সালাফ সালিহীনের কর্মরীতি ত্যাগ করা সমাজে বিভক্তির অন্যতম করণ !

সালাফ সালিহীনের কর্মরীতি ত্যাগ করা 
সমাজে বিভক্তির অন্যতম করণ !
ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহঃ
 সম্পাদনাঃ মুহাম্মদ হামিদুল ইসলাম আজাদ


সালাফ সালিহীনের কর্মধারা থেকে বিচ্যুতিই সকল প্রান্তিকতা, বিভক্তি ও বিচ্ছিন্নতার কারণ। মহান আল্লাহ কুরআন কারীমে সাহাবীগণকে, বিশেষত প্রথম অগ্রগামী মুহাজির ও আনসারগণকে পরবর্তী সকল মুমিনের অনুকরণীয় আদর্শ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাঃ তাঁর সাহাবীগণ এবং পরবর্তী দুই বা তিন প্রজন্মের মানুষদের কল্যাণময়তার সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাঁদের কর্মধারায় আমরা দেখি যে, তাঁরা ঈমান-আকীদা বিষষে মতভেদ করেন নি এবং এ বিষয়ে মতভেদ প্রশ্রয় দেন নি। আকীদাগত বিভ্রান্তিতে লিপ্ত ব্যক্তিদের বিভ্রান্তির কঠোর প্রতিবাদের পাশাপাশি তাদেরকে ‘কাফির’ বলা থেকে যথাসম্ভব বিরত থেকেছেন। যুদ্ধের ময়দানে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও সাধারণ অবস্থায় তাদের সাথে ধর্মীয়, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক ও সম্প্রীতি বজায় রেখেছেন।

ফিকহী মাসআলায় তারা ব্যাপক মতভেদ করেছেন এবং মতভেদকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। মতভেদসহ একে অপরকে গভীরভাবে ভালবেসেছেন। সালাতের মধ্যে হস্তদ্বয় ধরে রাখা বা ঝুলিয়ে রাখা, আমীন জোরে বা আস্তে বলা, রাফউল ইয়াদাইন করা বা না-করা ইত্যাদি মুসতাহাব মাসআলাতেই শুধু নয়, ফরয-ওয়াজিব মাসআলাতেও তাঁরা নিজের মতে স্থিরতাসহ ভিন্নমতের প্রতি উদার ছিলেন। হানাফী ও হাম্বালী মাযহাবে দেহ থেকে রক্ত বের হলে বা রক্তমোক্ষণ করালে ওযূ বিনষ্ট হয়। সালাত আদায়ের পূর্বে উক্ত ব্যক্তির জন্য ওযূ করা ফরয। পক্ষাÍেরে ইমাম মালিকের মতে এতে ওযূ ভঙ্গ হয় না। প্রত্যেকে নিজের মতের পক্ষে দলিল পেশ করেছেন। কিন্তু ইমাম মুহাম্মাদ, আবূ ইউসূফ ও অন্যান্য হানাফী ফকীহ মদীনায় গেলে মালিকী ইমামদের পিছনে সালাত আদায় করেছেন। তারা রক্তপাত বা রক্তমোক্ষণের পর ওযূ করেছেন কিনা তা জানতে চেষ্টা করেন নি। এমনকি ওযূ করেন নি জানলেও সালাত আদায় করেছেন। এ প্রসঙ্গে শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবী বলেন: “সাহাবীগণ, তাবিয়ীগণ ও পরবর্তীগণ কেউ সালাতের মধ্যে ‘বিসমিল্লাহ’ পড়তেন, কেউ পড়তেন না, কেউ তা জোরে পড়তেন, কেউ তা আস্তে পড়তেন, কেউ ফজরের সালাতে কুনূত পড়তেন, কেউ পড়তেন না, কেউ রক্তমোক্ষণ, নাক দিয়ে রক্তপাত
ও বমি হলে ওযূ করতেন, কেউ এগুলোর কারণে ওযূ করতেন না, কেউ গুপ্তাঙ্গ স্পর্শ্ব করলে ওযূ করতেন, কেউ করতেন না, কেউ উত্তেজনাসহ স্ত্রীকে স্পর্শ করলে ওযূ করতেন, কেউ করতেন না, কেউ রান্না করা কিছু ভক্ষণ করলে ওযূ করতেন, কেউ করতেন না, কেউ উটের গোশত ভক্ষণ করলে ওযূ করতেন, কেউ করতেন না। এরূপ ভিন্নমতসহই তারা একে অপরের পিছে সালাত আদায় করতেন। যেমন আবূ হানীফা, তাঁর ছাত্রগণ, শাফিয়ী ও অন্যান্যরা মদীনার মালিকী ইমামগণ ও অন্যদের পিছনে সালাত আদায় করতেন, যদিও মদীনার ইমামগণ সালাতের মধ্যে জোরে বা আস্তে কোনোভাবেই ‘বিসমিল্লাহ’ পড়তেন না। ইমাম মালিক খলিফা হারূন রশীদকে বলেছিলেন যে, রক্তমোক্ষণ বা রক্তপাতের কারণে ওযূ ভঙ্গ হয় না। এজন্য তিনি রক্তমোক্ষণ করার পরে ওযূ না করেই ইমাম হয়ে সালাত আদায় করেন। ইমাম আবূ ইউসূফ তাঁর পিছনে মুক্তাদী হয়ে সালাত আদায় করেন এবং তিনি এ সালাত পুনরায় পড়েন নি। ইমাম আহমাদের মতে নাক দিয়ে রক্ত বের হলে বা রক্তমোক্ষণ করলে ওযূ করা ফরয। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, যদি কোনো ইমামের দেহ থেকে রক্তক্ষরণ হয় কিন্তু তিনি ওযূ না করে সালাত আদায় করেন তবে আপনি কি তার পিছনে সালাত আদায় করবেন? তিনি উত্তরে বলেন: ইমাম মালিক অথবা সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়িব যদি ইমাম হন তবে আমি কিভাবে তাঁর পিছনে সালাত আদায় না করে থাকতে পারি? বায্যাযিয়া গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইমাম আবূ ইউসুফ একবার গোসলখানায় গোসল করে জুমুআর সালাতের ইমামতি করেন। জামাতের পরে মুসল্লীগণ চলে যাওয়ার পর তাঁকে সংবাদ দেওয়া হয় যে, গোসলখানার কূপের মধ্যে একটি মৃত ইঁদুর বিদ্যমান। তখন তিনি বলেন, তাহলে আমরা মদীনাবাসীদের মাযহাব গ্রহণ করলাম, কারণ তাদের মতে পানির পরিমাণ যদি দুই কোলা হয় তবে তার মধ্যে নাপাকি পড়লেও তা নাপাক হয় না।” শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলবী, আল-ইনসাফ, পৃষ্ঠা ১০৯।

উৎসঃ সালাতের মধ্যে হাত বাঁধার বিধান ।
ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহঃ