মূলঃ ড.আ.ছ.ম.তরীকুল ইসলাম
সম্পাদনাঃ মুহাম্মদ হামিদুল ইসলাম আযাদ
ইমামের পেছনে যারা ছালাত আদায় করেন, তাদেরকে মুক্তাদী বলা হয়। ইমাম সাধারণত সূরাতুল-ফাতিহাহ ছাড়া কুরআনের অন্য অংশও পড়ে থাকেন। মুক্তাদী অন্য অংশ পড়া না পড়া নিয়ে, কোন মতভেদ না থাকলেও, মুক্তাদী সূরাতুল-ফাতিহাহ পড়বেন কিনা এ নিয়ে ফকীহদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। এ বিষয়ে বর্ণিত হাদীছগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হাদীছ হচ্ছে-ক. ইমামের পিছনে সূরাতুল-ফাতিহাহ পাঠ নিষ্প্রয়োজন
কিরাআত উচ্চস্বরে পড়ার ছালাত হোক অথবা চুপি চুপি পড়ার ছালাত হোক, উভয় অবস্থাতে মুক্তাদীর সূরাতুল-ফাতিহাহ পাঠ করা নিস্প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে,
عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: من صلى ركعة لم يقرأ فيها بأم القرآن فلم يصل إلا وراء الإمام.
‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ইমামের পেছনে নয় এমন এক রাক‘আত ছালাত আদায় করলে যদি কেউ সূরাতুল-ফাতিহাহ না পড়ে, তাহলে সে ছালাতই আদায় করেনি।’১ (তিরমিযী এ হাদীছটিকে ছাহীহ বলে মন্তব্য করেছেন) অর্থাৎ নিজে ছালাত আদায় করলে, অবশ্যই সূরাতুল-ফাতিহাহ পড়তে হবে। তবে ইমামের পেছনে আদায় করলে না পড়লেও চলবে। এ হাদীছ অনুযায়ী উচ্চস্বরে কিরাআত পাঠের ছালাত হোক অথবা মনে মনে কিরাআত পাঠের ছালাতই হোক; উভয় অবস্থাতেই ইমামের পেছনে মুক্তাদীর সূরাতুল-ফাতিহাহ পড়া নিষ্প্রয়োজন। আরো বর্ণিত হয়েছে-
عن عبد الله بن شداد قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من كان له إمام فإن قراءة الإمام له قراءة.
‘আবদুল্লাহ ইবন শাদ্দাদ রাদি আল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যার ইমাম রয়েছে, ইমামের কিরাআতই হচ্ছে তার জন্য কিরাআত।’২ আল-আলবানী হাদীছটিকে ছাহীহ বলেছেন।
এ হাদীছটি যেহেতু ইমামের যে কোন কিছুকে পড়াকে মুক্তাদীর জন্য পড়া হিসাবে গণ্য করাকে সমর্থন দেয়, সেহেতু এই আলোকে ইমাম সূরাতুল-ফাতিহাহ পড়লে, ইমাম কিরাআত উচ্চ স্বরে পড়ুন অথবা নিচু স্বরে পড়ুন, উভয় অবস্থাতেই মুক্তাদীর জন্য তা পড়ার প্রয়োজন হবে না।
খ. ইমামের পিছনে সূরাতুল-ফাতিহাহ পাঠ অত্যাবশ্যকীয়
এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে-
قال عبادة بن الصامت: صلى بنا رسول الله -صلى الله عليه وسلم- بعض الصلوات التى يجهر فيها بالقراءة ، فالتبست عليه القراءة ، فلما انصرف أقبل علينا بوجهه فقال : هل تقرءون إذا جهرت بالقراءة؟ গ্ধ. فقال بعضنا : إنا نصنع ذلك. قال : فلا، وأنا أقول ما لى أنازع القرآن ، فلا تقرءوا بشىء من القرآن إذا جهرت إلا بأم القرآن.
‘উবাদাহ ইবনুছ ছামিত রাদিআল্লাহু ‘আনহু বলেন, প্রকাশ্যে কিরাআত আদায় করতে হয় এমন ছালাতে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার আমাদের ইমামতি করেন। (তাঁর) কিরাআত তালগোল পাকিয়ে গেল। যখন তিনি সালাম ফিরালেন তখন আমাদের দিকে ফিরে বললেন, আমি যখন আল-কুরআন প্রকাশ্যভাবে পড়ি তখন কি তোমরাও কুরআন পড়? আমাদের কেউ কেউ বললেন হাঁ, হে আল্লাহর রাসূল। তিনি বললেন না, আমি বলছি (কি ব্যাপার) আমার সাথে কুরআন নিয়ে ধাক্কাধাক্কি করা হচ্ছে! যখন আমি উচ্চস্বরে কিরাআত পড়ব তখন শুধু সূরাতুল-ফাতিহাহ ব্যতীত অন্য কিছু তোমরা পড়বে না।’৩
আবুল হাসান আদ-দারা কুতনী বলেন, এই হাদীছের সনদ হাসান, এর বর্ণনাকারীগণ আস্থাযোগ্য (ثقات)৪
এ হাদীছ রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইমামের পেছনে সূরা আল ফাতিহাহ পড়তে নির্দেশ দিয়েছেন তার প্রমাণ পেশ করে। এ বিষয়ে আরো বর্ণিত হয়েছে -
عن أبى هريرة عن النبى -صلى الله عليه وسلم- قال : من صلى صلاة لم يقرأ فيها بأم القرآن فهى خداج - ثلاثا - غير تمام.
আবূ হুরাইরাহ রাদিআল্লাহু ‘আনহু বলেন, ‘‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিন তিনবার বলেছেন, যে সূরাতুল ফাতিহাহ ব্যতীত ছালাত আদায় করে সেটি অপরিপূর্ণ।’’৫
এ হাদীছ প্রতিটি ছালাতে সূরাতুল-ফাতিহাহ পাঠ যে অত্যাবশ্যক, তারই স্পষ্ট দলীল।
গ. উচ্চস্বরের কিরাআত বিশিষ্ট ছালাতে ইমামের পিছনে সূরাতুল-ফাতিহাহ পাঠ নিষ্প্রয়োজন
এমন গ্রহণযোগ্য হাদীছ পাওয়া যায়, যা স্পষ্টত এ কথার প্রমাণ বহন করে যে, ইমাম যে ছালাতে প্রকাশ্যে কিরাআত পাঠ করবেন, সে ছালাতে যেহেতু সূরাতুন ফাতিহাহ মুক্তাদীও শুনে থাকেন, সে জন্য তাঁর সূরাতুল-ফাতিহাহ পাঠ করার প্রয়োজন নেই। এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে-
عن أبي هريرة : أن رسول الله صلى الله عليه و سلم انصرف من صلاة جهر فيها بالقراءة فقال هل قرأ معي أحد منكم آنفا ؟ فقال رجل نعم يا رسول الله قال إني أقول مالي أنازع القرآن!
আবূ হুরাইরাহ রাদিআল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘‘ছালাতে উচ্চস্বরে কিরাআত পড়া হয়েছে এমন ছালাত থেকে ফিরে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমাদের কেউ কি একটু পূর্বে আমার (কুরআন) পাঠের সাথে সাথে কোন কিছু পাঠ করছিলে? একজন বলল, জ্বি হ্যাঁ, হে রাসূলাল্লাহ। তখন রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি বলছি, আমার সাথে কুরআন নিয়ে ধাক্কাধাক্কি করা হচ্ছে!’’৬
অর্থাৎ আমি অহেতুক কুরআন পড়তে থাকব, আর তা শ্রবণ করা হবে না, এটি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।
আল-আলবানী হাদীছটিকে ছাহীহ বলেছেন।
এ প্রসঙ্গে আরো বার্ণত হয়েছে -
عن أبي هريرة قال : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم: إنما جعل الإمام ليؤتم به . فإذا كبر فكبروا . وإذا قرأ فأنصتوا .
