লিচেনস্টিন
মুহাম্মাদ ইউছুফ
মুহাম্মাদ ইউছুফ
নামঃ প্রিন্সিপালিটি অব লিচেনস্টিন। রাজধানী ভাডুজ। ইউরোপের চতুর্থ ক্ষুদ্রতম লিচেনস্টিন। এর আশপাশের অন্য ইউরোপীয় দেশগুলো হলো জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি ও চেক প্রজাতন্ত্র।
লিচেনস্টিনের চেয়ে ছোট ইউরোপের অন্য দেশগুলো হলো যথাক্রমে খ্রিষ্টানদের পবিত্র ভূমি ভ্যাটিকান সিটি, মোনাকো ও স্যানমেরিনো। লিচেনস্টিনের চেয়ে ছোট বিশ্বের অন্য দুটো দেশ হলো নাউরু ও ট্যুভালু। এগুলো ওশেনিয়া অঞ্চলে অবস্থিত।
আয়তন ও জনসংখ্যাঃ লিচেনস্টিন-এর আয়তন ১৬০ বর্গকিলোমিটার আর জনসংখ্যা ৩৭ হাজারের মত। গড় আয়ু ৮১.৬৮। দেশটির শতভাগ লোকই শিক্ষিত।
ভাষাঃ প্রধান ভাষা জার্মান। প্রায় ৯৬% লোক এই ভাষায় কথা বলে। জার্মান ভাষা হল লিচেনস্টিন-এর অফিসিয়াল ভাষা। এছাড়া ইতালী এবং অন্যান্য ভাষায় ৪% লোক কথা বলে।
ধর্মঃ প্রধান ধর্ম রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টান। প্রোটেস্টান্ট ৬.৫%, মুসিলম ৫.৪%, লুথেরান ১.৩%, অন্যান্য ২.৯%, ধর্মে বিশ্বাসী নয় ৫.৪%।
ইতিহাসঃ
ক্ষুদ্র এ দেশটির সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। গির্জাকেন্দ্রিক ইউরোপীয় শাসনব্যবস্থা নানা সময়ে এর ওপর প্রভাব রেখেছে। বর্তমান রাজধানী ভাডুজের নামেই মধ্যযুগে একটি কাউন্টি ছিল। ভোরারলবার্গের মন্টফোর্টে রাজবংশের অধীনে ছিল সেটি। পনের শতকে পরপর তিনটি যুদ্ধে একেবারে বিধ্বস্ত হয় ছোট এলাকাটি। ১৭ শতকে নানা অসুখ-বিসুখ আর মহামারীর ঝড় বয়ে যায় লিচেনবাসীর ওপর দিয়ে। এর পরবর্তী কিছু সময় বিবাদ-বিসম্বাদ আর প্রতিশোধ-পাল্টা প্রতিশোধে ক্ষতবিক্ষত হয় সমাজ। অস্ট্রিয়ার নিম্নাঞ্চলে লিচেনস্টিন নামক গির্জা থেকেই ১১৪০ সালে ছোট অঞ্চলটির এই নামকরণ করা হয়। পরবর্তী কয়েক শতকে পার্শ্ববর্তী মোরাভিয়া, স্টাইরিয়া ও অস্ট্রিয়ার নিম্নাঞ্চল থেকে বড় ধরনের ভূমি একীভূত করে নেয় তারা। এরপরও জার্মানির রাইকস্টাগে একটি আসনের মর্যাদা পায়নি লিচেনস্টিন। কিন্তু তৎকালীন লিচেনস্টিনের শাসকবর্গ জার্মান ক্ষমতাসীনদের কাছে রাজপুত্রের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়।
১৬৯৯ সালে প্রিন্স জন এডাম পার্শ্ববর্তী সেলেনবার্গ কিনে নেন। এবার জার্মান শাসকরা প্রিন্সকে লর্ডশিপ প্রদান করে। রাজা ষষ্ঠ কার্ল ২৩ জানুয়ারি ১৭১৯ সালে ভাডুজ ও সেলেনবার্গকে লিচেনস্টিন নামে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয়। তবে ১৮০৬ সালের আগে দেশটি পরিপূর্ণ স্বাধীনতা পায়নি। এ সময় দেশটি নেপোলিয়ানের কনফেডারেশনে যোগ দেয়। ১৮১৫ সালে এটি নতুন করে জার্মান কনফেডারেশনের সাথে যুক্ত হয়। নতুন সংবিধান অনুসারে তারা জার্মান সংসদে একটি আসনও পায়। ১৮৬৮ সালে জার্মান কনফেডারেশন বিলুপ্ত হয়। মাত্র ৮০ সদস্যের যে সামরিক বাহিনী ছিল এ সময় তার অবসান করা হয়। আর্থিক অসঙ্গতির কারণে তারা অতিুক্ষুদ্র এই সেনাবাহিনী বিলুপ্ত করে।
এরপর দেশটি স্থায়ী নিরপেক্ষতার নীতিতে অটল থাকার ঘোষণা দেয়। পরবর্তী দু’টি বিশ্বযুদ্ধেও তারা এ নীতি কঠোরভাবে অনুসরণ করে।
তাই বিবদমান ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে বাফারস্টেট হিসেবে কাজ করেছে লিচেনস্টিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধ আক্রান্ত এলাকা থেকে অনেকে সম্পত্তি সরিয়ে রেখেছেন দেশটিতে। এসব সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মাঝে নানা বিবাদ-বিসম্বাদও হয়েছে অনেকে। এক সময় পার্শ্ববর্তী চেকশ্লোভাকিয়ায় যেকোনো লিচেনবাসীর প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই দেশটির অর্থনীতি নাজুক হয়ে পড়ে। জাতীয় আর্কাইভে রক্ষিত লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির অমূল্য শিল্পকর্ম বিক্রি করেও তারা টিকে থাকার চেষ্টা করে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল গ্যালারি অব আর্ট চড়া মূল্যে এই শিল্পকর্ম কিনে নেয়।
ছোট্ট দেশটির জনপদ এখন অনেক সমৃদ্ধ। দেশটির রাজা বিশ্বের ষষ্ঠ ধনী শাসক। তার সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় চার শ’ কোটি ডলার। আয়তন আর জনসংখ্যায় ক্ষুদ্র হওয়ায় দেশটি সম্পূণরূপে স্বাধীন থাকতে পারেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত লিচেনস্টিন অস্ট্রিয়ার সাথে যুথবদ্ধ ছিল। পরপর দু’টো বিশ্বযুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণ না থাকলেও দেশটি সে সময়কার ইউরোপীয় অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়ে। একটা সময় তারা অন্য প্রতিবেশী দেশ সুইজারল্যান্ডের দিকে মুখ ঘুরাতে বাধ্য হয়। কাস্টম ও মনিটারি ইউনিয়ন গঠন করা হয় তাদের সাথে। আরও একটি অভিনব চুক্তি হয় দেশটির সাথে। এর ফলে যেসব দেশে সুইস দূতাবাস আছে সেখানে রাষ্ট্রদূতরা লিচেনস্টিনেরও প্রতিনিধিত্ব করে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিলতার সুযোগে নানান অনিয়ম হচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠে। রাশিয়া, ইতালি ও কলম্বিয়ার মাফিয়া ডনরা অর্থ পাচার কাজে লিচেনস্টিনের মাটি ব্যবহার করছে বলে দেশটির ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ সৃষ্টি হলে তারা কিছু সংশোধনীমূলক পদক্ষেপ নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দেশটি নিরপেক্ষ অবস্থান নিলেও পরে একটি কমিশন তাদের সাথে নাৎসিদের লেনদেনের অভিযোগ তোলে। এ নিয়ে ইউরোপীয় প্রতিবেশী দেশগুলোর পক্ষ থেকে তাদের ওপর দোষারোপের যে বিপদ তা কাটিয়ে উঠতে দেশটির শাসকরা বেশ দক্ষতার পরিচয় দেয়।
ছোট ছোট কয়েকটি জনপদ নিয়ে সৃষ্ট লিচেনস্টিন মূলত রাজারাই শাসন করছেন। গঠনের পর থেকে রাজ পরিবারের শাসন ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। রাজপরিবারের ক্ষমতা নিয়ে বিভিন্ন সময় টানাপড়েনের সৃষ্টি হয়। বার বার জনগণ রাজপরিবারের প্রতি তাদের পূর্ণ আস্থা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করে। সর্বশেষ ২০০৩ সালে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। প্রিন্স হ্যান্স-এডাম রীতিমতো জনগণকে হুমকি দেন এই বলে যে, তার বিশেষ কিছু ক্ষমতা বৃদ্ধি না করলে তিনি দেশ ছেড়ে চলে যাবেন। জনগণ গণভোটে তার প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন ব্যক্ত করেন।
এর মাধ্যমে জনগণ স্পষ্ট জানিয়ে দেয় রাজার প্রতি তাদের পূর্ণ শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার কথা। কী পরিমাণ ক্ষমতা রাজা ভোগ করবেন সে প্রশ্নে গণভোট হয়। দেশের শাসন ক্ষমতার ওপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ রাজার হাতে যাক সে জন্য ৬৪ শতাংশ ভোটার পক্ষে রায় দেয়। এর মাধ্যমে ইউরোপে একটি নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেল। বর্তমান রাজা প্রিন্স হ্যান্স এডাম একজন সফল ব্যাংকার। ১৯৮৯ সালে পিতা প্রিন্স ফ্রান্স জোসেফের মৃত্যুর পর তিনি রাজমুকুট মাথায় নেন। এদিকে ২০০৪ সালে এসে রাজা এডাম পুত্র এলিউসকে নির্বাহী ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। নির্বাহী ক্ষমতা নেয়ার সময় রাজপুত্র এলিউসের বয়স ছিল ৩৬ বছর। তিনি ব্রিটেনের স্যান্ডহার্স্ট মিলিটারি একাডেমি থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। রাজা এডামের চার সন্তানের মধ্যে তিনিই বড়। লিচেনস্টিনের বর্তমান সংবিধান প্রণয়ন করা হয় ১৯২১ সালে।
রাজতন্ত্রের ভিত্তিকে এর মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হয়। নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সংসদ গঠিত হওয়ার বিধান রয়েছে। নির্ধারিত সময়ে জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচন হয় তবে এর ওপর রাজার নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব রয়েছে। রাজা গণভোটের ডাক দিতে পারেন। নতুন আইন প্রস্তাব করতে পারেন। সংসদ বিলুপ্ত করতে পারেন। সরকারপ্রধান প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য চারজন মন্ত্রীর নিয়োগ দিয়ে থাকেন। দেশের এককক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের সদস্যসংখ্যা হচ্ছে ২৫ জন। সংসদে একটি আসন পেতে হলে যেকোনো দলকে কমপক্ষে ৮ শতাংশ ভোট পেতে হয়।
সরকারের ওপর রোমান ক্যাথলিক চার্চের শক্ত প্রভাব রয়েছে। কয়েক বছর আগে গর্ভপাতের কারণে বছরখানেক জেল খাটতে হয়েছে এক মহিলাকে। এ বিষয়ে শিথিল আইন পাসের পর ওই মহিলা ছাড়া পায়। ছোট দেশটি ১১ মিউনিসিপালটিতে বিভক্ত। এগুলো আসলে খুব ছোট ছোট শহর। মোটাদাগে দেশটি দু’ভাগে বিভক্ত। স্থানীয় ভাষায় একটি এলাকার নাম ওবারল্যান্ড অন্যটির নাম অন্টারল্যান্ড।
আলপস পর্বতমালার রাইন উপত্যকার ঢালু ভূমিতে দেশটি অবস্থিত। পশ্চিম সীমান্তের পুরোটাজুড়েই নদী। পূর্বে উঁচু পর্বতামালা। উত্তর থেকে প্রবাহিত বাতাস দেশটির আবহাওয়াকে সমভাবাপন্ন করেছে। শীতকালে দেশটি একটি স্পোর্টস গ্রাউন্ডে পরিণত হয়। ইউরোপ থেকে হাজার হাজার পর্যটক ভিড় জমায় এ সময়।
অর্থনীতি:
মাত্র ৬২ বর্গমাইলের এ দেশটির অর্থনৈতিক সামর্থ্য বিস্মিত হওয়ার মতো। বার্ষিক জাতীয় উৎপাদন প্রায় দুই শত কোটি ডলার। ৩৭ হাজার জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশটির মাথাপিছু জাতীয় উৎপাদন ৫৪ হাজার মার্কিন ডলারের বেশি। মুদ্রা : সুইস ফ্রাঙ্ক।
ছোট্ট এ দেশের বিস্ময়কর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পেছনে কাজ করছে তাদের ব্যতিক্রমী ট্যাক্স সিস্টেম। দেশটি ইউরোপের ট্যাক্স হেভেন বা করস্বর্গ নামেও পরিচিত। এর ফলে পৃথিবীর অসংখ্য কোম্পানি দেশটিতে তাদের অফিস নিয়েছে। আরো বিস্মিত হওয়ার জোগাড় হবে এ দেশে রেজিস্ট্রিকৃত কোম্পানীর কথা শুনলে। লিচেনস্টিনে নথিভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা দেশটির জনসংখ্যার দ্বিগুণের মত। প্রায় ৭৫ হাজার কোম্পানির লেটারবক্স রয়েছে এখানে। তাই জনগণের জীবনমান অনেক উঁচুতে।
প্রধান কৃষিজ : গম, বার্লি, শস্য, গোল আলু, ডেইরী প্রোডাক্টস ইত্যাদি।
প্রধান শিল্প : ইলেক্ট্রনিকস, ধাতবজাত পদার্থ উৎপাদন, ডেন্টাল প্রোডাক্টস, সিরামিক, ঔষধশিল্প, খাদ্য উৎপাদন, পর্যটন ইত্যাদি।
তথ্যসূত্রঃ
1. http://www.infoplease.com/country/ liechtenstein.html
2. http://www.onnodiganta.com