তাওহীদের গুরুত্ব ও শিরকের ভয়াবহতা !
ড. কামাল উদ্দিন জাফরী
মানুষের জীবনে তাওহীদ অতীব গুরত্বপুর্ণ বিষয়। তাওহীদ বিশ্বাসের কারণেই মানুষ পরকালে মুক্তি লাভ করবে। তাওহীদ সম্পর্কে জানা ও নির্ভেজাল তাওহীদে বিশ্বাসী হওয়া প্রত্যেকের জন্য অত্যাবশ্যক। তাওহীদের বিপরীত হ’ল শিরক। যার কারণে মানুষের জীবনের সকল পুণ্য বিনষ্ট হয়, পূর্বের সব আমল বাতিল হয়ে যায় এবং পরকালে জাহান্নাম অবধারিত হয়। তাই শিরক থেকে সতর্ক-সাবধান হওয়া সকল মানুষের জন্য অতি যরূরী। আলোচ্য নিবন্ধে তাওহীদ ও শিরক সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করা হ’ল।-
তাওহীদের পরিচয় ও প্রকারভেদ
তাওহীদ ‘ওয়াহদাতুন’ ধাতু হ’তে উৎপন্ন। যার অর্থ একক। তাওহীদ-এর আভিধানিক অর্থ একক গণ্য করা বা একত্ববাদ। পারিভাষিক অর্থ- ‘আসমান ও যমীনসহ এর ভিতর ও বাইরের জানা-অজানা সকল সৃষ্টির একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা হিসাবে আল্লাহকে বিশ্বাস করা। তাওহীদ তিন প্রকার : (১) তাওহীদে রুবূবিয়াত (২) তাওহীদে আসমা ওয়া ছিফাত (৩) তাওহীদে ইবাদত বা উলূহিয়াত। বাংলায় যাকে বলা যায়- সৃষ্টি ও প্রতিপালনে একত্ব, নাম ও গুণাবলীর একত্ব এবং ইবাদত ও উপাসনায় একত্ব।
(১) ‘তাওহীদে রুবূবিয়াত’-এর অর্থ হ’ল আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রূযীদাতা, রোগ ও আরোগ্যদাতা, জীবন ও মরণদাতা প্রভৃতি হিসাবে বিশ্বাস করা। কিছু সংখ্যক নাস্তিক ও প্রকৃতিবাদী ছাড়া দুনিয়ার প্রায় সকল মানুষ সকল যুগে এমনকি শেষনবী (ছাঃ)-এর আগমনকালে মক্কার মুশরিক আরবরাও আল্লাহকে ‘রব’ হিসাবে, সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা হিসাবে বিশ্বাস করত। কুরায়েশ নেতারা তাদের ছেলেদের নাম আব্দুল্লাহ, আব্দুল মুত্ত্বালিব ইত্যাদি রাখত।
(২) ‘তাওহীদে আসমা ওয়া ছিফাত’-এর অর্থ হ’ল পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে আল্লাহর নাম ও গুণাবলী যেভাবে বর্ণিত হয়েছে, সেভাবেই আল্লাহর সত্তার সাথে সম্পৃক্ত ও সনাতন বলে বিশ্বাস করা, যা বান্দার নাম ও গুণাবলীর সাথে তুলনীয় নয়। সুগন্ধিকে যেমন ফুল হ’তে পৃথক করা যায় না, কিরণকে যেমন সূর্য হ’তে বিচ্ছিন্ন করা যায় না, আল্লাহর গুণাবলীকে তেমনি তাঁর সত্তা হ’তে পৃথক ভাবা যায় না। তিনি দয়া বিহীন দয়ালু, কথা বিহীন কথক, কর্ণহীন শ্রোতা বা হস্তবিহীন দাতা নন। তিনি নিরাকার বা নির্গুণ সত্তা নন। বরং তাঁর আকার রয়েছে। কিন্তু তা কেমন তা কেউ জানে না। ‘তাঁর তুলনীয় কিছুই নেই, তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’ (শূরা ৪২/১১)। ‘তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই’ (ইখলাছ ১১২/৪)।
‘লোকেরা তাঁর সম্পর্কে যেসব বিশেষণ প্রয়োগ করে থাকে, সেসব থেকে তিনি অনেক ঊর্ধ্বে’ (ছাফফাত ৩৭/১৮০)। মু‘আত্ত্বিলাগণ আল্লাহকে নির্গুণ ও নিরাকার মনে করে শূন্য সত্তার পূজারী হয়েছে। জাহমিয়া, ক্বাদারিয়া, মু‘তাযিলা প্রভৃতি এদের অনেকগুলি উপদল রয়েছে। মুজাসসিমাহ ও মুশাবিবহাগণ আল্লাহকে বান্দার সদৃশ কল্পনা করে মূর্তিপূজারী হয়েছে। প্রকৃত সত্য রয়েছে এ দুইয়ের মধ্যবর্তী পথে, যা ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের গৃহীত পথ।
(৩) ‘তাওহীদে ইবাদত বা উলূহিয়াত’-এর অর্থ হ’ল ‘সর্বপ্রকার ইবাদতের জন্য আল্লাহকে একক গণ্য করা’। আল্লাহর জন্য সর্বাধিক ভালোবাসা সহ চরম প্রণতি পেশ করাকে ‘ইবাদত’ বলা হয়। সামগ্রিক অর্থে ‘ইবাদত’ ঐসকল প্রকাশ্য ও গোপন কথা ও কাজের নাম, যা আল্লাহ ভালবাসেন ও খুশী হন’। ‘ইলাহ’ সেই সত্তাকে বলা হয়, যাঁর নিকটে আশ্রয় ভিক্ষা করতে হয় ও যাঁকে ইবাদত করতে হয় মহববতের সাথে একনিষ্ঠভাবে ভীতিপূর্ণ সম্মান ও সর্বোত্তম শ্রদ্ধার সাথে।
মানুষের জীবনে ইবাদাত ও মু‘আমালাত বা আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক দু’টি দিক রয়েছে। এর মধ্যে আধ্যাত্মিক বা রূহানী জগতটাই বেশী গুরুত্বপূর্ণ। আধ্যাত্মিক জগতের বিশ্বাস অনুযায়ী মানুষ তার বৈষয়িক জীবন পরিচালনা করে। এ কারণে আধ্যাত্মিক জগতকে সুনিয়ন্ত্রিত করার জন্য ইসলাম যে বিধান সমূহ প্রদান করেছে তা হ’ল ‘তাওক্বীফী’। অর্থাৎ যার কোন নড়চড় নেই। বান্দার পক্ষ হ’তে সেখানে কোনরূপ রায়-ক্বিয়াস বা ইজতিহাদের অবকাশ নেই। ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত, যবহ-মানত ইত্যাদি ইবাদত সমূহের নিয়ম পদ্ধতি উক্ত বিধানের অন্তর্ভুক্ত। এসব ক্ষেত্রে কেবলমাত্র পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে প্রাপ্ত বিধান মেনে চলাই নিরপেক্ষ মুমিনের কর্তব্য।
অতঃপর ‘মু‘আমালাত’ বা বৈষয়িক জীবনে মুমিন আল্লাহ প্রেরিত ‘হুদূদ’ বা সীমারেখার মধ্যে থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করবেন। আদেশ-নিষেধ ও হালাল-হারাম-এর সীমারেখার মধ্যে থেকে যোগ্য আলেমগণ শারঈ মূলনীতির আলোকে ‘ইজতিহাদ’ করবেন ও যুগ-সমস্যার সমাধান দিবেন। রাজ্যশাসন, প্রজাপালন, চাকুরী-বাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি মানুষের জীবনের বিস্তীর্ণ কর্মজগত তার মু‘আমালাত বা বৈষয়িক জীবনের অন্তর্ভুক্ত। একজন প্রকৃত মুমিন তার আধ্যাত্মিক জীবনে যেমন আল্লাহর বিধান মেনে চলেন, তেমনি বৈষয়িক জীবনেও ইসলামী শরী‘আতের আনুগত্য করে থাকেন। আধ্যাত্মিক জীবনে আল্লাহর আনুগত্য ও বৈষয়িক জীবনে গায়রুল্লাহর আনুগত্য স্পষ্ট শিরক। জান্নাতপিয়াসী মুমিনকে তাই ইবাদতের ক্ষেত্রে যেমন হাদীছপন্থী হ’তে হবে, বৈষয়িক জীবনেও তেমনি শারঈ বিধানের আনুগত্য করে চলতে হবে। নইলে তার তাওহীদের দাবী মিথ্যা প্রমাণিত হবে। তাওহীদে রুবূবিয়াতকে মেনে নিলেও কাফের আরব নেতারা তাওহীদে ইবাদতকে মেনে নিতে পারেনি বলেই নবীকে অস্বীকার করেছিল।
তাওহীদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য :
তাওহীদের গুরুত্ব অপরিসীম। তাওহীদের কারণেই মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে এবং পরকালে জান্নাত লাভে সক্ষম হবে। নিম্নে তাওহীদের গুরুত্বের কতিপয় দিক উল্লেখ করা হ’ল।-
১. মানব সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য : আল্লাহ মানুষকে কেবল তাঁর ইবাদতের জন্য তথা তাওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্য সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ বলেন, وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ ‘আমি মানুষ ও জিনকে কেবল আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি’ (যারিয়াত ৫১/৫৬)। আর ইবাদতের মূল তাওহীদের স্বীকৃতি।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوْا رَبَّكُمُ الَّذِيْ خَلَقَكُمْ وَالَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ- ‘হে মানবমন্ডলী! তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহর ইবাদতে সর্বদা রত থাক, যিনি তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদেরকে সৃষ্টি করেছেন। তাহ’লে তোমরা সংযমী ও মুত্তাক্বী হ’তে পারবে’ (বাক্বারাহ ২/২১)। তিনি আরো বলেন, فَلاَ تَجْعَلُوْا للهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ- ‘তাঁর সাথে অন্য কাউকে কদাচ অংশীদার করো না, অথচ তোমরা জান’(বাক্বারাহ ২/২২)।
মানবজাতির সর্বপ্রথম কর্তব্য হচ্ছে তার সৃষ্টিকর্তা আললাহকে এক বলে জানা। কেননা আল্লাহকে এক বলে না জানা পর্যন্ত তাঁকে এক বলে মানাও যায় না। আল্লাহ বলেন, فَاعْلَمْ أَنَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَ اللهُ ‘অতএব জেনে রাখ, নিঃসন্দেহে আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য ইলাহ নেই’ (মুহাম্মাদ ৪৭/১৯)।
২. নবী-রাসূল প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিল তাওহীদের প্রতিষ্ঠা : তাওহীদ বা আল্লাহর একত্বকে প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্যই আল্লাহ মানবজাতির নিকট যুগে যুগে নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাওহীদই হচ্ছে সমস্ত রাসূলদের দাওয়াতের মূল কথা, যার দিকে তাঁরা তাঁদের উম্মতদের ডেকেছেন। আল্লাহ বলেন, وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلاَ نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَ أَنَا فَاعْبُدُونِ ‘আর তোমার পূর্বে এমন কোন রাসূল আমরা পাঠাইনি যার প্রতি আমরা এই ওহী অবতরণ করিনি যে, ‘আমি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই; সুতরাং তোমরা আমার ইবাদত কর’ (আম্বিয়া ২১/২৫)। তিনি আরো বলেন, وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوا اللهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ ‘আর আমরা অবশ্যই প্রত্যেক জাতির নিকটে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগূতকে পরিহার কর’(নাহল ১৬/৩৬)।
৩. তাওহীদ বিশ্বাস নিরাপত্তা ও হেদায়াত লাভের মাধ্যম : আললাহ বলেন,الَّذِيْنَ آمَنُواْ وَلَمْ يَلْبِسُواْ إِيْمَانَهُم بِظُلْمٍ أُوْلَـئِكَ لَهُمُ الأَمْنُ وَهُم مُّهْتَدُوْنَ ‘যারা ঈমান আনে এবং স্বীয় বিশ্বাসকে শিরকের সাথে মিশ্রিত করে না, তাদের জন্যেই শান্তি এবং তারাই সুপথগামী’ (আন‘আম ৬/৮২)।
তিনি আরো বলেন, ‘এবং এ কারণেও যে, যাদেরকে জ্ঞানদান করা হয়েছে তারা যেন জানে যে, এটা তোমার পালনকর্তার পক্ষ থেকে সত্য; অতঃপর তারা যেন এতে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর যেন এর প্রতি অনুগত হয়। আল্লাহ বিশ্বাসস্থাপনকারীকে অবশ্যই সরল পথ প্রদর্শন করেন’ (হজ্জ ২২/৫৪)।
৪. দুনিয়া ও আখেরাতে দৃঢ়তা লাভের মাধ্যম : আল্লাহ বলেন,يُثَبِّتُ اللهُ الَّذِينَ آمَنُواْ بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الآخِرَةِ ‘যারা শাশ্বত বাণীতে বিশ্বাসী তাদেরকে আল্লাহ দুনিয়ার জীবনে ও আখেরাতে সুপ্রতিষ্ঠিত রাখবেন’ (ইবরাহীম ১৪/২৭)।
৫. গোনাহ মাফের উপায় : আল্লাহ বলেন, وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَنُكَفِّرَنَّ عَنْهُمْ سَيِّئَاتِهِمْ وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَحْسَنَ الَّذِي كَانُوا يَعْمَلُونَ ‘আর যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, আমরা অবশ্যই তাদের মন্দ কর্মগুলো মিটিয়ে দেব এবং তাদেরকে তাদের কর্মের উৎকৃষ্টতর প্রতিদান দেব’ (আনকাবূত ২৯/৭)। তিনি আরো বলেন, وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْكِتَابِ آمَنُواْ وَاتَّقَوْاْ لَكَفَّرْنَا عَنْهُمْ سَيِّئَاتِهِمْ وَلأدْخَلْنَاهُمْ جَنَّاتِ النَّعِيمِ ‘আর যদি আহলে কিতাবরা বিশ্বাস স্থাপন করত এবং আল্লাহভীতি অবলম্বন করত, তবে আমরা তাদের মন্দ বিষয়সমূহ ক্ষমা করে দিতাম এবং তাদেরকে নে‘মতের উদ্যানসমূহে প্রবেশ করতাম’ (মায়েদাহ ৫/৬৫)।
৬. জান্নাত লাভের মাধ্যম : আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَبَشِّرِ الَّذِين آمَنُواْ وَعَمِلُواْ الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الأَنْهَارُ كُلَّمَا رُزِقُواْ مِنْهَا مِن ثَمَرَةٍ رِّزْقاً قَالُواْ هَـذَا الَّذِي رُزِقْنَا مِن قَبْلُ وَأُتُواْ بِهِ مُتَشَابِهاً وَلَهُمْ فِيهَا أَزْوَاجٌ مُّطَهَّرَةٌ وَهُمْ فِيهَا خَالِدُونَ
‘আর হে নবী! যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ সমূহ করেছে, তুমি তাদেরকে এমন জান্নাতের সুসংবাদ দাও, যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহমান থাকবে। যখনই তারা খাবার হিসাবে কোন ফল প্রাপ্ত হবে, তখনই তারা বলবে, এতো অবিকল সে ফলই যা আমরা ইতিপূর্বেও লাভ করেছিলাম। বস্ত্ততঃ তাদেরকে একই প্রকৃতির ফল প্রদান করা হবে এবং সেখানে তাদের জন্য শুদ্ধাচারিণী রমণীকুল থাকবে। আর সেখানে তারা অনন্তকাল অবস্থান করবে’ (বাক্বারাহ ২/২৫)।
শিরকের পরিচয় ও প্রকারভেদ
শিরকের আভিধানিক অর্থ- অংশ। الشِّرْكُ শব্দের মাছদার বা ক্রিয়ামূল হ’ল الاِشْرَاكُ (আল-ইশরাক) অর্থ: শরীক করা। পারিভাষিক অর্থ: আল্লাহর সত্তা অথবা গুণাবলীর সাথে অন্যকে শরীক করা। শিরকের সংজ্ঞায় আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন,الشرك هو أن يتخذ من دون الله نداً يحبه كما يحب الله ‘শিরক হ’ল আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ গ্রহণ করা এবং আল্লাহর মত তাকে ভালবাসা’।[1]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) শিরকের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন, أَنْ تَجْعَلَ لِلَّهِ نِدّاً وَهُوَ خَلَقَكَ ‘আল্লাহর জন্য অংশীদার সাব্যস্ত করা, অথচ তিনি (আল্লাহ) তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’।[2]
তাওহীদের বিপরীত হ’ল শিরক। শিরক ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ (নিসা ৪/৪৮, ১১৬)।
শিরক পাঁচ প্রকার। যথা- (১) জ্ঞানগত শিরক (২) ব্যবহারগত শিরক (৩) ইবাদতে শিরক (৪) অভ্যাসগত শিরক (৫) ভালবাসায় শিরক। এগুলি হ’ল বড় শিরক বা ‘শিরকে আকবার’। এতদ্ব্যতীত ‘শিরকে আছগার’ বা ছোট শিরক হ’ল ‘রিয়া’ বা লোক দেখানো দ্বীনদারী। যা বড় শিরকের এক দর্জা নীচে এবং সবচেয়ে বড় কবীরা গোনাহ।
(১) জ্ঞানগত শিরক : এর অর্থ হ’ল আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে অদৃশ্য জ্ঞানের অধিকারী মনে করা, বিপদ-আপদে অন্য কোন অদৃশ্য সত্তাকে আহবান করা, অন্যের নামে যিকর করা বা ধ্যান করা ইত্যাদি।
(২) ব্যবহারগত শিরক : এর অর্থ সৃষ্টির পরিকল্পনা ও সৃষ্টি জগতের পরিচালনায় অন্য কাউকে শরীক গণ্য করা। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকেই মুসলমানের রাজনীতি, অর্থনীতি, বিচারনীতি, শিক্ষানীতি, ধর্মীয় নীতি, সমাজনীতি সবকিছু পরিচালিত হবে। এটাই হ’ল তাওহীদের মূল কথা এবং এর বিপরীতটাই হ’ল শিরক।
(৩) ইবাদতে শিরক : এর অর্থ হ’ল ইবাদত বা উপাসনার ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করা। যেমন আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে সিজদা করা, অন্যের নামে যবহ করা, মানত করা, অন্যের নিকটে প্রার্থনা করা, অন্যকে ভয় করা, আকাঙ্ক্ষা করা, যে আনুগত্য ও সম্মান আল্লাহকে দিতে হয় সেই আনুগত্য ও সম্মান অন্যের প্রতি প্রদর্শন করা, কবরপূজা করা ইত্যাদি। পৃথিবীর সবচাইতে প্রাচীনতম শিরক হ’ল মূর্তিপূজা।
(৪) অভ্যাসগত শিরক : এর অর্থ হ’ল মানুষ অভ্যাস বশতঃ অনেক সময় শিরক করে থাকে। শিরকী কথা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করে, হালালকে হারাম করে, হারামকে হালাল করে ইত্যাদি। যেমন বিশ্বব্যাপী প্রচলিত রেওয়াজের দোহাই দিয়ে দেশে সূদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু রাখা, কারো সম্মানে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা, নিজেদের বানানো শহীদ মিনার, শিখা অনির্বাণ, শিখা চিরন্তন, স্মৃতিসৌধ, ভাষ্কর্য, টাঙ্গানো ছবি বা চিত্রে ইত্যাদিতে ফুলের মালা বা পুষ্পাঞ্জলী নিবেদন করা।
(৫) ভালবাসায় শিরক : এর অর্থ বান্দার ভালবাসাকে আল্লাহর ভালবাসার ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়া। অর্থাৎ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে বর্ণিত বিধানের ঊর্ধ্বে কোন মুজতাহিদ ইমাম, মুফতী, পীর-আউলিয়া বা শাসনকর্তার আদেশ-নিষেধ ও বিধান সমূহকে অধিক ভালোবাসা ও তদনুযায়ী আমল করা।
শিরকের ভয়বহতা ও পরিণতি
১. শিরক ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ :
আল্লাহ শিরকের গুনাহ ক্ষমা করবেন না। তিনি বলেন, إِنَّ اللهَ لاَ يَغْفِرُ أَنْ يُّشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُوْنَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللهِ فَقَدِ افْتَرَى إِثْمًا عَظِيْمًا. ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না। এ ব্যতীত অন্য সব, যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন। আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করল, বস্ত্ততঃ সে আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপ করল’ (নিসা ৪/৪৮)।
২. শিরক জাহান্নাম ওয়াজিব করে দেয় :
শিরক মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যাবে। আল্লাহ বলেন, إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِيْنَ مِنْ أَنْصَارٍ. ‘নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপন করে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার বাসস্থান হবে জাহান্নাম। অত্যাচারীদের কোন সাহায্যকারী নেই’ (মায়েদাহ ৫/৭২)।
ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ مَاتَ مِنْ أُمَّتِىْ لاَيُشْرِكُ بِاللهِ شَيْئًا دَخَلَ الْجَنَّةَ قُلْتُ وَإِنْ زَنَى وَإِنْ سَرَقَ قَالَ وَإِنْ زَنَى وَإِنْ سَرَقَ. ‘আমার উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক না করে মৃত্যুবরণ করে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (রাবী বলেন) আমি জিজ্ঞেস করলাম, যদি সে যেনা করে এবং চুরি করে থাকে তবুও? তিনি বললেন, যদিও সে যেনা করে এবং চুরি করে থাকে’।[3]
অন্য হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ لَقِىَ اللهَ لاَيُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ لَقِيَِهُ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا دَخَلَ النَّارَ. ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করে মৃত্যুবরণ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি তাঁর সাথে কাউকে শরীক করে মৃত্যুবরণ করবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে’।[4]
৩. শিরক পূর্বের আমল সমূহ বিনষ্ট করে দেয় :
আল্লাহ তা‘আলা বান্দার সৎ কাজগুলোকে বৃদ্ধি করে দেন। কিন্তু শিরক বান্দার ভাল আমলগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। আল্লাহ বলেন, وَلَوْ أَشْرَكُوْا لَحَبِطَ عَنْهُم مَّا كَانُواْ يَعْمَلُوْنَ. ‘যদি তারা শিরক করে তবে তাদের আমল সমূহ নষ্ট হয়ে যাবে’ (আন‘আম ৬/৮৮)। অন্য আয়াতে তিনি বলেন, وَلَقَدْ أُوْحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ. ‘তোমার প্রতি এবং তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছে যে, যদি তুমি আল্লাহর শরীক স্থির কর, তবে তোমার কর্ম নিষ্ফল হয়ে যাবে। আর তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (যুমার ৩৯/৬৫)।
৪. শিরক সবচেয়ে বড় গুনাহ :
বীরা তথা বড় গুনাহের একটি হ’ল শিরক। একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছাহাবীগণকে লক্ষ্য করে বললেন,أَلاَ أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الْكَبَائِرِ؟ قُلْنَا بَلَى يَارَسُوْلَ اللهِ. قَالَ اَلْإِشْرَاكُ بِاللهِ، وَعُقُوْقُ الْوَالِدَيْنِ. ‘আমি কি তোমাদেরকে সবচেয়ে বড় গুনাহ সম্পর্কে সংবাদ দিব না? আমরা বললাম, অবশ্যই হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা এবং পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া’।[5]
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
اِجْتَنِبُوا السَّبْعَ الْمُوْبِقَاتِ قَالُوْا يَارَسُوْلَ الله وَمَا هُنَّ؟ قَالَ الشِّرْكُ بِاللهِ، وَالسِّحْرُ وَقَتْلُ النَّفْسِ الَّتِىْ حَرَّمَ اللهُ إِلإَّ بِالْحَقِّ وَأَكْلُ الرِّبَا وَأَكْلُ مَالِ الْيَتِيْمِ وَالتَّوَلِّىْ يَوْمَ الزَّحْفِ وَقَذْفُ الْمُحْصَنَاَتِ الْغَافِلاَتِ وَالْمُمْنِاَتِ.
‘তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক জিনিস থেকে বেঁচে থেকো। ছাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ঐ ধ্বংসাত্মক জিনিসগুলো কি কি? তিনি জবাবে বললেন, আল্লাহর সাথে শরীক করা, যাদু করা, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা যা আল্লাহ হারাম করে দিয়েছেন, সূদ খাওয়া, ইয়াতীমের সম্পদ আত্মসাৎ করা, যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা, সরলা নির্দোষ সতী-সাধ্বী মুমিনা মহিলাকে অপবাদ দেওয়া’।[6] অন্য হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘সবচেয়ে বড় গুনাহ তিনটি (১) আল্লাহর সাথে শরীক করা (২) পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া এবং (৩) মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া’।[7]
৫. শিরক জঘন্যতম পাপ :
যেসব কাজ করলে আল্লাহর আনুগত্যের পরিবর্তে পাপ অর্জিত হয় শিরক তার অন্যতম। শিরককে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) জঘন্যতম পাপ বলে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘যে আল্লাহর সাথে শিরক করল সে জঘন্য পাপ করল’ (নিসা ৪/৪৮)।
আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, قُلْتُ يَارَسُوْلَ اللهِ أَىُّ الذَّنْبِ أَعْظَمُ عِنْدَ اللهِ؟ قَالَ: أَنْ تَجْعَلَ لِلّهِ نِدًّا وَهُوَ خَلَقَكَ. ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর নিকট জঘন্যতম পাপ কোন্টি? জবাবে তিনি বললেন, কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ বানানো (শরীক করা), অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’।[8]
অতএব খালেছ তাওহীদ বিশ্বাস ও শিরক থেকে বেঁচে থাকা ব্যতীত জান্নাত হাছিল করা সম্ভব নয়। সেকারণে আমাদেরকে আক্বীদার ক্ষেত্রে শিরক মুক্ত তাওহীদ পন্থী এবং আমলের ক্ষেত্রে বিদ‘আত মুক্ত সুন্নাতপন্থী হ’তে হবে। আল্লাহ আমাদের শিরক থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন- আমীন!
[1]. মাদারেজুস সালেকীন ১/৩৩৯; মাসিক আল-বায়ান, সংখ্যা ৬৯, নভেম্বর ১৯৯৭।
[2]. বুখারী হা/৪২০৭।
[3]. ছহীহ বুখারী হা/১২৩৭ ‘জানাযা’ অধ্যায়।
[4]. ছহীহ মুসলিম হা/২৬৬৩ ‘ঈমান’ অধ্যায়।
[5]. বুখারী, মুসলিম, রিযাযুছ ছালেহীন হা/১৫৫০।
[6]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫২; রিয়াযুছ ছালেহীন হা/১৬১৪।
[7]. বুখারী; রিয়াযুছ ছালেহীন হা/৫০।
[8]. বুখারী হা/৪২০৭।