আবূ হুরাইরাহ রাদিআল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ইমাম বানানো হয়েছে তাকে অনুসরণ করার জন্য, সুতরাং সে যখন তাকবীর দেবে তোমরাও তাকবীর দেবে আর সে যখন (কোন কিছু) পড়বে তোমরা চুপ থাকবে।’৭
এখানের وإذا قرأ فأنصتوا বাক্য ইমাম মুসলিম রাহিমাহুল্লাহ ছাহীহ বলে মন্তব্য করেছেন।৮
এ হাদীছে ইমাম যখন কোন কিছু তিলাওয়াত করবে, তখন চুপ থাকতে বলা হয়েছে। এ দ্বারা শ্রবণের উদ্দেশ্যেই চুপ থাকা প্রমাণিত হয়। সুতরাং যে ছালাতে ইমাম উচ্চ স্বরে কিরাআত পাঠ করবেন, সে ছালাতে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআনের কোন অংশ না পড়ে চুপ থাকারই যে নির্দেশ দিয়েছেন, এ হাদীছ সেই কথারই প্রমাণ বহন করে। তাহলে ইমাম উচ্চস্বরে কিরাআত পাঠ করলে মুক্তাদীর সূরাতুল-ফাতিহাহ পড়ার প্রয়োজন নেই।
এখানে ইমাম সাহেবের পেছনে মুক্তাদীর সূরাতুল-ফাতিহাহ পড়া, না পড়া নিয়ে তিন ধরনের হাদীছ পাওয়া গেল। হাদীছবেত্তাদের মানদন্ড অনুযায়ী এখানে উল্লেখিত কোন হাদীছ এ অবস্থায় নেই যা দা‘য়ীফ (দুর্বল) বা অন্য কোন কারণে একেবারেই উপেক্ষা যোগ্য। সুতরাং নিঃশর্ত ভাবে যাঁরা হাদীছ পরিপালন করতে চান, তাঁদের ছালাত আদায়ের সময় এ তিন শ্রেণীর হাদীছই বিবেচনায় আনা জরুরী। কোন এক শ্রেণীকে অগ্রহণযোগ্য বলা তাঁদের জন্য উচিত হবে না। আমার ক্ষুদ্র বিবেচনায়, কেউ যদি এ তিন শ্রেণীর সব হাদীছের উপর আমল করতে পারেন, তা হলে ভাল। অন্যথায় যে কোন এক শ্রেণীর উপর আমল করলেই যথেষ্ট। তবে অন্য দুই শ্রেণীকে বিভিন্ন অজুহাতে সমালোচনা করে, এর গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্ন বিদ্ধ করা, কোন ভাবেই ঠিক হবে না।
উৎসঃ বাংলাদেশ ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার
১. মালিক, ১ খ. ৮৪ পৃ, আত-তিরমিযী, ২ খ. ১২২ পৃ.
২. আল-বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ২ খ..১৬০ পৃ; আদ-দারা কুতনী ১ খ. ৪০২ পৃ:
৩. আল-হাকিম ১ খ.,৩৬৪ পৃ:, আল-বায়হাকী, ২ খ. ১৬৬ পৃ:
৪. আল বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা, তাবি- খ. ২, পৃ. ১৬৫।
৫. আহমাদ ৬ খ. ২৭৫ পৃ:, ইবন মাযাহ ১ খ., ২৭৪ পৃ:, ছাহীহ মুসলিম. ১ খ ২৯৬ পৃ:.
৬. আত-তিরমিযী, ২ খ., ১১৯ পৃ:, ইবন হিববান, ৫খ., ১৫১ পৃ: আবূ দাউদ ১ খ., ২১৮ পৃ:, ইবন মাজাহ ১ খ., ২৭৬ পৃ:
৭. আহমাদ, ২ খ., ৩৭৬ পৃ:, ইবন মাজাহ ১ খ. ২৭৬ পৃ:
৮. ছাহীহ মুসলিম, ১ খ., ৩০৪ পৃ: