তা অনুসরণ করা যাবে না। তিনি আরো বলেছেন-
الاجتهاد إذا خالف السنة كان مردودا.
‘ইজতিহাদ যদি সুন্নাহর সাথে সাংঘর্ষিক হয়, তাহলে তা প্রত্যাখ্যাত হবে।’১০ সুতরাং ইজতিহাদের মাধ্যমে কোন কিছু উপস্থাপন করলে যদি তা হাদীছের বিরোধী হয় তাহলে তা কক্ষনো গ্রহণ করা যাবে না। বরং হাদীছটিই হবে ইজতিহাদের মাপকাঠি।
[গবেষণা ও প্রচারে] বাংলাদেশ ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার ও বাংলাদেশ ইসলামী দাওয়াহ সেন্টার
উৎসঃ
১. ইবন আবিদীন, হাশীয়াতু রাদ্দিল মুখতার, বায়রূত, ১৪১৫ হি:, ১খ. ৭২ পৃ:
২. ইবন আবিদীন, হাশীয়াতু ‘আলাল বাহারির রায়িক, ৬ খ. ২৩৫পৃ:, ইবন ‘আব্দিল বারর, আল-ইনতিকা’ ১৪৫পৃ:
৩. ইবন ‘আব্দিল বারর, আল-জামি‘, ২খ. ৯১পৃ:
৪. আবূ আবদুল্লাহ মুহাম্মা্দ ইবন আব্দুল্লাহ আল- খারাশী, শারহি মুখতাছারি খালীল, ২১ খ.২১৩ পৃ
৫. আন- নাবাভী, আল-মাজমু‘, বায়রূত, তাবি., ১খ.,৬৩ পৃ:
৬. আল-বদর, ‘আব্দুল মুহসিন, কুতুবু ‘আব্দুল মুহসিন, ১৪২৩ হি: ১৮খ., ৩৯ পৃ:
৭. আল আছরী, আবদুল্লাহ ইব্ন আব্দুল হামীদ, আল-আওজীয় ফি ‘আকীদাতিস সালফীছ ছালিহ, সৌদী আরব, ১৪২২ হিঃ ১ খ. ১২৮ পৃ.
৮. আদ-দুআইশ, আইমান ইবন আব্দুর রাজ্জাক ফাতওয়াল লাজনাতুদ দায়্যিমাহ লিন বুহুছিল ওয়াল-ইফতা, ১৯১৭ হিঃ রিয়াদ ৬ খ. ৪৭৮ পৃ:
৯. ইবনু তাইমিয়্যাহ ই‘লামিল মুওয়াক্কি‘ঈন, বায়রূত, ১৯৭৩, ২খ. ২৮০ পৃ:
১০. প্রাগুক্ত, ২খ. ২৯৬ পৃ: