মুসলিম জাতির ঐক্যের পথে প্রতিষ্ঠিত থাকার উপায়

মুসলিম জাতির ঐক্যের পথে প্রতিষ্ঠিত থাকার উপায়
আজ মুসলিম উম্মাহ শতধা বিভক্ত। এই বিভক্তির সুযোগে ইসলামের শত্রুরা মুসলমানদের ধ্বংস সাধনে অধিকতর তৎপর হয়ে উঠেছে। ফলে বিশ্বের দিকে দিকে আজ মুসলমানরা মার খাচ্ছে। পৃথিবীর আকাশ বাতাস মজলুমের আত্ম চিৎকারে অস্থির হয়ে উঠেছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তির প্রয়োজনে দরকার মুসলিম জাতির ইস্পাত কঠিন ঐক্য। যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে রসুল(সঃ)- এর কর্মপদ্ধতির পূর্ণ অনুসরণ ও অনুকরণের মাধ্যমে। কিন্তু বড়ই পরিতাপ ও লজ্জার বিষয়, মুসলিম সমাজে রসুল (সঃ)- এর কর্মপদ্ধতির পূর্ণ অনুসরণ ও অনুকরণের বড়ই অভাব। এ অভাবই মুসলিম অনৈক্যের মৌলিক কারণ। তাই আজ গোটা মুসলিম বিশ্বে দাউ দাউ করে জ্বলছে অশান্তির আগুন। গোটা মুসলিম উম্মাহ তার মৌলিক দায়িত্ব বিশ্ব মানবতাকে আল্লাহর পথে আহ্বান ও দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ পরিত্যাগ করে দ্বীনের কিছু কাজ আঞ্জাম দিয়ে রসুলের সুন্নতকে মেনে চলার দাবি করে আত্ম তৃপ্তি লাভ করছি, আর অপর দিকে রসুলের প্রতিষ্ঠিত জীবন ব্যবস্থা যা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ, তা ধ্বংসের যারা চক্রান্ত চালাচ্ছে তাদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে, বুকে বুক মিলিয়ে চলছি।

মুসলিম ঐক্যের বদলে এই বিভক্তির কারণ কী তা বুঝে নেয়ার সময় এসেছে। আমাদের এ কালে আমরা অধিকাংশ মুসলমানই বিক্ষিপ্ত ভাবে রসুল (সঃ)-এর অনুসরণের কিছু কিছু কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু রসুলের উপরে অর্পিত মূল দায়িত্ব দ্বীনকে বিজয়ী করার কাজ থেকে দূরে অবস্থান করছি। অথচ রসুলের প্রতি আগত কিতাবের প্রতিষ্ঠাই ছিল আমাদের মূল কাজ। এ কথাই ইরশাদ হচ্ছে পবিত্র কালাতুলাহতে-“বলে দিন : হে আহলে কিতাবগণ, তোমরা কোন পথেই নও, যে পর্যন্ত না তোমরা তাওরাত, ইঞ্জিল এবং যে গ্রন্থ তোমাদের উপরে তোমাদের পালন কর্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে তা সর্বোপরি প্রতিষ্ঠা না কর। (আল মায়েদা- ৬৮)
এই দায়িত্ব পালন করা ছিল মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ কাজ। কিন্তু আমরা আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য রসুলের সুন্নত অনুযায়ী অগ্রসর হতে আগ্রহী নই। যে কারণে আমরা পরস্পর পরস্পরের প্রতি মহব্বত ও দরদ অনুভব করি না। সাহাবায়ে কেরাম রসুলের সুন্নাত অনুযায়ী দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করে গেছেন, তাইতো তারা ছিলেন ‘রুহামাউ বাইনাহুম’ -একে অপরের প্রতি ছিলেন বন্ধু প্রতিম। কিন্তু আমরা সাহাবাগণের বৈশিষ্ট্যের কাছাকাছিও নেই। একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়ে বরং আমরা একে অপরকে হেয় করার জন্য ফতোয়াবাজিতে ব্যস্ত। এ জন্য অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে উপদলে বিভক্ত সংক্রান্ত ভবিষ্যৎ মূলক হাদিস- “ তোমাদের পূর্ববর্তী কিতাবধারীগণ বাহাত্তরটি দলে বিভক্ত ছিল আর উম্মতেরা তিয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে এবং একটি দল জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর সেই দলটি হলো জামায়াত। (ইবনে মাজাহ, সুনান, আবওয়াব আল ফিতান) যেখানে মুসলমানদের উচিত ছিল একে অপরের সাধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সুন্নাত প্রতিষ্ঠায় আত্ম নিয়োগ, সেখানে এই হাদিসকে ভিত্তি করে তারা একে অন্যকে ভ্রান্ত, ফাসেক এমনকি কাফের ফতোয়া দিয়ে বাহবা কুড়াচ্ছে।
আমরা একজন নাস্তিক বা ইসলামের কট্টর দুশমনকে ততটা দুশমন মনে করি না যতটুকু করছি অন্য এক মুসলমানকে, যিনি আমার দলের অনুসারী হয়ে ঠিক আমার মত জীবন যাপন করছে না। এই যে বিভেদ ও ফতোয়াবাজি, তার মূল কারণই হলো সুন্নতের সঠিক জ্ঞানের অভাব, আর জ্ঞান থাকলেও তার সঠিক বাস্তব প্রয়োগ না থাকা। এই জঘন্য ব্যাধি হতে মুক্তি পেতে সুন্নতের উপরে প্রতিষ্ঠিত আমাদের পূর্ববর্তী মহান ব্যক্তিদের ইতিহাস থেকে সবক গ্রহণ করা দরকার। আসুন, আমরা খোলা মন নিয়ে ইতিহাস ঘেটে সুন্নতের দাবিদারেরা তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এক দিলের অধিকারী হওয়ার প্রচেষ্টা চালাই।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই “পূর্বেকার বিশেষজ্ঞ আলেমগণ (সালাফ) থেকে পরবর্তী আলেমগণ (খালাফ) পর্যন্ত তাঁরা যাদের সম্মান ও মর্যাদার পাত্র মনে করতেন তাদের নিষ্পাপ মনে করা তাদের নীতি ছিল না এবং তাদের ইজতেহাদী বিষয়ের মধ্যে কোন জিনিসকে ভ্রান্ত ও ভুল মনে করেছেন তার বিরোধিতায় অবতীর্ণ হওয়া এবং তাঁদের অবদান অস্বীকার করার মনোবৃত্তি তাদের ছিল না। পক্ষান্তরে তাঁরা যে জিনিসকে ভুল মনে করেছেন তাকে যুক্তি প্রয়োগের সাহায্যে প্রত্যাখ্যান করেছেন, কিন্তু কারো ইজহেদী ভুলকে তাঁরা সংশ্লিষ্ট মুজতাহিদের মান-মর্যাদার জন্য কলঙ্কজনক মনে করেননি। তাঁরা ইজতেহাদী ভুলকে ভুলও বলতেন এবং তার সাথে মতভেদও পোষণ করতেন, কিন্তু মুজতাহিদের মান-মর্যাদার প্রতিও লক্ষ্য রাখতেন এবং ইজতেহাদী ভুলের কারণে তাঁর সমস্ত অবদান অস্বীকার করে বসতেন না। ” (রাসায়েল ও মাসায়েল-৩য় খণ্ড)
সলফে সালেহীনদের এ ব্যাপারে কেমন আচরণ ছিল, তা থেকে দু’একটি ঘটনা তুলে ধরা হলো।
বাদশাহ হারুণ-অর -রশীদ ছিলেন ইমাম মালেক (রঃ )-এর অনুসারী। ইমাম মালেকের মতে রক্ত প্রবাহিত হলে অজু ভঙ্গ হয় না। তাই একদিন রক্তের চাপ কমানোর জন্য দেহ থেকে রক্ত বের করেছিলেন কিন্তু পরে ওজু না করেই নামাজে ইমামতী করেন। ইমাম ইউসুফ রক্ত বের হলে ওজু ভঙ্গ হয় বলে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তিনি ইমাম মালেকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে তাঁর নিজস্ব ইজতেহাদ লব্ধ জ্ঞান পরিত্যাগ করেন। ইমাম আবু ইউসুফ (রঃ) বাদশাহর ভয় বা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার জন্য নয় বরং ইমাম মালেকের প্রতি শ্রদ্ধার জন্য নিজ ইজতেহাদী জ্ঞানকে ছেড়ে দিতে কুণ্ঠা বোধ করেননি।
আর একটি ঘটনা ইমাম শাফেয়ী (রঃ)-এর জীবনের। ইমাম শাফেয়ী (রঃ )-এর মতে ফজরের নামাজে দুয়া-ই- কুনুত পড়তে হয় এবং তিনি ও তাঁর মযহাবের অনুসারীরা বছরের সময় সময়ই এভাবে পড়ে থাকেন। কিন্তু ইমাম আবু হানিফা (রঃ)- এর ইন্তিকালের পরে তাঁর কবর জিয়ারতে আসেন ইমাম শাফেয়ী (রঃ)। তিনি ফজরের নামাজ ইমাম আবু হানিফা (রঃ)-এর কবরের পাশেই আদায় করেন। কিন্তু তিনি সে দিন তাঁর নিজস্ব মযহাব অনুযায়ী ফজরে দোয়া -ই- কুনুত পড়েননি। এ ব্যাপারে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, তাঁর (ইমাম আবু হানিফার) প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে তিনি তাঁর নিজস্ব অভিমত এ জায়গায় পরিত্যাগ করেছেন।
যদিও ইমাম শাফেয়ী (রঃ) ফজরে দোয়া ই-কুনুত পাঠ জরুরি তা হাদিস থেকে প্রমাণ পেশ করে থাকেন। কিন্তু হাদিস দ্বারা প্রমাণিত জরুরি আমলটি একজন মৃত ইমামের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার জন্য তাঁর কবরের পাশে এসে ছেড়ে দিলেন। আর এভাবেই একজন প্রথম শ্রেণির ইমাম তাঁর পরবর্তী অনুগামীদের জন্য সম্প্রীতি বজায় রাখার আদর্শ রেখে গেলেন।
একের প্রতি অপরের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার ইতিহাস এখানেই শেষ নয়। হজরত ইবরাহিম নখয়ী ও হজরত ইবরাহিম তায়িমী দুইজন ফকিহ ফেকহী মতামতের ব্যাপারে দুই ধরনের মত অবলম্বন করতেন। কিন্তু তাই বলে পরস্পরের প্রতি পরস্পরের শ্রদ্ধাবোধ ও আন্তরিতা মোটেও কম ছিল না। তখনকার গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসুফ একটি ব্যাপারে ইবরাহিম নখয়ী (রঃ)-এর উপরে ক্ষেপে গিয়ে তাকে বন্দী করার নির্দেশ প্রদান করেন। গভর্নরের লোকেরা হজরত ইবরাহিম তায়িমীকে ইবরাহিম নখয়ী মনে করে বন্দী করে জেলখানায় আবদ্ধ করে। তিনি বন্দী অবস্থায়ই জেল খানায় ইন্তিকাল করেন। কিন্তু ইবরাহিম তায়িমী কোন দিনই প্রকাশ করেননি যে তিনি ইবরাহিম নখয়ী নন বরং ভুল করে তাঁকে বন্দী করা হয়েছে। এক ফকীহর জন্য অপর ফকীহর জান কোরবানির পেছনে ছিল একের প্রতি অপরের গভীর ভালবাসা ও মমত্ববোধ। দুনিয়ার প্রচলিত রীতি নীতি ও শরয়ী বিধানের দিক দিয়ে হজরত ইবরাহিম তায়িমী নিজকে নির্দোষী হিসেবে মুক্ত করে নেয়ার জন্য পূর্ণ হকদার ছিলেন। কিন্তু এক ভাইয়ের প্রতি অন্য ভাইয়ের মহব্বত ও জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এই সুযোগ গ্রহণের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ইজতিহাদের বিভিন্নতা এক অন্যকে দূরে ঠেলে দিতে সক্ষম হয়নি, কারণ তাঁরা ছিলেন রসুল (সঃ)-এর সঠিক অনুসারী। তারা রসুলের সুন্নতকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার ও প্রতিষ্ঠিত রাখার অন্দোলনে তৎপর ছিলেন।
কিন্তু আজ মুসলমান সমাজের চিত্র বদলে গেছে। আমরা যেন দোকানদারী মনোভাব নিয়ে দ্বীনদারী করছি। লোকদের বলছি, আসুন ভাই, আমার দ্বীনি খেদমত তরিকাহই একমাত্র খাঁটি তরিকাহ। আমার উদ্ভাবিত পন্থাই তোমাকে জান্নাতের দরজায় পৌঁছে দেবে। এ যেন পাদরীদের বেহেশতের সার্টিফিকেট বিক্রি আর কি। ফলে জনসাধরণের আদালতে আমরা লা-জওয়াব হয়ে যাচ্ছি। তাদের প্রশ্ন আমরা কোন দলে ভিড়ব, কাদের তরিকাহ মানব? আপনারা তো সবাই ইসলামের কথা বলছেন? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছি না। বড়ই আফসুস! মানুষের আদালতে আমরা যখন লা- জওয়াব, তখন আল্লাহর আদালতে আমাদের অবস্থা কি দাঁড়াবে!
মুসলিম জাতির এমন চরম সংকটকালে প্রয়োজন পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও মমত্ব বোধ। কিন্তু তা পয়দা না হওয়ার পেছনে যে দু’টি বিষয় কাজ করে যাচ্ছে তা সম্পর্কে আমাদের সাব ধান হওয়া প্রয়োজন।
দু’টি বিষয়ের প্রথমটি হলো ইসলামবিরোধীদের চক্রান্ত। তারা চায় আমরা আত্মকলহে লিপ্ত থাকি। আর এ ভাবে কুফরীর দ্বার প্রান্তে পৌঁছে যাই। এরশাদ হচ্ছে, “আহলে কিতাবদের মধ্যে এমন বহুলোক রয়েছে যারা চায় যে, ঈমান আনার পর আবার তোমাদের কাফের বানিয়ে দেবে।”
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো প্রত্যেক দলই নিজের কাজকে উত্তম ও যথেষ্ট মনে করে উল্লসিত হয়ে ওঠে। ফলে মনে সৃষ্টি হয় জেদ। যার ফলে অন্য দলের যোগ্যতা, ইলম ও তাকওয়াকে তুচ্ছ করে দেখা ও মানুষের সামনে তুচ্ছ করে তুলে ধরবার প্রবণতা সৃষ্টি হয়ে থাকে। ইতিপূর্বে মুশরিকরা স্বভাব ধর্ম, সত্য ধর্ম ইসলামে বিভেদ সৃষ্টি করে আলাদা হয়ে গেছে। তারা সৃষ্টি করে নিয়েছে বিভিন্ন বর্ণ, ফলে জনগণও বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে গেছে। ইসলামপন্থীদের মাঝেও আজ সুন্নতের অনুসরণের নামে বিভিন্ন উপদল সৃষ্টি হয়ে মানুষকে বিভ্রান্তির গোলক ধাঁধায় ফেলেছে। প্রত্যেক উপদল নিজ নিজ পন্থা নিয়ে হর্ষোৎফুল। বিভেদ সৃষ্টিকারীদের বৈশিষ্ট্য এমনই হয়ে থাকে। যেমন ইরশাদ হচ্ছে- “যারা তাদের ধর্মে বিভেদ সৃষ্টি করেছে এবং অনেক দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। প্রত্যেক দল নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে উল্লসিত।”(রূম) শুধু কি উল্লসিত, পারস্পরিক জেদ ও বিদ্বেষের ফলে এক অপরকে ছেড়ে অনেক দূর চলে গেছে।
মুসলমানদের এই দলাদলি থেকে বাঁচবার উপায় কী? উপায় মাত্র একটি বলে আমার মনে হয়, তা হলো ইত্তেবায়ে রসুলের দাবি মোতাবেক দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিজেদের শরীক করা। যে দ্বীন আজ ভূলুণ্ঠিত হয়ে আছে তাকে বিভিন্ন দলের পথ অনুসারে খেদমত করতে থাকলে কখন সে দ্বীন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। বিরাট মহীরুহকে যেমন আগাছা লতা পাতা ঢেকে ফেলে তার অস্তিত্বকে ধীরে ধীরে নিশ্চি‎হ্ন করে তোলে, তেমনি বিভিন্ন উপদলের ভ্রান্ত মতবাদের বেড়াজাল ছিন্ন করে প্রকৃত দ্বীন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারলে এই শক্তিশালী দ্বীনও একদিন বেদ্বীন জাহেলিয়াতের চাপে পড়ে দৃষ্টির অগোচরে চলে যাবে। তাই ইত্তেবায়ে রসুল তথা রসুলের সুন্নতের প্রতিষ্ঠায় সবাইকে খোলামন নিয়ে ঐক্যবদ্ধ ভাবে অগ্রসর হতে হবে। আল্লাহর পক্ষ থেকে ইরশাদ হচ্ছে -“আর তোমরা যেন সেই সমাজের ন্যায় বিভ্রান্ত হয়ে না পড়। সুস্পষ্ট দলিলগুলি তাদের কাছে পৌঁছে যাওয়ার পরেও যারা ফেরকায় ফেরকায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং নিজেদের মধ্যে মতভেদ ঘটিয়েছে এদের জন্য অবধারিত আছে গুরুতর আজাব। ”
এই সব ফেরকাবাজি সমাজে অশান্তি ছড়াচ্ছে। সাধারণ মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ইসলাম থেকে। ইসলাম বিরোধী শক্তিরা এক্যবদ্ধভাবে এ সুযোগের ব্যবহার করছে। ইসলামবিরোধীদের চক্রান্ত নস্যাৎ করে ঐক্যবদ্ধ থেকে দ্বীন বিজয়ী করার (লিইউজ্হিরাহু) আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া দুনিয়ার শান্তি ও আখেরাতের মুক্তির মূল চাবিকাঠি।
ঐক্যবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ প্রদান করে ইরশাদ হচ্ছে “আর যারা কাফের তারা পারস্পরিক সহযোগী বন্ধু। তেমরা যদি এমন ব্যবস্থা না কর, তবে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বিস্তার লাভ করবে এবং দেশময় বড়ই অকল্যাণ হবে।” বিশ্বময় মুসলমানদের চরম বিপর্যয়ের কারণ আল্লাহর এই নির্দেশের অবমাননা। রসুলের ইত্তবার দাবিদারদের মাঝে যে রোগ বর্তমান তথা ইখতেলাফ ও ফরক তা নিরসনের পন্থা সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করতে গেলে ও তা কার্যকরী করতে গেলে আমরা দেখব যে এই রোগের কারণ যা কোরআনে বর্ণনা করা হয়েছে তা যুগ যুগান্তরে রূপ পাল্টিয়েছে।
প্রথম যুগের মতপার্থক্যের কারণসমূহ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী (রঃ) বলেছেন-
১. রসুলের হাদিস জানা থাকা বা না থাকার পার্খক্য।
২. রসুল (সঃ)-এর কাজের ধরন নির্ণয়ের পার্থক্য।
৩. ধারণাগত বিশেষণের পার্থক্য।
৪. হাদিস ভুলে যাবার কারণে মত পার্থক্য।
৫. রসুলুল্লাহ (সঃ)এর সঠিক উদ্দেশ্য আয়ত্ব করা বা না করার পার্থক্য।
৬. বিধানের কারণ নির্ণয়গত পার্থক্য। এবং
৭. সামঞ্জস্য বিধানগত পার্থক্য।
এসব কারণে মযহাবগত যে পার্থক্য হয়েছে তা দূষণীয় নয়। কেননা এসব ব্যাপারে সবার সামনে স্পষ্ট যে “আলমুজহতাহিদু ক্বাদ ইউখতি ওয়া ইউসিবু”- মুজতাহিদের ভুলও হতে পারে আবার সঠিক সিদ্ধান্তেও পৌঁছতে পারে। তাই পূর্ব যুগে পরস্পর পরস্পরের প্রতি দোজখের সনদ দিতে খোদাকে ভয় করতেন। কিন্তু বর্তমান যুগে যে মতপার্থক্য তার পেছনে শুধু ইলমী ও ইজতেহাদী পার্থক্য নয় বরং গোটা বিশ্বে মুসলিম খেলাফত শেষে আন্তর্জাতিকভাবে মুসলমানদের শিক্ষা ও রাজনীতি ও ক্ষেত্রে অমুসলিম সম্রাজ্যবাদী চক্র বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিয়েছে। শিক্ষা জগতে এমন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে যার ফলে আত্মগরিমায় তরুণদের মাথা ভরে যেত। আর তার ফলে তারা অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মাদরাসায় ধর্মীয় তিক্ত মতভেদের সৃষ্টি করতো। উদাহরণ স্বরূপ কলিকাতা আলিয়া মাদরাসার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। “সাত বৎসর ধরে ছাত্ররা কতগুলি কেতাব মূল ও ব্যাখ্যাসহ একেবারে মুখস্ত করে ফেলতো। কিন্তু তাদের সংকীর্ণ পাঠ্য পুস্তকের বাইরে যদি কোন এক খানা সহজ গ্রন্থও তারা পড়তে যায়,তা হলে তারা বিদ্যের সব পুঁজি হারিয়ে ফেলে। সহজেই অনুমেয় যে, এ ধরনের শিক্ষার ফলে তাদেরকে যা কিছু পড়ানো হয়নি, সে সম্বন্ধে তাদের অনুদার অবজ্ঞাই জাগ্রত হয়। আর তাদের শিক্ষার অসারতাই তাদেরকে আরো আত্মগর্বী করে তোলে। (ভারতীয় মুসলমান- উইলিয়াম হান্টার) অন্য দিকে “বহু কর্মঠ ছাত্র মাদরাসার এই অতি ক্ষুদ্র বিষয়গুলো পূরণ করে নিতে বাইরের খারেজী মাদরাসায় পড়াশুনা করে। বিন্তু এসব খারেজী পড়ার বিষয় ছিল প্রধানত হাদিস ও মধ্য যুগীয় ধর্মান্ধ রকমের শরীয়তী আইন - এসব পড়েই তরুণদের মাথা আত্মগরিমায় ভরে যেত। এভাবেই আমরা শেষ পর্যন্ত মুসলমান তরুণদের আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী শিক্ষিত করে তুলতে সক্ষম হবো। তাদের ধর্মে এতটুকু হস্তক্ষেপ না করে এবং তাদেরকে ধর্মীয় কর্তব্যগুলো শিক্ষা দেয়ার অছিলায়। আমরা হয়তো তাদেরকে ধর্মনিষ্ঠ করতে এবং নিশ্চিতভাবে কম ধর্মান্ধ করে তুলতে পারবো। নয়া পুরুষের মুসলমানরা তখন হিন্দুর মতো নতুন পথে চলতে শিখবে এবং তাদের মতো উদারনৈতিক হয়ে ঊঠবে। অথচ এই হিন্দুরাই মাত্র কিছুদিন আগেও ছিল দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে গোঁড়া জাতি। এই উদার নীতির ফলে তারা বাপ দাদার চেয়ে ধর্মে কম আস্থাবান হচ্ছে।”(ভারতীয় মুসলমান- উইলিয়াম হান্টার)
সাম্রাজ্যবাদীরা শিক্ষার ক্ষেত্রে তখন বিভিন্ন অনুদার ফির্কা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। তেমনি রাজনৈতিক জগতেও আলেমদের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দলে বিভক্ত করতে সক্ষম হলো। এক সময় গ্রুপিং হলো দারুল হরব ও দারুল ইসলাম নিয়ে।
ভারতের মুসলমান আবার উপদলে বিভক্ত হলো ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে। এভাবে ইসলামের শত্রুরা ইত্তেবায়ে রসুলের অনুসারীদের মাঝে ইত্তেবা বিরোধী আমল ‘অনৈক্য’ ঘটাতে সক্ষম হলো। আজ তাই আলেম সমাজ অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগছে। এ বিরোধ ও ফতোয়াবাজি রোগ থেকে মুক্তি পেতে হলে তিনটি কাজ মৌলিকভাবে করা দরকার।
এক- আল্লাহ ভীতি অর্থাৎ এমন কাজ করা উচিত হবে না যাতে আল্লাহ নাখোশ হন এ অনুভূতি অন্তরে সদা জারী রাখা।
দুই- আখেরাতের কাঠ গোড়ায় জওয়াব দিহির অনুভূতি অর্থাৎ যারা ফতোয়াবাজি করছি ও যাদের বিরুদ্ধে করছি উভয় দলকে বিচারের কাঠগোড়ায় দাঁড়াতে হবে এবং এই কোন্দল ও ফের্কাবাজির জন্য কৈফিয়ত দিতে হবে, সেদিন কৈফিয়ত দিতে পারবো তো, এ চিন্তা মনে সদা জাগরুক রাখা।
তিন- ব্যক্তি পূজার প্রবণতা ত্যাগ, অর্থাৎ যত বড় প্রভাবশালী আলেম হোক না কেন তাকে অন্ধভাবে অনুসরণ না করার অনুভূতি মনে পয়দা করা।
এই তিনটি মৌলিক কাজে অভ্যস্ত হলে আজ যে ফেরকাবাজি রোগে মুসলিম সমাজ শেষ হয়ে যাচ্ছে তা থেকে মুক্তি পেয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ মজবুত বিজয়ী শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে সক্ষম হবে।
“ঐক্যের ভিত্তি রচনা করতে হলে দ্বীনের সব খাদেমকে দু’টি নীতি মেনে নিতে হবে।
এক- যে যতটুকু পারেন বা বুঝেন দ্বীনের খেদমত করে যাবেন। কিন্তু কোন দ্বীনি জামায়তের বা কাজের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বা গোপনে প্রচার করবেন না। যদি কখন কোন জামায়াত বা খেদমত সম্পর্কে আলোচনার প্রয়োজন হয় তা হলে শ্রোতার মনে বিরূপ ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা না করে দরদী মন নিয়ে কথা বলবেন। তাদের কোন ত্রুটি বা কমতি আছে মনে করলে সংশোধনের নিয়তে পরামর্শ দিতে পারেন।
দুই- দ্বীনের যত রকম খেদমত হচ্ছে তাকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে এক অপরের সহায়ক ও পরিপূরক সে কথা বুঝবার চেষ্টা করা উচিত। অপরের সম্পর্কে সরাসরি ভাবে না জেনেই বিরোধী কোন কথা শুনে বিরূপ ধারণা করা ঠিক নয়। যারা যে ধরনের খেদমতে নিয়োজিত সেটাকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে করাই স্বাভাবিক। এ গুরুত্ব বোধ ব্যতীত নিষ্ঠার সাথে কাজ করা অসম্ভব। কিন্তু অন্যান্য খেদমতকে তুচ্ছ জ্ঞান করা অন্যায়। কার খেদমত কত বড় তা একমাত্র আল্লাহ পাকই বিবেচনা করবেন। (ইসলামী ঐক্য ও ইসলামী আন্দোলন- অধ্যাপক গোলাম আযম)
আমরা জানি যে, প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের কোন উপদল হোক তারা খারেজী বা মুতাজেলাহ, কোন সময়ই সুন্নতের বৈধতা অস্বীকার করেননি। কিন্তু আজ সামগ্রিক ভাবে সুন্নাহকে বর্জনের পক্ষপাতী একটি প্রবল ভাবধারা প্রগতিবাদ নামে অভিহিত হয়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। তাই মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সব চেয়ে বেশি প্রয়োজন কোরআন ও সুন্নাহকে মজবুত ভাবে আঁড়িয়ে ধরা। মতানৈক্য দূর করার জন্য ইমাম ইউসুফ (রঃ) -এর একটি অভিমতের প্রতি খেয়াল রাখলে আমরা সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে পারি। তাঁর অভিমত “জনসাধারণ সবসময়ই এই জিনিস করে এসেছে ”- এ কথার উপর নির্ভর করে কোন কিছু ন্যায় বা অন্যায় বলে রায় দেয়া চলে না। কেননা যেটা করা অন্যায় এবং অনুচিত, অধিকাংশ সময়েই জনসাধারণ সেটাই করে এসেছে। রায়ের ভিত্তি হতে হবে রসুলের অথবা প্রাথমিক যুগের মুসলিমদের সালফ অর্থাৎ সাহাবায়ে রসুল আইনজ্ঞ সুধী বৃন্দের সুন্নাহ।” (আলরদ আলা সীয়ার আল আওজাই)
ইমাম ইউসুফ (রঃ)-এর কথাই আজ সমস্ত মুসলিম জগৎ যদি মেনে নেয় তবে তাদের মাঝের অনৈক্য দূর হয়ে যাবে, প্রতিষ্ঠিত হবে পরস্পর পরস্পরের বন্ধুত্ব। আর পরস্পরের বন্ধুত্বই সারা বিশ্বের মুসলমানের কাম্য। সাহাবাদের কাজ ছিল,‘ইকামতে দ্বীন’। আজ সারা বিশ্বের মুসলমান যদি এই কাজটিকে মূল কাজ হিসেবে বেছে নিয়ে আল্লাহর জমিনে ছড়িয়ে পড়ে তবে খেদমতে দ্বীনের নামে যে অনৈক্য সৃষ্টি হয়েছে তা ধীরে ধীরে দূর হয়ে যাবে। আজ যারা দ্বীনের ইকামতে ও খেদমতে লিপ্ত আছেন তাঁরা যদি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের (রাঃ) নিম্ন বর্ণিত বাণীর প্রতি খেয়াল করে তা পালনে সচেষ্ট হন তবে সহজে অনৈক্যের জাল ছিন্ন হয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে মহব্বতের সুদৃঢ় সীসা ঢালা প্রাচীর।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বর্ণনা করেন, “যদি কেউ কারও অনুকরণ করতে চায় তা হলে যারা মরে গেছেন তাঁদের অনুকরণ করা উচিত। কারণ মানুষ যত সময় বেঁচে থাকে তত সময় ফেতনায় পড়ার ও দ্বীনে হক থেকে তার বিচ্যুত হবার আশংকা থাকে।
যাদের অনুকরণ করতে হবে তারা হলেন আসহাবে রসুল (সঃ), তাঁরা ছিলেন উম্মতের সর্বোত্তম ব্যক্তি। তাদের অন্তর ছিল তাকওয়া পূর্ণ, দ্বীনের ব্যাপারে ছিল তাদের গভীর জ্ঞান। তাঁরা লৌকিকতা ও আনুষ্ঠানিকতা থেকে দূরে অবস্থান করতেন। আল্লাহ তাঁদেরকে রসুলের সাহায্য করার জন্য এবং দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার জন্য বেছে নিয়ে ছিলেন। অতএব হে মুসলমানগণ! তোমরা তাঁদের মর্যাদা চিনে নাও, তাঁদের অনুসরণ কর এবং যথাসাধ্য তাঁদের নীতি নৈতিকতা ও চরিত্রকে দৃঢ়ভাবে অবলম্বন কর ,কারণ তারা ছিলেন সোজা রাস্তায় - ছিলেন আল্লাহর নির্দেশিত সরল পথে। (মেশকাত)”
বর্তমান সময়ে দর্শনের নামে, তাসাউফ ও তাজকিয়ার নামে যে বিভিন্ন চিন্তা ধারা সৃষ্টি হয়েছে সে গুলিকে তাদের স্থানে রেখে দিয়েই যদি ইকামতে দ্বীনের আন্দোলনে (যা আজ বর্তমান বিশ্বের জন্য সব চেয়ে অধিক প্রয়োজন) নিজেদের নিয়োজিত করা যায় তবেই পরস্পর পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, বিশ্বস্ততা ও নির্ভর যোগ্যতা বেড়ে যাবে।
আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে সঠিক পথে চলার সাহায্য করুন। আসুন আমরা আলমা ইকবালের একটি কথার দিকে নজর দেই, “ইউতো সায়্যিদ ভি হো, মীর্জা ভী হো, বাতাও তোম মুসলিম ভি হো।”