ছালাতুল বিতরের রাক‘আত সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তির সমাধাণ !

ছালাতুল বিতরের রাক‘আত সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তির সমাধাণ !

মূলঃ ড.আ.ছ.ম.তরীকুল ইসলাম
সম্পাদনাঃ মুহাম্মদ হামিদুল ইসলাম আযাদ
ছালাতুল বিতর কত রাক‘আত এ নিয়ে আমাদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। আমরা যারা যে মতকে অনুকরণ করি সেটাকেই নির্ভুল মনে করে, তার পক্ষের হাদীছগুলোকে দলীল হিসাবে উপস্থাপনের চেষ্টা চালাই। একইভাবে বিপক্ষের উপস্থাপিত হাদীছগুলোকে আমলে আনার সামান্য সদিচ্ছা তো পোষণ করিই না, বরং সেগুলোর বিরোধিতা করাকে যথার্থ কাজই মনে করি।
এমনকি নিজের মতই যে সঠিক, তা প্রমাণের জন্য আদাজল খেয়ে লেগে যাই। যার অনিবার্য পরিণতিতে একপক্ষ অন্য পক্ষের হাদীছকে যা ইচ্ছা তাই বলে সমালোচনা করতেও পিছপা হই না। এ কাজটি মূলত ছাহীহ ও গ্রহণযোগ্য হাদীছের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ারই নামান্তর। ঈমানের অনিবার্য দাবী হচ্ছে, ছাহীহ ও গ্রহণযোগ্য হাদীছের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ। যাই হোক, ছালাতুল বিতরের রাকা‘আত নিয়ে যে হাদীছগুলো বর্ণিত হয়েছে, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হাদীছগুলো হচ্ছে নিম্মরূপ:
ক. বিতর এক রাক‘আত:
বর্ণিত হয়েছে-
عن ابن عمر عن رسول الله صلى الله عليه وسلم أنه قال: صلاة الليل مثنى مثنى فإذا أردت أن تنصرف فاركع واحدة توتر لك.
ইবন ‘উমার রাদি আল্লাহু ‘আনহুমা সূত্রে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘রাত্রির ছালাত (তাহাজ্জুদ) দুই রাক‘আত করে করে, যখন তুমি এ থেকে ফিরে যেতে (এটা পূর্ণ করতে) চাও, তখন এক রাক‘আত আদায় করবে, যা তোমার ছালাতকে বেজোড় বানিয়ে দেবে।’১ অন্য সূত্রে বর্ণিত হয়েছে-
عن أبي مجلز قال سمعت ابن عمر يحدث عن النبي صلى الله عليه وسلم قال : الوتر ركعة من آخر الليل.
আবূ মাজলায সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ইবন ‘উমার রাদি আল্লাহু ‘আনহুমাকে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হাদীছ বর্ণনা করতে শুনেছি, তিনি বলেন, ‘‘বিতর হচ্ছে শেষ রাত্রিতে এক রাক‘আত।’২
عن ابن عمر أن رجلا سأل رسول الله صلى الله عليه وسلم عن صلاة الليل، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: صلاة الليل مثنى مثنى فإذا خشي أحدكم الصبح صلى ركعة واحدة توتر له ما قد صلى.
ইবন ‘উমার রাদি আল্লাহু ‘আনহুমা সূত্রে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রাতের ছালাত সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন; তিনি বললেন, ‘রাতের ছালাত হচ্ছে, দুই রাক‘আত দুই রাক‘আত করে, যখন তোমাদের কেউ সকাল হওয়ার আশঙ্কা করে, এক রাক‘আত ছালাত আদায় করবে যা তার আদায় করা ছালাতকে বেজোড় বানিয়ে দেবে।’৩ এখানে বর্ণিত হাদীছগুলো বিভিন্নভাবে বর্ণিত হলেও বর্ণনাকারী একই, এগুলোর বক্তব্য হচ্ছে, ছালাতুল বিতর এক রাক‘আত।
খ. বিতর এক রাক‘আত হতে পাঁচ রাক‘আত:
যেমন বর্ণিত হয়েছে-
عن أبي أيوب الأنصاري أن رسول الله صلى الله عليه و سلم قال: الوتر حق، فمن شاء فليوتر بخمس ، ومن شاء فليوتر بثلاث ، ومن شاء فليوتر بواحدة .
আবূ আইয়ূব আল-আনসারী রাদি আল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল-বিতর হচ্ছে অপরিহার্য, যে চায় পাঁচ রাক‘আত দ্বারা, যে চায় তিন রাক‘আত দ্বারা, যে চায় এক রাক‘আত দ্বারা বিতর করবে।’৪ আল-আলবানীর মতে হাদীছটি ছাহীহ।৫
গ. বিতর পাঁচ রাক‘আত ও সাত রাক‘আত:
বর্ণিত হয়েছে-
عن أم سلمة قالت كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يوتر بخمس وبسبع لا يفصل بينهن بسلام ولا بكلام.
উম্মু সালামাহ রাদি আললাহু ‘আনহা বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাঁচ ও সাত রাক‘আত বিতর আদায় করতেন, সালাম এবং কোন কথার দ্বারা এ গুলোর মধ্যে কোন বিভাজন করতেন না।’৬
ঘ. বিতর তিন রাক‘আত
বর্ণিত হয়েছে-
عن ابن عباس قال : كان رسول الله صلى الله عليه و سلم يوتر بثلاث يقرأ في الأولى بـ (سبح اسم ربك الأعلى) وفي الثانية بـ(قل يا أيها الكافرون) وفي الثالثة بـ(قل هو الله أحد).
ইবন ‘আববাস রাদি আল্লাহু ‘আনহুমা সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিন রাক‘আত বিতর আদায় করতেন, প্রথম রাক‘আতে سبح اسم ربك الأعلى দ্বিতীয় রাক‘আতে قل يا أيها الكافرون এবং তৃতীয় রাক‘আতে قل هوالله أحد পড়তেন।’৭ আল-আলবানী এ হাদীছটি ছাহীহ বলেছেন।৮
আরো বর্ণিত হয়েছে-
عن عبد الله بن عباس أنه رقد عند رسول الله -صلى الله عليه وسلم- فاستيقظ فتسوك وتوضأ وهو يقول (إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِأُولِي الْأَلْبَابِ) فقرأ هؤلاء الآيات حتى ختم السورة ثم قام فصلى ركعتين فأطال فيهما القيام والركوع والسجود ثم انصرف فنام حتى نفخ ثم فعل ذلك ثلاث مرات ست ركعات كل ذلك يستاك ويتوضأ ويقرأ هؤلاء الآيات ثم أوتر بثلاث.
‘আবদুল্লাহ ইবন ‘আববাস বলেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট ঘুমালেন, এরপর তিনি (রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘুম থেকে জাগলেন, মিছওয়াক করে অজু করলেন, এরপর পড়লেন إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآيَاتٍ لِأُولِي الْأَلْبَابِ এবং একই সূরাহ সমাপ্ত করে তিনি দাঁড়ালেন, এরপর লম্বা কিয়াম ও সিজদাহ সহকারে দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করলেন, এরপর তিনি ফিরে গিয়ে নাক ডেকে ঘুমালেন। এমনিভাবে মিছওয়াক, ওজু এবং ঐ সব আয়াত তিলাওয়াত শেষে তিনি তিন বারে ছয় রাক‘আত ছালাত আদায় করলেন, এরপর তিন রাক‘আত বিতর আদায় করলেন।’৯
আরো বর্ণিত হয়েছে-
عن عمر بن الخطاب أنه أوتر بثلاث ركعات لم يفصل بينهن بسلام.
‘উমার ইবনুল খাত্তাব রাদি আল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিন রাক‘আত বিতর আদায় করতেন, ছালাম দ্বারা তন্মধ্যে কোন ভাগ করতেন না।’১০
আরো বর্ণিত হয়েছে-
عن عائشة رضي الله عنها قالت : كان نبي الله صلى الله عليه و سلم لا يسلم في ركعتي الوتر.
‘আয়িশাহ রাদি আল্লাহু ‘আনহা সূত্রে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছালাতুল বিতরের দুই রাক‘আতে ছালাম ফিরাতেন না।’১১ আল হাকিম বলেন আল-বুখারী ও মুসলিমের দেয়া শর্তানুযায়ী হাদীছটি ছাহীহ। ইমাম আয্ যাহাবী তাঁর সাথে একাত্বতা ঘোষণা করেছেন।
উল্লেখ্য যে ছালাতুল বিতরের রাক‘আত সম্পর্কে আরো অনেক বর্ণিত হাদীছ রয়েছে।
যাই হোক পর্যবেক্ষণ করলে স্পষ্ট হয় যে, এ সকল হাদীছ ছালাতুল বিতরের রাক‘আত সংখ্যা প্রসংগে চারটি বক্তব্য উপস্থাপন করেছে।
এক : ছালাতুল বিতর এক রাক‘আত, দুই : তিন রাক‘আত,
তিন : পাঁচ রাক‘আত, চার : সাত রাক‘আত।
এখানে এটাও বুঝা যাচ্ছে যে, বিতর এক রাক‘আত হওয়া, তিন রাক‘আত হওয়া বা ততোধিক হওয়া গ্রহণযোগ্য হাদীছ দ্বারাই প্রমাণিত। এ চারটি বর্ণনা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাজ অথবা বক্তব্য। তিনি কখনো বা এক রাক‘আত, কখনো তিন রাক‘আত, কখনো বা এর চেয়ে বেশি রাক‘আত ছালাতুল বিতর আদায় করেছেন। সুতরাং এ চারটির যে কোন একটি আমল করাই হাদীছ দ্বারা অনুমোদিত। যিনি এক রাক‘আত ছালাতুল বিতর আদায় করেন, তার পক্ষে তিন বা ততোধিক রাক‘আতকে অস্বীকার করা যেমন সঠিক নয়, তেমনি যিনি তিন রাক‘আত ছালাতুল বিতর আদায় করেন, তাঁর পক্ষে এক বা তিনের অধিক রাক‘আত ছালাতুল বিতরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া কোন ভাবেই ঠিক নয়। যেহেতু এ সকল অবস্থাই হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত, সেজন্য সত্যিকারের হাদীছ পালনকারীর জন্য উচিত, এখানে উল্লিখিত সকল প্রকারের হাদীছের উপরই আমল করা অর্থাৎ কখনো এক, কখনো তিন, কখনো বা ততোধিক রাক‘আত ছালাতুল বিতর আদায় করা। এ প্রসঙ্গে শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দিহলাভী রাহিমাহুল্লাহর বক্তব্যও অনেকটা এমনই। তিনি একই বিষয়ে একাধিক মতের পক্ষে গ্রহণযোগ্য ছাহীহ হাদীছ পাওয়ার বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন-
الحق عندي في مثل ذلك أن الكل سنة ونظيره الوتر بركعة واحدة أو بثلاث
‘এ সব বিষয়ে সঠিক হচ্ছে এটাই যে, প্রত্যেকটিই সুন্নাহ। ছালাতুল বিতরের এক রাক‘আত অথবা তিন রাক‘আত এর উদাহরণ।’১২ শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিছ দিহলাভী রাহিমাহুল্লাহর মত নিরপেক্ষভাবে গ্রহণযোগ্য হাদীছ পরিপালনে এমন উদার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা সকলের জন্যই অপরিহার্য।
উৎসঃ বাংলাদেশ ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার
১. ইবুন হিববান,,৬ খ. ৩৫৪ পৃ.
২. মুসলিম, খ.১ পৃ.৫১৮
৩. প্রাগুক্ত, খ.১ পৃ.৫১৬
৪. ইবন হিববান, ৬ খ.১৭০পৃ:; ইবন মাযাহ; ১ খ. ৩৭৬ পৃ., হাকিম, ১ খ. ৪৪৪ পৃ:
৫. আল- আলবানী, ছাহীহু ওয়া দা‘‘য়ীফু ইবন মাযাহ, ৩খ., ১৯০ পৃ:
৬. আন- নাসাঈ, ১খ. ৪৪১ পৃ.
৭. আহমাদ, ১ খ. ২৯৯ পৃ: , আন- নাসাঈ, ১খ. ৪৭৭ পৃ.
৮. আল-আলবানী কিতাবু ছালতুত তারাবীহ, ১ খ. ১১০পৃ:
৯. মুসলিম, ১ খ. ৫৩০ পৃ:
১০. ইবন আবী শায়বাহ, ৩ খ. ৯০ পৃ:
১১. আত-তাহাবী, শারহি মা‘আনিল আছার, ১খ., ৪৮১ পৃ:
১২. দিহলাভী, শাহ ওয়ালিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, ২খ., ১০ পৃ